রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৪

অন্বেষণ

আরামবাটী থেকে ফেরার ট্রেন ছিল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় | উঠে একটা জানলার ধারে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম | গাড়িটা ছাড়লে জানালা দিয়ে হুহু করে ধান ক্ষেতের মেঠো হওয়া ছুটে এলো | গাড়ির গতিকে অগ্রাহ্য করে জানালা দিয়ে ঢুকে আমার গায়ে মুখে এমন হানা দিল যে তার উৎপাতে না বলে চলে আসা কিছু কথা মন থেকে আবছা হয়ে হারিয়ে যেতে লাগল | বিরক্ত হয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম, চোখ বুজে কথাগুলো ভাববার জন্য | বন্ধ জানালার বাইরে হাওয়াটা তীক্ষ্ণ সুরে ঘুম পাড়ানি গান শুরু করল | ঘুম পেতে পেতে পারুলের কথা মনে পড়ল, বাড়ি গিয়ে ওকে সব বলতে হবে |

আমি আর পারুল আমরা সারাদিনের সব কথা গল্প করি | কোনও কথা বাদ যায় না | নতুন কোন আলাপ হলে তা নিয়েও কথা হয় | আমার ক্ষেত্রে সেই জন কোন স্ত্রী হলে পারুল আমার মুখ দেখে টের পায় | তাই মনে মনে আমি আগেই কথা সাজাই যে বাড়িতে গিয়ে পারুলকে কী বলব | আজ হয়ত পারুলের সাথে আমার কথা হবে এই ভাবে –
পারুল – “কেমন দেখলে সব ?”
আমি – “কোথায় ?”
পারুল – “আরামবাটীতে | ভদ্রমহিলাকে পেলে ?”
আমি – “হ্যাঁ |”
পারুল – “কে কে আছে বাড়িতে ?”
আমি – “ওর কেউ ছিল না |”
পারুল – “কেন ?”
আমি – “বাড়িটা ওর নয় |”
পারুল – “তাহলে কার ?”
আমি – “ওর দিদি, জামাইবাবুর |”
পারুল – “আর ওর বর ? তাকে দেখলে না ?
আমি – “না |”
পারুল – “ওর বর ছিল না ? নাকি নেই ?”
আমি – “হ্যাঁ ?”
পারুল – “কী হল ? তুমি মুখ ফুটে কিছু বলবে ? নাকি হ্যাঁ, না দিয়ে কাজ সারবে ?”
আমি – “বলছি তো ... জানো, ওর নাম শেফালী নয় | ওর নাম শিউলি | শেফালী ওর দিদির নাম |”
পারুল – “বাহ | বেশ মিষ্টি নাম তো | দেখতে কেমন ?’
আমি – “সেটা নিয়েই তো মুশকিল ... মানে বলা মুশকিল |”
পারুল – “কেন ? তুমি ভালো করে দেখনি বুঝি ?
আমি – “দেখেছি | কিন্তু তোমাকে বলার মত করে দেখিনি |”
পারুল – “তাহলে কাকে বলার মত করে দেখেছ ?”
আমি – “কাউকে বলার মত করে নয় |”
পারুল – “এ আবার কেমন কথা ?”
আমি – “বলছি ... মনে করো, ওকে দেখতে ওর মায়ের মত |”
পারুল – “কিন্তু ওর মাকে তো আমি দেখিনি |”
আমি – “আমি দেখেছি | ওনার বয়েস হয়েছে, মুখে তার ছাপ | তারই সাথে একটা দুঃখ কোথাও লুকিয়ে আছে ওনার চেহারার মধ্যে |”
পারুল – “তুমি বললে ওর কেউ ছিল না ওখানে |”
আমি – “না আমি বহরমপুরের কথা বলছি | বহরমপুরে ওর বাবা মা থাকে |”
পারুল – “তুমি বহরমপুরে গিয়েছিলে ?”
আমি – “আজ নয় | আগে, কিছুদিন আগে বহরমপুর গিয়েছিলাম | কাজে |”
পারুল – “কই, আমায় তো বলনি |”
আমি – “তুমি থাকলে তো |”
পারুল – “ও |”
আমি – “কী বলছিলাম ? হ্যাঁ, ওর মায়ের চেহারা প্রতিমার মুখের মত | আর ওকে দেখতে ওর মায়ের মত | এবার বুঝতে পারছ ?”
পারুল – “না | তুমি সোজাসুজি বলো না, শিউলিকে কেমন দেখেছ |”
আমি – “আমি শুধু ওর চোখ দুটো দেখেছি |”
পারুল – “ধ্যাত ! আমি কাউকে দেখে ওরকম বলতে পারি, ‘আমি শুধু ওর চোখ দেখেছি’ ? ... কেন, ওর চিবুক, ঠোঁট, গাল, কপাল ?”
আমি – “না | আমি যতবার ওর মুখের দিকে তাকিয়েছি, শুধু ওর চোখ দুটো নজরে পড়েছে | অতল গভীর থিতানো চোখ নিয়েই যেন ওর সারা চেহারাটা | সেই চেহারায়, ওর চিবুকে, গালে, কপালে ছড়ানো ওর ঠোঁটে আটকে থাকা একটা বিব্রত হাসির সংকোচ |”
পারুল – “তোমার ভাল লেগেছে ?”
আমি – “কী ?”
পারুল – “যা দেখেছ, যেটুকু দেখেছ |”
আমি – “জানি না |”
পারুল – “তুমি কি সত্যি গিয়েছিলে ?”
আমি – “হ্যাঁ | কেন সন্দেহ করছ ?”
পারুল – “কই টিকিটটা দেখি |”
আমি – “টিকিট ?
পারুল – “হ্যাঁ | টিকিটটা দেখি |”

কেউ ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলল, “ও মশাই ! ঘুমের ঘোরে কী বলছেন ? দেন দেখি, টিকিটটা |” উত্তর না দিয়ে টিকিট দেখালাম | টিটিই চলে গেল |

আশেপাশের যাত্রীদের কৌতূহলী চোখ এড়াতে বন্ধ জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে তাকালাম | বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার | তার মধ্যে একমাত্র ছবি কাঁচে কামরার প্রতিফলন | সেই ছবির ভিতর দিয়ে কামরার আলো বাইরে একটা চৌকো আলোর মালা গেঁথেছে, যেটা অসমান জমির গায়ে কোথাও লাফিয়ে উঠে, কোথাও আছড়ে পড়ে, ছুটে  ছুটে চলেছে ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে | কামরার প্রতিফলনের পিছনের অন্ধকারে ছেয়ে আছে শিউলির মুখ | মুখ না মুখের বাদল, অসীম যার ব্যাপ্তি | তার মেঘে মেঘে বাকি সব অস্পষ্ট | ওর চোখ, বিশেষ করে ওর অতল গভীর চোখের তারা মিলিয়ে গেছে সেই মেঘের সম্ভারে | হয়ত ওর চোখের তারার আলো দেখা যাবে জানালাটা খুললে আকাশের তারায় | কিন্তু ভয়, আকাশ হতে তারার বর্ষা, আর খোলা জানালার সুযোগ নিয়ে ছুটে আসা ওই ধান ক্ষেতের বাদলা হাওয়া আমার চিন্তাধারাকে বিহ্বল করে দেবে | স্বপ্নটা কেটে যাবে |

