শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

গহ্বর চৌর্য কাণ্ড


|| গহ্বর চৌর্য কাণ্ড ||                                 


আমার শৈশব কাটে এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে, নাম জৈত্যপুর | জৈত্যপুরের জমিদার নৃসিংহ দেব পৈত্রিক ভিটা ত্যাগ করিয়া কলিকাতা নিবাসী হইবার পূর্বে ভিটার রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার্থে বহির্বাটীখানি পুলিশ থানার জন্য দান করেন | তাই সেই কালেই জৈত্যপুরে থানা পুলিশ ছিল – নতুবা এই কাহিনীর ঘটনাটি ঘটিত না |

আর একটি কথা – শৈশবে দেখিয়াছি পুলিশের মাথায় পাগড়ি-টুপী | বোধ হয় সেই পাগড়ি-টুপীতে মাথা গরম হয় বলিয়া বহুকাল পূর্বে তাহার সমাপ্তি হয়, ও পুলিশের আধুনিক টুপীর আবির্ভাব ঘটে | সেই পুরাতন পাগড়ি-টুপীর সহিত এই কাহিনী সংযুক্ত |

আমাদের শৈশব কালে সামাজিক জীবন খুবই সুষ্ঠু ও সামঞ্জস্য পূর্ণ ছিল | সমাজে ভেদাভেদ যে ছিল না তাহা নহে, কিন্তু উত্তম, মধ্যম ও অধম একত্রে উঠবস, খাওয়া দাওয়া করিত | ধনী গরিবকে সম্মান, গরিব ধনীকে সম্ভ্রম করিত | শিক্ষিত অশিক্ষিতকে উপেক্ষা, কিম্বা অশিক্ষিত শিক্ষিতকে অবজ্ঞা করিত না | জনতা ও পুলিশ একে অপরকে বিশ্বাস করিত | চোর ও পুলিশের মধ্যে যথেষ্ট সহযোগিতা ছিল |  নেহাত অভাবে না পড়িলে চোর চুরি করা দ্রব্য ভোগ না করিয়া,  সন্নিকটের রামপুর শহরে চোর-বাজারে কম দামে বিক্রয় করিত | সেই জন্য যাহার বাড়িতে চুরি হইত সে থানা যাইবার পরিবর্তে চোর-বাজারে যাইয়া ঢুঁ মারিত | একবার এইরূপ হইল যে বাড়িতে বাড়িতে স্নানের সাবান চুরি হয় | অনুসন্ধান করিয়া
দারোগা জানিলেন যে কোনও এক চোরের ভগিনীর বিবাহ স্থির হইতেছে, তাই সে রোজ সাবান মাখিয়া স্নান করিতে চায় – অন্তত, যতদিন না বিবাহ হয় | সুতরাং, দারোগা চোরের সহিত যোগাযোগ করিয়া এই চুক্তি করিলেন যে সে এক বাড়ি হইতে সাবান চুরি করিয়া একদিন ব্যবহারের পর তাহা পরবর্তী রাত্রে অন্য বাড়িতে রাখিয়া, সেখানকার সাবান লইয়া যাইবে আগামী দিনের জন্য | একদিন কাহারো হামাম সাবান চুরি হইলে, তাহার পরিবর্তে পরদিন সে এক লাক্স সাবান ফেরত পাইল | সাবানটি কাপড় কাচার সোডা দিয়া ফুটাইয়া, গঙ্গাজলের ছিটা দিয়া শুদ্ধ করা হইল, নতুন সাবান কিনিবার প্রয়োজন হইল না |

কখনো সেইরকম বড় কিছু চুরি হইলে পুরস্কার ঘোষণা করা দস্তুর ছিল | পুরস্কারের টাকা চোর ও পুলিশ ভাগাভাগি করিয়া চুরির মাল ফেরত দিত | এমন কথা আমরা ক্বচিৎ শুনিয়াছি যে পুলিশ চুরির অনুসন্ধান করিতেছে | চুরি হইলে পুলিশ কেবলমাত্র জেলেপাড়া, মুচিপাড়া, ঘাঁসীপাড়া যাইয়া সম্ভাব্য চোরের সহিত, পরিস্থিতি অনুযায়ী গোপনে কিম্বা প্রকাশ্যে, যোগাযোগ করিত ও পুরস্কারের রকম দরাদরি করিয়া ফিরিয়া আসিত | যাহার চুরি হইয়াছে সে ক্ষমতা সাপেক্ষ পুরস্কার দিতে রাজী হইত, এবং সেই অনুযায়ী চুরি করা জিনিস ফেরত আসিত | এই ব্যবস্থায় সকলেরই অলিখিত সম্মতি ছিল, কাহাকে কখনো কোনও আপত্তি প্রকাশ করিতে দেখি নাই |

অধুনা থানা অরাজকতার লঙ্কা, পুলিশ সেথায় সুপ্ত কুম্ভকর্ণ | কোনও অপরাধ হইলে থানা যাইতে হয় | পুলিশ অতি কষ্টে প্রাথমিক রিপোর্ট লেখে | সে’কালে পুলিশের কাজ ছিল টহল দিয়া অপরাধের খবর সংগ্রহ করা | তাহার জন্য পাড়া প্রতি বীট-কনস্টেবল ছিল | সে সিপাহী রোজ প্রাতঃকালে পাড়ায় টহল দিতে যাইত, যে যদি সময়কালে কোনও চুরির খবর মেলে, তবে চোর সংসারের নানা কার্যতে ব্যস্ত হইবার, কি বাহিরে যাইবার পূর্বে তাহাকে ধরা যায় | আমাদের পাড়ার বীট-কনস্টেবল ছিল এক শ্যামলাল যাদব | প্রত্যহ প্রত্যুষে দেখা যাইত সে নিদ্রা-ক্লিষ্ট চক্ষু কচলাইতে কচলাইতে টিপ টিপ পায়ে মাথা হেঁট করিয়া থানা হইতে আসিতেছে | তাহার টাক-মাথা প্রভাতের রৌদ্রে চক চক করিত | কিছুক্ষণ পরে সে যখন প্রত্যাবর্তন করিত তখন তাহার হাতে পাগড়ি-টুপী থাকিত | এই প্রথার কারণ, বীট-কনস্টেবলদিগের আচরণে লক্ষ্য রাখিবার জন্য থানার দারোগা পহেলবান সিং এক কৌশল করিয়াছিলেন | প্রতি রাত্রে তিনি স্বয়ং, কিম্বা বিশ্বস্ত সিপাহী দ্বারা, বিভিন্ন পাড়ার বিশেষ বিশেষ স্থানে বীট-কনস্টেবলদের টুপী লুকাইয়া রাখিতেন | সপ্তাহের সাত দিনের জন্য সাতটি গোপন স্থান ধার্য ছিল | সিপাহীদের দায়িত্ব ছিল রাত্রির টহল শেষ করিয়া সপ্তাহের দিন অনুযায়ী যথাযথ গোপন স্থান হইতে নিজ টুপী উদ্ধার করিয়া থানায় ফিরিয়া পহেলবানজীর সামনে হাজিরা দেয়া | শুনিয়াছিলাম যে দারোগা সাহেবের কুকুর শমশের সকল সিপাহীর টুপীর গন্ধের সহিত পরিচিত ছিল | তাহাকে ধোঁকা দিয়া কোনও সিপাহীর পক্ষেই অপর সিপাহীর টুপী দিয়া সংক্ষেপে কাজ সারিবার উপায় ছিল না | সিপাহীর শরীরের এবং টুপীর গন্ধের মধ্যে বিন্দুমাত্র বৈষম্য বোধ করিলেই শমশের অশান্ত হইয়া গুরুগম্ভীর হাঁকডাকে থানা মাথায় করিত |

পুলিশের সেই লাল কাপড়ের শিরস্ত্রাণ-সদৃশ টুপী ছিল সদ্য সমাপ্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিদ্যমান স্মারক | সে’কালে অপরাধ অপেক্ষাকৃত ভাবে কম ছিল – পুলিশের কাজে মস্তিষ্কের প্রয়োজন তেমন ছিল না | এই দেশের উষ্ণতা-জনিত সিপাহীদের মাথার ঘাম ব্রিটিশ আমল হইতে পায়ে না পড়িতে পাইয়া সেই সব টুপীতে পুঞ্জিত লবণে সঞ্চিত ছিল | অতএব, সিপাহী ভিন্ন অন্য কাহারো ওই পাগড়ি-টুপীর প্রতি লোভ হয় এ সম্ভাবনা ছিল না | আমরা খেলিতে খেলিতে দেখিয়াছি সে টুপী লুকানো আছে – কোনও গাছের ফোকরে, কি আটচালার খড়ের নীচে | কিন্তু তাহা পাইলেও কোনও দুষ্ট বুদ্ধির প্ররোচনা কখনও চিত্ত বিচলিত করে নাই | শ্যামলাল যাদব প্রায়শই ঘুমাইতে ঘুমাইতে প্রত্যাশিত জায়গা হইতে টুপী সংগ্রহ করিয়া টহল শেষ করিত, থানায় ফিরিয়া রিপোর্ট দিত, “সাহব, মাঠপাড়া মে সব ঠিক হ্যায় |” মাঠপাড়া  ছিল জৈত্যপুরে আমাদের পাড়া |

