|| খাপ ||
অভি প্রতিভাকে জিজ্ঞাসা করল, “সোমাকে দেখছি না |” প্রতিভা বলল, “সোমা রাজেশকে নিয়ে একটু বেরিয়েছে |” অভি ভুরু কুঁচকে বলল, “কাল মেয়েটার বিয়ে, আর আজ ছেলেবন্ধুকে নিয়ে বেরিয়েছে ?” প্রতিভাও একটু বিরক্তির স্বরে বলল, “জানি না ... ওদের মধ্যে যে কী আছে | আজ কত বছর হয়ে গেল, এখনও একজন আরেকজনকে ছাড়তে পারে না | রোজ ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা | তারপরে ফেসবুক, চ্যাট, এসএমএস ... কী না !”
অভি – “কোথায় গেছে কিছু বলে গেছে ?”
প্রতিভা – “সোমা বলল রাজেশকে পার্কটা দেখিয়ে দেবে |”
ঘড়িতে এখন দুপুর তিনটে |
অভি – “পার্ক ? এই ভর দুপুরে ? তোমার কি মনে হয় ওদের মধ্যে কিছু ... ?”
প্রতিভা – “না, তা মনে হয় না | সোমা তো আমার সামনেই ওর সাথে ফোনে বকবক করে | তেমন তো কোনও লুকিয়ে কথা বলার ইচ্ছা, বা কোনও আড়ষ্টতা দেখি না ওর মধ্যে | এই যা, ছেলেটা সোমাকে খুব মানে | ওর কোনও ঝামেলা হলেই সোমাকে সেটা জানাবে, আর জিজ্ঞাসা করবে, ‘বল, এখন কী করি ?’ তারপর সোমা যা বলবে তাই করবে | এত বাধ্য ছেলে আমি দেখি নি |”
অভি – “কী রকম ঝামেলা ? কই আমি তো কিছু জানি না | ছেলেটা তো বেশ গোবদা-গাবদা | সারাদিন মুড়ি-মিছরির মত ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে খাচ্ছে | মনে হয় কিছু হেলথ প্রবলেম আছে | কিন্তু, এছাড়া ওর কিছু সমস্যা আছে বলে তো মনে হয় নি | তুমি জানলে কী করে ?”
প্রতিভা – “তুমি বাড়িতে থাকলে তো জানবে | এই তো দু মাস আগে রাকেশ ফোন করল, ওর ছোট বোন – বছর খানেকও হয় নি বিয়ে হয়েছে – বাড়ি ফিরে এসেছে | স্বামীর সাথে মানিয়ে নিতে পারে নি | রাকেশ ফোন করে বলল, ‘সোমা, বল তো এখন কী করি ? আমার তো মনে হচ্ছে সিম্মিকে (বোনের নাম) গলা ধাক্কা দিয়ে বরের কাছে ফেরত পাঠাই |’ সোমা ওকে খুব বকলো প্রথমে, তারপরে অনেক বোঝালো | এখন ভাই বোন দিব্যি আছে |”
অভি – “হ্যাঁ, রাকেশ কিছু একটা বলছিল, ওর বোনের সম্বন্ধে | মেয়েটা বোধহয় লেখাপড়া করা | এমএ না কী পাশ করেছে | বলছিল, বোনকে ওর আর ওর বাবার ব্যবসায়ে পার্টনার করে নেবে ... এই রকম কিছু একটা |”
প্রতিভা – “আমার কেন জানি না মনে হয় ছেলেটার বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কম |”
অভি – “কম ? কেন ?”
প্রতিভা – “ওই যে ... কেমন দুম করে ব্যাঙ্গালোরের অত ভালো চাকরিটা ছেড়ে বাড়িতে চলে এলো | এখন কোন চাকরি নেই | বাপের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে, আর বাপের টাকায় কী সব বিজনেস করার কথা ভাবছে | সোমা বলে ওর কোনও আইডিয়াই নেই | বাপের সব টাকা নষ্ট করবে ... সোমার কী যে দরকার ছিল, ছেলেটার চাকরি বাকরি কিছু নেই – তাকে বিয়েতে আসতে বলার | এসেই ও বলেছে ও যে উপহারটা দেবে সেটা তেমন কিছু দামী নয় |”
সোমার সাথে রাকেশের আলাপ নর্থ-বেঙ্গলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে | সোমা অঙ্ক বুঝতে পারত না | ক্যালকুলাস নিয়ে একটা বিরাট সমস্যা ছিল | তখন ক্লাসে রাকেশের পাশে বসতে শুরু করে, কেন না রাকেশ ক্লাসে কোন পরীক্ষা হলে টুক করে পেপার লেখা শেষ করে জমা দিয়ে সিগারেট খেতে চলে যেত | সেই অঙ্ক দেখানো থেকে দুজনের বন্ধুত্ব | সোমা দ্বিতীয়-বর্ষে কলেজ ছেড়ে চলে এলেও রাকেশের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল | তারপর আট বছর কেটে গেছে | একসময় প্রতিভার মনে অনেক আশংকা দেখা দিয়েছে | কিন্তু সোমা হেসে বলেছে, “মা, রাকেশ খাঁটি পাঞ্জাবি | ও পাঞ্জাবি ছাড়া বিয়ে করবে না | আর আমারও ওর প্রতি কোন দুর্বলতা নেই | ও শুধু আমার বন্ধু মাত্র | কাজেই তুমি চিন্তা কোর না | দেখেছো তো ওকে আমি ভাইয়া বলে রাগাই |”
পার্কের বেঞ্চে বসে পড়ে কপাল থেকে ঘাম মুছে সোমা বলল, “বল, কী বলবি বলে কাল থেকে মাথা খারাপ করছিস ?” রাকেশ একটু অন্যমনস্ক হয়ে (নর্থ-বেঙ্গলে চার বছর থেকে শেখা পরিষ্কার বাংলায়) বলল, “তুই আমাকে তোর বিয়েতে কেন ডেকেছিস ?”
