শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬

দেখা

|| দেখা ||


স্টাফ-রুমে  ঢুকে বুকে চেপে ধরা বইগুলো নামিয়ে চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে নীতা দেখল বড় টেবিলটার এক কোনে দীপা চুপ করে বসে আছে | সামনে একটা খোলা খাতা, হাতে ধরা কলম, কিন্তু শরীরের নিস্তেজ ভঙ্গি দেখে মনে হল ওর মন ওই দুটোর মধ্যে নেই | নীতা চেয়ার টানলে একটু আওয়াজ হল, কিন্তু দীপা ধ্যানস্থ হয়েই বসে রইল, নড়ল না, তাকাল না | নীতা বসে পড়ে বলল, “এই, কী হয়েছে তোর ?” একটু পরে মাথাটা খুব আস্তে ঘুরিয়ে দীপা বলল, “হরষে-বিষাদ কথাটার মানে কী জানিস ?” নীতা বলল, “হরষে-বিষাদ . . . আমি তো জানি হরিষে বিষাদ . . . যাকগে, হটাত এই কথাটার মানে কেন জিজ্ঞাসা করছিস ? কিছু হয়েছে ? তোর মেয়ে কেমন আছে ?”

উত্তর না দিয়ে দীপা মাথা নামিয়ে খোলা খাতায় একটা টিক দিল, তারপর পাতা ওলটাল | নীতা উঠে গিয়ে দীপার পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলল, “কিছু বলবি না ?” দীপা মুখটা তুলে একটু হাসল – ম্লান হাসি, যেমন মেঘলা দিনে চর জেগে ওঠা গাঙের বুকে দূরের জল চিকচিক করে ওঠে কোন অদৃশ্য সূর্যের ছটায় | তারপর পাশের চেয়ারটা টেনে বলল, “কাছে বোস, বলছি |” নীতা বসলে দীপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল -

কাল রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি | দেখেছি ওর সাথে কোথাও বেড়াতে গিয়েছি | আমরা একটা হোটেলে উঠেছি | তার চারিদিকে ঢালাও খোলামেলা প্রকৃতি, হাতছানি দিচ্ছে বেড়াতে যাওয়ার জন্য | কী সুন্দর সিন্যরী ! আমরা লবিতে বসে দেখছি, আর ভাবছি কখন বেরব | আমি ওয়াশরুমে গেলাম | ওয়াশরুমেও বড় বড় জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে | তখন দেখি ওয়াশরুমের পিছন দিকে একটা দরজা | কী কৌতূহলে দরজাটা খুললাম | পিছনে চারিদিক একেবারে গাছে গাছে ঢাকা, সবুজে সবুজ, মুগ্ধ করে দেয়ার মত | আর ওই দরজা থেকে একটা পায়ে হাঁটা পথ তার মধ্যে চলে গেছে | আমি ওর কথা ভুলে গেলাম, কোথায় আমি, কী করছিলাম সব ভুলে গেলাম | সব ভুলে গিয়ে ওই পথ ধরে রওনা দিলাম, যেন আমি জানি কোথায় যেতে হবে | কী সুন্দর, কী পরিষ্কার চারিদিক, কোথাও কোন আগাছা নেই, নিচে সবুজ ঘাসে একটা ময়লা, একটা খড়-কাঠি, একটা কুটো, কি একটা শুকনো পাতা নেই, চারিদিক শুধু সবুজ পাতা ছাওয়া বড় বড় গাছ | এইভাবে বাইরেটা আমাকে সব ভুলিয়ে দিয়ে টেনে নিয়ে চলল | কিসের টানে যে আমি কোন ভয় না করে এগিয়ে গেলাম তা আমি জানি না | কতদূর চলে গিয়েছি এই ভাবে হুঁশ হারিয়ে | তারপর দেখলাম গাছগুলো একটু ফাঁকা হচ্ছে, মাঝখানে বেশ খানিকটা পরিষ্কার জায়গা, যেন কেউ ওই ভাবে জায়গাটা তৈরি করেছে | গাছগুলো যত্ন করে সাজানো, নিচে কেয়ারি-করা ফুলবাগান  আর সমান করে ছাঁটা ঘাস, তার মধ্যে একটা বসার বেঞ্চ | বুঝলাম আমি কোন পার্কে পৌঁছেছি | সেই বেঞ্চে একটা বউ বসে, আর তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একজন হাবভাব ভঙ্গিতে বয়স্ক লোক, যে কোন কারণে বউটার থেকে সরে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে – যাকে সে সাথে করে নিয়ে এসেছে, কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না, অপেক্ষা করছে কখন সে ফিরে যেতে চাইবে | লোকটার মুখটা দেখতে না পেলেও বুঝলাম লোকটা মনের দৃষ্টিতে বউটার দিকে তাকিয়ে আছে, সেই দৃষ্টিতে একসাথে বিস্ময়, কৌতূহল, অপেক্ষা, আকাঙ্ক্ষা সব মিশে আছে | দুজনেই চুপ |

আমি কাছে যেতেই বউটা আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আর উঠে দাঁড়াল | অল্প বয়েস | লম্বা, সুঠাম, সুন্দর চেহারা | গায়ের রঙ ফর্সা নয় ময়লা, কিন্তু মুখের আদল অপূর্ব সুন্দর – যেন তার সব কটা বৈশিষ্ট্য কোন শিল্পীর খুব যত্ন করা হাতে ছেনি দিয়ে ছিলা-কাটা | মাথা ভরা কোঁকড়ানো চুল কাঁধ ছাপিয়ে উপচে পড়ছে | আর কী শান্ত চোখের দৃষ্টি, কত সৌম্য মুখের ভাব | আমি এমন সুন্দরী আর একজন দেখি নি | আমি ওকে দুচোখ ভরে দেখছি দেখে ও একটু হাসল | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “সুখবরটা পেয়েছেন তো ?” ও মাথা নাড়ল, যেন খবরটা কেউ না বললেও
ওর জানা | আমি বললাম, “আপনি খুশি ?” ও বলল, “আমি খুউব খুশি |” আমি বললাম, “আপনার ছেলে আপনাকে মিষ্টিও পাঠাবে |” ও বলল, “পাঠাবে ? আমি মিষ্টি পাবো ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ পাবেন, ও নিশ্চয় পাঠাবে |” ও বলল, “তবে তুমি ওকে বোলো দুটোর বেশি নয় |”

ওর কথা শুনতে শুনতে আমি চোখ ফেরাতেই পারছি না | এত সুন্দর মুখশ্রী, আর তাতে এত আনন্দ | কিন্তু এই শেষ কথাটা বলতে গিয়ে ওর মুখে একটা ছায়া পড়ল | ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি যাচ্ছেন তো ?” আমি বললাম, “আমি যাব, খুব শিগগিরই যাব | আপনি যাবেন না ?” ও বলল, “আমিও যাব |”

আমার হটাত মনে হল, এর টানেই কি আমি সব ভুলে ছুটে এসেছি | না হলে, আমি কেন ওর  মুখ থেকে আমার দৃষ্টি সরাতে পারছি না ? আমি কি ওকে আগে কখনও না দেখে থাকলেও সেই মুহূর্তে চিনেছিলাম ? এই সব প্রশ্নের চিন্তায় আমি একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম হয়ত, হয়ত আমার দৃষ্টিটা এক মুহূর্তের জন্য আবছা হয়েছিল | আবার দৃষ্টি স্পষ্ট হলে দেখলাম দুজনে নেই | আমি তখন ওই পথেই তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে এলাম |

দীপার বলা শেষ হলে নীতা জিজ্ঞাসা করল, “তুই কবে যাচ্ছিস মেয়ের কাছে ?”
দীপা, “এখনও দেরী আছে |”
নীতা, “ডেট কবে দিয়েছে ?”
দীপা, “বলছে তো এক্সপেক্টেড ডেলিভারি আশ্বিনের মাঝামাঝি, তবে এক আধ সপ্তাহ আগেও হতে পারে |”
নীতা, “তুই তোর মেয়েকে স্বপ্নটার কথা বলবি ?”
দীপা, “কী বলব ? যে ওর শাশুড়িকে স্বপ্নে দেখেছি | ওনাকে তো আমি দেখিই নি | শুনেছি, উনি আমার জামাইকে জন্ম দিয়ে মারা যান |”
নীতা, “তবে কী করে মনে করছিস যে ওটা তোর বেয়ান ছিল ?”
দীপা, “কে জানে, হয়ত ওই জামাইয়ের মত কোঁকড়া চুল, ওর হাসি, ওরই গায়ের রঙ . . . জানি না রে . . . বা, হয়ত ওর কাছে যে বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে ছিল সে আমার বেয়াই ছিল | সেই রকমই লাগছিল তার দেহভঙ্গি দেখে |”

এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে নীতা আবার দীপাকে স্টাফ-রুমে একা পেয়ে বলল, “কেমন আছে তোর মেয়ে ?”
দীপা, “ভালো আছে | এই তো স্কুলে আসার আগে ফোনে কথা হল |”
নীতা, “কিছু মনে করিস না . . . জিজ্ঞাসা করছি  . . . তোর সেই স্বপ্নের কথাটা তুই মেয়েকে বলেছিস ?”
দীপা, “হ্যাঁ বলেছি | আমার বরও আমাকে চাপ দিচ্ছিল | ক’দিন আগে মেয়েকে বললাম | বললাম, জামাইকে বলিস | ও বলল, ওকে ফোনটা দিচ্ছি, তুমি নিজের মুখে বল | জামাইকে বললাম | শুনে জামাই একটু চুপ করে থেকে বলল, মা, আপনি বাবাকে একটু বলবেন এই কথা ? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কিছু মনে করবেন না তো ? ও বলল, না | আমি বললাম, কিন্তু বলার দরকার আছে কি ? জামাই বলল, আপনি বলে দেখুন, বাবা হয়ত কিছু বলতে পারে |”
নীতা, “তুই বললি, তোর বেয়াই কে |”
দীপা বলল, “আমি বলি নি | আমার বর বলেছে | পরে বড় আমাকে বলল, স্বপ্নের কথা শুনে বেয়াই নাকি একদম চুপ করে গেলেন | তারপর ফোনটা ছেড়ে দিলেন আর কোনও কথা না বলে |”
নীতা, “আশ্চর্য তো !”
দীপা, “আশ্চর্য নয় | বা বলতেও পারিস . . . | কাল মেয়ের কাছে শুনলাম, জামাই ওকে বলেছে, প্রথম দুই মেয়ের জন্ম দেয়ার পর আমার বেয়ানের শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়, ডায়াবেটিসে ধরে | এইটুকু আমিও জানতাম | জানতাম না যে ওনার শ্বশুর চাইছিলেন নাতি | কিন্তু বেয়ান আর সন্তান চাইছিলেন না | শ্বশুরের শখ পূর্ণ করে দিয়ে আমার বেয়ান আর বেশি দিন বাঁচেন নি |”

