|| উল বোনার ঝুরো গল্প ||
বাবা, মা মারা যাওয়ার পর অনেকদিন ফ্ল্যাটটা বন্ধ পড়েছিল | বাবা উইল করে যায়নি | মা আগেই মারা গেছে | উকিল ধরে জানা গেল অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, বেশ কিছু টাকাও খরচ হবে, কোর্ট থেকে উত্তরাধিকারের কাগজ বের করতে | তাও, বিদেশে থাকা ছোট ছেলে নাকি কোনও অংশ পাবে না | বড় ছেলে পরিতোষ বাকি ভাই বোনেদের বলে দিল, “আমি আমার অংশ ছেড়ে দিচ্ছি | তোরা যা করবি কর |” সবাই শুনে বলল, “তাই কি হয় | তুই না বড় ছেলে |” পরিতোষ অটল দেখে শেষে জামাই মুকুল কোমর বেঁধে নামল | কয়েক বছর আগে রিটায়ার করেছিল | কাজের মানুষ, লোক চেনে, আর লোক চরাতে পারে | মুচকি হেসে স্ত্রীকে বলল, “আমি আগেই জানতাম, আমার ওই ভাবুক, প্রেমিক শালার দ্বারা কিস্সু হবে না |”
কার্যত পরিতোষ হাত সম্পূর্ণ গুটিয়ে থাকতে পারল না | যদিও সে হলফনামা লিখে দিল যে সম্পত্তির কোনও দাবী করবে না, তবুও নানান কাগজে সই করতে হয় | মাঝে মধ্যে মুকুল আলগোছে বলে, “তুমি কী সত্যিই নেবে না ? আমি কিন্তু চাই তুমি তোমার অংশ পাও |” পরিতোষ শান্ত ভাবে মাথা নাড়ে | এই ভাবে বছর খানেক কেটে গেলে মুকুল একদিন ফোন করলো, “শোনো, বাড়িটার খরিদ্দার ঠিক হয়ে গেছে | হস্তান্তর হওয়ার আগে যা জিনিস আছে সব বিদায় করছি | তুমি কি কিছু নেবে ?” পরিতোষের মনে পড়ল তার ছোট বেলার কিছু বই ছিল বাবার আলমারির তলায় | একটা প্যাকিং কেসেও বাবার কিছু বইও ছিল | বলল, “আচ্ছা, মুকুলদা’ আমি একবার এসে দেখব | কিছু বই হয়তো নেব |”
প্যাকিং কেসের মধ্যে পাওয়া গেল পরিতোষের স্কুলের প্রাইজের আর বাবা মায়ের কিছু বই | বহু বছর বাক্সে বন্ধ থাকায় বইগুলোর গা ময় চিটচিটে ঝুল, এক-দুটো পোকার ডিম, আর অজস্র গুঁড়ো ময়লা, যা চট করে ছাড়তে চায় না | ওগুলো বাড়িতে এনে পরিতোষ কদিন পিছনের বারান্দায় রোদে ফেলে রেখে, একদিন ভালো করে ভ্যাকুয়াম ক্লিনর দিয়ে পরিষ্কার করে, ঘাঁটতে বসলো | কিছু বই স্কুলে পুরস্কারে পাওয়া – খুবই ছেলেমানুষি – হয়তো সেই বয়েসে উদগ্রীব হয়ে পড়েছে, কিন্তু ও এখন আর সেই উত্তেজনা অনুভব করল না | বাবার বইগুলো ব্রিটিশ আমলের কারিগরির বই | স্কুলে পড়াকালীন খুব দুরূহ অথচ চিত্তাকর্ষক লাগত, মনে হত কবে ও কলেজে উঠে ওই সব বই পড়বে | এ ছাড়া ছোটবেলার কিছু পুরনো পুজো সংখ্যা – আর পরবর্তী কালে মাকে কিনে দেয়া কিছু শারদীয়া আনন্দবাজার আর দেশ |
সব শেষে, উচ্চতায় কম, প্রস্থে লম্বাটে মায়ের উল বোনার বইটা - শ্রীমতী মীরা দেবীর লেখা উলশিল্প – প্রথম ভাগ | বহু ব্যবহারে বাঁধাই ছিঁড়ে এলেও, পাতাগুলো প্রায় সবই আছে | প্রথম পাতায় মায়ের অপরিণত হাতে লেখা নাম | সাড়ে তিন টাকা দামের, আশ্বিন ১৩৪৩ এ প্রথম প্রকাশিত, বইটার বর্তমান সংস্করণ আশ্বিন ১৩৫৬ | পরিতোষ হিসেব করে দেখল বইটা তার জন্মের কাছাকাছি সময়ে কেনা | ভিতরে কয়েক পাতা অন্তর সাদা-কালোয় উল বুনুনির বিভিন্ন নকশার ছবি | কিছু তার খুব চেনা, যেন এখনও চোখ বুজলেই সেই সব সোয়েটার দেখতে পাবে, যদিও বিশেষ সময়টা মনে পড়বে না | যেমন এই তো সেই নকশাটা, যেটা মা ওর মেরুন রঙের সোয়েটারে বুনেছিল |
বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেলা হলে, নন্দিনী এসে ডাকল, “এই যে মিস্টার লস্ট ! কত বেলা হল | স্নান করবে, খাবে কখন ?”