সোমা, অবাক হয়ে, “মানে ? আমার বিয়েতে তোকে ডাকব না তো কাকে ডাকব ?”
রাকেশ – “কাজটা কী ঠিক করলি ? কাকু, কাকিমা কী ভাবছে ? নিশ্চয় ভাবছে যে কেন এক ডাকে ছেলেটা ইন্দোর থেকে ছুটে এলো, তাও সারাটা পথ বিনা রিজার্ভেশনে, ট্রেনে |”
সোমা – “বা রে ! আমার বিয়েতে তুই আসবি না ? আচ্ছা, আমি যদি উল্টো প্রশ্ন করি, আমি ডেকেছি তো কী হয়েছে, তুই এত কষ্ট করে এত দূরে ছুটে এলি কেন ?”
রাকেশ – “শুধু একটা কথা জানতে |”
সোমা – “কী কথা ? ফোনে কেন জানতে চাইলি না ?”
রাকেশ – “এই জন্য যে হয়ত তুই উত্তর দিবি না ... এড়িয়ে যাবি | আর তাহলে আমার আর কোনও উপায় থাকবে না |”
সোমা – “কিসের উপায় ? কী তুই এত হেঁয়ালি করে কথা বলছিস ? এই জন্যই কি এই ভর দুপুরে পার্ক দেখতে চাইলি ?”
রাকেশ – “না | ভর দুপুরে পার্কে আসতে চাইলাম, কারণ আমি চাই একটু নিরিবিলিতে তোর সাথে কথা বলতে | আমি চাই দরকার হলে তোর উপরে জোর খাটাতে |”
সোমা – “জোর ? কিসের জোর ?”
রাকেশ হাতের হাতব্যাগটা থেকে খবরের কাগজে মোড়া একটা কিছু বের করে কাগজটা ছাড়িয়ে দেখালো, আর বলল, “এর জোর |”
সোমা অবাক হয়ে দেখল, একটা ছুরি, হাতলে কারুকার্য করা, সম্ভবত হাতির দাঁতের | সুন্দর দেখতে ছুরিটা | ফলাটা বেশ লম্বা – তার দুদিকই ধারালো | সোমা বলল, “বাহ | কোথায় পেলি এটা ?”
রাকেশ – “এটা একবার নেপাল গিয়েছিলাম, তখন | যখন কিনেছিলাম, তোকে বলি নি | কেন না ....”
সোমা – “বলিস নি | তুই কি যাই কিনিস আমাকে জানাস ?”
রাকেশ – “না তা করি না | তবে এই ছুরিটা তোকে উপলক্ষ করে কিনেছিলাম ... তাই বলছিলাম |”
সোমা – “ওহ, হেঁয়ালির পর হেঁয়ালি ! দে, আমার জন্যেই এনেছিস তো আমায় দে |”
রাকেশ –“সাবধান ! হাত কেটে যেতে পারে ... দাঁড়া একটু | একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আছে | আগে তার উত্তরটা জেনে নিই | তারপর ছুরিটা হয় আমার কাছে থাকবে, নয় তোর কাছে যাবে |”
সোমা –“তার আগে বল, ছুরিটার খাপ নেই, আর তুই ওটাকে হাতব্যাগে নিয়ে রেখেছিস | যদি ব্যাগে হাত ঢোকাতে গিয়ে হাত কেটে যায় ?”
রাকেশ – “না, না, ছুরিটা এতক্ষণ আমার স্যুটকেসে ছিল | এখন নিয়ে এসেছি |”
সোমা – “এখানে কেন নিয়ে এসেছিস ?”
রাকেশ – “একটা নিষ্পত্তি করতে |”
সোমা – “কিসের নিষ্পত্তি ?”
রাকেশ – “এই যে ... না ! আগে শোন – একটা প্রশ্ন করব | যা উত্তর দিবি ভেবে চিনতে দিবি | আই’ম ভেরি সিরিয়াস | এটা একটা জীবন মরণের প্রশ্ন আমার কাছে | হয়ত তোরও |”
সোমা – “আমার জীবন মরণের প্রশ্ন ? কী ভাবে ? ও ! ভয় দেখাচ্ছিস ! সেই জন্যে এই ছুরিটা এনেছিস ? নাহ, তোকে নিয়ে আর পারি না | নে, চট করে প্রশ্নটা করে নে |”
রাকেশ একটু চুপ করে থেকে বলল, “জানিস এই ছুরিটার ফলাটা ফাঁপা ... মানে এর ফলাটা হল আসলে দুটো ধার-জোড়া দেয়া পাতলা পাতলা ফলা, দুটোই বাইরের দিকে একটু ফোলা | ছুরিটার ছুঁচলো আগাটায় একটা সূক্ষ্ম ফুটো আছে | সেই ফুটো দিয়ে যাকে মারা হবে তার শরীরের রক্ত ওই ফাঁপা ফলাটার ভিতর টেনে নেয়া যায় | মানে, ছুরিটা এমন ভাবে তৈরি করার উদ্দেশ্যেই তাই | এর হাতলে একটা কায়দা আছে | হাতলটার মাথায় একটা বোতাম মত আছে | এই দেখ |” রাকেশ দেখালো ছুরিটার হাতলের মাথায় একটা বোতাম – অনেকটা রান্নাঘরের গ্যাস লাইটারের মাথায় যেমন থাকে | রাকেশ বলল, “ধর, যদি আমি এই ছুরিটা তোর বুকে ঢুকিয়ে দিয়ে এই বোতামটা বার কয়েক টিপে ছেড়ে দিই, তাহলে ছুরিটার ফলার ভিতরটা তোর রক্তে ভরে যাবে |”
একটা অস্বস্তিতে গলাটা ধরে এলেও, সোমা নীরস গলায় বলল, “কী করবি সেই রক্ত দিয়ে ?” প্রশ্নটা শুনে খানিকক্ষণ একটু বোকার মত মুখ করে থেকে রাকেশ হটাত হা হা করে হেসে উঠল | তারপর বলল, “জানি না | তবে আমাকে এই ছুরিটা যে বিক্রি করেছিল সে বলেছিল, আগেকার দিনে শত্রুকে মেরে তার রক্ত দিয়ে মা কালীর পুজো করার চল ছিল নাকি | আবার অনেক সময় কোন মেয়েছেলের সাথে কেউ খারাপ কাজ করলে, তার দাদা, ভাই কি স্বামী সেই অপরাধী কে মেরে তার রক্ত নিয়ে গিয়ে বোন বা স্ত্রীকে দেখাত – সর্ট অফ লাইক এ প্রুফ – বুঝেছিস | তুই তো জানিস এমনিতে খোলা হাওয়ায় রক্ত চট করে জমে যায় | কিন্তু, এই ছুরি দিয়ে শুষে নেয়া রক্ত নাকি অনেকদিন তরল থাকে |”
সোমা –“বুঝলাম | কিন্তু, কারো ব্যবহার করা ছুরি তুই কিনলি কেন ? সেও আমার জন্য ...”
রাকেশ –“কে বলল ছুরিটা ব্যবহার করা ? আর আমি কখন বললাম তোর জন্য ছুরিটা কেনা ? আমি বললাম যে তোকে উপলক্ষ করে ছুরিটা কেনা ... কিন্তু এখন একটা মুশকিল হয়েছে |”
সোমা –“আবার মুশকিল ? কী মুশকিল ?”
রাকেশ –“ভাবছি, তোকে কী দেব তোর বিয়ের উপহার হিসাবে ?”
সোমা –“না বাবা, আর যাই দিস এই খাপ খোলা ছুরিটা আমায় দিস না | এবার, নে, চট করে প্রশ্নটা কর, যা করতে চাস |”
রাকেশ –“আমি ... আমি জানতে চাই, আমাদের দু’জনের মধ্যে যা ছিল, যা আছে ... সেটা কী ? মানে, আমাদের সম্পর্কটা কী ?”
সোমা –“কী আজেবাজে প্রশ্ন করছিস তুই ! তুই আমার বন্ধু, আমি তোর বন্ধু | ব্যাস !”
উত্তরটা শুনে রাকেশ একটু থতমত খেয়ে অন্যদিকে তাকালো | তারপর, ছুরিটার ছুঁচলো আগাটা বাঁ হাতের মণিবন্ধে শিরার উপর চেপে ধরল | সোমা চমকে দেখল সেখানে এক বিন্দু রক্তের ফোঁটা দেখা দিয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করল | তারপর অদ্ভুত ভাবে সেটা ছোট হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন ছুরির ফলাটা রক্তটা শুষে নিলো | সোমা ব্যাকুল হয়ে রমেশের ছুরি ধরা ডান হাতটা টেনে সরাতে সরাতে বলল, “রাকেশ এ কী করছিস ?”
রাকেশ –“আগে তুই সত্যি উত্তরটা বল |”
সোমা হার মেনে সরে যাওয়ার ভঙ্গিতে নিজের হাত দুটো গুটিয়ে বলল, “থাক না | আমার ছুরিটা না হয় খাপে বন্ধ থাক |”
-----------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