দুজনেই চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ | তারপর দীপা বলল, “আর জানিস, আমি ভেবেছিলাম স্বপ্নে উনি মিষ্টির কথা বলছিলেন . . . যখন বললেন, ‘তবে তুমি ওকে বোলো দুটোর বেশি নয় |’ ”


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩০ এপ্রিল ২০১৬

রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৬

মেনি বিড়াল

|| মেনি বিড়াল ||


আমার বিছানায় জুটেছে এক বিড়াল
বড় দুর্বিনীত, অসভ্য তার আচরণ
শোনে না কোন কথা, আমায় চাটে
না আগে, না পরে করে আচমন
গায়ে হাত বুললে লেজ খাড়া করে
কষে পিঠ বেঁকিয়ে রুঠে সে দাঁড়ায়
চোখ সরিয়ে নিলে এসে গা ঘষে
ককিয়ে প্রেম, করে পাড়া মাথায়
তার ব্যবহারে সে মনে করায় কিছু
তোমার সঙ্গর ছোট বিস্মৃত কথা
কাছে থেকে তুমি হলে না গা-লাগা
চলে গেছ, সারা গায়ে এখন ব্যথা
ওর সাথে তোমার একটাই তফাৎ
মনে হয় ওর আমি ছাড়া কেউ নেই
তোমার স্তাবক মেনি হুলো বিড়াল
ইংরেজির মেনি মানে জানতোই !


--------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৭ এপ্রিল ২০১৬

শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৬

বুকা

|| বুকা ||


ভেবেছিলাম কথাগুলো কী ভাবে গুছিয়ে লিখব | কতদিন আগেকার কথা | আমার কী না কী মনে আছে | তোমাকে বললে তুমিই কি মনে করতে পারবে ? আর, কী ভাবেই বা বলব ? কেটে গেল সাতাশ থেকে সাতান্ন – তোমার খোঁজ নিতে আজ অব্দি কাছে যেতে পারি নি | কেন, সে কথা এখন থাক ... বা, একটু পরে না হয় !

আমি শুধু একটা প্রশ্ন করতে তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম – ওই কোকিলটা কোথা থেকে এলো ? আর এলো তো এলো, আমাকে ছাড়ে না কেন ? জানো, বছরের বড় জোর এক দু’ মাস – শ্রাবণে তুমুল বর্ষা নামার পর থেকে হেমন্তের শেষ অব্দি শুধু – কোকিলটা থাকে না | তারপর একদিন হঠাত এক ছিমছাম অমল সকালে শুনি তার হালকা গলায় প্রথম সংশয়ী কূ ডাক | ওই ডাক এক মূহুর্তে আমার মাস দুয়েকের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ভাঙিয়ে দিয়ে আমাকে সচকিত করে দেয় | ডেকেই একটু পরে ও আবার ডাকে, যেন আস্কারা চেয়ে ; আবার ডাকে একটু পরে | ক্রমশ ওর ডাক জোরালো হয়, ওর যে কী জেদই চাপে, আর ওর ডাকের লয় কত যে দ্রুততর হয় | শেষে গলাটা সপ্তমে তুলে চমকে উঠে ও ডাক থামিয়ে দেয় | কিছুক্ষণ পরে, যেন বুকে দম ভরে নিয়ে, ও আবার ফিরে ডাকে | ওর ওই ডাকের ওঠা নামা, ওর আসা যাওয়ার টানা পোড়েন আমাকে টেনে নিয়ে যায় এক অপার সময় সমুদ্রের কিনারে |

মনে পড়ে যায় পিয়ারুল, প্রত্যেক বার নতুন করে | নামটা কী মিষ্টি | বাবা সেবার বলেছিল আমরা গরম পড়লে পিয়ারুলে বেড়াতে যাব | সেখানে নাকি যে দিকেই তাকাও শুধু শাল গাছ | তখন কেন জানি আমার বুক ঢিপঢিপ করে উঠেছিল হটাত | সেই বয়সটায় আমার ওইরকমই হত হয়ত | ক’দিন আমার সবকিছু কেমন টানটান হয়ে উঠেছিল এক উৎসুক কাতরতায় | আর, বেশ কয়েক রাত আমি স্বপ্ন দেখছিলাম যে আমার মাথার উপর শালের মঞ্জরী, তার মাঝে কেউ লুকিয়ে আছে | আমি যেন জানি যে সে গাছের ডালে, পাতার ফাঁকে কোথাও লুকিয়ে আছে | কিন্তু মাথা তুলে দেখতে সাহস পাচ্ছি না, যদি সে পালিয়ে যায়, মাথায় মঞ্জরী খসিয়ে |

প্রথম দিন তুমি এলে, আর ছোট পিসি তোমার পরিচয় দিয়ে আমায় আভাস দিল যে তুমি আমার চেয়ে বড় | হয়ত ছিলে | মাথায় তো ছিলে, কিন্তু চোখ দেখে মনে হল না | তোমার চোখে দেখলাম একটা লুকানো কিছুর রহস্যময় বিহ্বলতা, যেমন লক্ষ্মী ট্যারার দৃষ্টিতে হয়, যেন তুমি এমন কিছু দেখে নিয়েছ যা চাও না আর কেউ দেখুক | আমার প্রথমেই ভয় হল তুমি আমাকে সরল মনে নেবে না | আমাকে নেয়ার কথা কেন ভেবেছিলাম তা মনে নেই | তবে ছোটবেলায় আমার একটা ভয় ছিল আমাকে ভালো কেউ নেবে না | আসলে মা আমাকে ছোটবেলা থেকে শাসন করার বদলে ভয় দেখিয়ে বলত, তোকে ভালো কেউ নেবে না | কিন্তু, তা তো হল না | দু’দিনেই – আমার ঠিক মত ভাবও হয় নি – তুমি এসে পিসিকে বললে, রবার্টসন সাহেবের বাড়িতে নাকি একটা সাদা ময়ূর এসেছে – সে ভারী সুন্দর, আর আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি সাদা ময়ূর দেখেছি কিনা | আমি দ্বিধায় মাথা নেড়েছিলাম | ভয় ছিল সত্যি বললে যদি কিছু হয়, যদি তুমি আমার কথা অবিশ্বাস করো | আমি যে চাইছিলাম তোমার সাথে যেতে | কোথাও |

পরদিন আমি পিসিকে বলে তোমার সাথে গেলাম সাদা ময়ূর দেখতে | মেম-ঝিলের পাশ দিয়ে সাতটা কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচ দিয়ে কত দূরে আমার চলে গেলাম | আমরা কোন কথা বলি নি | তুমি আমাকে মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছিলে | শুধু একবার আমাকে তুমি বললে, “হারিয়ে গেলে একা ফিরতে পারবি ?” আমি মাথা নেড়েছিলাম | শীলঘাটা হলে অন্য কথা ছিল | ওখানে অনেক রিকশাওয়ালা আমাদের বাড়ির সবাইকে চেনে | কিন্তু পিয়ারুলের রিকশাওয়ালারা তো সব অচেনা | ওদের সাঁওতাল হাসি আমি বুঝতাম না | সারাদিন অলস বসে থাকত, আধো স্বরে কথা বলত, আর ঝকঝকে
সাদা দাঁত বের করে হেসে থুতু ফেলে আবার হাসত | মনে হত না ওরা কোনও কাজের লোক | হয়ত রিক্সায় উঠলে আধপথ নিয়ে যাবে | পরদিন পিসির বাড়ি এসে তুমি দেখবে আমি নেই | আর রিকশাওয়ালাদের জিজ্ঞাসা করলে ওরা থুতু ফেলে হাসবে |

তো, সেই লাল ইটের দেয়ালে ঘেরা বাংলোর উঠোনে আমি দেখলাম সাদা ময়ূরটা, দিব্যি দর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে | আমার কেন জানি না ঠিক ভালো লাগেনি | আমার বেশি ভালো লেগেছিল, পিছু টানছিল মেম-ঝিল, লেক ঘিরে কৃষ্ণচূড়ার সাতনরী – তুমি বলেছিলে কথাটা, ভুল বলেছিলে | আর, ভালো লেগেছিল বুকা মাহাতোর শালের বাগানের ভিতর দিয়ে শর্টকাট | শর্টকাট কথাটা সেই প্রথম তোমার কাছে শুনেছিলাম |

আমি কি তখন জানি যে ওই বুকা মাহাতোর শালের বাগান আর থাকবে না | আর তার কোকিলটা – ওখানেই আমি প্রথম যার ডাক শুনেছিলাম – আমার চেতনায় ঠাঁই নেবে | একই কোকিল, না অন্য কোন ? কোকিল ক’বছরই বা বাঁচে ?

ন’বার যখন তুমি আমায় নিয়ে যাচ্ছিলে রবার্টসন সাহেবের বাড়ি, ওই বুকা মাহাতোর শালের বাগানে হঠাত শুনলাম সর্বাঙ্গ শিউরে দেয়া একটা মায়াডাক | আমি চমকে উঠে উপরে তাকালাম উৎসটা দেখার জন্য | সোজা সোজা উঠে যাওয়া ঋজু শালের গুঁড়ির মাথায় অনচ্ছ সবুজ ছাউনির আকাশ | আমি তাকিয়ে রইলাম বুকের ঢিপঢিপ চেপে | তুমি আমার হাত ধরে টেনে বললে, চল, কিছু দেখতে পাবি না | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ও কে ডাকল ? তুমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, সে কী, তুই জানিস না ওটা কোকিল ? আমি জানতাম না | তাই বললাম, আমি কোকিল দেখব | তুমি বললে, আচ্ছা, ফেরার পথে দেখিস |

ফেরার পথে তুমি আমাকে নিয়ে শাল বাগানে দাঁড়ালে, আর বললে চুপ করে থাকতে | চুপ করেই ছিলাম, হটাত পায়ের কাছে জমিতে পড়া শুকনো শালপাতার মধ্যে থেকে সরসর করে একটা শব্দ হল | আমি ভয় পেয়ে তোমার গা ঘেঁসে দাঁড়ালাম | তুমি আমাকে টেনে তোমার গায়ে এক করে চুপ করে থাকলে | সে কতক্ষণ ! তারপর তুমি আমাকে দেখালে দূরে একটা বাদামী হলুদ সাপ | তার সারা শরীরের উপর কালো কালো ছাপ | আর, পিঠের উপর দিয়ে দুটো হলুদ ডোরা চলে গেছে লেজ অব্দি | আমাকে বললে, ওই দেখ, সাপটা চলে যাচ্ছে | চল এবার বাড়ি যাই | আমি তখন তোমার স্পর্শে, শাল মঞ্জরীর গন্ধে, বৈশাখের উত্তাপে আড়ষ্ট |  তোমার মা হতে তৈরি বুকে আমার মাথাটা মিশে যেতে দেখে তুমি চাপা এক হাসিতে হিলহিল করে উঠে বললে, এই ঢোঁড়া সাপ ! তুইও কি ঢোঁড়া সাপ ? তুই এমন চুপ করে গেছিস কেন ?

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, তুমি কি কোকিল দেখাবে না ? তুমি বললে, সেই লুকানো কিছুর অদ্ভুত আলো আঁধার ভরা মায়াচোখ নাচিয়ে, বুকা, জানিস না, কোকিল এমনি দেখা দেয় না | কোকিলের ডাক শুনতে পাবি, দেখা পাবি না |

কথাটা ঠিক তাই হল | আমি কত বনে জঙ্গলে যে ঘুরেছি – আম কাঁঠালের গাছে ঠাসা বাগানে গিয়ে বসে থেকেছি, কখনও কখনও হাতে ক্যামেরা নিয়ে | না | ছবির বইয়ে কোকিলের ছবি দেখেছি | অথচ, আমার কোকিলটা আমার সাথে থেকেছে, দেখা দেয় নি | তাই সন্দেহ হয়, কোকিলটা কি সত্যি | নাকি এটা আমার একটা ভ্রম | আমি যে মাঝে মাঝে ওর ওই নিঃসঙ্গ ডাক সহ্য করতে পারি না |

কী করতে পারতাম ? আবার পিয়ারুল যেতাম ? তোমাকে বলতাম ? তোমাকে বললে কি তুমি দেখিয়ে দিতে ? আমার কোকিলটাকে আমার থেকে আলাদা করে দিতে পারতে ? কিন্তু তাই বা কী করে হত | কোকিলটা তো এলো আরও ষোল বছর পরে, আমার সাতাশ পার হতেই |

সে দিন থেকে জীবনের এই রোগ লক্ষণ শুরু, সে কবেকার কথা | আমার আঠাশতম জন্মদিন ছিল সেটা | বন্ধুদের সাথে পুরী বেড়াতে গিয়ে হোটেল থেকে মাকে ফোন করেছিলাম | ফোনটা তোলার ঠিক আগে শুনলাম জানালার বাইরে ভুলে যাওয়া পিয়ারুলের কোকিলের ডাক | মনে পড়ে না পিয়ারুলের পরে এর আগে কখনও আমি কোকিলের ডাক শুনেছি | তাই মনে হয় সেইদিনই ওই কোকিলটা আমার সঙ্গ নিলো | সেই ডাকটা ছিল তীক্ষ্ণ আর আর্ত – যে ভাবে ভূমিকম্পের সময় মায়ের শঙ্খধ্বনিতে বাজতে শুনেছি – যেন কোকিলটা বলতে চাইল আমার দুঃসময় আগত |

কিন্তু, ফোনে আমার মৌখিক প্রণাম নিয়েই মা বলল, ভালো খবর আছে, তোর জন্য একটা মেয়ে খুব পছন্দ হয়েছে | খুব স্মার্ট আর ফর্সা | তুই কবে দেখতে আসবি বল | আমি একদম ছুটি পাই নি সে বছর | তাই আভাকে দেখতে গেলাম প্রায় এক বছর পরে | আমার বিপরীত, অসম্ভব সপ্রতিভ | এর পর ওকে দেখলাম বিয়ের রাত্রে | আমাদের ফাল্গুন মাসে বিয়ে হয়েছিল | বিয়ের লগ্ন ছিল গভীর রাতে | বিয়ের মন্ত্র পড়ব কি, কাছেই কোথাও কোকিলটা এসে জুড়ে বসল, আর ক্রমাগত ককিয়ে ডেকে গেল | কী বুক ভাঙ্গা সেই ডাক |

বাসর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, আভাও আমার পাশে পিঠে বালিশ দিয়ে ওর খোঁপায় ভারী মাথা আমার কাঁধে রেখে চোখের পাতা নামাল | কোকিলটা আবার ভর করল, পাগল করল ডেকে ডেকে | একবার ভাবলাম উঠে গিয়ে দেখি | কিন্তু আমি তো ইতিমধ্যে আভার সাথে গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়ে গেছি |

ফুলশয্যার রাত্রে আভাকে প্রথম দেখলাম ঠিক করে | বা বলা যায়, প্রথম সবার থেকে আলাদা করে | আমি ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিতেই কোকিলটার ডাক শুনলাম | একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম কিনা জানি না | আভার চন্দনে সাজানো অসম্ভব ফর্সা মুখে মনে হল কিছুর একটা ছায়া পড়ল | বলল, কখন থেকে ওই কোকিলটা বড্ড বিরক্ত করছে ডেকে ডেকে | এই জানালার বাইরেই কোথাও আছে | বন্ধ করে দিই ? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ও উঠে জানালটা বন্ধ করে দিল | আমি ক্লান্ত ছিলাম | বিছানায় গা এলিয়ে বালিশে মাথা ফেললাম | আভা পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে শাড়ির খসখস, চুড়ি বালার রিনরিন আর পান খাওয়া মুখের গোলাপজলের গন্ধের জাল ফেলে আমাকে ঘিরে ফেলে জিজ্ঞাসা করল, ঘুম পেয়েছে ? আমি বললাম, একটু | ও খুব হালকা ঠাট্টার গলায় জিজ্ঞাসা করল, আর ফুলশয্যার আদর ? পাচ্ছে না ?

তার কথা আগে ভাবি নি, বা ভেবে থাকলেও সেই মূহুর্তে মাথায় আসে নি, হয়ত ক্লান্তিতে | কী উত্তর দেব ভাবার আগেই আভা মুখটা নামিয়ে নিয়ে এলো | নিশিবাতির স্নিগ্ধ আভায় উদ্ভাসিত বিছানাটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো বহ্নিশিখায় | আর সেই রাত, সারা রাত, একটা সাদা ময়ূর আমাকে ঠুকরে ঠুকরে খেল | নিজেকে মনে হল আমি এক নির্জীব সাপ হয়ে পড়ে আছি ওই সাদা ময়ূরের ধারালো চঞ্চু আর নখের নিচে |

আশ্চর্য হলাম না মোটেই, যখন খুব শিগগিরই আভা ধরে ফেলল যে আমি প্রায় সারা বছর, দিনরাত কোকিলের ডাক শুনি | ধরে ফেলল, কেন না ডাকটা শুনলেই আমি ব্যাকুল হয়ে আমার স্মৃতিতে বুকা মাহাতোর শালের বাগানে ফিরে যাই | তখন আমার চোখের মণিতে তাকালে দেখা যাবে আকাশভেদী শাল গাছের গুঁড়ি, আর তার উপরে ছাওয়া সবুজ শালের পাতা – যার মাঝে কোকিলটা লুকিয়ে | আভা মাকে কিছু জানালো না | আভা কাউকে কিছু বলার মত মানুষ নয় | ও চুপচাপ কাজ করার মানুষ | তাই ও সাদা ময়ূরটাকে বাগ মানাতে শুরু করল | বুনো ময়ূরটা কী ভাবে ওর যে বশ হয়ে গেল জানি না | কিন্তু তিন পক্ষের খেলা ঘোর হয়ে উঠল | কোকিলটা, একটা সাদা ময়ূর আর আমি, এক নির্জীব ঢোঁড়া সাপ | বশ মানানো ময়ূর বড় ভয়ঙ্কর হতে পারে, বড় হিংস্র হয়ে খেলাতে পারে তার শিকারকে | সেই খেলায় যেন সাপটাও আমার থেকে আলাদা হয়ে ক্রমে ক্রমে পাকা সেয়ানা হয়ে উঠল | রোজ রাতে যখন কোকিলটা ডাকে, আভা সংসারের কাজ গুছিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে জানালাটা বন্ধ করে | তারপর নীল নিশিবাতিটা জ্বেলে রূপ বদলে সাদা ময়ূর হয়ে ঘনিয়ে আসে পরিশ্রমের বিছানায় | সাপটা তার উপর চোখ বুজে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে আছে | জানে ময়ূরটা এসে নখর নখে তাকে ধরে, নামিয়ে আনবে তার শরীরের উপর দুই ধারালো চঞ্চু | তারপর সেই চঞ্চু একটু একটু করে সাপটার খোলস ছাড়াবে | চাপা শীৎকারের সাথে সাথে ছটফট করে সাপটার শরীর ছিঁড়ে ফালাফালা করবে | বাইরে কোকিলটাকে বোবা করে রাত গভীর হবে | তারপর ময়ূরটা, প্রোথিত বিমথিত ময়ূরটা, এক জৈবিক নির্যাস নিকষিত করে নেতিয়ে নিজের মসৃণ মসলিন আবরণে ঢুকে পড়বে | সাপটা তার ফালি ফালি শরীরটা জড়ো করে একটা জামায় পুরে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে, ধুঁকবে | তখন কোকিলটা আবার ডাকবে, জানাবে, ও জেগে থেকেছে, সব শেষ হতে দেয় নি | চাঁদের আলো মেঘের আড়াল থেকে সাবধানে উঁকি মেরে পরিস্থিতি সহজ দেখে লাফ দিয়ে বেরিয়ে স্বস্তির হাসি হেসে চারিদিক আলো করবে | গাছের পাতায় শিরশির করে হাওয়া বলবে, ভোর হতে চলল | সেই খুশিতে কোকিলটা চঞ্চল হয়ে আবার ডাকবে | সাপটা বুকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বুকা মাহাতোর শাল বাগানে ফিরে যাবে |

এই ভাবেই আমি রোজ ঘুমিয়ে পড়েছি বছরের পর বছর | আর চেয়েছি বার্ধক্য | কিন্তু, ফিরে যেতে পারি নি পিয়ারুলে | পিসির মেয়ে সুরুচির কাছে খবর চেয়ে পেয়েছি – তোমার সেবায় থেকে রবার্টসন সাহেব মারা যাওয়ার পর তোমার কোন খবর নেই | সাহেবের বাংলো ভেঙ্গে পড়েছে | বুকা মাহাতোর শাল বাগান গাছ কেটে কেটে শেষ |

কাল রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম | একটা শ্যামবর্ণ হাতের পাতা চিত করে ধরা, যার রেখাগুলো সুগভীর | তার উপর চন্দন রঙের একটা ভারী সুন্দর সাপ বুক পেতে শুয়ে | নির্মোক হীন সাপটার বাকি দেহ সেই হাতেরই কব্জি জড়িয়ে | যেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্লীওপাত্রার হাতের এক আভরণ | আর একটা তেমনই শ্যামবর্ণ হাত সাপটার মাথার উপর আলতো করে রেখে বুলিয়ে ওকে আদর করছে | আমি বললাম, কী করছ ? তুমি বললে, ওকে বলছি, আমার ভাগ্যরেখায় পড়ে থাকিস না, সরে যা |

সারাদিনে অনেকবার আভা এসে দেখে গেছে আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছি | ওর কোন কৌতূহল নেই কাগজ পত্রে | ও শুধু জানে আমি একটা চিঠি লিখছি কাউকে, যার ঠিকানাটা সুরুচিকে বলেছি দিতে | আভা একবার দু’বার জিজ্ঞাসা করেছে, কতদিন ধরে চিঠিটা লিখছ | শেষ করবে না ?

ঠিক কথা, কিন্তু, একটু আগে সুরুচি ফোন করেছিল | বলতে, তুমি আর কোনও ঠিকানায়ই নেই |

তবুও কলমটা তুলেছি | একটা কথা না লিখলেই নয়, যা কাল হটাত মনে পড়েছে, আর আমি ধরে ফেলেছি কোকিলটাকে |

সেবার শেষদিন যখন আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে দেখাবে না কোকিল ? তুমি বলেছিলে, চল তাহলে বুকা মাহাতোর বাগানে | কই, ওখানে গিয়ে তো তুমি আমাকে কোকিল দেখালে না | শুধু, চারিদিক দেখে, তোমার কাছে আমায় টেনে তোমার হাতের তালু আমার বুকে চেপে বললে, বুকা কোথাকার ! কোকিল এখানে থাকে | বুঝিস না, তুই ?

আমি বুঝেছি, এখন বুঝছি, সেদিন তুমি তোমার হাতের তালু দিয়ে ঠেলে আমার বুকের কপাট খুলে একটা কোকিল ঢুকিয়ে দিয়েছিলে | সে ডাকত, আর আমি বুকার মত তাকে বাইরে বাইরে খুঁজতাম | তাই না, আয়াদি ?


-----------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৬ এপ্রিল ২০১৬

রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৬

তুষার সন্ধ্যায় বনানী সমীপে বিরাম

|| তুষার সন্ধ্যায় বনানী সমীপে বিরাম ||


এই বনানী যার, যেন মনে হয় তাকে আমি চিনি
নিবাস তার ওই গ্রামে যে সে কথা যদিও মানি
সে দেখবে নাকো আমি এখানে নিয়েছি বিরাম
দেখতে বনানী ঢেকে দেয় তুষারপাত অবিরাম

আমার ছোট্ট ঘোড়াটা নিশ্চয় ভাবে কী আশ্চর্য
বিরাম, যখন কাছেপিঠে নেই কোন খামারের জো
বনানী আর বরফ-জমা এই হ্রদের ঠিক মাঝে
বছরের সবচেয়ে অন্ধকারতম সঙ্গিন এক সাঁঝে

অধৈর্য হয়ে সে ঝাঁকায় তার ঘণ্টি বাঁধা লাগাম
শুধাতে আমাকে আমি কি কোন ভুল করেছিলাম
এছাড়া যে শব্দ শুনি তা ঝাঁট দিয়ে যাওয়া বাতাস
অবাধ, আর তার সঙ্গে পলকের মত তুষারের রাশ

এই বনানী কত সুন্দর, কত গহীন, কত অন্ধকার
কিন্তু আমি যে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ, করেছি অঙ্গীকার
এখনও যোজন যেতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে
এখনও যোজন যেতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ||


(অনুবাদ - Stopping by Woods on a Snowy Evening by Robert Frost)
----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১০ এপ্রিল ২০১৬

শনিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৬

সাপ

|| সাপ ||

উষ্ণ, উত্তপ্ত একদিন, যখন খরতাপে আমি ছিলাম পায়জামায়,
আমার জলাধারে এসেছিল সাপ এক
জল খেতে

বিশাল, নিরালোক তেঁতুল গাছের সুনিবিড় অচিন-গন্ধী ছায়ায়
আমি নেমেছিলাম সিঁড়ি বেয়ে, জলের পাত্র সমেত
কিন্তু যেহেতু ও ছিল জলাধারে আমার আগে, আমাকে দাঁড়াতে, অপেক্ষা করতে হয়

মেটে-দেয়ালের এক ফাটল থেকে ও নেমে এসেছিল আবছায়ায়
আর পাথরের জলাধারটার কানার উপর ও লতিয়ে নিয়ে গিয়েছিল
ওর পীতাভ-পিঙ্গল শিথিলতা, ওর নমনীয় পেট উপুড় করে
আর, রেখেছিল ওর গলা  নিচের পাথরের উপরে
এবং, যেখানে নল থেকে জল চুয়ে পড়েছিল, সেখানে এক সংকীর্ণ স্বচ্ছতায়
ও চুমুক দিয়েছিল ওর সরল মুখে
মৃদু ভঙ্গিতে সরল মাড়ির ভিতর দিয়ে,
ও শুষে নিয়েছিল ওর লম্বা ঢিলে শরীরের অন্তরে
নিঃশব্দে

কেউ তো ছিল আমার জলাধারে আমার পূর্বগামী
আর, দ্বিতীয় এক আগতের মত, প্রতীক্ষায় আমি

ওর জল পান থেকে ও উঁচিয়েছিল ওর মাথা, যেমন করে গবাদি পশু
আর দেখেছিল আমার দিকে ভাসাভাসা দৃষ্টিতে, পানরত গবাদির মত
ওর ঠোঁট থেকে লকলক করে উঠেছিল ওর দ্বিশৃঙ্গ জিভ
এবং মুহূর্তের জন্য  ও তন্ময় হয়েছিল
আর, ঝুঁকে আরও একটু জল খেয়েছিল
সেই সিসিলিয় জুলাইয়ের দিনে, যখন এতনা ধূমায়িত
জ্বলন্ত ভূগর্ভ হতে নিঃসৃত ওর মেটে-পিঙ্গল, মেটে-স্বর্ণাভ আভা দেখে
আমার শিক্ষাদীক্ষা সরবে আমায় বলেছিল
ওকে বধ করতে হবে
কেননা সিসিলিতে কৃষ্ণ-কালো সাপেরা নির্দোষ, আর সোনালীরা বিষধর

আর আমার অন্তরের স্বরেরা বলেছিল আমায়, তুমি যদি প্রকৃত পুরুষ হতে
তুমি হাতে লাঠি নিতে, ওকে ভেঙ্গে ফেলতে, ওকে শেষ করতে

কিন্তু, আমাকে কি স্বীকার করতেই হবে ওকে আমার কত ভালো লেগেছিল
কত খুশি হয়েছিলাম আমি, যে ও অতিথির মত নীরবে এসেছিল
আমার জলাধারে জল খেতে
আর শান্ত, প্রশমিত হয়ে অকৃতজ্ঞের মত ফিরে যেতে
পৃথিবীর জ্বলন্ত গর্ভে?

সেটা কি ছিল আমার কাপুরুষতা, যে আমি ওকে মারতে সাহস পাই নি ?
নাকি বিকৃতি যে আমি ওর সাথে আলাপের আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম ?
নাকি বিনম্রতা, এত সম্মানিত বোধ করায় ?
আমি কত সমাদৃত যে বোধ করেছিলাম !

কিন্তু সেই সব কণ্ঠস্বরেরা:
তুমি যদি না ভয় পেয়ে থাকতে, তুমি ওকে মেরে ফেলতে !

আর, সত্যিই তো আমি ভয় পেয়েছিলাম, বড় বেশি ভয়
অথচ তা সত্ত্বেও, আরও বেশি হয়েছিলাম সম্মানিত
যে ও আমার আতিথেয়তা চাইবে
গোপন জগতের আঁধার দুয়ার থেকে আগত

ও যথেষ্ট পান করেছিল
আর মাতালের মত মাথা উঁচিয়েছিল, স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে
এবং, ঠোঁট চেটে নেয়ার ভঙ্গিতে
বাতাসে ওর জিভ লকলক করেছিল দ্বিশৃঙ্গ নিশার মত, সে কী কালো
আর, ও দেবতার মত দেখেছিল, দৃষ্টিহীন, চারিপাশে বাতাসে
আর, ধীরে ওর মাথা ঘুরিয়েছিল
ধীরে, অতি ধীরে, যেন ত্রিগুণ স্বপ্নমগ্ন
এগিয়েছিল ও সর্পিল ভঙ্গিতে ওর মন্থর দৈর্ঘ্য টেনে নিতে
আর, আবার আমার দেয়ালের গায়ের ভাঙ্গা পাড়ে উঠে পড়তে

এবং, যেই ও ওর মাথা গুঁজল সেই ভয়ঙ্কর কোটরে,
যেই ও ধীরে থামল, ওর কাঁধে সর্পিল আয়েস মাখিয়ে, আর আরও ভিতরে সেঁধিয়ে গেল
এক ধরনের ভয়, এক ধরনের প্রতিবাদ – ওই ভয়ঙ্কর অন্ধকার কোটরে ওর প্রস্থানের বিরুদ্ধে,
সুচিন্তিত ভাবে অন্ধকারে ঢুকে পড়ে তারপর নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে –
আমাকে অভিভূত করল, যেই ওর পিঠ আমার দিকে ফিরল

আমি নামিয়ে রাখলাম আমার হাতের পাত্র, আমি ঘুরে দেখলাম,
আমি তুলে নিলাম একটা বেকায়দা চ্যালাকাঠ
আর সেটা ছুঁড়লাম জলাধারের দিকে সশব্দে

আমার মনে হয় তাতে ওর আঘাত লাগেনি
কিন্তু হঠাত ওর পিছিয়ে পড়া অংশটা এক অশালীন ব্যস্ততায় আন্দোলিত হল
মোচড় খেল বিদ্যুতের মত, আর তারপর মিলিয়ে গেল
সেই অন্ধকার কোটরে, আমার দেয়ালের গায়ে মেটে-ঠোঁটের মত ফাটলে
যা দেখে, সেই প্রখর স্তব্ধ দুপুরে, আমি চেয়ে রইলাম এক বিমুগ্ধ আকর্ষণে

আর সেই মুহূর্তেই আমার অনুতাপ হল
মনে হল আচরণটা কী সামান্য, কী অশোভন, কী ইতরই না ছিল
আমি ঘৃণা করলাম নিজেকে, আর আমার অভিশপ্ত মানুষী শিক্ষাদীক্ষার স্বরকে

আর আমার মনে পড়ল সেই সমুদ্রের পাখির কথা
আর আমি চাইলাম যে ও – আমার সাপ – ফিরে আসুক

কারণ, আমার আবার মনে হল যে ও রাজসিক
নির্বাসিত রাজা সম, অধোভুবনে মুকুটহীন
যার এখন আবার অভিষিক্ত হওয়ার সময় হয়েছে

আর, তাই আমি সুযোগ হারালাম জীবের প্রভুদের একজনের সাহচর্যের
এবং, আমায় খেসারৎ দিতে হবে কিছুর;
এক ক্ষুদ্র মানসিকতার |


(অনুবাদ - D. H. Lawrence, "Snake")

-------------------------------------
© ইন্দ্রনীর – ০৯ এপ্রিল ২০১৬