আমার থেকে কয়েক মাসের বড় আমার মাসতুতো ভাই দিনেশ থাকত শিরিনীতে | শিরিনী আমাদের দক্ষিণাপুর থেকে বোম্বাইয়ের দিকে তিনটে স্টেশন পরে | মেসোমশাই শিরিনীর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে সুপারভাইজারের কাজ করতেন | মাইনে খুব একটা ভালো ছিল না, তার উপর বড় সংসার | দিনেশ ছিল ভাই বোনেদের মধ্যে সবথেকে বড়, বয়েসের তুলনায় বিচক্ষণ, আর আমার খুব প্রিয় |
মেসো রেলের পাশ নিয়ে দু’ চার মাসে একবার ঢুঁ মেরে যেতেন | আসতেন বিকেলের দিকে | বাবা অফিস থেকে ফিরে দেখে একটুও অবাক না হয়েই বলত, “আরে, দেবলদা যে !” তারপর বাবা সাইকেলটা রেখে, ধীরে সুস্থে জামা কাপড় ছেড়ে, হাত মুখ ধুয়ে গামছাটা মেলে, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে খাটে মেসোর পাশে বসত | মা মুড়ি - নারকেল থাকলে নারকেল কুচি দিয়ে - আর চা খেতে দিত | তখন খাটের উপর পা তুলে বসে দুজনের গল্প শুরু হত | আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম, কেন না সেদিন আর বাবা আমার পড়া দেখতে বসত না | ফাঁকি দিলেও বাবার কাছে বকুনি দেয়ার সুযোগ হত না | মা রাত্রে খেতে দেয়া অব্দি সেই গল্প চলত | খেয়ে উঠেও গল্প চললে আমি ঘুমে ঢলে পড়তাম | ঘুমের ঘোরে এক সময় টের পেতাম মেসো উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাটো করে বলছেন, “রমেন, আমি তাহলে আসি | সাড়ে এগারটার এক্সপ্রেসটা ধরব |” বাবা বলত, “যেতে চাও ? রাতটা কাটিয়ে গেলে হত না ?” মেসো বলতেন, “না, থাক | ইয়ে ... বলছিলাম কি, কিছু টাকা হবে ?” আমি শুনতাম বাবা, “কত ?”, বলে দেরাজ খুলছে | মেসো আরও আস্তে করে কিছু বললে, বাবা বলত, “অত তো দিতে পারব না | যা আছে, তাই দিচ্ছি, নাও |”
আর, এক আধ বার দিনেশ দক্ষিণাপুরে এসেছে, একা একা, বই কিনতে, যে হেতু শিরিনীতে স্কুলের সব বই পাওয়া যেত না | দিনেশ আসত সকালের ট্রেনে | এসে আমাদের বাড়িতে উঠে জলখাবার খেয়ে স্টেশনে ফেরার পথে বইয়ের দোকান থেকে বই কিনে ফিরে যেত | আমি অবশ্য ওর সাথে বইয়ের দোকান অব্দিও যেতাম না, কেন না তখনো আমাকে বাড়ি থেকে বেশি দূরে একা ছাড়া হত না |
আমার মনে পড়ে না মেসো কখনো মাসি আর মাসতুতো ভাই বোনদের সবাইকে সাথে নিয়ে এসেছেন, যদিও এক আধ বার মেসো মাসীকে ট্রেনে তুলে দিয়েছেন কোনও এক ছেলে বা মেয়ের সাথে | মাসি এসে ক’দিন থেকে ফিরে গেছেন | মাসি ছিল মায়ের মেজ দিদি | শক্ত শরীর, যেমন দরকার হয় অনেক ছেলে মেয়ের সংসার সামলাতে | হয়ত ওই শক্ত শরীরের জন্যই সংসারটা এত বড় হয়েছিল | গায়ের রং ঘোর শ্যামল, এমন কী ঠোঁট দুটোও ছিল প্রায় কালো | মস্ত খোঁপা, আর চিবুকে একটা বড় কালো আঁচিল নিয়ে মাসির মুখটা ছিল ভারী মিষ্টি | কথায় কথায় হাসতেন সাদা ধবধবে নিখুঁত দাঁত মেলে | তখন ঘন কালো লম্বা পলকের ঝাঁপ তোলা চোখের কোনের চামড়া কুঁচকে হাজার ভাঁজ পড়ত | দেখে মনে হত না অত বড় অভাবের সংসার নিয়ে মাসির কোনও কষ্ট আছে | ফিরে যাওয়ার আগে বাবা মাসির হাতে কিছু টাকা দিয়ে প্রণাম করে বলত, “হাসিদি, টাকা কটা রাখো | নিজের কাছে রেখ, দেবলদার হাতে দিও না যেন |” মাসি তখন বাবার থুতনি ধরে আদর করে বলতেন, “রমেন, তুমি এস না একবার সবাই কে নিয়ে |”
বলতে অবশ্য হত না | এমনিতেই বছরে অন্তত একবার আমরাও শিরিনী যেতাম | মেসোর ছোট ঘরে কদিন গুঁতোগুঁতি করে খুব ভালো কাটত | রেলের ছোট কলোনি, মাঝে একমাত্র পীচের রাস্তার সিঁথি | এক পাশে বড় সাহেবদের খসখসের পর্দা ঝোলানো টানা বারান্দার পিছনে বাংলো, ফুলের বাগানে ঘেরা | সেই সব বাগানে কত বড় বড় গাছ - কিছু ফলের, কিছু অচেনা ফুলের | আর রাস্তার অন্য পাশে পীচ রাস্তার আড়া আড়ি কয়েকটা মোরাম ফেলা রাস্তার দু’পাশে পিঠোপিঠি করে ছোট ছোট কোয়ার্টার, কয়েক পায়ের একটা বাগানের পরে কাঠের জাফরি দেয়া তার বারান্দা | বেশির ভাগ বাগানে গাঁদা, জবা, সূর্যমুখী ফুলের গাছ কিম্বা পেঁপে কি পেয়ারার গাছ | বড় গাছ খুব কম | পরিষ্কার বোঝা যেত পীচ রাস্তার দু’পাড়ের তফাৎ কোথায়, কী ভাবে |
অবশ্য তাতে কোন অসুবিধা ছিল না | মেসো কারখানা থেকে বাতিল করা টুকি টাকি পার্টস এনে দিনেশ কে দিতেন | ও আর আমি তাই নিয়ে খেলতাম | আমার মনে আছে কারো ফেলে দেয়া মেকানো সেট আর মেসোর আনা টুকিটাকি লোহার পাত্তি, স্ক্রু, নাট আর বল্টু দিয়ে ওর বানান একটা ক্রেন ছিল | একটা মোটা তারের হাতল ঘুরিয়ে তার ভার তোলার আঁকশিটা উঠানো নামানো যেত | কিন্তু ওটা দিয়ে সামান্য ভারও তুলতে গেলে ক্রেনটা মুখ থুবড়ে পড়ে যেত | দিনেশ বলত, “এটা একটু ঠিক করতে হবে | কিন্তু একদম সময় পাচ্ছি না |” ক্রেনটা নিয়ে আমার কৌতূহল মিটে গেলে দিনেশ বলত, “চল মাঠে যাই | দেখি কে কী করছে |”
শিরিনীর ওই রেলের কলোনিতে সব মরশুমেই ছেলেরা ক্রিকেট খেলত | রেলের কলোনিতে নানান ধরনের ছেলে তেলেগু, পাঞ্জাবি, বিহারী | তার মধ্যে দিনেশের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল টুকটুক বলে একটা তেলেগু ছেলে | আমার খুব আশ্চর্য লাগত যে ওই বয়েসে টুকটুক সব হিন্দি সিনেমার গান জানত | কলোনিতে প্রায় সব সময় কারো না কারো বাড়িতে রেডিও বাজত | শান্ত কলোনি, তাই এক বাড়ির শব্দ অনেক দূর অব্দি শোনা যেত | সারাদিনই কেউ না কেউ বিবিধ-ভারতী লাগিয়ে রাখত | এ ছাড়া রেডিও সিলোন | মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে ট্রেনের বা মালগাড়ির আওয়াজ | চলে গেলেই আবার গানের সুরেলা ঢেউ ফিরে এসে আছড়াত | গরমকালে তার সাথে বাংলোগুলোর দিক থেকে আসা হওয়ায় নাম না জানা ফুলের অস্থির করা গন্ধ | ফেরার দিন এই সব মিলিয়ে বড্ড ঘুম পেত | মনে হত শিরিনীতে থেকে যাই, কী হবে দক্ষিণাপুরে ফিরে |
শিরিনী স্টেশনের ওপারে ছিল ছোট আদিম শহরটা | সটান উঠে যাওয়া একটা সংকীর্ণ গলির দুপাশে তরকারী, মাছ, ডিম বিক্রি হত | একটু এগিয়ে গেলে কাঁচের চুড়ি, মুদী, মনিহারি, রঙিন মিষ্টি, বই-খাতা, রেশন, কেরোসিন, হ্যাজাক, লোহা লক্কড়ের দোকান | প্রায় সব দোকানেরই ভিতরের দিকে আধো আঁধারে নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘোমটা দিয়ে বসা বাড়ির বউ, কি বাচ্চা, আর ওখান থেকে ভেসে আসা পুরনো পারিবারিক ব্যবসায়ের অচেনা মন উদাস করা ম ম গন্ধ | তারপর কয়েকটা মারোয়াড়ীদের পাকা বাড়ি | ওই পাড়াটা শেষ হলে গলিটা চওড়া হয়ে ঢালে নেমে, আর বাড়িগুলো ছোট মাটির হয়ে হয়ে দূরে সরে যেতে যেতে তিনদিক ফাঁকা শাল, পলাশের মাঠে শহরটা শেষ হত | শেষের দিকের বিহারীদের টালির ছাদের ইটের বাড়িগুলোর উঠোনে দেখতাম আম জামের গাছতলায় গোরু, মোষ বাঁধা | সাঁওতালদের তাল পাতা কি খড়ের ছাদের বাড়ির ন্যাড়া উঠোনে এক আধটা পলাশ কি শিমুল গাছতলায় ছাগল আর মুরগী চরে বেড়াত | কখনো তাদের কোনও বাড়ির ভিতর থেকে আবলুস কালো মেয়েমানুষ বেরিয়ে এসে অবাক চোখে দেখত আমাদের | দিনেশ তার দিকে তাকিয়ে হাসত | কখনো কখনো ওদের ভাষায় কিছু বলত যা আমি বুঝতাম না | শেষে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলত, “চল, এবার বাড়ি ফিরি |”
ওই বয়েসে আমার মনে হত দিনেশ আমার থেকে অনেক কিছু বেশি জানে বা বোঝে | যেমন, কখনো দিনেশ আমাকে নিয়ে ওভারব্রিজ ছেড়ে পায়ে হেঁটে রেল লাইন পার হত | তখন লাইন এর মাথায় বিজলী তার খাটিয়ে সবে ইলেকট্রিক ইঞ্জিন চালানো শুরু হয়েছে – শুধু কিছু মালগাড়ি টানে | তারের নিচ দিয়ে রেল লাইন পার হওয়ার সময় দিনেশ আমার হাতে ওর হাত ছুঁইয়ে দেখাত হাতে কাঁটা ফুটছে | একবার বলল, “এই যে মাথার উপর তার, ওতে কত ভোল্ট আছে জানিস ?” আমি মাথা নাড়লে বলল, “দেখছিস তো গায়ে কেমন কাঁটা ফুটছে হাই ভোল্টের জন্য |” “কত ভোল্ট ?”, আমি জিজ্ঞাসা করলে ও দেখাল বিজলী তারের থামে লাল রঙের বোর্ড | তাতে কঙ্কালের মাথা আঁকা, আর লেখা কত ভোল্ট | কখনো কোনও ট্রেন আসতে দেখে ও বলত, “এটা থ্রু যাবে বুঝলি |” তারপর চট করে পকেট থেকে একটা পেরেক বা তারের টুকরো বের করে রেল লাইনের উপর রেখে দিত | ট্রেনটা চলে গেলে দেখতাম সেটা চিঁড়ে চেপটা হয়ে গেছে | সাথে সাথে তুললে দেখতাম ওটা তখনও বেশ গরম |
আমি নিজেকে কিছুতেই দিনেশের সমকক্ষ মনে করতে পারতাম না | মুখে যাই বলি মনে মনে খুব সমীহ করতাম যে শিরিনীর মতো একটা ছোট জায়গায় থেকেও, ও আমার থেকে অনেক ব্যাপারে কত বেশি এগিয়ে ছিল |
আমার এই সম্ভ্রমের দুটো বিশেষ কারণ ছিল | প্রথমত, দিনেশের কথা বার্তা থেকে আমার ধারণা হয়েছিল যে মেয়েদের সম্বন্ধে ও আমার থেকে বেশি জ্ঞান রাখত | পাড়ার সব মাসিমা, কাকিমা ওকে চিনত, বাড়িতে ডাকত, নানান কাজ দিত | আর পাড়ার সব মেয়েদের ও চিনত | আমি খুব মুখচোরা ছিলাম বলে ও আমাকে কারো সাথে আলাপ করিয়ে দিত না | কিন্তু কারো সাথে দেখা হওয়ার পরে ও আমাকে তার সম্বন্ধে এমন এমন কথা বলত যে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতাম, “তুই কী করে জানলি ? ও কি তোকে বলেছে ?” তখন দিনেশ অদ্ভুত ভাবে হেসে বলত, “ও তুই বুঝবি না | তবে শোন, তুই কিন্তু এই সব কথা মা কে বলবি না | দেবেশ কেও নয় |” দেবেশ ছিল দিনেশের ভাই, আমার থেকে কয়েক বছরের ছোট | খুব সাদাসিধে আর একটু বোকা | ও কখনও কখনও আমাকে দিনেশের কিছু কথা এমন ভাবে গোপনে বলত যে মনে হত সেটা গুপ্ত কথা | দিনেশের সাথে আমার প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা ছিল ওইটুকু, দেবেশের কাছে প্রতিপক্ষের গূঢ় তথ্য সংগ্রহ করা |
আমার ওই বয়েসে সিনেমা দেখা মানা ছিল | দিনেশ রেলওয়ে ইন্সটিটিউটে হিন্দি সিনেমা দেখত | এটাও আরেকটা ব্যাপার ছিল ওর আমার থেকে জ্ঞানগম্যি বেশি হওয়ার কারণ | ওই সিনেমা দেখে দেখেই টুকটুকের সব হিন্দি গান মুখস্থ ছিল | আমরা ক্রিকেট খেললে দিনেশ আর টুকটুক আমাকে ওদের পক্ষে নিত না | আমি ব্যাট করতে নামলেই টুকটুক স্পিন বল দিয়ে, কিম্বা দিনেশ গায়ের জোরে গুড লেন্থ বল ছুঁড়ে আমাকে আউট করে দিত | খেলা শেষ হলে আমরা তিনজন কলোনি যেখানে শেষ হয়েছে তারপর একটা জলের নালার ধারে গিয়ে ঘুরতাম | দিনেশ আর টুকটুক কী যে খুঁজত আমি বুঝতাম না | অনেকক্ষণ পরে দুজনের একজন পাথর কুড়িয়ে অলস ভাবে ছুঁড়ে জলে ফেলত | তখন অন্যজন বলত, “বাড়ি ফেরা যাক |”
একবার ওই ভাবে ঘুরতে ঘুরতে টুকটুক একটা গান গুনগুন করে উঠলে দিনেশ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুই এই গানটা শুনেছিস ?” আমি অন্যমনস্ক ছিলাম নালার জলের ধারে কিছু গাঁদা ফুলের চারা দেখে | ওগুলোয় কী রঙের ফুল হবে সেই কথা ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন গান ?” তখন দিনেশ কিছুটা বেসুরো গলায় গেয়ে শোনালো,
“তেরা, মেরা, প্যার অমর,
ফির কিঁউ মুঝকো ল্যগতা হ্যয় ডর |”
আমি চুপ করে থাকলে দিনেশ গানটা শেষ করে বলল, “এটা আমার খুব ফেভারিট |” আমি একটু চিন্তা করলাম | আমি দক্ষিণাপুরে অনেকবারই মাইকের মাধ্যমে গানটা শুনেছি | কখনোই আমার গানটা তেমন কিছু মনে হয়নি | আমি বরঞ্চ রবিবারের দুপুরের অনুরোধের আসরের গান বেশি পছন্দ করতাম | আমি খুব দমে গেলাম যে, একটা গান যেটা আমি গণ্যই করিনি সেটা এত মিষ্টি যে দিনেশের অতি প্রিয় | আমার আবার মনে হল আমি দিনেশের সমান মোটেও নই, হয়ত হবও না কোনোদিন | বুঝলাম মেয়ে ও প্রেমের ব্যাপারে দিনেশ চিরকাল আমার থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে | আমি ওর ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারব না | মনটা আরও দমে গেল | দিনেশের প্রতি আমার সম্ভ্রমের দ্বিতীয় কারণ যোগ হল এইভাবে |
একই বছর আমি দক্ষিণাপুর বয়েজ হাই স্কুল থেকে হায়ার সেকন্ডারী পাশ করলাম, আর দিনেশ শিরিনীর রেলের একমাত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিক | আমি চলে গেলাম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে | মেজ মেসো দিনেশকে আর পড়াতে পারবেন না বুঝে দাদু ওকে বেলডাঙায় ডেকে নিলেন ওখান থেকে পড়াশুনা করাতে | আমি কলেজে বন্ধু বান্ধব পেয়ে দিনেশের সঙ্গ ভুলতে লাগলাম | এরপর দিনেশের সাথে দেখা হল শুধু কলেজের দ্বিতীয় বছর, যখন চিঠিতে বাবা, মা দেশে যাচ্ছে জেনে আমি কলেজ থেকে বেলডাঙা গেলাম ওই সুযোগে | গিয়ে দেখলাম ওরা গ্রামে চলে গেছে | কটা দিন বেলডাঙায় কাটিয়ে দেখলাম দিনেশ দিব্যি আছে | যদিও কোন মেয়ে বন্ধু হয়নি বলেই মনে হল – যেটা আমি আশা করিনি | তবে দেখলাম ও মেজ মামার মেয়ে বন্ধুদের সাথে খুব ভাব করে নিয়েছে |
আমার দাদু স্কুলে থেকে রিটায়ার করে বাড়িতে টিউশন দিতেন | বেশির ভাগই স্কুলের শেষের দিকের কিম্বা সবে কলেজে ওঠা ছাত্রী | সবার সাথে মেজ মামার ছিল ভাব, বাড়িতে যাওয়া আসা | মামা তাদের কারো কারো দিদি বা অবিবাহিত মাসি, পিসির সাথেও আলাপ রাখত | সেই সুবাদে দেখলাম দিনেশও তাদের সাথে মেলা মেশা করে | কিন্তু বলার মত কিছু গল্প দিনেশ বলল না | আমি একটু ঈর্ষা কাতর হলাম, যে ও হয়ত এই পরিস্থিতিতেই একদিন জীবনসঙ্গিনী খুঁজে পাবে, কোন বিশেষ চেষ্টা না করেই |
এর পর আর দিনেশের সাথে যোগাযোগ থাকেনি | আমি কলেজ থেকে ফিরলে মায়ের কাছে কখনও কিছু এক-আধটা খবর পেতাম | কিন্তু আমার বিশেষ কৌতূহল হত না খুঁটিয়ে জানার |
আমি কলেজে থাকতেই মেজ মামা এক বান্ধবী কে বিয়ে করল | স্কুলের বয়েসে আমি মেজ মামার সাথে তার বাড়ি গিয়েছি | নিম্ন মধ্যবিত্ত এক পরিবারের মেয়েটির হাতে বানান মামার বহুচর্চিত চর্বির বড়া আর চা খেয়েছি | মামাকে দেখেছি তার সাথে হালকা কথাবার্তা করতে কিম্বা ইয়ার্কি মারতে | হবু মামীমার হাঁপানির রোগ ছিল, তার ছায়া ছিল ক্লান্ত চোখের কালো কোলে | সেই মায়াতেই মামা ওকে বিয়ে করল কি ? জানি না | যা জানি, দুজনে সুখী হয়েছিল, যদিও মামীমা পূর্ণ জীবন ভোগ করার আগে মারা যায় |
একবার মায়ের কাছে শুনলাম দিনেশ বিয়ে করছে | মেয়েটি নার্স, ওর থেকে বয়েসে বড়, গায়ে শ্বেতি আছে | সবারই ঘোর আপত্তি, একমাত্র মেজ মামা ছাড়া | মা আরও জানল যে একবার মেজ মামা হাসপাতালে ভর্তি হলে ওকে দেখতে দিনেশ যেত, তখন এই মেয়েটি অ্যাটেন্ডেন্ট নার্স ছিল | সেই আলাপ থেকে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে বিয়ে | এর বেশি মা বলতে চাইল না, না কি বলতে পারল না | শুধু বলল, “মেজদির যাও বা আশা ছিল যে ছেলেটা চাকরি করলে একটু টাকা পয়সার মুখ দেখবে, তাও গেল |” আমি বললাম, “কেন ?” মা আর তার উত্তর দিল না | সেই সাথে, ‘দিনেশ ও কি মেজ মামার মত মায়া করে বিয়ে করল ?’, এই প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে গেল | পরে শুনেছিলাম দিনেশ পড়তে পড়তে টেক্সটাইল পড়া ছেড়ে দিয়ে সরকারী অফিসে কেরানি হয়েছিল | নিজের আর স্ত্রীর আয় জুটিয়ে কোন মতে মেয়ে দুটো মানুষ করছিল |
চাকরি জীবন শুরু হল | হাঁফ ধরা প্রতিযোগিতার জীবনে ক্বচিৎ দূরে মাইকে বাজা দিনেশের সেই ছোট বেলার প্রিয় গানটা শুনলে ওর কথা মনে পড়া ছাড়া ওকে ভুলেই গেলাম | ছেলে মেয়ে বড় হল, আলাদা হল | বাবা, মা মারা গেল | আমি রিটায়ার করলাম | প্রতিমা অকালে বিদায় নিলো | পর পর দুই মামা মারা গেল | খবর পেয়েও যাওয়া হল না, যদিও মনে হল যে গেলে হয়ত একবার দিনেশ কেও দেখে আসতে পারতাম | এই ভাবে কোনও দিন নিজের আর ওর স্ত্রীকে একসাথে পাশাপাশি দেখা হল না | দেখেই বা কী জানতাম – কে কী পেলাম জীবনে, শুধু এই মাত্র ?
এই নিস্তরঙ্গ শেষের জীবনে একদিন ফোন বাজলো, “অমিয়, আমি মিহির, ছোট মামা, বলছি |”
খুব অবাক হয়ে বললাম, “আরে, কী ব্যাপার ? কোথা থেকে বলছ ?”
মামা – “কেন ? বেলডাঙা থেকে ... তোরা সব ভালো আছিস তো ?”
আমি – “হ্যাঁ ... তোমরা ?”
মামা – “হ্যাঁ, হ্যাঁ | শোন, যে জন্য ফোন করেছি – রবিনের, মানে আমার ছোট ছেলের ... অবশ্য তুই তো দেখিস নি, কত বছর হল দেখা নেই ... বিয়ে সামনের মাসে | তোরা আয় | আমি বিয়ের চিঠি পোস্ট করব | কিন্তু আগেই মুখে জানিয়ে রাখছি | তোদের আসতেই হবে |”
আমি – “মামা, আমাদের বলতে আমি তো এখন একা |”
মামা – “কেন ? প্রতিমা ?”
আমি – “ও তো আর নেই, দু’ বছর হয়ে গেল | খবর তো পাঠিয়েছিলাম |”
মামা – “ও ! কী হয়েছিল ? ... না এখন থাক | অনেক গুলো ফোন করার আছে | তুই আয়, বসে সব শুনব |”
আমি – “বলার মত বিশেষ কিছু নেই | ... দেখি | আসলে এতদিন যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি |”
মামা – “কত বছর দেখা হয়নি বলত ?”
আমি – “বোধহয় ১৯৬৬ সালে শেষ গিয়ে থেকেছি | না, একবার ১৯৭৬ এ কলকাতা থেকে গিয়ে দিনের দিন ফিরেছি | সেই শেষ |”
মামা – “না, না তোকে আসতেই হবে | বড়দা, মেজদা সব মারা গেল, তুই এলিই না, কত যে ব্যস্ত থাকিস |”
আমি – “না, এবার আসবো |”
মামা – “হ্যাঁ, আয় | সকলের সাথে দেখা হয়ে যাবে, এই সুযোগে |”
আমি – “সেই ... দিনেশের সাথে ও তো দেখা হয়নি কত বছর | ও তো বেলডাঙায় আছে না ?”
মামা – “দিনেশ ? কী রে ? তুই কি কিছুই খবর রাখিস নি আমাদের ?”
আমি – “কেন ?”
মামা – “দিনেশ মারা গিয়ে চার বছর হয়ে গেল | তাই বলছি, যোগাযোগ না রাখলে কোনদিন দেখবি আমরা কেউ নেই |”
আমি – “দিনেশ মারা গেছে ? কী বলছ তুমি ? কী হয়েছিল ? ওর ফ্যামিলি কোথায় এখন ?”
মামা – “আয়, না | তুই আয়, ঘুরে যা | একবার সবাইকে দেখে যা | আমার ও বয়েস আটাত্তর হতে চলল | এই শেষ কাজটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে বাঁচি | আয়, এসে আমায় দায়মুক্ত কর |”
আমি – “না, তুমি আগে দিনেশের কথা বল | কী হয়েছিল ওর ?”
মামা – “দিনেশের ... কী বলব ... প্রেশার ছিল, সুগার ও | হটাত করে ঠাণ্ডা লাগল, নিউমোনিয়া মত হল | বেশ ক’দিন ভুগে শেষ | সরলা অনেক যত্ন করেও বাঁচাতে পারল না | খুব খারাপ অবস্থা ...”
আমি – “সরলা মানে দিনেশের বউ ?”
মামা – “হ্যাঁ | ও, তুই তো বোধহয় তাকেও দেখিস নি | তাই বলছি, আয় না এবার |”
আর বেশি কথা হল না | ফোনটা রেখে মন খারাপ হয়ে গেল | আমি কলেজে যাওয়ার পর এক এক করে দেবেশ, আর তার পর মেজ মাসির বড় মেয়ে দীপ্তি মারা যায় অল্প বয়েসে | তাও মাসি দিনেশের কাছে যান নি | মেসো মারা গেলে সেজ ছেলে পুরুলিয়ায় রেলে কাজ পায় | মাসি সেজ ছেলের সাথে পুরুলিয়ায় থেকে গেছেন |
পরের মাস এলো | যাব কি যাব না, এই নিয়ে কিন্তু কিন্তু করে শেষে গেলাম বেলডাঙায়, সাঁইত্রিশ বছর পেরিয়ে | আলাপ হল অনেক নতুন মুখের সাথে – বড় মামার দুই ছেলে, মেজ মামী আর দুই মেয়ের সাথে, আর ছোট মামী, মেয়ে আর ছেলেদের সাথে | ছোটমামাকে জিজ্ঞাসা করলাম দিনেশের বউয়ের কথা | বলল, “আসতে তো বলেছি, বিয়ের কদিন এখানে খেতেও বলেছি |”
বৌদি এলো বিয়ের একদিন আগে | দরজার ঘণ্টি শুনে আমিই দরজা খুলে দেখলাম পিছনে একটা বাইশ তেইশ বছরের মেয়েকে সাথে নিয়ে কালো সরু পাড় সাদা শাড়ি পরা এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে | অস্পষ্ট চেহারাটা না চিনলেও মুখে শ্বেতির দাগ দেখে কোন সন্দেহ রইল না | বললাম, “সরলা বৌদি ?” | মেয়েটা এগিয়ে বৌদির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনাকে তো চিনলাম না |” আমি বললাম, “চিনবে কী করে ? আমি অমিয়, দিনেশের মাসতুতো ভাই | তোমার বাবার সেজ মাসির বড় ছেলে | জানি না দিনেশ কোনোদিন আমার কথা বলেছে কি না | এসো, ভিতরে এসো |” আমি একপাশে সরে দাঁড়ালে বৌদি মৃদু হেসে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকল | মেয়েটা টুক করে প্রণাম করে বলল, “বাবার কাছে আপনার নাম শুনেছি কাকু | আমি কণিকা | যান, আপনি ভিতরে যান, আমি দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আসছি | কখনো কখনো ছিটকিনিটা ঠিক করে লাগে না |”
আর কোন তেমন কথা হল না ওদের সাথে | দুপুরে খেতে বসলে সরলা বৌদি অন্যদের সাথে খাবার পরিবেশন করল | মনে হল খুব কম কথার মানুষ | অথচ আমাকে জিজ্ঞাসা না করে আমার পাতে সঠিক পরিমাণের ভাত, তরকারী দিল, না বেশি না কম | শুধু শেষে একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “ঠাকুরপো, খেজুরের চাটনি আর একটু নেবে ?” শুনেই দিনেশের কথা মনে পড়ল | ছোটবেলায় ছুটি কাটাতে দাদুর বাড়িতে এসে কতদিন পাশাপাশি বসে একসাথে ভাত খেয়েছি | একসাথে পাল্লা দিয়ে চাটনি খেয়েছি, যতক্ষণ না দিদিমার বকুনি শুনেছি | মনে হল আজ যদি দিনেশ পাশে হত, তাহলে কি দু’জনে পাল্লা দিয়ে সরলার কাছে চেয়ে চাটনি খেতাম |
খাওয়ার পর দেখলাম ঘুম পাচ্ছে | ছেলেদের খাওয়া হলে মেয়েরা খেতে বসল | কথাবার্তার গুঞ্জন হল-ঘর থেকে খাবার ঘরে সরে গেল | আমার চোখে ঘুম দেখে রবিন বলল, “অমিয়দা, তুমি একটু পাশের ঘরে বাবার খাটে শুয়ে জিরিয়ে নাও |” আমি গিয়ে সটান হলাম | দেখলাম ঘুম এসেও কেটে যাচ্ছে | জানালা দিয়ে ক’টা বাড়ি ছাড়িয়ে সেই পুরনো বট গাছ | ছোটবেলায় শুনেছি ওর নিচে একটা ধর্মশালা ছিল, যদিও ওখানে নোনা ধরা একটা বাড়ির ইটের স্তূপ ছাড়া কিছু দেখিনি | এত বছর পরেও সেই একই আছে | ছাদে উঠলে গাছটার মাথা দেখা যেত | আর, মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় মামারা দূরে হাত দেখিয়ে বলত, “ওই দেখ, বহরমপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের চূড়া |” শীতকালে আকাশ খুব নীল হলে মনে হত একটা রুপালী ছুঁচের ডগার মত কিছু দেখা যাচ্ছে দূর দিগন্তের ঠিক ওপরে |
এই সব ভাবতে চোখ বুজে এলে শুনলাম কেউ ডাকছে, “কাকু, ঘুমচ্ছ ?” চোখ খুলে দেখি কণিকা | বলল, “গানের আসর বসছে | মা জিজ্ঞাসা করছে, আসবে ?” আমি বললাম, “তোমরা গাও না | আমি একটু ঝিমিয়ে নিই |” ও চলে গেল | একটু পরে হৈচৈ এর মধ্যে কেউ হারমোনিয়াম খুলে এক দুটো রিড টিপল | আসতে আসতে কোলাহল শান্ত হল | কেউ গান ধরল | একটা, দুটো, কোনটা খালি গলায়, কোনটা হারমোনিয়ামের সাথে | একবার গলাটা চিনে মনে হল কণিকা গাইছে এবার | চোখ খুলে কেউ নেই দেখে মনে হল সবাই পাশেই হল-ঘরে আসরে বসে | গানটা শেষ হলে আমি আস্তে করে ডাকলাম, “কণিকা |” সাড়া না পেয়ে আবার একবার ডাকলাম | একটু পরে কণিকা এসে বলল, “ডাকছিলে কি ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ | তুমি গাইছিলে ?” কণিকা বলল, “না তো | মা গাইছিল | কেন কিছু বলবে ?” আমি বললাম, “বৌদিকে বলতো একটা গান গাইতে |” কণিকা বলল, “কোন গান ? ... না থাক, দাঁড়াও মাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি |”
সরলা বৌদি এসে বলল, “তুমি এসো ঠাকুরপো, ওখানে বসবে | আর সবাই আছে |” আমি বললাম, “না থাক | থেকে থেকে ঝোঁকের মত ঘুম আসছে | তারই মৌতাতে মনে পড়ল | দিনেশের একটা প্রিয় গান ছিল, খুব পুরনো হিন্দি সিনেমার একটা গান | জানি না তুমি চিনবে কি |” বৌদি বলল, “বলে দেখ, দেখি জানি কি না |” আমি বললাম, “গানটা হল, ‘তেরা, মেরা, প্যার অমর, ফির কিঁউ মুঝকো ল্যগতা হ্যয় ডর |’”
বৌদি চমকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এই গানের কথা তুমি জানলে কী করে ?”
আমি – “এ তো আমাদের ছোটবেলার গান | দিনেশই আমাকে গানটা ওর প্রিয় বলে জানিয়ে প্রথম ভালো লাগিয়েছিল |”
বৌদি – “ও !”
আমি – “কেন, কী হয়েছে ?”
বৌদি – “না কিছু না | ... আচ্ছা, যাই, ওরা বসে আছে |”
বৌদি চলে গেল |
আমি বুঝতে পারলাম না ভুল কিছু বলে ফেলেছি কি, না কি কোন গোপন ক্ষতে ঘা দিয়ে ফেলেছি | একটু পরে শুনলাম অন্যদের কথাবার্তার মাঝে বৌদি গাইতে শুরু করল | যে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিল সে বাজান বন্ধ করল | সব উচ্ছ্বাস শান্ত হয়ে গেল | নিরাভরণ স্বচ্ছ শান্ত সুরে খালি গলায় দিনেশের প্রিয় গানটা গাইতে গাইতে শেষের দিকে বৌদির গলা ভারী হয়ে এলো | তারপর গানটা শেষ না করে বৌদি হটাত থেমে গেল | পাশের হল ঘরে জমাট নিস্তব্ধতায় আমার মনে একটু লাগা ছোটবেলার শিরিনীর ঘোরটা কেটে গেল |
শুনলাম কণিকা ধরা গলায় বলল, “মা তুমি কেঁদো না |”
আর, ছোট মামীমা বোঝানোর গলায় বলল, “সরলা, বিয়ে বাড়ি তো | অমন করে কেঁদো না | অকল্যাণ হবে |”
------------------------------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৪
মেসো রেলের পাশ নিয়ে দু’ চার মাসে একবার ঢুঁ মেরে যেতেন | আসতেন বিকেলের দিকে | বাবা অফিস থেকে ফিরে দেখে একটুও অবাক না হয়েই বলত, “আরে, দেবলদা যে !” তারপর বাবা সাইকেলটা রেখে, ধীরে সুস্থে জামা কাপড় ছেড়ে, হাত মুখ ধুয়ে গামছাটা মেলে, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে খাটে মেসোর পাশে বসত | মা মুড়ি - নারকেল থাকলে নারকেল কুচি দিয়ে - আর চা খেতে দিত | তখন খাটের উপর পা তুলে বসে দুজনের গল্প শুরু হত | আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম, কেন না সেদিন আর বাবা আমার পড়া দেখতে বসত না | ফাঁকি দিলেও বাবার কাছে বকুনি দেয়ার সুযোগ হত না | মা রাত্রে খেতে দেয়া অব্দি সেই গল্প চলত | খেয়ে উঠেও গল্প চললে আমি ঘুমে ঢলে পড়তাম | ঘুমের ঘোরে এক সময় টের পেতাম মেসো উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাটো করে বলছেন, “রমেন, আমি তাহলে আসি | সাড়ে এগারটার এক্সপ্রেসটা ধরব |” বাবা বলত, “যেতে চাও ? রাতটা কাটিয়ে গেলে হত না ?” মেসো বলতেন, “না, থাক | ইয়ে ... বলছিলাম কি, কিছু টাকা হবে ?” আমি শুনতাম বাবা, “কত ?”, বলে দেরাজ খুলছে | মেসো আরও আস্তে করে কিছু বললে, বাবা বলত, “অত তো দিতে পারব না | যা আছে, তাই দিচ্ছি, নাও |”
আর, এক আধ বার দিনেশ দক্ষিণাপুরে এসেছে, একা একা, বই কিনতে, যে হেতু শিরিনীতে স্কুলের সব বই পাওয়া যেত না | দিনেশ আসত সকালের ট্রেনে | এসে আমাদের বাড়িতে উঠে জলখাবার খেয়ে স্টেশনে ফেরার পথে বইয়ের দোকান থেকে বই কিনে ফিরে যেত | আমি অবশ্য ওর সাথে বইয়ের দোকান অব্দিও যেতাম না, কেন না তখনো আমাকে বাড়ি থেকে বেশি দূরে একা ছাড়া হত না |
আমার মনে পড়ে না মেসো কখনো মাসি আর মাসতুতো ভাই বোনদের সবাইকে সাথে নিয়ে এসেছেন, যদিও এক আধ বার মেসো মাসীকে ট্রেনে তুলে দিয়েছেন কোনও এক ছেলে বা মেয়ের সাথে | মাসি এসে ক’দিন থেকে ফিরে গেছেন | মাসি ছিল মায়ের মেজ দিদি | শক্ত শরীর, যেমন দরকার হয় অনেক ছেলে মেয়ের সংসার সামলাতে | হয়ত ওই শক্ত শরীরের জন্যই সংসারটা এত বড় হয়েছিল | গায়ের রং ঘোর শ্যামল, এমন কী ঠোঁট দুটোও ছিল প্রায় কালো | মস্ত খোঁপা, আর চিবুকে একটা বড় কালো আঁচিল নিয়ে মাসির মুখটা ছিল ভারী মিষ্টি | কথায় কথায় হাসতেন সাদা ধবধবে নিখুঁত দাঁত মেলে | তখন ঘন কালো লম্বা পলকের ঝাঁপ তোলা চোখের কোনের চামড়া কুঁচকে হাজার ভাঁজ পড়ত | দেখে মনে হত না অত বড় অভাবের সংসার নিয়ে মাসির কোনও কষ্ট আছে | ফিরে যাওয়ার আগে বাবা মাসির হাতে কিছু টাকা দিয়ে প্রণাম করে বলত, “হাসিদি, টাকা কটা রাখো | নিজের কাছে রেখ, দেবলদার হাতে দিও না যেন |” মাসি তখন বাবার থুতনি ধরে আদর করে বলতেন, “রমেন, তুমি এস না একবার সবাই কে নিয়ে |”
বলতে অবশ্য হত না | এমনিতেই বছরে অন্তত একবার আমরাও শিরিনী যেতাম | মেসোর ছোট ঘরে কদিন গুঁতোগুঁতি করে খুব ভালো কাটত | রেলের ছোট কলোনি, মাঝে একমাত্র পীচের রাস্তার সিঁথি | এক পাশে বড় সাহেবদের খসখসের পর্দা ঝোলানো টানা বারান্দার পিছনে বাংলো, ফুলের বাগানে ঘেরা | সেই সব বাগানে কত বড় বড় গাছ - কিছু ফলের, কিছু অচেনা ফুলের | আর রাস্তার অন্য পাশে পীচ রাস্তার আড়া আড়ি কয়েকটা মোরাম ফেলা রাস্তার দু’পাশে পিঠোপিঠি করে ছোট ছোট কোয়ার্টার, কয়েক পায়ের একটা বাগানের পরে কাঠের জাফরি দেয়া তার বারান্দা | বেশির ভাগ বাগানে গাঁদা, জবা, সূর্যমুখী ফুলের গাছ কিম্বা পেঁপে কি পেয়ারার গাছ | বড় গাছ খুব কম | পরিষ্কার বোঝা যেত পীচ রাস্তার দু’পাড়ের তফাৎ কোথায়, কী ভাবে |
অবশ্য তাতে কোন অসুবিধা ছিল না | মেসো কারখানা থেকে বাতিল করা টুকি টাকি পার্টস এনে দিনেশ কে দিতেন | ও আর আমি তাই নিয়ে খেলতাম | আমার মনে আছে কারো ফেলে দেয়া মেকানো সেট আর মেসোর আনা টুকিটাকি লোহার পাত্তি, স্ক্রু, নাট আর বল্টু দিয়ে ওর বানান একটা ক্রেন ছিল | একটা মোটা তারের হাতল ঘুরিয়ে তার ভার তোলার আঁকশিটা উঠানো নামানো যেত | কিন্তু ওটা দিয়ে সামান্য ভারও তুলতে গেলে ক্রেনটা মুখ থুবড়ে পড়ে যেত | দিনেশ বলত, “এটা একটু ঠিক করতে হবে | কিন্তু একদম সময় পাচ্ছি না |” ক্রেনটা নিয়ে আমার কৌতূহল মিটে গেলে দিনেশ বলত, “চল মাঠে যাই | দেখি কে কী করছে |”
শিরিনীর ওই রেলের কলোনিতে সব মরশুমেই ছেলেরা ক্রিকেট খেলত | রেলের কলোনিতে নানান ধরনের ছেলে তেলেগু, পাঞ্জাবি, বিহারী | তার মধ্যে দিনেশের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল টুকটুক বলে একটা তেলেগু ছেলে | আমার খুব আশ্চর্য লাগত যে ওই বয়েসে টুকটুক সব হিন্দি সিনেমার গান জানত | কলোনিতে প্রায় সব সময় কারো না কারো বাড়িতে রেডিও বাজত | শান্ত কলোনি, তাই এক বাড়ির শব্দ অনেক দূর অব্দি শোনা যেত | সারাদিনই কেউ না কেউ বিবিধ-ভারতী লাগিয়ে রাখত | এ ছাড়া রেডিও সিলোন | মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে ট্রেনের বা মালগাড়ির আওয়াজ | চলে গেলেই আবার গানের সুরেলা ঢেউ ফিরে এসে আছড়াত | গরমকালে তার সাথে বাংলোগুলোর দিক থেকে আসা হওয়ায় নাম না জানা ফুলের অস্থির করা গন্ধ | ফেরার দিন এই সব মিলিয়ে বড্ড ঘুম পেত | মনে হত শিরিনীতে থেকে যাই, কী হবে দক্ষিণাপুরে ফিরে |
শিরিনী স্টেশনের ওপারে ছিল ছোট আদিম শহরটা | সটান উঠে যাওয়া একটা সংকীর্ণ গলির দুপাশে তরকারী, মাছ, ডিম বিক্রি হত | একটু এগিয়ে গেলে কাঁচের চুড়ি, মুদী, মনিহারি, রঙিন মিষ্টি, বই-খাতা, রেশন, কেরোসিন, হ্যাজাক, লোহা লক্কড়ের দোকান | প্রায় সব দোকানেরই ভিতরের দিকে আধো আঁধারে নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘোমটা দিয়ে বসা বাড়ির বউ, কি বাচ্চা, আর ওখান থেকে ভেসে আসা পুরনো পারিবারিক ব্যবসায়ের অচেনা মন উদাস করা ম ম গন্ধ | তারপর কয়েকটা মারোয়াড়ীদের পাকা বাড়ি | ওই পাড়াটা শেষ হলে গলিটা চওড়া হয়ে ঢালে নেমে, আর বাড়িগুলো ছোট মাটির হয়ে হয়ে দূরে সরে যেতে যেতে তিনদিক ফাঁকা শাল, পলাশের মাঠে শহরটা শেষ হত | শেষের দিকের বিহারীদের টালির ছাদের ইটের বাড়িগুলোর উঠোনে দেখতাম আম জামের গাছতলায় গোরু, মোষ বাঁধা | সাঁওতালদের তাল পাতা কি খড়ের ছাদের বাড়ির ন্যাড়া উঠোনে এক আধটা পলাশ কি শিমুল গাছতলায় ছাগল আর মুরগী চরে বেড়াত | কখনো তাদের কোনও বাড়ির ভিতর থেকে আবলুস কালো মেয়েমানুষ বেরিয়ে এসে অবাক চোখে দেখত আমাদের | দিনেশ তার দিকে তাকিয়ে হাসত | কখনো কখনো ওদের ভাষায় কিছু বলত যা আমি বুঝতাম না | শেষে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলত, “চল, এবার বাড়ি ফিরি |”
ওই বয়েসে আমার মনে হত দিনেশ আমার থেকে অনেক কিছু বেশি জানে বা বোঝে | যেমন, কখনো দিনেশ আমাকে নিয়ে ওভারব্রিজ ছেড়ে পায়ে হেঁটে রেল লাইন পার হত | তখন লাইন এর মাথায় বিজলী তার খাটিয়ে সবে ইলেকট্রিক ইঞ্জিন চালানো শুরু হয়েছে – শুধু কিছু মালগাড়ি টানে | তারের নিচ দিয়ে রেল লাইন পার হওয়ার সময় দিনেশ আমার হাতে ওর হাত ছুঁইয়ে দেখাত হাতে কাঁটা ফুটছে | একবার বলল, “এই যে মাথার উপর তার, ওতে কত ভোল্ট আছে জানিস ?” আমি মাথা নাড়লে বলল, “দেখছিস তো গায়ে কেমন কাঁটা ফুটছে হাই ভোল্টের জন্য |” “কত ভোল্ট ?”, আমি জিজ্ঞাসা করলে ও দেখাল বিজলী তারের থামে লাল রঙের বোর্ড | তাতে কঙ্কালের মাথা আঁকা, আর লেখা কত ভোল্ট | কখনো কোনও ট্রেন আসতে দেখে ও বলত, “এটা থ্রু যাবে বুঝলি |” তারপর চট করে পকেট থেকে একটা পেরেক বা তারের টুকরো বের করে রেল লাইনের উপর রেখে দিত | ট্রেনটা চলে গেলে দেখতাম সেটা চিঁড়ে চেপটা হয়ে গেছে | সাথে সাথে তুললে দেখতাম ওটা তখনও বেশ গরম |
আমি নিজেকে কিছুতেই দিনেশের সমকক্ষ মনে করতে পারতাম না | মুখে যাই বলি মনে মনে খুব সমীহ করতাম যে শিরিনীর মতো একটা ছোট জায়গায় থেকেও, ও আমার থেকে অনেক ব্যাপারে কত বেশি এগিয়ে ছিল |
আমার এই সম্ভ্রমের দুটো বিশেষ কারণ ছিল | প্রথমত, দিনেশের কথা বার্তা থেকে আমার ধারণা হয়েছিল যে মেয়েদের সম্বন্ধে ও আমার থেকে বেশি জ্ঞান রাখত | পাড়ার সব মাসিমা, কাকিমা ওকে চিনত, বাড়িতে ডাকত, নানান কাজ দিত | আর পাড়ার সব মেয়েদের ও চিনত | আমি খুব মুখচোরা ছিলাম বলে ও আমাকে কারো সাথে আলাপ করিয়ে দিত না | কিন্তু কারো সাথে দেখা হওয়ার পরে ও আমাকে তার সম্বন্ধে এমন এমন কথা বলত যে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করতাম, “তুই কী করে জানলি ? ও কি তোকে বলেছে ?” তখন দিনেশ অদ্ভুত ভাবে হেসে বলত, “ও তুই বুঝবি না | তবে শোন, তুই কিন্তু এই সব কথা মা কে বলবি না | দেবেশ কেও নয় |” দেবেশ ছিল দিনেশের ভাই, আমার থেকে কয়েক বছরের ছোট | খুব সাদাসিধে আর একটু বোকা | ও কখনও কখনও আমাকে দিনেশের কিছু কথা এমন ভাবে গোপনে বলত যে মনে হত সেটা গুপ্ত কথা | দিনেশের সাথে আমার প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা ছিল ওইটুকু, দেবেশের কাছে প্রতিপক্ষের গূঢ় তথ্য সংগ্রহ করা |
আমার ওই বয়েসে সিনেমা দেখা মানা ছিল | দিনেশ রেলওয়ে ইন্সটিটিউটে হিন্দি সিনেমা দেখত | এটাও আরেকটা ব্যাপার ছিল ওর আমার থেকে জ্ঞানগম্যি বেশি হওয়ার কারণ | ওই সিনেমা দেখে দেখেই টুকটুকের সব হিন্দি গান মুখস্থ ছিল | আমরা ক্রিকেট খেললে দিনেশ আর টুকটুক আমাকে ওদের পক্ষে নিত না | আমি ব্যাট করতে নামলেই টুকটুক স্পিন বল দিয়ে, কিম্বা দিনেশ গায়ের জোরে গুড লেন্থ বল ছুঁড়ে আমাকে আউট করে দিত | খেলা শেষ হলে আমরা তিনজন কলোনি যেখানে শেষ হয়েছে তারপর একটা জলের নালার ধারে গিয়ে ঘুরতাম | দিনেশ আর টুকটুক কী যে খুঁজত আমি বুঝতাম না | অনেকক্ষণ পরে দুজনের একজন পাথর কুড়িয়ে অলস ভাবে ছুঁড়ে জলে ফেলত | তখন অন্যজন বলত, “বাড়ি ফেরা যাক |”
একবার ওই ভাবে ঘুরতে ঘুরতে টুকটুক একটা গান গুনগুন করে উঠলে দিনেশ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুই এই গানটা শুনেছিস ?” আমি অন্যমনস্ক ছিলাম নালার জলের ধারে কিছু গাঁদা ফুলের চারা দেখে | ওগুলোয় কী রঙের ফুল হবে সেই কথা ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন গান ?” তখন দিনেশ কিছুটা বেসুরো গলায় গেয়ে শোনালো,
“তেরা, মেরা, প্যার অমর,
ফির কিঁউ মুঝকো ল্যগতা হ্যয় ডর |”
আমি চুপ করে থাকলে দিনেশ গানটা শেষ করে বলল, “এটা আমার খুব ফেভারিট |” আমি একটু চিন্তা করলাম | আমি দক্ষিণাপুরে অনেকবারই মাইকের মাধ্যমে গানটা শুনেছি | কখনোই আমার গানটা তেমন কিছু মনে হয়নি | আমি বরঞ্চ রবিবারের দুপুরের অনুরোধের আসরের গান বেশি পছন্দ করতাম | আমি খুব দমে গেলাম যে, একটা গান যেটা আমি গণ্যই করিনি সেটা এত মিষ্টি যে দিনেশের অতি প্রিয় | আমার আবার মনে হল আমি দিনেশের সমান মোটেও নই, হয়ত হবও না কোনোদিন | বুঝলাম মেয়ে ও প্রেমের ব্যাপারে দিনেশ চিরকাল আমার থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে | আমি ওর ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারব না | মনটা আরও দমে গেল | দিনেশের প্রতি আমার সম্ভ্রমের দ্বিতীয় কারণ যোগ হল এইভাবে |
একই বছর আমি দক্ষিণাপুর বয়েজ হাই স্কুল থেকে হায়ার সেকন্ডারী পাশ করলাম, আর দিনেশ শিরিনীর রেলের একমাত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিক | আমি চলে গেলাম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে | মেজ মেসো দিনেশকে আর পড়াতে পারবেন না বুঝে দাদু ওকে বেলডাঙায় ডেকে নিলেন ওখান থেকে পড়াশুনা করাতে | আমি কলেজে বন্ধু বান্ধব পেয়ে দিনেশের সঙ্গ ভুলতে লাগলাম | এরপর দিনেশের সাথে দেখা হল শুধু কলেজের দ্বিতীয় বছর, যখন চিঠিতে বাবা, মা দেশে যাচ্ছে জেনে আমি কলেজ থেকে বেলডাঙা গেলাম ওই সুযোগে | গিয়ে দেখলাম ওরা গ্রামে চলে গেছে | কটা দিন বেলডাঙায় কাটিয়ে দেখলাম দিনেশ দিব্যি আছে | যদিও কোন মেয়ে বন্ধু হয়নি বলেই মনে হল – যেটা আমি আশা করিনি | তবে দেখলাম ও মেজ মামার মেয়ে বন্ধুদের সাথে খুব ভাব করে নিয়েছে |
আমার দাদু স্কুলে থেকে রিটায়ার করে বাড়িতে টিউশন দিতেন | বেশির ভাগই স্কুলের শেষের দিকের কিম্বা সবে কলেজে ওঠা ছাত্রী | সবার সাথে মেজ মামার ছিল ভাব, বাড়িতে যাওয়া আসা | মামা তাদের কারো কারো দিদি বা অবিবাহিত মাসি, পিসির সাথেও আলাপ রাখত | সেই সুবাদে দেখলাম দিনেশও তাদের সাথে মেলা মেশা করে | কিন্তু বলার মত কিছু গল্প দিনেশ বলল না | আমি একটু ঈর্ষা কাতর হলাম, যে ও হয়ত এই পরিস্থিতিতেই একদিন জীবনসঙ্গিনী খুঁজে পাবে, কোন বিশেষ চেষ্টা না করেই |
এর পর আর দিনেশের সাথে যোগাযোগ থাকেনি | আমি কলেজ থেকে ফিরলে মায়ের কাছে কখনও কিছু এক-আধটা খবর পেতাম | কিন্তু আমার বিশেষ কৌতূহল হত না খুঁটিয়ে জানার |
আমি কলেজে থাকতেই মেজ মামা এক বান্ধবী কে বিয়ে করল | স্কুলের বয়েসে আমি মেজ মামার সাথে তার বাড়ি গিয়েছি | নিম্ন মধ্যবিত্ত এক পরিবারের মেয়েটির হাতে বানান মামার বহুচর্চিত চর্বির বড়া আর চা খেয়েছি | মামাকে দেখেছি তার সাথে হালকা কথাবার্তা করতে কিম্বা ইয়ার্কি মারতে | হবু মামীমার হাঁপানির রোগ ছিল, তার ছায়া ছিল ক্লান্ত চোখের কালো কোলে | সেই মায়াতেই মামা ওকে বিয়ে করল কি ? জানি না | যা জানি, দুজনে সুখী হয়েছিল, যদিও মামীমা পূর্ণ জীবন ভোগ করার আগে মারা যায় |
একবার মায়ের কাছে শুনলাম দিনেশ বিয়ে করছে | মেয়েটি নার্স, ওর থেকে বয়েসে বড়, গায়ে শ্বেতি আছে | সবারই ঘোর আপত্তি, একমাত্র মেজ মামা ছাড়া | মা আরও জানল যে একবার মেজ মামা হাসপাতালে ভর্তি হলে ওকে দেখতে দিনেশ যেত, তখন এই মেয়েটি অ্যাটেন্ডেন্ট নার্স ছিল | সেই আলাপ থেকে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে বিয়ে | এর বেশি মা বলতে চাইল না, না কি বলতে পারল না | শুধু বলল, “মেজদির যাও বা আশা ছিল যে ছেলেটা চাকরি করলে একটু টাকা পয়সার মুখ দেখবে, তাও গেল |” আমি বললাম, “কেন ?” মা আর তার উত্তর দিল না | সেই সাথে, ‘দিনেশ ও কি মেজ মামার মত মায়া করে বিয়ে করল ?’, এই প্রশ্নের উত্তর অজানা রয়ে গেল | পরে শুনেছিলাম দিনেশ পড়তে পড়তে টেক্সটাইল পড়া ছেড়ে দিয়ে সরকারী অফিসে কেরানি হয়েছিল | নিজের আর স্ত্রীর আয় জুটিয়ে কোন মতে মেয়ে দুটো মানুষ করছিল |
চাকরি জীবন শুরু হল | হাঁফ ধরা প্রতিযোগিতার জীবনে ক্বচিৎ দূরে মাইকে বাজা দিনেশের সেই ছোট বেলার প্রিয় গানটা শুনলে ওর কথা মনে পড়া ছাড়া ওকে ভুলেই গেলাম | ছেলে মেয়ে বড় হল, আলাদা হল | বাবা, মা মারা গেল | আমি রিটায়ার করলাম | প্রতিমা অকালে বিদায় নিলো | পর পর দুই মামা মারা গেল | খবর পেয়েও যাওয়া হল না, যদিও মনে হল যে গেলে হয়ত একবার দিনেশ কেও দেখে আসতে পারতাম | এই ভাবে কোনও দিন নিজের আর ওর স্ত্রীকে একসাথে পাশাপাশি দেখা হল না | দেখেই বা কী জানতাম – কে কী পেলাম জীবনে, শুধু এই মাত্র ?
এই নিস্তরঙ্গ শেষের জীবনে একদিন ফোন বাজলো, “অমিয়, আমি মিহির, ছোট মামা, বলছি |”
খুব অবাক হয়ে বললাম, “আরে, কী ব্যাপার ? কোথা থেকে বলছ ?”
মামা – “কেন ? বেলডাঙা থেকে ... তোরা সব ভালো আছিস তো ?”
আমি – “হ্যাঁ ... তোমরা ?”
মামা – “হ্যাঁ, হ্যাঁ | শোন, যে জন্য ফোন করেছি – রবিনের, মানে আমার ছোট ছেলের ... অবশ্য তুই তো দেখিস নি, কত বছর হল দেখা নেই ... বিয়ে সামনের মাসে | তোরা আয় | আমি বিয়ের চিঠি পোস্ট করব | কিন্তু আগেই মুখে জানিয়ে রাখছি | তোদের আসতেই হবে |”
আমি – “মামা, আমাদের বলতে আমি তো এখন একা |”
মামা – “কেন ? প্রতিমা ?”
আমি – “ও তো আর নেই, দু’ বছর হয়ে গেল | খবর তো পাঠিয়েছিলাম |”
মামা – “ও ! কী হয়েছিল ? ... না এখন থাক | অনেক গুলো ফোন করার আছে | তুই আয়, বসে সব শুনব |”
আমি – “বলার মত বিশেষ কিছু নেই | ... দেখি | আসলে এতদিন যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি |”
মামা – “কত বছর দেখা হয়নি বলত ?”
আমি – “বোধহয় ১৯৬৬ সালে শেষ গিয়ে থেকেছি | না, একবার ১৯৭৬ এ কলকাতা থেকে গিয়ে দিনের দিন ফিরেছি | সেই শেষ |”
মামা – “না, না তোকে আসতেই হবে | বড়দা, মেজদা সব মারা গেল, তুই এলিই না, কত যে ব্যস্ত থাকিস |”
আমি – “না, এবার আসবো |”
মামা – “হ্যাঁ, আয় | সকলের সাথে দেখা হয়ে যাবে, এই সুযোগে |”
আমি – “সেই ... দিনেশের সাথে ও তো দেখা হয়নি কত বছর | ও তো বেলডাঙায় আছে না ?”
মামা – “দিনেশ ? কী রে ? তুই কি কিছুই খবর রাখিস নি আমাদের ?”
আমি – “কেন ?”
মামা – “দিনেশ মারা গিয়ে চার বছর হয়ে গেল | তাই বলছি, যোগাযোগ না রাখলে কোনদিন দেখবি আমরা কেউ নেই |”
আমি – “দিনেশ মারা গেছে ? কী বলছ তুমি ? কী হয়েছিল ? ওর ফ্যামিলি কোথায় এখন ?”
মামা – “আয়, না | তুই আয়, ঘুরে যা | একবার সবাইকে দেখে যা | আমার ও বয়েস আটাত্তর হতে চলল | এই শেষ কাজটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলে বাঁচি | আয়, এসে আমায় দায়মুক্ত কর |”
আমি – “না, তুমি আগে দিনেশের কথা বল | কী হয়েছিল ওর ?”
মামা – “দিনেশের ... কী বলব ... প্রেশার ছিল, সুগার ও | হটাত করে ঠাণ্ডা লাগল, নিউমোনিয়া মত হল | বেশ ক’দিন ভুগে শেষ | সরলা অনেক যত্ন করেও বাঁচাতে পারল না | খুব খারাপ অবস্থা ...”
আমি – “সরলা মানে দিনেশের বউ ?”
মামা – “হ্যাঁ | ও, তুই তো বোধহয় তাকেও দেখিস নি | তাই বলছি, আয় না এবার |”
আর বেশি কথা হল না | ফোনটা রেখে মন খারাপ হয়ে গেল | আমি কলেজে যাওয়ার পর এক এক করে দেবেশ, আর তার পর মেজ মাসির বড় মেয়ে দীপ্তি মারা যায় অল্প বয়েসে | তাও মাসি দিনেশের কাছে যান নি | মেসো মারা গেলে সেজ ছেলে পুরুলিয়ায় রেলে কাজ পায় | মাসি সেজ ছেলের সাথে পুরুলিয়ায় থেকে গেছেন |
পরের মাস এলো | যাব কি যাব না, এই নিয়ে কিন্তু কিন্তু করে শেষে গেলাম বেলডাঙায়, সাঁইত্রিশ বছর পেরিয়ে | আলাপ হল অনেক নতুন মুখের সাথে – বড় মামার দুই ছেলে, মেজ মামী আর দুই মেয়ের সাথে, আর ছোট মামী, মেয়ে আর ছেলেদের সাথে | ছোটমামাকে জিজ্ঞাসা করলাম দিনেশের বউয়ের কথা | বলল, “আসতে তো বলেছি, বিয়ের কদিন এখানে খেতেও বলেছি |”
বৌদি এলো বিয়ের একদিন আগে | দরজার ঘণ্টি শুনে আমিই দরজা খুলে দেখলাম পিছনে একটা বাইশ তেইশ বছরের মেয়েকে সাথে নিয়ে কালো সরু পাড় সাদা শাড়ি পরা এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে | অস্পষ্ট চেহারাটা না চিনলেও মুখে শ্বেতির দাগ দেখে কোন সন্দেহ রইল না | বললাম, “সরলা বৌদি ?” | মেয়েটা এগিয়ে বৌদির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনাকে তো চিনলাম না |” আমি বললাম, “চিনবে কী করে ? আমি অমিয়, দিনেশের মাসতুতো ভাই | তোমার বাবার সেজ মাসির বড় ছেলে | জানি না দিনেশ কোনোদিন আমার কথা বলেছে কি না | এসো, ভিতরে এসো |” আমি একপাশে সরে দাঁড়ালে বৌদি মৃদু হেসে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকল | মেয়েটা টুক করে প্রণাম করে বলল, “বাবার কাছে আপনার নাম শুনেছি কাকু | আমি কণিকা | যান, আপনি ভিতরে যান, আমি দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আসছি | কখনো কখনো ছিটকিনিটা ঠিক করে লাগে না |”
আর কোন তেমন কথা হল না ওদের সাথে | দুপুরে খেতে বসলে সরলা বৌদি অন্যদের সাথে খাবার পরিবেশন করল | মনে হল খুব কম কথার মানুষ | অথচ আমাকে জিজ্ঞাসা না করে আমার পাতে সঠিক পরিমাণের ভাত, তরকারী দিল, না বেশি না কম | শুধু শেষে একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “ঠাকুরপো, খেজুরের চাটনি আর একটু নেবে ?” শুনেই দিনেশের কথা মনে পড়ল | ছোটবেলায় ছুটি কাটাতে দাদুর বাড়িতে এসে কতদিন পাশাপাশি বসে একসাথে ভাত খেয়েছি | একসাথে পাল্লা দিয়ে চাটনি খেয়েছি, যতক্ষণ না দিদিমার বকুনি শুনেছি | মনে হল আজ যদি দিনেশ পাশে হত, তাহলে কি দু’জনে পাল্লা দিয়ে সরলার কাছে চেয়ে চাটনি খেতাম |
খাওয়ার পর দেখলাম ঘুম পাচ্ছে | ছেলেদের খাওয়া হলে মেয়েরা খেতে বসল | কথাবার্তার গুঞ্জন হল-ঘর থেকে খাবার ঘরে সরে গেল | আমার চোখে ঘুম দেখে রবিন বলল, “অমিয়দা, তুমি একটু পাশের ঘরে বাবার খাটে শুয়ে জিরিয়ে নাও |” আমি গিয়ে সটান হলাম | দেখলাম ঘুম এসেও কেটে যাচ্ছে | জানালা দিয়ে ক’টা বাড়ি ছাড়িয়ে সেই পুরনো বট গাছ | ছোটবেলায় শুনেছি ওর নিচে একটা ধর্মশালা ছিল, যদিও ওখানে নোনা ধরা একটা বাড়ির ইটের স্তূপ ছাড়া কিছু দেখিনি | এত বছর পরেও সেই একই আছে | ছাদে উঠলে গাছটার মাথা দেখা যেত | আর, মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় মামারা দূরে হাত দেখিয়ে বলত, “ওই দেখ, বহরমপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের চূড়া |” শীতকালে আকাশ খুব নীল হলে মনে হত একটা রুপালী ছুঁচের ডগার মত কিছু দেখা যাচ্ছে দূর দিগন্তের ঠিক ওপরে |
এই সব ভাবতে চোখ বুজে এলে শুনলাম কেউ ডাকছে, “কাকু, ঘুমচ্ছ ?” চোখ খুলে দেখি কণিকা | বলল, “গানের আসর বসছে | মা জিজ্ঞাসা করছে, আসবে ?” আমি বললাম, “তোমরা গাও না | আমি একটু ঝিমিয়ে নিই |” ও চলে গেল | একটু পরে হৈচৈ এর মধ্যে কেউ হারমোনিয়াম খুলে এক দুটো রিড টিপল | আসতে আসতে কোলাহল শান্ত হল | কেউ গান ধরল | একটা, দুটো, কোনটা খালি গলায়, কোনটা হারমোনিয়ামের সাথে | একবার গলাটা চিনে মনে হল কণিকা গাইছে এবার | চোখ খুলে কেউ নেই দেখে মনে হল সবাই পাশেই হল-ঘরে আসরে বসে | গানটা শেষ হলে আমি আস্তে করে ডাকলাম, “কণিকা |” সাড়া না পেয়ে আবার একবার ডাকলাম | একটু পরে কণিকা এসে বলল, “ডাকছিলে কি ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ | তুমি গাইছিলে ?” কণিকা বলল, “না তো | মা গাইছিল | কেন কিছু বলবে ?” আমি বললাম, “বৌদিকে বলতো একটা গান গাইতে |” কণিকা বলল, “কোন গান ? ... না থাক, দাঁড়াও মাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি |”
সরলা বৌদি এসে বলল, “তুমি এসো ঠাকুরপো, ওখানে বসবে | আর সবাই আছে |” আমি বললাম, “না থাক | থেকে থেকে ঝোঁকের মত ঘুম আসছে | তারই মৌতাতে মনে পড়ল | দিনেশের একটা প্রিয় গান ছিল, খুব পুরনো হিন্দি সিনেমার একটা গান | জানি না তুমি চিনবে কি |” বৌদি বলল, “বলে দেখ, দেখি জানি কি না |” আমি বললাম, “গানটা হল, ‘তেরা, মেরা, প্যার অমর, ফির কিঁউ মুঝকো ল্যগতা হ্যয় ডর |’”
বৌদি চমকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এই গানের কথা তুমি জানলে কী করে ?”
আমি – “এ তো আমাদের ছোটবেলার গান | দিনেশই আমাকে গানটা ওর প্রিয় বলে জানিয়ে প্রথম ভালো লাগিয়েছিল |”
বৌদি – “ও !”
আমি – “কেন, কী হয়েছে ?”
বৌদি – “না কিছু না | ... আচ্ছা, যাই, ওরা বসে আছে |”
বৌদি চলে গেল |
আমি বুঝতে পারলাম না ভুল কিছু বলে ফেলেছি কি, না কি কোন গোপন ক্ষতে ঘা দিয়ে ফেলেছি | একটু পরে শুনলাম অন্যদের কথাবার্তার মাঝে বৌদি গাইতে শুরু করল | যে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিল সে বাজান বন্ধ করল | সব উচ্ছ্বাস শান্ত হয়ে গেল | নিরাভরণ স্বচ্ছ শান্ত সুরে খালি গলায় দিনেশের প্রিয় গানটা গাইতে গাইতে শেষের দিকে বৌদির গলা ভারী হয়ে এলো | তারপর গানটা শেষ না করে বৌদি হটাত থেমে গেল | পাশের হল ঘরে জমাট নিস্তব্ধতায় আমার মনে একটু লাগা ছোটবেলার শিরিনীর ঘোরটা কেটে গেল |
শুনলাম কণিকা ধরা গলায় বলল, “মা তুমি কেঁদো না |”
আর, ছোট মামীমা বোঝানোর গলায় বলল, “সরলা, বিয়ে বাড়ি তো | অমন করে কেঁদো না | অকল্যাণ হবে |”
------------------------------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন