শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০১৫

গঙ্গাপ্রাপ্তি

|| গঙ্গাপ্রাপ্তি ||


(অভিধান অনুযায়ী, গঙ্গাপ্রাপ্তি শব্দটি সাধারণ অর্থে মৃত্যু, ও বিশেষ অর্থে গঙ্গাতীরে বা গঙ্গাজলে মৃত্যু, জ্ঞাপন করে)

বহুকাল পূর্বের কথা  | সেই কালে, বঙ্গের শহরে গ্রামে স্থানীয় নদীকে, সে যে নদীই হউক, চলিত কথায় গঙ্গা বলা হইত (যথা, “যাই গঙ্গায় নাই করে আসি”) | কিন্তু, অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও সচ্ছল মানুষের মনঃপুত ছিল না যে তাহার মৃত্যু হইলে, ওই স্থানীয় গঙ্গাতীরেই তাহার অন্তিম সংস্কার করা হউক | অতি দরিদ্র মানুষ ব্যতিরেকে যে কেহই কিঞ্চিত অর্থ কিম্বা প্রতিপত্তি লাভ করিত, সে কামনা করিত যে তাহার অন্তিম সংস্কার যেন প্রকৃত গঙ্গাতীরে নির্বাহ করা হয় | এই উদ্দেশ্যে প্রকৃত গঙ্গা নিকটবর্তী না হইলে, স্থান বিশেষে অদূরবর্তী হুগলী নদীকেই গঙ্গা রূপে গণ্য করা হইত | হেন কারণে, হুগলী নদীর আশেপাশের বহু শহর কি গ্রাম হইতে মৃত ব্যক্তির মরদেহ হুগলী নদীতটে আনিয়া দাহকার্য, জলে অস্থি বিসর্জন ইত্যাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করিবার প্রথা প্রচলিত ছিল |

এইরূপে, মায়াপুর গ্রামের হরিসাধন বাবুর মৃত্যু হইলে, গ্রামের পাঁচজন মনস্থ করিল, তাঁহার গঙ্গাপ্রাপ্তি করানো হইবে | তিনি দেবতুল্য মানুষ ছিলেন | গ্রামের দুর্গা পূজা বাবদ অর্থ ব্যয়ে ও অন্যান্য দীন দুঃখী সেবায় সকলের চক্ষে সম্মান শ্রদ্ধার পাত্র হইয়াছিলেন | সুতরাং তিনি ব্যতীত আর কে হইতে পারে মরণোত্তর গঙ্গাপ্রাপ্তির যোগ্য ? মায়াপুর হইতে সর্বাপেক্ষা নিকটস্থ হুগলী নদীর তটবর্তী শহর বৈরামগঞ্জ দশ – বারো ক্রোশ দূর | একটি মাত্র মোটরবাস, এই দূরত্ব যাইতে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা লয় – কেন না পথের বেশ কিছু অংশ পাকা নহে | উপরন্তু, গাড়িটি যাত্রী উঠাইয়া, নামাইয়া, থামিতে থামিতে যায় | কিন্তু, যথেষ্ট অর্থের প্রলোভন দেখাইয়াও ওই গাড়ির চালককে মৃতদেহ বহন করিতে সম্মত করানো গেল না | ওদিকে বর্ষা প্রায় সমাগত | আবহাওয়া মোটেই মৃতদেহ রক্ষণের উপযুক্ত নহে | তখন গ্রামের সর্বজ্ঞ পান্নালাল ঘোষ বাবু, পানু খুড়ো নামে জনপ্রিয়, প্রস্তাব করিলেন যে মরদেহ কাঁধে লইয়া বৈরামগঞ্জ যাওয়া হইবে | পানু খুড়ো আরও জ্ঞাপন করিলেন যে, যাহারা মৃতদেহ বহনে স্কন্ধ দান করিবে তাহারাও ওই পুণ্যবলে গঙ্গাপ্রাপ্তির ভাগ্য অর্জন করিবে |

গ্রামে হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল | কার্যত দশ জন সক্ষম তরুণ শববাহক পাওয়া গেল, যাহাদের উৎসাহের কোনও অন্ত নাই | কারণ, তাহারা ইতিপূর্বে বৈরামগঞ্জ কি, কোনও শহরই দেখে নাই | পানু খুড়ো তাহাতে বিশেষ বিস্মিত হইলেন না, কেন না তাঁহার এই প্রস্তাবের কারণ স্বয়ং তিনিও এই সুযোগে বৈরামগঞ্জ শহর দেখিয়া লইবেন | রক্ষা এই যে, এই সব পুত্রসম তরুণদের মধ্যে কেহই সেই গুপ্ত উদ্দেশ্য টের পাইবে না |

পরদিন অতি প্রত্যুষে, দলটি ‘বল হরি, হরি বোল’ রবে গ্রাম মুখরিত করিয়া বৈরামগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল | সাথে চলিল একটি গরুর গাড়ি, দাহ কার্যের জন্য কাষ্ঠ ও কিছু রন্ধনের সামগ্রী লইয়া | এই প্রান্তিক গ্রাম হইতে বহির্জগতে যাইবার একমাত্র পথটি বৈরামগঞ্জ শহরের দিকে গিয়াছে বটে | কিন্তু সেই পথে কিছু দূর যাইলেই একটি করিয়া গ্রাম আসে, ও পথটি বিভক্ত হইয়া এদিক ওদিক চলিয়া যায় – কিছু গ্রামটির ভিতর দিয়া, কিছু গ্রামটির বাহিরে বাহিরে | পাছে শববাহকরা ভুল পথে সময় ও শক্তির অপচয় করে, সর্বাগ্রে পানু খুড়ো দৃঢ় পদক্ষেপে পথ দেখাইতে দেখাইতে চলিলেন | প্রতিটি গ্রামে, মোটরবাস কোন পথে বৈরামগঞ্জ যায় এই প্রশ্ন করিয়া পাঁচ দশ গ্রামবাসীর মতামত লইয়া নিশ্চিত হইয়া শববাহকদিগকে পথ প্রদর্শন করেন | ইত্যবসরে শববাহকরা কাঁধ-বদল করিয়া, কিম্বা শব নামাইয়া রাখিয়া, যথাসম্ভব বিশ্রাম লয় | এইভাবে থামিয়া থামিয়া শবযাত্রা অগ্রসর হইল |

দ্বিপ্রহর হইলে একটি গাছের নিচে শব নামাইয়া সিদ্ধ-পক্ব ভাত রাঁধিয়া খাওয়া হইল | পানু খুড়ো সকলকে আশ্বাস দিলেন যে সন্ধ্যা নাগাদ বৈরামগঞ্জ পৌঁছানো যাইবে | কিন্তু সন্ধ্যা হইলে জানা গেল শহরে পৌঁছাইতে আরও ঘণ্টা দুই লাগিবে | সন্ধ্যা ঘোর হইয়া আসিলে দূরে শহরের আলো দেখা দিল | ক্লান্ত যুবকরা হৃত উৎসাহ ফিরিয়া পাইয়া পদচালনা দ্রুততর করিল | তথাপি, বৈরামগঞ্জ পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে সময় নবম প্রহর পার হইল | শ্মশানের খোঁজ পাইতে বিশেষ পরিশ্রম করিতে হইল না | শহরে প্রবেশ করিয়াই গঙ্গার পার্শ্বে যে বড় রাস্তা পাওয়া গেল তাহার শুরুতেই “জাগ্রত-কালী” শ্মশান, বাম হস্তে রাস্তা ও দক্ষিণ হস্তে গঙ্গার মধ্যবর্তী | প্রচুর প্রাচীন বৃক্ষের বাগানে সংলগ্ন জাগ্রত-কালীর মন্দির, ও তাহার পার্শ্বেই নদী তীরে শবদাহ করিবার স্থান | কিন্তু কালী মন্দিরটি ততক্ষণে বন্ধ হইয়া গিয়াছে | যে একটি মাত্র ডোমের দেখা পাওয়া গেল সেও স্বগৃহে ফিরিবার প্রস্তুতি করিতেছে | সে জানাইল যে শেষকৃত্য সম্পন্ন করিবার পুরোহিত মহাশয় নিদ্রা গিয়াছেন | আগামীকাল সকালের পূর্বে কোনও দহন কার্য সম্ভব নহে | ততক্ষণ শববাহকরা মন্দির প্রাঙ্গণে রাত্রি যাপন করিতে পারে | তবে লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে কোনও জন্তু যেন মৃতদেহ আক্রমণ না করে | এই কয়েকটি কথা বলিয়া ডোম বিদায় লইল |

ইতিমধ্যে অমাবস্যার অন্ধকারে অজান্তে মেঘের সঞ্চার হইয়া গুমোট গরম ধরিয়াছিল | সহসা সেই নিশ্ছিদ্র নিকষ কালো শামিয়ানা বিদীর্ণ করিয়া মুহুর্মুহু হুঙ্কার সহযোগে বিদ্যুৎ ঝিলিকের অসিযুদ্ধ শুরু হইল, এবং আর্দ্র শীতল বাতাসের ঝটিকা আশু ঝড়-বৃষ্টির অগ্রিম আভাস দিল | পানু খুড়ো সকলকে তাড়া দিয়া মৃতদেহটি মন্দিরের চত্বরে রাখিয়া চতুর্দিকে প্রদীপ জ্বালিয়া রাখিবার ব্যবস্থা করিলেন | লন্ঠনের আলোয় অনুসন্ধান করিয়া নিকটেই একটি তেঁতুল গাছের পাদদেশে একটি পূর্বে ব্যবহৃত উনুন পাওয়া গেল | চটপট কাষ্ঠ জ্বালাইয়া রন্ধনের ব্যবস্থা করা হইল |

চারিদিক নিস্তব্ধ | সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শববাহক যুবক সকল কেহ কথা কহিতেছে না | কেবল উনুন হইতে প্রজ্বলিত কাঁচা কাষ্ঠ ফাটিবার ফুটফাট শব্দ শোনা যাইতেছে | এমন সময় দূর হইতে বিলম্বিত লয়ে ক্যানেস্তারা কর্তনের কর্কশ শব্দের ন্যায় একটি গোঙানির আওয়াজ বাতাসে ভাসিয়া আসিল | দূর হইতে আগত সেই নির্ঘোষ ক্ষীণ হইলেও এত সুস্পষ্ট ও জান্তব যে মনে হইল যেন কোনও জন্তু করাতের মত দাঁত দিয়া অসম্ভব কঠিন কোনও জিনিস কাটিতে চেষ্টা করিতেছে | সচকিত হইয়া সবে একে অপরের দিকে চাহিল | কিন্তু, পর মুহূর্তেই নিস্তব্ধতা বিরাজ করিলে কান পাতিয়াও কেহ বিশেষ কিছু বুঝিতে পারিল না | কেবল সমর, শববাহকদিগের একজন, প্রশ্ন করিল, “পানু খুড়ো, ওটা কিসের আওয়াজ ছিল ?” পানু খুড়ো এইরূপ শব্দ পূর্বে কখনও শুনেন নাই | কিন্তু কোনরূপ অনভিজ্ঞতা স্বীকার করা তাঁহার আত্মসম্মানে বাধে | তিনি মনে মনে কিছু উপযুক্ত উত্তরের মুসাবিদা করিতেছেন কি, সহসা অতি নিকট হইতে সেই বিকট আর্তনাদ আবার শোনা গেল – মূহুর্মূহু, একের পর এক, কতিপয় উৎস হইতে | মনে হইল যেন কেহ বা কাহারা মস্ত বড় কোদাল দিয়া বিশাল জালার বাহিরে ও ভিতরে চাঁছিয়া শব্দ করিতেছে | সমর কহিল, “এ তো মনে হয় কোনও ভয়ঙ্কর জন্তু ...” তাহার মুখের কথা কাড়িয়া সুবল কহিল, “বাঘ নয় তো ?” কিন্তু হলধর, যাহার শ্রবণশক্তি কিঞ্চিত ক্ষীণ, সে দৃঢ় বিশ্বাসে কহিল, “বাঘ নয় | মনে হয় ওগুলো ফেউ, গঙ্গার ওপারে খাওয়া-খাওয়ি করছে |” দৃঢ় পণ সমর প্রশ্ন করিল, “ওপারে ফেউ বলে কি এপারে বাঘ চরতে পারে না ?” হলধর কহিল, “না, তা সম্ভব নয় |”

এই সব গ্রামবাসী জীবনে গবাদি পশু, কুকুর কি শৃগাল ব্যতীত অন্য কোনও জন্তু দেখে নাই | হলধরের বরাভয় সমাপ্ত হইবামাত্রই শ্মশানের ঠিক বাহিরে পাকা রাস্তার উপর ঠকঠক শব্দ করিয়া যেন কোনও চতুষ্পদ জন্তু দৌড়াইয়া পলাইল | তাহার পলায়নের শব্দ দূরে মিলাইয়া যাইবার পূর্বেই রাস্তার উপর আবার ঠকঠক শব্দ করিয়া কোনও জন্তু দ্রুতপদে নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল | অতঃপর শ্মশানের প্রবেশ দ্বারের দিক হইতে একই ভয়ঙ্কর কর্ণবিদারী নির্ঘোষ নিনাদ শোনা গেল, এবং একাধিক বার দ্রুততালে সেই নির্ঘোষের অনুক্রম ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ন্যায় গুঞ্জিত হইতে থাকিল | ততক্ষণে সকলের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হিম ও রক্ত জল হইয়া গিয়াছে | কেহ অস্ফুট স্বরে কহিল, “খুড়ো, কী হবে এখন ? উপায় কী ?” তাহার কথা শেষ হইবার পূর্বেই পানু খুড়ো, “শিগগির ! সবাই চট করে এক একটা গাছের নিচে আগুন জ্বেলে, গাছে উঠে পড়,” এই কহিয়া তিনি স্বয়ং জ্বলন্ত উনুনের ভ্রুক্ষেপ না করিয়া এক লম্ফে তাহার ঠিক উপরে গাছের একটি ডাল ধরিয়া আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় তাহাতে উঠিয়া পড়িলেন | তাঁহার দেখাদেখি অন্যান্য সকলেও তৎক্ষণাৎ উনুন হইতে প্রজ্বলিত কাষ্ঠ লইয়া চতুর্দিকে দৌড়াইয়া নিকটে যে যাহা গাছ পাইল তাহার নিচে কোনও মতে এক দুইখানি কাষ্ঠে আগুন জ্বালাইয়া জোড়ায় জোড়ায় গাছে চড়িয়া যথা সম্ভব উপরে উঠিয়া বসিল | কেবল গোরুর গাড়ির চালক মহেশ গাড়ির সামগ্রী নামাইয়া রাখিয়া গোরুগুলিকে জল পান করাইতে লইয়া গিয়াছিল | সে হয়তো ফিরে নাই, বা ফিরিয়া আসিলেও সে কোনও সাড়াশব্দ করিল না |

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাওয়ার দাপটে লন্ঠনটি নিভিয়া গেল | তুমুল বৃষ্টি নামিল | বৃষ্টির জলে সব আগুন একে একে নিভিয়া গেল | সেই বৃষ্টির জলের শব্দ এমন প্রচণ্ড যে আর কিছুই শোনা যায় না | তথাপি, পানু খুড়ো আন্দাজ করিলেন গাছের ডালে ডালে বিরাজমান যুবকরা কেহই টুঁ শব্দটিও করিতেছে না | কে জানে তাহারা জাগিয়া আছে কিনা ? যদি ওই অবস্থায় কেহ ঘুমাইয়া পড়ে (সকলেই যেরূপ ক্লান্ত) ও বৃষ্টিতে পিচ্ছল গাছের ডাল হইতে পড়িয়া যায়, তবে তাহার কী গতি হইবে ? গ্রামে ফিরিয়াই বা কী করিয়া লোকজনকে মুখ দেখাইবেন ? কী কহিবেন ? স্বচক্ষে না দেখিয়া শুধুমাত্র শ্রবণের ভিত্তিতে নরখাদক বাঘের বর্ণনা কী রূপে করিবেন ? – এই সব চিন্তায় তাঁহার ঘুম আসিল না |

ক্রমে ক্রমে বৃষ্টিপাতের বেগ হ্রাস পাইল | বৃষ্টি থামিলে, এদিক ওদিকের বৃক্ষ হইতে দু একটি চড় চাপড়ের শব্দ শুনিয়া পানু খুড়ো নিশ্চিন্ত হইলেন যে বৃক্ষারূঢ় যুবকরা মশার উপদ্রবে ঘুমায় নাই, জাগিয়া আছে | একবার তাঁহার মনে হইল এক এক করিয়া নাম ধরিয়া ডাকিয়া দেখেন কে আছে, কে নাই | ঠিক তখনই তাঁহার গাছের নিচেই পর পর ধপাস-ছপাস শব্দ করিয়া কিছু জিনিস যেন উপর হইতে নিচে বৃষ্টির জমা জলে পড়িল | সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বৃক্ষ হইতে বিভিন্ন ভয়ার্ত স্বরে শোনা গেল, “কে ? কে পড়ল ?” ... “পানু খুড়ো কোথায় ?” ... “এই, চুপ কর ! টুঁ শব্দও করবি না  ...”

এই ক্ষণিকের আকস্মিক কোলাহল শান্ত হইলে স্পষ্ট শোনা গেল নিচে কোনও ভারী জিনিস ছেঁচড়াইয়া টানিয়া লইয়া যাইবার শব্দ | একটু পরেই কিছু চর্বণ করিয়া ভক্ষণ করিবার শব্দ শোনা গেল – নরখাদকটি কখনও কড়মড়, তো কখনও মুচমুচ শব্দে কিছু চিবায়, আবার কখনও শুধু লালা-মিশ্রিত খাদ্য ভক্ষণের সপসপ শব্দ শোনা যায় | এইরূপ নানাবিধ শব্দে অনেকক্ষণ আহার করিতে করিতে নরখাদকটি হটাত হাঁচিতে শুরু করিল | বোধহয় সে হাঁচির বেগ সামলাইতে না পারিয়া ক্ষিপ্ত হইয়া হাঁচিতে হাঁচিতে সবেগে পলায়ন করিল | পানু খুড়ো ডোমের সাবধান বাণী স্মরণ করিয়া মনে মনে প্রমাদ গণিলেন যে আর বোধহয় সকাল বেলায় মৃতদেহটি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যাইবে না, সৎকার না করিয়াই গ্রামে ফিরিতে হইবে | ‘কিন্তু,’ তিনি মনে মনে বিস্মিত হইলেন, ‘তাহলে বাঘটার নাম কী ঢুকে যাওয়াতে বাঘটা পালাল ?’

ভগবানদের কী বিচিত্র লীলা | সব আতঙ্ক ক্রমে ক্রমে নিদ্রায় বিলীন হইল | একে একে যে যাহার বৃক্ষশাখা জড়াইয়া ধরিয়া ঘুমে অচেতন হইল |

অতি প্রত্যুষে ডোম আসিয়া এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখিতে পাইল | নিচে মন্দির চত্বরে তিন দিনের বাসি মড়া গরমে ও বৃষ্টিতে ফুলিয়া ঢোল হইয়াছে | আশেপাশে কেহ নাই | একটি তেঁতুল গাছের নিচে নির্বাপিত উনুনের উপর ভাতের হাঁড়ি বসান | পাশে একটি লন্ঠন কাত হইয়া পড়িয়া আছে | অনতিদূরে একটি বস্তা হইতে লুণ্ঠিত যাবতীয় খাদ্য সামগ্রী – চাল, ডাল, বড়ি, চালভাজা, হলুদ, লঙ্কার গুঁড়া ইত্যাদি – ছড়াইয়া ছিটাইয়া পড়িয়া, ও তাহার চারিপাশে কাদায় কোনও চতুষ্পদ জন্তুর ক্ষুরের বিক্ষিপ্ত পদচিহ্ন | ডোম দৃষ্টি এদিক ওদিক করিয়া দেখিল উপরে গাছের ডালে ডালে জনা দশ বারো মানুষ নানাবিধ ভঙ্গিতে – কেহ বানর, কেহ বাদুড়, কেহ পক্ষীর ন্যায় – নিদ্রামগ্ন | ডোম দৌড়াইয়া গিয়া মন্দিরের বন্ধ দরজার উপর করাঘাত করিয়া ডাকিতে লাগিল, “ঠাকুর মশাই ! শিগগির উঠুন | কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়েচে ... শিগগির উঠে আসুন, দেখুন | হে মা কালী ...”

এই চীৎকারে পানু খুড়ো জাগিয়া উঠিয়া দ্রুত বৃক্ষ হইতে নিচে অবতরণ করিলেন ও বেশি হাঁকডাক অপচয় না করিয়া, একটি গাছের ডালের খোঁচা দিয়া বাকি সকলকে জাগাইলেন | সকলে নিচে নামিয়া চক্ষু বারম্বার কচলাইয়া দেখিয়া অবাক হইল যে মৃতদেহ এখনও বর্তমান, যদিও এত ফুলিয়াছে যে চেনা মুশকিল !

সৎকার ক্রিয়া সমাপ্ত হইতে বেলা হইল | পুরোহিত মহাশয়কে কিঞ্চিত অধিক দক্ষিণা প্রদান করিয়া পানু খুড়ো ক্ষেদের সহিত কহিলেন, “চাল, ডাল, তেল, ঘি, হলুদ, নুন কিছুই দিতে পারছি না ... কাল রাত্তিরে বাঘ এসে সব নষ্ট করে গিয়েছে |” পুরোহিত মহাশয় আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “বাঘ ?” পানু খুড়ো কহিলেন, “হ্যাঁ, সে কী তর্জন গর্জন ! আমরা তো গাছে উঠে পড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি | তবে ভাগ্যিস বাঘটা মড়াটা খায়নি |” এই তথ্যের সহিত সম্মত হইয়া পুরোহিত মাথা নাড়িলেন | পানু খুড়ো শুধাইলেন, “আচ্ছা, বাঘটা মড়া না খেয়ে চাল, ডাল কেন খেল বলুন তো ? মড়াটা বাসি বলে ? নাকি, জলে ভিজে ফুলে ঢোল হয়েছিল, বলে ? কোথায় থাকে এমন বাঘ ?” পুরোহিত মহাশয় হুগলীর অপর তটের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া কহিলেন, “শুনেছি ওপারে ভৈরব মণ্ডলের জঙ্গলে নাকি এক আধটা বাঘ থাকে | বা, থাকত ... কিন্তু, বহুদিন কেউ তাদেরকে দেখে নি, তাদের ডাকও শোনে নি | আপনি ঠিক শুনেছিলেন, বাঘের ডাক ?”

ঠিক সেই মূহুর্তে শ্মশানের বাহিরের রাস্তা হইতে সেই ভয়ঙ্কর ডাক শোনা গেল | চমকিত যুবাগণ পানু খুড়োর সহিত একত্রিত হইয়া, পিঠে পিঠ লাগাইয়া ঘনিষ্ঠ হইয়া দাঁড়াইয়া আত্মরক্ষার বেষ্টনী সৃষ্টি করিল | অতঃপর সকলে ভয়ে ভয়ে রাস্তার দিকে চাহিয়া দেখিল একটি লোক একটি চতুষ্পদ জন্তু লইয়া যাইতেছে | রামছাগল অপেক্ষা সামান্য বড় জন্তুটির সহিত মানুষ দেখিয়াই সকলে কিঞ্চিত আশ্বস্ত বোধ করিল | যেন জন্তুটি চিনিতে পারিয়া সমর কহিল, “এতো দেখতে কিছুটা জগুবাবুর ইতিহাসের বইয়ের সেই চেতক ঘোড়াটার মত, তাই না ?” শশাঙ্ক, যে পড়াশোনায় অপেক্ষাকৃত কৃতী, কহিল, “ধুর, দেখছিস না এটার কানে কত চুল, চোখ দুটো ডাগর হলেও কত বোকা বোকা, আর দেখতে কত খিটখিটে ?” পৃষ্ঠে একগাদা কাপড়ের গাঁট চাপান জন্তুটির অবস্থা দেখিয়া বোঝা গেল যে বোঝার ভারে সে নড়িতে পারিতেছে না | লোকটি হাতের লাঠি দিয়া তাহার ঠ্যাঙে প্রহার করিলে সে পুনরায় ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করিল | তাহা শুনিয়া সকলে একত্রে শিহরিয়া উঠিল | কেবল পানু খুড়ো ম্রিয়মাণ কণ্ঠে কহিলেন, “ওই তো ! ওই শুনুন, সেই ভয়ঙ্কর ডাক !”

পুরোহিত মহাশয় কাষ্ঠ হাসি হাসিয়া কহিলেন, “মনে হয়, আপনারা বৈরামগঞ্জে এই প্রথম এলেন | তাই এখানকার বিখ্যাত গাধার-ডাক আগে কখনও শোনেন নি |”

---------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৬ জুন ২০১৫

বুধবার, ২৪ জুন, ২০১৫

ডিমের-ঝোলের আলু

|| ডিমের-ঝোলের আলু ||


ও মা সোনা, আজ রাঁধ না, প্রিয় সেই ডিমের ঝোল
কষে লঙ্কা-জিরা বাঁটার সাথে কোরা কচি নারকোল
ফোড়ন বলতে লবঙ-এলাচ, আর কিছু কালোজিরে
ঝোলের আলু নয় আগে-ভাগেই রাখিস সেদ্ধ করে
মৌলা আলী ধারে দিয়েছে হাসের ডিম দু’ জোড়া
একটা তোর আর একটা বাবার, সিধে হিসেবে ধরা
জল বসিয়ে ডিমগুলো ছেড়ে, মিনিট দুয়েক রেখে
ফুটে উঠলে নামিয়ে নিয়ে রাখিস তাদেরকে ঢেকে
ঠাণ্ডা হলেই ছাড়িয়ে খোসা, ডিম ধুয়ে নিয়ে জলে
নিস সাঁতলে, গরম তেলে, এক চিমটে হলুদ মলে
ডিম আর আলু, তারপরেতে, সুতোর ধারে কেটে
কষা মশলায় আলু নেড়ে নিস, দিয়ে জলের ছিটে
ফুটে উঠলে ফেলে দিস ঝোলে কুসুম উপরে করে
কাটা ডিম, যেন কুসুমের ফাঁকে ঝোল না যায় ভরে
দারচিনি বেঁটে শিল ধোয়া জল দিলে ডিমের ঝোলে
দেখিস যেন ঝোলটা জোলো না হয়ে যায় অথৈ জলে
ঝোলের মাঝে আলুর পাশে চেয়ে চেয়ে যেন জাগে
কমলা রঙের ডিমের কুসুম, সূর্য্যি অস্ত যাওয়ার আগে

আমি নাই-ঘাটে যাই, করতে নাই, তুই চাপা গে ভাত
ঘাটের পথে ইস্কুলে যেয়ে দেখে নিতে হবে এক হাত
শুনেছি সাত সকালেই টাঙ্গিয়েছে এক্জামিনের ফল
যাই তাই দেখি, যদিও জানিস তোর ছেলে হয় সফল
তাই বলে রাখি, হয় হোক আমার ফিরতে একটু দেরী
গায়ে জল ঢেলে শাড়িটা বদলে, রাখবি ভাতটা তৈরি
পাশ করলে, দিস গরম ভাতে, জোড়া ডিম্বের ঝোল
ফেল করলে ? ভাবিস নে গো মা, হবে সে গণ্ডগোল

তবে দেখ যদি বিনে নাই করে ফিরে আসে তোর ছেলে
শুধু বেড়ে ভাত, দিস ডিম বাদ, ঝোল আর আলু ঢেলে ||


------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৪ জুন ২০১৫

রবিবার, ২১ জুন, ২০১৫

মায়ের আলু-ভাজা

|| মায়ের আলু-ভাজা ||


ও বউ, তুমি এক দিনের জন্য মা হয়ে যাও দিকি
দেখি না, তুমি মায়ের মত আলু ভাজতে পার নাকি

আরে না, না, ও ভাবে হবে না, ওরে সব্বোনাশ !
রাখো সরিয়ে খোসা-ছাড়ানি, ছুরি, কাটার পাটাতন আর গ্যাস
যাও, গিয়ে ধরাও কয়লার উনুন - কেরোসিন, কাঠ, ঘুঁটে দিয়ে
গনগনে হয়ে উঠলে আঁচটা, কিছু কয়লা গুঁড় দিও ছড়িয়ে

তৈরি তো ? তাহলে, ঝুড়ি থেকে দেখে বেছে নাও আলু ক’টি
পিঁড়িটা টেনে, মাটিতে বসে পড়ে, পায়ে চেপে ধরো বঁটি
পাতলা করে ছাড়াও তাদের খোসা, নিপুণ দু’হাতে ধরে
তারপরে কাটো লম্বাটে ফালি, বেশি না জিরি জিরি করে

উনুনে বসাও লোহার কড়াইটা, একটু ধুয়ে নিয়ে জলে
পরিমাণ মত ঢাল সর্ষের তেল, কড়াইটা শুকিয়ে গেলে
যতক্ষণে তেল হচ্ছে গরম, কাটা আলু নাও ধুয়ে
ও মা, সে কী, এই টুকুতেই পড়েছ তুমি হাঁপিয়ে ?

আলু কেন ধোবে ? আলু ধুলেই তো চলে যাবে তার মাড় ?
কী করে বোঝাই, সেখানেই তো মায়ের সাথে তফাতটা তোমার
যাক গে, ছাড়, এবার আলুগুলোর জল টল নাও ঝরিয়ে
খোসাগুলো ফেলে, হাত ধুয়ে মুছে, বঁটিটা রাখ সরিয়ে

ওদিকে দেখ কড়াইয়ে, তেল থেকে উঠছে কি হালকা ধোঁয়া
তাহলে তাতে দাও শুকনো লঙ্কা, আর রসুন এক দু’ কোয়া
লঙ্কা ভাজার গন্ধ উঠলে দাও আলু কড়াইতে ছেড়ে
একটু একটু করে, মাঝে মধ্যে খুন্তি দিয়ে নেড়ে নেড়ে

এর পরে দাও নুন আর হলুদ, দিয়ে নেড়ে দাও আলু
আঁচ গুনগুন, তবু কয়লার উনুন, হাত নাড়া রাখো চালু
ব্যাস, এইবার কাজটা তোমার ধরো মোটামুটি শেষ
এখুনি ছাড়বে আলুর ভাজা ভাজা গন্ধের প্রথম রেশ

গন্ধে যখন ভরে উঠবে রান্নাঘর, ছুটে আসবে তোমার ছেলে
বলবে, “মা, কী করছ ?”, ওকে তুমি নিয়ে নিও কোলে
আঁচল দিয়ে ওর মুখ মুছে বোলো, “শোনরে, আমার রাজা,
তোর জন্য আমি করছি তোর ভীষণ প্রিয় আলু-ভাজা”

নামানোর আগে মোটা-দানা নুন একটু দিও ছিটিয়ে
তেল থেকে টেনে আলু-ভাজাগুলো দিও কড়া’য়ের পাড়ে উঠিয়ে
এখন হল আলু ভাজা শেষ, তুমিও ক্লান্ত, ক্লেদাক্ত
গলায় তোমার ঘামের বিন্দু, চেহারা হয়েছে আরক্ত

ওই মাটির উনুন, আঁচ গুনগুন, ওর জাদু করে অদ্ভুত গুণ
আলু-ভাজার গায়ে তেলের বুদ্বুদ, লঙ্কা-রসুন, মাখোমাখো গুঁড় নুন
মা চলে গেছে, মনে রয়ে গেছে মায়ের আলু-ভাজার জাদু
দাও দাও পাতে, আলু-ভাজা ডাল ভাতে, আমার মাতৃসমা বঁধু ||


-----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২১ জুন ২০১৫

শুক্রবার, ১৯ জুন, ২০১৫

নীল-স্নান

|| নীল-স্নান ||


চেয়ে চেয়ে তীব্র সুনীল, নির্নিমেষ দু’চোখ ক্লান্ত
এসো এবার নেমে, আকাশ, করো প্রতীক্ষা ক্ষান্ত
অনিকেত মেঘের ভাসমান পাল পশ্চিমে তাড়িয়ে
বুনেছ জমিতে ধুসর ছায়াজাল, কী দুরাশা ঘনিয়ে
কী সুলুকে হাওয়া দিশেহারা, সৌগন্ধে মাতোয়ারা
লহর তার কম্পিত, উত্তপ্ত, ঊর্ধ্বে আরোহী পারা
কুমুদিনী আননে হরিত প্রতিফলনে নার্গিস বনানী
ঝিমোয় ঝিরঝির বৃষ্টি অপেক্ষায়, কি দিবস, রজনী
দেখো চেয়ে খোলা জানালায় কে চিকণিয়া আঙ্গুলে
ইনিয়ে বিনিয়ে ছাড়ায় কবরী কোঁকড়ান খোলা চুলে
অভিসার আশায়, তার মদিরা প্রোষিতভর্তৃকা চোখ
অধীর মদালসে চায় প্রতীক্ষার এবার সমাপ্তি হোক
সেই বিরহিণী জানে না ভিনদেশী এসে ঠায় দরজায়
দাঁড়িয়ে, জানতে আছে কি তার সিনানের অভিপ্রায়
তাই নামো এবার আকাশ, ছেঁড় উষ্ণতার আবেশ
বরিষণ মুখর কলগুঞ্জনে নামাও আলুলায়িত কেশ
আনো তাকে টেনে জানালা থেকে খিড়কির পুকুরে
দু’জনে নিরাবরণে নাই নীল নাতিশীতোষ্ণ মুকুরে ||


------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৯ জুন ২০১৫

মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০১৫

নির্ভরতার সম্পর্ক

|| মনে ধরে ||

সময়টা স্কুল থেকে ফেরার | উপেন বাবু রান্নাঘরের জানালা থেকে দেখলেন নিচে রাস্তায় একটা গাড়ি ঘিরে খুব ভিড় | গাড়ি থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে দু’জন মহিলা, সাথে স্কুল ফিরতি কয়েকটা বাচ্চা | কলোনির সিক্যুরিটির পোশাক পরা একটা লোক, আর একটা এমনি লোক গাড়িটার গা ঘেঁসে, তার দরজা আর বনেট খুলে কিছু করছে | এ ছাড়া বেশ কিছু নিষ্ক্রিয় লোক দাঁড়িয়ে দেখছে কী হচ্ছে |

উপেন বাবুর ফ্ল্যাট চার তলায় | তরকারী কেটে কুটে গ্যাসে বসিয়ে দিয়ে, ব্যালকনিতে এসে আঁচ করার চেষ্টা করলেন কী হয়েছে | পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন নেই | সেই সিক্যুরিটি গার্ড আর অন্য লোকটা হাতে কিছু সরঞ্জাম নিয়ে গাড়ির এদিক ওদিক খোঁচাখুঁচি করছে | মহিলা দু’জন, একজন বয়সী, পরনে ছিট কাপড়ের সালোয়ার কামিজ, অন্যজন, কম বয়সী, ছাই রঙের স্ল্যাক্সের উপর একটা সাদা টপ পরে, ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছে | স্কুলের ব্যাগ পিঠে নিয়ে বাচ্চাগুলো একটু সরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে | ঘন মেঘ করেছে | তারই কোথাও এক ফাঁক দিয়ে দুপরের তীব্র আলো চারিদিকে ঠিকরচ্ছে | এই ভ্যাপসা গরমে উপেন বাবু বেশি ক্ষণ দাঁড়াতে পারলেন না | ঘড়িতে দেখলেন সময় প্রায় দু’টো | রান্না ঘরে ফিরে রান্নায় মন দিলেন |

কিছুক্ষণ পরে আবার একবার রান্নাঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, একটা স্কুটারে করে দুজন লোক এসে নামল | পিছনে বসা লোকটা হাত থেকে একটা বাক্স মত নামিয়ে ঢাকনি খুলে লম্বা কিছু একটা বের করল | এত দূর থেকেও তার কমলা রঙের হাতল দেখে মনে হল স্ক্রু-ড্রাইভার | ‘ও, তাহলে এরা মেকানিক !’ ভাবলেন উপেন বাবু, ‘তার মানে গাড়িটা খারাপ হয়েছে | কিন্তু, অদ্ভুত তো, গাড়িটা স্কুল থেকে ফিরে, ঠিক বাড়িতে পৌঁছেই খারাপ হল !’

একটু পরেই ব্যাপারটা জানা গেল | একটা সিক্যুরিটি গার্ড এসে ঘণ্টি বাজিয়ে খাওয়ার জল চাইল | উপেন বাবু একটু বিরক্ত হলেন | এই এক জ্বালা হয়েছে | কেউ আসে কাউকে খুঁজতে, কেউ আসে খাওয়ার জল চাইতে | সবাই যেন এসে তাঁরই ঘণ্টি বজায় | অনেক বার ভেবেছেন জিজ্ঞাসা করবেন, “নিচের ফ্ল্যাটে কি কেউ নেই নাকি ? এই চার তলায় উঠে এসেছ |” কিন্তু, জিজ্ঞাসা করতে পারেন না | মৃদুলার কথা মনে করে চুপ করে যান | মৃদুলা আপত্তি করতেন, “আহা, এত গরমে কেউ একটু জলে চাইছে, দিয়েই দাও না |”  তারপর স্বগতোক্তি করতেন, “মানুষটা যদি কাউকে কোনদিন মনে ধরে কিছু দিতে পারে | একদিনও দেখলাম না কাউকে খোলা মনে কিছু দিতে |” তবুও, প্রত্যেক বার উপেন বাবুর মনে প্রশ্নটা উসখুস করে, আর ভাবেন, ‘আচ্ছা, সবাই কি জেনে গেছে আমি একা থাকি ? না হলে গেরস্থ ঘরে না গিয়ে আমার কাছেই সবাই কিছু চাইতে আসে কেন ?’ আসলে, অযথা কারো সাথে কিছু দেয়া নেয়া উপেন বাবু পছন্দ করেন না | পাছে কোন নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে |

গার্ডটার জল খাওয়া হলে উপেন বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, ওই গাড়িটার কী হয়েছে ? তখন থেকে ভিড় দেখছি |” গার্ডটা নিঃস্পৃহ ভাবে বলল, “ওর দরজার লক খারাপ হয়ে গেছে |” উপেন বাবু বললেন, “বুঝলাম না | লক খারাপ মানে ?” গার্ড আবার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, “জাম হয়ে গেছে বাবু, লকটা জাম হয়ে গেছে |” গার্ডটাকে আর এক গেলাস জল এনে দিয়ে, এবং আরও বেশ কিছু প্রশ্ন করে জানা গেল ম্যাডাম (গার্ডের আঙ্গুল অনুযায়ী কম বয়সী মহিলা) নিজের এক বাচ্চা, আর পাড়ার আরও কিছু বাচ্চা নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে গাড়ি থামিয়ে দেখে গাড়ির দরজার লক খুলছে না, এমন কী কাঁচও নামান যাচ্ছে না | গাড়ির ভিতরে আটকা পড়ে গিয়ে গরমে বাচ্চাদের দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় | ম্যাডাম গাড়ি থেকে বেরনোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মোবাইলে মাতাজীকে (গার্ড বয়সী মহিলাকে দেখাল) খবর দেয় | মাতাজী নিচে এসে সিক্যুরিটি গার্ডকে ডাকে | প্রথমে ম্যাডাম গাড়ির ভিতর থেকে বনেট খুলে দেয় | কিন্তু ব্যাটারি, ইলেকট্রিকাল তার, এইসব ঘাঁটাঘাঁটি করে কোন কাজ হয় না | তখন সিক্যুরিটি কাছের বস্তি থেকে একটা লোককে ডেকে আনে যে  নাকি জানে কী ভাবে লক করা দরজা খোলা যায় | সে
(গাড়ি চোর ?) গাড়ির জানালার আর কাঁচের মাঝের রাবারের পট্টি উপড়ে ফাঁক করে ভিতরে একটা লম্বা খুন্তি ঢুকিয়ে কোনও ভাবে দরজা খুলে ম্যাডাম আর বাচ্চাদের বের করে | গাড়িটা একদম নতুন | এখন ওই ম্যাডাম ভয় পাচ্ছে যে গাড়িতে বৃষ্টির জল ঢুকবে | তাই মিস্ত্রী ডাকা হয়েছে দেখাতে কী করা যায় | তবে সে ঠিক হবে কিনা বলতে পারছে না |

উপেন বাবু খেয়ে উঠেছেন কি বৃষ্টি নামল টিপটিপ করে | সেই সাথে ভয়ঙ্কর মেঘের ডাকে ইঙ্গিত যে জোরে বৃষ্টি নামবে একটু পরেই | উপেন বাবু ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলেন গাড়িটার আশেপাশে কেউ নেই | বনেট আর দরজা সব বন্ধ | কিন্তু, মনে হল যেন, গাড়িটার জানালার কাঁচ নামান | ‘সর্বনাশ’, ভাবলেন উপেন বাবু, ‘তা হলে তো গাড়ির ভিতরে জল ঢুকে যাবে |’ ঠিক তখনই তাঁর নজরে পড়ল, সামনের ফ্ল্যাটে তিন তলায় একটা জানালায় কেউ দাঁড়িয়ে গাড়িটা দেখছে |

খানিকক্ষণ পরে বৃষ্টিটা একটু থামলে উপেন বাবু কী কৌতূহলে আবার ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলেন সেই জানালায় সে আর নেই | তখনই নজরে পড়ল, ওই ফ্ল্যাটেরই ব্যালকনিতে সেই ছাই রঙের স্ল্যাক্স আর সাদা টপ পরা মহিলা দাঁড়িয়ে | একেবারে নিশ্চল | উপেন বাবু কল্পনা করলেন মহিলা মন খারাপ করছে এমন নতুন গাড়িটায় এই ভাবে জল ঢুকবে, নিশ্চয় সিটের গদি ভিজে যাবে, হয়ত নষ্টই হয়ে যাবে, বেশি ভিজলে |

উপেন বাবু শোয়ার ঘরে এসে আলমারি থেকে মেয়ের দেয়া দূরবীনটা বের করলেন | সচরাচর ব্যবহার করা হয় না | আর ফ্ল্যাটে বসে দেখবেনই বা কী | রান্নাঘরে এসে দূরবীনটা চোখে লাগিয়ে মহিলার মুখে তাক করলেন, দেখতে তাতে কি কোন দুঃখের ছাপ, নতুন গাড়ি নিয়ে | কিন্তু মেঘ করে আলো এত কমে এসেছে যে ঠিক বোঝা গেল না |

উপেন বাবু দূরবীনটা রেখে ঘরে তালা দিয়ে বেরলেন | নিচে এসে গ্যারেজের দরজা খুললেন | কলোনিতে খুব কম লোকের গ্যারেজ আছে | বেশির ভাগ লোক রাস্তায় গাড়ি রাখে | ওনার গ্যারেজ এখন খালি পড়ে থাকে | নিজের টাকায় কোন কালে গাড়ি কিনতে পারেন নি | মৃদুলা স্কুল থেকে অবসর নিলে তার পাওনা টাকায় শখ করে একটা গাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন | পয়সার অপচয় হবে অজুহাতে উপেন বাবুর আপত্তি ছিল | মৃদুলা জোর করে গাড়ি কেনালে, উপেন বাবু একটা প্লাস্টিকের গাড়ি ঢাকার বর্ষাতি কিনেছিলেন | তারপর মৃদুলা কী ভাবে এই গ্যারেজটাও কিনে ফেলেন এক প্রতিবেশীর কাছে থেকে | উপেন বাবু গাড়ি চালান শিখতে চান নি, তাই মৃদুলা একটা ড্রাইভার রেখেছিলেন | মৃদুলা মারা গেলে মেয়ে গাড়িটা বিক্রি করে দেয় | কিন্তু গ্যারেজটা বিক্রি করে নি, বলেছে কোনদিন ফ্ল্যাটটা বিক্রি করলে গ্যারেজ শুদ্ধ বেশি দাম পাওয়া যাবে |

প্লাস্টিকের বর্ষাতিটা নিয়ে উপেন বাবু গার্ড রুমে গিয়ে দেখলেন সেই লোকটাই আছে যে জল খেতে এসেছিল | ওকে প্লাস্টিকটা দিয়ে বললেন, গিয়ে গাড়ির ম্যাডামকে দিয়ে আসতে | গার্ডটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বর্ষাতিটা নিয়ে চলে গেল |

তারপর উপেন বাবু ফ্ল্যাটে ফিরে এসে রান্না ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকালেন | দেখলেন নিচে দুজন গার্ড বর্ষাতিটা গাড়িটার উপর বিছিয়ে দিয়ে কোনাগুলো আটকাচ্ছে | সেই মহিলা তার মাকে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে | উপেন বাবুর একবার মনে হল দূরবীনটা দিয়ে দেখেন মা মেয়ের মুখে সোয়াস্তির হাসি ফুটেছে কি, কিম্বা কোনও কৃতজ্ঞতার ছাপ ?

তার আগেই সহসা ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে চারিদিক ধোঁয়াটে হয়ে গেল | মা মেয়ে ব্যালকনি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল | যেতে যেতে 
যেন মৃদুলা একবার তাঁর দিকে চেয়ে দেখলেন, উপেন বাবুর মনে হল ||

----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৫ জুন ২০১৫

রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

বৃষ্টির ছানি

|| বৃষ্টির ছানি ||

স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভেবে আসবে তুমি
অসময়ে বৃষ্টি এলো, ভিজিয়ে ভুবন ভূমি

ভিজে গেল দৃষ্টি আমার, ভিজে সব ঝাপসা
ট্রেন এসে চলে গেল, ভিড়ে মুখ একসা
এলে কিনা, নামলে কিনা, নামল শুধু বৃষ্টি
কত জন চেয়ে দেখল, উৎসুক মুখ মিষ্টি

সময় সারণীতে আজ আর নেই কোন ট্রেন
শেষ ট্রেনও ছেড়ে গেল বাজিয়ে সাইরেন
যে যাত্রিণী রয়ে গেছে, বৃষ্টি-ভেজা বিহ্বল
তার মুখে চেহারা নেই, শুধুই বৃষ্টির জল

বৃষ্টি নামলে জানো, গুলিয়ে যায় সব মুখ
ধুয়ে যায় বৃষ্টির জলে দুঃখের
সুখী সুখ
লোকায়ত বৃষ্টি, সব মুখকেই ফেলে ফাঁদে
সব মুখই মিলে যায় এক আদলের ছাঁদে

অসময়ে বৃষ্টি এলো, চোখে বৃষ্টির ছানি
তুমি গেছ হারিয়ে, কেমন করে কী জানি ||


----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৪ জুন ২০১৫

(প্রেরণা: নাগপুরের প্রবীণ চিত্রকার বিজয় বিসওয়ালের আঁকা বৃষ্টি ভেজা প্ল্যাটফর্মের ছবি)

শনিবার, ১৩ জুন, ২০১৫

রূপসী কোলকাতা

|| রূপসী কোলকাতা ||

রূপসী কোলকাতা, পায়ে আলতা, গায়ে বৃষ্টি ভেজা ওড়না
বলছি কিছু, গায়ে মেখো না মিছু, তুমি লাগছ ভারী অনন্যা
রূপের শরীর, গোড়ালি গভীর, এ তো সমালোচকের উক্তি
বুক যখন হায়, ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়, মন তো মানে না সে যুক্তি

তাই আমি দাঁড়িয়ে, দেখি চোখ জুড়িয়ে, সর্পিল ট্রাম লাইন
ঘণ্টির ঝংকার, বাতির কণ্ঠহার, ভিজে হাওয়া, নিওন সাইন
বর্ষাতি গায়, আগন্তুক চায়, তার কালো চশমা হয় রহস্যময়
শিউলি সুবাসে, শেষ স্টপ আসে, তাই কি নেমে যেতে হয়

রয়ে যায় মনে, দিন অবসানে, এক অচেনা মুখ ফিরিয়ে দেয়া
শত স্রোতস্বিনী, বিস্তীর্ণ সরণী, হারায় আমার অলীক খেয়া |


------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১২ জুন ২০১৫

শুক্রবার, ১২ জুন, ২০১৫

জাম কুড়ানোর পালা



|| জাম কুড়ানোর পালা ||

ক্রীড়া সদনের পাশে যে রাস্তায় ভোর ভোর হাঁটতে যাই, সেটা ভারী সুন্দর | হালকা চড়াই উতরাই নিয়ে রাস্তাটা এঁকে বেঁকে গেছে মাইল খানেক | একপাশে সমান ঘাসের খেলার মাঠ, অন্যপাশে জমিটা কয়েক হাত উঁচু | সেখান থেকে কিছু কৃষ্ণচূড়া, কিছু জিলাপি, আর অনেক অচেনা গাছ রাস্তাটার উপর মাতৃস্নেহে ঝুঁকে আছে ছায়ার আঁচল বিছিয়ে | আর তার মাঝে এক দুটো জামের গাছ – একটু বেমানান | ঝড় ঝাপটা হলে পরদিন দেখি জাম গাছ তলায় অজস্র জাম পড়ে আছে | পাদচারীরা তার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, জাম, কৃষ্ণচূড়া ফুল সমান তাচ্ছিল্যে মাড়িয়ে |

কদিন ধরে এই জাম নিয়ে এক কান্ড দেখলাম | তার কথা বলি –

যারা নিয়মিত হাঁটতে আসে, তারা প্রায় সবাই একা | গরমের ছুটি হলে একটু একটু করে ‘গ্রীষ্ম শিবিরে’ নিয়ে আসা স্থানীয় বাচ্চাদের বাবা মা পাদচারীদের ভিড় বাড়াতে লাগল | তারা রোজ ওই ঘণ্টা কয়েক কোথায় যাবে ? তাই, এদিক ওদিক উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়, আর তাদের জুড়ি এই ভিড়ে যারা একা হাঁটে তাদের উপস্থিতি যেন বেশি প্রকট করে তোলে |

সেই প্রকটিতদের মধ্যে একজন মহিলা খুব ঢ্যাঙ্গা, রোগা, রং ময়লা | খেলার লাল গেঞ্জি আর নীল পায়জামা পরে খালি পায়ে দ্রুত গতিতে হাঁটে | যদিও শরীরের বক্রতা এখনও সুস্পষ্ট, বয়েস তিরিশের কোনদিকে তা বোঝা মুশকিল  | দ্বিতীয় মহিলা দেখে মনে হয় সদ্য স্কুল ছেড়ে কলেজে যাওয়া উনিশে পড়ুয়া মেয়ে | মেদ ভারে সম্পন্ন শরীরটা খাটো | চোখে চশমা, পরনে কিশোরী সুলভ হলুদ টপ আর বাদামী স্ল্যাক্স | ভালো করে লক্ষ্য করলে তার নাভির কাছে স্ফীতি দেখে মনে হয় সে সংসারে ঢুকে পড়েছে | এর কানে লাগানো থাকে গান শোনার তার | মাথা নিচু করে শ্লথ গতিতে হাঁটে | আবার মাঝে মাঝে পার্কিঙে গিয়ে গাড়িতে দরজা খুলে ড্রাইভারের জায়গায় বসে থাকে | তৃতীয় মহিলা চল্লিশের কাছাকাছি | অসম্ভব মোটা কিন্তু খুব সাবলীল | পরনে গায়ের সাথে চিপে লেগে থাকা বিসদৃশ গোলাপি গেঞ্জি আর আকাশী নীল প্যান্ট | তার দ্রুত হাঁটার মধ্যে একটা অদ্ভুত আলস্য | এই তিন জনেরই ব্যক্তিত্বে একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য একটা সুস্পষ্ট একাকীত্ব | চতুর্থ জন সাদা হাফপ্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি পরা বছর পঁচিশের এক রোগা শিখ যুবক | পাগড়ি হীন মুখে অসম্ভব বুনো চুলদাড়ি | চেহারা, চুল সব মিলিয়ে একটা অসহিষ্ণু খিটখিটে ভাব |

একদিন দেখলাম হলুদ সাদার সাথে হাঁটছে | কথাও বলছে অনর্গল – কিন্তু পাশাপাশি হাঁটছে একটু দূরত্ব রেখে | ক’দিনেই সেই দূরত্ব কম হল | আসতে যেতে অতিক্রম করার সময় কথা না বুঝলেও, স্বর শুনে মনে হল পরিচিতির অন্তরঙ্গতা জমে উঠেছে | আবার কিছু দিন দেখি সাদা একা একা হেঁটে বেড়ায় – হলুদের সঙ্গ নেই | একদিন দেখি হলুদ লালের সাথে ভাব করেছে | লালের সাথে পাল্লা দিয়ে জোরে হাঁটছে, কান থেকে ইয়ার-ফোন খসে পড়েছে | উত্তেজিত দুজনের কথাবার্তা | এই সখিত্ব কিছুদিন চলল | তারপর হলুদ আবার একাকিনী | একদিন দেখি একটা জাম গাছ তলায় লাল আর গোলাপি জাম কুড়চ্ছে | হলুদ পাশ কাটিয়ে চলে গেল | তার পিছনে একটু পরে সাদা গেল | ধরতে পারলাম না কে কবে কার সঙ্গ নেবে সেটা কী ভাবে ঠিক হয় |

আশ্চর্য হলাম, একদিন দেখি একটা ছোট গাছের নিচে চারজনকে একসাথে | সাদা গাছের একটা নিচু ডাল ধরে ঝাঁকাচ্ছে, আর হলুদ, গোলাপি আর লাল নিচে হুমড়িয়ে পড়ে নানান শিশুসুলভ হামাগুড়ির ভঙ্গিতে কিছু কুড়চ্ছে | এক দফা ঘুরে এসে দেখি একই দৃশ্য, তবে আরও উদ্দীপ্ত | তিনটি মেয়েলি গলায় প্রচুর উত্তেজনা একসাথে সাদাকে প্ররোচিত করছে | তার খিটখিটে ভাব মনে হল কিঞ্চিত মোলায়েম হয়েছে | গাছটাকে ভালো নজর করে সন্দেহ হল জাম গাছ | কিন্তু কোন জাম দেখতে পেলাম না | ক’দিন পরে দেখি তিন জম্বু-রঙ্গিণী গাছের নিচে জমায়েত | সাদা রাস্তার উল্টোদিকে শুকনো গাছের ডাল খুঁজে বেড়াচ্ছে | একটু পরে দেখলাম সে সেই ডাল গাছের উপরের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে | আর তার সাথে সাথে মহিলা কণ্ঠের উত্তেজিত কুহরণ – বুঝলাম ফলন অপ্রত্যাশিত ভালো | একটু পরে দেখা গেল চারজন গোল হয়ে ঘাসে বসেছে | দূরত্বের সম্ভ্রম চুলোয় গেছে | প্রায় হাঁটুতে হাঁটু ঠেকিয়ে মাঝখানে একটা রুমালে রেখে তুলে তুলে জাম খাচ্ছে সবাই | সেই সাথে গল্প, হাসাহাসি | মনে হল, ‘আচ্ছা, এদের কি বাড়িঘর নেই ? অবশ্য আমি বা তা জেনে কী লাভ করব ?’

এখন গরমের ছুটি শেষ | পাদচারীর ভিড়ও কম | বর্ষা নামলে জামগাছে আরও বড়, আরও রসালো জাম হবে | শুধু তিন জম্বুরঙ্গিণী আর আসবে না | সর্দারজীও জল কাদা থেকে সাদা কাপড় বাঁচিয়ে হেঁটে ফিরে যাবে | যারা উল্কার মত কাছে এসেছিল তাদের স্মৃতি সরিয়ে রেখে ? ওরা কি কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করেছিল কে কোন সৌরমণ্ডল থেকে এসেছিল ? নাকি, এসেছিল, শুধু জাম খেতে ভাব করেছিল – এই জ্ঞানই যথেষ্ট ?

এ কথা থেকে সে কথায় মন চলে যায় |

আমি তখন খুব একটা ছোট নই, বীরহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেছি | গরমের ছুটিতে দেশ গ্রামে গেলে পাশের বর্ধিষ্ণু গ্রাম রাঙাপুরে যাই বাবার স্কুলের বন্ধু দীনুকাকার কাছে | দীনুকাকা পোস্টমাস্টার | এককালের জমিদারের পোড়ো বাড়ির বৈঠকখানায় রাঙাপুর পোস্টঅফিস | বাড়িটার বাকি ঘর কবেই পড়ে গিয়েছে, শুধু তার বিশাল দু’কামরার রান্নাঘর তখনও অক্ষত | তাতেই দীনুকাকা আর কাকিমা থাকেন | মাতৃসমা কাকিমার টানে যাওয়া | কাকিমা মাতৃস্নেহে আমাকে স্থানীয় ছেলে মেয়ের সাথে বড় একটা মিশতে দেন না, শহুরে ছেলে কোথায় মফস্বলের কী না কী আজেবাজে প্রভাবে পড়ে যাবে | আমিও একা থাকতে ভালোবাসি | একা একা ঘুরে বেড়াই ওই জমিদার বাড়ির বাগানে | বেশিরভাগটাই আগাছায় দুর্গম | কিন্তু এক কোনে দেয়াল ঘেঁসে একটা মস্ত জামগাছ | তার প্রথম ডালটা লাফিয়ে ধরে উপরে উঠে বসে থাকি | ডালটা যেখানে গাছটার গুঁড়ি থেকে বেরিয়েছে সেখানে একটা গর্ত মতন – শুকনো পাতা আর জামের বিচিতে ভরা | তাতে দেখি কাঠবিড়ালি আসা যাওয়া করে | জানি না ওরা জাম খায় কি না | আমি উঠে বসলে ওরা পালিয়ে যায় | কোন কোন দিন দেখি ওর ভিতরে পুরুষ্টু জাম পড়ে আছে, তুলে জামায় মুছে খাই |

একদিন এমনি উঠে বসে ডালটায় হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে উপরে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে আছি, হটাত শুনলাম মেয়েলি গলায়, “এই, ওই খোকলায় জাম আছে ? দে না দুটো আমাকে |” নিচে তাকিয়ে দেখি একটা শাড়ি পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে | আমি ধড়মড় করে উঠে বসে বললাম, “কোথায় বললে ?” মেয়েটা হেসে বলল, “ওই তুই যেখানে পা লাগিয়ে বসে আছিস, গত্ত আছে না একটা ?” আমি মাথা নাড়লাম, “ছিল, আমি সব খেয়ে ফেলেছি |” মেয়েটা বলল, “কাল আসবি না ? আমার জন্য রেখে দিস |” আমি জিজ্ঞাসা করব ও কে, তার আগেই ও ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল | ঘরে ফিরে বলি বলি করেও কাকিমাকে বলতে পারলাম না | পরদিন আমি গাছে উঠবার আগে নিচ থেকে একটা শুকনো ডাল ছুঁড়ে কিছু জাম পেড়ে সেগুলো পকেটে পুরে উঠে বসলাম | পকেট থেকে জামগুলো বের করে খোকলাতে রেখে উপরে তাকিয়ে বসে রইলাম | তন্দ্রা এসে গিয়েছিল কি শুনলাম, “কই, কিছু রেখেছিস ?” নিচে তাকিয়ে দেখি দৃষ্টিতে প্রত্যাশা নিয়ে দাঁত বের করে বিব্রত মুখে হাসছে মেয়েটা | আমি বললাম, “ফেলি ?” ও বলল, “দাঁড়া |” তারপর কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে দু’হাতে মেলে বলল, “এর উপরে ফেলে দে |” আমি ফেলব না দেখব, ওর শাড়ির সাথে ব্লাউজের বদলে পরা ফ্রকে ফুটে ওঠা  যৌবনের চাপা উদ্ভাস | ও আবার বলল, “বললাম তো, ফেল জামগুলো | দেখছিস কী?” আমার কান লাল হয়ে উঠল | দু’হাতে জামগুলো ছুঁড়ে ফেললাম ওর আঁচলে | “এতো গুলো ... যাই বাড়ি নিয়ে যাই” বলে মেয়েটা ছুটে পালাল ওই ঝোপঝাড়ের পথ দিয়ে |

কিছুদিন পরে ধরা পড়ে গেলাম – কেন না জামার দুই বুক পকেটে জামের দাগ লেগে গিয়েছিল, কাকিমা জামা কাচতে গিয়ে ধরে ফেলল | আমি তাও বললাম না মেয়েটার কথা | পরের দিন মেয়েটা এসে দেখল আমি নিচে দাঁড়িয়ে | খুব হেসে বলল, “জাম কই ? ধরা পড়ে গিয়েছিস বুঝি ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কিসের ধরা ?” ও সোজা উত্তর না দিয়ে বলল, “আমি দেখেছি, রোজ তুই আগে ভাগে জাম পেড়ে পকেটে পুরে গাছে উঠে বসিস |” আমি খানিকটা নিঃস্পৃহ গলায় বললাম, “আজ জাম চাই না ?” মেয়েটা হটাত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না, থাক | যাই, কেউ দেখলে কী বলবে ?” তারপর মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটা ধীর পায়ে চলে গেল |

আমার কী মনে হল, বাড়ি ফিরে কাকিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ওই দিকে জামগাছের কাছে একটা মেয়ে আসে, আমায় দেখলে জাম চায়, ও কে ?” কাকিমা আশ্চর্য হয়ে বলল, “ফ্রকের উপর শাড়ি পরে ?”
আমি – “ফ্রক ? অত দেখি নি |”
কাকিমা – “কে জানে, হারান বাগদির মেয়ে হাসি হবে হয়তো ...”
আমি – “হারান কে ?”
কাকিমা – “ওই তোর কাকার কাছে পিয়নের কাজ করত | বাগানের এক কোনে থাকত | বউ কবেই মারা গেছে | মেয়েটা বাগানময় চষে বেড়াত আর ফল, মূল যা পেত তুলে খেত ... তুই হাসির সাথে কথা বলিস নি তো ?”
আমি মাথা নাড়লাম – “কী হবে, কথা বললে ?”
কাকিমা হেসে কাছে টেনে বলল – “কী দরকার ? হাসি তোর চেয়ে অনেক বড় | কবেই বিয়ের বয়েস হয়েছিল | ওর বাবা ওর বিয়েও দিয়েছিল | কিন্তু মেয়েটা খেতে না পেয়ে রইল না স্বামীর কাছে, পালিয়ে এলো | এখন রোজ শাড়ি পরে বেরয় , চেয়ে চিন্তে, এখানে ফল, ওখানে চাল ডাল ... কোনমতে দিন চলে যায় বাবা মেয়ের ... যাকগে, থাক সে সব কথা |”

এর এক দিন পরে ভয়ঙ্কর কাল বৈশাখীর ঝড় উঠল ভর দুপুরে, তার পর তুমুল শিলাবৃষ্টি | বিকেল সেই ঝড় বৃষ্টি থেমে অদ্ভুত একটা সোনালী আলো ফুটল | আমি ছুটে গেলাম জাম গাছটার কাছে | চারিদিকে অজস্র জাম পড়ে, আর বেশ কিছু শিল, তখনও গলে নি | হাসি নেই | ওকে ডেকে আনার কথা ভেবে আমি সাহস করে ঝোপঝাড়ের মধ্যে ওর আসা যাওয়ার পথ ধরে এগুলাম | একটু দূরে যেতেই দেখলাম পথটা দেয়ালের ভাঙ্গার ভিতর দিয়ে বাইরে চলে গেছে | ভাঙ্গাটায় পৌঁছে উঁকি মেরে দেখেই থমকে গেলাম | দেয়ালের লাগোয়া একটা মাটির বাড়ি, তার চাল উড়ে গেছে | একটা মাঝ বয়সী লোক দিশাহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মনে হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া জিনিস কুড়াতে কুড়াতে | একপাশে হাসি দাঁড়িয়ে, গায়ে ফ্রক | বোধহয় আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ও তাকাল আর সংকুচিত হয়ে এক হাতে বুক আর এক হাতে তলপেট আড়াল করল | আমি বললাম, “অনেক জাম পড়ে আছে, হাসি, শিল লেগে একদম ঠাণ্ডা | শিগগির চলো |” হাসি কথা না বলে মাথা নেড়ে ফিরিয়ে তাকাল | ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম পাশে একটা বাবলা গাছের উপর ওর শাড়িটা বোধহয় ঝড়ে উড়ে গিয়ে আটকে শতচ্ছিন্ন হয়ে হাওয়ায় আছড়িয়ে আক্ষেপ করছে | ইঙ্গিতটা শেষ করে হাসি আমার দিকে মুখ ফিরালে, বিকেলের পড়ন্ত রোদে চকচক করে উঠল ওর সজল দুটো চোখ – যেন দুটো শিল ছোঁয়ানো কালো জাম |

বুঝলাম জাম কুড়ানোর পালা শেষ |

----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / 12 জুন ২০১৫

বৃষ্টির কথা – ১

|| বৃষ্টির কথা  – ১ ||

এই মাত্র, সবে নেমেছে বৃষ্টি
হবে আতপ্ত ধরা ক্রমশ শীতল
এসেছ তো চলে যাবেই জানি
দাও ঝরতে বৃষ্টি, পড়তে জল

মেঘের পর মেঘ দেখে দেখে
কাটল সারাটা দুপুর, বিকেল
কত শত কথা যে ছিল বলার
কিছু আজগুবি, বাকি বিটকেল

তোমাকে সে’সব শোনাব বলে
মানত করে চেয়েছি বৃষ্টির ঝারি
আঁচল পেতে বস দোরগোড়ায়
এখনি যেও না, এত তাড়াতাড়ি

দেখ ওই তরুরা পিপাসাকাতর
খরায় বিদীর্ণ-বুক পুষ্প বাগিচায়
হাওয়া খুঁজে মরে মাটির আতর
ক্ষেত ভরা ধানি সবুজ গালিচায়

তুমি চলে গেলে কূট অভিমানে
বৃষ্টিও যাবে তোমার অনুসরণে
আমি বসে রইব খালিঘর কোনে
না বলা কথাটা গুমরে মনে মনে

সেই কথাটাই বলে নিই এবেলা
কখন থামবে বৃষ্টি তার ঠিক নেই
বৃষ্টি থামলেই আমিও উবে যাব
হারিয়ে আমার শত কথার খেই

বলি, যাবে তো যাও, চলে যাও
ছেড়ে যাও শুধু একটু আঁচল
বুকে ভরা কথা ছেঁচে, নিংড়ে
আঁচলে ভরব কিছু বৃষ্টির জল  ||


-----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১২ জুন ২০১৫

বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০১৫

অলস দুপুরে

|| অলস দুপুরে ||

গরমটা ভ্যাপসা
ঘেমে নেয়ে একসা
ভাত ভাল্লাগে না
কফি, চা ও অচেনা

আম আর জাম খেয়ে
চাতকের মত চেয়ে
মুখ ভরেছে অরুচি
হাওয়া-পানির কী সূচী ?

প্রাণ করে আইঢাই
কাম কাজ ধুর ছাই
ক্লেদাক্ত শরীরের
ছোঁয়া নাহি চাই রে


গুছিয়েআঁধার ঘর
বউ নিয়ে তার বর
খোঁজে সোঁদা গন্ধ
কিছু ভালো মন্দ

বাইরে মেঘে গুড়গুড়
নাক করে সুড়সুড়
নাক করে শিরশির
তবু ... দেখা নেই বৃষ্টির ||


------------------------------
© ইন্দ্রনীর  / ১১ জুন ২০১৫

প্রেমের উদ্ভব

This Bengali translation of the poem “The Birth of Love” by  Robert Penn Warren, is for my friend Shyamal Mazumder who had first posted it in one of the FB groups both of us belong to:

|| প্রেমের উদ্ভব ||


বিলম্বিত ঋতু, বিলম্বিত দিন, সূর্য সদ্য অস্তগত, আর আকাশ
নিরুত্তাপ পিতল, কিন্তু সজীব গোলাপের ছোঁয়ায় রঞ্জিত
মেয়েটি সেই জল, আকাশবর্ণ  - শুধু যেখানে তার উত্থান
সেখানে খানখান. থরথর রুপোর টুকরো কুচি কুচি -
ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়ায় সদ্যজাত ঘাসে
স্প্রুস গাছে এখন নব-ঘনীভূত নিশার বিপরীতে
তার নগ্নতা ঝিকমিক করে উঠে, আর ঝরে তার
বুক আর মাজা হতে প্রবহমান রুপালি রেখায়

পুরুষটি কিছু হাত দশেক দুরে এখন লম্বিত
গতিহীন,  ওই পিতল জলে তার পা  শীতল
মৃত্যুর হিমেল গভীরতায় | তার সত্তা হতে বিলুপ্ত
সমস্ত ইতিহাস আর কিছু নয়, শুধু এক চোখ |
শুধু মাত্র এক চোখ -

দেখে, তার, আর সময়ের, উপভোগে চিহ্নিত ওই দেহ
উঠতে, আর অপ্রত্যাশিত স্খলিত বাতাসের পরিবেশে
দুলে উঠে, ঝুঁকে আঁকড়ে ধরতে পল্বল কূল |
দেখে কী ভাবে সেই নারীসুলভ অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায়
সহসা উপলব্ধ এক সৌষ্ঠবতার প্রচেষ্টায়,
স্তনদ্বয় নিজস্ব অনাবিল বক্রতার ভারে অধোমুখে স্ফীত হয়
আর শ্রোণীর উত্থানে রচে চন্দ্রোদয়,
উথলিত ঐক্যে উভয়ে ঝিকমিকে রুপালী

এরপর দেহ তার ঋজু হয়, সে - যেই সে হোক - হয় আত্মস্থ
দু’হাতে তোয়ালের দুই প্রান্ত ধরে সে করে আকর্ষণ
তার পিঠে, নিতম্বে, আগু-পিছু - মুখ তুলে উচ্চাকাশে
যেখানে অতি-রঞ্জিত গোলাপি আভাস এখন ক্ষীণ
ম্রিয়মাণ, যদিও সেখানে এখনও নেই কোন তারার স্পন্দন
তার তোয়ালে এখন বিস্মৃত, গতিহীন স্থির
শুধু তার চাহনি রয়ে যায় আকাশে নিবদ্ধ

স্প্রুস গাছের আঁধার পটভূমিতে তার দেহের পরিলেখ যেন
মনে হয় নিজেরই প্রতি আকৃষ্ট, আর তার শুভ্রতায় ঘন হয়ে ওঠে
সেই আলো, যা এখনও আকাশে স্থায়ী,
অথবা জলের পার্থিব বিমূর্ত কঠোরতা হতে উত্তোলিত |
তার দেহ, এখন হাতে ঝুলন্ত তোয়ালে নিয়ে,
এক শুভ্র বৃন্ত যা থেকে তার পুষ্পিত মুখ উচ্চাকাশ পানে চায় |
এই মুহূর্তটি চরম, যার নেই কোন অনুক্রম, নেই কোন স্বীকার্য সংজ্ঞা
কেন না আর সমস্ত অনুক্রমিক মুহূর্ত তাতে বিলীন, সংজ্ঞা-সক্ষম

মেয়েটি, মুখ এখনও তোলা, এক নিদ্রালসা অঙ্গবিক্ষেপে
তোয়ালেটা জড়িয়ে নেয় তার স্তনের নিচে তার দেহে,
তারপর ঐভাবে তাকে ধরে, বিলুপ্ত মিশরের ঋত্বিকের মত
ঋজু হয়ে উঠে যায় আগাছার হিজিবিজি জটে পাক খাওয়া
সিঁড়ির ধাপ কাটা পথে |  আঁধার ঝরানো পাতার জাফরি পেরিয়ে
তার ক্ষীণ শুভ্রতা নিবুনিবু জ্বলে | জ্বলে উঠে হয় তার অন্তর্ধান |

আর অন্ধকারময় মাধ্যমে লম্বিত পুরুষটি উর্দ্ধপানে চায়
যেখানে সে জানে, অগোচরে, মেয়েটি সঞ্চারিণী |
আর সে তার হৃদয়ে আর্তনাদ করে ওঠে,
যে যদি তার সামর্থ্য থাকত, তাহলে সে হাত বাড়িয়ে ধরে রাখত
মেয়েটির উপর, তার সমস্ত গমনাগমনে তাকে রক্ষা করতে
যখন যেমনই হোক, আকাশের রুক্ষতা আর জগতের আবহাওয়া থেকে

সে দেখে স্প্রুস গাছের নিশার উচ্চতা আর উত্তোলিত দূর পাহাড়ের উপরে
প্রথম তারার অস্তিত্ব স্পন্দনে জেগে উঠে ঝিকমিক করে সেথায় |

আমি জানি না ওই তারা তাকে কী প্রতিশ্রুতি জানায় |

------ রবার্ট পেন ওয়ারেন

অনুবাদ: ©  ইন্দ্রনীর / ১১ জুন ২০১৫
----------------------------------------------------

|| The Birth of Love ||
(The Original Poem)

Season late, day late, sun just down, and the sky
Cold gunmetal but with a wash of live rose, and she,
From water the color of sky except where
Her motion has fractured it to shivering splinters of silver,
Rises. Stands on the raw grass. Against
The new-curdling night of spruces, nakedness
Glimmers and, at bosom and flank, drips
With fluent silver. The man,

Some ten strokes out, but now hanging
Motionless in the gunmetal water, feet
Cold with the coldness of depth, all
History dissolving from him, is
Nothing but an eye. Is an eye only. Sees

The body that is marked by his use, and Time’s,
Rise, and in the abrupt and unsustaining element of air,
Sway, lean, grapple the pond-bank. Sees
How, with that posture of female awkwardness that is,
And is the stab of, suddenly perceived grace, breasts bulge down in
The pure curve of their weight and buttocks
Moon up and, in swelling unity,
Are silver and glimmer. Then

The body is erect, she is herself, whatever
Self she may be, and with an end of the towel grasped in each hand,
Slowly draws it back and forth across back and buttocks, but
With face lifted toward the high sky, where
The over-wash of rose color now fails. Fails, though no star
Yet throbs there. The towel, forgotten,
Does not move now. The gaze
Remains fixed on the sky. The body,

Profiled against the darkness of spruces, seems
To draw to itself, and condense in its whiteness, what light
In the sky yet lingers or, from
The metallic and abstract severity of water, lifts. The body,
With the towel now trailing loose from one hand, is
A white stalk from which the face flowers gravely toward the high sky.
This moment is non-sequential and absolute, and admits
Of no definition, for it
Subsumes all other, and sequential, moments, by which
Definition might be possible. The woman,

Face yet raised, wraps,
With a motion as though standing in sleep,
The towel about her body, under her breasts, and,
Holding it there hieratic as lost Egypt and erect,
Moves up the path that, stair-steep, winds
Into the clamber and tangle of growth. Beyond
The lattice of dusk-dripping leaves, whiteness
Dimly glimmers, goes. Glimmers and is gone, and the man,

Suspended in his darkling medium, stares
Upward where, though not visible, he knows
She moves, and in his heart he cries out that, if only
He had such strength, he would put his hand forth
And maintain it over her to guard, in all
Her out-goings and in-comings, from whatever
Inclemency of sky or slur of the world’s weather
Might ever be. In his heart
he cries out. Above

Height of the spruce-night and heave of the far mountain, he sees
The first star pulse into being. It gleams there.

I do not know what promise it makes him.

—Robert Penn Warren

সোমবার, ৮ জুন, ২০১৫

সাজ

|| সাজ ||

ঠোঁটে
লাগিয়ে লিপস্টিক, চোখে কাজল আর আইশ্যাডো
ঘাড় অব্দি বব-কাট ছেঁটে, ব্লাউজে
পুরে মালার টর্পেডো
শ্যাম্পু করে চুল ফাঁপিয়ে, দাঁড়িয়ে থাকিস তুই মার্কেটে
মুখ ফিরিয়ে ক’ জন
দ্যাখে, বল দেখি তুই, মেরে কেটে
নামিয়ে শাড়ি নাইয়ের নিচে, যতই উপচে দেখাস দেমাক
ধম্মের ষাঁড়ও তাকিয়ে চায় না, উড়িয়া পালায় পক্ষী-কাক
আর যে পরিস শাড়ির নিচে ওই ডবল, ডবল ফুলকো সায়া
না দিলে এই গুলটা, ধরা পড়ে যাবে কি তোর সিঁটকে কায়া
হিলের জুতোর খটাস খটাসে, ফাটাস কি তুই চিংড়িপটাশ
পেটে হাঁসির গুঁতো চেপে সব, মুখেই বলে, ‘শাবাশ,শাবাশ !’

বাঘ, সিংহের চাকরি চাইলে, সুপারিশ দিতেম চিড়িয়াখানায়
কিন্তু, কী আর বলব রে ভাই, যার ভাগ্যে যা, সে তাই পায়
বরাতের দোষে  চাকরিতে তোকে সাজতে হচ্ছে ম্যানিকিন
লেখা পড়াটা করলে রাজা, বিনে সাজেতেই লাগতিস কুইন !
     ||

-------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৮ জুন ২০১৫

রবিবার, ৭ জুন, ২০১৫

খোকা-ভুলানো

|| খোকা-ভুলানো ||

উত্থিত কচ্ছে হইয়া সিকিভাগ দিগম্বর
ভীমবাবু করেন মূত্রত্যাগ বিনা আড়ম্বর
রৌপ্যরেখা নিম্নমুখী সেই ধারা ক্ষুরধার
পতনে সফেন ধরা অশ্রু গদগদ অপার

সহসা পার্শ্ব হইতে এক শিশু অট্টহাসে
“দেখে ফেলেছি” কহিয়া নাচে উল্লাসে
“তবে রে !” হাঁকেন রোষকষায়িত বাবু
“আয় দেখি কাছে” শুনি শিশু হয় কাবু

বোঝেন বাবু যে শিশুটির লাগিয়াছে ডর
মোলায়েম কণ্ঠে করেন তাহাকে আদর
“আয় না বাবা কাছে, তোকে দেব কিছু”
শুনিয়া ভীত শিশু দ্বিধায় মাথা করে নিচু

শুধায়, “আগে বলো কী দেবে আমাকে ?”
বাবু হাসিয়া রৌপ্যমুদ্রা দর্শান তাহাকে
“কিন্তু, কেন দেবে ?” শিশুর পুনঃ প্রশ্ন
বাবুর হয়েন ধৈর্যচ্যুত, কণ্ঠস্বর হয় উষ্ণ

কহেন দুই হস্তে বেষ্টিয়া নিজ স্ফীতোদর
“দেখছিস না এই ভুঁড়ি, ওরে বিচ্ছু বাঁদর
পাই না দেখতে আমি আর এইটার নিচে
ঝুঁকতেও পারি না, কুপোকাত হই পাছে”

“তুই তো দেখতে পেলি, বড়ই ভাগ্যবান
বলিস না কাউকে, কিন্তু, মলে দেব কান
রাখিস যদি মুখবন্ধ তুই, না ঘটিয়ে অনর্থ
দিতে পারি সামর্থ্য অনুযায়ী সামান্য অর্থ”

দুষ্ট শিশু, ছিনিয়া মুদ্রাটি, সবেগে পালায়
“অত্তোটার এইটুকু দাম !” শুনাইয়া রায় !     ||


------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৭ জুন ২০১৫

শুক্রবার, ৫ জুন, ২০১৫

অবশেষে বৃষ্টি

|| অবশেষে বৃষ্টি ||


রণে অবতীর্ণ বৃষ্টি, হাঁকে বাজ কড়া
অগ্রদূতের পদতলে সোঁদাগন্ধ ধরা
জানালা ডিঙিয়েছে ধুঁয়ো ধুঁয়ো ছাঁট
গরাদের পাঁজর ভিজে আহ্লাদে আট
পাটে তুলে দিয়ে ভাতঘুম অক্লেশে
শিশুরা উদোম ভেজে চড়ুই উল্লাসে
ছাতা মাথায় কে এক যায় একাকিনী
তুলে নূপুরে জলের সুর, ওই অঋণী
উড়ে যাক না তার ছাতা, সে ভিজুক
বৃষ্টি সবে এলো, একটু হবেই ভুলচুক

তাই বৃষ্টি ঝিপঝিপ, তাই হাওয়া সনসন
বলি … ‘দেবে কি ধার, কেউ তার মন ?’


--------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৫ জুন ২০১৫

ভাড়া বাড়ি

|| ভাড়া বাড়ি ||

বোতাম টিপলে জল পড়ে
কল খুলে খাই বেদম শক
ফ্রিজ খুললে গরম হাওয়া
ছাতে ফ্যান করে বকরবক

দরজা খুললেই সারমেয়রা
জানলা খুললে হাজার মশা
বাথরুমেতে বিড়ালের ভিড়
শোয়ার কামরা ছুঁচোর বাসা

চুলোগুলো যে গেছে চুলোয়
হাঁড়ি কড়াই মেঝেয় গড়ায়
আর হাতা খুন্তির ঠোকাঠুকি
কুরুক্ষেত্র-রণ স্মরণ করায়

তবুও নতুন বাড়ির পড়শি
সাত সকালেই খবর নেয়
চায়ের মতন চিনিটা চেয়ে
বিটকেল নুন ফেরত দেয়

সকালে খায় ফ্যানা ভাত
দুপুরে চিবায় খবরকাগজ
সন্ধ্যাবেলা আলাপ ছলে
চেটে খায় আমার মগজ

ভাড়া বাড়ির সবই ভালো
দক্ষিণাও তেমন মন্দ না
সবার ভালো পড়শি-বালা
ভারি মিষ্টি নাম, ‘গঞ্জনা’ ||

------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০5 জুন ২০১৫

মঙ্গলবার, ২ জুন, ২০১৫

অঙ্কোপরি

|| অঙ্কোপরি ||


(কোলুপরি পরী নয়, নয় সে মোটে কোলাপুরি
উপরি যা কিছু কোলে সয়, সন্ধিতে কোলুপরি)
.
ব্র্যাঞ্চ আপিসের নটুবাবু, ঘেমে হয়রান, ক্লান্ত
বাড়ি ফিরে খাবেন বলেন, নুন, নঙ্কা, পান্তো
একটু খেলেই ওঠে তাঁর জোড়া চোঁয়া-ঢেকুর
শুনেই সাথে ককিয়ে ওঠে পোষা নেড়ি কুকুর
ক’দিন ধরেই হচ্ছে এমনই বুক-জ্বালা, অম্বল
সারা শরীর ঘামে সপসপ; হাত, পা, গা দুর্বল
গিন্নি বলেন, “জলটা খাও, নইলে খাবে বিষম !
“জোয়ান আরক খেয়ে দ্যাখ, হয় যদি উপশম”
.
(কিন্তু)
কথায় তিনি যতই পটু, হতাশ মাথা নাড়েন নটু
মাথায় ঘোরে বড়সায়েবের জবাব, “নটু ! নো টু !”
.
(শোনো)
বাংলায় এর তর্জমা বলি, ‘চলবে নাকো জোড়া’
(না, না, নয় গাধা-ঘোড়া, না গোদে বিষফোঁড়া)
আসলে, নটু চেম্বারেতে ডাকেন যেই টাইপিস্ট
সুযোগ বুঝে মিসটি বলে, “স্যার, লেট মি সিট”
এই বলে সে দোর ভেজিয়ে বসে কোলের উপর
ক্রমে, ক্রমে এই উপরির কথা চারিদিকে চাউর
নজরদাররা বলে, “স্যার, ঘটনাটা যা শুনছি, কী ?
“কোলুপরি এক সাকি আপনি পেয়েছেন নাকি !”
প্রমাদ দেখে নটু করেন টাইপিস্টকে ছুটি দান
বন্ধ সবার মুখ, বন্ধ আপিসি চিঠি আদানপ্রদান
মরিয়া নটু ভাবেন, ‘যদি পাই একটা ল্যাপটপ,
‘চিঠি মুসাবিদা করে ফেলি, টাইপ করে টপাটপ’
করেই হেন আবেদন তিনি পেলেন উত্তর কটু
বড়সায়েবের সংক্ষিপ্ত ঐ টিপ্পনী, “নটু ! নো টু !”
.
মানে, বাছা, হিসাব সাঁচা - টাইপিস্ট, কম্প্যুটার
একটার বেশি কোলুপরির কোরো না আবদার  ||


# অঙ্কোপরি [aṅkōpari]  অব্য.  কোলের উপর । [সং. অঙ্ক+উপরি] । দ্রঃ: http://www.ovidhan.org/b2b/পরি

-------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০২ জুন ২০১৫