সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৫

পাঁচ মিনিট

|| পাঁচ মিনিট ||


-    “তুই শুনবি না ?” বিরক্ত হয়ে সীমা জিজ্ঞাসা করল |
-    “হ্যাঁ, এইবার বল – শুনি তোর কথা |” খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে, চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে নামিয়ে রেখে তিন্নি বলল, “শুরু থেকে বল | কোথায় বললি তোর বর তোকে নিয়ে গেল ... আর, কেন ?”

সীমা - “সকাল সকাল – একটু আগেই শৈবাল ডেকে বলেছে প্রায় সাতটা বাজে – একটা ফোন এলো | ফোনে এক দুটো কথা বলেই গম্ভীর গলায় ও বলল, ‘ওঠো | চলো, বেরোতে হবে |’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হয়েছে ? কার ফোন ছিল ? কোথায় যেতে হবে ?’ ও বলল, ‘বড় মামার ফোন ছিল | বলল, এই মাত্র খবর পেয়েছি, তোতনদা মারা গেছে | হাসপাতাল থেকে ফোন করে খবর দিয়েছে |  আমার তো এখন লোকজন দরকার | তুই সীমা কে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারিস আয় |’ ”
তিন্নি - “তোতনদা বলতে ?”
সীমা - “শৈবালের বড় মামার সৎ-কাজিন |”
তিন্নি - “ইউ মীন ... শৈবালদা’র দাদুর দু’টো বউ ছিল ?”
সীমা - “আরে না | ওর দাদু একটাই বিয়ে করেছিলেন | তাঁর যে বাবা, তেনার দুটো বউ ছিল, সেই কোন এক কালে | সেই সুবাদে তোতন ... মামাই হবে তো ... বড় মামার একরকম সৎ-কাজিন হয় | মানে – বুঝছিস তো – আমি জানি না ওনাকে এক্চ্যুয়ালি কী বলা উচিত |”
তিন্নি - “ও ... তারপর ?”
সীমা - “আমি উঠে চটপট দু’একটা কাজ সেরে শাড়িটা পাল্টে তৈরি হয়ে নিলাম |”
তিন্নি - “কী শাড়ি পরলি ? তাঁত ?”
তিন্নি - “আহ, ছাড় তো | এত সিরিয়াস কথাবার্তার মধ্যে ... ‘কী শাড়ি পরলি ?’ ... তুই ও না !”
তিন্নি - “আচ্ছা বাবা, রাগিস না, বল |”
সীমা - “শৈবাল আমাকে নিয়ে একটু পরেই বেরিয়ে পড়ল | তাড়াহুড়োয় জলখাবারটা অব্দি মুখে দিতে পারলাম না | ও বলল পৌঁছে মুখে কিছু দেবার একটা ব্যবস্থা করবে | সবাই নাকি অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য |”
তিন্নি - “কোথায় যেতে হল ?”
সীমা - “সে অনেক দূরে | বাড়ি থেকে রিক্সা ধরে লেভেল-ক্রসিং মোড়ে গিয়ে সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ...  তোতন মামার বাড়ি সব মিলিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা | ওখানে, ও বলল কী নাম যেন পাড়াটার, হুগলীর মোহনার পাড়ে একটা ক্রিমেটোরিয়াম আছে – তারই সামনে একটা বাড়িতে | আমরা অনেক খুঁজে সেটা বের করলাম | দেখলাম, অনেকেই সেখানে আগে এসে অপেক্ষা করছিল |”
তিন্নি - “সেটা কি সেই ... তোতন মামার বাড়ি ?”
সীমা - “উহুঁ | ওটা কারো বাড়ি ছিল না – মানে, বাড়িটায় লোকজন বাস করে এমন কিছু দেখলাম না |”

সীমা একটু নড়েচড়ে বসে গুছিয়ে বলতে শুরু করল |

বাড়িটা একতলা, কিন্তু খুব বড় – যাকে বলে বিশাল, ছড়ানো | কিসের বাড়ি সামনে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই – ভিতরে গিয়ে বুঝলাম বাড়িটা সম্ভবত ভাড়া দেয়া হয় এই ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য | যেমন, যারা গঙ্গাপ্রাপ্তির জন্য মড়া পোড়াতে দূর দেশ থেকে লোকজন, দলবল নিয়ে আসে তারা ওখানে ওঠে | আমরা যখন পৌঁছলাম বাড়িটা প্রায় ফাঁকা | ভিতরে ঢুকেই দেখলাম একটা বেশ বড়সড় কামরায় মেঝেতে ফরাস পেতে অনেক লোক বসে | বেশির ভাগই পুরুষ মানুষ, আর দু’এক জন মেয়ে মানুষও বসে | কাউকেই চিনলাম না | মনে হয় না শৈবালও কাউকে চিনল | কিন্তু, ওদেরই মধ্যে থেকে কেউ এগিয়ে এসে ওকে বলল, “এসো, এসো |” মেয়ে বউদের একটা দল এক পাশে বসে আমাকে দেখছিল | তাদের একজন আমাকে হাত নেড়ে ডাকল ওদের কাছে বসে পড়ার জন্য | আমি কাছে গিয়ে বসতেই সে বলল, “চুপচাপ বসো এখন | অনেক সময় লাগবে |” কিসের সময় লাগবে ভাবছি, ততক্ষণে শৈবাল আমার কাছে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “শোনো, মনে হচ্ছে দেরী হবে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কিসের দেরী ?” ও বলল, “বলছে চুল্লীর ওখানে লাইন পড়ে গেছে | আমাদের পালা আসতে দেরী হবে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “বড় মামা কোথায় ? ওনাকে তো দেখছি না |” ও বলল, “আমিও দেখলাম না | কেউ বলতেও পারছে না |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আর তোতন মামার বডিটা ?” শৈবাল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “দাঁড়াও সীমা, আমি সব খবর নিয়ে এসে বলছি |” এই বলে ও চলে গেলে আমি বসে থাকলাম | অনেকক্ষণ বসে থাকলাম | ও আর ফিরেই এলো না |

বাকি সবাইও চুপ করে গ্রুপে গ্রুপে বসে | কিন্তু কেউই তেমন কথা বলছে না | বুঝতে পারছি না সবাই কি তোতন মামার সাইডের লোক, না আলাদা আলাদা ডেড বডির সাথে আসা দল | সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার - কাউকে কাঁদতে দেখলাম না | এও বুঝলাম না যে তোতন মামার পরিবার, ছেলে মেয়ে বলতে কিছু কি নেই ?

হলঘরটায় একটা ঘড়ি ছিল | তাতে যখন প্রায় দুটো বাজে, শৈবাল ফিরল | দূর থেকে আমাকে ডাকল | আমি উঠে গেলে বলল, “শোনো, মুশকিল হয়েছে | কিছু ছেলে, এখানকার মাস্তান-টাস্তান হবে, বড় মামার সাথে খুব ঝামেলা করছে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী নিয়ে ঝামেলা ?” ও বলল, “কাল তোতন মামার মারা যাওয়ার খবর পেয়ে বড় মামা হাসপাতালে গিয়ে বডিটা মর্গে রেখে, আজ ভোর ভোর এখানে এসেছিল | একা মানুষ, কী ভাবে সামলাবে ভেবে পায় নি | চিন্তা হয়েছিল যে কাঁধ দেবার লোকজন জোগাড় করে বডি নিয়ে আসতে আসতে এখানে পোড়ানোর লম্বা লাইন পড়ে যাবে | তাই আগে এখানে এসেছিল লাইনে জায়গা ধরতে | এসে দেখল মড়া বিনে কেউ কথাই বলতে চায় না | একদল বখাটে ছেলে খবরদারি করছিল | তারা বলল, ‘আগে মড়া নিয়ে আসুন | তারপর কথা বলবেন |’ মামা ওদেরকে বলল, ‘দেখো ভাই, আমি একা মানুষ | যে মারা গেছে, তারও তিন কুলে কেউ নেই | লোকজন জোগাড় করে বডি আনতে আনতে দেরী হয়ে যাবে | তাই বলছিলাম, আমার নম্বরটা যদি লিখে রাখতে |’ একজন বলল, ‘ঠিক আছে, নাম বলুন – আপনার না – যে মারা গেছে তার নাম বলুন |’ মামা নাম বললে ওরা নাকি একটা নোটবুকে লিখে রেখে বলল, ‘যান, গিয়ে মড়া নিয়ে আসুন | আপনার নম্বর থাকলো |’ তারপরই বড় মামা আমাকে ফোন করেছিল | আমি তখন বলেছিলাম, ‘হাসপাতালে নিশ্চয়ই ডেড বডি শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য হ্যর্স (শবযান) পাওয়া যাবে  | তুমি অপেক্ষা করো, আমি আসছি |’ এখন একটু আগে মামাকে নিয়ে হাসপাতালের হ্যর্স জোগাড় করে, তোতন মামার বডি নিয়ে ফিরেছি | এখানে এসে দেখছি আমাদের লাইন নেই – ইতিমধ্যে অন্য যারা এসেছে, ওই মাস্তানগুলো তাদের আমাদের আগে নম্বর দিয়ে বসে আছে | বড় মামা যে ভোরে এসেছিল সে কথা ওরা মানছেই না | বড় মামা যখন ওদের বলল ওদের একজন নোটবুকে নাম লিখেছিল, ওরা সবাই খুব খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিশ্রীভাবে হাসল | একজন বলল, ‘যা শ্যালা, সসান ঘাটে নোটবুক ! দাদু, এটা কি দেখে ইসকুল-টিস্কুল মনে হচ্ছে ?’ এই ধরনের কথা শুনে বড় মামার মাথা গরম হয়ে গেছে | আমি কোনমতে বড় মামাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ওই হাসপাতালের হ্যর্সে বসিয়ে রেখে এসেছি ... আমি এখন যাই – রগচটা মানুষ, সামলে না রাখলে আবার তেড়ে যাবে ওদের সাথে লাগতে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “খাওয়ার কী হবে ? সেই সকাল থেকে যে না খেয়ে আছি |” “দেখছি কী করা যায়”, বলে শৈবাল গেল |

সীমা কথা থামাল | তিন্নি বলল, “থামিস না | বেশ ইন্টারেস্টিং !”  সীমা চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে আবার বলতে লাগল |

যখন দেয়াল ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা বাজে, রোদ পড়ে আসছে, দেখলাম বাথরুম পেয়েছে – যদিও সকাল থেকে এক গেলাস জলও খাই নি | উঠলাম | বাড়িটার ভিতর দিকে ঘরটা থেকে বেরিয়ে একটা করিডোর – তার এক পাশে উঠোন, অন্য পাশে ঘর পর পর | কোনটার দরজা বন্ধ, কোনটার খোলা | কোথাও বাথরুম দেখতে পেলাম না | বেশ কিছু এগিয়ে গিয়ে পেলাম  এই করিডোরটার আড়াআড়ি আর একটা করিডোর | তার দু’পাশে ওইরকম খালি খালি ঘর | যতই এগোই কোনও বাথরুম দেখতে পাই না | এলোমেলো ঘুরে কখন কোন করিডোর থেকে কোন করিডোরে চলে গিয়েছি জানি না – হঠাত মনে হল আমি পথ গুলিয়ে ফেলেছি | ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে আন্দাজে হাঁটা দিলাম | একটু পরে লোকের কথা বলার আওয়াজ শুনে ভরসা পেলাম যে যাক নিজের ঘরটার কাছাকাছি এসেছি | তখন দেখি একটা ঘরের দরজা খোলা যার উল্টোদিকের দেয়ালে একটা আধখোলা দরজা – সেদিক থেকে অপরিষ্কার বাথরুমের মত একটা গন্ধ ভেসে আসছে | ঢুকে ভিতরের দরজাটার কাছে গিয়ে দেখি তার পিছনে একটা কুঠরি | তার মেঝেয় একটা কল থেকে জল পড়ে পড়ে শ্যাওলা হয়েছে, যার গন্ধ পেয়েছিলাম | ফিরে বেরিয়ে আসতে গিয়ে দেখি বাইরের ঘরটার একদিকে দেয়ালের লাগোয়া একটা টেবিলে সাদা কাপড় পেতে তার উপরে কিছু ফুল, সাথে কাগজের প্লেটে প্লেটে থরে থরে অনেক মিষ্টি রাখা | মনে হল  শ্মশান যাত্রীদের জন্য হয়ত জলযোগের ব্যবস্থা করা আছে | পাশে গেলাসে গেলাসে জলও রাখা ছিল | খুব তেষ্টা পেয়েছিল | একটা গেলাস তুলে জলটায় মুখ দিয়েছি কি, কী ভাবে ধাক্কা লেগে একটা মিষ্টির প্লেট থেকে কিছু মিষ্টি মাটিতে পড়ে গেল | তুলে দেখি শুকনো মিষ্টি | ওগুলো হাতে নিয়ে জল খেতে খেতে ভাবছি, মিষ্টিগুলো প্লেটে রেখে দেব না ফেলে দেব – এমন সময় কেউ বলল, “এ তুমি কী করলে ?” মেয়ে মানুষের গলা শুনে তাকিয়ে দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে একজন অল্প বয়সী বউ ভীষণভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে | আমি তাকাতেই সে বলল, “এখনও মড়ার মুখাগ্নি হল না, আর তুমি মিষ্টি খেয়ে মুখে জল দিলে ? ছি ছি ছি !” মনে করতে পারলাম না যাদের সাথে বসেছিলাম তাদের মধ্যে ওকে দেখেছি কিনা | আমি কিছু বলার আগেই সে মাথা পিছনে ঘুরিয়ে বলল, “এ কেমন  অলক্ষুণে কথা, দেখো দিদি ! কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার !” তার পিছন থেকে একজন বয়স্কা বউ উঁকি দিয়ে বলল, “কী সর্বনাশ ! চল চল, গিয়ে খবরটা ওদের বলি |” প্রথম বউটা মাথার কাপড় তুলে আঁচলের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে কাঁদো কাঁদো গলায়, “এর কী বিহিত হবে এখন ? হে ভগবান ! যে চলে গেল তার আত্মা এখন কী ভাবে শান্তি পাবে ?” বলে দরজা থেকে সরে গেল | আমি কী বলব, ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম | একটু সময় লাগল এই শক থেকে ধাতস্থ হতে | তারপর চট করে মিষ্টিগুলো কুঠরিতে ফেলে, ওখানে কলে হাত ধুয়ে করিডোরে বেরলাম | ওদের দু’জনকে কিন্তু কোথাও দেখতে পেলাম না |

লোকজনের গলা শুনতে শুনতে ঘরটায় পৌঁছলাম | ভিতরে ঢুকে কটা বাজে দেখার জন্য দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি কোনও ঘড়ি নেই | যারা বসে আছে তারা সব নতুন মুখ | স্পষ্ট বুঝলাম আমি যে ঘরে বসেছিলাম এটা সেই ঘর নয় | তাহলে আমি কি সত্যি হারিয়ে গিয়েছি ? দ্বিধা নিয়ে বেরিয়ে আসতে যাব, অমনি বসে থাকা বউদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠলো | দেখলাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে | একে একে সব বউরা নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করল | সেই বয়স্কা বউটা যে আমাকে মিষ্টির ঘরে উঁকি মেরে দেখেছিল, সে মাথা নাড়ল | অল্প বয়সী বউটা হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকল | আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, “কী ?” অমনি দু’তিন জন বউ সমস্বরে কথা বলতে লাগল | কেউ জিজ্ঞাসা করল, “এখনও মড়া পোড়ানো হয় নি, আর তুমি উপোষ ভাঙ্গলে ?” কেউ বলল, “এমন কাজ করলে ভাই !” আবার কেউ বলল, “আমরাও তো সবাই না খেয়ে আছি | ছি, ছি, ছি – কাজটা ভালো করলে না |” আমি ভাবলাম বলি, ‘আমি তো আপনাদের, বা যিনি মারা গেছেন তাঁর, কেউ নই | আর, আমি শুধু জল খেয়েছি, আর কিছু খাই নি |’ কিন্তু, ওদের আরও মতামত, মন্তব্য বলা শুরু হয়ে গেল – সবই আমার খেয়ে ফেলা নিয়ে কটু কথা | শুনে মনে হল না আমি ওদের অচেনা, ওদের পর | আমি ভীষণ হতাশ বোধ করলাম | একে না খেয়ে আছি সকাল থেকে, তারপর হারিয়ে গিয়েছি এই বাড়িটার গোলকধাঁধায়, আর জানি না শৈবাল কোথায়, কী করছে, আমি যে মিসিং আদৌ তা লক্ষ্য করেছে কিনা | আমি ছুটে করিডোরে বেরিয়ে এলাম |

জানি না কতক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মত যেদিকে পেরেছি হেঁটেছি | হয়ত এ্যাবসেন্ট মাইন্ডে বাইরে বেরোনোর পথ খুঁজছিলাম | কিছুক্ষণ পরে মনে হল সূর্য অস্ত গেছে | আলোটা আবছা হয়ে আস্তে আস্তে আঁধার ঘনিয়ে আসছে | অন্ধকার করিডোরে আমি সম্পূর্ণ একা |

আমি প্রায় কেঁদে ফেলব, হটাত কেউ পিছন থেকে এসে আলতো হাতে আমার ডান কব্জি ধরল – হাতের তালু খসখসে আর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা – আর বলল, “এ কী ? তুমি এখানে ! সবাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা করছে |” গলা শুনে আন্দাজ করলাম বড় মামা | আমি ওনার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম | উনি বললেন, “তুমি কি ওদের কথায় রাগ করেছ ? ছেড়ে দাও মেয়েমানুষের কথা | ও সব গায়ে মাখতে নেই ... আমি এলাম তোমায় খুঁজতে, কেননা ওদিকে খুব ভয়ঙ্কর অবস্থা | শিগগির চলো | বাকি সবাই জড়ো হয়েছে, শুধু তুমি নেই |” আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল, তাই মুখ না ঘুরিয়ে, চলা না থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে ?”
-    “কতকগুলো ছেলে তোমার বড় মামার সাথে খুব মারপিট করেছে | ওকে বেদম মেরেছে |”
-    “কারা ? কেন মারল ? শৈবাল কই ? ও কেন এলো না আমাকে খুঁজতে ?”
আমি এক নিশ্বাসে প্রশ্নগুলো করে ফেলেই থমকে গেলাম | যে মানুষটা এই ভাবে বড় মামার কথা বলছে সে কী করে বড় মামা হবে ? মুখ তুলে পাশে তাকিয়ে দেখি বড় মামার মতই লম্বা চওড়া বেশ বয়স্ক একজন মানুষ | তার মুখের আদল বড় মামার মতই সৌম্য, কিন্তু চোখ দুটো কেমন অন্ধকার, নিষ্প্রভ | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কারা মেরেছে বড় মামাকে ? উনি এখন কোথায় ... আর, আপনি কে ?” লোকটা বলল, “তুমি আমাকে চিনবে না ... তোমার বড় মামা গিয়েছিল ওদের সাথে কথা বলতে, ওরা কেন আমাদের আগে অন্যদের চুল্লীর লাইনে ঢুকিয়েছে | সেই নিয়ে ... ওই দেখো, শৈবাল আসছে ! ওর কাছে শোনো কী হয়েছে ঘটনাটা |” লোকটা আমার হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল |

করিডোরের শেষে একটু আলোয় দেখলাম শৈবাল হন্ত দন্ত হয়ে আসছে | আমি ছুটে ওর কাছে যেতেই ও দাঁড়িয়ে পড়ে আমার হাত ধরল | তারপর আমায় টেনে ফিরে যেতে যেতে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি ? আমি কত খুঁজছি | শিগগির চলো ... বড় মামাকে ছেলেগুলো খুব মারধোর করেছে | বড় মামা কথা বলতে গিয়েছিল, ছেলেগুলো কেন আমাদের লাইন কেটে অন্যদের ঢুকিয়েছে | এই নিয়ে তর্কাতর্কি থেকে মারামারি |” আমি ওর সাথে সমান বেগে হাঁটার চেষ্টা করতে করতে বললাম, “এখন বড় মামা কোথায় ?” শৈবাল বলল, “ওখানেই |” “ওখানেই মানে ?” আমার প্রশ্ন শুনে শৈবাল আমার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, “সীমা, ওরা বড় মামাকে এমন মেরেছে যে বড় মামা চুল্লীগুলোর দরজার সামনে নেতিয়ে পড়ে আছে, উঠতে পারছে না | ছেলেগুলোর দলের সর্দারটা সবাইকে বলছে  ‘এখন লাইনে ইনি নেক্সট | জায়গা চাইছিলেন – জায়গা করে দিয়েছি |’ বড় মামাকে ওই অবস্থায় ফেলে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি | বাকি সবাই ওখানে |” আমি আঁতকে উঠে বললাম, “তার মানে ? কী হয়েছে খুলে বলছ না কেন ?’ শৈবাল বলল, “আমি হ্যর্সে তোতন মামার বডি নিয়ে বড় মামার সাথে বসে ছিলাম | কখন একটু চোখ বুজে এসেছিল | হঠাত শুনি খুব চেঁচামেচির আওয়াজ | চমকে উঠে চোখ খুলে দেখি বড় মামা নেই | চুল্লীগুলোর দিকে থেকে একটা হট্টগোলের শব্দ আসছিল | একজন ছুটে এসে আমাকে বলল, ‘শিগগির যান, ওনাকে বাঁচান |’ দৌড়ে গিয়ে দেখি ততক্ষণে ওরা বড় মামাকে মেরে প্রায় শেষ করে দিয়েছে | রক্তমাখা জখম দেহটা একটা চুল্লীর সামনে মাটিতে শুইয়ে রেখেছে | আমি গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতেই ওখানকার জটলা করে দাঁড়ানো একদল ছেলের মধ্যে একজন আমাকে বলল, ‘আর দেরী হবে না | লাইনে এখন ইনিই নেক্সট |’”

আমরা ততক্ষণে বাড়িটার সামনে বেরিয়ে এসেছি | আমি বললাম, “সে কী ? তোমরা কেউ কিছু প্রতিবাদ করলে না ? তোমরা এতগুলো মানুষ আর ওই কটা ছেলে ... ওরা ক’জন ? হাসপাতালে, পুলিশে কোথাও খবর দেবে না ?” শৈবাল বলল, “দেব, দেব | তক্ষুনি আমার প্রথম চিন্তা হল তোমাকে নিয়ে | তাই আমি আগে ছুটলাম তোমাকে খুঁজতে | এতগুলো ঘর, কোনটায় যে তুমি বসেছিল কিছুতেই চিনতে পারলাম না | তোমার সাথে ওই ঘরটায় যারা ছিল তাদেরকেও দেখতে পেলাম না ... এখন দেখি কী করতে পারি ... তুমি একটা কাজ করবে ?” আমি বললাম, “কী ?” শৈবাল বলল, “তুমি ওই হ্যর্সটার ভিতরে বসো | আমি যাই, অন্যদের ধরে বড় মামাকে তুলে নিয়ে আসি |” আমি আঁতকে উঠে বললাম, “না, না, ওতে ডেড বডি আছে ... আমি পারব না |” তাও শৈবাল প্রায় জোর করে আমাকে হ্যর্সটার কাছে দাঁড় করিয়ে সাইডের একটা দরজা একটু খুলে বলল, “ওঠো !” সারাদিনের ক্লান্তিতে তখন আমার চোখ জড়িয়ে ঘুম নামছে | বসতে পেলে শুয়ে পড়ি | জিজ্ঞাসা করলাম, “এত অন্ধকার যে, কটা বাজে এখন ?” “প্রায় সাতটা ... নাও, উঠে বসো” বলে শৈবাল আমার কাঁধে একটু চাপ দিয়ে চলে গেল | কিছুক্ষণ পরেই একজন দৌড়ে এসে হ্যর্সটার পিছনের দরজা দুটো সপাট খুলে দিল | দেখলাম শৈবাল আর কিছু লোক ধরাধরি করে নিয়ে আসছে বড় মামার বিরাট শরীর |

সীমার কথা থেমে গেল | তিন্নি বলল, “উফ ! কী বীভৎস ব্যাপার ! তুই ...”  সীমা উত্তর দিল না, কেননা মনে পড়ল ...

ওর দৃষ্টি কী ভাবে যে হ্যর্সটার ভিতরে চলে গিয়েছিল, হয়ত দেখতে যে বড় মামার দেহটা কোথায় রাখবে | তখনই চোখ পড়েছিল ভিতরে শোয়ানো তোতন মামার দেহটার দিকে | মুখের কাপড় সরানো | পিছনের খোলা দরজা দিয়ে আসা রাস্তার আবছা আলোয় বোজা চোখ দুটোর অন্ধকার গর্ত ঠিক দেখা না গেলেও, মুখটার আদল অবিকল বড় মামার মত – সৌম্য, বেশ অভিজাত – যেমন কিছু আগে ও দেখেছে করিডোরে | সীমার ডান হাতের কব্জি থেকে একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি শিরশির করে উঠে সারা শরীরে ছড়িয়ে গিয়েছিল | সীমা অবশ হয়ে পড়ে যেতে যেতে শুনেছিল, ক্ষীণ গলা থেকে ক্রমশ জোরালো হয়ে আসা শৈবালের ডাক, “সীমা ... সাতটা বাজছে ... আর না ... ওঠো এবার !”


----------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ নভেম্বর ২০১৫

বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫

বার্ধক্যের থ্রুপুট

|| বার্ধক্যের থ্রুপুট ||


দ্রুতগতি বার্ধক্যের সাথে সাথে বেনু (বেণী মাধব) বাবুর গতানুগতিক সমস্যাও টপাটপ দেখা দিচ্ছে | উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ, গেঁটে বাত ... কী নেই বলা মুশকিল | প্রতি ছ’মাসে রক্ত পরীক্ষা | প্রতি মাসে একবার ডাক্তারের মুখদর্শন |

এর মধ্যে ধরা পড়ল, বেনু বাবুর রক্তে প্লেটলেট কমে এক লাখের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে | রুগীর পক্ষে যা চিন্তার বিষয়, ডাক্তারের পক্ষে তা নয় | রিপোর্ট দেখে হরি সাধন ডাক্তার ওষুধ লিখে দিলেন, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স | কেমন ঝুরঝুরে বড়িগুলো, চট করে ভেঙ্গে যায় | বেনু বাবুর ব্যাপারটা মনঃপুত হল না | স্ত্রী কে বললেন, “নিভা, ডাক্তার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তেমন গা করল না | তুমি একটু নেটে দেখো তো |” নিভা (নিভাননী দেবী) কলেজে জীববিজ্ঞান পড়েছিলেন | এখনও চোখে চশমা লাগে নি | ছেলের ফেলে যাওয়া কলেজের কম্প্যুট্যরটা মাঝে মাঝে ঘেঁটে অন্তর্জাল থেকে নানান কাজের তথ্য খুঁজে পান ও বেনু বাবুর উপর তা প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা যাচাই করেন |

দু’দিন পরে বেনু বাবু বললেন, “নিভা, তুমি নেটে কিছু দেখেছ ? আমার কিন্তু ...” বলতে বলতে তিনি থেমে গেলেন | নিভা প্রশ্ন করলেন, “কিন্তু কী ?”
- “না, মানে দু’দিন ধরে সকালে বাথরুম করে দেখছি ...”
- “কী দেখছ ?”
- “হলুদ বাথরুম হচ্ছে |”
- “বলবে তো !”

আবার ডাক্তার হরি সাধন, আবার রক্ত পরীক্ষা | রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন, “হুম, প্লেটলেট তো যা ছিল তাই আছে ... এদিকে বিলিরুবিন একের একটু উপরে দেখছি ... মনে হচ্ছে জন্ডিস হয়েছে | যাক, সবে শুরু, চিন্তার কিছু নেই | ওষুধ লিখে দিচ্ছি |”

ইতিমধ্যে নিভা নেট ঘেঁটে একটি যুতসই জিনিস পেয়েছেন | নেটে বলছে, প্লেটলেট বাড়ানোর একেবারে মোক্ষম পথ্য ! এছাড়াও তার অজস্র গুণ | প্রথমত:, তাতে কী নেই ? লোহা, তামা, দস্তা, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম সব আছে (যদিও শেষের দুটো ঠিক চেনা লাগল না, তবে অধিকন্তু ন দোষায়) | তারপর, পর পর – তাতে যকৃৎ উপকৃত হয় ; রক্তচাপ কমে ; মেদ কমে ; বার্ধক্যের গতি রোধ হয় ; এমন কি, কর্কট (বালাই ষাট !) রোগেরও উপশমে সাহায্য করে |

একটু মুশকিল, তার ভয়ঙ্কর রঙ নিয়ে | খাবারে রঙ নিয়ে বেনু বাবুর রাইট এন্ড রং জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর | রান্নায় হলুদ কম খান | মিষ্টি কেনেন তো শুধু সাদা | বাজারের বোঁদে চলে না, বাড়িতে তৈরি হয় বিনে রঙ দিয়ে | কেনা ডালমুটে লাল বোঁদে, সবুজ মটর দেখলে বেছে বেছে ফেলে দেন | যেদিন থেকে শুনেছেন পটল রঙ করে বিক্রি করা হয়, পটল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন | সবুজ সবজি, সাদা মুলো চলে, কিন্তু কুমড়ো, লাল মুলো কি গাজর না |

অনেক ভেবে নিভা একটা উপায় খুঁজে পেলেন | ওটাকে কুচিয়ে আরও অন্য কিছু মিশিয়ে কড়াইয়ে একটু নেড়ে নরম করে দু-পিস পাউরুটির মধ্যে দিয়ে স্যান্ডউইচ করে দিলে বেনু বাবু খেয়ে নেবেন | রাত্রের খাবার শুকনো হলে ভালো, সাদা পাউরুটি হলে তো কথাই নেই |

ক’দিন পরে বেনু বাবু বললেন, “নিভা, তুমি নেটে কিছু দেখেছ ? আমার তো এখন ...” বলতে বলতে তিনি থেমে গেলেন | নিভা জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন আবার কী হল ?”
- “না, মানে আজ সকালেও টয়লেট করলাম | কেমন যেন ...”
- “কেমন ?”
- “একটু কালচে লাল মনে হল |”
- “কালচে লাল ! মানে রক্ত ?”

কিছু না বলে নিভা ডাক্তারকে ফোন করলেন | ডাক্তার শুনে একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওর খাওয়া দাওয়া ঠিক আছে তো | কোন অনিয়ম ?” নিভা একটু দ্বিধায় মাথা নাড়লেন, যেটা ডাক্তার দেখতে পেলেন না | তাই জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু খাওয়া দাওয়ার থেকেই গণ্ডগোল হচ্ছে মনে হয় | কাল রাত্রে কী খেয়েছে ?” এবার সতর্ক হয়ে নিভা জানালেন ইদানীং সন্ধ্যায় তিনি প্লেটলেট বাড়ানোর জন্য একটা নতুন পথ্য দিচ্ছেন, অবশ্যই বেনু বাবুকে না জানিয়ে |

“কী ?” ডাক্তারের প্রশ্ন | উত্তরটা শুনে ডাক্তার না সামলাতে পেরে অট্টহাসি হেসে উঠলেন | হাসি আর থামে না | ক্রমে বেগ কমে এলেও খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতেই থাকলেন | বিব্রত হয়ে নিভা জিজ্ঞাসা করলেন, “হাসছেন যে !” ডাক্তার বললেন, “প্লেটলেট ইন – প্লেটলেট আউট |”
- “মানে ?”
- “মানে ... বিটরুট ইন – বিটরুট আউট !”