আমি আবার চোখ বুজলাম পারুলের সাথে কথাটা শেষ করতে |

আমি – “কেন তুমি জানতে চাইলে আমি গিয়েছিলাম কিনা ?”
পারুল – “কেন না আমি দেখছি তুমি কিছু না নিয়েই ফিরে এসেছ |”
আমি – “কী নিয়ে আসতে হত ?”
পারুল – “ওর পরিচয় |”
আমি – “পরিচয় হয়নি ভাবছ ?”
পারুল – “না | দেখছি শুধু আলাপ হয়েছে |”
আমি – “আলাপ আর পরিচয়ের মধ্যে পার্থক্য ?”
পারুল – “অনেক | আমার তোমার সাথে পরিচয় আছে, শিউলির, শুধু আলাপ |”
আমি – “কী করে বলছ ?”
পারুল – “আমি জানি তুমি যা চাও | শিউলি কী জানে তুমি কী চাও ?”
আমি – “বলো, আমি তোমার কাছে কী চাই |”
পারুল – “আমার কাছে বলে নয় | তুমি যা চাও তা চাও – কি আমি, কি শিউলি |”
আমি – “সেই যুক্তিতে তো তুমি আর শিউলি এক |”
পারুল – “বা রে | তা কী করে হবে ?”
আমি – “হবে না ? ... হয়ত নয় | সে কথা কি আমি জানি ? আমি কি জানি আমি কী চাই ? যদি কেউ বলে দিত ...”
পারুল – “আমি তো কত চেষ্টা করলাম | এখন হয়ত শিউলি পারবে |”
আমি – “কী ভাবে ?”
পারুল – “পরিচয় করে দেখো | ওকে জানো | আরও, আরও জানো |”
আমি – “তুমি যদি জানতে তো দিলে না কেন ?”
পারুল – “কী দিলাম না ?”
আমি – “যা আমি চাই |”
পারুল – “হয়ত কোথাও খটকা ছিল যে সেটা দেয়া আমার পালা নয়, অন্য কারোর |”
আমি – “শুধু খটকা ?”
পারুল – “নয় ভবিতব্য |”
আমি – “ভবিতব্য কী ভাবে ?”
পারুল – “কেন না যখন আমি অপারগ হয়েছি, আমরা, অন্তত আমি, বাস্তবে যে শিউলি আছে সে কথা জানতাম না | না হলে হয়ত ...”
আমি – “কিসে অপারগ ?”
পারুল – “তোমাকে তোমার জীবনের শেষ পাওয়া পাইয়ে দিতে | এখন হয়ত সেটা হবে |”
আমি – “তুমি কি আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছ ?”
পারুল – “না | জেগে ওঠো | দু’চোখে চেয়ে দেখো |”
আমি – “তাই তো করতে গিয়ে, দু’চোখ দিয়ে, দু’চোখে চেয়ে ...”

সহযাত্রীদের ব্যস্ততায় স্বপ্নটা কেটে গিয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল | দেখলাম ট্রেনটা বর্ধমানে ঢুকছে | রাত হয়ে আসা প্ল্যাটফর্মে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় অশান্ত যাত্রীরা উসখুস করছে ট্রেনটা থামার জন্য | একটু ধাক্কাধাক্কি করে নামতে হল | বাড়ির তালা খুলে ঢুকে বাতি জ্বেলে দেখলাম দেয়াল ঘড়িতে প্রায় এগারোটা | হাত মুখ ধুতে গিয়ে বাথরুমের আয়নায় মুখ দেখলাম | একদম অচেনা চেহারা | এমন অচেনা, মনে হল খুব পরিচিত লোকও চিনতে পারবে না আমাকে এই মুহূর্তে | মুখের উন্নত অংশের ছায়া অবনত অংশে | অনেক ভাঁজ আর রুক্ষতা সর্বত্র ছড়িয়ে | আমার মধ্যে আর আমি নেই | জামাকাপড় বদলাতে গিয়ে দেখলাম সব কিছু ধুলোয় ভরে আছে | বিছানায় ধুলো | চাদরে ধুলো | নিজের শরীরের দিকে আর তাকালাম না | বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম |

ভেবেছিলাম স্বপ্নে কথা হবে না জানি কার সাথে | স্বপ্নে কেউ দেখা দিল না, এক যিশু ছাড়া | সেও শুধু একবার চোখ খুলে ভুরু কুঁচকে একটু দেখে, আমায় কি না জানিনা, মুখ আধ-ফাঁক করে জিভ ভেংচে ছোট্ট একটা হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়ল | আমিও তাই করার চেষ্টা করলাম | সব কিছুই নকল করলাম, কিন্তু অনেক হাই তুলেও বুক ভরল না | বুকের ভিতরের ফাঁকা ভাবটা থেকেই গেল | ভাবলাম যিশু কে দেখতে শিউলি আসবে | শিউলি এলোও, কিন্তু আমার দিকে পিঠ করে বসে যিশুকে কোলে শুইয়ে খাওয়ানোতে মন দিল | আমি আর যিশু কে দেখতে পেলাম না | শুধু শিউলির কোমরের এক পাশে দেখলাম মাঝে মাঝে যিশুর ছোঁড়া পায়ের আস্ফালন | আর, তাই থামাতে ফলের ভারে গাছের ডালের মত শিউলিকে পিঠ বেঁকিয়ে সামনে নুইয়ে যেতে | একটু পরে শিউলি হাঁটু দুলিয়ে যিশুকে ঘুম পাড়াতে লাগল | তাই দেখতে দেখতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম |

পরদিন অফিসে অজিতকে এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভেবে কোন লাভ দেখলাম না | অজিতকে এড়িয়ে আমার বরঞ্চ ক্ষতি হবে, কেন না গত রাত্রের পারুলের সাথে কথার হেঁয়ালির থেকে যাবে | শেষে নিজের সাথেই একটা বোঝাপড়া করলাম | অজিত আরামবাটীর সব কথা, আমার কথা, মন দিয়ে শুনল | শুনে চুপ করে থাকলে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী রে | কিছু বলবি না ?”
অজিত – “এই যে তোর বর্ণনা, ‘শিউলি কে দেখতে কেমন জানি না, আমি শুধু ওর চোখ দেখেছি’ – সত্যি করে একটা কথা বলবি ?”
আমি – “কী ?”
অজিত – “তুই ওর মধ্যে কী খুঁজছিস ?”
আমি – “কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করছিস ?”
অজিত – “কেন না, যখন কেউ কিছু খোঁজে কারো অন্তরে, তখন সে তার বাইরের রূপটাকে ঠিক করে ঠাহর করে দেখে না |”
আমি – “আমি তো কোনও ভাবে ওকে খুঁটিয়ে দেখিনি |”
অজিত – “তুই এটা তো মানছিস, যে তুই কিছু খুঁজতে গিয়েছিলি ?”
আমি – “হয়ত |”
অজিত – “পেলি ?”
আমি – “যা পেলাম তা শিউলির মধ্যে নয় |”

আমাদের কথার মাঝে বেয়ারাটা চা দিয়ে গেল |

অজিত – “তুই বলছিলি, তুই যা খুঁজতে শিউলির কাছে গিয়েছিলি তা পেলি, তবে শিউলির মধ্যে নয় | কোথায় পেলি ?”
আমি – “যিশুর মধ্যে |”
অজিত – “যিশু ?”
আমি – “হ্যাঁ | শিউলির ছেলে |”
অজিত – “কত বড় ?”
আমি – “মাস খানেক |”
অজিত – “তাহলে তো তুই যা পেলি তা প্রথম দেখায় শিউলির মধ্যে ছিল | তখন কি তুই তা খুঁজছিলি না ?”
আমি – “আমি তো বহুদিন ধরে খুঁজে আসছি | শিউলিকে যখন দেখলাম, তার খোঁজ পেয়েও বুঝতে পারিনি |”
অজিত – “আর, এখন তা শিউলির মধ্যে নেই ?”
আমি – “না নেই |”
অজিত – “তুই কি আবার শিউলির কাছে যাবি ?”
আমি – “তুই দুটো জিনিস গুলিয়ে ফেলছিস | আমি খুঁজছিলাম কিছু | প্রথম দেখায় শিউলির মধ্যে হয়ত তার খোঁজ পেয়েও বুঝি নি | তাই গিয়েছিলাম শিউলির কাছে | ওর কাছে গিয়ে যা পেলাম, তা ওর মধ্যে পেলাম না |”
অজিত – “যিশুর মধ্যে পেলি ?”
আমি – “ঠিক |”
অজিত – “এরপর তুই কোথায় খুঁজবি ?”
আমি – “কী ?”

