শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০১৫

দৃষ্টিহীনের অপেক্ষায়

|| দৃষ্টিহীনের অপেক্ষায় ||


এইতো তুমি কেমন সুন্দর হাসি নিয়ে তাকিয়েছ দু’নয়নে
কী বলছি আমি এসো শুনে যাও, যা আছে অবলা বয়ানে
সিঁথিতে সিঁদুরের রেখা পরিখা, কপালে উজ্জ্বল লাল টিপ
নাক ফোটানো হীরের ফুল-নথ, দৃষ্টিতে সন্দেহের জরিপ
কুঁকড়ানো চুল সব বেণী খোলা, নেমে উচ্ছৃঙ্খল ঢেউয়ে,
তাঁতের শাড়ির ভারী আঁচল ঢেকেছে ভরা বুকখানি ছেয়ে
ঠোঁটে কিঞ্চিত বিদ্রূপ, কিছু ‘সবই বুঝি’ প্রলোভনের হাসি
অথচ সব সত্যেও রূপসী মুখটি কত যে পলকহীন উদাসী
শুনেছি প্রবাদ, তুমি নাকি এককালে ছিলে এপাড়ার মেয়ে
অবিতর্কিত সুন্দরী ; তবু বিবাদীর মতে, মাঙ্গলিক, অপেয়ে
তবে বলো, কী করে জোটালে সিঁদুর, টিপ, কণ্ঠে মঙ্গলসূত্র
কে সে ভাগ্যবান, তোমার হাতখানি ধরল কেমন রাজপুত্র

কী বললে ? মিথ্যা সব সাজ, এড়াতে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি
তুমি আছ এক দৃষ্টিহীনের প্রতীক্ষায়, কাটাতে তোমার রিষ্টি ||


-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩১ জুলাই ২০১৫

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৫

বায়বীয় স্মৃতি

|| বায়বীয় স্মৃতি ||

তুমি ছিলে আমার যাবতীয় – আমার প্রতিমা, আমার বিশ্বাস
আমার হৃদয়ের অন্তরতম কোষে সঞ্চিত অদ্ভুত জাদু নির্যাস
আমার সর্বাঙ্গে বিছিয়ে ছিল তোমার কুহেলিকাময় উপস্থিতি
তোমার আদরে খুঁজে পেয়েছি আমি মহাজাগতিক সম্প্রীতি

আমার বাহুতে শিথিল আত্মসমর্পণে তুমি দিলে শেষ আহুতি
এখন
লিপ্ত কপালে আমার, তোমার ভস্মিত সিঁদুরের বিভূতি
প্রেয়সী, তুমি চাঁদনী রজনী, তুমি দিবস মেদুর, বাদল-ছাওয়া
আজ আমার চাওয়ার আর কিছু নেই, সব হয়ে গেছে পাওয়া

তবু বলি, দূর বহুদূর চলে গেছ তুমি, সুবর্ণলোকের অন্তরালে
বলে গেলে না কেন এই লেখা ছিল আমার মসিকৃষ্ণ কপালে
তোমার চোখে তো আমি কতবারই দেখেছি আমার প্রতিকৃতি
কেন দেখি নি ভাগ্যে কী লেখা আছে ? এখন শোনো আকুতি -

একবার এসো ফিরে, সান্ধ্য সমীরে, উজাড় করে বায়বীয় স্মৃতি
শেষবার তোমাকে দেখতে চাই, টানবার আগে জীবনের ইতি ||


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩০ জুলাই ২০১৫

বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫

ত্রিকোণমিতি

<< চীনেবাদাম কবিতা >>

এ’রকম কি কিছু আছে, চীনেবাদাম কবিতা ?
আসলে আমি চীনেবাদাম খাওয়ার মত ছন্দময় অথচ অন্তঃসারশূন্য অনুভূতির এক বিশেষ প্রকাশের কথা ভাবছিলাম |

আপনি এক ঠোঙ্গা চীনেবাদাম কিনলেন – ছোট ঠোঙ্গা, তার সাথে এক পুরিয়া লঙ্কার গুঁড়ো মেশানো দানা-নুন | টাকাটা আগেই হাতে বের করেছেন, একদম সঠিক খুচরো – কেন না, ঠোঙ্গাটা হাতে ধরলেই প্যাভলোভিয়ান প্রতিক্রিয়ায় জিভে জল কাটবে  – ধুর মশাই, তখন কে নুলো বাড়িয়ে অপেক্ষা করবে বাদামওয়ালার কাছ থেকে খুচরো ফেরত নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে পকেটে পুরতে !

যাক, এবার আপনি জুত করে বসলেন ঘাসে – চিন্তা নেই, পরনের প্যান্ট ঘাসের মতই পরিষ্কার বা ময়লা | সাবধানে ঠোঙ্গাটা ফাঁক করে দেখলেন – বাদাম একটু কম লাগছে, লাগুক | সন্তর্পণে, প্রথম বাদামের খোলা ভেঙ্গে দানাগুলো হাতের তালুতে রেখে দেখে নিলেন – পোকা লাগা নেই তো | তারপর মুখ খুলে বাদামগুলো ফেলেই বিদ্যুৎ বেগে নুনের পুরিয়া খুলে এক চিমটে মুখে দিলেন | ইতিমধ্যে জিভের উপরে বাদাম, আর নিচে লালার জোয়ার – সেই জোয়ারে নুন গুলো একটু গুলে উঠলেই আপনি চিবাতে শুরু করলেন | শুরু হোলো মুখে লালা, বাদাম আর ঝাল-নুনের কোলাকুলি | আহা ! আপনি চিবচ্ছেন আর একটু একটু গিলছেন – এক আশ্চর্য ‘খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’ সম্ভোগ !

কিন্তু, পরমানন্দ কি ধরে রাখা যায় ? তবে পুনঃ পুনঃ প্রার্থনা করতে ক্ষতি নেই | অতএব, দ্বিতীয় বাদামের নগ্নীকরণ ও ঝাল-নুন সহযোগে চর্বণ | তারপর, তৃতীয় ...

ক্রমে, এক সুন্দর ছন্দের চালে চলে, বাদামের সাইজ কমে আসে, মজুদও কমে – সেই সাথে ঝাল-নুনের চাহিদা বাড়ে |
শেষে, নাহ, সব শেষ – ঠোঙ্গা ঝেড়েঝুড়ে, তার কোনা ঘুপচি হাতড়ে, শেষ বাদামটাও শেষ | এমন নিখুঁত হিসেবে খাওয়া যে ঝাল-নুনের কয়েক দানা শুধু বাকি, আর আঙ্গুলের ডগায় সব শেষে তার কিছু রেশ ...

একটা ঢেকুর তুললেন | ঠোঙ্গাটা দুমড়ে ফেলতে গিয়ে ভাঁজ করে রেখে অবশ্যম্ভাবী এই চিন্তাটাকে আর অগ্রাহ্য করতে পারলেন না -
“হঠাত করে কেমন একটা ছন্দপতন, আর গোটা ব্যাপারটা ভেবে দেখলে কত অন্তঃসারশূন্য !”

কিছু কবিতা লেখা ঠিক এই রকম চীনেবাদাম খাওয়ার মতন | হঠাত ঝোঁক ওঠে, পদে পদে ছন্দ নিয়ে শব্দ আসে, কিন্তু, লেখা শেষে সেই অন্তঃসারশূন্যতা বোধ | এই এক অদম্য ঝোঁক আমায় প্রায়ই পেয়ে বসে, আর আমি মাথার খোল থেকে শব্দের দানা আলাদা করে, ঝেড়েঝুড়ে রুচির ঝাল-নুন দিয়ে সাধি | একেই বলি চীনেবাদাম কবিতা – মাথা নেই, মুণ্ডু নেই, সার নেই, মর্ম নেই ...
– ছন্দ ? হয়ত আছে, পড়ে দেখুন ...


|| ত্রিকোণমিতি ||


অযাচিত তোমার সখ্যতা, বন্ধু, অযাচিত তোমার আবির্ভাব
এতদিন যে তুমি ছিলে না জীবনে, ছিল না কোনও অভাব
কী হোলো হঠাত তোমার খেয়াল, কী হোলো প্রয়োজন ?
হঠাত করে দিলে চিঠিতে খবর, যার ভাবে বিস্তর আসঞ্জন

আমার নাকি কিছুটা ভালো, বেশির ভাগ ঠিক নয় মোটে
দাঁড়ালে আমিও হয়ত জিতব, তবে মাত্র তোমার জোটে
কিসে দাঁড়ালে, লেখ নি সেকথা, চিরকাল আমি দাঁড়িয়ে
দেখেছি তুমি ঘোর বেপাড়ায়, শুধু যাও এ পাড়া এড়িয়ে

এখন ঘুরে ঘুরে সুকতলা ক্ষয়েছে, পায়ে ভিড় ফোস্কার
তাই বুঝি বসে, জিরিয়ে রোয়াকে, শোনালে, “নমস্কার !”
আহা, কী মধুর, যদিও লাগে বন্ধুর, চেনা এই অভিবাদন
কী যেন বললে নামটা তোমার, হনুমান না কি গন্ধমাদন ?

হ্যাঁ, রে হতভাগা, পড়েছে মনে, বছর তিন কি চার আগে
ধার দিয়েছিলাম আমার সুপ্রীতি, যদি কোনো কাজে লাগে
সেই ভালবাসা তুমি দিয়ে দিলে আমার বান্ধবীকে উপহার
আজ আবার তুমি এসেছ কোন মুখে চাইতে পুনশ্চ ধার ?

তবে বলি শোন, কাউকে বোলো না, আমি যে দাঁড়াতেম
তোমার জন্য নয়, জানাতে আমার ওই বান্ধবীটিকে প্রেম
আমি কী জানতাম যে বেপাড়ায় ঘুরে সে করে ফষ্টিনষ্টি
আমার বদলে তোমার সাথে – হে ভগবান এ কী অনিষ্টি !

এখন এসেছ মুখটা পুড়িয়ে, বকে বান্ধবীর সাথে অনর্গল
দিয়ে মহিলাকে ফেরত, নিতে পার ধার, এক টিউব বার্নল
কেটে পড় তুমি, জুটে যাই আমি, বিনে কারোরই জোটে
তর্জনী চেপে দিই অর্গল, তার বেসামাল প্রগলভ ঠোঁটে ||
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -    (কি ? আরেক ঠোঙ্গা চলবে ?)


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৯ জুলাই ২০১৫

মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০১৫

ভোরের বৃষ্টি

|| ভোরের বৃষ্টি ||


রাতভোর শুনেছি পা টিপেটিপে হাঁটার শব্দ
সকালে উঠে দেখেছি সারা উঠোন ভিজে
নিশুতিতে কে যে সে এসেছিল কাছাকাছি
বাইরে গুমরে ফিরেছে; ভিতরে আসে নি যে

রাতের গভীরে সে জানল আমি ঘুমে অচেতন
সকালটা তাই কি গুমোট, জমাট চাপা আঁধার
দেখলাম আকাশটা থমথমে কালো অভিমানে
হটাত নামল প্রবল ধারা, তোয়াক্কা নেই বাধার

এই আসার আশায় থেকেছিলাম কাল জেগে
চেয়েছিলাম আসুক না সে তার জোর খাটিয়ে
নামিয়ে আগল দোরের তাকে ডাকতাম, “এসো,
দাও আমায় সর্বস্ব, তোমার সব দ্বিধা কাটিয়ে” |
|

---------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৮ জুলাই ২০১৫

শনিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৫

জানতে হবে

|| জানতে হবে ||


আজ আবার আকাশ ভেঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে বৃষ্টি
ঘিরে নেবে চারিদিকে এক তুমুল বৃষ্টির দেয়াল
এও ভালো লাগে, পরপর দেয়াল ইটের, জলের
যখন মনের দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে না মন
মাথায় পাহাড়, হাজার বর্ষাতি আশঙ্কার আচ্ছাদন

