|| হাট দরজা ||
পুরীতে বেড়াতে গিয়ে ভাগ্যচক্রে দেখা হয়ে গেল সোনালী আর প্রতিমার সাথে | ওরাও বেড়াতে এসেছে আমাদের মত, স্বামী-স্ত্রী | সবাই একই হোটেলে উঠেছি – পুরীর বি.এন.আর | সবারই এক সন্তান, বিদেশে থাকে | অবসর জীবনে ফি বছর পুরী দর্শন |
সোনালী আমার ছোটবেলার নার্স-ডাক্তার খেলার সাথী | আমার মাকে বলত, তিতুন যদি বড় হয়ে ডাক্তার হয় তাহলে আমি ওর হাসপাতালেই নার্স হব | প্রতিমা আর আমি একই কলেজে পড়েছি | ফষ্টিনষ্টি করেছি, হাতখরচ ধার নিয়েছি, পরে শোধ করব বলে | এ ছাড়া আর কোনও স্বপ্ন দেখাই নি | তাও বন্ধুরা বলত ও আমাকে চাইত | ভগবানের ইচ্ছেয় দুটো সম্পর্কই বেশি দূর গড়ানোর আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে | অথচ, বিয়ের মেয়ে যখন দেখা হচ্ছে, মা একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “বল না, কী ধরনের মেয়ে পছন্দ তোর | নাকি সোনালী ... না প্রতিমা ?” আমি বলেছিলাম, “যা ভালো বোঝ তাই কর | আমার সব চলবে |”
যাই হোক, সেই সময়ের স্মৃতি এখন ক্ষীণ | তাই এইভাবে দেখা হয়ে যাওয়ায় কারো কোন দ্বিধা বা বিকার দেখা দিল না | সোনালী আমার আলাপ করিয়ে দিল ছোটবেলার এক-পাড়ার বন্ধু বলে, আর প্রতিমা পরিচয়ে বলল আমরা এক কলেজে পড়েছি |
তাও জানি না হয়ত মেয়েরা যখন আলাদা বসেছে, গল্প করেছে, সব রকম কথাই হয়েছে |
একদিন রাত্রের খাবার খেয়ে বারান্দায় বসে আড্ডা হচ্ছিল | বা বলা যায় স্মৃতি চারণ | তপন কে আমাদের ছোটবেলার নার্স-ডাক্তার খেলার গল্প বলল সোনালী – কী ভাবে রুগীর অভাবে আমি ওকেই লেমনেডের ওষুধ গেলাতাম | প্রতিমা নয়নকে বলল, কী ভাবে আমি ওর কাছে টাকা ধার নিয়ে বলতাম একদিন ফেরত দেব – যেদিন আর আসে নি | সব মিলিয়ে সুদে আসলে আজ হয়ত কয়েক শ’ টাকা হয় |
কাকলী মুচকি মুচকি হেসে গল্প উপভোগ করছিল | তারপর হটাত কেমন গম্ভীর হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল | তাই দেখে সোনালী ওকে চেপে ধরল, “কাকলী, তোমার কোন গল্প নেই ?” প্রতিমা বলল, “হ্যাঁ, বলো না, কাকলী ! কিছু মনে পড়েছে বুঝি ?”
একটু চাপাচাপি করার পর, কাকলী আমার দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ গলায় বলল, “তিতুন, আজ যদি তোমাকে একটা সুযোগ দেয়া হয়, আমাদের তিনজনের মধ্যে একজন কে বেছে নিতে, তুমি কাকে টানবে ?” দেখলাম কাকলীর চোখ কৌতুক সত্ত্বেও একটু চিকচিক করছে | আমিও একটু হেসে বললাম, “আমি কাকে নেব, না কে আমাকে নেবে ?” কাকলী বলল, “তোমার কী মনে হয় ?” আমি বললাম, “মানে ... পুরানো টানের প্রশ্ন তো | মস্ত সমস্যা | চট করে এর উত্তর দেয়া যায় না | তবু ভেবে দেখব | তার আগে এক ঘুম দিই | চলো এখন শোয়া যাক | কাল না হয় বলব |”
মনে হল সকলের ধরে রাখা স্বস্তির নিঃশ্বাস একসাথে পড়ল |
পরদিন জলখাবার টেবিলে বললাম, “শোন সবাই, কালকের সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে ... এক স্বপ্নে |”
সবাই সমস্বরে বলল, “স্বপ্ন ! কী স্বপ্ন ? কাকে নিয়ে ?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ |” সবাই সমস্বরে হইচই করে উঠল, “বলো, বলো |”
আমি বললাম, “স্বপ্ন দেখেছি আমরা সমুদ্রে স্নান করে ফিরেছে | সোনালী, প্রতিমা আর কাকলী যে যার ঘরে চলে গেছে স্নান করে কাপড় বদলে আসতে | একটু পরে আসছি বলে আমরা তিনজন চা খেতে বসেছি | এক ফাঁকে বাথরুম যাওয়ার নাম করে উঠে গিয়ে আমি এক এক করে তিনটে ঘরের দরজায় টোকা দিলাম | তিনজনেই প্রশ্ন করল, ‘কে ?’ আমি চাপা গলায় বললাম, ‘আমি !’ ”
এতটা বলে আমি চায়ের কাপ তুলে মুখ নামিয়ে চুমুক দিলাম | এক, দুই ... ‘বেশ ভালো চা ...উমদা চা ...’
কাকলী বলল, “ইস! থামলে কেন ?”
আমি বললাম, “দু’জন উত্তর দিল, ‘দরজা ভেজানো আছে |’ শুধু একজন বলল,‘দাঁড়াও, কাপড় বদলে দরজা খুলছি |’ ”
সোনালী বলল, “মোটেও না ! অভদ্র কোথাকার !”
প্রতিমা বলল, “ইস, কী অসভ্য ! বয়ে গেছে !”
তপন বলল, “আমি কিছুই বুঝলাম না |”
কাকলী বলল, “এটা অসম্ভব কিছু নয় |”
নয়ন বলল, “কাকলী, কী অসম্ভব নয় ?”
কাকলী বলল, তপন আর নয়নের দিকে তাকিয়ে, “তিতুন খুব ভালো অন্যের গলা নকল করতে পারে | জাস্ট বিয়ের পর একবার বাবার গলা নকল করে ও আমাকে ফোন করে বলেছিল, ‘শোন, জয়ন্ত আজও ফোন করেছিল | ও নাকি তোকে ভুলতে পারছে না | কী করি বলতো ?”
------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৮ জুন ২০১৬