এক শনিবার, বিহারীদের ছট্ পর্বের দিন – প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের পূর্ব হইতেই পথ ঘাট স্নানার্থী লোকজনে গিজগিজ করিতেছে | বেলা বাড়িলে যখন ভিড় কমিল, তখন দেখা গেল শ্যামলাল বীটে যাইতেছে | সেই দিন তাহার টুপী থাকার কথা খেলার মাঠের শেষে নদীর পাড়ে এক কাঁঠাল গাছের ফোকরে | যখন সে ফিরিল, দেখিলাম তাহার লাল টুপী হাতে না ধরিয়া মাথায় রাখিয়াছে, কারণ তাহার কোলে এক রোরুদ্যমান বালক | শিশুর ক্রন্দন শুনিয়া পাড়ার কিছু জনগণ ছুটিয়া আসিল | কিন্তু দেখা গেল সে শিশু পাড়ার নহে | সে কিছু কহে না, কেবল কাঁদে | শ্যামলালকে প্রশ্ন করিলে সে জানাইল যে সে যখন টুপী লইয়া ফিরিতেছিল তখন গাছের পশ্চাৎ হইতে এক শিশুর ক্রন্দন শুনিতে পায় | সেখানে গিয়া দেখে এই শিশুটি এক গর্তের পার্শ্বে বসিয়া আছে | তাহার দুই হাত গর্তের কিনারায় রাখিয়া সেই ভাবে সে যেন কিছু জাপটাইয়া ধরিয়া উঠাইতে চেষ্টা করিতেছে, ও বিফল হইয়া কাঁদিতেছে | ইহার বেশি বিশেষ কিছু শ্যামলাল বলিতে পারিল না | এই কথাবার্তার সময় শিশু বারম্বার খেলার মাঠের দিকে হাত দেখাইয়া শ্যামলালের কান ধরিয়া টানিতে থাকিল | তখন আমাদের প্রতিবেশী ও পাড়ার বিশিষ্ট গণ্যমান্য জন মহাদেব বাবু কহিলেন, “শ্যামলাল, এ লড়কা কো ময়দান ওয়াপস লে চলো |” কার্যত আমরা সকলেই শ্যামলাল ও শিশুর সহিত মাঠের দিকে অগ্রসর হইলাম | দূর হইতে তাহার টুপী লুকাইবার কাঁঠাল গাছ দেখাইয়া শ্যামলাল জানাইল যে তাহার পিছনে সে শিশুটিকে বসিয়া কাঁদিতে দেখিতে পায় |

আমরা সেই গাছের কাছে পৌঁছানো মাত্র সে শিশু শ্যামলালের কোল হইতে অস্থির হইয়া নামিয়া দৌড়াইয়া কাঁঠাল গাছের পিছনে গেল | সেখানে মাটিতে এক গর্ত দেখাইয়া সে কহিল, “এই তো আমার গত্ত ! একে আমার বাড়ি নিয়ে চলো |” শ্যামলাল টুপী খুলিয়া শিরে করাঘাত করিয়া কহিল, “মহাদেও বাবু, অব হম ক্যা করে বতাইয়ে |” মহাদেব বাবুও (বোধ হয় শ্যামলালের মতো শিরে করাঘাত করিতে গিয়া) অপ্রতিভ হইয়া মাথা চুলকাইলেন | বাঁকি সকলে নীরব থাকিল | কেবল আমি সন্দিগ্ধ-মনে প্রশ্ন করিলাম, “গত্ত আবার কী করে কেউ বাড়ি নিয়ে যায় ?” সে কথা শুনিয়া সে শিশু উচ্চস্বরে জেদ করিল, “আমার গত্ত, আমি নেব, তোমার তাতে কী ?“

অতঃপর মহাদেব বাবুর নেতৃত্বে জনগণ থানার দিকে রওয়ানা হইল | থানা পৌঁছাইয়া দেখা গেল ছট্ স্নান সারিয়া পহেলবানজী সুপ্রসন্ন চিত্তে আসন্ন শীতের প্রথম হাওয়ায় বাহিরে কেদারায় বসিয়া চা পান করিতেছেন | তিনি সম্ভ্রম সহকারে মহাদেব বাবুকে নমস্কার করিয়া কহিলেন, “কী বেওপার মহাদেও বাবু, এত সোকাল সোকাল ?” তারপর তিনি শ্যামলালের কোলে অস্থির শিশুটি দেখিয়া প্রশ্ন করিলেন, “আরে, এ সামলাল, এ বছুয়া ক্যহাঁ সে আইল্, সুবহ্, সুবহ্ ?” ঘটনার গুরুত্ব অনুমান করিয়া রামেশ্বর জমাদার আশ্চর্য তৎপরতার সহিত এক হাতল-ভাঙ্গা কুর্সি আনিয়াছিল | ততোধিক ক্ষিপ্রতার সহিত মহাদেব বাবু তাহা দখল করিয়া কহিলেন, “পহেলবানজী, এই বাচ্চা হারিয়ে গেছে | নদীর ধারে বসে কাঁদছিল, শ্যামলাল বীটে গিয়ে পেয়েছে | একটু খোঁজ খবর নিয়ে একে বাড়ি পাঠিয়ে দিন |”

পহেলবানজী – “য়েহি বাত ? এ রামেসর, ব্যবুয়া কো অন্দর লে যাও | নজর রখনা, ঠিক সে !
“মহাদেও বাবু, চিন্তা নেই | কিছু সময় লাগবে | আপনি বিকেলে একটু খবর লিয়ে যাবেন |
“বাকি আপনারা সব এখন ওয়াপস জান |
“আপনি বসুন মহাদেও বাবু, কিছু বিচার-বিমর্স করি আমরা |”

জনগণ বিদায় হইলেও আমি রহিলাম | আবহাওয়া ও রাজনীতির ক্ষেত্রে জোচ্চুরি-জনিত অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে বিচার বিমর্শ করিয়া পহেলবানজী মহাদেব বাবুকে বিদায় করিলেন | তিনি আমাকে লইয়া বাড়ি ফিরিয়া চাকরের হস্তে সেই শিশুর জন্য কিছু দুধ ও ফল থানায় পাঠাইলেন | চাকরের উপর ভরসা না হওয়ায় আমাকে সাথে পাঠাইলেন | মহাদেব বাবু বিপত্নীক, স্থানীয় ইস্কুলের এককালীন হেড-মাস্টার – অবসর লইয়া গ্রামেই বসবাস করিতেছিলেন আমাদের প্রতিবেশী হইয়া | তাঁহার এক মাত্র পুত্র কলিকাতায় চাকুরীরত | নিঃসঙ্গ জীবনে আমার উপর তিনি কিঞ্চিত সদয় | বস্তুত, কোনও দৈনিক কার্যতে বা পদচারণে যাইবার পূর্বে তিনি আমার খোঁজ নেন, ও পারিলে আমি তাঁহাকে সঙ্গ দিই | এই কারণে লোকে বলে আমি তাঁহার ন্যাওটা |

বৈকালে মহাদেব বাবু রওয়ানা হইলেন থানায় ‘কেসের’ অগ্রগতি জানিবার জন্য | আমিও তাঁহার ডাকে তাঁহার সহিত যাইলাম | থানায় জানা গেল ‘কেস’ বিশেষ কিছু অগ্রসর করে নাই | প্রথমত, সমস্ত বীট-কনস্টেবল ফিরিয়া আসিলে, কাহারো নিকট হইতে কোনও বিশেষ ঘটনা জানা যায় নাই | কেবল দিনকর পাঁড়ে, যে বেনেপাড়ায় গত রাত্রে প্রহরায় ছিল, ছটের ভোরবেলায় একজনকে দৌড়াইয়া পলাইতে দেখে | কিন্তু বেনেপাড়ায় কোনও চুরির ঘটনা ঘটে নাই | দ্বিতীয়ত, সেই শিশু সারা দিন কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়া কেবল কাঁদিয়াছে – তাহার মুখে একই প্রশ্ন, “আমার গত্ত কই ?” শেষে সে ক্লান্ত হইয়া দুধ ও ফল খাইয়া এক বেঞ্চে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে |

মহাদেব বাবু সযত্নে শিশুর নিদ্রাভঙ্গ করিলেন | শ্যামলাল তাহার হাত, পা, মুখ এক ভিজা গামছা দিয়া মুছিয়া দিলে, মহাদেব বাবু শিশুকে কোলে বসাইলেন | সে এদিক ওদিক চাহিল ও প্রশ্ন করিল, “আমার গত্ত কোথায় ?”

মহাদেব বাবু – “তোমার নাম কী বাবা ?”
শিশু – “না |”
মহাদেব বাবু – “তোমার নাম নেই ?”
শিশু – “না |”
মহাদেব বাবু – “ও !”
আমি – “তোমাকে বাড়িতে কী বলে ডাকে ?”
শিশু – “খোকা |”
মহাদেব বাবু – “তাই বুঝি ? তবে যে তুমি বললে তোমার নাম নেই! “
শিশু – “নেই না, আমার নাম খোকা ! আমার বাবার নাম বাবা !”
মহাদেব বাবু – “ও আচ্ছা, আচ্ছা ... হুম, বুঝেছি |”
আমি – “সবারই তো নিজের বাবাকে বাবা বলেই ডাকে |”
মহাদেব বাবু - “তা, তোমার বাবার নাম কী যেন বললে ?”
শিশু – “বাবা |”
মহাদেব বাবু – “বাবার নাম জানো না ?”
শিশু – “বললাম তো, বাবার নাম বাবা |”
মহাদেব বাবু – “ঠিক কথা | আচ্ছা, এটা বলো, তোমার বাবা কী করে ?”
শিশু – “বাবা খালি বকে | খুব বকে |”
মহাদেব বাবু – “কাকে বকে ? কেন বকে ?”
শিশু – “বাবা আমাকে বকে | আমি বাড়িতে গত্ত খুঁড়তে চাই, বাবা বাড়িতে গত্ত খুঁড়তে মানা করেছে, খুঁড়লে পরে বকে |”
মহাদেব বাবু – “তুমি কোথায় থাক ? তোমার বাবা, মা কোথায় থাকে ?”
শিশু – “আমরা সবাই বাড়িতে থাকি |”
মহাদেব বাবু – “তোমার বাড়ি কোথায় ?”
শিশু – “বললাম তো | ওই যেখানে বাবা থাকে, মা থাকে, ওটাই আমার বাড়ি |”
মহাদেব বাবু – “তা, বাবা বকে তাও তুমি গর্ত কেন খোঁড় ?”
শিশু – “তুমি এত প্রশ্ন কেন করছ ? আমার গত্ত কোথায় ?”
পহেলবানজী – “ফির ওহি জিদ ! এ তো বহুত জিদ্দি বাচ্চা আছে |”
মহাদেব বাবু – “কই তুমি তো বললে না তুমি গর্ত কেন খোঁড় |”
শিশু – “জায়গা করতে গত্ত খুঁড়ি | গত্তে জায়গা হয়, জানো না বুঝি ?”
মহাদেব বাবু – “তুমি গর্ত খোঁড় বাড়িতে জায়গা করতে ? জায়গা করে কী করবে ?”
শিশু – “আমার নতুন খেলনা এনে কোথায় রাখব ? বাবা আমায় বলেছে, বাড়িতে তো আর জায়গা নেই, তাই আরও যদি খেলনা চাস তো আগে বাড়িতে জায়গা কর |”
মহাদেব বাবু – “ওহ ! তা, তুমি মাঠে কেন গত্ত খুঁড়তে গেলে ? বাড়িতে খুঁড়লেই তো পারতে |”
শিশু – “বললাম তো যে বাবা বকে | বলে, খবরদার যদি বাড়িতে গত্ত খুঁড়েছিস ... তুমি চলো না বাপু, আমার গত্তটা বাড়ি নিয়ে যাব, ওতে অনেক জায়গা, অনেক খেলনা আঁটবে |”
পহেলবানজী – “এ খোকা | খিলোনা এখন কোথায় মিলবে ? যখন কিনবে তখন গত্ত লিয়ে লিবে |”
শিশু – “না, না | আমি কাল ছটের মেলায় খেলনা দেখেছি | চাইলাম তো বাবা বলল, বাড়িতে আগে জায়গা কর, তবে খেলনা পাবি |”
মহাদেব বাবু – “তাই তো !”
অতঃপর মহাদেব বাবু যেন উপরোক্ত সংলাপ অনুধাবন করিয়া কহিলেন, “ও ! এই ব্যাপার |”

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করিলে পহেলবানজী অনেক চিন্তার পর মহাদেব বাবুর সহিত সম্মত হইয়া একবার, “ও ! য়েহি বেওপার |”  কহিয়া অন্যমনস্কভাবে গোঁফে তা দিতে লাগিলেন | এদিকে সন্ধ্যা হয় হয়, রামেশ্বর এক হারিকেন বাতি রাখিয়া গেল | মহাদেব বাবু কিঞ্চিত ইতস্তত করিয়া পহেলবানজীকে প্রশ্ন করিলেন, “তাহলে বাচ্চাটা আজ রাত কোথায় কাটাবে ? এটা তো ভাবার বিষয় !”
পহেলবানজী – “কিছু চিন্তা নাই | আমি ওকে গোমতীকে পাস সুলিয়ে দিব | খানা-পিনা ভি ওহি করিয়ে দিবে | কোনও বেওপার নেই | আপনি এখন আসুন | কাল ফির বাত হোবে |”

গোমতী দারোগা সাহেবের স্ত্রী | নিঃসন্তান মহিলাটি মাতৃত্বের সকল স্নেহ ও কোমলতার এক প্রতিমূর্তি | কোনও শিশু পাইলে বড়ই মাতৃস্নেহে তাহার আদর যত্ন করে | হোলির দিন পাড়ার সব শিশুরা তাহার হাতের মালপুয়া ও ঘুঘনী খায় | অতএব, মহাদেব বাবু নিশ্চিন্ত হইয়া থানা হইতে বাড়ি ফিরিলেন |

পরদিন সকাল হইতেই হুলস্থূল কাণ্ড | মা আমাকে ঘুম ভাঙ্গাইল যে মহাদেব বাবু ডাকিতেছেন | ত্বরায় মুখ চোখে জল দিয়া ছুটিলাম, দেখিলাম থানা হইতে পেয়াদা হারাধন আসিয়াছে, যে মহাদেব বাবুকে পহেলবান সাহেব জোর তলব করিয়াছেন | থানায় গিয়া দেখিলাম পহেলবান
জী দ্রুত পায়ে থানার বাহিরে টহল দিতেছেন | মহাদেব বাবুকে লইয়া সোজা নিজ কক্ষে গেলেন | রামেশ্বর চা আনিতে গেল | ইত্যবসরে যাহা জানা গেল তাহা এই |

গত রাত্রে পহেলবান
জীর বাড়িতে শিশুটি খুবই দাঙ্গা করিয়াছে - রাতভোর একই কান্না, একই প্রশ্ন, “আমার গত্ত কই ?” এই গোলমালে জাগিয়া থাকিতে, থাকিতে শেষ রাত্রে দারোগার হটাত মনে পড়ে যে তিনি শ্যামলালের পাগড়ি-টুপী লুকাইয়া আসিতে ভুলিয়াছেন | তখন তিনি রামেশ্বরকে লইয়া যাইয়া খেলার মাঠের শেষে নদীর পাড়ে  কাঁঠাল গাছের ফোকরে শ্যামলালের পাগড়ি-টুপী লুকাইয়া আসেন | কিন্তু তাহাঁর খেয়াল থাকে না যে সেদিন রবিবার, মন্দিরে টুপী রাখিবার কথা | শ্যামলাল সেই রাত্রে ছটের আনন্দে গাঁজা-ভাং এর নেশা করিয়াছিল | সকালে নেশা কাটিবার পূর্বেই অভ্যাস মতো মন্দিরের আটচালা হইতে পাগড়ি-টুপী সংগ্রহ করিতে যায় | টুপী না পাইয়া সে পহেলবানজীকে আসিয়া কহে যে তাহার টুপী চুরি হইয়াছে | ঠিক সেই সময় গোমতী শিশুর আবদারে পরাক্রান্ত হইয়া তাহাকে থানায় রাখিতে আসিয়াছিল | শিশু শ্যামলালকে দেখিবামাত্র প্রশ্ন করে, “আমার গত্ত কোথায় ?” হতভাগা শ্যামলাল নেশার ঝোঁকে, নাকি প্রশ্নটি টুপী সম্বন্ধিত ভাবিয়া, উত্তর দেয়, “চোরি হয়ে গেছে |”

সর্বনাশ ! শিশু তৎক্ষণাৎ গোমতীর হাত ছাড়াইয়া, মাটিতে আছাড় খাইয়া পড়িয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগে | তাহার হাত পা ছোঁড়া সামলান যায় না |  কাঁদিতে কাঁদিতে তাহার মুখ চোখ লাল হয় ও চক্ষের মনি পালটাইয়া যায় | শেষে মুখে ফেনা হইয়া সে প্রায় অজ্ঞান মতো হয় | কোন মতে গোমতী তাহাকে আবার বক্ষে লইয়া, ও বারম্বার এই সান্ত্বনা দিয়া যে পহেলবানজী চোর অবশ্যই ধরিয়া তাহার নিকট হইতে গর্ত বরামত্ করিবেন, শিশুকে লইয়া ঘরে ফেরত যায় |

চায়ে চুমুক দিয়া মহাদেব বাবু কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া প্রশ্ন করিলেন, “আচ্ছা পহেলবানজী, এখনও কেউ খবর করে নি যে কোনও বাচ্চা হারিয়ে গেছে ?”
দারোগা – “ওহি তো মুস্কিল বাত আছে | সে রোকম কোনও রিপোট নাই | সব সিপাহীকে আমি পুছেছি | আপনি ভি পুছতে পারেন |”
মহাদেব বাবু – “তাহলে কি ঢাক পিটিয়ে সারা গ্রামে এই খবর প্রচার করা যায় যে একটা শিশুকে পাওয়া গেছে ? যদি কেউ কিছু বলতে এগিয়ে আসে |”

এই সব কথা বার্তা চলিতেছে এমন সময় সিপাহী দিনকর পাঁড়ে আসিয়া জোরে সেলাম ঠুকিল | তাহার উসখুস ভাব ভঙ্গি দেখিয়া পহেলবানজী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ক্যা বাত ?” দিনকর তখন জানাইল যে ছট্ স্নানের পূর্বের রাত্রে সে যাহাকে পলাইতে দেখিয়াছিল তাহাকে তখন চিনিতে পারে নাই, কারণ সেই দুষ্কৃতিকারী বহুকাল যাবত কোনও দুষ্কর্ম করে নাই | কিন্তু, তাহাকে পরদিন খেয়া ঘাটে ফেরী নৌকার জন্য অপেক্ষা করিতে দেখিয়া দিনকর তাহাকে চিনিতে পারে যে সে পুরাতন সিঁধকাটা চোর গণেশ | দিনকরের সন্দেহ হয় যে গণেশ সেই রাত্রে কোনও কুকর্ম করিয়া পলায়ন করিতেছে | সে গণেশকে চাপিয়া ধরিয়া তাহার জেরা করে, কিন্তু গণেশ কোনও রূপ কুকর্ম কবুল করে না | তাহার কথাবার্তা হইতে এইরূপ বোধ হয় যে গণেশ কোনও কারণে ভয়ঙ্কর ভাবে ভীত, কিন্তু সে তাহা কোনও মতেই স্বীকার করে না | এই পরিস্থিতিতে দিনকর গণেশকে ধরিয়া আনিয়েছে যে যদি পহেলবানজী তাহাকে জেরা করিতে চাহেন |

পহেলবানজী রাজী হইলে গণেশকে কক্ষের ভিতর আনা হইল | দেখা গেল সত্যিই সে অদ্ভুত ভাবে ভয়ভীত, দুই নিষ্প্রভ চোখ বসিয়া গিয়াছে, নিদ্রার অভাবে ওষ্ঠ শুষ্ক ও কালো | মনে হইল যে সে যেন দিনভোর খায় নাই | পহেলবানজীর আদেশে রামেশ্বর তাহাকে জল আনিয়া দিলে সে তাহা পান করিয়া মাটিতে উবু হইয়া বসিয়া দুই হস্তে মস্তক ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল, “হুজুর, আমার প্রাণ বাঁচান, আমাকে গারদে রাখুন |”

তাহার অনেক কান্নাকাটি, ও পরিবর্তে দারোগা সাহেবের দাপট, অনুনয়, সান্ত্বনা ও প্রলোভন বাদে গণেশ জানাইল যে ছটের পূর্ব সন্ধ্যায় তাহার মনে হয় যে সে অনেক দিন সিঁধ কাটে নাই, এই ভাবে দিন কাটিলে ক্রমে ক্রমে সে পেশা-চ্যুত হইবে | তাহার তখন চিন্তা হয় সে বার্ধক্যে খাইবে পরিবে কী করিয়া | অনেক চিন্তা ভাবনা করিয়া সে স্থির করে যে সে রাত্রে বেনেপাড়া যাইয়া দেখিবে কেহ প্রত্যুষে ছট্ স্নানে যাইতেছে কি | এবং সেরকম মক্কেল পাইলে সে সেই সুযোগ লইয়া সিঁধ কাটিবে - শুধু মাত্র হাতযশ বজায় রাখিবার জন্য, তেমন কোনও বড় চুরি সে করিবে না | রাত্রে শুইবার পূর্বে সে বেনেপাড়া যাইয়া চারিদিক পরীক্ষা নিরীক্ষণ  করে | শিবানন্দ স্যাঁকরার বাড়ি হইতে কথাবার্তা শোনা যাইতেছিল | কান পাতিয়া তাহার ঠাহর হয় যে শিবানন্দ প্রত্যুষে রওয়ানা হইবার প্রস্তুতি করিতেছে | তখন গণেশ ঠিক করে যে সে প্রত্যুষ-পূর্বের অন্ধকারে আসিয়া সিঁধ কাটিবে | মাটি দিয়া গাঁথা ইটের দেয়াল, বিশেষ সমস্যা হইবে না | সে প্রায় চার ঘটিকায় আসিয়া দেখে বাড়ি অন্ধকার | সে অনুমান করে যে শিবানন্দ ইতিমধ্যেই ছট্ স্নানে গমন করিয়াছে | সে মন দিয়া দেয়ালের মাটি কাটিতে শুরু করে | কিন্তু, হটাত সেই শয়নকক্ষ, যাহার দেয়ালে সে সিঁধ কাটিতে শুরু করিয়াছিল তাহার ভিতর হইতে উচ্চস্বরে শোনা যায় শিবানন্দর গলায়, “এতদিন তো ব্যাটা বেশ হাত গুটিয়ে ছিল | আজ কি আমি বাড়ি থাকব না জেনে সেই সুযোগ নিয়ে মাটি কাটবে ঠাউরেছে ? ভেবেছে কী সে, হ্যাঁ ? মারের ভয় নেই বুঝি ?” ভিতর, বোধহয় রান্নাঘর, হইতে  শিবানন্দর স্ত্রীর ত্রস্ত কণ্ঠে শোনা যায়, “আস্তে বলো | শুনে ফেললে ছেলেটা চমকে উঠে ভয় পাবে |”
শিবানন্দ – “শোনে শুনুক | তোমার জ্বালায় তো এই বাড়িতে জোরে কথা বলার উপায় নেই | কী মুশকিল !”
স্ত্রী – “কথা বলা এক, আর মারধোর করা আর এক | তুমি এত বড় একটা মানুষ, ওকে পেটালে ও কি আর বাঁচবে ?”
শিবানন্দ – “তবে কি চোখ কান বুজে ভিটের মাটি কাটা সহ্য করব ?”
স্ত্রী – “মাটিই তো কাটছে, সিঁধ তো নয় |”
শিবানন্দ – “তুমি কচু জানো | মাটি কাটা থেকে সিঁধ কাটা - বেশি দূর নয় | মাটি কাটুক না, তারপর আমি ধরব আর  মেরে হাড়গোড় আর মাংস আলাদা করে দেব | আস্ত রাখবো না |”
স্ত্রী – “তোমার বাবা ঠিক বলেছিল, রাগলে তো তুমি নিজের ছেলেকেও খুন করতেও পারো |”
শিবানন্দ – “সাবধান ! বলে দিচ্ছি, আমি ভিটেয় খোঁড়াখুঁড়ি সইবো না, একটা হেস্তনেস্ত করবোই |”

এই কথাবার্তা শুনিতে শুনিতে গণেশের হাত পা অবশ হয়, সে বোঝে যে সে মারাত্মক ভুল করিতে চলিয়াছে – জাগ্রত গৃহস্থ তাহার অপচেষ্টা ধরিয়া ফেলিয়াছে | সেই সময় সে শোনে শিবানন্দ বলিতেছে, “আর দেরী করবো না | দাও দেখি আমার লাঠিটা, আর আলোটা একটু ধরো |” তৎক্ষণাৎ সে অতি মনোবলে শিথিল হস্ত-পদ সঞ্চালন করিয়া সিঁধকাঠি তুলিয়া দৌড় দেয় | যাইতে যাইতে সে দেখে দিনকর পাঁড়ে টহল দিতেছে | তখন সে সারাদিন গৃহে লুকাইয়া রহিয়া, সারাদিন চিন্তা করিয়া স্থির করে যে তাহার কুকর্ম অবশ্যই ধরা পড়িবে, সুতরাং তাহার গ্রাম হইতে পলায়ন করা উচিত |

গণেশের বৃত্তান্ত শুনিয়া পহেলবান
জী তাহাকে সোজা গারদে চালান করিলেন | গণেশ বিশেষ আপত্তি করিল না, নিশ্চয় এই ভাবিয়া যে গারদে সে শিবানন্দর প্রহার হইতে বাঁচিতে পারিবে | ওদিকে পহেলবানজী হারাধনকে পাঠাইলেন শিবানন্দকে তলব করিতে, যাহাতে তাহার বয়ান নেয়া যায় যে গণেশ কিছু চুরি করিয়াছে কি না | ইহার পর পহেলবানজী আমাদের ছুটি দিলেন |

বৈকালে থানা হইতে কোনও ডাক না আসায় অস্থির হইয়া মহাদেব বাবুর বাড়ি সম্মুখে পায়চারী করিতে লাগিলাম | আমায় দেখিয়া তিনি হাস্যমুখে কহিলেন, “কী নীরেন, তোমার তর সইছে না বুঝি | আচ্ছা দাঁড়াও, আমি চাদর আর ছড়িটা নিয়ে আসি |”

থানায় গিয়া দেখা গেল পহেলবানজী কক্ষে নাই | গারদের ভিতরে গণেশ ও বাহিরে শিশু, এবং শিশুর তদারকিতে নিরত রামেশ্বর | প্রথম দুই জনে খুব ভাব হইয়াছে | গারদের এপারে ওপারে বসিয়া তাহারা ঘনিষ্ঠ ভাবে গল্প করিতেছে | দারোগা সাহেবের জন্য অপেক্ষায় বসিয়া আড় পাতিয়া শুনিয়া বুঝিলাম যে আসলে গণেশ শিশুকে নানাবিধ গর্ত খোঁড়ার প্রণালী ও কী কী বিশেষ সাবধানতা অবলম্বনের দরকার তাহা বুঝাইতেছে | শিশু অতি গভীর মনোযোগ সহকারে তাহা শুনিতেছে | এঁটেল মাটি, বেলে মাটি, শক্ত মাটি, নরম মাটি, গভীর গর্ত, ফালাও গর্ত, খাল, সুরঙ্গ ইত্যাদি অনুযায়ী প্রণালী যে বিভিন্ন তাহা আমি জানিতাম না | সশব্দে ও নিঃশব্দে গর্ত কাটার মধ্যে আশ্চর্য তফাত | গর্তে মানুষ প্রবেশ করিবে কি না তাহার উপর নির্ভর করে কাটা মাটি কিভাবে রাখা বা ফেলা হইবে | গর্ত কাটিয়া যদি তাহাতে কিছু ফেলিয়া, অথবা গর্ত শূন্য রাখিয়া, তাহা আবার বুজাইতে হয় তবে কাটা মাটির কিছু পরিমাণই হাতের কাছে রাখা হইবে ও বাকি মাটি ফেলিতে হইবে | কাজ শুরু করিবার পূর্বেই সেই সব পরিমাণের হিসাব করা আবশ্যক | এই পরিমাণ মাটির প্রকৃতি ও আর্দ্রতার উপর নির্ভর করিবে | দেখিলাম শিশু মাঝে মাঝে এমন এক দুই প্রশ্ন করিতেছে যে মনে হইল সে এই বিদ্যা অধ্যয়ন করিতে সক্ষম | সব বৃত্তান্ত শুনিয়া শেষে শিশু জানাইল তাহার এক গর্ত চুরি হইয়াছে | পহেলবান
জী সেই গর্ত চোরের সন্ধানে আছেন | তাঁহার নাম শুনিয়া শমশের আসিয়া শিশুর গাল চাটিয়া লেজ নাড়িয়া ঘনিষ্ঠ হইয়া বসিল |

ঠিক এই সময় পহেলবানজী সবেগে কক্ষে প্রবেশ করিয়া মাথার টুপী দ্রুত খুলিয়া আপন কেদারায় বসিয়া শরীর এলাইয়া দিলেন | তাঁহার দৃষ্টিপাতে গণেশ উঠিয়া কয়েদ-কক্ষের গভীরে লুকাইল | শিশু তাঁহার নিকটে আসিয়া প্রশ্ন করিল, “আমার গত্ত চোর ধরেছ ?” পহেলবানজী কোনও উত্তর না দিয়া অঙ্গুলি দ্বারা রামেশ্বরকে নির্দেশ করিলেন শিশুকে গোমতীর কাছে লইয়া যাইতে |  সে শিশুকে লইয়া গেলে তিনি জানাইলেন যে শিবানন্দের সন্ধানে হারাধন তাহার বাটীতে গিয়া দেখে সে নাই | সে দুই দিনের জন্য মুঙ্গেরে গিয়াছে, কোনও গহনা ক্রয় সংক্রান্ত ব্যাপারে | তাহার যাওয়ার দিন, অর্থাৎ ছটের দিন, প্রতিবেশীরা দেখে বাড়ি বন্ধ, কেহ নাই | পরদিন দেখা যায় বাড়ি খোলা, ভিতরে তাহার স্ত্রী শান্তিবালা শয্যাগত | সে ভয়ঙ্কর অসুস্থ, ঘন ঘন মূর্ছা যাইতেছে | কখনো স্বামীর, কখনো বা পুত্রের নাম লইয়া কাঁদিতেছে | ছটের দিনের ও তত্পূর্বের রাত্রির কথা কিছুই তাহার মনে নাই |

মহাদেব বাবু প্রশ্ন করিলেন, “বাড়িতে আর কেউ নেই, ছেলে মেয়ে, আত্মীয় স্বজন ?”
পহেলবানজী – “সিবানন্দের তো এক বেটা ছিল | কেউ বলছে কী সে বাবার সঙ্গে গেছে মুঙ্গের |”
মহাদেব বাবু স্বগতোক্তি করিলেন, “আশ্চর্য, গণেশের কথায় মনে হল বউটা ছটের সকালে ঠিক ছিল | তাহলে সেদিন সে কোথায় গেল ? আর ফিরে এসে অসুস্থই বা হল কী ভাবে ? হুম্ ...
“যাক গে ! চলো নীরেন, বাড়ি যাই |”

মহাদেব বাবু উঠিয়া আমাকে লইয়া বাড়ি ফিরিলেন |  রাত্রি-ভোজ সম্পন্ন হইয়াছে কি হারাধন হারিকেন হাতে লইয়া আসিয়া ডাকিল |

থানায় আসিয়া দেখি পহেলবানজী দ্রুতগতিতে পদচারণ করিতেছেন ও গণেশ গারদের বাহিরে মাটিতে বসিয়া আছে | রামেশ্বর দরজায় প্রহরারত | আমরা প্রবেশ করিতেই বসিতে ইঙ্গিত করিয়া পহেলবানজী নিজস্ব কেদারায় স্থান গ্রহণ করিলেন, এবং তৎক্ষণাৎ গণেশ বলিতে শুরু করিল, “বাবু, ওই খোকা শিবানন্দ স্যাঁকরার ছেলে | আমি ওর সাথে কথা করে ধরতে পেরেছি | বাবা বাড়ি থেকে বেরোতেই খোকা পালিয়ে গেছিল নদীর ধারে, গত্ত খুঁড়তে | সবাই ভাবছে খোকা বাবার সাথে মুঙ্গেরে গেছে | হয়তো খোকার খোঁজ না পেয়ে ওর মা সেদিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আশে পাশে এদিক ওদিক খুঁজেছে | খুঁজে না পেয়ে বাড়ি ফিরে কাঁদতে লেগেছে | কেউ বুঝছে না আসল কথা কী |”
পহেলবানজী – “অব ব্যতাইয়ে বেওপার ... কী রকোম এই ব্যচ্চা সবাইকে পরেশান করেছে |”
শিবানন্দ বাবু – “তাহলে তো ব্যাপার চুকে গেল | খোকাকে এখন বাড়ি পাঠিয়ে দিলেই হল, শিবানন্দ ফিরে আসার আগে |“
পহেলবানজী – “এতো সোজা না আছে বেওপারটা, মহাদেও বাবু | গণেশ, ব্যতাও ইনকো |”
গণেশ – “বাবু, খোকা আমায় বলেছে ও ওর সেই গত্ত নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে | গোমতী ভাবীকেও বলছে, পহেলবানজীকে বলো চোরের কাছ থেকে আমার গত্ত এনে দিতে, তবে আমি বাড়ি যাবে | আমার ভয় হচ্ছে যে জোর করলে খোকা আবার বাড়ি থেকে পালাবে |”
পহেলবানজী – “আর আমাকে গোমতী বলছে, এ কোনসি বড়ি বাত ? এতো ছোটো ব্যচ্চা এত রোনাধোনা করছে | বুঝলেন মহাদেও বাবু, গোমতী এক রকোম ব্যচ্চাটাকে গোদ, মানে কোলে, লিয়ে লিয়েছে | আমাকে বলছে, এ আমার ইজ্জতের সওআল | আপনি বলুন কী উপায় আছে |”
মহাদেব বাবু কিঞ্চিত চিন্তা করিয়া কহিলেন, “ঠিক আছে, তাহলে আজ রাত্রে ও থাকুক গোমতীর কাছে | ভেবে দেখি, কী উপায় করা যায় |”

বাড়ি ফিরিয়া বিছানায় ছটফট করিতে করিতে শেষ রাত্রে নিদ্রা আসিল, জাগিলাম বিলম্বে | দেখিলাম বেলা হইয়াছে, বাহিরে ঝরঝরে হাওয়া ও ঝলমলে রৌদ্র, যেন আকাশে বাতাসে এক পরিমল আনন্দের আগমনী সম্বর্ধনা | সেই সময় কানে বাজিল দুর হইতে ভাসিয়া আসা, হাওয়ার সহিত ওঠাপড়া, ঢাকের আওয়াজ | সে কী ? তড়াক করিয়া উঠিলাম এবং মায়ের গলায় শুনিলাম, “উঠেছিস ? যা চট করে মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে | মহাদেব বাবু ভোর ভোর থানায় গেছেন, বলে গেছেন তুই উঠলে তোকে পাঠিয়ে দিতে |”

কোনমতে নাকে মুখে দুই গ্রাস মুড়ি দিয়া ছুটিয়া গেলাম | থানার কাছে যাইতে যাইতে ঢাকের শব্দ প্রবলতর হইল | কাছে গিয়ে দেখি থানার বাহিরে এক ঢাকি ঢাক বাজাইতেছে | সেই সময় থানার দরজা দিয়া হারাধন বাহির হইল, পরনে হলুদ মাখানো ধুতি, গা খালি, মাথায় এক বৃহৎ কুলো, তাহার উপর এক ধামা যাহাতে কিছু ফুল ও বেলপাতা | তাহার পিছন পিছন বাহির হইল, একাদিক্রমে, গ্রামের পুরোহিত মহাশয়, কোলে শিশু লইয়া গোমতী, পাশাপাশি পহেলবানজী ও মহাদেব বাবু এবং সর্ব-পশ্চাতে শমশেরের গলায় বাঁধা দড়ি ধরিয়া শ্যামলাল যাদব | আমি দৌড়াইয়া যাইয়া মহাদেব বাবুর হাত ধরিলাম ও প্রশ্ন করিলাম, “কী হচ্ছে ? কোথায় যাচ্ছ তোমরা ?”
মহাদেব বাবু – “চলো সাথে | এখুনি দেখতে পাবে |”

রাস্তায় যাইতে যাইতে এই মিছিলে কিছু কৌতূহলী শিশু যোগ দিল | শীঘ্রই মিছিল নদী তীরে সেই কাঁঠাল গাছের কাছে পৌঁছাইল | সেখানে দেখা গেল গণেশকে কোমরে দড়ি দিয়া বাঁধিয়া দড়ি হাতে ধরিয়া রামেশ্বর দাঁড়াইয়া আছে | সে পহেলবানজীকে সসম্ভ্রম সেলাম করিয়া কহিল, “পকড় লিয়া সাব | য়েহি চোর হ্যায় |”
তারপর গর্তটি দেখাইয়া রামেশ্বর শিশুকে কহিল, “এই দেখ, খোকা বাবু | তোমার গর্ত বরামত্ করেছি কেমন |”
শিশু অধীর উত্তেজনায় শরীর কচলাইয়া গোমতীর কোল হইতে নামিয়া দৌড়াইয়া গর্তের নিকট গেল ও মাটিতে উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িয়া দুই হাতে গর্তটি ঘিরিয়া যেন আলিঙ্গন করিল | চক্ষু তাহার নিমীলিত, মুখে তাহার কী অকপট, নির্মল, প্রশান্ত আনন্দ, যেন বহুকালের হৃত খেলনা খুঁজিয়া পাইয়াছে | গোমতী আসিয়া তাহাকে উঠাইয়া পুনরায় কোলে লইয়া কহিল, “চলো, এবার তোমার গর্ত তোমার বাড়ি নিয়ে যাব |”

পহেলবানজী গম্ভীরভাবে মস্তক হেলাইয়া কার্য যথাযথ হইয়াছে এইরূপ এক ইঙ্গিত করিয়া রামেশ্বরকে ইশারা করিলেন সহসা অকারণে হাস্যবদন গণেশকে কাঁঠাল গাছের আড়ালে লইয়া যাইতে |

গর্তের সম্মুখে কিছু জায়গা পরিষ্কার করিয়া একটি রঙ্গিন চাটাইয়ের আসন পাতিয়া পুরোহিত মহাশয় পূজায় বসিলেন | তিনি ধামা হইতে ফুল বেলপাতা বাহির করিয়া কুলায় রাখিলেন | তাহার নির্দেশে হারাধন প্রথমে সেই গর্তের মাটি চারিপাশ হইতে একত্রিত করিয়া ধামায় ভরিল | অতঃপর পুরোহিত মহাশয় তাহার উপর ফুল ও বেলপাতা রাখিয়া কোশা-কুশি হইতে গঙ্গাজল ছিটাইয়া এই মন্ত্র পড়িলেন –

                          এতঃ পশ্য নিম্নম কাঁঠালস্য বৃক্ষ

                           এক গহ্বর ছিদ্রতি ধরিত্রী বক্ষ
                            যস্য প্রহরায় রাহু, কেতু, যক্ষ
                           তস্য পরি ক্রিয়তি চোরম্ লক্ষ্য
                          পহেলবান দারোগা পরমঃ সুদক্ষ
                        অভ্যুর্থানমকৃত ক্রিয়তি গহ্বর রক্ষ
                         অদ্র অগ্রহায়নম্ মাসে শুক্লম্ পক্ষ
                         এত গহ্বর গচ্ছতি শিবানন্দ কক্ষ
                   ওম্ নমো, সর্ব গহ্বরায়ঃ নমো, ওম্ নমো

মন্ত্রটি তিনবার পড়া হইলে পুরোহিত মহাশয় রামেশ্বরকে কহিলেন গণেশকে লইয়া আসিতে | গণেশ আসিলে পুরোহিত মহাশয় তাহার কানে কিছু কহিলেন | গণেশ আঙ্গুলে আঙ্গুলে হিসাব কষিয়া ধামার কিছু মাটি চারিদিকে ছিটাইয়া ধামার বাঁকি মাটি কুলো দিয়া ঢাকিল | তারপর সে কুলো সমেত ধামা সাবধানে উপুড় করিয়া সেই গর্তের উপর রাখিল | পুরোহিত মহাশয় বিড়বিড় করিয়া আরও কিছু মন্ত্র পড়িলেন | গণেশ বাম হস্তে ধামা ধরিয়া, দক্ষিণ হস্তে অতি সন্তর্পণে তাহার নীচ হইতে কুলোটি টানিয়া বাহির করিল | তারপর ধামাটি সযত্নে গর্তের উপর কয়বার এদিক ওদিক সঞ্চালন করিয়া তাহাকে একটু উঠাইয়া তাহার নীচে কিছু নিরীক্ষণ করিল - কী তাহা আমরা দেখিতে পাইলাম না | বেশ কয় বার এইরূপ ধামা সঞ্চালন ও তাহার নিম্নে পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন হইলে সে সন্তুষ্টি সূচক মাথা নাড়া দিয়া পুনরায় কুলোটি ধামার নীচে ঢুকাইয়া ধামা ও কুলো যুগপৎ সোজা করিয়া গর্তের উপর হইতে সরাইল | বিস্মিত হইয়া দেখিলাম যে সে গর্ত আর নাই | শিশু তৎক্ষণাৎ উৎসুক হইয়া গোমতীর কোল হইতে নামিয়া পুরোহিতের নিকট যাইয়া অভিযোগের কণ্ঠে শুধাইল, “আমার গত্ত কোথায় গেল ?”
পুরোহিত মহাশয় – “তোমার গত্ত ধামাতে পুরে নিয়েছি | এখন ওকে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবো |”
শিশু – “কই ? আমায় দেখাও গত্ত |”
তখন তাহাকে কুলোটি অল্প তুলিয়া দেখানো হইল ধামার ভিতর | ফাঁকা ধামা দেখিয়া শিশু কিছু ইতস্তত করিলে গোমতী তাহাকে কহিল, “দেখো গত্তের সব জায়গা এখন ধামায় ঢুকে গেছে | এসো এবার আমার কাছে, বাড়ি যেতে হবে |” শিশু তাহার কোলে উঠিয়া কহিল, “হ্যাঁ | এবার আমি ঠিক বাড়ি যাব |”

পুনরায়, দারোগা সাহেবের মস্তক হেলনের ইশারায় রামেশ্বর গণেশকে লইয়া রওয়ানা দিল | কেহ দেখিল না যে যাইবার পূর্বে গণেশ চুপচাপ পুরোহিত মহাশয়ের রঙ্গিন চাটাইয়ের আসন হস্তগত করিল |

ঢাকের আওয়াজ করিতে করিতে মিছিল চলিল বেনেপাড়া | সর্বাগ্রে হারাধন, মাথায় কুলো ঢাকা ধামা, যাহার ভিতর খোকার গর্ত | সর্ব-পশ্চাতে শ্যামলাল ও শমশের, শিশুর দোদুল্যমান হাত পা চাটিয়া | কিছু সন্দেহ প্রকাশ করিয়া শমশের কখনো হাঁচে, কখনো বা কাশে, এবং সেই সন্দেহ নির্মূল করিতে সে পুনরায় শিশুর হাত পা চাটে |

বেনেপাড়া যাইয়া মিছিল উপনীত হইল শিবানন্দের মাটির বাড়িতে | জমি হইতে মোটা দেয়াল উঠিয়াছে বুক সমান উচ্চতায়, যাহার উপরের দেয়াল কিঞ্চিত পাতলা | একটি জানালা দেখা গেল, বোধ হইল তাহা শয়নকক্ষের | খোলা জানালার দুই পাল্লার নিকট বাঁশে বাঁধা কাপড় শুকাইবার দড়িতে রামেশ্বর তাহার গরম চাদর ঝুলাইয়া দিয়াছে, ও তাহার আড়ালে গণেশকে লইয়া দাঁড়াইয়া আছে, তপ্ত রৌদ্র হইতে বাঁচিতে | পুরোহিত মহাশয় ঢাকিকে কহিলেন, “ঘরের ভিতর ঢাক বাজালে তো খুব কানে লাগবে | তুমি ওই জানালার কাছে যাও | ওখানেই দাঁড়িয়ে ঢাক বাজাবে, জানালা দিয়ে আওয়াজ ভিতরে ঢুকবে |” ঢাকি রামেশ্বরের নিকট চলিয়া গেল |

বন্ধ দরজায় করাঘাত করিতে এক দাসী আসিয়া তাহা খুলিয়া প্রশ্ন করিল, “কাকে চাই ?”
পুরোহিত মহাশয় - “শান্তিবালা আছে ?”
দাসী, কিঞ্চিত ইতস্তত করিয়া - “উনি তো অসুস্থ |”
পুরোহিত মহাশয় – “গিয়ে বলো ওর হারিয়ে যাওয়া ছেলে আমরা ফেরত এনেছি |”
দাসী  - “ও আচ্ছা ! তবে, আপনারা ভেতরে আসুন |”

আমরা সদলে অন্দরে প্রবেশ করিলাম | বাহিরে বৈঠকখানা, তাহার অপর দিকে উঠান ও তাহার চারিদিকে নানাবিধ কামরা, শয়নকক্ষটি ডান দিকে | পুরোহিত মহাশয় নিঃসংকোচে শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলেন | দেখিলাম এক পালঙ্কে শায়িতা এক মহিলা, তাহাকে আর এক মহিলা হাতে পাখা লইয়া হাওয়া করিতেছে | শায়িতা মহিলা চক্ষু খুলিয়া লোক জন দেখিয়া ক্ষণিকের জন্য যুগপৎ বিস্মিত ও শঙ্কিত হইয়াছেন কি, শিশু “মা” বলিয়া তাহাকে সম্বোধন করিল | মহিলা মুহূর্তে উঠিয়া আসিয়া গোমতীর কোল হইতে শিশুকে ছিনাইয়া লইয়া “খোকা, খোকা” বলিয়া উদ্বেগ-সমাপ্তির অশ্রু সম্বরণ করিতে করিতে শিশুকে শত সহস্র চুম্বন করিল |  শিশু তাহার বক্ষে মুখ লুকাইল | কিছু পরে মহিলা ক্রন্দন করিতে লাগিল, “বাবা তোকে মারবে না রে খোকা | ও মুখেই শুধু বলে মারধোরের কথা | তাই শুনে তুই এমন করে পালালি | একা একা আমি তোকে কত খুঁজেছি | কোথায় কোথায় না গিয়েছি | আর ভেবেছি তোর বাবা ফিরে এলে কী জবাব দেব |”

আবেগের বন্যা প্রশমিত হইলে পুরোহিত মহাশয় কহিলেন, “হারিয়া যাওয়া ছেলে ক’দিন পরে বাড়ি ফিরেছে, একটু যে পুজো করতে হবে মা |” মহিলা ত্রস্ত পদে আসিয়া পুরোহিত মহাশয়কে প্রণাম করিয়া কহিল, “আমায় কী করতে হবে ? আমার তো কোনও যোগাড় নেই পুজোর |”
পুরোহিত মহাশয় – “সব আছে মা, সব আছে | পহেলবানজী আর মহাদেব বাবু যখন খোকাকে ফিরিয়ে এনেছেন তখন ওঁরা সব ব্যবস্থাই করে রেখেছেন | তুমি চিন্তা করো না |
“আমি এখানে এই জানালার সামনে বসে পুজো সেরে নেব | বাইরে চাদর ঝুলছে, ভালই, মুখে রোদ লাগবে না | তুমি শুধু আমায় একটা দড়ি দাও দেখি মা, এই পাঁচ কি ছ হাত লম্বা | আর একটা ধুনুচি, নারকেলের ছোবড়া আর বেশ কিছু ধুনো |”

দাসী দড়ি, ধুনুচি ইত্যাদি লইয়া আসিলে পুরোহিত দড়ির তিন ভাগের দুই ভাগ কামরার ভিতর দিকে ও বাঁকি তৃতীয় ভাগ কামরার বাহির দিকে ঝুলাইয়া জানলার শিকে বাঁধিলেন | দড়ির ভিতরের অংশ অর্ধ-বিভক্ত করিয়া এক ভাগে কুলো ও অন্য ভাগে ধামা বাঁধিয়া ঝোলানো হইল, প্রথমে কুলো – তাহার পিঠ দেয়ালের উপর, ও তাহার বুকের উপর উপুড় হইয়া পড়া ধামা, যে অবস্থায় এই দুইয়ের মধ্যে আবদ্ধ শিশুর গর্ত লইয়া আসা হইয়াছে | ধামার ঠিক নিম্নে ধুনুচি রাখিয়া ঠাকুর মহাশয় ধুনো জ্বালাইয়া দিলেন | এই অসাধারণ আয়োজন সম্পূর্ণ হইলে তিনি আমাদের জানাইলেন যে এইবার তিনি পূজা করিয়া খোকার গর্তকে ধামা হইতে শিবানন্দর ভিটায় সঞ্চারণ করিবেন |

পুরোহিত মহাশয় ঘণ্টি বাজাইলেন ও সেই সাথে জানালার বাহিরে ঢাক বাজিতে লাগিল | বাহিরে ঢাক ও ভিতরে পুরোহিত মহাশয়ের ঘণ্টি এবং মন্ত্রোচ্চারণ – মন্ত্র একই, যাহা পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি – এই সমবেত শব্দের কোলাহলে বধির হইবার অবস্থা | তদুপরি পুরোহিত মহাশয় ঘন ঘন ধুনো ছিটাইলে কক্ষ ধূম্রাচ্ছন্ন হইয়া প্রায় অন্ধকার হইল | দর্শন ও শ্রবণ শক্তি ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া লোপ পাইল | কিছুক্ষণ পরে কী ভাবে বোধ করিলাম যে  কেহ বা কিছু যেন কুলোর পিছনে এক মৃদু ধাক্কা দিল | বুকে ধামা লইয়া কুলো দেয়াল হইতে অল্প দুলিয়া উঠিয়া আবার যথাস্থানে ফিরিয়া গেল | পুনরায় সেই ধাক্কা, কিঞ্চিত জোরে | ক্রমে ক্রমে ধাক্কার জোর ও ধামার আন্দোলনের বেগ বাড়িলে, আমি ভয় পাইয়া মহাদেব বাবুর হাত ধরিয়া প্রশ্ন করিলাম, “কী হচ্ছে ওখানে ?”
মহাদেব বাবু – “ওই দেয়াল আর গর্তের মাঝে লড়াই লেগেছে | গর্ত ধামা থেকে বেরিয়ে দেয়ালে ঢুকতে চায়, কিন্তু দেয়াল তাতে বাধা দিচ্ছে |”
আমি – “তাহলে কী হবে ?”
মহাদেব বাবু – “আরে, এই মাটির দেয়াল ওই মেঠো গর্তের সাথে তাই এঁটে উঠতে পারে নাকি | একটু ধৈর্য ধরে দেখো, এত পুজো কী বৃথা যাবে ?
“আরে এই শ্যামলাল, এই হারাধন, এখানে এসে ধামা আর কুলো দেয়ালের ওপর চেপে ধরো তো বাছাধনেরা |”

দুজনে আসিয়া ধামা ও কুলো দেয়ালে চাপিয়া ধরিল | শমশের সুযোগ পাইয়া চুপচাপ বাহিরে পরিদর্শন করিতে প্রস্থান করিল | কিছুক্ষণ আরও দেয়াল ও গর্তের সংগ্রাম চলিবার পর কুলোর পিছন হইতে কিছু সংকীর্ণ কাদাজলের রেখা বাহির হইয়া দেয়াল বাহিয়া মাটিতে নামিল | মহাদেব বাবু আমাকে কহিলেন, “ওই দেখো নীরেন, দেয়াল এবার ঘেমে নেয়ে অস্থির, ওর জারিজুরি আর খাটল না | গর্ত জিতে গেছে মনে হচ্ছে |”

তথাপি, যতক্ষণ ঢাক বাজিতে থাকিল পুরোহিতে মহাশয় মন্ত্রোচ্চারণ জারি রাখিলেন | প্রায় এক কি দেড় প্রহর পার হইলে পূজা সম্পন্ন হইল | পুরোহিতে মহাশয় মুখ তুলিয়া জানালার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া পূজা সমাপ্ত হইয়াছে এইরূপ ইঙ্গিত করিতে তিন বার টিং টিং করিয়া ঘণ্টি বাজাইলেন | ঢাক থামিল | কেহ বাহির হইতে জানালার নিকট টাঙ্গানো চাদর সরাইয়া দিল | উজ্জ্বল রৌদ্রের আলোয় চোখ ধাঁধাইয়া গেল সকলের | সেই উজ্জ্বলতা চক্ষে সহ্য হইলে দেখিলাম রৌদ্রালোকে উদ্ভাসিত ধূম্রময় কামরার মেঝেতে কুলো ও ধামা গড়াগড়ি যাইতেছে | যেখানে তাহারা দেয়ালের উপর নিলম্বিত ছিল সেখানে এক অতি সুন্দর কুলুঙ্গির আবির্ভাব হইয়াছে, যেন তাজা কাদামাটি দিয়া তাহা কেহ নিপুণ হস্তে সদ্য গঠন করিয়েছে |  শুধু তাহাই নহে, সেই কুলুঙ্গির পিছনের দেয়াল একটি অতি সুন্দর আলতা ও হলুদ দিয়া রং করা চাটাই, যাহার নক্সা ঠিক গণেশ কর্তৃক অপহৃত পুরোহিত মহাশয়ের আসনের মত | সেই কুলুঙ্গি দেখিয়া এমন বোধ হইল যে যেন বিশ্বকর্মা দেব স্বয়ং কক্ষের ভিতরে আসিয়া কাজ সমাপ্ত করিয়াছেন |

মহাদেব বাবু নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া কহিলেন, “খোকা দেখো তো ওই দেয়ালে তোমার গর্তে নতুন খেলনা রাখার জায়গা হবে কিনা |”
শিশু মাতৃক্রোড়ের মায়া ছাড়িয়া আসিয়া বিস্মিত বিস্ফারিত চক্ষে কুলুঙ্গি দেখিতে লাগিল | একবার সে মাকে দেখে, আবার পুরোহিত মহাশয়কে, আবার কখনো সেই ধামা ও কুলো |

এমন সময় দরজায় করাঘাত শোনা গেলে দাসী দেখিতে গিয়া ছুটিয়া আসিয়া কহিল, “মা, বাবু ফিরে এয়েছেন |”

“শান্তি, ও শান্তি | আরে ব্যাপারটা কী ? বাইরে এত লোকজন, ঢাক, বাদ্যি – কী হচ্ছে টা কী ?” এই সব প্রশ্ন করিতে করিতে একজন হড়বড় করিয়া কামরায় প্রবেশ করিয়া এত লোক দেখিয়া থতমত খাইয়া বাক্যহারা হইল | তাহার চেহারা ভ্রমণ ক্লিষ্ট, কয়দিন ক্ষৌরকর্ম হয় নাই, মাথার চুল অবিন্যস্ত |  তাহার এক হাত হইতে একটি বাক্স ও অন্য হাত হইতে একটি থলি ও লাঠি ধপাধপ করিয়া একে একে মাটিতে পড়িল | থলির ভিতর হইতে কিছু খেলনা বাহির হইল | একটি চাকা লাগানো কাঠের ঘোড়া গড়াইতে গড়াইতে কুলুঙ্গির সামনে গিয়া দেয়ালে ধাক্কা পাইলে তাহার গতিরোধ হইল | শিশু দৌড়াইয়া গিয়া ঘোড়াটি তুলিয়া কুলুঙ্গিতে রাখিয়া অত্যধিক উত্তেজিত ভাবে তাহার পিতাকে কহিল, “বাবা দেখো, দেখো, আমি কেমন আমার খেলনা রাখার জায়গা করেছি | ওই গত্ত বাড়িতে খুঁড়ি নি কিন্তু ! নদীর ধারে গত্ত করে বাড়ি নিয়ে এসেছি |” এই কহিয়া সে বাবার নিকট গিয়া তাহার দুই জানু জড়াইয়া ধরিল | তাহার পিতা চুপ থাকিলে সে পুনরায় কহিল, “তুমি আর বকবে না তো ?” শিবানন্দ তাহাকে অন্যমনস্ক ভাবে কোলে তুলিয়া কহিল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে | আমি তো কিছুই বুঝছি না |  এই কুলুঙ্গি এলো কোথা থেকে ?”

ইহার পরের ঘটনা বিশেষ উত্তেজনাময় নহে | পহেলবানজী শিবানন্দকে বাহিরে লইয়া যাইয়া বুঝাইলেন যে সে মুঙ্গেরে রওয়ানা হইবার কিঞ্চিত পরেই খোকা বাড়ি হইতে বাহির হয় বাবার পিছু পিছু  | সিঁধকাটা গণেশ শিবানন্দের বাটীতে সিঁধ কাটিতে আসিয়াছিল, কিন্তু সে শিশুকে ভোর রাত্রে বাটির বাহিরে যাইতে দেখিয়া কার্য শেষ না করিয়া শিশুর অনুসরণ করে | নদীর নিকট বীট-কনস্টেবল তাহাদেরকে ধরে | দুই দিন জেরা করার পর সমস্ত ব্যাপার পরিষ্কার হয় | এক্ষণে গণেশ দেয়ালে সিঁধ কাটার ছিদ্র বন্ধ করিতে সেখানে সেই কুলুঙ্গিটি বানাইয়া দিয়াছে, পরে যাহা বন্ধ করিলে করা যাইতে পারে |

সর্বশেষে মহাদেব বাবু শিবানন্দকে অনুরোধ করেন যে সে যেন গণেশকে কিছু পারিতোষিক দান করে, শিশুকে উদ্ধার করার জন্য | শিবানন্দ সে অনুরোধ উদারচিত্তে পূরণ করিয়া ছিল | আর, মহাদেব বাবু শিবানন্দকে উপদেশ দেন, এই কহিয়া, “শিবানন্দ, পুত্র-ধন এন্জয় করো, মারধোর করলে হিতে বিপরীত হবে |”

সেই পুত্র, পূর্বে খোকা, ও পরবর্তী কালে ধনঞ্জয়, বড় হইলে মহাদেব বাবুর ন্যাওটা হইয়া আমার স্থান দখল করে |

এবং যতদূর জানি, এই ঘটনার পর গণেশ সিঁধ কাটা পরিত্যাগ করিয়া রাজমিস্ত্রির কার্যে সাফল্য অর্জন করে | জৈত্যপুর গ্রামে পূর্ব-নির্মিত দেয়াল কাটিয়া তাহাতে দরজা, জানালা, কুলুঙ্গি, তাক, খোবর ইত্যাদি বানাইতে তাহার মতো পটু আর কেহ ছিল না সেই কালে |

-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৩

শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

না প্রেম না বিরহ



|| না প্রেম না বিরহ ||


চূর্ণকুন্তল অতিরঞ্জিত শ্বেত পুষ্পে
চঞ্চল মীনাক্ষী সিঞ্চিত অশ্রু-বাষ্পে
ললাটে অধোলম্বিত বিশৃঙ্খল অলক
নেত্রপল্লবে অগণিত শ্রী কৃষ্ণ-পলক
চুম্বনাকাঙ্ক্ষী কমলা অধরা ওষ্ঠাধর
সিক্ত বসনে লিপ্ত নম্র পৃথু পয়োধর

তড়িৎ দৃষ্টিতে বালা সে চাহিয়া ত্রস্তে
জড়ায় কেন মম তনু কম্পিত হস্তে

আমি মাত্র পূজারী, আসিয়াছি পূজিতে
না চাই প্রেম, না বিরহ ব্যথা বুঝিতে      ||


--------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৩