কিন্তু একি ? আকাশে যে মেঘ করেছিল জটলা
হওয়ার সাথে করছিল ঢলাঢলি, গায়ে পড়ে পড়ে
হটাত তারা কেন উপে গেল, কী হয়েছিল ? ও ...
আমি জানি, কিম্বা জানতাম উত্তরটা এককালে
ছোটবেলায় | লিখেও ছিলাম বাদলের খাতায়
কিন্তু বাদল তো ফেল করে করে পিছিয়ে গেল
আমি উঠে এলাম হাই স্কুলে, বাদল রয়ে গেল
এখন বাদল ট্যাক্সি চালায়, কখনও যাত্রী নিয়ে
কিন্তু জোর বৃষ্টি নামলে একা, একা কাঁচ নামিয়ে,
আর ওকে ঘিরে নিয়ে এগোয় বৃষ্টির ঝাপসা দেয়াল

একদিন বাদলকে ধরে জানতে হবে মেঘেরা কেন
থাকে ওর সাথে, অথচ আমাকে দেখে পালায় ||

---------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৫ জুলাই ২০১৫



শুক্রবার, ২৪ জুলাই, ২০১৫

নায়কের চোখে

|| নায়কের চোখে ||


তোমার চশমাটা দেখে বুঝেছিলাম কাঁচে শক্তি নেই
যা কিছু শক্তি আছে, তা  তোমার চোখের চাঞ্চল্যে
তবুও তুমি মোটা কালো ফ্রেমের চশমা কেন পর ?
চোখের মনির অস্থির চঞ্চলতা গণ্ডিতে বাঁধতে ?
কিন্তু, তোমার মধ্যে তো সেই ইচ্ছাশক্তি নেই
যা চোখের বে-লাগাম মনিকে আগলাতে পারে
প্রায়ই তো দেখি তোমার দু’চোখ নেমে আসে
আমার হাতের আঙ্গুলে, আমার হাতের পাঞ্জায়
আমার পাঞ্জা দেখে ভাবো কী সুন্দর, শিল্পীসুলভ
তোমার চোখ তো তা বলে না – ওতে দেখি ভয়
ভয় কেন ? কেন তোমার চোখ নেমে যায় বুকে ?
তুমি কেন বার বার দেখ আঁচল কোথায় পালিয়েছে
ভেসে গেছে কি মেঘমালা, তুঙ্গ শিখর উন্মুক্ত করে
কতো কিছুই তো আছে আমাদের মাঝের ব্যবধানে
টেবিল, বটুয়া, খাবারের রকমারি ডিশ আর কাঁটা ছুরি
আর, লক্ষণরেখার গণ্ডির কাছে টেনে প্রতিহত করা
ছেঁদো, অসার, হালকা, চপলমতি, নৈর্ব্যক্তিক কথা
তবুও এই সবের মধ্যে তোমার চোখ উড়ে বেড়ায়
প্রজাপতির মত, আমার হাতের বুড়ি ছুঁয়ে ছিটকে
নামে ওই বুকের স্থানভ্রষ্ট আঁচলে দৃষ্টিগোচর করা
উপত্যকায়, যেখানে বালিয়াড়ি অস্তগামী সোনালী
বুঝি, তুমি খুঁজছ একান্ত পর্যটক, প্রকৃতিতে যাযাবর |
সবই বুঝি আমি, বুঝি যখন তুমি কোলে হাত নামিয়ে
ন্যাপকিন টানার ছলে শাড়ি টেনে ঢাক তোমার নাভি
তখন শাড়ির অন্য পাড়ে ভারী পাড়ের পর্দায় টান পড়ে
যেমন ভাবে নদী সর্পিল স্রোতে নিজের বক্রতা বদলায়
আমি তখন মুখ ঘুরিয়ে বেয়ারা খুঁজি, বলি বিল দিতে
বেয়ারা চোখে চোখ রেখে বলে, “বাবু, খেয়ে নিন”
খাব কী ? গিলছ তুমি আমাকে চোখে গোগ্রাসে !
তার থেকে যদি তুমি তোমার চশমা একটু নামাতে
মুক্তি পেতাম তোমার অরক্ষিত হয়ে যাওয়া মণিতে ||

---------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৪ জুলাই ২০১৫

দীপশিখা

|| দীপশিখা ||

অন্ধকারে আলোক বিহীন বিশাল অট্টালিকা
তাহার এক বাতায়নে কে দাঁড়ায়ে ওই একা
নয়নে তাহার নাহিক আলো, শুধুই অন্ধকার
রুদ্ধ তাহার মানস, হৃদয় – রুদ্ধ সকল দ্বার
উদ্বেল মসিকৃষ্ণ কুন্তল ঢাকে ছায়াচ্ছন্ন বুক
যাহার দুয়ার খুলিয়া সে দিশেহারা, উৎসুক
দিগন্তে গিয়াছে সূর্য অস্ত, জাগায়ে প্রতীক্ষা
কে যাও বালক কক্ষে কক্ষে লইয়া দীপশিখা
লইয়া বহ্নি, হের মুখখানি, প্রাণহীন উদাসিনী
তোমার উষ্ণ বক্ষে সঁপিয়া তাহার শীতল পাণি
তাহার চক্ষে দেখিবে তখন আশ্চর্য বিকিরণ
যে দ্যুতি শিহরিবে তোমারে মোহিয়া অকারণ
দীপশিখা সম, কক্ষে কক্ষে লয়ে যাও বালিকা
আলোক সাজে সাজাইতে হৃদিহীন অট্টালিকা ||


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৪ জুলাই ২০১৫

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৫

ঘুঁটেকুড়ানি

|| ঘুঁটেকুড়ানি ||

এই টুসকি, তুই হেসে মুচকি,
ওই দেয়াল কেন রে চাঁছিস ?
বেঁকিয়ে কোমর, গজর গজর
আবোল তাবোল ও বকিস !

লাগে বুড়ো তুই ভাবিস নতুন
বের করা দাঁতে পলেস্তারা ঘুণ
দেয়াল নয় এতো ইটের পাঁজা
কোথা’ এনে তুই বসাবি রাজা ?

কোন ভাগ্যে তুই হবি রে রানী
লুকাস নে, আমায় বল দিকিনি -
কেন চোখের জলে চোখ ধুয়ে
তুই আজব, আজব স্বপ্ন দেখিস ?

তোর মা ও তো একই দেয়ালে
ঘুঁটে দিত হারিয়ে চোখের জলে
বুকে আগলিয়ে তোর টুকরোকে
গাল পাড়ত সে তোরই বাবাকে !

হলফ করে বলে, ‘চাই নে নাগর’
দেয়ালে দিত এঁটে ঘুঁটের চাপড়
ওই দেয়ালটাই তুই সাফাই করে
নতুন ঘুঁটেয় লিখবি দেয়াল ভরে ?

পুরনো দেয়ালে দিলে নতুন ঘুঁটে
বদলাবে না রে তোর ভাগ্য মোটে 
তবুও, চোখের জলে দেয়াল মুছে
তুইও রাজার, রানীর স্বপ্ন দেখিস !

ঘুঁটেকুড়ানির মেয়ে ঘুঁটেকুড়ানি
স্বপ্ন দেখে, হয়েও হবি নে রানী
তার চেয়ে চল যাই খুঁজে আনি
ঘুঁটের গোবর ভরা গামলাখানি

ঘুঁটে দিতে দিতে কপালের চুল
সরাবি তুই ওই হাতে করে ভুল
আর এই অভাগা, তোর চক্ষুশূল
ফুটছে দেখবে গুবরে ঘেঁটু ফুল

ঘুঁটেকুড়ানির মেয়ে ঘুঁটেকুড়ানি
আমি স্বপ্ন দেখি, তুই আমার রানী
জেগে দেখ, সামনে দাঁড়িয়ে রাজা
দে উলুধ্বনি, যা না, শঙ্খটা বাজা ||


-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ জুলাই ২০১৫

মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০১৫

চির-শুভ্র শতদল

|| চির-শুভ্র শতদল ||


আজও যাওয়া হল না, প্রাতে, পদব্রজে, দেখতে
ফুটেছে নাকি পুষ্করিণীতে শালুক শাপলার ফাঁকে
এক কমল | পড়ে আছে আধো আঁধারে বিছানায়,
বামে, এক কাতে নিদ্রায় আচ্ছন্ন অসাড় বৈষ্ণবী
প্রেম, শত বিরহ-বিচ্ছেদ ও পুনর্মিলনের সঙ্গিনী
তার মুদ্রিত আঁখি পল্লব গৌরের স্বপ্নে নিমীলিত
ঠোঁট ঈষৎ প্রসারিত, বেআবরু বুকে শ্বাস কম্পন
তার কণ্ঠিতে সাজিমাটির তিলকের কারুকাজে;
গলার মেদের খাঁজে জীর্ণ, নিষ্প্রাণ তুলসীমালায়;
আর কখন সম্ভোগে স্বেদাক্ত, এখন নিরম্বু দেহে
মদালস হতে উত্থিত এক কর্পূর-গন্ধি মাদকতা

একটু পরেই সে উঠবে, আড়মোড়ায় হাই তুলে
তারপর চুল না ভিজিয়ে স্নান করে, খুলে এলিয়ে
মিশি দিয়ে দাঁত মেজে, আয়নায় মুখ দেখবে সে
আর আমায় দেখাবে তার অজস্র ঝুরি নামা চুলে
বাঁধানো মুখের হাসিতে ফুটেছে অন্য একটি কমল
নেই তার অত পরিপাটি, শুধু ননী-রঙা বত্রিশ পাটি
তবুও তো তারই শরীরের, যা আমি করেছি পঙ্কিল

প্রতি রাত্রি ডুবুরী হই তার শরীরের গভীরে খুঁজতে
তার পুষ্করিণীতে শালুক শাপলার ফাঁকে উৎসারিত
এই কমল, প্রতি প্রত্যুষে পুনঃ-শুচিস্মিত শতদল ||


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২০ জুলাই ২০১৫

শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০১৫

প্রবুদ্ধ-ত্রয়ীর যাত্রা

|| প্রবুদ্ধ-ত্রয়ীর যাত্রা ||


(T S Eliot এর “The Journey Of The Magi” এর অনুবাদ)

‘আমরা লভেছিলাম এক হিমেল সমাগম তার,
ঠিক বছরের নিকৃষ্টতম সময়ে
চরম শীতের মধ্যবর্তী – যখন
আবহাওয়া তীক্ষ্ণ, আর পথ বরফে গভীর,
এক যাত্রার, এক সেমত দীর্ঘ যাত্রার জন্য’

পায়ের ব্যথায় কাতর উটেরা বিগড়ে বেঁকে বসেছিল,
গলে যাওয়া বরফের মাঝে শুয়ে পড়ে |
কতবার আক্ষেপ করেছিলাম
ছেড়ে আসা পাহাড়ের ঢালে দেহলি ঘাট, গ্রীষ্মাবাস প্রাসাদ,
আর শরবৎ পরিবেশিকা কৌশিক বালিকাদের কথা ভেবে |

তখন উটের সহিসদের অবিরাম গজগজানি, শাপশাপান্ত
আর তাদের মদ আর মেয়েমানুষের খাঁই, আর আর সরে পড়ে চম্পট,
আর নিশি-অনলের নিভে যাওয়া, আর আশ্রয়ের অভাব,
বৈরীভাবাপন্ন নগর সব, প্রতিকূল শহরতলী
আর আদাড়ে পল্লীগ্রামে দাবী চড়া দাম :
সে কী এক কঠিন সময় কেটেছিল |

পরিশেষে আমরা শ্রেয় মনে করলাম রাতভোর সফর
বিচ্ছিন্ন তন্দ্রা কিছু কেড়ে নিয়ে
সাথে, কানের ভিতর সমস্বরে গাওয়া গুঞ্জন,
শুনিয়ে, যে সমস্ত ব্যাপারটা একটা নিছক পাগলামি |

তারপর প্রাতে আমার নেমে এলাম তুষার রেখার নিচে
এক আর্দ্র, ভেষজ গন্ধমাখা নাতিশীতোষ্ণ উপত্যকায় ;
যাতে বহমান এক স্রোতস্বিনী, ও আঁধার হটাতে ব্যস্ত এক জল-যাঁতাকল,
আর অধঃ-আকাশপটে তিনটি গাছ ;
এবং, এক আদিম সাদা ঘোড়া তৃণভূমি মাঝে ছুটে গেল দ্রুত কদমে |

ক্রমশ আমরা পৌঁছলাম এক সরাইয়ে, যার চৌকাঠ ঢাকা দ্রাক্ষালতার পাতায়,
এক খোলা দরজায় ছ’জন খেলছে পাশা, রৌপ্যমুদ্রার আশে,
পা দিয়ে রিক্ত মদিরা-মশকে লাথি মেরে মেরে |
কিন্তু সেখানে মিলল না কোন সংবাদ, অতএব আমরা এগলাম
ও খুঁজে পেয়ে সেই স্থান, উপনীত হলাম, ঠিক সন্ধ্যায়,
এক মুহূর্তও আগে নয়, যা ছিল সন্তোষজনক (বলা যায়) |

এত সব ঘটেছিল বহুকাল আগে, আমার মনে পড়ে
এবং, লিখে নাও, আমি করব তার পুনরাবৃত্তি
লিখে রাখ উক্তি
এই : আমরা কি পরিচালিত হয়েছিলাম ওই সমগ্র পথে
আবির্ভাব বা তিরোধানের পানে ? হয়েছিল এক আবির্ভাব, ইহ নিশ্চিত
আমরা পেয়েছিলাম সন্দেহাতীত প্রমাণ | আমার তো দেখা ছিল জন্ম ও মৃত্যু
কিন্তু ভেবেছিলাম যে তারা ভিন্ন ; এই আবির্ভাব ছিল
মহাপ্রয়াণ সম, আমাদের মৃত্যু ; আমাদের পক্ষে কঠিন ও উগ্র যন্ত্রণাময় |

আমরা ফিরলাম, যে যার  দেশে দেশে, এইসব রাজত্বে
কিন্তু এখানে,  এই পুরাতন বিধি-বিধানে, আর নেই সেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ
নিজস্ব দেব-দেবতা আঁকড়ে পড়ে থাকা ভিনদেশীদের মাঝে
আর এক মৃত্যু, আমি সানন্দে বরণ করব  ||

---------------------------------------------------
অনুবাদ © ইন্দ্রনীর / ১৯ জুলাই ২০১৫

শুক্রবার, ১৭ জুলাই, ২০১৫

আমি কেন ফেসবুকে

|| আমি কেন ফেসবুকে ||


বন্ধ-কপাট জানালা দুপুর,
পীচ গলা পথ, প্রবাসী কুকুর
বন্ধ দরাজ দরজার মুকুর
লুকিয়ে টাটায় অতীত সুদূর

ঘর অন্ধকার, পর্দা টানা
এসির ফিসফিস একটানা
কাপড়-কাচা মেশিন নিপুণ
গান গেয়ে যায় গুনগুনগুণ

মিটিয়ে দিয়েছ সব পাওনা
রান্না ঘরে তো আর যাও না
মৃন্ময়ী তুমি কোথায় সোনা ?
পাশে থাকো, দূরে যেওনা

আমি এখনও ইহজগতে
টিকে রয়েছি কোনও মতে
নাড়ি ধমনীর রক্ত স্রোতে
টানাপড়েনের প্রতিঘাতে

বৈদ্যুতীন  তারে তারে তে
আদানপ্রদান রোববারেতে
একা মানুষটার দুঃসংবাদ
সবই আছে, জীবনটা বাদ

থাকবে বলে আমার সাথে
তুমি পালিয়েছ ওপারেতে
কী করে কাটাও দুপুরবেলা
জমিয়ে জমিয়ে প্রশ্ন মেলা ?

আমার চারিদিকের দেয়াল
এখন রাখে আমার খেয়াল
ওরা সবাই তোমারও ছিল
কী আক্কেলে যে বিদায় দিল

এখন ছায়া ছাওয়া অন্ধকার
বহুদিন হলো অবল কারবার
সব লেনদেন উঠেছে লাটে
যেদিন তুমি শুয়েছ খাটে

ফুল, চন্দন, ধূপ, ধুনোতে
সবাই পুজোয় উঠল মেতে
গেলে তুমি শেষ সাজেতে
আমায় ফেলে বিনকাজেতে

এখন তুমি যেথাই থাকো
আমার একটা কথা রাখো
বড্ড ইচ্ছে, মুখ দেখতে
এসো না আমার মুখবইতে

বলব আমি আর কী মুখে
‘এসো তুমি আমার বুকে’
বললে কি আর তুমি দিতে
এভাবে আমায় মুখ লুকাতে ?




---------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৭ জুলাই ২০১৫

বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০১৫

অতুষ্টি

|| অতুষ্টি ||


আধমোছা সিঁদুরের লাল
উল্কা তোমার কপালে
নিষ্পিষ্ট পলকে গাঁথা দুর্লভ অশ্রুবিন্দুর পুঁতি
মেঘ এখনও ঘনিয়ে চোখের পাতায় কাজলে
আড়মোড়া ভাঙ্গা চিলতে কোমরে বিদ্যুৎ দ্যুতি

কী খুঁজছ ? কিসের জলে, গালটা ভেজা কেন ?
ভাবছ খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছিল বৃষ্টি
না, না দেখো, বিছানার চাদরটা মসৃণ, শুকনো
ভুল বুঝেছ তুমি, আমার সাথে বৃষ্টির ফষ্টিনষ্টি

কেউই যে ভালবাসে না, প্রেম ব্যাপারটা নাস্তি
কিন্তু তাতো জানে না পালঙ্কে সাজানো বিছানা
মেঘ বৃষ্টির তাই নেই কোনও শান্তি, সোয়াস্তি
জানালা দিয়ে দেয় উঁকি, শোনে না শত মানা

উঠে বসো বরঞ্চ, আসছি চায়ের পেয়ালা নিয়ে
তুমি হাঁটু মুড়ে বসে সামলে নিয়ে উদাসীন দৃষ্টি
রেখ কিছুক্ষণের জন্য তোমার ঠোঁটে লাগিয়ে
আমার
কম চিনি দেয়া দুধ-চায়ের গোলাপি মিষ্টি

রাখো না অনুরোধ, চলো ফেলে ঘরোয়া আষাঢ়
বাসি কাপড়েই - কেউ দেখবে না, জানবে না
বৃষ্টির ছাঁটে ভিজিয়ে নিয়ে তোমার শাড়ির পাড়
আমায় বাড়ি ফিরিয়ে দিও করে কিছু আনমনা

তখন তোমাকে দেখে কেই বা বুঝবে তুমি কে,
আমি তো না ই | তুমি কি তুমি, না তুমি অনাবৃষ্টি
মেলে দিলে শুধু দেখবে, ওই মেঘ বৃষ্টির ফাঁকে,
ভিজে কাপড়ে
আটকে আমার চোরকাঁটা অতুষ্টি ||

---------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৫ জুলাই ২০১৫

শনিবার, ১১ জুলাই, ২০১৫

ঘোষ বাবু নির্ঘোষহীন

|| ঘোষ বাবু নির্ঘোষহীন ||


বকবকানির জন্ম দোষ, সামলে বসে শ্রীযুক্ত ঘোষ
গরম গরম সংলাপ সব, ভাবছে কিন্তু ছাড়ছে না
মনের কথা পেটে চেপে, পেট উঠেছে ফুলে ফেঁপে
ঢেকুর তুলে সমান তালে, তবুও ধ্রুপদ মিলছে না

সকাল, দুপুর, বিকেল, রাতি, ফেসবুকেতে মাতামাতি
বন্ধুদের কত যতন-আতি, তবুও যে কেউ সাধছে না
তেনার এই মান অভিমান, গোলা পেটে ধানি কামান
সলতে দিয়ে আগুন দিলেও, নিশানা তিনি দাগছে না

(আসল কথা বলি শোনো, আর কেউ না জানে যেন
মুখে কুলুপ এঁটে কেন, ঘোষ করছে বদভ্যাস হেন)

গিন্নি গেছে ছেলের বাড়ি, না, না ভাই নয়কো আড়ি
মান্ধাতার এই পোড়োবাড়ি, বেড়াল ছুঁচোর বাড়াবাড়ি
পালঙ্কে উঠে পেরেম পিরিত, করতে তারা ছাড়ছে না
পাড়ার বৌ, মেয়ে, ধাড়ি, আড় চোখে কী দেখছে না ?

হাঁড়ির খবর সবাই রাখে, চায় বাবুটা একায় যায় বখে
তারা আছে তাই আড়ি পেতে, বাবুটা মুখ খুলছে না
কোন কথাটার কী মানে, কে বুঝবে কেই বা জানে
ভালোবাসার ঢল বাজারে, ভাল বাসা যে মিলছে না ||


--------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১১ জুলাই ২০১৫