সেদিন রাত্রে শুয়ে নন্দিনী জিজ্ঞাসা করল, “তুমি যে বইটা দেখছিলে ওটা কিসের ?” পরিতোষ উত্তর দিল, “মায়ের উল বোনার বই |”
নন্দিনী – “মা বুঝি খুব বুনতেন ?”
পরিতোষ – “হ্যাঁ | ছোটবেলায় আমরা ভাই বোনেরা মায়ের হাতের বোনা সোয়েটার পরেই বড় হয়েছি | বাবাও মায়ের হাতের বোনা সোয়েটার পরত | তবে বাবার খুঁতখুঁতানির জন্য মাকে দেখেছি একই সোয়েটার বার বার বুনে, খুলে আবার বুনতে | এমন ও হয়েছে যে বাবা একই সোয়েটার এক শীতে পরে পরের শীতে মাকে দিয়ে খুলিয়ে আবার বানিয়েছে |”
নন্দিনী – “তাই বুঝি এত সময় ধরে লস্ট হয়ে গিয়েছিলে ?”
পরিতোষ – “আসলে, উল বোনা ঘিরে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছিল | সব কেমন গল্পের মত ... “
নন্দিনী – “কী গল্প ? আমি কি আগে শুনেছি ?”
পরিতোষ – “হয়তো, হয়তো নয় | আমার অনেক কথাই তুমি জানো, আবার কিছু কিছু হয়তো কোনদিন বলিনি |”
নন্দিনী – “তাহলে বলো সব, শুনি |”
পরিতোষ – “ওহ, সে সব কথা শোনাতে, শুনতে রাত কেটে যাবে | তোমার ঘুম পায় নি ?”
নন্দিনী – “পাক গে | তুমি বলো |”
<<
বেশ, শোনো তাহলে ...
আমাদের ছোটবেলায় সব বয়েসের মেয়েরাই উল বুনত | শীতকালে দুপরে ঘুমনোর চল ছিল না | পাড়ার বউরা একসাথে বসে উল বুনত | আর সেই সাথে নানান গল্প গুজব, আর পরচর্চা হত | মান অভিমানও হত, আবার মিটেও যেত | পাড়ার বউদের মধ্যে মা খুব ভালো বুনতে পারত বলে বোনার আসর আমাদের বাড়িতেই বেশি বসত | সামনের উঠোনে দুপুরের রোদ এসে পড়ত | সেই রোদে সবাই উঠোনে নামার সিঁড়িতে, কেউ উপরে, কেউ নিচে বসে বুনত | তাদের কারো কারো মেয়েও এসে বসত, বোনা শিখত, কিম্বা শুধু গল্প শুনত | কখনও তারা বকুনিও খেত, “এই যা, গিয়ে খেল | বড়দের সব কথা তোদের শোনার মত নয় |” বুঝতাম কিছু এমন গল্পও হয়, যা অল্পবয়সী মেয়েদের শোনার কথা নয় | কিন্তু কান দিয়ে শুনেও কোনও দিন কিছু বুঝতে পারিনি, কেন না তখন তেমন কিছু কথা যেই বলত, সে গলা খাদে নামিয়ে বলত |
যতদূর মনে পড়ে, আমার প্রথম সোয়েটারটা ছিল মেরুন রঙের, যেটা আমার বাড়ন্ত বয়েসের সাথে সাথে এক আধ-বার খুলে, আরও উল যোগ করে প্যাটার্ন বদলে বোনা হয়েছিল | মেরুন রংটা আমি ওই উলের রং দেখেই চিনি | তখনকার দিনের পিওর উল | খুব গরম হত | ওর একটা প্যাটার্ন আমার এখনো মনে আছে – খাড়া খাড়া ডিমের ছড়া, প্রত্যেকটার মাথায় শুঁড় আর লেজে ফুটো | মা বলত ওগুলো পশমের গুটি, কিন্তু দেখে আমার আরশোলা মনে হত |
>>
নন্দিনী পরিতোষকে থামিয়ে বলল, “ঘটনার কথা কী বলছিলে ?”
<<
বলছি তো ...
আমার বছর পাঁচেক বয়েসে প্রথম ঘটনা – শীতকালে মাসি এসেছে, সাথে পিয়াদি’, আমার থেকে দু’বছরের বড়, আর পাপুন, আমার থেকে বছর খানেকের ছোট | দুপুর বেলায় মায়েরা উল বুনছে, আর আমরা কাছে কাছেই ঘুরঘুর করছি, মা মাসির গল্প শুনছি | উজ্জ্বল রোদে শীতটা তেমন গায়ে লাগছে না | হটাত পাপুন বলল ওর খুব শীত করছে, কোট পরবে | কোটটা ভিতর ঘরে দেয়ালে ওর নাগালের ঊর্ধ্বে টাঙানো ছিল | মাসি বলল, “শীত কই ? কোট পরবি যে, গরম লাগবে না ?” কিন্তু পাপুন একগুঁয়ে, মানল না, নাছোড়বান্দা জেদ ধরে বসল | শেষে পিয়াদি’কে উঠে কোটটা এনে দিতে হল | একটু পরে মাসি দেখে পাপুন কোটের পকেট থেকে কিছু বের করে মুখে পুরছে | “এই, দেখি দেখি, কী মুখে দিচ্ছিস |” পাপুন ধরা পড়ে গেল | লুকিয়ে কুল কিনে কোটের পকেটে রেখেছিল, পরে খাবে বলে | তখন আমাদের কুল খেতে মানা, বেশি খেয়ে কাশি হওয়ার ভয়ে | তাই পাপুন মাসিকে বলতে পারছিল না, অথচ কুলের লোভ সামলাতেও পারছিল না | ওর কাণ্ড দেখে পাড়ার মাসীমারা খুব হাসলেন, মাসিকে বললেন, “আহা, দাও দাও, বেচারাকে ক’টা কুল খেতে দাও | কিছু হবে না |” তাও মাসির রাগ কমে না, “কুল খাবে, খাক | আমি জানতে চাই, ও পয়সা পেল কোথায় ?” শেষে আমি বললাম, গুলু মাসি কিনে দিয়েছিল | গুলু মাসি পাড়ার বাগচি মাসিমার আইবুড়ো বোন | আমি জানতাম গুলু মাসিকে কেউ কিছু বলবে না | ও উল বোনার আসরে আসত না | কিন্তু প্রায়ই পাড়ার ছেলেদের স্কুলের সোয়েটার বুনে দিত | আমায় ধরে গায়ে যার তার সোয়েটার পেতে বলত, “দেখি, বোনাটা ঠিক হচ্ছে কি না |” আমার কেন জানি না মনে হত, আমাকে ও ওই অছিলায় ডাকত | তারপর কাছে টেনে বলত, “শোন, উল বোনার ওখানে আমাকে নিয়ে কী গল্প হয়, বলবি ?”
