বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৩

উনিশের রজনীগন্ধা





অষ্টমী / দুপুর ১:০০

জিত,



ছড়া করে লিখছি | তুমি রাগ করবে না, আমায় রাগাবেও না, লক্ষ্মীটি !


---

জানো কি , আজ আমি ভোগ খেতে যাইনি ?
বাড়ির সবাই গেছে, আমি বুকে সাহস পাইনি
কেন যে লাগে একা, ভিড় যখন খুব প্যান্ডেলে
অঞ্জলি দিয়ে ফিরেছি তাই কোন সাত সকালে
এসে থেকে আমি শোওয়ার ঘরে জানলা ধরে
জাবর কেটেছি গত পুজোর অষ্টমী মনে করে
ভেবেছি এই, যে, কী ভাবে কাটল একটা বছর
নতুন কী ঘটেছে, কী আছে লেখার মত খবর
তাই বুঝি চিঠি লিখি না তোমাকে সচরাচর
---


তুমি কি ভোগ খেতে গিয়েছিলে? মা আর বাবা দুজনেই খুব জোর করলো, “সে কী, অষ্টমীর দিন তুই ভোগ খেতে যাবি না?” বললাম, “আমার উপোষ করে গা গোলাচ্ছে, দুপুরে কিচ্ছু খাবো না |” মা বলেছিল থেকে যাবে, আমি জোর করে পাঠিয়েছি, নিরিবিলিতে তোমায় লিখতে, যে কথা মুখোমুখি বলতে পারি না |

---
সত্যি বলছি ! জানি তুমি বিশ্বাস করবে না এটা
যে, তোমার দেয়া সেদিনের সাদা বড় চকলেটটা
যেটা বটুয়ায় তুলে রেখেছিলাম, পরে খাবো বলে
ভুলেও ভেবো না করছি এই উপোষ ওই সম্বলে
ওটা বের করে ক’দিন ধরে দেখেছি, হয়েছে লোভ
করেছে প্রতারণা আমার নতুন ডায়েটিং এর ক্ষোভ
তাও, এক সাথে খাব বলে তুলে রেখেছি ধৈর্য ধরে
লালপেড়ে তাঁতে, তোমার প্রিয় বাদামী লিপস্টিক পরে
আলতো দাঁতে ধরব যখন চকলেটের ছোটো টুকরো
কটা ছবি তুলো ; একটা আমার মুখের ক্লোসআপেরও 


মা’রা সবাই খেতে চলে গেলে, আমি শুলাম বিছানায়
কী লিখব, কী লিখব না, এই নিয়ে বিভ্রান্ত ভাবনায়
কিছু পরে উঠে গত অষ্টমীর তাঁতের সাদা শাড়িটা
বের করে দেখি শূন্য লাগছে তার খোলের বাড়িটা
নিচের লাল পাড়ের কাছে একটু জেদি এঁটেল মাটি
করেছে নষ্ট নিষ্কলঙ্ক শাড়ীর সাদা জমির পরিপাটি
তবুও কেন টান বোধ করলাম বুকের দু’ কোরকে
সযত্নে খুঁটে রাখলাম ওটা নীল কাগজের মোড়কে
মায়ের পুজোয় শুনেছি লাগে নানা দুয়ারের মৃত্তিকা
কোন দ্বারে পেয়েছি এ মাটি আমি, শিঞ্জিনী-বালিকা
---


শাড়িটা দেখতে দেখতে কতক্ষণ জানি না তন্ময় হয়ে ছিলাম  ...

---
শিরশির করে উঠতে অনাবৃত নগণ্য আমার শরীরটা
অন্তর্বাস বাদ দিয়ে পরলাম ব্লাউজ, জড়ালাম শাড়িটা
অবশেষে লিখছি চিঠি খালি গায়ে জড়িয়ে তাঁতের খোল
লিখতে সে কথা যা লজ্জায় করছে কোলাহল উতরোল


উপুড় শুয়ে দেরাজের আয়নায় করে নিজেকে নিরীক্ষণ
দেখলাম অন্তর্বাসটা, কতদিনের সেই ছোট্ট এক আবরণ
মা কে এ’ কথা জানাতে, বলল, “দাঁড়া, একদিন মা হবি”
কিন্তু কিছুতেই মনে ফোটে না সে অনাগত যৌবনের ছবি


কোন মা ? আমার ? না, যাকে অঞ্জলি দিয়েছি সকালে ?
প্রথম মা রোজ বুড়ি হচ্ছে, দ্বিতীয় স্থায়ী চিরযৌবন কালে
হতে চাই সেই মায়ের প্রতিমা, নিষ্কাম শিশুর কৌতূহলে
কাঁচা বয়েসে তুমি যাকে মৃন্ময়ী রূপে পূর্ণযৌবনা দেখেছিলে


এই সব ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে নিঃশব্দ হালকা পায়ে
তোমাকে চিঠি লেখার ঘোর এলো ঘিরে সমস্ত স্বত্বা ছেয়ে


প্রথম থেকেই যখনই তোমাকে চিঠি লিখতে আমি বসি
দেখি কেন যেন অনেকক্ষণ মন মানে না বশের রশি
তারপরে একটু একটু করে এই দুর্বার জোয়ার আসে
খরস্রোতায় ভেসে যাই আমি ; একা নই, তুমি পাশে
আমি লিখি, আর তুমি বসে বসে দেখো আমার লেখা
আমার মাথার পিছন থেকে, যত দুর্বোধ্য মসী-রেখা
মাঝে মাঝে আমার ঢলে পড়া খোলা চুলের অসভ্যতা
সামলাতে তুমি মাথায় রাখ ঈষদুষ্ণ আলতো পাতা
দাও ঠেলে উড়ো চুল গুলো কানের পিছনে বনবাসে
লাজুক লতি হয় স্পর্শে কাতর, আঁখি ঢলে আলস্যে


ঘোরটা তখন যদি আমাকে আরও অবশ করে তোলে
যদি খুব লাগে বিভ্রান্ত, যদি লিখনের বৃত্তান্ত যাই ভুলে
চিত হয়ে শুয়ে তোমার মুখের দিকে থাকি ঠায় তাকিয়ে
মনে হয় তুমি হয়ত বলবে আমায় বড় বড় আঁখি দেখিয়ে
“পড়ছিলাম তুমি কী লিখছ | আগে  চিঠিটা শেষ করো !”
বলতে পারি কি, “তুমি আগে আমায় একটু চেপে ধরো” ?
---



আমি আয়নায় দেখছি - উপুড় হয়ে শুয়ে দু’ পা তুলে, গোড়ালি জোড়া করে, পা দোলাচ্ছি, পায়ের নূপুর গুলো উঠছে পড়ছে | আয়নার ছায়ায় তোমার পিছনে এই সব ঘটছে | তুমি আমার  পাশে বসে চিঠি দেখতে এতো ব্যস্ত যে দেখছও না, আমার পায়ের গোছ, আমার নূপুর পরা গোড়ালি, আর আলতা মাখা পায়ের তলা | আজ আমি আলতা পরেছি, ভারী মিষ্টি লাগছে | আলতা পরে শাড়ি তুলে পা শুকাতে শুকাতে মনে পড়ল -


---

এইতো সেদিন, তবু মনে হয় যেন কতো যুগ আগে
বৃষ্টি পড়ছে, তুমি আমার অপেক্ষায় গুলমোহর বাগে
মিনিবাস থেকে নামলাম কাদায়, শাড়িটা একটু তুলে
দৌড়ে এসে তুমি আমার সে হাতই ধরলে প্রচ্ছন্ন ছলে
ফুটপাথে উঠে বললে, “শাড়িটা এখনই নামিও না”
চমকে তোমার চোখে দেখলাম নির্দোষ মিনতির বন্যা
থতমত খেয়ে বললে তুমি, “চারিদিক জলে জলাকার”
বুকে উঠলো বেজে প্রতিধ্বনি আকাশেতে মেঘ ডাকার
---


আমি যেতে যেতে, থেকে থেকে, জানতে চাইলাম কেন | তুমি চুপ করে থেকে বললে ...  অনেকক্ষণ পরে ...

---
“রজনীগন্ধার গোছা দেখেছি আজ, জলে ভেজা বিপন্ন”
বললাম অবাক হয়ে, “কেন তবে কেন নি আমার জন্য ?”
রহস্যময় হাসি মেখে তুমি বললে, “না, আজ ছেড়ে দাও
সে যে বাঁধা রুপোর নিগড়ে | চলো, শাড়ি ঠিক করে নাও”
তারপরে কী হল যে জানিনা, তুমি হটাত চুপ করে গেলে
আর কোনও কথা বল নি, যত কথাই সাজিয়েছি ঢেলে
তুমি শুধু এক দু’টো হুঁ-হাঁ করেছ, বল নিকো আর কথা
শেষে বাসে ওঠানোর সময় ভাঙ্গলে সেই পাথরের নীরবতা
বললে, “আবার যেদিন বৃষ্টিতে তুমি নামবে মিনিবাস থেকে
চোখে ভরে নেব তোমায়, এক জোড়া রজনীগন্ধার স্তবকে”
ঠিক তখনি মিনিবাস এলো, উঠলাম নিয়ে তোমার হেঁয়ালি
চটি খুলে পা তুলে বসলাম ছড়িয়ে, পেয়ে সীটটা পুরো খালি
ভাবলাম তোমার অসংলগ্ন কথা, ছাড়াতে নূপুরের কাদামাটি
তুমি কি জানতে পেরেছিলে আমার মনের অলঙ্ঘনীয় ‘না’ টি ?
---

তুমি আমার পায়ের গোছের কথা বলেছিলে, না ? ছি ! বেশ হয়েছে, এখন তুমি তা দেখতে পাচ্ছ না, আমি নিশ্চিন্তে পা দুলিয়ে চিঠি লিখছি | 

(... চকলেটটা খাই কি ? ... না, থাক ওটা !)

এখন রাখি, একটু চোখ বুজি | ঘুম তো আসবে না, কিন্তু এই ঘোরেই শুয়ে থাকব মা’রা বাড়ি ফেরা অব্দি | এই ঘোরটাই করেছে মুশকিল | এটা লুকাতেই তো মা, বাবার থেকে দূরে দূরে থাকছি সেই সকাল থেকে | মা এখন আমার মুখ দেখলেই বলবে, “কী হয়েছে তোর ? জিত ফোন করেছিল ?”

তুমি প্যান্ডেলে গিয়েছিলে ? বিশেষ কিছু তেমন দেখলে?
আচ্ছা, মনে আছে তো এই আমার আজকের বিশেষ শেষ দিনটা ?

তোমার ইতি

***

নবমী / ভোর ১:৩০

ইতি,
আজ সারাদিন ঘুরে একটু আগে ফিরেছি | ভেবেছিলাম শুয়ে পড়ব, এত ঘুম পেয়েছিল | তখন মনে পড়ল, ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে দেখব মেইল আছে কিনা | আর দেখলাম তোমার মেইল | একবার মেইলটা পড়ে, জামা কাপড় ছেড়ে আবার পড়লাম |

ক্লান্তির আবেশে তোমার অতল মনে ডুবে যেতে যেতে স্বপ্নের মতো মনে হল যেন আমরা প্যান্ডেলে গিয়েছি | তুমি বললে, “একটু আসছি, মাকে প্রণাম করে |” তারপর কোথায় চলে গেলে, আমি কতক্ষণ অপেক্ষায় রইলাম | একবার প্রতিমার সামনে গিয়ে মেয়েদের ভিড়ে তোমাকে খুঁজলাম | কোথাও তুমি নেই | কী করি ভাবছি, তখন তোমার মেসেজ পেলাম, তুমি বাড়ি ফিরেছ আমায় বসে চিঠি লিখতে | কী বলার ছিল ? চিঠিতে তো লেখ নি |

আচ্ছা, তুমি কি রাগ করবে, যদি বলি তুমি চলে যাওয়ার পর আমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে মেয়েদের মুখে, প্রতিমার শরীরে তোমাকে খুঁজেছি ? এখন খুঁজছি তোমার চিঠিটার দিকে তাকিয়ে |

কেন খুঁজছি ? ... তুমি ‘আসছি’ বলে চলে যেতে একটা নিচু করে বাঁধা বাঁশের বেড়ার উপর শাড়ি আলগোছে তুলে পার হলে যখন, আমার তখন মনে পড়ে গেল ঠিক করেছিলাম তোমায় দেখাব, দেখানো হয় নি, মায়ের সাজে রজনীগন্ধার স্টিক, ঠিক বর্ষার জলে ভেজা তোমার পায়ের গোছ দেখেছিলাম যে রকম | এখন সেই কথা মনে পড়ছে, আর ভাবছি,

---
যখন তোমার ঘোর আসে, সাজের আয়নায়, আমার পাশে
উপচিয়ে কোরকের কাঁচুলি, বিলাও তুমি আতর আহেলি
উপুড় হয়ে দুলিয়ে নূপুর, লেখ যত আবোলতাবোল মধুর
হারিয়ে আমি সকল পুঁজি, উদ্ভ্রান্ত হয়ে তোমায় খুঁজি
মায়ের তিন তারায় দেখি, নেই তুমি, সব লাগে মেকী
কোথায় গুলমোহর বাগ, কোথায় সে মেঘমেদুর সন্ধ্যা ?
কোথায় তুমি আড়াল করেছ আমার সে দুই রজনীগন্ধা ?
---

যাচ্ছি এখন, লুকিয়ে যেতে ঘুমের কোলে |
তুমি কি বাদামী লিপস্টিকটা পরেছিলে আজ ?
ঘুম থেকে উঠে দেখো, তোমার বালিশের পাশে পাবে একটা সাদা চকলেট,  আর ফুলদানিতে রজনীগন্ধা, আগত কৌমার্যের সংবর্ধনায় |
প্রমিস!
(প্লিজ একটু বেলা অব্দি শুয়ে থেক ! ফোন করে ভোরে উঠিয়ে আমায় ছুটিয়ো না !)

জিত

***

নবমী / সকাল ১০:৩০

জিত,
কী অপ্রস্তুত ই তুমি করলে আমায়, সকাল সকাল !

একটু আগে মা ঘুম থেকে তুলে বলল, “ওঠ এবার, তোর না আজ জন্মদিন ! জিত এসেছিল | তোর জন্য রজনীগন্ধা আর চকলেট নিয়ে | তুই ঘুমচ্ছিস দেখে রেখে গেছে |”
আমি বললাম, “কিছু বলল ?”
মা বলল, “ছেলেটা একটু অদ্ভুত | আমায় কাছে সুতো চাইল | দিলাম | নিয়ে রজনীগন্ধার গোছাটা খুলে দুটো আলাদা গোছা করলো, ফুলদানিতে রাখল | আমি কেন জানতে চাইলে বলল, ইতি কে জিজ্ঞাসা করবেন | হ্যাঁ রে, ফুলদানি তো একটা, দুটো গোছা করে রাখার কী দরকার ?”

শোনো ! তুমি আর আমায় এই পুজোয় পাচ্ছ না | চকলেট দুটো আমি বন্ধুদের সাথে ভাগ করে খাব | তুমি দূরে থেকো | এটা তোমাকে সংযত করার জন্য, বুঝেছ ?

(মা বলছিল, “অষ্টমীর শাড়িটা পরে একদিন ও বেরলি না |” তুমি কি দশমীর দিন আসবে বিকেলে ? দুজনে গুলমোহর বাগে গিয়ে লেকের জলে বিসর্জন দেব ওই কাদামাটির নীল মোড়কটা | আর জলে পা নামিয়ে ডোবাবো রজনীগন্ধা জোড়া | জিজ্ঞাসা কর না কোনটা, প্লীজ !)

(আর তোমার নই)
ইতি




-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ষষ্ঠী- ১০ অক্টোবর ২০১৩