অজিত একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপ করে থাকলে আমি পারুল কে মনে মনে ডেকে আলোচনাটা চালিয়ে গেলাম |

পারুল – “এরপর তুমি কোথায় খুঁজবে ?”
আমি – “কী ?”
পারুল – “যা খুঁজছ | আমাকে তো বলোনি কী খুঁজছ |”
আমি – “সেটাই তো বুঝতে পারছি না, নিজে নিজে একা একা |”
পারুল – “কী বুঝছ না ?”
আমি – “যা আমি খুঁজছি, হয়ত তাই আমি শিউলির মধ্যে দেখেছি, তখন | এখন নেই | আবার যদি সেই জিনিস শিউলির মধ্যে খুঁজি তাহলে সেটা কি শিউলিকে খোঁজা হবে না ? যাই খুঁজছি তার জন্য একই মানুষ কে, বা একই মানুষের মধ্যে, কতবার খুঁজব ?”
পারুল – “তুমি আমার মধ্যে সেই জিনিস খুঁজবে না ?”
আমি – “না | আমি তো ওর মধ্যে এমন কিছু খুঁজতে গিয়েছিলাম যা তোমার মধ্যে পাইনি | ছিল কি ?”
পারুল – “আমি জানি না তুমি আমার মধ্যে কী খুঁজেছিলে |”
আমি – “কিন্তু কাল তুমি যে বললে, তুমি জানতে আমি কী চাই ?”
পারুল – “আমি ভেবেছিলাম | কিন্তু আমার ভাবা আর তোমার ভাবা কি এক ?”
আমি – “তুমি জানতে না আমি তোমার মধ্যে কিছু খুঁজছিলাম ?”
পারুল – “জানতাম | সেটা জানতাম | যা জানতাম না তা হল কী তুমি খুঁজছিলে |”
আমি – “তবে তুমি কেন চলে গিয়েছিলে ?”
পারুল – “হয়ত বুঝে, যে আমি চলে গেলে তুমি অন্য কোথাও খুঁজবে, খুঁজে পাবে |”
আমি – “পেলাম | কিন্তু যার মধ্যে যা খুঁজছিলাম সে আর সেই জিনিস এখন আলাদা হয়ে গেছে |”
পারুল – “দেখো আবার চেষ্টা করে, এক করা যায় কি না |”

অজিত আমার হাতে হাত রেখে বলল, “এই প্রবাল | কী হল ? বিড়বিড় করে কী চিন্তা করছিস ? নে, চা টা শেষ কর | জুড়িয়ে গেছে নিশ্চয় এতক্ষণে |”

বহুদিন অসুস্থ মানুষের মত অফিস করলাম | খিদে নেই, তাও খেলাম | খিদে বা হজমের কোন তারতম্য হল না | খাওয়ার একটু পরে মনেও করতে পারলাম না কী খেয়েছি, কখন | ঘুম পেল না, তাও ঘুমলাম, ঘুমে কোন ব্যাঘাত হল না | উঠে কোন স্বপ্ন দেখেছি বলেও মনে হল না | কাজে মন লাগল না, তাও দিব্যি কাজ করলাম ভুল চুক না করে |  কিন্তু কাজ হল খুব আস্তে আস্তে, যে ভাবে লোকে কাজ করে, কারো ফোন আসার অপেক্ষা করতে করতে | তাই কি, না কাছে এসে, বেঞ্চে পাশে বসে, ‘আমি এবার এগোই’ বলে চলে যাওয়া একজনের ? বুঝলাম না |

একদিন, একটু তাড়াতাড়ি অফিস ছেড়ে লোকালে মাঝপথে নেমে স্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা রিকশা নিয়ে পরের স্টেশন অব্দি যেতে বললাম | রিকশাওয়ালা প্রায় আধ ঘণ্টা পর আমায় একটা খুব ছোট গ্রামের বাইরে নামিয়ে গ্রামে যাওয়ার পায়ে হাঁটা রাস্তাটা দেখিয়ে বলল ওটা দিয়ে একটু গেলেই স্টেশনটা পেয়ে যাব | আমি রাস্তাটা ধরে গ্রামটা পার হয়ে একটা ধান ক্ষেতের মধ্যে পড়লাম | একটা লোককে দেখে দাঁড়ালাম পথ জানতে | পিছন থেকে কী একটা হালকা সুগন্ধ হাওয়ায় ভেসে এসে আমায় শিউলির কথা মনে করিয়ে দিল | সুগন্ধের ঢেউটা এগিয়ে যেতে যেতে আমাকে সামনে যেতে টানল | লোকটাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম স্টেশনটা সামনে, পায়ে হেঁটে তিরিশ মিনিটের পথ | দেখলাম ফেলে আসা পথে ফেরা, আর এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই | আমি মনে মনে শিউলিকে প্রশ্ন করলাম, ‘বাতাসে শিউলির সুগন্ধ | কী করে এমন হল ?’ সুগন্ধ জড়িয়ে শিউলি পিছন থেকে এসে আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল | আমি হাওয়ায় ওর শাড়ির আঁচলের ওড়া দেখতে না পেয়ে জোর পায়ে এগিয়ে ওর পাশে হলাম | দেখলাম ও যিশুকে কোলে নিয়েছে আঁচলে মুড়িয়ে | আমাকে দেখে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চোখের ভাষায় বলল, ‘এখুনি ঘুমিয়ে পড়বে |’ তখন কথা বলে যাবে এই আশায় চুপ করে  একসাথে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম অস্ত যাওয়া রোদে ধানের শিষে রং ধরছে | আমার গায়ে রোদটা একটুও লাগছে না দেখে অনুভব করলাম হাওয়ায় নেমে আসা সন্ধ্যার শিরশিরে ঠাণ্ডার সাথে সাথে সেই সুগন্ধটা ক্রমে হালকা হয়ে আসছে | সুগন্ধটার সাথে সাথে শিউলি একটু একটু করে পিছিয়ে পড়তে পড়তে মনে করিয়ে দিল আমি বহুদিন শিউলিকে দেখিনি, শিউলি ফুলও না | আমি পিছন ফিরে তাকালে ও আমায় ইশারা করল এগিয়ে যেতে | স্টেশনে পৌঁছে পিছন ফিরে আর ওকে দেখতে পেলাম না | মনে হল নিশ্চয় যিশু ঘুমিয়ে পড়েছে, আর শিউলি রয়ে গেছে যতক্ষণ না যিশু জাগে | একবার মনে হল ফিরে যাই | কিন্তু, ভাবলাম, গিয়ে যদি যিশুকে ওর কোল থেকে নিতে হাত বাড়াই, আর ও বলে, ‘এ তো আপনার নয়’ ?

লোকালে উঠে লোকজনের ভিড়ে আমার মনের মধ্যে গুমরাতে থাকল সব প্রশ্ন, ‘আমি কাকে চাই – শিউলি ? না যিশু ? নাকি শিউলির সুরভি মাখা যিশু ? আমার নিজস্ব শিউলির সুরভি মাখা যিশু কই ?’ সেই রাতে ছমছমে ঠাণ্ডায় ফাঁকা স্টেশনে নেমে আমার বেঞ্চটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম ওটার কাজই কি ছিল আমার মনের মধ্যে এই সব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা ?

শীত কমে আসার সাথে সাথে আমার স্টেশনের বেঞ্চটার মায়া কমতে লাগল | নাকি অন্য কিছু হল বুঝলাম না | একদিন আমি বেঞ্চটার কাছে গিয়েও বসতে পারলাম না | মনে হল খুব তাড়াতাড়ি এসে গেছি, অপেক্ষা করে দেখি যদি কেউ আসে | কেউ এলো না | আমি অপেক্ষায় রয়ে গেলাম | পরদিন জোর করে বসলাম, একপাশে | প্ল্যাটফর্মে লোকাল এসে হৈচৈ শুরু হলে নিজের অজান্তে বেঞ্চে রাখা স্যুটকেসটা কাছে টেনে আনতে গিয়ে দেখলাম কোন স্যুটকেস নেই | সম্বিত ফিরে পেয়ে চমকে প্ল্যাটফর্ম বরাবর চোখ মেলে কাউকে দেখতে পেলাম না, কোন ক্লান্ত অবিন্যস্ত মহিলা কে | ব্যাকুল হয়ে চারিদিকে তাকালাম, কিন্তু কোথাও কাউকে দেখলাম না ধীর গতিতে আসতে আমার বেঞ্চের দিকে, যাকে দেখে বুঝব কাকে আমি খুঁজছি | ‘আমি খুব দেরী করে ফেলেছি’, ভেবে ফাঁকা বুকটা নিশ্বাস নিয়ে ভরে নিতে চাইলাম | না পেরে ছটফট করে উঠে দাঁড়ালাম | ভাবলাম এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাই, গিয়ে দেখি টেলিগ্রাম অফিসের জানালায় | কিন্তু কী দেখব ভেবে পেলাম না | বেঞ্চটায় বসে পড়ে হাঁটুতে কনুই রেখে দু’হাতে মাথা ধরে চোখ দুটো বুজলাম | অকারণে দুর্বার এক কান্নায় পেয়ে বসল | যে কান্নাটা বুকে জমে ছিল | এক পশলা কান্না | খুব তীব্র আবেগে শুরু হয়েই একটু পরে হটাত থেমে গেল, যেমন হটাত পেয়েছিল | রুমালটা বের করে চোখ মুছতে গিয়ে দেখি চোখ শুকনো | ‘তবে কি আমি ভুল বুঝেছিলাম ? তা কী করে ? আমার যে এত শূন্য লাগছে, যেন কত দুঃখ পার করে এসেছি |’ মাথা তুলে দেখলাম আমার সামনে একটা কুকুর দাঁড়িয়ে শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে | ‘কুকুরটাও কি ভুল করে আমি কাঁদছি ভেবে কাছে এসেছিল ?’ আমি মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে কুকুরটাকে হাত নাড়লাম চলে যেতে বলতে | ও গেল না | শরীরটা মাটিতে নামিয়ে সামনে দু’পা জড়ো করে বসে আমার দিকে তাকাল | বুঝলাম যে আমি ওকে খেদিয়ে ঠকাতে পারব না |  ‘তাই তো | আমি তো ওকে ঠকানোর চেষ্টা করেছি | ওকে বলে আসি নি যে আমি আবার যাব দেখা করতে | কেন না, যেতে আমাকে হবেই |’ আমার শরীরের ঝাঁকুনিতে চমকে কুকুরটা তড়াক করে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে শরীরটা লম্বা করে আড়মোড়া ভেঙ্গে মাথা নাড়ল | আমি হাত নেড়ে ওকে যেতে বললাম | কুকুরটা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে বোধহয় আশ্বস্ত হয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল |

গরম পড়তে শুরু করল | একদিন অফিসে পৌঁছে সবে কাজে বসেছি, রিসেপশন থেকে ফোন করে বলল কেউ এসেছে আমার সাথে দেখা করতে | নিচে গিয়ে দেখি লবিতে সোফায় বসে এক বয়স্ক দম্পতি | আমি লিফট থেকে বেরোতেই হাতের ইশারায় রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা ভদ্রলোকের ধ্যান আমার দিকে আকর্ষণ করল | দু জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে দেখল – এক জোড়া পুরু চশমার পিছনে উদ্ভ্রান্ত, আর অন্য জোড়া বেদনায় লীন |  চিনে, আশ্চর্য হয়ে বললাম, “একি, হারাধন বাবু,  আপনারা হটাত এ ভাবে কোথা থেকে ?”
সরমা বললেন, “বাবা, খুব বিপদে পড়ে ছুটে এসেছি |”
হারাধন – “কোথাও বসে একটু কথা বলা যাবে ?”
আমি – “এখনই ? এখানে বলা যায় না ?”
হারাধন – “খুব জরুরী কথা | যদি নিরিবিলি কোথাও একটু ...”

রিসেপশনিস্টকে বললাম অফিসে খবর দিতে যে আমি একটু বাইরে যাচ্ছি | ওনাদের নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে উল্টোদিকে মিষ্টির দোকানে একটা চায়ের টেবিলে বসালাম | এই সময় তেমন ভিড় থাকে না  | সরমা ইতস্তত করে বললেন, “এখানে কথা বলে যাবে ?”
আমি – “কাছে পিঠে আর তো আর তেমন কোন জায়গা নেই | এখন অত খদ্দেরের ভিড় হবে না | বলুন, আপনি কী বলতে চান |”
সরমার চোখ ছলছল করে উঠল | তিনি নিঃশব্দে আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন | হারাধন অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলেন | আমি উঠে কাউন্টারে চা দিতে বলতে গিয়ে এদিক ওদিক করে কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে এসে বসলাম | হারাধন সরমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “সরমা, ওনাকে যা বলার বলো | উনি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছেন | ওনাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখা উচিত হবে না |”
আমি – “আপনারা আমার অফিসের ঠিকানা পেলেন কোথায় ?”
হারাধন – “তুমি আমাদের ওখানে যাওয়ার পর মাস খানেক কেটে গেলে একদিন পাড়ায় একটা রিকশাওয়ালা কে দেখে চেনা চেনা মনে হল | আমি ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমাকে আমার বাড়িতে আনার কথা | ও প্রথমে মনে করতে পারল না | আমি ওকে আন্দাজে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এক বাবু কে হোটেল থেকে এনে আবার ফেরত নিয়ে গিয়েছিলে | মনে আছে ?’ তখন ও মনে করতে পারল | আমি ওকে নিয়ে ওই হোটেলে গেলাম | আপনার নাম আর আসার দিন বলে জানতে চাইলাম আপনার ঠিকানা | প্রথমে ওরা রাজী হল না কিছু বলতে | আমি মিনতি করলাম যে আপনি আমার মেয়ের খবর জানেন, যা আমার জানা খুব দরকার | তখন ওরা ওদের খাতায় আপনার নাম খুঁজে অফিসের ঠিকানাটা দিল | বলল বাড়ির ঠিকানা নেই |”
আমি – “সে তো অনেক দিনের কথা |”
হারাধন – “আমি তো তখনই আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সরমা এতদিন চায় নি | আশা করছিল শিউলি ফিরে আসলে তার দরকার হবে না |”
সরমা – “বাবা, আমাদের খুব ভুল হয়ে গেছে, সেদিন ও ভাবে তোমাকে তাড়িয়ে দেয়া | তুমি বল, শিউলি কোথায় আছে | তোমার কাছে ?”
আমি – “না, না | আমার কাছে কী করে হবে ?”
সরমা – “তবে কোথায় ? তুমি যা জানো বলো |”
আমি – “আমি ওকে শেষ দেখেছি  ... কিন্তু সে ও তো কয়েক মাস হয়ে গেল |”
সরমা – “কোথায়, শেষ কোথায় দেখেছ | বলো, বাবা বলো | আমার বুক ফেটে যাচ্ছে জানতে ও ঠিক আছে কি না ? ওর শরীর স্বাস্থ্য ...”
আমার মনে পড়ে গেল যিশুর কথা | বললাম, “আচ্ছা আপনি সেদিন কেন বলেছিলেন আপনাদের মেয়ে ছিল ?”
সরমা – “বলছি বাবা, সব বলছি | ও আমাদের একমাত্র মেয়ে ... আমরা ওকে ত্যাগ করে – করেছিলাম – সব জেনে, সইতে না পেরে | এখন আর থাকতে পারছি না, ও কোথায় আছে, কেমন আছে না জেনে |”
আমি – “সব কী জেনে ?”
হারাধন – “সরমা, মনে হয় না প্রবাল সব জানে, তুমি যেমন ভাবছ |”
ভদ্রমহিলা চমকে উঠে প্রশ্ন করলেন – “কী ? তবে যে তুমি টেলিগ্রামটায় লিখেছিলে ...” ভদ্রমহিলা কাঁপা হাতে নিজের ব্যাগটা খুলে একটা ভাঁজ করে রাখা কাগজ আমায় দিলেন | সেই টেলিগ্রামটা, যাতে লেখা – ‘... যার জন্য আর যার সাথে বেরিয়েছি সেই জন আমার ভরসা ...’
সরমা – “তুমি কি সেই জন নও যার সাথে আর যার ভরসায় শিউলি বেরিয়েছিল ?”
‘যার সাথে আর যার ভরসায় শিউলি বেরিয়েছিল – সে কি যিশু ?’ | মনের প্রশ্নটা চেপে বললাম, “আপনি ভুলে গেছেন | আমি সব বলেছিলাম | বর্ধমান স্টেশনে আপনার মেয়ের সাথে আমার কী কথা হয় | কথা মানে, উনি কী ভাবে ওনার ট্রেনে ওঠার আগে টেলিগ্রামটা পাঠাতে না পেরে আমাকে দেন আপনাদের পাঠাতে |”
সরমা বিভ্রান্ত স্বরে বললেন,  “তুমি শিউলির সেই জন নও ? শিউলি তোমার ...”

একটা ছেলে চা দিতে এলে সরমা কথা চাপলেন | কী বলব ভেবে না পেয়ে উত্তর দেয়া এড়িয়ে যেতে আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম | ফুটন্ত গরম বিস্বাদ চায়ে জিভটা পুড়ে গেল | হারাধন বাবু আমার বিকৃত মুখভঙ্গি দেখে চায়ের কাপ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন | আমি বুঝলাম না, ‘সব কথা’ না জেনে, আরামবাটীর কথা বলা উচিত হবে কিনা |

সরমা ততক্ষণে পাথরের মত জড় হয়ে বসেছেন | হারাধন বললেন, ‘সরমা, তোমাকে আমি আগেই বলে ছিলাম আমার মনে হয় না প্রবাল ...”
সরমা খুব ঠাণ্ডা, নিচু অথচ শক্ত গলায়, “তাহলে শিউলির গর্ভধারণের কারণ তুমি নও ...” বলে উঠে দাঁড়ালেন |
আর কিছু বলার না পেয়ে হারাধন ও উঠে দাঁড়ালেন | দু’জনে ধীর পায়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন | আমি উঠে কাউন্টারে গেলাম চায়ের দাম দেয়ার জন্য | হারাধন বাবু ফিরে এসে বললেন, “প্রবাল, সরমার কথায় তুমি কিছু মনে কোর না | তুমি চলে আসার পর সরমা টেলিগ্রামটা বারবার পড়ে একটা ধারণা করে যে শিউলির সাথে যা ঘটেছে তা তুমিই ঘটিয়েছ | যাই হোক, শিউলির যদি কোন খবর পাও, জানি না কী ভাবে, তাহলে জানিও |”
আমি – “কী করে জানাব ? আমার কাছে তো আপনার নম্বর নেই |”
হারাধন বাড়ির ফোন নম্বর একটা রসিদের পিছনে লিখে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন | আমি জিজ্ঞাসা করলাম না ফোনটা ঠিক হয়েছে কি না |

বাড়ি ফিরে ক্যালেন্ডারে দেখলাম আরামবাটী থেকে এসে দু’মাস কেটে গেছে | অসহ্য প্রতীক্ষা নিয়ে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে উঠে ছ’টার আরামবাটী এক্সপ্রেস ধরলাম | রাস্তায় দেরী করে ট্রেনটা আরামবাটী পৌঁছল দেড়টায় | দীনবন্ধু লজে উঠে স্নান করে বেরোতে বেরোতে প্রায় আড়াইটা | ভর দুপুরের গরমে চট করে অটো পেলাম না | একটা রাজী হল মাত্র মৌলিপাড়া অব্দি যেতে | বলল ওখান থেকে রিকশা পাব | রিকশা নিয়ে যখন পশ্চিম বঙ্গ বিদ্যুৎ পর্ষদের অফিসের রাস্তায় শেফালীদের বাড়ির সামনে নামলাম, দেখলাম তিনটে বেজে গেছে | হটাত দ্বিধা দেখা দিল  – এই দুপুরে স্বল্প পরিচিত কারো বাড়িতে কী অজুহাতে নিজেকে উপস্থিত করব ? কী করব ভাবতে ভাবতে সামনে একটা বকুল গাছ  দেখে ওদিকে পা বাড়ালাম | আমি ওর ছায়ায় দাঁড়ালে রিকশাওয়ালা পিছন পিছন এসে বলল, “বাবু, ভাড়াটা দিয়ে আমায় ছেড়ে দিন |” আমি কিছু বলার আগে একটা খোলা জানালা দিয়ে কেউ ডাকল, “এই রিকশা !” একটু পরেই দরজা খুলে কোলে যিশুকে নিয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো শিউলি | এসে ওকে রিকশার সিটে শুইয়ে তাড়াতাড়ি উঠে বসে ওকে কোলে নিলো | তারপর রিকশাওয়ালাকে খুঁজতে চারিদিকে তাকিয়ে আমাদের দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, মুখে সেই বিব্রত হাসি ফুটিয়ে বলল, “এ কী ? আপনি ? এখানে ?”

রিকশার ছাউনিটা টানা থাকলেও দেখলাম সেই কয় মুহূর্তের মধ্যে শিউলির চেহারায় একটা হালকা ঘামের আর্দ্রতা ছড়িয়ে গেল | ওর চোখের দৃষ্টিতে কী দেখতে পেয়ে জানি না আমার ম্রিয়মাণ বুক তার স্পন্দনের অবসান হওয়ার শেষ তরঙ্গ ছড়াতে কেঁপে উঠে নিস্পন্দ হল | হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম |

শিউলি রিকশায় একটু নড়ে নামার জন্য উদ্যত হয়ে বলল, “ও কী ? দাঁড়িয়ে রইলেন কেন ? এসে ধরুন, আমি নামব |” আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে রিকশার কাছে গিয়ে ওর কাছ থেকে যিশুকে নেয়ার জন্য হাত বাড়ালাম |
শিউলি বলল, “আরে না | রিকশাটা ধরুন |”
ততক্ষণে রিকশাওয়ালাটা এসে গেছে | ও রিকশাটা ধরল | আমি চুপ করে এক পাশে দাঁড়ালাম | শিউলি যিশুকে সীটের উপর শুইয়ে চট করে নেমে ওকে কোলে নিতে গেল | আমি বললাম, “এ কী করছেন ? কোথায় যাচ্ছিলেন যান |”
শিউলি – “বা রে | আপনি এসেছেন আর আমি চলে যাব | আমি রিকশা না পেয়ে অপেক্ষা করে করে, এটাকে দেখে আপনাকে লক্ষ্যই করিনি | চলুন, বাড়ি চলুন | আমার পরে গেলেও হবে |”
আমি – “তার আগে বলুন, যাচ্ছিলেন কোথায় ?”
শিউলি – “এই যে, একে নিয়ে যাচ্ছিলাম হেলথ সেন্টারে দেখাতে |”
আমি – “ও, তো আপনি একাই যাচ্ছেন ? শেফালীদি’ ?”
শিউলি – “দিদির খুব জ্বর | অরুণদা’র কাজের চাপ, আমাকে কোনমতে একটা রিকশা ডেকে পাঠিয়ে দিয়েছিল | তার চেন ছিঁড়ে গেল | সেই থেকে আমি এদিক ওদিক করছি রিকশার জন্য |”
শিউলি রাস্তার দু’দিকে চোখ ফেলল, বোধহয় আর রিকশা দেখতে | আমি বললাম, “এমন হয় না, আমি গেলাম আপনার সাথে ? তারপর ফিরে এসে না হয় ...”
শিউলি বাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল | তারপর বলল, “তাও হয় |” ও উঠে বসে যিশুকে কোলে নিলে আমি রিকশায় উঠে ওর পাশে বসলাম | শিউলি রিকশাওয়ালা কে বলল এগিয়ে যেতে |

বিশ্বাস হল না যা ঘটছে | মনটা চলে গেল কয়েক মুহূর্ত আগেকার  সময়ে, যখন আমি ওই গাছের ছায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, না ভেবে পেয়ে যে কী ভাবে শিউলির সাথে দেখা হবে | ‘আবার কি সেই মুহূর্ত ফিরে আসতে পারে ? আর, এমন হয় যে আমি ফিরে চলে যাই ? এই দেখা কি হওয়ারই ছিল ? নাহলে কেন হচ্ছে এইভাবে ?’

একটা গর্তে পড়ে রিকশাটা খুব জোরে দুলে উঠল, আর শিউলির মাথা আমার কাঁধে লাগল | ওর মিহি, কোঁকড়ানো, উড়ো কিছু বেসামাল চুলের স্পর্শে বহুদিন পরে চূর্ণকুন্তল শব্দটা মনে পড়ল | সেই  চুলে একটা চেনা হালকা ফুলেল গন্ধ | শিউরে উঠে আমি ওর দিকে তাকালাম | শিউলি যিশুকে কোলে ঠিক করে নিতে নিতে বলল, “কী এত ভাবছেন ?”
আমি – “এই ভাবে আপনার সাথে দেখা হওয়ার কথা |”
শিউলি হেসে বলল, “এই ভাবে মানে বকুল গাছের ছায়ায় ?”
আমি – “আসলে, আমি এসেছিলাম ঝোঁকের মাথায় | আপনার বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে অপ্রস্তুত বোধ করলাম | গাছের ছায়া পেয়ে মনে হল একটু দাঁড়িয়ে ভেবে দেখি কী করতে চলেছি | এত শান্ত ওই ছায়া যে তন্ময় হয়ে পড়লাম | ... আপনি কেমন আছেন ?”
শিউলি – “ও ! ... আমি ? আমি ভালো আছি ... আর আপনি ?”

পথে যেতে যেতে আমি নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকলাম, শিউলি যিশুর যত্নে | মাঝে মধ্যে গর্তে ভরা রাস্তাটা | গর্তে পড়ার ধাক্কা খেতে খেতে প্রথম প্রথম শিউলি সচকিত হয়ে উঠে একটু সরে বসার চেষ্টা করল | তার মাঝে একবার যিশুর মাথা আমার দিক থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে ওকে আমার গায়ে ঠেস দিতে হল | যিশুকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার বসতে অসুবিধা হচ্ছে, না ?”
আমি বললাম – “না, না | আপনি ওকে ঠিক করে নিয়ে বসুন |”
তখন শিউলি একটু শিথিল হয়ে বসল | আমার গায়ে ওর কৃশাঙ্গ দেহলতার হালকা চাপটা নিয়ে বিচলিত মনটাকে বিক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করে বললাম, “হেলথ সেন্টারে কী দেখাবেন ?”
শিউলি – “এমনি ... ওর ওজনটা নেব, আর একটু ডাক্তার কে জিজ্ঞাসা করব ডি পি টি দ্বিতীয় বার কবে নিতে হবে |”
আমি – “ওর কত বয়েস হল ?”
শিউলি – “তিন মাস | সময় হয়ে গেছে বোধহয়, কিন্তু গত সপ্তাহে একটু গা গরম ছিল বলে নিয়ে আসি নি |”
আমি – “আপনার প্রথম ?”
শিউলি চমকে উঠে বলল, “কী ?” আমার গায়ে লাগা ওর শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে গেল | মুখ ঘুরিয়ে ওর মুখে তাকাতে না পারলেও দেখলাম যিশুর উপর হালকা করে রাখা ওর নিরাভরণ হাতের রোমকূপে কাঁটা দেয়ার চিহ্ন |
নড়ে, সরে বসে, শিউলি বলল, “এই প্রশ্নটা না করলেও পারতেন |”
আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, “স্যরি ! না জেনে অহেতুক প্রশ্ন করে আমি কী ভুল করেছি জানিনা, কিন্তু মাফ চাইছি | আর এরকম হবে না |”

কিছুক্ষণ পরে সহজ গলায় শিউলি বলল, “এসে গেছি |”
দেখলাম সামনে কিছু বাড়ি ঘর শুরু হচ্ছে | তার মধ্যে একটার পোস্টার মারা দেয়ালে লেখা ‘মৌলিপাড়া প্রাইমারী হেলথ সেন্টার’ | বাইরে কিছু নিশ্চল লোক আর কয়েকটা উদ্দেশ্যহীন বেওয়ারিশ কুকুর |
রিকশা থামলে আমি আগে নামলাম | শিউলি নেমে ঘড়ি দেখে বলল, “আপনি দাঁড়ান, আমি যাব আর আসবো | আপনার চিন্তা নেই | মনে হয় ফিরে ট্রেন ধরতে পারবেন |”
কুকুরগুলো দেখিয়ে বললাম, “না, আমি আপনার সাথে যাব |”
শিউলি ভিতরে গিয়ে সোজা ডাক্তারের ঘরে ঢুকে গেল | আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলাম ভিতরে মহিলা ডাক্তারটি একজন রুগী দেখছে | শিউলির সময় হলে ডাক্তার হাসি মুখে আমাকে বলল, “ওখানে দাঁড়িয়ে কেন ? ভিতরে আসুন |” আমি একটু ইতস্তত করে ঢুকলাম | ডাক্তার যিশুকে দেখতে দেখতে কৌতূহলী চোখে আমাকে দেখল এক দু বার | শিউলিকে বলল, “আসছে সপ্তাহে আসুন ডি পি টি দেয়াতে | ওনাকে নিয়ে আসবেন | ওনাকে তো দেখাই যায়না |”

ডাক্তারের ঘর থেকে শিউলি যখন বেরল দেখলাম ওর থমথমে মুখময় লাল আভা | আমি ভেবে পেলাম না, ওর সাথে ডাক্তারের কাছে আসার জন্য ক্ষমা চাইব কিনা |

রিকশার কাছে এসে শিউলি বলল, “ওকে একটু রাখবেন ? আমি ভিতরে গিয়ে শাড়িটা ঠিক করে নিতাম |”
আমি হেসে বললাম, “তাহলে তো সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয় |”
শিউলির থমথমে মুখে একটু হাসির আভাস দেখা দিল | বলল, “না, সেরকম কিছু ব্যাপার নেই | আর, ওর প্রথম দু’মাস তো কেটে গেছে, যখন সব থেকে বেশি চিন্তা থাকে |”
শিউলি যিশুকে সীটে শুইয়ে আমাকে বলল সীটের ধারে একটা হাত রাখতে | আমি যিশুর পাশে হাত রেখে ওর মুখের দিকে চাইলাম | অঘোরে ঘুমিয়ে | ওর ছোট বুকের ওঠাপড়া দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম না শিউলি ভিতরে গিয়ে ফিরে এসেছে | পাশে এসে দাঁড়িয়ে যিশুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “এবার ছাড়ুন |” আমি চমকে হাত সরিয়ে নিতে গিয়ে ওর হাতে আমার হাত লেগে গেল | আমি অপরাধী দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকালাম | ও অতল চোখে গভীর বিস্ময় মাখিয়ে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে রিকশায় উঠে যিশুকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে ?”
আমি মাথা নেড়ে, ‘কিছু না’ জানিয়ে রিকশায় উঠে বসলাম |

বলার বিশেষ কিছু না পেলেও ফেরার পথে রাস্তার ভাঙ্গাচোরা অংশটা যেন চট করে শেষ হয়ে গেল | শিউলি একটু সরে বসল | তারপর সামনে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এবার বলুন |”
আমি – “কী বলব ?”
শিউলি – “এই যে ... কী জন্য এসেছিলেন, কাকে দেখতে, কেন ?”
আমি – “এত প্রশ্ন, একসাথে ?”
শিউলি – “কেন ? আসার উদ্দেশ্য কী একটাই ?”
আমি – “যদি বলি তাই |”
শিউলি – “কী সেই উদ্দেশ্য ?”
আমি – “আপনাকে জানাতে, যে গতকাল আপনার বাবা মা এসেছিলেন আমার অফিসের ঠিকানা খুঁজে |”
শিউলি চমকে উঠে ওর বাঁ হাতে আমার ডান হাত চেপে ধরল | পেলব হাতের তালু, সামান্য আর্দ্র, আঙ্গুলের নখে ধার নেই | আমি নিশ্চল ঋজু  হয়ে সামনে তাকালাম, দেখতে যে ও কী দেখে এই রকম করল | সেরকম কিছুই দেখতে পেলাম না | শিউলি কিছু না বলে চুপ করে থাকল, আমিও তখনই বলার মত আর কিছু খুঁজে পেলাম না |

একটা জায়গা এলো যেখানে রাস্তার ধারে ঝিলের দিকটায় জমিটা একটু উঁচু | সেখানে একটা পুরনো বটগাছ, অজস্র ঝুরি নিয়ে | চারিদিকে তার শুকনো পাতা ঝরিয়ে গাছটা গরম হাওয়ার ঢেউয়ে দুলছে থেকে থেকে | গাছটার তলা দিয়ে একটা পুরনো কয়েক ধাপের ইটের সিঁড়ি ঝিলটার পাড়ে উঠে গেছে | মনে হল সিঁড়িটা ওদিকে নেমে গেছে ঝিলের জলে | রিকশাওয়ালা রিকশাটা গাছটার শতচ্ছিন্ন ছায়ায় দাঁড় করিয়ে বলল, “বাবু, আমি একটু আসছি |” ও সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল | আমি আস্তে করে শিউলির হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে রিকশা থেকে নেমে পা সোজা করলাম | বাচ্চাটা মনে হল ঘুমিয়েই আছে | শিউলিকে স্থাণু হয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কী আর কিছু শুনতে চান না ?” শিউলি শুকনো গলায়, “কী বললেন ওনারা ?” বলে সামনে থেকে দৃষ্টিটা নামিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকাল |

আমিও ওর পায়ের পাতার দিকে তাকালাম | ঈষৎ গর্বিত লম্বাটে বুড়ো আঙ্গুলে রক্তিম লাল নেল পলিশের অবগুণ্ঠন | বাকি চারটে সলজ্জ আঙ্গুল সামনের দিকে অনাবৃত নখে ঢাকা মাথা নত করে কুঁকড়ে গোল হয়ে রয়েছে | যেন সব ফুলের কুঁড়ি, একটি আধফোটা পরিণীতা, বাকি ফোটার অপেক্ষায় কুমারী | ভীষণ ইচ্ছে করল লজ্জায় সংকুচিত আঙ্গুলগুলোর মুখ তুলে সোজা করে সাজিয়ে দেখি পুরো পায়ের পাতা | শিউলি তার আগেই বাচ্চাটাকে এক হাতে বুকের কাছে তুলে নিয়ে অন্য হাতে শাড়িটা হাঁটুর সামনে একটু টেনে পায়ের পাতা দুটো ঢাকতে নামিয়ে দিল |
আমি ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “কালকে ... আপনার মা আমাকে সেই টেলিগ্রামটা দেখালেন |”
শিউলি – “ও |”
আমি – “ওটাতে আপনি কারো সম্বন্ধে লিখেছিলেন ‘... যার জন্য আর যার সাথে বেরিয়েছি সেই জন আমার ভরসা ...’ “
শিউলি – “হুঁ |”
আমি – “তিনি বা সে কে ? আপনার মা ভেবেছিলেন সে আমি | সে কে ?”
শিউলি এবার আমার দিকে দৃষ্টি তুলল | কোলের বাচ্চাটাকে আরও বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল, “মা যাই ভাবুক, আপনি কী ভেবেছিলেন ?”

রিকশাওয়ালাটা সিঁড়ি বেয়ে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে এসে বলল, “রিকশায় বসুন বাবু | আমি একটু মাথাটা ধুয়ে নিলাম | খুব গরম লাগছিল |”

আমি উঠে বসলে শিউলি আবার আমার ডান হাত ওর বাঁ হাত দিয়ে ধরল, আগের মত, তবে আলতো করে | আমার গায়ে ওর ভরসার ভার ফিরে এসে হালকা কুয়াশার মত আমায় গ্রাস করল | গ্রস্ত হতে হতে শুনলাম শিউলি জিজ্ঞাসা করল, “বলুন, আপনি কী ভেবেছিলেন |”
আমি কিছু উত্তর না দিয়ে বসে থাকলাম, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে |
একটু পরে শুনলাম যেন শ্রুতির নেপথ্যে শিউলির স্বগতোক্তি,  “কেন যে, যেই একটা ভরসা পাই, এক নিমেষেই সেটা মেকী মনে হয় ?”
আমি তাও কিছু বলার মত পেলাম না | অনুভব করলাম আস্তে আস্তে আমার বাস্তব জগত, আর কল্পনার জগত সব একটা নিরবচ্ছিন্ন স্বপ্নে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, যেখানে আমাকে বাকি জীবন একটা অন্বেষণে কাটাতে হবে জানতে আমি কী চাই | কেন না, যে আমার ভরসা চাইছে সে এগিয়ে আসবে না আমার যা প্রাপ্য তা আমাকে পাইয়ে দিতে |

ওদের বাড়ি এসে গেলে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালাম | শিউলি নামল | আমি ঘড়িতে দেখলাম প্রায় পাঁচটা বাজে | শিউলিও ঘড়ি দেখল, বলল, “আপনি এখনই রওনা হলে হয়ত সাড়ে পাঁচটার ট্রেনটা পাবেন | যান, এগিয়ে যান | ... ও ! রিকশার ভাড়াটার কী হবে ?”
আমি হেসে বললাম, “হয়ত আবার আসবো | টেলিগ্রামের হিসাব ও তো বাকি আছে |”
শিউলি – “টেলিগ্রামের ?”
আমি – “টাকার নয়, কথাগুলোর | সব যোগ করে একদিন চুকিয়ে দেবেন |”
শিউলি – “কবে ?”
আমি – “কেন ? আপনি আর কতদিন আছেন ? এখানে ?”
শিউলি – “এর অন্নপ্রাশন অব্দি |”
আমি – “আমাকে ডাকবেন তো ?”
শিউলি একটু ম্লান হেসে বলল, “জানি না | ... যান, আর দেরী করবেন না |”

আমি রিকশায় উঠতেই দুরে এক দল লোকের রেহাই পাওয়ার কলরোল শুনলাম | শিউলি, “ওই বোধহয় অরুণদা’র অফিসে ছুটি হল” বলে হাত নাড়ল বিদায় জানাতে | ওর কোলে যিশু নড়ে উঠল | শিউলি ওকে দেখতে মাথা নামাল | যিশুকে একটা চুমু খেয়ে আমার জগত থেকে নিজের জগতে মিলিয়ে গেল |

বিদ্যুৎ পর্ষদের গেটের কাছে এসে দেখি লোকজন বেরচ্ছে | তাদের মধ্যে থেকে একজন আলাদা হয়ে আমাকে হাত নাড়ল | অরুণ | আমি রিকশা থামাতে বললাম | অরুণ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, “দেখতে এসেছিলেন বুঝি ?”
আমি প্রশ্নটা না ধরতে পেরে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলাম | অরুণ আবার প্রশ্ন করল, “কেমন দেখলেন, যিশুকে ?”
আমি – “যিশু ? ও হ্যাঁ ... ঠিকই তো মনে হল |”
অরুণ – “আচ্ছা | ... আর আপনি কেমন আছেন ?”
আমি – “ভালো | আপনি ?”
অরুণ – “আমি, আমরা দুজনেই, ভাল আছি | আমরা আপনাকে আরও আগে আশা করছিলাম |”
আমি – “ও | আমি তো সেরকম কোন আভাস পাইনি সেবার |”
অরুণ – “বা রে | আপনি যে ফিরে যাওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি আবার আসতে পারেন কি না যিশু কে দেখতে |”
আমি – “বলেছিলাম বুঝি ?”
অরুণ – “হ্যাঁ | আমরা তাই ভেবেছিলাম আপনি এসে মাঝে মধ্যে দেখে যাবেন যিশুকে |”
আমি – “ওর নাম তাহলে যিশুই রাখলেন ?”
অরুণ – “হ্যাঁ, দুজনেরই, মানে আমার আর শেফালীর নামটা খুব পছন্দ |”
আমি – “আর শিউলির ?”
অরুণ – “শিউলির ...  ও তো ওর ভূমিকা শেষ হলেই চলে যাবে |”
আমি – “ওর ভূমিকা শেষ হলেই ... ”
অরুণ – “হ্যাঁ, তিন মাস তো কেটেই গেল | আর তিন মাস |”
আমি – “আচ্ছা, যিশুর জন্ম কি বাড়িতে হয়েছে ?”
অরুণ – “কেন ?”
আমি – “দেখলাম শিউলি যিশুকে হেলথ সেন্টারে দেখাচ্ছে |”
অরুণ – “না, না | বাড়িতে কেন হবে ? শিউলি আপনাকে বলেনি ? ওকে আমরা দিয়েছিলাম এখানেই, একটা ভালো নার্সিং হোমে |”
আমি – “ও ! আমি জানতাম না |”
অরুণ – “হ্যাঁ | ... আপনি তো সাড়ে পাঁচটার গাড়িটা ধরবেন বোধহয় ? তা না হলে বাড়িতে এক কাপ চা খেতে ডাকতাম |”
আমি – “আজ থাক |”
অরুণ – “আচ্ছা, তাহলে চলি | আমাকে আবার চা খেয়েই অফিসে ফিরতে হবে | ... পরে কখনও কথা হবে |”

আমাকে মৌলিপাড়া অব্দি রিকশায় যেতে হল না | পাওয়ার সাপ্লাই লেন থেকে হাইওয়েতে উঠেই একটা অটো পেয়ে গেলাম | পিছনে তাকিয়ে দেখলাম অরুণকে তখনো দেখা যাচ্ছে রাস্তায়, ওর বাড়ি প্রায় পৌঁছে গেছে | চট করে রিকশা থেকে নেমে ভাড়ার উপর কিছু বেশি টাকা বের করে রিকশাওয়ালাকে দিলাম | লোকটা টাকা গুনে অবাক হল, তারপর খুশি | আমার একটা কার্ড বের করে হাত দিয়ে অরুণ কে দেখিয়ে বললাম, “যাও | এই এটা ওকে দিয়ে দাও |” ও হাসিমুখে কাজটা নিয়ে রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেল | দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম অরুণ বাড়িতে ঢুকল, রিকশাওয়ালা পৌঁছল, শিউলি বেরিয়ে এলো | আমি অটোর ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে  বললাম, “স্টেশন চলো, সাড়ে পাঁচটার গাড়িটা ধরতে হবে |”

স্টেশন পৌঁছতে পৌঁছতে পাঁচটা চল্লিশ হয়ে গেল | ট্রেনটা পাওয়ার আশা আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম | অটোর ড্রাইভার স্টেশনের প্রথম প্রান্তে নামিয়ে বলল, “স্যার, ভাড়াটা চট করে দিয়ে ছুটে যান | গাড়িটা এখনো ছাড়ে নি | দৌড়লে পেয়ে যাবেন |” নেমে টাকা দিয়ে ছুটলাম ওই প্রান্ত থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠে | দেখলাম পার্সেল ভ্যানে মাল তোলা হচ্ছে | কামরায় উঠেও হাতে একটু সময় পেলাম | জায়গা খুঁজে বসলাম | ট্রেন ছাড়ল |

ছ’টা নাগাদ মোবাইলটা বাজল | অপরিচিত নম্বর | তুলে বললাম, “প্রবাল” | আবছা মেয়েলি গলায় বলল কেউ, “ট্রেনটা ধরতে পেরেছেন ?”
আমি – “কে শিউলি ? ... হ্যাঁ, কোনমতে |”
শিউলি – “আপনার খুব ছুটোছুটি হল, না ?”
আমি – “না তো |”
শিউলি – “বসার জায়গা ?”
আমি – “পেয়েছি |”
শিউলি – “আর কিছু, বলার মত ?”
আমি – “এই তো কথা হল ...”
শিউলি – “তাহলে রাখি ?”
আমি উত্তর দেয়ার আগে শিউলি ফোন রেখে দিল | আমি নম্বরটার সাথে অরুণের নাম লিখে রাখতে গিয়ে খেয়াল হল ওর পদবীটা মনে নেই | তখন লিখলাম ‘অরুণ – যিশু’ | ঠিক পছন্দ হল না | অরুণের অফিসে ফিরে যাওয়ার কথা মনে পড়ায় শেষে লিখলাম ‘শিউলি – আরামবাটী’ |

সারা রাস্তায় কতবার যে মনে হল মোবাইলটা বাজছে, আর বের করে দেখলাম |

বাড়ি ফিরে জামা কাপড় বদলে, মুখ হাত ধুয়ে, ফ্রিজ থেকে কিছু একটা বের করে খেয়ে শুয়ে পড়লাম | আবার উঠে মোবাইলটা বালিশের তলায় নিয়ে শুলাম | দেখলাম ওতে সময় দেখাচ্ছে সাড়ে বারোটা | আর ফোন আসার আশা নেই মনে হল | সবে তন্দ্রা এলো আর মোবাইলটা বাজল | তুলে দেখলাম নামটা,  ‘শিউলি – আরামবাটী’ | এত রাত্রে ! ফোনটা তুলে সাবধানে বললাম, “প্রবাল” |
শিউলি – “শুয়ে পড়েছিলেন ?”
আমি – “হ্যাঁ, সবে ঘুমটা এসেছিল |”
শিউলি – “আমি জাগিয়ে দিলাম ?”
আমি – “না, বলুন | এত রাত অব্দি আপনি জেগে ?”
শিউলি – “ও আজ কিছুতেই ঘুমচ্ছিল না | এতক্ষণে ঘুম পাড়িয়ে সময় পেলাম |”
আমি – “ও বলতে যিশু ?”
শিউলি – “আপনি কি ওকে যথার্থ যিশু মনে করেন ?”
আমি – “কোন অর্থে জানি না | ওকে প্রথম দেখে ওই নামটাই মাথায় এসেছিল |”
শিউলি – “কেন ?”
আমি – “আচ্ছা, আপনি কি এই কথা জানতে এত রাত্রে ফোন করেছেন ?”
শিউলি – “না, তা নয় | আমি একটু উদ্বিগ্ন ...”
আমি – “কেন ? আপনি তো জেনেই গিয়েছিলেন আমি ট্রেনটা ধরতে পেরেছি |”
শিউলি – “ওই একটা কথায় কি উদ্বিগ্নতা কাটে ?”
আমি – “কিসের উদ্বিগ্নতা ?”
শিউলি – “আপনার চেহারা এত খারাপ হয়ে গেছে | এবার আপনাকে দেখে আমি চট করে চিনতে পরিনি | মনে হল অনেকদিন ঘুম, খাওয়া দাওয়া কিছুই হয়নি ঠিক করে | ... বাড়ি ফিরে আপনি কিছু খেয়েছেন ?”
আমি – “হ্যাঁ |”
শিউলি – “ঘুম পেয়েছে ?”
আমি – “না বলি কী করে ?”
শিউলি – “তাহলে আমি রাখি ?”
আমি – “আমি কিন্তু এখনো জানতে পারলাম না আপনি কেন এতো রাত্রে ফোন করেছেন |”
শিউলি – “যদি বলি, ঘুম আসছে না | যদি বলি, কিছু কথা বলে দেয়ার কেউ নেই |”
আমি – “কী কথা ?”
শিউলি – “এলোমেলো জটিল সব প্রশ্ন |”
আমি – “শুনি তাহলে | দেখি উত্তর পাই কি না |”
শিউলি – “যেমন,আপনি কেন আমায় বলবেন না আপনি কী ভাবেন আমার ওই টেলিগ্রামের কথা নিয়ে ? যেমন, কেন আজ আপনি আমার হাতে আপনার হাত ঠেকলে এত সংকুচিত হয়েছিলেন ? পরে আপনি আমার পায়ের পাতায় কী দেখছিলেন ? কেন সব সময় আপনি আমার দিকে তাকালে আমার চোখের দৃষ্টি ধরে আমার ভিতরে উঁকি দেন ?”
আমি – “শুধু এই কটা প্রশ্ন ?”
শিউলি – “এই রকমই আরও কত কী ... সব প্রশ্নের শেষ প্রশ্ন, আপনি কী খুঁজছেন আমার মধ্যে, বারে বারে এসে ?”
আমি – “হয়ত খুঁজছি কিছু |”
শিউলি – “কী ?”
আমি – “সেটাই তো জানি না |”
শিউলি – “আমার সেই ভয় | ভয়, ওই অজানার খোঁজে আপনি আবার আসবেন | আসবেন, যখন আমি আর থাকব না |”
আমি – “আপনার কি মনে হয় না তাতে আমার এই অন্বেষণের ইতি হবে ?”
শিউলি – “মনে হয় ? ভয় হয় | ভয়, যে আপনি হয়ত এই খোঁজে নিজেকে শেষ করবেন | নয়, আমার মধ্যে আপনার খোঁজা শেষ হলে আমরা দু’জনেই শেষ হব | এই নিয়ে আমার আসল উদ্বিগ্নতা ... তাই এতো রাত্রে ফোন করেছি |”
আমি – “শিউলি ! ... এত কথা তো একবারে বলার মত নয় |”
শিউলি – “না নয় | তা আমি জানি | তবু আমার যা বলার তা বলতে আর দেরী করতে চাইনি | বলা হল | এখন রাখছি |”

------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৬ জানুয়ারি ২০১৪






কোন মন্তব্য নেই: