সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩

ফেসবুকে ইভ তুমি

|| ফেসবুকে ইভ তুমি ||


যখনই দেখি – তুমি বদলেছ ছবি – রোজই এক নতুনত্ব
কোনটা যে তোমার আসল রূপ, কোন রূপে আছে সত্য ?

কখন বাগানে ঝারি হাতে নিয়ে জল দিচ্ছ গাছে, ফুলে
কখন গাড়ি থেকে হাত নাড়ছ, কাউকে নামিয়ে স্কুলে
কখন দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে ছাড়াচ্ছ গোটানো শাড়ি
কখন আয়নায় খুঁটিয়ে দেখছ শুভ্র দাঁত, গোলাপি মাড়ি

কখন ড্রেসিং টেবিলে বসে বিলি কাটছ জটিল রুখু চুলে
কখন বাথটাবে গোড়ালি ঘষছ, গান গেয়ে, দুলে দুলে
কখন রূপচর্চায়,  সিঁদুরের সাথে রঙে মানাও দুই ঠোঁট
কখন চিঠি লিখতে আনমনা, খেয়ে যাও চিন্তার হোঁচট

কখন গোছাও ওই মণিবন্ধ, যা বাঁধা শাঁখা, পলা, নোয়ায়
কখন হাতে নিয়ে কবিতার বই, ধ্যান নেই যেটা পড়ায়
কখন জানালায় উদাসী মুখ, চোখে মেলে আদিগন্ত দৃষ্টি
গহীন আঁধারে নির্বাসিতা ইভ তুমি, আদিম আদমের সৃষ্টি

ঝারি, জল, ফুল, গাড়ি, হাত, স্কুল, চুল, বাথটাব, শাড়ি,
সিন্দূর, আয়না, দাঁত, মাড়ি, চিঠি, কবিতায় চিন্তার পাড়ি,
মণিবন্ধ, পলা, শাঁখা, নোয়া ... এক এক তোমার কোয়া
অন্তরঙ্গতার শখ মেটায় না তাদের সহস্র টুকরো ছোঁয়া

ক্যামেরা কিনব, তুলব ছবি সব, এ কথা ভাবতে ভাবতে
ডুবে গেল চিরতরের মুহূর্ত, অচির সময়ের ঘূর্ণি-আবর্তে
জানা ছিল না তো মন-নয়নের আদি পিন-হোল ক্যামেরা
তুলেছে ছবি, স্বপ্নিল একই, নিয়ে তার বিবর্তমান চেহারা

তাতে তোলা ছবি একটাই, কিন্তু যখনই সেটাকে দেখি
মনের মধ্যে পাতা খোলে আমার কল্পনাকারী দুই আঁখি
সে কল্পনায় পুনর্বাসিত ইভ তুমি, খসিয়ে লজ্জার নির্মোক
খুলেছ জানালা, মেলেছ দিক্বিদিক-জ্ঞান শূন্য, মুগ্ধ চোখ

দেখতে, দেখতে দেখি বদলায়, সেই ছবিটি নিতি-নিত্য
সে সবেতে আছে নানান রূপ, সব রূপই লাগে চিরসত্য ||


--------------------------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ২৮ অক্টোবর ২০১৩


শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৩

দিয়ে পাওয়া

|| দিয়ে পাওয়া ||


জীবনটা যদি যায় চুকে, তো যাক না
মেলে, তারই দরুন, কল্পনার দু'পাখনা
হটিয়ে মনের লজ্জা, চিন্তা, ভাবনা
যাই খুঁজি তাকে, যার তরে মন আনমনা

বলেনি কেউ, কোরো না তার কামনা
বলেনি কেউ, সইতে তার দুখ যাতনা
বলেনি কেউ, মেনে নিতে তার প্রতারণা
এও জানি না, সেই কি আমার বেদনা

ক্লান্ত চোখের শ্রান্ত দুই পাতা বুজে
কানের কথা মনে শুনে, বুঝে-সুঝে
নিজের জটিল গোলকধাঁধায় নিজে নিজে
একবার শুধু হবেই পেতে তাকে খুঁজে

বলতে হবে, "কেন দেখা দাওনা আমায় ?
বাকি কিছু পাওনা আছে দেনার খাতায় ...

একটা, চোখের দৃষ্টি তোমার কমনীয়
একটা, ঠোঁটের চুমুক তোমার নমনীয়
একটা, ভুরুর ভ্রুভঙ্গিটা লোভনীয়
আর, সেই কথাটা, যা খুবই গোপনীয়”

না, না, তোমায় বলতে হবে না "ভালবাসি"
বোলো শুধু, "দাও গো বিদায়, এবার আসি !"

তোমার বিদায় আমার হৃদয় জানেই জানে
তারই মাঝে লুকিয়ে, "দিয়ে পাওয়ার" মানে ||


---------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ২৫ অক্টোবর ২০১৩

মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৩

চৌকাঠ


                                                                                                  লক্ষ্মী পুজো, ২০০১
জিত,
         <<
         আজ লক্ষ্মী পুজো সারা হয়ে গেলে ...
         >>

         দুপুরের নিথর শরীর থেকে আলসেমির আঁচল ফেলে
         যখন দিনটা বিকেল হয়, অভিসারের চিন্তায় নিমগ্ন
         তখন হটাত ঘূর্ণি হাওয়ার এক অবাধ্য দুরন্ত ছেলে
         চিলেকোঠায় দরজার কড়া নেড়ে করে আমায় বিপন্ন

         সিঁড়িতে উঠতে দেখি গোধূলি রোদের তির্যক রেখা
         পাশ কাটিয়ে নেমে যায় অশালীন হাওয়ার তাড়ায়
         হাওয়া তাকে ছেড়ে, পেয়ে অবিন্যস্ত আমাকে একা
         “ডাক আছে!” শুনিয়ে মনে আশঙ্কার উদ্বেগ জাগায়

         দরজা খুলে চৌকাঠে দাঁড়াই আমি অনুসন্ধিৎসু মনে
         জানতে কি বার্তা এনেছে প্রকাশ্যে দস্যু দূত বাতাস
         আমায় আবিষ্কারের অভিপ্রায় জানি ছিল সংগোপনে
         তারই চিঠি পাঠিয়েছ কি, না দিয়ে কোনও পূর্বাভাস ?

         স্মরণে এসে আছড়ায় এক বলাকার মানসে লুপ্ত ছবি
         সুদূর অতীতে, ঘূর্ণি হাওয়াতে, যে হয়েছিল আবির্ভূত
         চিত্রিত তার শ্বেতাভ নিষ্পাপ রূপ, যেন বিস্মৃত সুরভি
         ঝরা ফুলের | এক সুপ্ত বিরহিণী, কি বিষাদে অভিভূত

         চিত্রপটে এঁকেছ অন্ধকার চিলেকোঠায় দরজার পরিখা
         পরিপ্রেক্ষিতে সমুজ্জ্বল পুঞ্জিত অগুনতি যূথিকা বাদল
         সাজায় একাকিনী নিথর মেয়েলি অবয়বের সীমারেখা
         যার পলকে, কপোলে ও চিবুকে আমার মুখের আদল

         আশ্চর্য তার একাগ্র অনাবৃত শরীর বৈশিষ্ট্যহীন কায়া
         যেন অন্তঃসলিলা সে তার শৈশবের অতনু অস্তিত্বে
         শুধু তিন বিন্দুতে পড়েছে অনাগত কৌমার্যের ছায়া
         দুটি অ-প্রস্ফুটিত মৃণালে, আর একটি মৃগনাভিতে

         চমকে সঙ্কুচিত চেতনা হতে লজ্জার বসন সরিয়ে
         খতিয়ে নিই আমার শরীরের ভূগোল ও ইতিহাস
         সবই তো অনাবিষ্কৃত, দেখি | পাই হিসাব মিলিয়ে
         সঞ্চিত আছে তিন বৃন্তহীন শিউলির অনাঘ্রাত সুবাস


- ইতি 


                                                                                                  লক্ষ্মী পুজো, ২০০১
ইতি,
         আজ, লক্ষ্মী পুজোর দিন, দুপুরে একা একা এই সব পুরনো কথা মনে পড়ছিল ...

        আমি তখন ছোট, বোধ হয় ছ’ বছরের | পুজোর ছুটিতে মহালয়ার এক দিন আগে রূপাখ্যানপুরে তুনি মাসির কাছে গেছি, বাবা মায়ের সঙ্গে | ঠাকুমাও গেছে সাথে | চাকর-বাকরের হাতে তাঁকে একা রেখে যাওয়া যাবেনা, আর তিনি নাতিকে চোখের আলগা করবেন না কিছুতেই, বিশেষ করে পুজোর সময় |

        রূপাখ্যানপুরে মেসোর বড় রেলের বাংলো, বারো-তেরো খানা ঘর, বাথরুম ইত্যাদি নিয়ে | চারিদিকে ছড়িয়ে প্রশস্ত রেলের কলোনি, তার পরে খাকি চষা মাঠ | আলের ধারে অজস্র শ্যামল পলাশ গাছদের পাহারা দেয় এখানে ওখানে কিছু খয়ের রঙের নির্জীব তাল, নারকেল, খেজুরের গাছ | সব মাঠ পেরিয়ে এক দুটো ছোট গ্রাম | রেলের কলোনি এমনিতেই শান্ত, সন্ধ্যা হলে তো নিঝুম | বাগানের গাছের অন্ধকারে এমন কি পাশের বাড়ির বাতি ও দেখা যায় না | শুধু শোনা যায়, রেলের শান্টিং এর শব্দ – চলার লিং-টিং লিং-টিং, আর থামার খ্যাস-খ্যাস-খ্যাস | কখনো কোনও এংলো-ইন্ডিয়ান বাড়ি থেকে পিয়ানোর টুংটাং | মাঝে মধ্যে থ্রু ট্রেনের চাপা গর্জন ছাপিয়ে উঠেই আবার নিস্তব্ধতা | আবার কোনও কোনও দিন কানে তালা ধরানো একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার কলরব |

        রূপাখ্যানপুরে স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটাই বড় রাস্তা রেল কলোনি দিয়ে | তার থেকে যে সব রাস্তা এপাশে ওপাশে বেরিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটা সেটাই বাড়ির সামনে দিয়ে গেছে | মেসো এটাকে বলে এখানকার মেজ রাস্তা | এক ধারে উঁচু পাড়ের ওপাশে বিরাট এক লেক মতন – নাম পদ্মপুকুর | তারই জল ফিল্টার হয়ে বাড়িতে বাড়িতে যায় | রাস্তার অন্য ধারে বাড়ি | গেট থেকে নুড়ি পাথরের পথ, ফুলের বাগানের সামনে দিয়ে ডানদিকে ঘুরে বাড়ির বারান্দার সামনে এসে থেমেছে | ফুল-বাগানের উল্টো দিকে বিরাট ঘন বাগান, বন বললেই হয় | তেঁতুল, শিরিষ, আম, জ্যাম, কাঁঠাল, চিকু - কি নেই ? তাতে কাঠবিড়ালির আর লাল ডেঁয়ো পিঁপড়ের রাজত্ব | বাড়ির মাঝখানে প্রধান ঘরটা বাসঘর - বসার ও খাওয়ার আসবাব রেখেও প্রচুর জায়গা | তার দু পাশে দুটো করে চারটে শোয়ার ঘর, এক একটা বাথরুম মাঝখানে | পিছনে রান্নাঘর আর জিনিস পত্র রাখার স্টোর | এছাড়া টুল-শেড্, চাকর দের থাকার ঘর ইত্যাদি | চুড়ো করা টালির ছাত বাসঘর থেকে নিচু হয়ে চারিদিকে নেমেছে | সামনে নেমে আসা টালির নীচে চওড়া বারান্দা, ঘুরে শোয়ার ঘর গুলোর সামনে দিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে | মেঝে লাল সিমেন্টের, এমন পালিশ করা যে তাতে রাখা বেতের চেয়ারের ছায়া পরিষ্কার দেখা যায় | বারান্দার সামনে কাঠের থামে ওপর থেকে নেমে আসা কাঠের জাফরি, তার ভিতরে গুটানো চেরা বাঁশের পর্দা, গরমকালে নামিয়ে জল ছিটিয়ে ঠাণ্ডা করার জন্য | এই সবের মধ্যে আমি একা একা ঘুরে বেড়াই, কোনও খেলার সাথী নেই | ঠাকুমা ঠায় তাকিয়ে দেখে |

        মেসো খালি পুজোর কটা দিন ছুটি নেবে, তাই অফিস যাচ্ছে | বাবাকে নিয়ে | বাবা নাকি মেসোর অফিসের লোকের সাথে গল্প করে সময় কাটাতে যায়, কিন্তু মা বলে বাবা গিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে ট্রেন দেখতে দেখতে কাগজ পড়ে আর চা খায় | দুজনে যখন দুপুরে ফেরে, সাইকেলের চাকায় নুড়ির পথে সরসর করে আওয়াজ হয় | অমনি ঠাকুমা বলে, “বৌমা, অরিন আর সমর ফিরেছে, খাবার বাড়তে বল | আর টুকু, তুই নাইতে যা চট করে |”

        আমার খেলার সাথী করেছি অর্জুনকে | অর্জুন সর্দার সাঁওতাল | রেলের মজুর, মেসোর বাড়িতে ম্যান-ফ্রাইডে | সব কাজের মাঝে আমাকে বাজারে নিয়ে যায়, ঢেলা চিনির লাল-হলুদ মাছ-লজেন্স কিনে দেয় | কখনো দুপুরে রেল লাইন ধরে ধরে অনেক দুরে নিয়ে যায় যেখানে নীচ দিয়ে কেয়ূর নদী বয়ে যায় | জল কম, শুধু মস্ত মস্ত পাথর বালির উপর সী-লায়নের মতো শুয়ে বসে আছে | কোথাও তাদের কোল ঘেঁষে পরিষ্কার জলের গভীর ধারায় ছোট ছোট হলুদ কিম্বা কালো মাছ | আমি মনে করিয়ে দিলে অর্জুন হরলিক্সের বোতল নিয়ে যায় | আমাকে মাছ ধরে দিয়ে আমাকে কোমরে জড়িয়ে জলের উপর ঝুঁকিয়ে ধরে | আমি বোতল উল্টো করে দিই | মাছ গুলো জলে পড়ে আবার সাঁতার খেলতে লাগে, যেন কিছুই হয়নি | অর্জুন বলে আমি না তাকালে নাকি মাছের ছটফটিয়ে নেচে নেচে আনন্দ করে | তা আমি জানি না | তবে আমার মনে হয়, হয়ত অর্জুন সব কথা জানেনা ; কিছু কিছু মন গড়িয়ে বলে, আমায় অবাক করতে | তাইতো একবার আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম বাতির সুইচ টিপলে বাতি কি করে বোঝে জ্বলতে হবে না নিভতে হবে | অর্জুন একটু ভেবে বলল, বাতিটা সুইচ টিপলে নিজের গাটা দেখে, ফর্সা না কালো | ফর্সা হলে বোঝে নিভতে হবে, আর না হলে, জ্বলতে হবে ! আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম বাতিটা কি করে জানতে পারে যে সুইচ টেপা হয়েছে | অর্জুন খানিকক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে, ভেবে, হো হো করে হেসে বলল, সেটা তো বিজলি মিস্ত্রী বাতি কে লাগাবার সময়ই বলে বুঝিয়ে দিয়ে যায় ! কিন্তু, অর্জুন গাছ-পালা, শাক-সবজি আর নিজের কাজ খুব বোঝে | পদ্মপুকুরের পাড় থেকে কলমি শাক এনে দেয় মাসি কে | শিউলি ফুল এনে দেয় ঠাকুমাকে | আর আমাকে তীর-ধনুক, গুলতি, তালপাতার বাঁশি এই সব বানিয়ে দেয়, যেদিন যেরকম পারে |

        একদিন অর্জুনের সাথে বাজার থেকে ফিরছি, হাতে সদ্য কেনা ফিরকি, মানে তালপাতার ঘূর্ণি-পাখা, একটু হাওয়া লাগলেই ঘোরে | বাড়ির কাছে এসে হটাত সেটা হাওয়ার ঝটকায় হাত থেকে উড়ে গিয়ে পালাতে লাগলো মাটিতে গড়িয়ে | আমি ছুটে ধরতে গিয়ে আছড়ে পড়লাম | একটা সাঁওতাল গুণী পথের ধারে কি সব বই, মালা, তাবিজ, টোটকাটুটকি আর একটা খাঁচায় বন্ধ টিয়া পাখি নিয়ে বসে ছিল | আমি হুমড়িয়ে পড়লাম তার জিনিসপত্রের উপর | চমকে টিয়া পাখিটা খাঁচার ভিতর ছটফট করে ব্যস্ত হয়ে কিছু বলতে লাগলো বারবার | অর্জুন দৌড়ে এসে আমায় তুলল | আমি ধুলো ঝেড়ে অর্জুন কে জিজ্ঞাসা করলাম, “টিয়াটা কি বলছে ?” অর্জুন এক চোখ ছোট করে গুণীটাকে ইশারায় প্রশ্ন করলে সে গম্ভীর হয়ে বলল, “ইয়ে ... তোতা বলছে – বউ আইলা, পালা পাগলা |” আমি ‘ধ্যাত’ বলে অর্জুনের হাত ছেড়ে দৌড়ে এক্কেবারে বাড়ি | ঠাকুমা আমার লাল মুখ চোখ দেখে ডেকে পাশে বসিয়ে মুখ মুছিয়ে অনেকক্ষণ আমাকে হাওয়া করলো হাতপাখা দিয়ে | তারপরে ওনার হাত ছাড়িয়ে আমি গেলাম বাড়ির পিছনে স্লিপারের পাঁজার উপর ওঠে করমচা গাছে করমচা খুঁজতে | ভাগ্যিস ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করেনি ওইটুকু দৌড়ে মুখ কেন লাল হয়েছিল | গাছের শেষ করমচা গুলো খুঁজতে খুঁজতে জানার ইচ্ছা হল বউ আনতে কেন বড় হয়ে বিয়ে করতে হয় | ঠিক করলাম ঠাকুমা কে জিজ্ঞাসা করব |

        অনেকক্ষণ পরে শুনলাম ঠাকুমার গলায়, “বৌমা, ওরা ফিরেছে | দেখ তো টুকু টা কোথায় গেল |” আমি দৌড়ে নেমে রান্নাঘরে পিছন দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে শুনলাম, মেসো মাসিকে বলছে, “তুনি, একটু মুশকিল হয়েছে !”
 

        কোনও মুশকিল – একটু হোক কি বেশ - আমার মনে ভীষণ কৌতূহল জাগায় | তাই আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম কথা শুনতে |
মাসি –“কি মুশকিল ?”
মেসো – “নীরেন দিল্লি থেকে চিঠি দিয়েছে | পুজোয় কলকাতা আসছে | পথে আসানসোলে নেমে ব্রেক-জার্নি করবে আমার কাছে আসার জন্য | ক’দিন কাটিয়ে যাবে | সেই বিয়ের পর কত বছর দেখা সাক্ষাত নেই | তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না লিখেছে | এখন কি করি ?”
মাসি – “একা আসছে নিশ্চয় | তাতে কি মুশকিল ?”
মেসো – “আরে না না | সাথে ফ্যামিলি |”
মাসি – “ও ! ... আমি কি ওর বৌকে দেখেছি ?”
মেসো – “না | ওর বিয়েতে আমি একা গিয়েছিলাম |”
মাসি – “হুম ! ... তা, আসানসোল থেকে ওরা আসবে কি করে ?”
মেসো – “দেখো, আমাকে তো আসানসোল যেতেই হবে ওদের সাথে দেখা করার জন্য | ভাবছি অফিসের জিপ টা নিয়ে যাব, আর যদি ও নেমেই পড়ে, তাহলে তাতেই ...”
মাসি তখনি আমাকে লক্ষ্য করে বলল, “এই টুকু, যা, স্নান করে নে | খেয়ে ঘুমিয়ে নিবি, বিকেলে বাড়িতে নতুন লোক আসবে |”

        বুঝলাম বাড়িতে আরও লোকের ব্যাপারটা মাসি মেনে নিয়েছে | যদিও জানা হল না আমার সাথে খেলার মত কেউ আসছে কি না |

        এদিকে অফিসের কি কাজ এসে পড়াতে মেসোর আসানসোল যাওয়া হোল না | অর্জুনকে জিপে পাঠিয়ে দিয়ে মেসো আসানসোলের স্টেশনমাস্টার কে রেলের ফোনে বলে দিল স্বয়ং ওদের গাড়ি থেকে নামিয়ে জিপে তুলে দিতে |

        সন্ধ্যা বেলায় আমি আর ঠাকুমা বারান্দার সিঁড়ির ধাপে বসে | বাইরে রাস্তায় জিপ এসে থামল, কেননা ভিতরের পথে জিপের চাকা খুব নুড়ি ছিটায় | একটু পরে দেখলাম এক ভদ্রলোক আসছে, সাথে হাত ধরে একটা মেয়ে – আমার থেকে আরও ছোট, তার পিছনে এক ভদ্রমহিলা, সব শেষে অর্জুন জিনিষপত্র নিয়ে | মেয়েটার পরনে একটা চুমকি বসানো ফ্রক | সোনালী আলোতে খুব ঝিলিক দিচ্ছে |

        ভদ্রলোকে এসে ঠাকুমাকে প্রণাম করে বললেন, “সমরদা’র মা না ? অরিন কোথায় ?”
ঠাকুমা – “থাক থাক | এসো, ভিতরে চলো | অরিন এখুনি অফিস থেকে এলো বলে |”

        ঠাকুমা ওদের নিয়ে ভিতরে চলে গেলে আমি উঠে বারান্দার বাতির সুইচ টিপলাম | বাতিটা, নিজের গাটা ফর্সা না কালো বুঝতে পেরে কি না পেরে জানিনা, জ্বলল না | আমি ঘনান অন্ধকারে একটা চেয়ারে বসে কি করব না করব, কোন ঘরে যাওয়া যায়, এই সব ভাবছি, তখন সেই ভদ্রমহিলা মেয়েটার হাত ধরে বেরল, এখন তার গায়ে একটা খাটো সেমিজ | আমার কাছে এসে বলল, “এই নাও, তোমার নতুন খেলার সাথী, ভাব কর |” আর, মেয়েটাকে বলল, “তুমি ওর সাথে থাক | একটু পরে তোমার মুখ ধুয়ে চুল বেঁধে দেব, কেমন ?”

        মেয়েটার হাতে দেখলাম একটা লম্বা সরু কোনও খেলনা, মনে হল রাবারের কুমির | ও আমার চোখের দৃষ্টি লক্ষ্য করে আস্তে আস্তে ওটা আমার চোখের কাছে ধরল, দেখি ওটা একটা বহুরূপী | ও বলল, “দেখি তো তুমি একে ভয় পাও কিনা |” বলেই, ও চোখ বুঁজে আমার মুখে নাকে খেলনাটা চেপে ধরল | বহুরূপীটা অদ্ভুত নরম আর ঠাণ্ডা, আর তাতে আপেল না চন্দন না লেবু পাতা না এলাচ - নাকি সব মেশানো - অদ্ভুত একটা গন্ধ | আমি কিছু বলার আগেই ও ভয়ঙ্কর ভাবে মুখ ভেংচে হেঁসে কুটিকুটি হয়ে দৌড়ে পালাল | আমি দেখলাম ওর মাথার উপর ঝাঁকড়া কুঁকড়ানো চুলের ঝোপ দৌড়ের তালে তালে ঝাঁপাচ্ছে | তখনি সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে আমার খেলার সাথী করার প্রশ্ন ওঠে না |

        পরে জেনেছিলাম এই নতুন মাসির খুব টিকটিকির ভয় | সেই ভয় যাতে মেয়ের মনে না জন্মায় তার জন্য নতুন মেসো ওকে বহুরূপীটা দিয়েছিল খেলতে |

        রাত্রে খেতে বসে শুনলাম আর ওর বাড়ির নাম ঋহা | নতুন মাসী বলল, ও সবাইকে নিজের পছন্দ মত নাম দিয়ে ডাকে | ইতিমধ্যেই তনি মাসি হয়ে গেছে বুম্মা, মেসো বুব্বাই, মা হয়েছে মাম্মা আর বাবা বাপ্পি | তাই আমরাও ওকে যে যার পছন্দ মত নামে ডাকতে পারি | আর, নতুন মাসি আমাকে শেখাল ওনাদের মাসিমা, মেসো মশাই বলে ডাকতে | আজও তাই ডাকি, যদিও নতুন মাসির কথা ভাবলেই মনে পড়ে ওনার প্রথম কথা, “এই নাও, তোমার নতুন খেলার সাথী, ভাব কর |“

        সেদিন রাতের খাওয়া দাওয়া করে বাকি সবাই শুতে গেলে বাবা বলল, “চলো, আজ আমরা ডায়েরি লিখি, অনেক ঘটনা বাদ যাচ্ছে |”

        জন্মে থেকে দেখেছি, আমাদের বাড়িতে সবাই মিলে ডায়েরি লেখে, কোনও বিশেষ সময় বা ঘটনার পর | যেমন পুজো শেষ হলে, বা বাড়িতে কেউ এসে বেড়িয়ে গেলে | প্রথা অনুযায়ী একই ডায়েরি তে এক এক করে সবাই যার যা ইচ্ছে লেখে | তারপরে বাবা সেটা পড়ে আর মা শোনে | আবার কখনো মায়ের কিছু পুরনো কথা মনে পড়লে বাবা সে বছরের ডায়েরি বের করে এনে সেই পুরনো দিনের লেখা পড়ে শোনায় |

        সেদিন প্রথমে আমি লিখলাম | আমাকে সবসময় প্রথমে লিখতে হয় যাতে না দেখতে পাই কে কি লিখেছে | শেষে লেখে ঠাকুমা, তবে কখনো সখনো | সবার লেখা হলে বাবা পড়ে শোনালো,
“টুকু লিখেছে – ঋহাকে আমি ঝিলিক বলে ডাকব |
“তুমি লিখেছ – আমি ঋহার নাম রেখেছি চুমকি, ওর চুমকির জামা দেখে |
“আমি লিখেছি – ভাবছি, ঋহার নাম কি সিকুইন রাখা যায় ?
“আর মা লিখেছে – ঋহা আমার চিন্তার ইতি |
“ইতি ? ... কেন, মা ?”
ঠাকুমা – “কেননা এবার আমার এক চিন্তার ইতি হল |”
মা – “আর আপনার কি নিয়ে চিন্তা, মা ?”
ঠাকুমা – “টুকু কে নিয়ে |”
বাবা – “কেন, টুকু কি করল আবার ?”
ঠাকুমা – “না টুকু কিছু করেনি | কিন্তু ওর মনটা এত চঞ্চল | সব সময় খেলার সাথী খোঁজে | সেই নিয়ে যে চিন্তা ছিল এখন সেটা শেষ হয়েছে |”
বাবা – “ও ... কিন্তু সে তো এই ক’দিনের ব্যাপার মা |”
ঠাকুমা – “দ্যাখ | কতদিনের ...”
বাবা – “মা! এই যুগে তুমি ... আচ্ছা, আচ্ছা ! এবার তুমি চল শুয়ে পড়বে |”

        নতুন মেসো মাসি কলকাতা গেল লক্ষ্মী পুজো পার করে | কেননা কলকাতায় কাজ ছিল শুধু ফেলে রাখা বাড়িটা পরিষ্কার করা | আর এখানে কত আনন্দ, কত হৈচৈ | আর ঝিলিক আর আমার ‘পিঠোপিঠি’ স্নান ?

        ঝিলিকের স্নানের দুটো ব্যাপার – এক ও কিছুতেই পিঠে তেল মাখবে না | আর দুই, কল খুললে ও আর বন্ধ করবে না | ঠাকুমা ওকে প্রথম দিন পিঠে তেল মাখাতে গেলে ও হেঁসে কচলে বলল, “ঠাম্পা (ঠাকুমা) আমার কাতুকুতু লাগে |” তখন ঠাকুমা আমার পিঠে বেশি করে তেল মাখিয়ে বলল, “টুকু, যা ইতির পিঠে পিঠ লাগিয়ে দে দেখি |” সেই ভাবে শুরু পিঠে পিঠ লাগিয়ে একসাথে স্নান | অর্জুন কুয়ো থেকে বালতিতে জল তুলে আমাদের মাথায় ঢালে, আমরা পিঠে পিঠ ঘসে হুটোপুটি করি | এই ছিল ‘পিঠোপিঠি’ স্নান | আর, কুয়োর ঠাণ্ডা জলে ঝিলিকের শিউরে উঠে চেঁচান যা শুনে মাসীমা প্রায়ই দৌড়ে আসত ব্যাপার টা কি দেখতে |

        ওরা কলকাতা থেকে দিল্লি ফেরার পথে আমরা সবাই আসানসোলে গিয়ে ওনাদের সাথে দেখা করলাম | ট্রেন থেকে নেমে মাসীমা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “টুকু তুমি ঋহার বহুরূপীটা দেখেছ ?” বলল কলকাতা পৌঁছে ধরা পড়েছিল যে ওটা নেই | আমি মাথা নাড়লাম | ঝিলিক কোনও কথা বলছেনা দেখে পা ছটফট করলো পালিয়ে যাওয়ার জন্য | শেষে মাসীমা আমাকে জড়িয়ে অনেক চুমু খেয়ে বলল, “টুকু, এবার আমরা এদিকে চলে আসব | দিল্লিতে ঋহার একটুও ভালো লাগেনা, আমারও না |” মেসো মশাই হেঁসে বলল, “জিত, তাহলে তো আর কখনো আলাদা হওয়া যাবেনা !”

        আলাদা ?

        যাকগে ! যে এক দুটো কথা তোমাকে মনে করানোর জন্য এত ভূমিকা, সেই কথাই তো রয়ে গেল |

        আসার পরের দিনই ঝিলিক সকালে উঠে বায়না করল আঙ্গুর খাবে | অর্জুন বাজার থেকে ফিরল – কোথাও আঙ্গুর নেই | কি হবে ? মা, তনি মাসি সবাই ব্যস্ত, যেন নিজের মেয়ে | তখন আমি ঠাকুমার কানে কানে বললাম, “ঠাকুমা দেখ | ঝিলিকের পায়ের আঙ্গুল গুলোই তো আঙ্গুর, না ?” ঠাকুমা আমাকে ঠেলে সরিয়ে ঝিলিক কে বলল, “ইতি, আঙ্গুর তো নেই, আঙ্গুরের আচার খাবি ?” সবাই অবাক | ঠাকুমা এসেই গাছের শেষ পাকা করমচার মিষ্টি আচার করেছিল | ঝিলিক সেটা একটু খেয়ে ঠোঁট চেটে বলল, “খুব নামনাম !” মাসীমা বলল, “তার মানে ঋহার ওটা ভালো লেগেছে |” ঠাকুমা বলল, “তাহলে আচারটা আমি রেখে দেব | তুমি দিল্লি নিয়ে যেও ওর জন্য |”

        লক্ষ্মী পুজোর দিন পুজো হয়ে গেলে আমি স্লিপারের পাঁজার উপর উঠে দেখি অনেক কাঠবিড়ালি একটা গাছের ফোকরে কিছু নিয়ে গিয়ে রেখে আসছে | ঝিলিক কে দেখাতে দৌড়ে গেলাম ডাকতে | দেখি ঠাকুর ঘরে, যেটা আসলে একটা শোয়ার ঘর, ও রয়েছে ঠাকুমার সাথে | ঠাকুমা পা ছড়িয়ে হয়ে বসে, তার কোলে মাথা রেখে ঝিলিক আদুড় গায়ে মাটিতে শুয়ে | পুজোর বেঁচে যাওয়া ঘসা চন্দনে লবঙ্গ ডুবিয়ে তার ছাপ দিয়ে ঠাকুমা ওকে সাজাচ্ছে | মুখ সাজান হয়ে গেছে, এখন গায়ে মালা আঁকা হচ্ছে | আমি বললাম, “ঝিলিক, এস, কাঠবিড়ালিরা সব কি কাণ্ড করছে দেখবে | ঝিলিক বলল, “আগে আমি সেজে নিই |” ঠাকুমা বলল, “তুই যা, আমি ওকে পাঠাচ্ছি একটু পরে |”

        সাজা সারা হলে ঝিলিক এলো, এক হাতে একটা মাদুর আর অন্য হাতে বহুরূপীটা | ঠোঁটের কোনে খানিকটা করমচার আচার লেগে | হাত ধরে ওকে স্লিপারের পাঁজায় তুলে মাদুর পেতে দুজনে বসলাম | কাঠবিড়ালিদের কাণ্ড দেখতে দেখতে একটু পরে ঝিলিক অকাতরে ঘুমিয়ে পড়ল | আমি ওর পাশে কাত হয়ে শুয়ে হাতে মাথা রেখে দেখলাম বহুরূপীটা দুটো স্লিপারের ফাঁকে ঢুকে গেছে | ওর মাথার পাশে আধখোলা মুঠোয় বহুরূপীটার গন্ধ | আশে পাশে শিউলি গাছ থেকে ঝরে পড়া কিছু ফুল | খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আমি কটা শিউলি নিয়ে তাদের বোঁটা ছিঁড়লাম | দুটো দিয়ে ঝিলিকের বুকের গোলাপি বুটি দুটো আর একটা দিয়ে ওর নাভি ঢেকে দেখলাম কেমন লাগছে | ওর ঠোঁটের কোনে লাগা আচারটায় জিভ লাগিয়ে দেখলাম ঝিলিক কোনও সাড়া দিল না | কি নরম নোনতা ঘুম | আর কি করি ? চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম পাশে, ভাবতে ভাবতে যে আজকের ঝিলিক কাল চলে যাবে | আকাশে অনেক অনেক উঁচুতে হালকা সাদা মেঘের পাঁজা তুলো যেন যূঁই ফুলের জাল বিছান | ডান হাত কপালের উপর চিত করে আর বাঁ হাত মুখের উপর উপুড় করে ধরলাম | এইভাবে এ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের সাথে ও হাতের তর্জনী জুড়ে একটা চৌকাঠ হয় যেমনটা অর্জুন আমাকে শিখিয়েছিল | এর মধ্যে দিয়ে মেঘ দেখতে দেখতে মনে হয় মেঘেরা দাঁড়িয়ে আর আমি ভেসে যাচ্ছি | আমার ভেসে যাওয়া ভাবটা শুরু হতেই কি মনে হল, পাশ ফিরে চৌকাঠের মাঝে ঝিলিক কে একবার দেখে নিলাম | ও আমার নৌকায় শুয়ে আছে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে মেঘ দেখতে দেখতে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম | কত দুরে চলে গিয়ে পায়ে একটা হালকা ঝাপটা লাগল | দেখলাম দুপুরের গরম হাওয়া উঠে এসেছে, আর তার ধাক্কায় উড়ে মাদুরের শেষটা আমার পায়ে আছাড় খাচ্ছে | একটা বক কোথা থেকে এসে ঝিলিকের মাথার দিকে স্লিপারের পাঁজার এক কোনে নেমে হাওয়ার বিরুদ্ধে ডানা মেলে নিজেকে সামলাচ্ছে | ওদিকের ফুলবাগানের বুক থেকে ঘাস-পাতা উড়িয়ে একটা ছোট দমকা ঘূর্ণি উঠে এলো | এক মুহূর্তে সেই ঘূর্ণির ঝাপটা এসে শিউলির পাপড়িগুলো ঝিলিকের গা থেকে উড়িয়ে নিয়ে গেল | শিউরে উঠে ঝিলিক চোখ খুলে তাকিয়ে প্রথমে বকটাকে দেখল, তারপর অবাক মুখ ঘুরিয়ে আমায় দেখল |

        চোখের উপর হাত রেখে রোদ আড়াল করে ঝিলিক বলল, “টুকু, এবার আমায় ঘরে নিয়ে চল |”

        ইতি, তোমার মনে পড়ে কি ওই সব কথা ? বিশেষ করে ঝিলিকের শেষ কথাটা ?

- জিত


                                                                                                  ২০ অক্টোবর, ২০০১
জিত,
         এক দুটো কথা তুমি লিখনি | যেমন,

         তুমি দেখনি যে আমার বহুরূপীটার পেট চেরা ছিল, কলম রাখার জন্য | আমি নতুন ধূপ কাঠির বাক্স এলে তার থেকে একটা কাঠি ভেঙ্গে এক টুকরো ওর পেটে রাখতাম | এই করে ওর পেট ভরে গেলে আর রাখতে পারা যেত না | তারপর মায়ের সেন্টের নতুন বোতল এলে আমি এক দু ফোঁটা ওর পেট খুলে ঢেলেও দিয়েছি | তুমি আমার হাতে যে গন্ধ পেয়েছিলে তাতে সেই সব গন্ধ ছিল |

         শেষমেশ আমার সুগন্ধি বহুরূপীর কোথায় গেল ?

         একদিন দুপুরের খাওয়ার পর মেয়েরা সবাই বসে গল্প করছি, হটাত রান্না ঘরে শুনলাম কোনও বউ অর্জুনকে খুব মিনতি করে ওদের সাঁওতাল ভাষায় কিছু বলছে | বুম্মা মা কে বলল ওটা অর্জুনের বউ | আরও অনেক কথা শুনলাম যা তখন বুঝিনি | পরে মাকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছি অর্জুনের বউ এর্মে খুব শান্ত আর মিষ্টি ছিল | কিন্তু বাচ্চা হয়নি বলে অর্জুন ওর থেকে পালিয়ে বেড়াত | একটা সাঁওতাল গুণী এর্মের কাছে আসত, যাকে বুব্বাই একদিন দেখে ফেলে | বকাবকির পর লোকটা বলল ও এর্মের বাবা | লুকিয়ে আসে যাতে অর্জুন না জানতে পায় | ও অর্জুনকে খাওয়ানর টোটকাটুটকি এর্মেকে দিতে আসতো | সেই ওষুধ খাওয়াতে এর্মে আসত রান্নাঘরে, সবার খাওয়া হলে |

         শেষমেশ ওরা কোথায় গেল ?

         আর, জান আসার দিন কি কাণ্ড ? সবাই রেডি বেরোবে বলে, জীপ এসে গেছে | মা বলল, “যা, ঠাম্পাকে প্রণাম করে আয় |” ঠাম্পা না ঠাকুর ঘরে পা ছড়িয়ে বসে ছিল, ঠিক যেমন আগের দিন আমাকে সাজানোর সময় | আমি গিয়ে প্রণাম করব কি উনি আমায় কোলে বসিয়ে বুকে চেপে ধরে একেবারে স্থির হয়ে গেলেন | পরে দেখি উনি কাঁদছেন | কোনও শব্দ নেই, চোখে জল নেই, শুধু ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে আরে মাঝে মাঝে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন | অনেকক্ষণ পরে মা আমাকে খুঁজতে এলে ঠাম্পা মাকে জিজ্ঞাসা করল, “একে নিয়ে যাচ্ছ ?“

         দিল্লি এসে মা বলল, “ঈশ ! তোর ঠাম্পার কান্না দেখে আঙ্গুরের আচার আর চাওয়া হল না |” শেষমেশ ওই আচারের কি হল ?


         তুমি লিখেছ, ঝিলিক যে টুকুকে বলেছিল, “এবার আমায় ঘরে নিয়ে চল |“
         কোন ঘরে ? ঠাকুর ঘরে ?
         কোথায় গেল ঠাম্পা ?
         কোথায় গেল তাঁর নামনাম আঙ্গুরের আচার ?
         কোথায় গেল সেই সুগন্ধি বহুরূপী ?

         থেকে থেকে মনে হয় সেই যে ঝিলিক দিল্লি রওনা দিল নিশ্চুপ হয়ে, তারপর থেকে একের পর এক স্টেশন এসেছে, গেছে | প্রত্যেকটা আগেরটা থেকে বেশি বড়, বেশি ব্যস্ত, বেশি ঘিঞ্জি |

         কোথায় থেকে গেল টুকু আর ঝিলিক ? কি হল রূপাখ্যানপুরের অর্জুন আর এর্মের ? কেয়ূর নদীর মাছ গুলোর ?

         তুমি নিয়ে যেতে পার না আমায়, দেখাতে রূপাখ্যানপুরের ওই বাড়ির ঠাকুর ঘর, স্লিপারের পাঁজা, করমচা আর শিউলির গাছ ?

- ইতি

সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৩

রাধারমণের পথে

|| রাধারমণের পথে ||


রাধারমণের পথে দেখেছি বাসে যেতে
বরিষণ উত্তর সতেজ হরিত শাল বীথি
হাওয়ার সোহাগে শিহরিত ধানক্ষেতে
রাঙা মোরামের এক আঁকাবাঁকা সিঁথি

যেখানে সে মেলে এসে এই রাজপথে
সেখানে রমণীয় এক কৃশাঙ্গী তন্বী তাল
সেজে পাতার খোঁপায় আর ফলের নথে
যাত্রার অপেক্ষায় যেন আছে কতকাল

দেখিনি সেখানে কভু অন্য কোন রমণী
না কোনও যাত্রী উঠে দিতে দূরে পাড়ি
অগ্রাহ্য করে তরুবালার স্মিত হাতছানি
গতির পরিচালক কভু বাঁধেনি কো গাড়ি

আমি শুধু বসে জানালায় অলস কল্পনায়
ভেবেছি কেমন হবে যদি কোনও একদিন
নেমে যাই সেই রাঙা মোরামের মোহনায়
গেরুয়া-সিঁদুর নদীতে, নাহই নাবিক নবীন

একদিন থামে গাড়ি সহসা | নামতে গিয়ে
দেখি দাঁড়িয়ে আছে কী এক অনন্যা একা
উদগ্রীব চিবুক তুলে, তার ভীরু হাত দিয়ে
ইঙ্গিতে জানায় যাবে সে,  যাত্রী পলাতকা

অধীর হৃদয়ে জাগে তীব্র তুমুল আকাঙ্ক্ষা
আবিষ্ট হই কল্পিত এক নির্যাসের সুবাসে
বুকে হাত রেখে চাপি দুরুদুরু আশংকা
যখন সে উঠে স্থান নেয় আমারই পাশে

বাহুর মৃদু স্পর্শে হয় সে লজ্জায় শিথিল
স্বর্ণাভ মুখে তার ঢলে পড়ে কিছু চুল
সামলে কপোলে তাদের দুরন্ত মিছিল
কবরীতে গোঁজে সে কিছু মহুয়ার ফুল

টিকালো নাকে তার ঘামের শিশির শয্যা
বিস্ফারিত ঠোঁট যেন দোপাটি কমলার
কম্পিত অধরে কি নব পরিচয়ের লজ্জা
পেলব নগ্ন দু’ বাহু, ঋজু শাখা লতিকার

নত, নম্র, নিস্পন্দ, নির্নিমেষ নয়নে
খেজুর পাতার মত পলকে ছাওয়া নীড়
তার অবাধ্য স্মিতহাস্য বিস্ময়ের চয়নে
আশকারার আহ্বান হয়েছে সুনিবিড়

দ্বিধায় প্রশ্ন করে, “কত দূর এই পথ?”
আমি বলি, “তুমি যেতে চাও কত দূর?”
“আমি জানিনা, নেই কোনও মতামত”
“তবে কেন চিন্তা ? পথ এখনো  প্রচুর”

পথের স্বল্পমেয়াদী পরিচয়ে করে ঋণী
আর কোনও কথা নেই, শেষ সব প্রশ্ন
পথের পাথেয় পেয়ে সাথী মিতভাষিণী
তন্দ্রায় বিলীন হয়ে দেখে দূরত্বের স্বপ্ন

সেই অবসরে জানালায় দিয়ে হানা
চঞ্চল হওয়া খেলে নিয়ে তার কাপড়
আমি ভাবি চোরা চাউনি কেন মানা
কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত গ্রীবা থাকে অবশ নিথর

যখন হওয়ায় সরে তার বুকের আঁচল
ধুপের ধোঁয়ার মতো উঠে আসে তাপ
মনের দরজায় খুলে ব্রীড়ার আগল
দেখি দুই গোলাপের কুসুম নিষ্পাপ

মাথার বুনো চুলে খেলে হাওয়ার অলি
সিঁথিতে জ্বলে অস্তগামী রোদের আগুন
ঝরে চূর্ণকুন্তল হতে স্ফুলিঙ্গ-রেণু গুলি
গালের টোলে সাজাতে গেরুয়া ফাগুন

অস্তাচলে সূর্য ধায়, এসে পড়ে রাধারমণ
যুগলবন্দী এই যাত্রায় নামাতে যবনিকা
আমার জানু ছুঁয়ে তার সোনার কাঁকন
শুধায়, “আমায় ছেড়ে যাবে কি একা?”

শুনি যেন, “বলেছিলে পথ আছে প্রচুর
সেই আশায় তন্দ্রা এলো, কাটল সময়
কেন ভাঙিয়ে তাই, করে স্বপ্ন চুর চুর
আলাপেই দাঁড়ি টান, না করে প্রণয়?”

রাধারমণ অযথা এসে চলে যায় পিছে
শুরু হয় গোধূলিতে অশেষ পথে চলা
গেরুয়া সিঁথির মোহ মন থেকে মুছে
মুঠোয় ধরি তরুবালার সোনার বালা ||

                                                  -----------------------------------------------------------------------
                                                     © ইন্দ্রনীর / ১৪ অক্টোবর ২০১৩ (বিজয়া দশমী)

বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৩

উনিশের রজনীগন্ধা





অষ্টমী / দুপুর ১:০০

জিত,



ছড়া করে লিখছি | তুমি রাগ করবে না, আমায় রাগাবেও না, লক্ষ্মীটি !


---

জানো কি , আজ আমি ভোগ খেতে যাইনি ?
বাড়ির সবাই গেছে, আমি বুকে সাহস পাইনি
কেন যে লাগে একা, ভিড় যখন খুব প্যান্ডেলে
অঞ্জলি দিয়ে ফিরেছি তাই কোন সাত সকালে
এসে থেকে আমি শোওয়ার ঘরে জানলা ধরে
জাবর কেটেছি গত পুজোর অষ্টমী মনে করে
ভেবেছি এই, যে, কী ভাবে কাটল একটা বছর
নতুন কী ঘটেছে, কী আছে লেখার মত খবর
তাই বুঝি চিঠি লিখি না তোমাকে সচরাচর
---


তুমি কি ভোগ খেতে গিয়েছিলে? মা আর বাবা দুজনেই খুব জোর করলো, “সে কী, অষ্টমীর দিন তুই ভোগ খেতে যাবি না?” বললাম, “আমার উপোষ করে গা গোলাচ্ছে, দুপুরে কিচ্ছু খাবো না |” মা বলেছিল থেকে যাবে, আমি জোর করে পাঠিয়েছি, নিরিবিলিতে তোমায় লিখতে, যে কথা মুখোমুখি বলতে পারি না |

---
সত্যি বলছি ! জানি তুমি বিশ্বাস করবে না এটা
যে, তোমার দেয়া সেদিনের সাদা বড় চকলেটটা
যেটা বটুয়ায় তুলে রেখেছিলাম, পরে খাবো বলে
ভুলেও ভেবো না করছি এই উপোষ ওই সম্বলে
ওটা বের করে ক’দিন ধরে দেখেছি, হয়েছে লোভ
করেছে প্রতারণা আমার নতুন ডায়েটিং এর ক্ষোভ
তাও, এক সাথে খাব বলে তুলে রেখেছি ধৈর্য ধরে
লালপেড়ে তাঁতে, তোমার প্রিয় বাদামী লিপস্টিক পরে
আলতো দাঁতে ধরব যখন চকলেটের ছোটো টুকরো
কটা ছবি তুলো ; একটা আমার মুখের ক্লোসআপেরও 


মা’রা সবাই খেতে চলে গেলে, আমি শুলাম বিছানায়
কী লিখব, কী লিখব না, এই নিয়ে বিভ্রান্ত ভাবনায়
কিছু পরে উঠে গত অষ্টমীর তাঁতের সাদা শাড়িটা
বের করে দেখি শূন্য লাগছে তার খোলের বাড়িটা
নিচের লাল পাড়ের কাছে একটু জেদি এঁটেল মাটি
করেছে নষ্ট নিষ্কলঙ্ক শাড়ীর সাদা জমির পরিপাটি
তবুও কেন টান বোধ করলাম বুকের দু’ কোরকে
সযত্নে খুঁটে রাখলাম ওটা নীল কাগজের মোড়কে
মায়ের পুজোয় শুনেছি লাগে নানা দুয়ারের মৃত্তিকা
কোন দ্বারে পেয়েছি এ মাটি আমি, শিঞ্জিনী-বালিকা
---


শাড়িটা দেখতে দেখতে কতক্ষণ জানি না তন্ময় হয়ে ছিলাম  ...

---
শিরশির করে উঠতে অনাবৃত নগণ্য আমার শরীরটা
অন্তর্বাস বাদ দিয়ে পরলাম ব্লাউজ, জড়ালাম শাড়িটা
অবশেষে লিখছি চিঠি খালি গায়ে জড়িয়ে তাঁতের খোল
লিখতে সে কথা যা লজ্জায় করছে কোলাহল উতরোল


উপুড় শুয়ে দেরাজের আয়নায় করে নিজেকে নিরীক্ষণ
দেখলাম অন্তর্বাসটা, কতদিনের সেই ছোট্ট এক আবরণ
মা কে এ’ কথা জানাতে, বলল, “দাঁড়া, একদিন মা হবি”
কিন্তু কিছুতেই মনে ফোটে না সে অনাগত যৌবনের ছবি


কোন মা ? আমার ? না, যাকে অঞ্জলি দিয়েছি সকালে ?
প্রথম মা রোজ বুড়ি হচ্ছে, দ্বিতীয় স্থায়ী চিরযৌবন কালে
হতে চাই সেই মায়ের প্রতিমা, নিষ্কাম শিশুর কৌতূহলে
কাঁচা বয়েসে তুমি যাকে মৃন্ময়ী রূপে পূর্ণযৌবনা দেখেছিলে


এই সব ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে নিঃশব্দ হালকা পায়ে
তোমাকে চিঠি লেখার ঘোর এলো ঘিরে সমস্ত স্বত্বা ছেয়ে


প্রথম থেকেই যখনই তোমাকে চিঠি লিখতে আমি বসি
দেখি কেন যেন অনেকক্ষণ মন মানে না বশের রশি
তারপরে একটু একটু করে এই দুর্বার জোয়ার আসে
খরস্রোতায় ভেসে যাই আমি ; একা নই, তুমি পাশে
আমি লিখি, আর তুমি বসে বসে দেখো আমার লেখা
আমার মাথার পিছন থেকে, যত দুর্বোধ্য মসী-রেখা
মাঝে মাঝে আমার ঢলে পড়া খোলা চুলের অসভ্যতা
সামলাতে তুমি মাথায় রাখ ঈষদুষ্ণ আলতো পাতা
দাও ঠেলে উড়ো চুল গুলো কানের পিছনে বনবাসে
লাজুক লতি হয় স্পর্শে কাতর, আঁখি ঢলে আলস্যে


ঘোরটা তখন যদি আমাকে আরও অবশ করে তোলে
যদি খুব লাগে বিভ্রান্ত, যদি লিখনের বৃত্তান্ত যাই ভুলে
চিত হয়ে শুয়ে তোমার মুখের দিকে থাকি ঠায় তাকিয়ে
মনে হয় তুমি হয়ত বলবে আমায় বড় বড় আঁখি দেখিয়ে
“পড়ছিলাম তুমি কী লিখছ | আগে  চিঠিটা শেষ করো !”
বলতে পারি কি, “তুমি আগে আমায় একটু চেপে ধরো” ?
---



আমি আয়নায় দেখছি - উপুড় হয়ে শুয়ে দু’ পা তুলে, গোড়ালি জোড়া করে, পা দোলাচ্ছি, পায়ের নূপুর গুলো উঠছে পড়ছে | আয়নার ছায়ায় তোমার পিছনে এই সব ঘটছে | তুমি আমার  পাশে বসে চিঠি দেখতে এতো ব্যস্ত যে দেখছও না, আমার পায়ের গোছ, আমার নূপুর পরা গোড়ালি, আর আলতা মাখা পায়ের তলা | আজ আমি আলতা পরেছি, ভারী মিষ্টি লাগছে | আলতা পরে শাড়ি তুলে পা শুকাতে শুকাতে মনে পড়ল -


---

এইতো সেদিন, তবু মনে হয় যেন কতো যুগ আগে
বৃষ্টি পড়ছে, তুমি আমার অপেক্ষায় গুলমোহর বাগে
মিনিবাস থেকে নামলাম কাদায়, শাড়িটা একটু তুলে
দৌড়ে এসে তুমি আমার সে হাতই ধরলে প্রচ্ছন্ন ছলে
ফুটপাথে উঠে বললে, “শাড়িটা এখনই নামিও না”
চমকে তোমার চোখে দেখলাম নির্দোষ মিনতির বন্যা
থতমত খেয়ে বললে তুমি, “চারিদিক জলে জলাকার”
বুকে উঠলো বেজে প্রতিধ্বনি আকাশেতে মেঘ ডাকার
---


আমি যেতে যেতে, থেকে থেকে, জানতে চাইলাম কেন | তুমি চুপ করে থেকে বললে ...  অনেকক্ষণ পরে ...

---
“রজনীগন্ধার গোছা দেখেছি আজ, জলে ভেজা বিপন্ন”
বললাম অবাক হয়ে, “কেন তবে কেন নি আমার জন্য ?”
রহস্যময় হাসি মেখে তুমি বললে, “না, আজ ছেড়ে দাও
সে যে বাঁধা রুপোর নিগড়ে | চলো, শাড়ি ঠিক করে নাও”
তারপরে কী হল যে জানিনা, তুমি হটাত চুপ করে গেলে
আর কোনও কথা বল নি, যত কথাই সাজিয়েছি ঢেলে
তুমি শুধু এক দু’টো হুঁ-হাঁ করেছ, বল নিকো আর কথা
শেষে বাসে ওঠানোর সময় ভাঙ্গলে সেই পাথরের নীরবতা
বললে, “আবার যেদিন বৃষ্টিতে তুমি নামবে মিনিবাস থেকে
চোখে ভরে নেব তোমায়, এক জোড়া রজনীগন্ধার স্তবকে”
ঠিক তখনি মিনিবাস এলো, উঠলাম নিয়ে তোমার হেঁয়ালি
চটি খুলে পা তুলে বসলাম ছড়িয়ে, পেয়ে সীটটা পুরো খালি
ভাবলাম তোমার অসংলগ্ন কথা, ছাড়াতে নূপুরের কাদামাটি
তুমি কি জানতে পেরেছিলে আমার মনের অলঙ্ঘনীয় ‘না’ টি ?
---

তুমি আমার পায়ের গোছের কথা বলেছিলে, না ? ছি ! বেশ হয়েছে, এখন তুমি তা দেখতে পাচ্ছ না, আমি নিশ্চিন্তে পা দুলিয়ে চিঠি লিখছি | 

(... চকলেটটা খাই কি ? ... না, থাক ওটা !)

এখন রাখি, একটু চোখ বুজি | ঘুম তো আসবে না, কিন্তু এই ঘোরেই শুয়ে থাকব মা’রা বাড়ি ফেরা অব্দি | এই ঘোরটাই করেছে মুশকিল | এটা লুকাতেই তো মা, বাবার থেকে দূরে দূরে থাকছি সেই সকাল থেকে | মা এখন আমার মুখ দেখলেই বলবে, “কী হয়েছে তোর ? জিত ফোন করেছিল ?”

তুমি প্যান্ডেলে গিয়েছিলে ? বিশেষ কিছু তেমন দেখলে?
আচ্ছা, মনে আছে তো এই আমার আজকের বিশেষ শেষ দিনটা ?

তোমার ইতি

***

নবমী / ভোর ১:৩০

ইতি,
আজ সারাদিন ঘুরে একটু আগে ফিরেছি | ভেবেছিলাম শুয়ে পড়ব, এত ঘুম পেয়েছিল | তখন মনে পড়ল, ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে দেখব মেইল আছে কিনা | আর দেখলাম তোমার মেইল | একবার মেইলটা পড়ে, জামা কাপড় ছেড়ে আবার পড়লাম |

ক্লান্তির আবেশে তোমার অতল মনে ডুবে যেতে যেতে স্বপ্নের মতো মনে হল যেন আমরা প্যান্ডেলে গিয়েছি | তুমি বললে, “একটু আসছি, মাকে প্রণাম করে |” তারপর কোথায় চলে গেলে, আমি কতক্ষণ অপেক্ষায় রইলাম | একবার প্রতিমার সামনে গিয়ে মেয়েদের ভিড়ে তোমাকে খুঁজলাম | কোথাও তুমি নেই | কী করি ভাবছি, তখন তোমার মেসেজ পেলাম, তুমি বাড়ি ফিরেছ আমায় বসে চিঠি লিখতে | কী বলার ছিল ? চিঠিতে তো লেখ নি |

আচ্ছা, তুমি কি রাগ করবে, যদি বলি তুমি চলে যাওয়ার পর আমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে মেয়েদের মুখে, প্রতিমার শরীরে তোমাকে খুঁজেছি ? এখন খুঁজছি তোমার চিঠিটার দিকে তাকিয়ে |

কেন খুঁজছি ? ... তুমি ‘আসছি’ বলে চলে যেতে একটা নিচু করে বাঁধা বাঁশের বেড়ার উপর শাড়ি আলগোছে তুলে পার হলে যখন, আমার তখন মনে পড়ে গেল ঠিক করেছিলাম তোমায় দেখাব, দেখানো হয় নি, মায়ের সাজে রজনীগন্ধার স্টিক, ঠিক বর্ষার জলে ভেজা তোমার পায়ের গোছ দেখেছিলাম যে রকম | এখন সেই কথা মনে পড়ছে, আর ভাবছি,

---
যখন তোমার ঘোর আসে, সাজের আয়নায়, আমার পাশে
উপচিয়ে কোরকের কাঁচুলি, বিলাও তুমি আতর আহেলি
উপুড় হয়ে দুলিয়ে নূপুর, লেখ যত আবোলতাবোল মধুর
হারিয়ে আমি সকল পুঁজি, উদ্ভ্রান্ত হয়ে তোমায় খুঁজি
মায়ের তিন তারায় দেখি, নেই তুমি, সব লাগে মেকী
কোথায় গুলমোহর বাগ, কোথায় সে মেঘমেদুর সন্ধ্যা ?
কোথায় তুমি আড়াল করেছ আমার সে দুই রজনীগন্ধা ?
---

যাচ্ছি এখন, লুকিয়ে যেতে ঘুমের কোলে |
তুমি কি বাদামী লিপস্টিকটা পরেছিলে আজ ?
ঘুম থেকে উঠে দেখো, তোমার বালিশের পাশে পাবে একটা সাদা চকলেট,  আর ফুলদানিতে রজনীগন্ধা, আগত কৌমার্যের সংবর্ধনায় |
প্রমিস!
(প্লিজ একটু বেলা অব্দি শুয়ে থেক ! ফোন করে ভোরে উঠিয়ে আমায় ছুটিয়ো না !)

জিত

***

নবমী / সকাল ১০:৩০

জিত,
কী অপ্রস্তুত ই তুমি করলে আমায়, সকাল সকাল !

একটু আগে মা ঘুম থেকে তুলে বলল, “ওঠ এবার, তোর না আজ জন্মদিন ! জিত এসেছিল | তোর জন্য রজনীগন্ধা আর চকলেট নিয়ে | তুই ঘুমচ্ছিস দেখে রেখে গেছে |”
আমি বললাম, “কিছু বলল ?”
মা বলল, “ছেলেটা একটু অদ্ভুত | আমায় কাছে সুতো চাইল | দিলাম | নিয়ে রজনীগন্ধার গোছাটা খুলে দুটো আলাদা গোছা করলো, ফুলদানিতে রাখল | আমি কেন জানতে চাইলে বলল, ইতি কে জিজ্ঞাসা করবেন | হ্যাঁ রে, ফুলদানি তো একটা, দুটো গোছা করে রাখার কী দরকার ?”

শোনো ! তুমি আর আমায় এই পুজোয় পাচ্ছ না | চকলেট দুটো আমি বন্ধুদের সাথে ভাগ করে খাব | তুমি দূরে থেকো | এটা তোমাকে সংযত করার জন্য, বুঝেছ ?

(মা বলছিল, “অষ্টমীর শাড়িটা পরে একদিন ও বেরলি না |” তুমি কি দশমীর দিন আসবে বিকেলে ? দুজনে গুলমোহর বাগে গিয়ে লেকের জলে বিসর্জন দেব ওই কাদামাটির নীল মোড়কটা | আর জলে পা নামিয়ে ডোবাবো রজনীগন্ধা জোড়া | জিজ্ঞাসা কর না কোনটা, প্লীজ !)

(আর তোমার নই)
ইতি




-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ষষ্ঠী- ১০ অক্টোবর ২০১৩

সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৩

শতরূপা

|| শতরূপা ||


কি হবে পুজোর দিন যদি প্যান্ডেলে না যাই
গড়িমসি করে দিন না হয় বাড়িতে কাটাই
খুঁজে বার করে কোনো পুরানো পুজোসংখ্যা
মিটাই অনেক দিনের সুপ্ত পড়ার আকাঙ্ক্ষা
বারান্দায় ইজি চেয়ারে এলিয়ে ক্লান্ত শরীর
পাই একটু রোদ একটু ছায়ার আমেজ গভীর
রোমে রোমে ভরে নিয়ে, টেনে গভীর শ্বাস
ফিরে পাই, হারানো, ফিরে পাওয়ার আশ্বাস

একটু জিরিয়ে নিই, অনেক পথ চলেছি
কথার পিঠে অবান্তর কথা কতো বলেছি
অনেক গিয়েছি প্যান্ডেলে, দেখেছি প্রতিমা
আজ তোমার মুখ মনে পড়েনা কেন, মা ?
হে রূপসী, নিত্য কি তোমার রূপ বদলায় ?
কেন তুমি অন্তরঙ্গ হয়ে নাও আবার বিদায় ?
স্মৃতির বিশাল পটে আছে আঁকা কত ছবি
মুছে গেছে শুধু শৈশবের মায়ের পৃথিবী
ঝাপসা স্মৃতি আর মানে না মনের কাকুতি
অদৃশ্যে ছুপায় তোমার করুণার অনুভূতি

তাই একটু বসি না করে কোনো আয়োজন
থাকি অপেক্ষায়, এবার যেতে শেষ বিসর্জন
বছরে এই চারটে দিন না কাটিয়ে কোলাহলে
শান্তিতে সারাটা বছর খেলতে তোমার কোলে
দেখতে তোমার সব রূপ বয়ঃসন্ধির আঁখিতে
স্মৃতির চিত্রপটে এক এক করে সব আঁকিতে
বালিকা, কিশোরী, প্রেয়সী, বঁধু, মাতা, কন্যা
শতরূপা এসো মা তুমি, মোর রূপসী অনন্যা ||

-------------------------------------------
 ইন্দ্রনীর / ০৭ অক্টোবর ২০১৩

কবিতা



|| কবিতা ||

যতই লিখেছি কবিতা, তোমার মনের কথা জানতে 
ততই ক্রমশ সরে গেছ তুমি, গোধূলি থেকে দিনান্তে 
তাদের চিন্তায়, কিম্বা আবেগে, ছিল কি কিছু কম ? 
লিখেছি শুধুই নিজের কথা, এই মাত্র যে আমার ভ্রম  

যৌবনের প্রেম, আশা আকাঙ্ক্ষা, এবং আত্মচিন্তা 
অস্তিত্বের প্রতিবিম্ব যেন এক আশ্চর্য মায়া দর্পণে 
নিজেরই অন্তঃসত্ত্বার প্রতিচ্ছবি কেন যে আত্মহন্তা 
নিজের মৃত্যুদণ্ড লিখি কলমে অহংকারের কর্ষণে

জানাতে তোমাকে লিখি চিঠিতে আমার ফরিয়াদ 
চাখাতে তোমাকে আমার অসাফল্যের তিক্ত স্বাদ 
ভাবো তুমি বুঝি এসব আমার প্রেমের আখ্যান 
চিঠির ধারা আধো-আধো বুঝে করো প্রত্যাখ্যান  

যদি না পড়ে চিঠি, শুধু রাখ বুকের মাঝে ধরে 
তার অনুরাগ দেবে চুম্বন তোমার গর্বিত অধরে


ইন্দ্রনীর / ০৭ অক্টোবর ২০১৩

অবনী, বাড়ি আছো ?

|| অবনী, বাড়ি আছো ? রাত ক’টা ? ||


“অবনী, বাড়ি আছো ?” নেই কোনও সাড়া
সবাই মিলে বন্ধ দরজা ধরে যতই নাড়ি কড়া
আধ-খোলা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে গুপী
কয়, “অবনী ফিতে কিছু করছে মাপা-মাপি !”

খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে ছেলে বলে, “শুনছেন ?
এটা কিন্তু আপনাদের একটু ভুল কোশ্চেন !
যাই হোক, বাবা তৈরি করছেন উত্তরটাকে |”
শুনে আশ্বস্ত হয়ে সবাই বসলাম রোয়াকে

একটু পরে ফিতে হাতে নিয়ে বেরুলো অবনী
ঘর্মাক্ত তার কলেবর আর উত্তেজিত সব ধমনী
“প্রশ্নটা হইবে, ‘অবনী, বাড়িয়াছ ?’ ” এই বলে
ফিতে ধরল নিজের বুক ঘিরে, চেপে দুই বগলে

বলল, “ছাতির মাপ হইল বিয়াল্লিশ, এক্চ্যুয়ালি |
তাহা বাড়িয়া হয় তেতাল্লিশ, যে দিন লৌহ তুলি |
যদি না করি বগলের ক্ষৌরকর্ম সকাল সন্ধ্যায়
তবে আর এক-আধ সিকি ইঞ্চি যোগ করা যায় |”

একথা শুনে কারো মাথায় হাত, কারো কপালে
ভাবি নি অবনী করবে বাজিমাত রাত বেশি হলে |


------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৭ অক্টোবর ২০১৩

পত্রাদি

|| পত্রাদি ||


যতই লিখেছি কবিতা, তোমার মনের কথা জানতে
ততই ক্রমশ হারিয়েছ তুমি, গোধূলি থেকে দিনান্তে

তাদের চিন্তায়, কিম্বা আবেগে, ছিল কি কিছু কম
লেখা শুধু নিজেরই কথা – এই মাত্র কি আমার ভ্রম

যৌবনের প্রেম, আশা আকাঙ্ক্ষা, এবং আত্মচিন্তা
অস্তিত্বের প্রতিবিম্ব যেন এক আশ্চর্য মায়া দর্পণে
আত্মজ সত্ত্বার অলীক প্রতিচ্ছবি কেন যে আত্মহন্তা 
নিজের মৃত্যুদণ্ড লেখে কলমে, অহংকারের কর্ষণে

জানাতে তোমাকে, লিখি চিঠিতে, আমার ফরিয়াদ
চাখাতে তোমাকে আমার অসাফল্যের তিক্ত স্বাদ

ভাবো তুমি বুঝি এসব আমার ভালবাসার আখ্যান
চিঠির ধারা আধো-আধো বুঝে, করো যে প্রত্যাখ্যান

তুমি যদি চাও, আমি না হই পাপী, না হই আত্মঘাতী
না চাও হতে মনোবিকলনে আমার শেষযাত্রার সাথী

না পড়ে পত্রাদি, শুধু রেখ তাদের বুকের মাঝে ধরে
নিষিক্ত করে, চুম্বনে ছুঁয়ে, তোমার কুমারী অধরে ||


------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ০৭ অক্টোবর ২০১৩

শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৩

অব্যর্থ বিদায়ী

|| অব্যর্থ বিদায়ী ||


ছেলেবেলার পুজো ছিল যেন অন্য সময়
অনিবার্য মহালয়ার ভোরে নদীতে প্লাবন
আকাশে ঝুঁকে থাকা মেঘের মূকাভিনয়
আভাসে জানাত যে পুজোয় হবে বরিষণ

তখন নতুন জামা গুলো অকাজের মাঝে
করে আধো পরিধান, চুপি, অতি সন্তর্পণে
মুড়িয়ে রাখতাম তাদের বিশৃঙ্খল ভাঁজে
আলমারির একই তাকের নির্দিষ্ট কোনে

রাতে বালিশের পাশে রেখে জুতো জোড়া
ঘুমের ঘোরে শুঁকতাম নতুন চামড়ার গন্ধ
শারদীয়া শিশু-সংখ্যা, পাতা রহস্যে মোড়া
চোরা চোখ বুলিয়ে, বই করতাম ফের বন্ধ

স্কুলে খুব হইচই কার ক’টা কাপড় নিয়ে
কুলাবে কি কুলাবে না পুজোর কটা দিন
কারো এক কাপড়ের ছিটটা ‘অদ্ভুত ইয়ে’
কোনদিন সে পরবে সেটা, সে প্রশ্ন সঙ্গিন

তারপর আশ্চর্য ভাবে পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর দিন
ঘুম ভেঙ্গে অনুভূত, এক আনন্দ অনির্বাণ
বাইরে রোদের ছটার তেজ আমেজী ক্ষীণ
নেইকো আকাশে মেঘ, নেই নদীতে বান

তখন বুকের ভিতর লাফ দিয়ে জোড়া পায়
উচ্ছ্বাস, উল্লাস সব সেই মুহূর্তেই ধরাশায়ী
মন কেমন করা এ এক বিয়োগান্ত ভাবনায়
‘শুরু হলেই পুজো শেষ ; অব্যর্থ এ বিদায়ী’  ||


-----------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৫ অক্টোবর ২০১৩

মেঘের বিরহে

|| মেঘের বিরহে ||


আজ আকাশে মেঘদের ফেরার পালা
কে যেন ওদের ভুলে দিয়েছে ছুটি
একদা জটিল, ধূসর, পুঞ্জ মেঘমালা
হয়েছে ছত্রভঙ্গ, ছত্রাকার কুটি কুটি |

বর্ষার পাঠশালে গুটিয়ে পাততাড়ি
ঈশানী প্রবাস থেকে নৈর্ঋত দেশে
সাগরিকা নভ চারী ফিরছে বাড়ি
ঝেড়ে পাখনার জল, রিক্ত বেশে |

ফিরে যেতে অস্থির, প্রবল গতিতে
উৎসুক ডানা তারা ভাসিয়ে হাওয়ায়
ঝকঝকে নীলাকাশে আগত শরতে
লেপে স্বর্ণাভ
রোদ, রুপালী চূড়ায় |

তারই মাঝে মুক এক বেদনার রেশ
মূর্ছনা যার হাওয়ার ত্রস্ত স্পন্দনে
যেন কিছু হারানোর অব্যক্ত ক্লেশ
বিলুপ্ত অশ্রুহীন, প্রশমিত রোদনে |

মেঘেতে মেঘের ছায়া, তার কিনারে
বন্দী আলোক অলীক ছায়ার মায়ায়
যার কারাগার ওই মেঘের মিনারে
মেঘের অলিন্দে যার আঁধার ঘনায় |

আসে যায় যাযাবর মেঘমেদুর দিন
কাটে জীবন আলো-আঁধারির মোহে
করে মেঘাত্যয়ের
এই ঔজ্জ্বল্য মলিন
বিকিরণ ডুকরে কাঁদে মেঘের বিরহে |

ইন্দ্রনীর / ০৫ অক্টোবর ২০১৩