শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কাপুরুষ

|| কাপুরুষ ||


উপর থেকে উদাস চোখে মিছিল দেখি
নিচে নেমে শামিল হওয়ার নেই মানস
আলগা থেকে প্রায়ই দেখি হচ্ছে জবাই
কাছে গিয়ে হাত থামানোর নেই সাহস

পথে ঘাটে রোজ যত যাই অন্যায় ঘটে
মুখে মুখে কারো কত অপবাদ যে রটে
আমি সব শুনি, চোখ এড়িয়ে সব দেখি
সাহস নেই, যাচাই করার আসল, মেকি

উপরে উঠে আমি নিজেই লেঙ্গি মেরে
ওঠার সিঁড়ি ফেলে দিয়েছি ধপাস করে
সেই নিচে কারা বহাল দেখ ঐ পিলপিল
কত স্লোগান, হট্টগোল আর কত মিছিল

মাঝে মাঝেই তারা কাউকে গলাটা ধরে
নিচে ফেলে লাথি, ঘুসি, কিল, চড় মেরে
আস্তে, আস্তে, হালাল করে জবাই করে
আমার জায়গায় বেকসুর লোক যায় মরে

আমি চুপটি করে থাকি, সব দেখি নিশ্চুপ
আজকাল আমার এ’টাই হল আসল রূপ
মুখ খুললেই পাছে তারা দেখে আমাকে
সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে, “মার ঐ শালাকে !”


--------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কাঁচা লাউয়ের সোওয়াদ



|| কাঁচা লাউয়ের সোওয়াদ ||


আমি খুব তক্কে তক্কে থাকি যে তেমন একটা ঘ্যাম স্বপ্ন দেখলে তাই নিয়ে লিখব | কিন্তু বহুদিন হল নিয়মিত স্বপ্নই দেখি না | যা ও বা দেখি, ঘুম থেকে উঠে মনেই পড়ে না | গত রাত্রে ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল | প্রেক্ষাপটটা এই – বহুদিন বাজারে যাওয়া হয় নি | কাল সন্ধ্যেয় রিলায়েন্স ফ্রেশে গিয়েছিলাম – কিন্তু তেমন মনঃপুত তরকারী পাই নি | একমাত্র তরকারী ছিল লাউ | লাউ আমার প্রিয় – খুব বলব না, তবে অন্য কিছু না পেলে খাই | কিন্তু যে লাউগুলো ছিল একটাও পছন্দসই নয় | হয় পেট-পিঠ সাদা গদাই-লস্কর, নয় যুদ্ধং দেহি লিকলিকে |

রাত্রে ঘুমে, এক মামা (নাকি দূর সম্পর্কের দাদা – বহুদিন আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাত নেই – যে এসে যা পরিচয় দেয় তাই মেনে নিই) দেখা দিয়ে বলল একটা ফাংশন করবে, তারই বাড়ির ছাদে | আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে | কী ফাংশন ঠিক বুঝলাম না, তবে খাওয়া দাওয়া থাকবে জেনে খুশি হয়ে রাজি হলাম | ফাংশনটা যদি তাদেরই বাড়ির ছাদে হয় তবে আমার সাহায্য দরকার কেন ? বুঝলাম, যখন মামা বলল বাড়িটা এক তত্ত্বাবধায়ক হাতে বহুদিন ধরে দেয়া আছে | এখন তার সহযোগিতা দরকার | কী সহযোগিতা ? মামা বলল, ফাংশনটার জন্য ছাতে একটা ছাউনি করতে হবে, তার জন্য টিনের চাল দরকার, কিন্তু কয়েকটাই মামার কাছে আছে, আর খান কয়েক ওই লোকটার কাছে চাইতে হবে | মামা কেন চাইবে না ? না, লোকটার নাকি অনেক বকেয়া বাকি | অতএব, আমিই লোকটাকে, নাম বীরু, ধরলাম | সে বলল, ঠিক আছে, আমি টিনের চাল দেব, তবে কিনে নিতে হবে | দাম কত ? বীরু বলল, আগে ফাংশনটা হোক | তারপর কেমন ফাংশন, কত লোক এলো গেল এই সব দেখে দামটা ধরা হবে – অর্থাৎ, কাজ অনুযায়ী দাম |

ফাংশন অবশ্য খুবই মামুলি হল, তাতে মামা বক্তা, আমি শ্রোতা এবং বীরু পর্যবেক্ষক – স্রেফ দেখতে যে ফাংশনটা কত জমকালো হল | মেনু ভাত আর লাউয়ের একটা ঝোলঝোল তরকারী | ফাংশন শেষ হলে বীরু কোন কথা না বলে, ভাত না খেয়ে, দু’ খানা কাঁচা লাউ তুলে চলে গেল |

পিছু পিছু মামা গেল বীরুর কাছে জানতে, যে টিনের চালের দরুন কত টাকা দিতে হবে | বীরু বেশ চড়া দাম হাঁকল | মামা অবাক হল দাম শুনে | বীরু বলল কারণ, এক – এত বাজে ফাংশন হয়েছে যে তার সব টিনের চালের এক রকম অবমাননা হয়েছে ; আর দুই, বাকি বকেয়াও তো দেখতে হবে ! মামা আমায় বলল, কী উপায় বল তো, আমার কাছে তো এতগুলো টাকা নেই | আমি বললাম, দাঁড়াও দেখছি | আমি গিয়ে বীরুকে বোঝালাম, যে টিনের চালগুলো বিক্রি না করে ভাঁড়া দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে | বছর বছর ও ভাঁড়া দেবে, আর মামা ফাংশন করবে | শেষে দশ হাজার টাকার দাম ছেড়ে দিয়ে ভাঁড়া হিসাবে হাজার খানেক টাকায়  বীরু রাজি হল | টাকা ট্যাঁকে গুজে নিজের টিনের চাল খুলে নিয়ে বীরু চলে গেল | মামাও নিজের টিনের চাল, আর কিছু বাকি লাউ, যা ওই ফাংশনের জন্য কেনা হয়েছিল, কিন্তু কোন গতি হয় নি, তুলে নিয়ে বলল, চল, এবার আমায় একটু এগিয়ে দে |

কিছুদূর এগিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়েই এক ভিয়েতনামের গেরিলা যুদ্ধের দৃশ্য | জল কাদায় ভরা ধানের ক্ষেতে একটা ভাঙ্গা টিনের চালের ঘর | সেদিকে তাকিয়েই মামা বলল, এই রে সর্বনাশ ! বলেই, মামা কাঁধ থেকে টিনের চাল মাটিতে ফেলে সামনে ঢালের মত ধরে বলল, শিগগির এর পিছনে লুকো | দুজনে টিনের চালের পিছনে দাঁড়াতেই, মামা আমাকে একটা সরু লিকলিকে লাউ হাতে ধরিয়ে বলল, এইটে উঁচিয়ে ধর বন্দুকের মত | আমি বললাম, কেন ? মামা বলল, দেখছিস না, সামনে ? ঐ ঘরটায় বীরু লুকিয়ে আছে, আমাদের অপেক্ষায় | আমি বললাম, কেন, কী করবে ও আমাদের ? মামা বলল, ঠিক করে দেখ | ঠাহর করে দেখলাম | বীরু দেখা না গেলেও, দেখলাম ঐ ঘরের বন্ধ জানালা থেকে দু দিকে দুটো লাউ উঁচিয়ে ধরে আমাদের দিকে তাক করা | ব্যাপারটা স্পষ্ট হল, বীরু ব্যাটা টিনের ভাঁড়া আদায় করে এখন বাকি বকেয়া আদায় করার জন্যে ফাঁদ পেতেছে |

বেশ খানিকক্ষণ আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে, আর ওদিকে বীরুর দিকেও কোন হাঁই-চাঁই নেই | কেউই গুলি চালাচ্ছে না | অথচ পরিষ্কার ভাবে পরিস্থিতি সঙ্গিন | কী করব ভাবছি, হঠাত ধাঁই করে মাথায় বুদ্ধি খেলল | মামার টিনের ঢাল থেকে বেরিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গেলাম বীরুর ঘরের দিকে | ও কিছু বোঝার আগেই ওর জানালা দিয়ে বের করা এক নলা লিকলিকে একটা লাউ আমি কপ কপ করে কামড়ে চিবিয়ে মুহূর্তের মধ্যে গিলে ফেলে, দ্বিতীয় লাউটারও একই গতি করলাম | সমস্ত ঘটনা চোখের নিমিষে ঘটে গেল | বীরুও একটু পরে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে মাথার উপর হাত তুলে ঘরটার পিছন দিক থেকে বেরিয়ে এলো |

এবার বলি, আমার মাথায় কী বুদ্ধি খেলেছিল | যখন আমি দেখলাম বীরু গুলি চালাচ্ছে না, আমি বুঝেছিলাম ওর কাছে গুলি নেই | আর, তক্ষুনি এও অনুভব করেছিলাম যে, যেহেতু আমাদের দিক থেকেও গুলি চলছে না, এই দেখে বীরুও শিগগির বুঝবে আমাদের কাছেও গুলি নেই | অতএব, ও সে’কথা বোঝার আগেই ওকে নিরস্ত্র করতে হবে | আর, নিরস্ত্র করার একমাত্র উপায় – বন্দুক লাউগুলোর সদ্গতি করা |

ঘুম থেকে উঠে খুব মনে পড়ল কেমন সুন্দর, একটু আঁকাবাঁকা, লিকলিকে সরু ছিল বীরুর লাউ দুটো | কিন্তু, কিছুতেই মনে পড়ল না ওগুলো খেতে কেমন লেগেছিল | বউকে বলতে, সে উল্টো অনুযোগ করল, কাল তুমি সিটকে দেখে লাউ নিলে না | একটা নিলে আজ চেখে দেখতে পারতে, কাঁচা লাউ কেমন লাগে খেতে |

একটা ব্যাপার বোধগম্য হয়েছে - র‍্যপিড আই মুভমেন্ট ঘুমে মুখে কোনও স্বাদ হয় না ||

------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ব্যভিচারিণী স্ত্রী



|| ব্যভিচারিণী স্ত্রী ||
(“La Casada Infiel” (The Faithless Wife) by Federico García Lorca এর অনুবাদ)

সেটা ছিল নিশীথ, ঋষি জেমস স্মরণে
তাই, যেন প্রায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আচরণে

তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম নদীতে আমি
স্থির বিশ্বাসে যে সে অনূঢ়া,
যদিও, ইতিমধ্যেই ছিল তার এক স্বামী |

পথের বাতি সব নিভেছিল একে একে,
আর মেতে উঠেছিল ঝিল্লিরা, উল্লাসিত ডাকে

আমি পথের শেষ বাঁকের কোনে
ছুঁয়েছিলাম তার বুকের সুপ্ত কোরক

আর, সহসা চেয়ে তারা আমার পানে
ফুটেছিল, যে ভাবে ফোটে কচুরিপানার স্তবক
তার অন্তর্বাসের কলপের আড়ষ্টতা যত,

দশখানা ছুরি দিয়ে এক টুকরো তসর
ফালাফালা করার শব্দের মত
আমার কানে বিঁধেছিল |

তাদের পাতায় রুপালী প্রভার অভাবে

আরও বিশাল মনে হয়েছিল গাছগুলো       
আর নদীর থেকে বহুদূরে, এক সারিতে
কুকুরের দল ডেকে গিয়েছিল |



তুঁত গাছ, নলখাগড়া,
আর কাঁটা-গুল্মের ঝাড় পেরিয়ে,

তার ঝাঁকড়া চুলের গুছির নিচে,
আমি বালিতে একটা খাঁজ কেটেছিলাম

খুলেছিলাম আমি আমার গলবস্ত্র
আমার কটিবন্ধ, সাথের আগ্নেয়াস্ত্র
খুলেছিল সে তার বেশবাস
আর, তার চার চারটে বক্ষবাস

না জটামাংসী ফুল না শুক্তির জঠর            
কভু ধরে চিকণ ত্বক, এমনতর
না রজত-সংকর কাঁচেও হয়
ঝলক এমন দ্যুতিময় |

আমার ধরা ছোঁয়া থেকে পালিয়েছিল
তার জঙ্ঘা, সচকিত মাছের মত পিছল
আধেক ছিল যার অগ্নিগর্ভ
আধেক ছিল শীতল |

বিনা লাগাম, বিনা রেকাবে আরোহণ করে
আমি ছুটিয়েছিলাম সেই নিশীথে
এক ঝিনুক বর্ণ অশ্বিনী,
সবচেয়ে সেরা রাজপথে |



সজ্জন আমি, তাই করব না পুনরাবৃত্তি
যা কিছু কথা সে বলেছিল কানে কানে |
অন্তর্দৃষ্টির আলোয় যা বুঝেছি -
কথা না বলাই ভালো, অকারণে |

হয়ে বালিতে আকীর্ণ, চুম্বনে লিপ্ত হয়ে
গিয়েছিলাম আমি তাকে নিয়ে দূরে, নদী হতে

তখন গ্লাডিওলাস ফুলের অসিপত্র
যুঝেছিল বাতাসের সাথে |



প্রকৃত ভবঘুরে বেদেদের ধারায়
যেমন আমি, তেমনই ছিল আমার ব্যবহার |
আমি তাকে দিয়েছিলাম পীতাভ স্যাটিনের
একটা বড় সীবন-সাজি উপহার,

কিন্তু, আমি চাই নি দিতে তাকে হৃদয়
কেন না, তার এক স্বামী থাকা সত্ত্বেও
সে আমাকে যে বলেছিল সে পরিণীতা নয়
যখন আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম নদীতে ||
---------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০২ অগাস্ট ২০১৫
 ---------------------------------------------------------
After I was intrigued by one particular English translation of the poem “La Casada Infiel” (The Faithless Wife) by Federico García Lorca, I looked up, and found several other translations of it. And, none probably transports the original poem’s charming flavor, as rued by some translators.
The one at:
http://ivanjennes.blogspot.in/2014/06/the-faithless-wife-leonard-cohen-philip.html
which by itself “is even more a ballad than the original”, also seems inadequate and affected.