----------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৮ নভেম্বর ২০১৫

রবিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৫

কুন্তলা

|| কুন্তলা ||


অধুনা-লুপ্ত একদাকে ঠাঁই দিয়ে এই গ্রামে
শিথিল বহমান সময় যেন গিয়েছে থেমে
সাড় হীন, চিৎপাত, গেরুয়া খোয়াই মাঠ
নিটোল আরশি সরসীর স্নানার্থী রিক্ত ঘাট
নিরুদ্দেশগামী ক্ষয়িষ্ণু পথেরা ধুলো ভরা
ছায়ামাখা সাকিন, দেয়াল নোনা, ঘুণ ধরা
দুরে মন্দাকিনীর বিলে পানা ছাপায় দুকুল
চূর্ণ চুনি সবুজ শ্যাওলা মাখা শিব দেউল
একা বেওয়ারিশ কুকুর, নামেমাত্র কুবের
বসে থাকে, মুখ চেয়ে যুধিষ্ঠির পুরুতের

এক প্রান্তে ঘুমন্ত অট্টালিকার তেতলায়
কার্নিশ বিহীন ভাঙ্গা খড়খড়ির জানালায়
ডুরে আলো-আঁধারিতে আবলুস খাটে
পা ছড়িয়ে বসে কন্যা চুলে বিলি কাটে
দাঁতভাঙ্গা গজদন্ত চিরুনি, চিকন হাতে
আংটির দাগ বসে নি যার অনামিকাতে
যার কপাল এখনো ছোঁয় নি বিন্দু সিন্দূর
মুখে চেয়ে তার চাঁদ রাতে মেঠো ইন্দুর
থমকে হয় এক চিরন্তন দিবাস্বপ্নে বিলীন
রাজকুমারের আগমন কি এতই কঠিন ?

কিন্তু আসে না কখনই কোন রাজকুমার
থেমে থাকে সময়, তবু শত যুগ হয় পার
যদি দূর হতে লোকজন নিয়ে বাস আসে
মন্দাকিনী পারে নলহাটি হাটের ওপাশে
কিছু লোক ওঠে, নাম দুই-এক অচিন মুখ
আশ ভরে শ্বাস নেয়, তবু ভরে না বুকে সুখ
কখনো কেউই পার হয় না ওই খোয়াই মাঠ
কেনই বা পার হবে ? আলাই-বালাই ষাট !
শুনেছে তারা এক ডাকিনীর কুহকের কথা
আজানুলম্বিত চুলে বেষ্টিত যার সুচারু মাথা
সে নাকি নামিয়ে তার কুন্তল পাতে ফাঁদ
যখন চারিদিক সুনসান, ফুটন্ত চাঁদনী রাত
তারপরে ফেলে দিয়ে সেই গজদন্ত চিরুনি
শুধায়, “এই, এত দিন কেন তুমি আস নি ?
এসেছ, তো আঁচড়ে দাও আমার এই চুল”
ব্যাস ! ওখানেই হবু রাজকুমার করে ভুল
যেই সে সেই ভাঙ্গা চিরুনি চুলেতে ঠেকায়
অমনি কোথায় চুল,  কুন্তলাই বা কোথায় ?
হারায় একদা, সময় চমকে জাগে বর্তমানে
নিঃসাড় গ্রাম জেগে ওঠে প্রাণের স্পন্দনে

হতে কি পারে না এমন, সত্যি ? বিলকুল !
হোক মিথ্যা, অবাস্তব কল্পনা, মায়ার ভুল ||


--------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৮ নভেম্বর ২০১৫

বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৫

ফ্র্যাক্টাল

|| ফ্র্যাক্টাল ||


একটু আগে সন্ধ্যা হয়ে রাস্তায় বাতি জ্বলেছিল, শীত নেমে আসছিল | বাওয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে বেরিয়ে পার্কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম পৌষমেলার আলোয় আলো হয়ে আছে | গানের জলসা বসেছে | একটা উঁচু করে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে, উপরটা খোলা | তার উপর বসে কেউ খালি গলায় গান গাইছে | সামনে অনেক – প্রায় শ’ দুয়েক হবে – চেয়ার পাতা | ধবধবে সাদা রং করা বেতের চেয়ার | তাতে বসে মগ্ন  হয়ে গান শুনছে লোকে | সামনের সারি গুলোয় ভিড় এড়াতে, আমি পিছনের দিকে গিয়ে বসলাম | এই সারিটা প্রায় ফাঁকা | এই প্রান্তে কয়েকটা চেয়ার ছেড়ে এক পুরুষ আর মহিলার জুটি বসে | লোকটার পাশের দুটো জায়গা ছেড়ে বসলাম | বসতেই দু’জনে আমার দিকে তাকাল – পুরুষটা মাঝ বয়সী, কপালের উপর ব্যাক ব্রাশ করা চুল পাতলা হয়ে পিছিয়ে গেছে | মহিলাটা না সাদামাটা না সুশ্রী দেখতে যুবতী – চোখে চকিত হরিণের চোরা চাউনি | আমি মুখ সামনে ফিরিয়ে গান শোনায় মন দিলাম |

চুপচাপ দুজন হটাত মনে হল চাপা গলায় কিছু কথা কাটাকাটি করল | আমি কী কৌতূহলে ওদের দিকে তাকাতেই আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা উঠে দাঁড়ালো | সজোরে বলল, “চলো, তোমাকে বাসে তুলে দিই |” মেয়েটা উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার বসে পড়ল | কেন জানি না, আমার মনে হল আমার উপস্থিতি ওদের অন্তরঙ্গতায় কিছু ব্যাঘাত ঘটিয়েছে | ভাবলাম উঠে যাই, কিন্তু ততক্ষণে লোকটা সারিটার অন্য প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেছে | বসে থাকা লোকদের হাঁটুর সামনে জায়গা কম, তাই বেশি দূরে যেতে পারে নি | শুনলাম, বলতে বলতে এগোচ্ছে, “এক্সকিউস মি ! এক্সকিউস মি !”

তখনই মেয়েটা ডাকল, “শুনুন !” আমি অবাক হয়ে তাকালাম | মেয়েটার চোখে গভীর আবেদন | বলল, “যদি কিছু মনে না করেন, একটু আসবেন আমাদের পিছন পিছন |” এগিয়ে যাওয়া লোকটা এদিকে ফিরে ডাকল, “এসো ... এর পর আর বাস পাবে না |” মেয়েটা আমার দিকে থেকে মুখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে “আসছি” বলে গলা খাদে নামিয়ে বলল, “প্লিজ !” তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অনিচ্ছুক দেহভঙ্গিতে লোকটার পিছু নিলো | কিছু দূর গিয়েই আমার দিকে ফিরে তাকাল, খুব আকুতি মাখানো দৃষ্টিতে – বুঝলাম কোনও বিপদের আভাস পেয়েই আমার সাহায্য চাইছে | ওরা দুজনে সারিটার ওপর প্রান্ত থেকে বেরিয়ে গেলে আমি আমার প্রান্ত থেকে বেরিয়ে ওদের উপর চোখ রেখে এগলাম | আমাকেও তো বাস ধরতে হবে |

পার্কের বাইরে রাস্তাটা শূন্য | বাতির তলায় কুয়াশা নেমে আসছে | এদিক ওদিক এক আধটা কুকুরকুণ্ডলী | রিকশার হুড নামিয়ে আলোয়ান মুড়ি দিয়ে রিকশাওয়ালারা ঘুমচ্ছে | পার্ক থেকে ভেসে আসা গান বাতাসে ভারী কুয়াশায় বেধে গুলিয়ে যাচ্ছে | সামনের মোড়ে বড় রাস্তায় ডানদিক ঘুরলেই বাস স্ট্যান্ড | লোকটা আর মেয়েটা মোড়ে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল | লোকটা পিছন ফিরে তাকাল | তারপর মনে হয় আমাকে দেখে হনহন করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো |

আমার কাছাকাছি এসে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলল, “আপনি ? আবার ?”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, “আবার মানে ?”
- “মানে বুঝিয়ে বলতে হবে ? একটু আগে আপনি এসে আমাদের পাশে বসেছিলেন না ? এখন আবার পিছু নিয়েছেন | কেন ?”
-    “কোথায় পিছু নিলাম ?”
-    “এই যে আমাদের পাশে এসে বসলেন ... এখন আমাদের পিছন পিছন আসছেন | ভাবছেন আমি বুঝি না ? বারবার একই ব্যাপার হচ্ছে |”
-    “দেখুন, আপনি ভুল বুঝছেন | আমি বাস ধরতে যাচ্ছি | সামনেই আমার বাস স্ট্যান্ড |”

ঠিক তখনই গর্জন করে একটা বাস বেরিয়ে গেল | দেখলাম মেয়েটা সামনের রাস্তায় আর নেই | লোকটা চমকে পিছন ফিরে সেদিকে তাকিয়ে বলল, “যাহ ! আবার ... আবার সেই একই ব্যাপার হল |”

না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না, “কী ব্যাপার ? মাফ করবেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি বারবার ‘আবার’ বলছেন কেন ?”
লোকটা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, অনেকটা স্বগতোক্তির গলায়, “দেখলেন না, আপনার জন্য ও আবার চলে গেল |”
- “আমার জন্য ? কে ? আপনার সাথের ওই ভদ্রমহিলা ?”
- “হ্যাঁ |”
- “উনি কে ? যদি কিছু মনে না করেন |”
- “সেটাই তো জানি না |”
- “জানেন না ? তবে যে আপনারা একসাথে ...”

লোকটা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল | তারপর বোধহয় আশ্বস্ত হয়ে যে আমাকে বিশ্বাস করা যায়, জিজ্ঞাসা করল, “আপনি সত্যিই কিছু জানেন না ?” যেন কোন অলীকের সন্ধান পেতে চলেছি, বললাম, “কী জানব ? কী করেই বা জানব ? আমি তো আপনাকে বা ওনাকে আগে কখনও দেখি নি | ব্যাপারটা কী বলুন তো |”

লোকটা একটা সিগারেট বের করে জ্বালাল | দেশলাইয়ের আলোয় মুখটা দেখে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল | কোথাও দেখেছি | কবে ? কোথায় ? লোকটা একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে হাত তুলে পার্কের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “ক’বছর ধরে পৌষমেলার এই গানের জলসার দিন এই একই কাণ্ড ঘটছে |  এই দিন সকাল বেলায় মেয়েটা ফোন করে | চিনি না জানি না, অথচ নাম ধরে চেনা মানুষের মত বলে, ‘তাহলে, পৌষমেলায় গান শুনতে আসছেন তো ? আমিও আসছি, আটটা নাগাদ | শেষের সারিতে থাকব |’ আমি জানতে চাই, ‘তুমি কে ?’ ও বলে, ‘দেখবেন, পরনে অমুক রঙের শাড়ি, গায়ে তসুক রঙের শাল থাকবে | সন্ধ্যাবেলায় আসুন, পরিচয় দেব | বেশি দেরী করবেন না | আমি কিন্তু নটার বাস ধরে ফিরব | আপনি তুলে দেবেন |’ অগত্যা আমি আসি ; কয়েক বছর ধরে এই ভাবে আসছি | প্রত্যেক বারই কোন না কোন কারণে আমার আসতে দেরী হয়, প্রায় নটা বেজে যায় | ও আগেই এসে বসে থাকে | আজকাল মুখ চিনতে কষ্ট হয় না | আমি ওর পাশে বসে  যেই জানতে চাই, ‘কে তুমি ?’ ও বলে, ‘বলব, বলব | যখন বাসে তুলে দিতে যাবেন, বলব ... দেরী করে এসেছেন, এখন চুপ করে গান শুনুন |” একটু পরেই কোন এক অচেনা লোক এসে আমাদের কাছে বসে, যেমন আজ আপনি এসে বসলেন | লোকটা এলেই ও যেন একটু অস্বস্তি বোধ করে | আমিও তখন ঘড়িতে দেখি প্রায় নটা বাজে, আর বলি, ‘চলো, এবার তোমাকে বাসে তুলে দেব | যেতে যেতে বোলো তুমি কে |’ আমরা উঠি, আর অচেনা লোকটাও উঠে আমাদের পিছু নেয় | তাই দেখে আমার রাগ হয়, মুখোমুখি হয়ে লোকটাকে চেপে ধরি, জানতে চাই লোকটা কী চায় | আমাদের কথা কাটাকাটির মধ্যে মেয়েটার বাস এসে পড়ে, আর ও উঠে চলে যায় | ওকে আর দেখি না | আবার এক বছর ধরে অপেক্ষা করি, কিন্তু প্রতি বছর একই ব্যাপার হয় !”

আমি কিছুটা অবিশ্বাস্য ভাবে বললাম, “কিন্তু আমি তো এই প্রথম আপনাদের দেখলাম |” লোকটা বলল, “হ্যাঁ, প্রত্যেক বছরই আলাদা লোক দেখি | কিন্তু অচেনা লোক পাশে এসে বসলেই ও বলে, যেমন এবার আপনি এলে বলল, “এই রে ! আবার সেই লোকটা ! শিগগির উঠুন | আমাকে বাসে তুলে দিন, আমি পালাই | নইলে বিপদ |”
- “কিসের বিপদ ?”
- “ঠিক জানি না | সেটাই তো জানবার কোন সুযোগ পাই নি আজ অব্দি |”

আমি একটু ভেবে বললাম, “আপনি কি গত বছর আমাকে দেখেছিলেন ?”
লোকটা বলল, “না, না | গত বছর যিনি এসে আমার পাশে বসেছিলেন, তিনি তো আলাপ করে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন | গুজরাটি সম্ভবত, নামটা মনে নেই | বিদেশ থেকে কদিনের জন্য এসেছিলেন, কোনও সেমিনারে অংশ নিতে | সামনেই বাওয়ারিং ইন্সটিটিউটে উঠেছিলেন |”

লোকটার কথায় গত বছরের কথা মনে পড়ে চমকে উঠলাম | সে’ বছর ঠিক এই সময় কলেজের বন্ধু আহমেদাবাদের নাগা (নাগামুনেন্দ্র) এসেছিল | বাওয়ারিং ইন্সটিটিউটে উঠে আমায় ফোন করেছিল | এসেছিল ফ্র্যাক্টালের উপর কী একটা সেমিনার এ যোগ দিতে | আমাকে বোঝাতে পারে নি ফ্র্যাক্টাল ব্যাপারটা কী | বলেছিল, ‘পঞ্চতন্ত্রে মনে আছে, গল্পের ভিতর গল্প, তার ভিতরে গল্প ?’ কিছুটা সেই রকম ব্যাপার | তবে ফ্র্যাক্টালের যত ভিতরেই যাবি, দেখবি ভিতর ভিতর গল্পটা একই |’

ওর সাথে গল্প করতে করতে দেখছিলাম ওর টেবিলে রাখা একটা খুব চকচকে রঙচঙে গোল ফিতে | আমার দৃষ্টি লক্ষ্য করে নাগা বলেছিল ‘এই রকম মবিয়াস স্ট্রিপ দেখেছিস ? এক পার্টি সেমিনারে এই মবিয়াস স্ট্রিপ বিলি করছে |’ কলেজে সাদা কাগজের ফালিতে এক পিঠে সাইড-এ, অন্য পিঠে সাইড-বি লিখে প্রান্ত দুটো জোড়া দিয়ে জিনিসটা বানিয়েছি | কিন্তু এত রঙচঙে কখনও দেখিনি | হাতে নিয়ে দেখলাম ওটা প্লাস্টিকের | রংটা ক্রমাগত সবুজ থেকে হলুদ হয়ে আবার সবুজ হয়ে গেছে | তাতে চৌকো ছোপ কাটা বিপরীত রঙের – সবুজে হলুদ আর হলুদে সবুজ | কোথাও জোড়া দেখা যাচ্ছে না | ওটা হাতে নিয়ে হরিনামের মালার মত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে পড়লাম | সেটা লক্ষ্য করে নাগা বলল, “এই, বেশি ঘাঁটিস না – দেখবি এক পিঠ থেকে অন্য পিঠে যেতে যেতে আসল থেকে অলীক জগতে পৌঁছে যাবি |”

সন্ধ্যা নামলে উঠে পড়ে নাগাকে বলেছিলাম, “শোন, সামনে পার্কে পৌষমেলা হচ্ছে | এখন গানের জলসা আছে | যাবি ? তারপর কোথাও একসাথে ডিনার করা যাবে |”

ও আশ্চর্য ভাবে তাকিয়ে, মাথা নেড়ে বলেছিল, “আমি হয়ত যাব, তবে তোর সাথে নয় |”
- “মানে ?”
- “রহস্যময় ব্যাপার ! আমি সিঙ্গাপুর থেকে কদিনের জন্য এসেছি ; এখানে কেউ আমায় চেনে না | আর, এক মহিলা আজ সকালে আমাকে ফোন করে জলসাটার কথা বলছে, যেন আমাকে চেনে | ওই ভাবেই জিজ্ঞাসা করেছে,  ‘যাবে ? আমি যাব আটটা নাগাদ |’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কে ? চিনব কী করে ?’ বলল, ‘এসো না, আবার না হয় পরিচয় দেব | শেষের দিকের সারিতে থাকব | দেখবে লাল সিল্কের শাড়ি আর গায়ে ক্রিম রঙের শাল, চুলে পনীটেইল বাঁধা মবিয়াস স্ট্রিপে |’ তখন বুঝলাম মহিলাটি সেমিনারে এসেছে | হয়ত কাল বুফ্যে লাঞ্চ করার সময় ছিল, কেউ আলাপ করিয়েছিল |”
- “তুই যাবি তাহলে ?”
- “এখনও জানি না | ভাবছি, কে না কে অচেনা মহিলা !”


-------------
ফুটনোট :
ফ্র্যাক্টাল: এক বিশেষ জ্যামিতিক রেখা বা আকার যার প্রতি অংশে ও সমগ্রতায় একই পরিসংখ্যাত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, ও যার প্রতি ক্রমাগত ক্ষুদ্রতর অংশে নিম্নতর মানে সদৃশ আকার দেখা যায় |
(Fractal (Mathematics) noun: A curve or geometrical figure, each part of which has the same statistical character as the whole, in which similar patterns recur at progressively smaller scales.)

------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৪ নভেম্বর ২০১৫