একটু বড় হয়ে, বোধহয় ক্লাস নাইন কী টেনে পড়ি – রাইগাংপুরে তখন মেসোমশাই বদলি হয়ে এসেছেন | মাসির কাছে বেড়াতে গেলাম শীতে | ভীষণ ঠাণ্ডা, ঠিক এখানকার মতই, তবে আকাশ অনেক বেশি ঝকঝকে, রোদ অনেক বেশি ঝলমলে, সাথের ঠাণ্ডা হাওয়া কী হালকা | দুপুরে মেসোমশাই খেয়ে অফিসে ফিরে গেলে মাকে নিয়ে মাসি কোন বান্ধবীর বাড়ি যায় | সেখানে উল বোনার ফাঁকে গল্প গুজব হয় | আমি বাড়িতে থেকে পাপুনের সাথে খেলি, নয় পিয়াদি’র সাথে গল্প করি | মাঝে মাঝে দিদির বান্ধবীরা আসে | আবার কখনও দিদিও মা, মাসির সাথে চলে যায় | একদিন দুপুরে ফোন বাজলে পিয়াদি’ ধরল, আর বলল, “মা ডাকছে | উল নিয়ে যেতে হবে |” আমিও গেলাম পিয়াদি’র সাথে মাসির বান্ধবীর বাড়ি | সেখানে বাগানের ঘাসে চেয়ার পেতে বসে অনেকে উল বুনছে | আর ঘাসে বসে মাসির সেই বন্ধুর মেয়েও উল বুনছে | ও ছিল পিয়াদি’র থেকে বছর কয়েকের বড় | শান্ত, মিষ্টি মুখটা দেখতে ভারি করুণ | ওর একটা পা ছোট হওয়ায় একটু খুঁড়িয়ে হাঁটত | পিয়াদি’ বলত ওর নাকি ওই কারণে বিয়ে হচ্ছে না | বলত, “আরও কারণ আছে, কিন্তু তোকে বলা যাবে না” | পিয়াদি’ মাসি কে উল দিতে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় কেউ একটা কিছু বলল, আর সবাই ওই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে উঠল | আমি দেখলাম মেয়েটা ঝট করে উঠে, ওর বুকের সামনে ঝোলা উড়নির ভাঁজে রাখা একটা উলের বল আর হাতের বোনা ঘাসে ফেলে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ির ভিতরে পালিয়ে গেল | ফেরার পথে আমি পিয়াদি’ কে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী কথা শুনে ওই দিদি এমন লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল |” দিদি বলল, “ওর মা বলল, সবার মেয়ের দুটো মানা, আমার মেয়ের শুধু একটা |” আমি বললাম, “মানা মানে ?” দিদি একটু থমকে গিয়ে বলল, “উলের বল ... ওই যেটা উড়নির ভিতরে ঝুলিয়ে বুনছিল, সেটাই |” আমি বললাম, “উলের বল কে মানা বলে ?” দিদি বলল, “ধর, তাই |” আমি বললাম, “কিন্তু সবাই তো একটাই উলের বল নিয়ে বুনছিল |” দিদি ভীষণ চটে গিয়ে বলল, “আচ্ছা, সব মেয়েলি কথা কি তোর না বুঝলেই নয় ?” বড় হয়ে জেনেছিলাম, কার মুখে মনে নেই, শরীরের গড়নের ওই অভাবের জন্যই ওই মেয়েটার ছেলে জুটছিল না |
আমার মনে নেই স্কুলের শেষের দিকে কী সোয়েটার পরতাম | কিন্তু যেবার কলেজে ভর্তি হলাম, পুজোর ছুটিতে বাড়ি এলে আমার একটা কট্সউলের জামা, আর একটা গাড় খয়েরী রঙের বুক খোলা ফুলহাতা সোয়েটার হল | ছুটির পরে যেদিন ফিরছি, সন্ধ্যের ট্রেন ধরিয়ে দিতে বাবা স্কুটারে আমায় স্টেশন পৌঁছিয়ে দিয়েছিল | সদ্য ঠাণ্ডায় আমি ওই নতুন সোয়েটারটা পরেছিলাম | পরে, বাবার চিঠিতে জানলাম স্টেশন যাওয়ার পথে, কি বাড়ি ফেরার সময়, স্কুটারের স্টেপনিটা ব্র্যাকেট সমেত ভেঙ্গে পড়ে যায় | বাবা বাড়ি ফিরে স্কুটারটা দাঁড় করাতে গিয়ে দেখে | সাথে সাথে আবার স্কুটার নিয়ে ছোটে, অনেক রাত্রি অব্দি সারা রাস্তা তন্ন তন্ন করে খোঁজে, কিন্তু পায় না | নতুন স্টেপনি কিনতে অনেক টাকা লাগে | বাবা আমাকে সব সময় বলত স্টেপনিটা ধরে বসতে | কিন্তু, পিছনে হাত ঘুরিয়ে ধরতে আমার আঁতে লাগত | এর পর, আমি ওই সোয়েটারটা পরলেই আমার কেমন অনুশোচনা হত | আমি সেকেন্ড ইয়ারে উঠে আমার স্কলারশিপের টাকায় আসানসোল থেকে ইয়র্কের একটা চারকোল গ্রে সোয়েটার কিনলাম, তখনকার দিনে তেষট্টি টাকা দিয়ে | সেটাই আমার প্রিয় সোয়েটার হয়ে দাঁড়াল | আমি মায়ের বোনা সোয়েটারটা পরতাম ক্লাস করতে |
ফাইনাল-ইয়ারে কোন এক ইংরেজি সিনেমায় নিটেড টাই দেখে মাকে ধরে ওই সোয়েটারের বেঁচে যাওয়া উল দিয়ে একটা টাই বুনিয়েছিলাম, | দু’মাথা চৌকো, সাবুদানা প্যাটার্নে বোনা, ওই টাইটাই আমার সম্বল ছিল অনেকদিন |
>>
পরিতোষ থামল | ওর প্রথম চাকরির ট্রেনিংয়ে কানপুরে থাকতে হয়েছিল এক বছর | তার আগে ও উত্তর ভারতের ভয়ঙ্কর শীত দেখে নি | ওর রুমমেট ছিল আর এক ট্রেনি নরেশ | ল্যখন্যউ এর ছেলে | দেখতে অনেকটা হিন্দি সিনেমায় বাবার ভূমিকার অভিনেতা নাসির হুসেনের মত | আধ-বোজা চোখ, আর ঝোলা গোঁফ সমেত | আর, সেই সিনেমার বাবাদের মতই দিলদরিয়া মেজাজ | সে প্রথমে পরিতোষকে নিজের একটা কম্বল দিয়ে বসল | তারপরে ওকে বলল বাড়ি গেলে ওর জন্য একটা সোয়েটার বানিয়ে এনে দেবে | সত্যিই সংক্রান্তিতে বাড়ি গেল দু’দিনের জন্য, আর ফিরে এলো একটা লাল-ইমলির খয়েরি রঙের উলের ভারি সুন্দর সোয়েটার নিয়ে | ওর নিজের বোন নাকি এক দিনে সমস্ত সোয়েটারটা বুনেছিল | কী গরমই ছিল সেই সোয়েটারটা | সেটা গায়ে দিলেই তার ওমের সাথে সাথে পরিতোষ অনুভব করত একটা অচেনা মেয়ের দয়া, আর জানতে ইচ্ছে করত, কেন, কী জন্য মেয়েটা ওকে এত বড় একটা কষ্টের উপহার দিয়েছিল |
নন্দিনী – “কি হল ? কী ভাবছ এত |”
পরিতোষ – “হ্যাঁ ? ... ওই, কানপুরে থাকার সময়ের কথা ... ”
নন্দিনী – “সব শুনেছি, সব জানি | তারপরের গল্প বলো |”
<<
কানপুরের ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি ফিরলাম শীতে | সেবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা | তখন মডেলার উল খুব চলত | আমি আমার টাকায় কালো সিক্স-প্লাই উল কিনে মাকে দিয়ে একটা হাই-নেক ফুলহাতা সোয়েটার বানালাম | সেটা হয়েছিল শীতের যম | ওটা পরে রাত্রি দশটা পর্যন্ত প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রকে বসে আড্ডা দিয়েছি, ঠাণ্ডা লাগে নি | কিন্তু তার জারিজুরিও খাটল না একবার | হ্যালের কাজে শ্রীনগর যেতে হয়েছিল | দিল্লি অব্দি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেনে | তারপর ওখান থেকে এয়ারফোর্সের একটা বিশেষ প্লেনে, দু’জন যাত্রী | ভোরে উঠে দিল্লি থেকে প্লেন ধরেছি | পরেছি সেই মডেলার সোয়েটার, আর তার উপর একটা টেরিউলের জ্যাকেট | পথে প্লেনটা লেহ তে নামল | ট্যাক্সিওয়ের বাইরে চারিদিকে বুক উঁচু বরফ | পাইলট জানালো, বাইরে তাপমান মাইনাস সতেরো | তাই কেবিনে ইঞ্জিনের গরম হাওয়া দেয়া হচ্ছে | আমার যেন বাইরে না যাই | আমার সহযাত্রী, সে লেহ তে আগে এসেছে, আমায় ঠাট্টা করল, “সে কী ? লেহ এর মাটিতে পা ছোঁয়াবেন না ?” ব্যাস, আমিও নেমে পড়লাম | একটা হ্যালের লোক পেয়ে তার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম | একটু পরে দেখি হালকা হালকা ঠাণ্ডা লাগছে | তাড়াতাড়ি কেবিনে ফিরে এলাম | কিন্তু ততক্ষণে জ্যাকেট, সোয়েটার সব মাইনাস সতেরোয় | যে হাড়কাঁপুনি ধরল, সে আর ছাড়ে না | প্লেনের দরজা বন্ধ হল, প্লেন উড়ল – আমি কতক্ষণ ধরে শুধু কাঁপতে থাকলাম | শেষে শ্রীনগর এ পৌঁছে এয়ারফোর্সের থেকে একটা কোট-পার্খা পেয়ে সে যাত্রায় ওখানকার শীতে টিকেছিলাম |
তাহলেও, বাড়িতে শীত কাটাতে এলে ওই মডেলার সোয়েটারটাই পরতাম সন্ধেবেলায়, আর সকালে সেই কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে কেনা ইয়র্কের সোয়েটারটা | তারপর বুনটির বিয়ে হল | মুকুলদা’র বাড়িতে প্রায় রোজ সন্ধ্যায় চা, পকুড়ি খেতে খেতে আড্ডা দেয়া, আর কখনো রাত্রিভোজ ও করে বাড়ি ফেরা | জয়ন্তী সরোবরের পাশ দিয়ে আসতে, অত ঠাণ্ডায়ও ওই মডেলার সোয়েটার গায়ে থাকলে স্কুটারের হাওয়া গায়ে লাগত না | কিন্তু তাতে কুনজর লাগলো | একদিন মুকুলদা’র পাড়ার এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী কে নিয়ে বেড়াতে এল | ভদ্রলোক এদিকের, স্ত্রী বাঙালি | মহিলার রং শ্যামলা, মাথায় কোঁকড়ান চুল টান করে বাঁধা তবু বিশৃঙ্খল, সিঁথিতে সিঁদুর নেই, আর একটু বুনো মুখশ্রীতে অসতর্ক চঞ্চল দৃষ্টি | পরে মুকুলদা'র কাছে শুনেছিলাম মহিলাটি নিজের বাঙালি বর কে ছেড়ে প্রতিবেশী এই লোকটার সাথে বাস করতে শুরু করে | সে যতক্ষণ থাকলো, মাঝে মাঝেই ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখতে থাকলো, চোখাচোখি এড়িয়ে | ক’দিন পরে একই ব্যাপার | কিছুদিন এইরকম গেলে আমি মুকুলদা’ কে ব্যাপারটা বললাম | বুনটি বলল, “হ্যাঁ, দাদা, ওই বৌদির কৌতূহলটা একটু বেশিই | তবে তোকে নিয়ে হয়ত নয় |” তার ক’দিন পরেই মুকুলদা’ হাসতে হাসতে বলল, “পরিতোষ, ব্যাপারটা পরিষ্কার হল | মঞ্জুলা (সেই মহিলা) কাল আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার শালার বুঝি আপনার কালো সোয়েটারটা খুব পছন্দ ?” আসলে কী হয়েছিল, অন্য উল কাচলে ছোট হয়, আর মডেলার উলটার ব্যাপারটা ছিল উল্টো | সোয়েটারটা কেচে কেচে বড় হয়ে গিয়েছিল | আমার গায়ে বেশ ঢিলে হয়ে গিয়েছিল | আমি বললাম, “কই মুকুলদা’, তুমি এটা পর তো, দেখি তোমার গায়ে ওঠে কি না |” সত্যি ওটা মুকুলদা’র গায়ে ঠিক হল | একদিন খুব রাত্রে মুকুলদা’ আমাদের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরবে | গায়ে হাফ হাত সোয়েটার শুধু দেখে মা বলল, “মুকুল, তুমি পরিতোষের সোয়েটারটা গায়ে দিয়ে যাও |” তারপর আমি আর সোয়েটারটা ফিরত নিলাম না | বদলে বুনটি ওর কলেজে থাকতে আর্ট ক্লাসে বোনা একটা সোয়েটার আমায় দিয়ে দিল | আকাশী নীল রঙের সিনথেটিক উলটা পাপুন সিমলা থেকে এনে দিয়েছিল | এর পর আমি গলাবন্ধ চেন দেয়া জ্যাকেট পরতে শুরু করি | সেই ছিল আমার শেষ সোয়েটার, বিয়ের আগেকার |
>>
কথা থামিয়ে, নন্দিনী চুপ করে আছে দেখে পরিতোষ জিজ্ঞাসা করল, “ঘুমিয়ে পড়েছ ?”
নন্দিনী ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “না, না ... হ্যাঁ, ঘুম তো একটু পাচ্ছে ... |”
পরিতোষ – “তাহলে ঘুমাও এবার |”
নন্দিনী – “ঘুমবো, ঘুমবো | তার আগে তোমার সব গল্পের নায়িকাদের শেষ কথা বলো | তোমার সেই পাড়াতুতো গুলু মাসির কি হল ?”
পরিতোষ – “গুলু মাসিকে দেখতে তো খুব সুন্দর ছিল | তাই বদনাম | তাই ছেলে খুঁজতে খুঁজতে বয়েস বেড়ে গিয়েছিল | শেষে ওই রূপের জোরেই এক খুব বড় ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয় | আমাদের পাড়ায় প্রথম দ্বিরাগমনে কেউ গাড়ি চড়ে আসে | জানো, তারপরে কিন্তু গুলু মাসি আর আমাকে দেখলে ডাকত না !”
নন্দিনী – “ভালো তো | আর, সেই খোঁড়া মেয়েটা ?
পরিতোষ – “পিয়াদি’র কাছে বহুকাল পরে জেনেছিলাম, ওর আর বিয়ে হয় নি | রাইগাংপুরে একটা স্কুলে চাকরি করত | ওর উল বোনার হাত ভালো ছিল বলে কাকাবাবু, ওর বাবা, ওকে একটা উল বোনার মেশিন কিনে দেয় |”
নন্দিনী – “আর, মঞ্জুলা বৌদি, না কী, সেই মুকুলদা’র পাড়ার বউটার |”
পরিতোষ – “বুনটি বলত,ও নাকি মাঝে মাঝে কাঁদত, ‘কী ভুল করেছি’ বলে | এক-দেড় বছর পরে নিজের বাবার কাছে ফিরে যায় | বর ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল, যায়নি |”
নন্দিনী পরিতোষের কাছ ঘেঁষে বলল, “আশ্চর্য ! আর, তোমার সেই কানপুরের বন্ধুর বোন ? ওর মনে কী ছিল, যে একদিনের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে সোয়েটার বুনে দিয়েছিল ?”
পরিতোষ – “ও হ্যাঁ ! সেই ঘটনাটার শেষটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম | মায়ের উল বুনে পাকা চোখ তো | অনেক দিন পরে বলেছিল সোয়েটারটার সামনের আর পিঠের দিকের বোনা নাকি আলাদা দু’হাতের ছিল, একটা যেমন নতুন বুনতে শিখলে হয়, অন্যটা পাকা হাতের টানটান | বলল, হয়তো, মায়ে মেয়েতে মিলে বুনেছিল | মা আমায় আগে বলে নি |”
নন্দিনী একটু চুপ করে থেকে বলল, “সত্যি ? মা ধরে ফেলেছিল ? কই, এতদিন তো তুমি আমায় বল নি !”
--------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৬ জানুয়ারি ২০১৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন