শনিবার, ১৮ জুন, ২০১৬

হাট দরজা

|| হাট দরজা ||


পুরীতে বেড়াতে গিয়ে ভাগ্যচক্রে দেখা হয়ে গেল সোনালী আর প্রতিমার সাথে | ওরাও বেড়াতে এসেছে আমাদের মত, স্বামী-স্ত্রী | সবাই একই হোটেলে উঠেছি – পুরীর বি.এন.আর | সবারই এক সন্তান, বিদেশে থাকে | অবসর জীবনে ফি বছর পুরী দর্শন |

সোনালী আমার ছোটবেলার নার্স-ডাক্তার খেলার সাথী | আমার মাকে বলত, তিতুন যদি বড় হয়ে ডাক্তার হয় তাহলে আমি ওর হাসপাতালেই নার্স হব | প্রতিমা আর আমি একই কলেজে পড়েছি | ফষ্টিনষ্টি করেছি, হাতখরচ ধার নিয়েছি, পরে শোধ করব বলে | এ ছাড়া আর কোনও স্বপ্ন দেখাই নি | তাও বন্ধুরা বলত ও আমাকে চাইত | ভগবানের ইচ্ছেয় দুটো সম্পর্কই বেশি দূর গড়ানোর আগে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে | অথচ, বিয়ের মেয়ে যখন দেখা হচ্ছে, মা একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “বল না, কী ধরনের  মেয়ে পছন্দ তোর | নাকি সোনালী ... না প্রতিমা ?” আমি বলেছিলাম, “যা ভালো বোঝ তাই কর | আমার সব চলবে |”

যাই হোক, সেই সময়ের স্মৃতি এখন ক্ষীণ | তাই এইভাবে দেখা হয়ে যাওয়ায় কারো কোন দ্বিধা বা বিকার দেখা দিল না | সোনালী আমার আলাপ করিয়ে দিল ছোটবেলার এক-পাড়ার বন্ধু বলে, আর প্রতিমা পরিচয়ে বলল আমরা এক কলেজে পড়েছি |

তাও জানি না হয়ত মেয়েরা যখন আলাদা বসেছে, গল্প করেছে, সব রকম কথাই হয়েছে |

একদিন রাত্রের খাবার খেয়ে বারান্দায় বসে আড্ডা হচ্ছিল | বা বলা যায় স্মৃতি চারণ | তপন কে আমাদের ছোটবেলার নার্স-ডাক্তার খেলার গল্প বলল সোনালী – কী ভাবে রুগীর অভাবে আমি ওকেই লেমনেডের ওষুধ গেলাতাম | প্রতিমা নয়নকে বলল, কী ভাবে আমি ওর কাছে টাকা ধার নিয়ে বলতাম একদিন ফেরত দেব – যেদিন আর আসে নি | সব মিলিয়ে সুদে আসলে আজ হয়ত কয়েক শ’ টাকা হয় |

কাকলী মুচকি মুচকি হেসে গল্প উপভোগ করছিল | তারপর হটাত কেমন গম্ভীর হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল | তাই দেখে সোনালী ওকে চেপে ধরল, “কাকলী, তোমার কোন গল্প নেই ?” প্রতিমা বলল, “হ্যাঁ, বলো না, কাকলী ! কিছু মনে পড়েছে বুঝি ?”

একটু চাপাচাপি করার পর, কাকলী আমার দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ গলায় বলল, “তিতুন, আজ যদি তোমাকে একটা সুযোগ দেয়া হয়, আমাদের তিনজনের মধ্যে একজন কে বেছে নিতে, তুমি কাকে টানবে ?” দেখলাম কাকলীর চোখ কৌতুক সত্ত্বেও একটু চিকচিক করছে | আমিও একটু হেসে বললাম, “আমি কাকে নেব, না কে আমাকে নেবে ?” কাকলী বলল, “তোমার কী মনে হয় ?” আমি বললাম, “মানে ... পুরানো টানের প্রশ্ন তো | মস্ত সমস্যা | চট করে এর উত্তর দেয়া যায় না | তবু ভেবে দেখব | তার আগে এক ঘুম দিই | চলো এখন শোয়া যাক | কাল না হয় বলব |”

মনে হল সকলের ধরে রাখা স্বস্তির নিঃশ্বাস একসাথে পড়ল |

পরদিন জলখাবার টেবিলে বললাম, “শোন সবাই, কালকের সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে ... এক স্বপ্নে |”
সবাই সমস্বরে বলল, “স্বপ্ন ! কী স্বপ্ন ? কাকে নিয়ে ?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ |” সবাই সমস্বরে হইচই করে উঠল, “বলো, বলো |”

আমি বললাম, “স্বপ্ন দেখেছি আমরা সমুদ্রে স্নান করে ফিরেছে | সোনালী, প্রতিমা আর কাকলী যে যার ঘরে চলে গেছে স্নান করে কাপড় বদলে আসতে | একটু পরে আসছি বলে আমরা তিনজন চা খেতে বসেছি | এক ফাঁকে বাথরুম যাওয়ার নাম করে উঠে গিয়ে আমি এক এক করে তিনটে ঘরের দরজায় টোকা দিলাম | তিনজনেই প্রশ্ন করল, ‘কে ?’ আমি চাপা গলায় বললাম, ‘আমি !’ ”

এতটা বলে আমি চায়ের কাপ তুলে মুখ নামিয়ে চুমুক দিলাম | এক, দুই ... ‘বেশ ভালো চা ...উমদা চা ...’
কাকলী বলল, “ইস! থামলে কেন ?”

আমি বললাম, “দু’জন উত্তর দিল, ‘দরজা ভেজানো আছে |’ শুধু একজন বলল,‘দাঁড়াও, কাপড় বদলে দরজা খুলছি |’ ”

সোনালী বলল, “মোটেও না ! অভদ্র কোথাকার !”
প্রতিমা বলল, “ইস, কী অসভ্য ! বয়ে গেছে !”
তপন বলল, “আমি কিছুই বুঝলাম না |”
কাকলী বলল, “এটা অসম্ভব কিছু নয় |”
নয়ন বলল, “কাকলী, কী অসম্ভব নয় ?”

কাকলী বলল, তপন আর নয়নের দিকে তাকিয়ে, “তিতুন খুব ভালো অন্যের গলা নকল করতে পারে | জাস্ট বিয়ের পর একবার বাবার গলা নকল করে ও আমাকে ফোন করে বলেছিল, ‘শোন, জয়ন্ত আজও ফোন করেছিল | ও নাকি তোকে ভুলতে পারছে না | কী করি বলতো ?”


------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৮ জুন ২০১৬

বুধবার, ১৫ জুন, ২০১৬

নিশানা

|| নিশানা ||


সোমেন বাবু বললেন, প্রেমের গল্প শুনবেন ? বিয়োগান্ত ?

আমি উত্তর না দিয়ে একটু নড়েচড়ে সজাগ হয়ে বসলাম | সোমেন বাবু বললেন,

আমি তখন পাশ করে কাজের জন্য হন্যে হয়ে আছি | বৌদির কাছে হাত পেতে চা, সিগারেট খাই | পাড়ায় হরির দোকানে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিই | চা শেষ হয়ে এলেও শেষ বিন্দুটা খুরিতে লেগে আছে কল্পনা করে মুখ উঁচু করে খুরিটা কাত করে ঝাঁকাই | পকেটে দেশলাই বাক্সে কাঠির বদলে আধ খাওয়া সিগারেট থাকে | অনেক বন্ধু চাকরি পেয়ে চুটিয়ে প্রেম করছে, আমার কেউ নেই | তাই মন ভালো থাকে না |

একদিন পাড়ার রাস্তা দিয়ে সকাল সকাল যাচ্ছি, দেখি একটা কাগজ বিলি করা চ্যাংড়া মার্কা ছেলে প্রাণপণ চেষ্টা করছে তেতালায় একটা কাগজ ছুঁড়ে ফেলার | বারবার সেটা নিচে পড়ে যাচ্ছে | উপরে তাকিয়ে দেখলাম তেতলায় ব্যালকনিতে একটা অল্প বয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে | আমি তাকাতেই মেয়েটা সরে গেল | আমার কী মনে হল, বললাম, “দাও তো ভাই দেখি, আমি একবার চেষ্টা করি |” ছেলেটা একবার উপরে তাকিয়ে অনিচ্ছুক ভাবে আমাকে কাগজটা দিল | আমি নিজেও কয়েকবার চেষ্টা করে পারলাম না | ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনার দ্বারাও প্রেম করা হবে না | মাঝখান থেকে আমার কাগজটা চোট খেল |” আমি অবাক হয়ে বললাম, “মানে ?” ছেলেটা বলল, “মানে আর আপনাকে বুঝতে হবে না | দিন কাগজটা | যাই আমি উপরে গিয়ে দিয়ে আসি |” আমার হটাত রাগ হয়ে গেল | আমি বৌদির কাছে থেকে নেয়া টাকাটা পকেট থেকে বের করে বললাম, “এই নাও কাগজের দাম |” ও কিছুতেই নেবে না | তখন ওর পকেটে জোর করে টাকাটা গুঁজে দিয়ে আমি হনহন করে হরির দোকানের দিকে পা বাড়ালাম | ছেলেটা পিছন থেকে এসে আমার হাত ধরে টেনে বললে, “দাদা, ভুল হয়ে গেছে | আর বলব না | কাগজটা ফেরত দিন |” আমি ওকে এক বকুনি দিলাম | ছেলেটা কাঁচুমাচু মুখ করে চাপা গলায় একটা বিরক্তিকর গালাগাল দিয়ে চলে গেল |

হরিকে পকেটে পয়সা নেই বলে চা চেয়ে কাগজটার হেডলাইনে চোখ বুলিয়ে খেলার পাতায় যাব বলে খুলতেই কাগজটার ভিতর থেকে একটা হ্যান্ডবিল বেরল | নির্ভুল ভাবে আধ-ভাঁজ করা দেখে অবাক হলাম – হ্যান্ডবিল তো খোলা রাখা হয় | এটা এমন ভাঁজ করা কেন ? ভাঁজটা খুলে দেখি আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় কোনও এক মিলিকে কিছু আবোলতাবোল আবেগের কথা লেখা | তারই মধ্যে লেখা –

আমি যখন তোমাদের বারান্দায় কাগজ ফেলি, তুমি যদি বারান্দায় এসে দাঁড়াও তাহলে দেখবে আমার হাতের নিশানা ভুল হয় না | আমি এক টিপেই তোমার গায়ে কাগজটা ফেলতে পারি |

মুখের হাসি চেপে হ্যান্ডবিলটা পকেটস্থ করলাম | ফেরার পথে বাড়িটার সামনে এসে দেখি তার একপাশে সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাওয়ার দরজায় মেয়েটা দাঁড়িয়ে | হয়ত উপর থেকে আমাকে আসতে দেখেছে | হয়ত আমার জন্য অপেক্ষা করছিল | আমাকে দেখেই আমার হাতের কাগজের দিকে তাকালো | আমি বোধহয় একটু ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসেছিলাম | তাই দেখে মেয়েটা চোখ নামালো |

আমি বাড়ি ফিরে বৌদিকে ঘটনাটা বললাম | বৌদি, দেখি কাগজটা, বলে আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়েই ব্লাউজের মধ্যে কাগজটা সোজা চালান করে দিল | হাতাহাতি করার সুযোগ পেলাম না |

বিকেলে আমাকে চা দিতে এসে বৌদি বলল, “তোমার কাগজটা আমি মিলিকে দিয়ে এসেছি, দুপুরে |” আমি বললাম, “মিলি ?” বৌদি বলল, “আহা ! ন্যাকা  সাজা হচ্ছে ?... জানো, মিলি কাগজটা পড়ে বলল, তোমার দেওরের হাতের নিশানাও এমন কিছু ভালো নয় |” 


---------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৫ জুন ২০১৬

বুধবার, ৮ জুন, ২০১৬

চুল জড়িয়ে

|| চুল জড়িয়ে ||


দুপুর দুটো নাগাদ প্রমথকে স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখে রথীন বলল, “বাবা, আপনি বিশ্রাম নেবেন না ?” প্রমথ বললেন, “না, আজ মনে হচ্ছে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছি | অনেকদিন পরে তোমাদের সাথে খেলাম তো | কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করি নি |” বিশাখা পাশে এসে বসে বললে, “কেন বাবা, কী কষ্ট হচ্ছে ? একটু জোয়ান দেব ?” প্রমথ ম্লান হেসে বললেন, “না রে, থাক | পেটটা একটু ভার হয়েছে | আবার ঠিক হয়ে যাবে |” রথীন বলল, “বাবা, আমার মনে হয় আপনি শুয়ে পড়লে ঠিক হয়ে যাবেন |”

বিশাখা বলল, “বাবা ভাত বেশি কেন খেলে ? তুমি খিদের আন্দাজ করতে পার না ?” প্রমথ বললেন “ভাতের আন্দাজ তো আছে | কিন্তু তুই এত সব রেঁধেছিলি, তাতেই বেশি হয়ে গেল |” রথীন অবাক হয়ে বলল, “বাবা আমি বুঝলাম না |” প্রমথ বললেন, “কত খিদেয় কত ভাত খেতে হয় তার অভ্যাস তো সেই ছোটবেলায় হয়েছে | তখন ভাত খাওয়া বলতে সাথে একটু ডাল, আর আলু পোস্ত কি কুমড়োর ছেঁচকি, গরমকালে ডালে সর্ষে ফোড়ন দিয়ে দুটো কাঁচা আমের টুকরো ছেড়ে দেয়া | সপ্তাহে হয়ত একদিন পোনা মাছ | তখন ভাত খেয়েই পেট ভরত | আর আজ ...” বিশাখার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “মেয়ে আমার কত পদই যে রেঁধেছিল | তাই ভাতের সাথে আনুষঙ্গিক সব খেয়েই খাওয়াটা বেশি হয়ে গেল | দোষটা ওই ছোটবেলার অভ্যাসের |” রথীন বলল, “আমরা যখন নেই, তখন কি আপনি বেশি খান না ?” প্রমথ বললেন, “তোমরা না থাকলে মিন্টুর মা ওই এক তরকারী, ডাল ভাত করে দিয়ে যায় | ও না এলে আমি আলু ডিম সেদ্ধ করে ফ্যানা ভাতের সাথে খেয়ে নিই |”

রথীন বলল, “আপনি যদি না ঘুমন তাহলে চলুন কোথাও থেকে ঘুরে আসি | এমন শীতের দুপুর ... |” বিশাখা আঁতকে উঠে বলল, “এখন কোথায় যাবে ? আমার যে ভাত ঘুম পাচ্ছে |” “আহ, চলো না | বাবার গাড়িটা কতদিন পড়ে আছে |” প্রমথ বললেন, “না, বিশু এসে মাঝে মধ্যে স্টার্ট দিয়ে যায়, জল, তেল, ব্যাটারিও দেখে নেয় | তবে সেই তোমরা পুজোয় এসেছিলে, তারপর আর গাড়িটা নড়ে নি |” চাঙ্গা হয়ে উঠে প্রমথ বলল, “চলো তাহলে | আমরা পুরুলিয়া ঘুরে আসি |” বিশাখা বলল, “আমি যদি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ি ?” প্রমথ বলল, “কোন অসুবিধা নেই |”

কোকালিয়া পার হতেই পিছনের সিট থেকে প্রমথ রথীনের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, “মেয়ে আমার ঘুমিয়ে পড়েছে |” রথীন গাড়ি চালাতে চালাতে ঠিক দেখে নি | খুব আস্তে করে গাড়িটা রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে নেমে বাঁ দিকের দরজা খুলে বিশাখার সিটটা পিছিয়ে দিয়ে তার পিঠটা পিছনে হেলিয়ে দিল | বিশাখা একবার উঁ করে উঠে শরীরটাকে হেলান সিটে মিশিয়ে নিল | তারপর মৃদু স্বরে বলল, “থেমো না | চালিয়ে যাও |”

রথীন গাড়িটা চালু করে একটু বেগ নিতেই প্রমথ বললেন, “সামনের লেভেল ক্রসিংটায় একটু থামবে ?” রথীন দেখতে না পেয়ে বলল, “কোথায় লেভেল ক্রসিং ?” প্রমথ বললেন, “চলো, আরও মাইল কয়েক পরে, রঘুনাথপুর ঢোকার আগে | ওখানে একটু থেমো |”

লেভেল ক্রসিং পৌঁছে রথীন ভুলে গিয়ে পার হয়ে যেতে যেতেই প্রমথ বললেন, “এই এখানে ... এখানে একটু থামো |”

জোরে থামানো গাড়ির ঝাঁকুনিতে বিশাখা চোখ খুলে বলল, “কোথায় এলাম আমরা ?” প্রমথ বললেন, “টুকু পিসির লেভেল ক্রসিংয়ে | তুই নামবি ?” বিশাখা বলল, “না, তুমি যাও | আমরা একটু গাড়িতেই বসছি |”

প্রমথ গাড়ি থেকে নেমে রেল লাইনের দিকে যেতে শুরু করলে ওনার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রথীন বলল, “টুকু পিসি কে ? আমি তো কোনদিন নাম শুনি নি |” বিশাখা বলল, “আসলে পিসি নয় | বাবার ছোটবেলার খেলার সাথী |”
-    “গার্লফ্রেন্ড, বান্ধবী ?”
-    “ঊঁহু ... বাবার ছোটবেলার খেলার সাথী |”
-    “ও |” না বুঝে রথীন চুপ করে থাকলো |

একটু পরে বিশাখা বলতে শুরু করল ...
“বাবা আর টুকু পিসি ছোটবেলায় একসাথে খেলত | খেলার মধ্যে ঝগড়াও ছিল | মাঝে মধ্যেই চুল জড়িয়ে ঝগড়া করত | দুজনের বাবা মা ওদের ছাড়াতে পারত না – এই ভাব, তো এই ঝগড়া, তো এই আড়ি |”

রথীন বিশাখা চুপ করে যাওয়ায় বলল, “তোমার গল্পটা এখানেই শেষ নয় বোধহয় ?”

বিশাখা আবার বলতে শুরু করল ...
“বড় হয়ে ওঠার আগেই দুজনে আলাদা | তারপর টুকু পিসির কী হল কে জানে | এদিকে, আমি ছোট থেকে দেখেছি বাবা মার সাথে ভীষণ ঝগড়া করত, কী প্রচণ্ড অনমনীয় মনোভাব নিয়ে, সে বলার নয় | কারণ জানতাম না, কিছু বুঝতামও না |

“তারপর, একদিন, তখন আমি স্কুলে এইটে উঠেছি | টুকু পিসি বাড়িতে এল | খুব বড় অসুখ থেকে উঠেছিল | পিসেমশায় আসতে পারে নি | পিসিকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল, বাবা স্টেশনে গিয়ে নিয়ে এসেছিল | একদিন বাবা, আমাকে, মাকে আর পিসিকে নিয়ে গাড়িতে করে এখানে এসেছিল | পিসি সারাটা পথ চুপ করে বসেছিল |

“এখানে নেমে, বাবার কী মনে হল, বলল, টুকু, চল ছোটবেলার মত চুল জড়িয়ে ঝগড়া করি | ও মা ! জানো, পিসি কী বলল ? বলল, ঝগড়া করার মত আর চুল কি আছে যে ঝগড়া করব তোমার সাথে | বাবা অবাক হয়ে বলল, কেন ? পিসি মাথায় পরা পরচুলা খুলে বলল, এই দ্যাখো |

“কেমোথেরাপি করে পিসির সব চুল পড়ে গিয়েছিল | এর কিছুদিন পরে পিসি ফিরে গেল | তারপর আর বেশিদিন বাঁচে নি |

“ পিসির মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পর মায়ের অদ্ভুত পরিবর্তন হল | কদিন খুব কাঁদলো | তারপর আমাকে একদিন ডেকে বলল, দেখিস, তোর বাবার সাথে আমি আর ঝগড়া করব না | আমি না বুঝে বললাম, ভালোই তো | কিন্তু বাপি যদি করে ?

“আমি তখন বাবাকে বাপি বলতাম ...
   
“মা বলল, করলে আমি মুখ বুজে থাকব | আমি বুঝেছি ... ও কি আর আমার সাথে ঝগড়া করে ? ও তো ওই টুকু পিসির সাথে ঝগড়া করে | বলে মা আবার কাঁদতে লাগল |

“তারপর আমরা আর এখানে আসি নি | আমি জায়গাটার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম |”


----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৮ জুন ২০১৬

শুক্রবার, ৩ জুন, ২০১৬

ইতিবৃত্ত

|| ইতিবৃত্ত ||


প্রথমে, আমার কিছু সর্বশেষ লেখার উল্লেখ করি :

  1.  কাব্যকল্প - ওথেলোর একালাপ
  2. গল্প – অপেক্ষা 
  3. কবিতা -মেনি বিড়াল
  4. রম্যরচনা - কাঁচা লাউয়ের সোওয়াদ
  5. অনুবাদ - তুষার সন্ধ্যায় বনানী সমীপে বিরাম
  6. রম্য ছড়া - মধুমেহ
  7. নাটকীয় গল্প -পাঁচ মিনিট

২০১৩’য় কর্ম জীবন থেকে অবসর নিয়ে মনে হয়েছিল ‘অনেক পড়েছি, এবার কিছু লেখা যাক !’ ব্লগিং শুরু করেছিলাম |

মাতৃভাষার সাথে মৌখিক ছাড়া প্রায় সব বাকি সম্পর্ক স্কুল ছাড়ার পরেই চুকে গিয়েছিল | উল্লেখযোগ্য বাংলা লেখা শেষ পড়েছি মনে হয় সমরেশ বসুর ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ঘুণ পোকা’ ... তারপরেই কলেজের নানান চাপ, নকশাল গোলমালের ফলে দক্ষিণ ভারতের কলেজে স্থানান্তর, চাকরি প্রথম এগারো বছর দক্ষিণ ভারতে | এইভাবে, ক্রমে ক্রমে বাংলা বলাও, এক নিজের বাড়িতে ছাড়া, বিরল হয়ে উঠল | তারপর পড়া বলতে শুধু অফিসের কাগজ পত্তর আর যত প্রাযুক্তিক বিবরণী |

লিখতে শুরু করে বুঝলাম ব্যবসায় জগতে মার্কেটিংয়ের এত গুরুত্ব কেন – বেচতে হলে খরিদ্দারের হদিস তো চাই ! তাই বন্ধুদের গ্রুপ-মেইল থেকে টুকে একটা বিরাট তালিকা করে ফেললাম ই-মেইল ঠিকানার | প্রথম লেখাগুলো ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠাতাম | অচেনা লোকের কাঁচা লেখা – কেউ দয়া করে পড়লেও কোনও মতামত কি সমালোচনা জানাত না | তখন এই ব্লগিংয়ের ধারণা মাথায় ঢুকল | কবে জানি না ‘গুগল ইনপুট টুল’ ডাউনলোড করে ফেলেছিলাম, সেই সাথে অভ্র স্পেল চেকার | কিছুদিনেই দেখলাম গড়গড় করে লিখে ফেলছি – তবে পাঠক তাও তেমন জুটল না | তখন খোঁজ পেলাম lonelyblogs.com এর | ওদের পাতায় লেখা “We made this website in order to support bloggers from all over the world and the blogger community.”

বেশ কিছুদিন আগে ওদের খাতায় নাম লিখিয়েও ফল পেয়েছি খুব সম্প্রতি |  সেপ্টেম্বর – অক্টোবর ২০১৫ থেকে দেখছি আমার ব্লগে পদধ্বনির কম্পাঙ্ক বেড়েছে | 

পাঠকের কাছে অনুরোধ: পড়ে ভালো লাগলে মন্তব্য করবেন | কিছু জানতে / জানাতে চাইলে যোগাযোগ করবেন এই ঠিকানায়: Indroneer@gmail.com


-------------------------------------------------------

মঙ্গলবার, ৩১ মে, ২০১৬

পরাণকালী

|| পরাণকালী ||

হটাতই দেখা হয়ে গেল ভবতোষের সাথে । মুচিপাড়ায় গিয়েছিলাম ইলেকট্রিকের বিল জমা দিতে । ফিরে আসছি, বড় রাস্তায় বাস ধরব বলে । সামনে দেখলাম একটা আদুড় গায়ে ছেলে, কোমরে ঘুনসিতে কড়ি বাঁধা, একটা বুড়ো মানুষের পিছন পিছন চলেছে, হাতে এলুমিনিয়ামের বাটি । যদিও মনে হল না ও কিছু চাইছে, তবুও বুড়ো মানুষটা থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বন্ধ ছাতাটা উঁচিয়ে ছেলেটাকে মারার ভয় দেখাচ্ছে । ছেলেটা থমকে দাঁড়িয়ে থেকে একটু পরে আবার বুড়ো মানুষটার পিছু নিচ্ছে । ওই ছাতা উঁচানো ভঙ্গি দেখে মজা লাগলে কিছু একটা কথা পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ল না । বাস স্ট্যান্ডে যখন পৌঁছলাম, বুড়োটা দেখি দুই হাঁটুর মাঝে ছাতাটা ধরে ধুতির কোঁচা তুলে মুখের ঘাম মুছছে । ব্যাস, মনে পড়ে গেল স্কুলের সহপাঠী ভবতোষের কথা । কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা, কি শীত – ভবতোষ স্কুলে ছাতা আনতো । পাছে আমরা ওটা লুকিয়ে ফেলি, ও ছাতাটা সব সময় আঁকড়ে থাকত । মাঝে মাঝে আমাদের ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে হাত তালি দিতে দুই হাঁটুর মাঝে ছাতাটা চেপে ধরত । আর বেশি বিরক্ত করলে, ঠিক এই ভাবে ছাতা উঁচিয়ে আমাদের মারবার ভয় দেখাতো ।

বুড়োটা ঘাম মুছে কোঁচা ছেড়ে আমার দিকে তাকাল | অবাক হয়ে, 'আরে ওই বাচ্চাটা হটাত করে বুড়ো হয়ে গেল কী করে ?' এইরকম মুখের ভাব করে ঘুরে ফিরে দেখল, না বাচ্চাটা ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে । বিরক্ত হয়ে বাচ্চাটাকে বলল, “এই যা পালা । ওই দ্যাখ বাস আসছে । আমি উঠে গেলে তুই কী করবি ? হ্যাঁ ?” বাচ্চাটা বুড়োটার দিকে ছদ্ম অভিমানের চোখে দেখল | যেন ওকে বলল, ‘কেন ? তুমি আমার ভাড়াটা দিলেই তো হয় ! চল না, সাথে নিয়ে, দাদু !’

“ওফ, কী জ্বালাতন রে বাবা ... দেখছেন আপনি, কী আপদ জুটেছে ?” বলে ভবতোষ আমার মুখের দিকে তাকিয়েই, ভ্রু কুঁচকে, চালশে চোখ দুটো ছোট করে বলল, “মহাদেব না ? হটাত কোথা থেকে উদয় হলি ?” আমি হেসে বললাম, “আমি তোর পিছন পিছন আসছিলাম । তুই ছাতা দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছিলি, তাই লক্ষ্য করিস নি ।” “মাছি ?”, বলে ও অবাক হয়েই হেসে ফেলল | বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস । এক এক দিনে এক এক জ্বালা !” “কিসের জ্বালা ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম । কথাটা যেন শুনতে পায় নি সেই ভাবে ভবতোষ বলল, “তা, এদিকে কোথায় এসেছিলি ? থাকিসই বা কোথায় । বাস ধরবি মানে দূরে কোথাও থাকিস নিশ্চয় ?” আমি বললাম, “থাকি ঘোষপাড়ায় । এসেছিলাম ইলেকট্রিকের বিল দিতে । তুইও তো এখানে থাকিস না । কোনও কাজে এসেছিলি ?” ভবতোষ আমার প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে বলল, “ওই তো বাস । আমিও যাব ওই বাসে । স্টেশনে নেমে মদনগোলা প্যাসেঞ্জার ধরব । ওখানেই আছি গত দু’বছর ।”

স্কুল ছেড়ে আমি সায়েন্স কলেজে গেলাম, আর ভবতোষ গেল বি-কম পড়তে । একটু আধটু যা দেখা সাক্ষাত হত বিয়ের আগে, বিয়ের পর আমি কলকাতায় গেলে আর তাও বজায় থাকে নি । তবে মাঝে মাঝে একটু আধটু এর ওর কাছ থেকে খবর পেতাম । শুনেছিলাম ব্যাঙ্কে যোগ দিয়ে বিয়ে করেছিল । ছেলের শখ ছিল, কিন্তু পর তিন তিনটে মেয়ে হয় । বেচারার প্রথম মেয়ের বিয়ে দেয়ার পর নাকি প্রায়ই বাপের বাড়ি ফিরে আসত । বলত স্বামী পছন্দ হয় নি । তারপর একদিন কারো সাথে উধাও হয়ে যায় । দ্বিতীয় মেয়েটা বছর তিরিশ বয়সে বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মারা যায় । আর তৃতীয় মেয়েটা মাধ্যমিকে ফেল করে প্রেম ট্রেম করে | তাতেও ফেল করে বিষ খায় । প্রত্যেকবার খারাপ খবর শুনে মনে হয়েছে একবার গিয়ে দেখা করে আসি । হয়েই ওঠেনি । শেষ দেখা একবার কলকাতা থেকে ফেরার ট্রেনে – সেও তো বছর তিন চার হবে । সেই চেহারা আর এখন নেই | এখন ভবতোষ যেন একটা আধ পোড়া চেলা কাঠ |

বাসে উঠে ফাঁকা সিট পেয়ে একসাথে বসে দুজনের দুটো টিকিট কেটে ফেললাম । স্টেশনটা পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিট | কিন্তু রাস্তাটা রেললাইনের এপার ধরে লেভেল ক্রসিং পার করে স্টেশনে ফিরে এসেছে লাইনের ওপার ধরে । তাই বাসে পরের পরের স্টপ । আমাকেও স্টেশনে নামতে দেখে ভবতোষ অবাক হয়ে বলল, “তুই যে বললি ঘোষপাড়ায় থাকিস ।” বললাম, “চল, তোর সাথে কত বছর পরে দেখা । আমি তো তোর মুখ দেখে চিনতেই পারতাম না, যদি না তোর ওই ছাতা ধরা মুদ্রাটা দেখতাম ।“ ভবতোষ একগাল হাসল | বললাম, “মদনগোলার গাড়ি তো যা জানি, ঘণ্টা দু'ঘণ্টায় আসে | চল, তাহলে ততক্ষণ তোর সাথে গল্প করে নিই |” “ কিন্তু, তোর ফ্যামিলি, মানে মিসেস ?”, ভবতোষ জানতে চাইল, “তোর দেরী দেখে চিন্তা করবে না ?” বললাম, “না, সে পাট চুকে । বউ সগ্গে গেছে এক বছর আগে । ছেলে কলকাতায়, মাঝে মধ্যে আসে । সারা সময় একাই থাকি । তোর খবর বল । এখানে মুচিপাড়ায় কার কাছে এসেছিলি ?”

ভবতোষ ছাতাটা মাটিতে ঠেকিয়ে হাতলটা দু হাতে ধরে আকাশের দিকে মুখ তুলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তার মানে, আমাদের সেই স্কুল থেকে এক যাত্রায় এই একটা ফল অন্তত পৃথক হয় নি, তাই না ? আমারও গিন্নি গত বছর বিদায় নিয়েছে ।”

বুঝলাম, ভবতোষ বোধহয় বলতে চায় না কী কাজে এসেছিল । না বলবে, না বলুক । প্রসঙ্গ বদল করতে বললাম, “তোর এই ‘সম্বৎসর’ ছাতা বয়ে বেড়ানোর অভ্যাসটা কিন্তু রয়ে গেছে ।” ভবতোষ বলল, “আর বলিস না । এখন রোদ বিষ্টি তেমন গায়ে লাগে না | তার থেকে অনেক বেশি অন্য সব আপদ বিপদ, পদে পদে । কোথাও বিড়াল, কোথাও বাছুর, কোথাও কুকুর, এমন কি ভিখিরি বাচ্চা অব্দি আমাকে পথে ঘাটে নিস্তার দেয় না ।”

প্ল্যাটফর্মে ঢুকে আমাকে একটা বেঞ্চ দেখিয়ে বসতে বলে ভবতোষ টিকিট কাটতে চলে গেল । ফিরে এসে আমাকে দূরে একটা বাচ্চা দেখিয়ে বলল, “কাণ্ডটা দেখ । কী ভাবে পা ঝুলিয়ে বসে আছে । এইসব বাচ্চাদের মায়েরা কী করে যে ওদের ছেড়ে দেয় ।” দেখলাম একটু দূরে ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে একটা ছোট ছেলে একটা বাটি থেকে কিছু খাচ্ছে । আমি বললাম, “ওর মায়ের মত কাউকে তো দেখছি না ধারে কাছে ।” ভবতোষ বলল, “আরে, ওই সব মায়েদের কী – একটা বাচ্চা গেলে আরেকটা পেতে কোনও অসুবিধা তো হয় না । আমাদেরই যত ঝামেলা ... আমার গুলোর কথা তো শুনেছিস নিশ্চয় । তিন তিনটে চলে গেল, ধরে রাখতে পারলাম না । ঠাকুর কে যে কত ডেকেছি ।”

আমি বললাম, “ঠাকুর ! ঠাকুর কী করবে ? মরা মানুষ ফিরিয়ে দেবে ?”

ভবতোষ বলল, “প্রশ্নটা জানি | তুই হয়তো উত্তরটাও জানিস তাই ঠাকুর দেবতা মানিস না । কিন্তু আমি মানি । বৌটা মারা যাওয়ার পর থেকে একে তো চরম একা হয়ে পড়েছি, তার উপর হাতে অঢেল অচল সময় । আকছার বসে বসে ঠাকুরকে ডাকি - একটা কারো সঙ্গ দাও । এত একা কী থাকা যায় ?”

আমি প্রশ্রয় না দিলে ভবতোষ বলল, “তুই জানিস না, বৌটা মারা যাওয়ার পর বাড়িটা আমার কী ভাবে ফাঁকা হয়ে গেল । একটা দুধ-গরু ছিল । তার সদ্য বাছুরটা কোথায় কী খেয়ে পেট ফুলে মারা গেল । তার দুঃখেই কিনা জানি না, গরুটা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল । সারাদিন অস্থির হয়ে চোখ পাকিয়ে পা দাপাত, আর চোখের জল বের হাম্বা হাম্বা করত । তারপর একদিন দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে গেল । বউয়ের পোষা বিড়ালটা বয়েস হয়ে খুব মোটা হয়ে গিয়েছিল । একদিন কার্নিশে পায়রা ধরতে গিয়ে পড়ে মারা গেল । চোখে কম দেখত হয়তো । শেষে বাড়ির কুকুরটা, ছোট ছানা ছিল যখন আমি মুঠোয় করে ঘরে এনেছিলাম, সেও মারা গেল ।”

ভবতোষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম । মনে হল এখন আর পুরানো কথার কোন মানে হয় না । ভবতোষের পক্ষে অতীত দুঃসহ । ও এখন বর্তমানে থাকতে চায় ।

স্টেশনের ঘণ্টা বাজিয়ে জানালো গাড়ি আসছে । ভবতোষ উঠলো । দেখলাম দূরে বাচ্চাটা তখনও প্ল্যাটফর্মের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে । ট্রেন আসছে সে হুঁশ নেই, না তার, না তার মায়ের । “আশ্চর্য !” বলল ভবতোষ । তারপর আমার চোখে সোজা তাকিয়ে বলল, “তুই জিজ্ঞাসা করছিলি আমি মুচিপাড়ায় কোথায় গিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম তুই নাস্তিক, তোকে বলে কি হবে ? কিন্তু শোন । গিয়েছিলাম ওখানে পরাণকালী মায়ের মন্দিরে । মাঝে মধ্যেই যাই । তুই যাস কি ?” আমি মাথা ঝাঁকালাম । বললাম, “শুনেছি মা নাকি জাগ্রত । আমার বউ যেত ।”

ভবতোষ মাথা নাড়ল, অনেকক্ষণ, নিজের মনে, তালে বেতালে ।

তারপর বলল, “আমিও শুনেছি । তাই মায়ের কাছে মানত করেছি । বলেছি, মা আমার এই একা জীবন এবার শেষ করো । হয় আমাকে নাও, নইলে আমাকে কারো সঙ্গ দাও – যার সাথে থাকলে একটু কম একা লাগবে ।” আমি বললাম, “তোর আত্মীয় স্বজন ?” “ধ্যুত, যত্ত সব স্বার্থপরের দল ।” তিড়বিড় করে জ্বলে উঠল ভবতোষ । তারপর হাতের ছাতাটা একটু উঁচিয়ে ভাঁড়ের মত বলল, “যতদিন আমার হাতে এই অস্ত্র আছে, কাউকে ঘেঁষতে দেব না মোর ধারে কাছে ।” আমি থাকতে না পেরে হেসে ফেলে বললাম, “যেমন বাস স্ট্যান্ডের বাচ্চাটা ?” ভবতোষ বলল, “আর বলিস না ... জানি না আমার মধ্যে কী যে আকর্ষণ আছে । ওই মন্দির থেকে বেরিয়ে এক একদিন এক এক কাণ্ড হয় । একদিন একটা বাছুর আমার পিছু নিলো । নাছোড়বান্দা । ছাতা দেখিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টায় কোন কাজ হল না । এই রকমই আরেকদিন একটা বেওয়ারিশ ছাগল ছানা । ম্যাঁ, ম্যাঁ করে আমায় ডেকে অস্থির | একদিন একটা ছোট্ট বিড়ালছানা মিউ মিউ করে আমার পায়ে গা ঘষে একাকার করল । এমন কি একদিন একটা পায়রাও হেঁটেছে আমার পিছন পিছন, গুটি গুটি পায়ে । ওই ভয়ে আজ আমি বাস ধরলাম | নইলে আমি স্টেশন হেঁটেই আসি |”

হা হা করে হেসে উঠে ভবতোষ বলল, “জানিস, আজ আমি মন্দিরে মাকে প্রণাম করে বললাম, 'জানি না মা, তোমার মনে কী আছে । তুমি আমাকে এই সব কেন দিচ্ছ ? ভালো কিছু নেই কি তোমার কাছে ?' কথাগুলো মনে মনে ক’বার বলে মন্দির থেকে বেরোতেই ব্যাস, ওই বাচ্চা ছেলেটা পিছন পিছন আসতে শুরু করল ।” আমি বললাম, “দুটো পয়সা দিয়ে দিলেই চলে যেত ।” “বের করেছিলাম তো একটা টাকা, ওকে দিতে”, ভবতোষ বলল, “তা এমন বেয়াড়া ছেলে, টাকাটা দেখে পিছন ফিরে মা বলে চিৎকার করে ডাকল । দেখি দূরে একটা গরিব মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে । সে আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, 'এমনিই নিয়ে যাও বাবা, ছেলেটাকে । তোমার কাজে দেবে ।' বোঝ, আবদার !”

হুট করে ট্রেনটা 'পোওওওঙ .. পোওওওঙ' করে হল্লা করতে করতে এসে স্টেশনে ঢুকে পড়তেই দুজনে তাকালাম । প্ল্যাটফর্মটা এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা । ছেলেটা কখন সরে গিয়েছে ।

কই না তো ! ওই তো, বাচ্চাটা ভবতোষের দিকে এগিয়ে আসছে । অন্তত, আমার তাই মনে হল । ওর হাতে একটা বাটি । আর কোমরে সকালের বাস স্ট্যান্ডের বাচ্চাটার মতই ঘুনসিতে কড়ি বাঁধা । দূরে একটা গরিব বউ দাঁড়িয়ে দেখছে মুখে আশার হাসি ফুটিয়ে |

বৌয়ের কথা মনে পড়ল | বলত ভক্তদের নাকি মা নানান রূপে দেখা দেয় ।
 

------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩১ মে ২০১৬

রবিবার, ২৯ মে, ২০১৬

ওথেলোর একালাপ

|| ওথেলোর একালাপ ||

সকালে ঘুম ভাঙ্গার মুখে তোর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম | স্নান সেরে শাড়ি কাপড় পরে এলো চুলে রোদে দাঁড়িয়ে চুল শুকচ্ছিস | রোদ দেখে মনে হল শীতের রোদ – যদিও ছবিটা সাদায় কালোয় | বয়েস তোর আন্দাজ আটাশ – কি তিরিশ | কোমর, কাপড়ের কুঁচি বাদ দিলেও, “ঈষৎ স্ফীত” | ছবিটা কী তোর জন্মের পর, না কী তুই জন্ম দেয়ার পর ? ভাবতে ভাবতে বুঝলাম গুলিয়ে ফেলেছি – তোর কথা ভাবছি তোকে মাতৃত্বের রূপে স্বপ্নে দেখে | তুই, তোর মা, সব আজকাল গুলিয়ে যায় |

মাঝে মাঝে তোর ছবিগুলো বার করে দেখি | কোথায় রেখেছি ছবিগুলো, কবে শেষ দেখেছি মনে নেই | তবে চোখ বুজলেই একটা বড় বাক্স হাতে পাই | তার ভিতরে থরে থরে ছবি সাজানো – তোর, আমার, আমাদের মায়েদের, আমাদের বাবাদের, আরও কত কার কার ছবি আছে | তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে তোর ছোটবেলার ছবি – পুতুলের মত ; তোর একটু বড় হয়ে ছবি – ডাগর চোখ, ফ্রকের তলায় লম্বা পা, আর ঠোঁটে একটা – তখনই ফুটছে – সেই হৃদয়সমুদ্র মন্থন করার ঠোঁট টেপা মৃদু, মিষ্টি, আলগোছ হাসি, “দূরে থাক ! খবরদার, কাছে আসবি না |” ওই হাসিটা এখনও তেমনি আমার বুকে হাতুড়ি পেটায় – অথচ তুই জানতিস না | তুই তো পালিয়ে বেড়াতিস – “চল খেলবি”, বলে কোথায় যে উধাও হতিস, ভালো করে জেনে যে তোকে আমি খুঁজে বেড়াব | আজও খুঁজি | খুঁজতে খুঁজতে ওই বাক্সয় হাতড়াই | কখনও তোর বড় হয়ে ওঠার ছবি পাই না – সেখানে পাই তোর মায়ের ছবি – কিন্তু হাসিটা গুলিয়ে দেয়, ভুল করিয়ে দেয়, যে ওটা তুই |

কী গান্ধারী ওই চেহারা | টিকালো নাক, উঁচু গালের উপর লম্বা পলকের ছায়ার শিরোনাম, পলকের নিচে কটা কটা চোখের মণি | আর ঠোঁটের কথা নাই বললাম | তুইও হয়তো তোর ঠোঁটের কথা জানতিস না | নইলে কী আমায় এগোতে দেখলেই ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে চুপ করতে ইশারা করতে গিয়ে উল্টে আমার টানটা আরও অদম্য করতিস ?

আমি আর তুই – যেন ওথেলো আর দেসদিমোনা | আচ্ছা বলতো, একই সম্পর্কের জালে কী ভাবে দু’রঙা সুতো থাকতে পারে, কালো আর লাল | কী করে সবাই হতে পারে হয় সুন্দর, নয় কুৎসিত ? আর কেন, তুই প্রথম দলে, তো আমি দ্বিতীয় দলে ? কোথায় আমাদের ধারা আলাদা হল ? কেন হল, এমন ? কেন হল এমন যে কাকা, পিসি, মামা, মাসি আর আরও সবাই – হয় রূপের পক্ষে, নয় বিপক্ষে ?

তুই কী লক্ষ্য করেছিস এই জালে সব সহোদর এক সুতোর নয় ? কেউ কালো, অপুষ্ট, শ্রীহীন, ক্ষীনপ্রাণ তো কেউ রূপের জেল্লায় লাল, ফেটে পড়ছে |

এই কথাতে  এসে আমার ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে যায় | রান্নার মাসি উনুন ধরিয়েছে পাট কাঠির মাথায় পাট জড়িয়ে কেরোসিন ঢেলে | তারপর চেলা কাঠ চাপিয়ে চলে গেছে | তোকে আর আমাকে বলে গেছে দেখতে যেন আগুনটা ধরে | আমি সামনে বসে পাটকাঠি দিয়ে ফুঁ দিচ্ছি গাল ফুলিয়ে – পরনে হাফ প্যান্ট, গা উদোম | তুই পাশে উবু হয়ে বসে দেখছিস – পরনে তোর লেস দেয়া হাতকাটা শেমিজ | কী কুক্ষণে যে তোর পায়ের দিকে আমার নজর গিয়েছিল, আর তুই লেসের হেম ধরে শেমিজ টেনে নামিয়ে হাঁটু গেড়েছিলি, পাছে আমার দৃষ্টি দুই ধারা কে কাছে টানে | তখন দেখছিলাম ওই আগুনে উজ্জ্বল হয়ে চেলা কাঠের বুক ফাটলো, তার স্ফুলিঙ্গ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ল, আর তোর গালে তার আগুন লাগলো | গালে ফুটে উঠল অজস্র লাল বিন্দুর স্ফুলিঙ্গ | তোর চোখও যেন জ্বলে উঠল | আমায় বললি, “মুখপোড়া হনুমান !” তারপর ছুটে পালিয়ে গেলি | তখনই তুই বলে গেলি – তুই শুভ্র, আমি কৃষ্ণ – আমরা জাতে, পঙক্তিতে আলাদা | আমরা ভিন্ন পথের পথিক |

অথচ আমি জানি, একদিন দুই ভিন্ন পথের পথিক – এক রূপসী আর এক দানো – এক হয়ে রক্তের ধারা এক করতে চেয়েছিল | তবুও কালো রক্তে লাল রক্ত মিশ খায় নি | দুটো ধারা আলাদা রয়ে গেছে | তাই তাদের প্রজন্মে দুই ধারা আলাদাই রয়ে গেছে |

তবুও তো আমার রক্তে রয়ে গেছে ওই অন্য রক্তের ডাক | আমার রক্ত ডাকে, আর এক রক্তের সাথে এক হতে – যাতে ওথেলো আর দেসদিমোনা আর আলাদা না থাকে |

ওই ডাক শুনে বিছানায় যাই | ওই ডাক শুনে ঘুম আসে | ঘুমে ছবির বাক্সটার ডালা খুলে ছবি দেখি | কিন্তু ওখানে তো তোর আর কোন ছবি নেই | তাই জানি না তুই কবে মায়ের রূপ ধরলি – আর কার সাথে এক হয়ে মা হলি | স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে আমি বুঝি – দুই রক্ত কোনদিন এক হবে না | ওথেলোরা চিরকুমার থেকে যাবে, আর দেসদিমোনারা চিরকুমারী |

তবুও বুকের চরে ভাঁটা পড়া রক্তের স্রোত বয়েই যায় – হয়ত এগোতে এগোতে তোর স্রোতের সাথে দেখা হবে, দুই স্রোত এক হবে |

যেখানেই থাক, বইতে থাক, থামিস না |


----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৯ মে ২০১৬

সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

অপেক্ষা

|| অপেক্ষা ||


হঠাত করে মলিনাদির সাথে দেখা হয়েছিল |

কিছু কাগজের কাজ নিয়ে কোর্টে গিয়েছিলাম | উকিলের সাথে কথা বলে বেরিয়ে বড় রাস্তার কাছে এসে মনে হল পেনটা ফেলে এসেছি, তাই ফেরত যাচ্ছিলাম পকেট হাতড়াতে, হাতড়াতে | উল্টোদিক থেকে মলিনাদি আসছিল | বয়েসের ছাপ তেমন না পড়লেও বেখেয়ালে আমি ঠিক লক্ষ্য করি নি |  মলিনাদি পাশ দিয়ে গিয়ে পিছন থেকে ডাকল, “ধ্রুব না ? এই ! তুই ধ্রুব না ?” যেই আমার হাতে পেনটা ঠেকল, শুনতে পেয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম । দেখে চিনতে একটুও অসুবিধা হল না |

তবে, সেই রকমই আছে তা বলবো না | শেষ দেখা হয়ে মনে হয় চল্লিশ – বিয়াল্লিশ বছর কেটে গেছে | এখন যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্মিত মুখে, তার রং সেই সময়ের তুলনায় বেশ কালো | মাজা, ঋজু চেহারাটা না হলেও পঁয়ষট্টি বছরের | মণিবন্ধের হাড় শক্ত, ব্লাউজের হাতার শেষে কনুইটা চওড়া | গাল একটু বসে গিয়ে মুখের চোয়াল আরও প্রশস্ত হয়েছে, আর তাকে দৃঢ় সমর্থন যোগাচ্ছে চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা | মাথার মসৃণ চুলে একটু পাক ধরলেও বেশিরভাগ কালো | এত গরমেও শাড়ির আঁচলটা গলায় পাকিয়ে বুকের উপর ছড়িয়ে ফেলা । শুধু এই আব্রুটুকু এই বয়সের তুলনায় বেমানান |

আমার চিনতে অসুবিধা হচ্ছে ভেবে মলিনাদি চোখ থেকে চশমাটা খুলে বলল, “এবার চিনতে পারছিস ?” সেই মমতা ভরা কালো গভীর চোখ ... যার চোখের লম্বা লম্বা পলক যে কোন মুহূর্তে ধীরে ধীরে নেমে এসে সেই মমতার হদিস হারিয়ে দিতে পারে | আমার কৈশোরের মলিনাদি – মলিনা মুখি – পাড়ার মুখি বাবুর বড় মেয়ে, আমার খেলার মাঠের সাথী বাবুয়ার দিদি |

আমি বললাম, “চিনব না কেন ? আসলে আমি পেনটা হারিয়ে ফেলেছি ভেবে একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই তোমাকে লক্ষ্য করি নি | কোথায় এসেছিলে ?”
মলিনাদি বলল, “একটু এফিডেভিটের কাজ ছিল | হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরছি | তুই ?”
আমি বললাম, “আমিও বাড়ি ফিরছি |”
-  “কতদিন পরে দেখা বল তো !"
-  "চল্লিশ বছর ?"
-  "বাড়ি ফেরার তাড়া আছে তোর ?”
-  “না, তেমন না | ইলাকে বলে এসেছি কোর্টের কাজ, সময় লাগতে পারে | কেন বলো তো ?”
কব্জির ঘড়িটায় চোখ রেখে মলিনাদি বলল, “কেমন আছিস ? চা খাবি ? খেতে খেতে বলবি ?”
আমি বললাম, “চা, এখানে ?”
-  “না, না ... কাছেই আমার বাড়ি, গেরুয়া রোডে | যাবি ?”
-  “কেন, তোমার আর কাজ নেই বুঝি বাড়িতে ?”
-  “কাজ ? একা মানুষের আর কাজ কী রে ? চল না, চল !”
-  “ঠিক আছে | তবে একটা কথা, পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দেবে তো ?”
-  “হ্যাঁ, হ্যাঁ ... এই রিক্সা !”

মলিনাদির বাড়ি কোর্টের রাস্তাটার উল্টোদিকে একটা বড় মাঠের ওপারে | রিক্সা থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইটুকু পথের জন্য রিক্সা নিলে কেন ?” মলিনাদি বলল, “আসলে আমার ওই গাড়ি ঘোড়ার রাস্তাটা পার হতে ভয় করে | বয়স হয়েছে, একা মানুষ, কে কোথায় ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে |”

“আয় |” বলে মলিনাদি বাগানের গেটটা খুলল | ছোট্ট কোয়ার্টার, সামনে একটু বাগান, তাতে কিছু ফুলের গাছ | দু ধাপ সিঁড়ি উঠে ছোট বারান্দা | দরজা খুলে সামনের ঘরে ঢুকলাম | এক সেট সোফা, একটা ডিভান, দু একটা ঘর সাজানোর জিনিস আর একটা ছোট পড়ার টেবিল চেয়ার – ছিমছাম সাজ-সজ্জাহীন | সিলিং ফ্যান চালিয়ে দিয়ে মলিনাদি বলল, “দাঁড়া, চায়ের জলটা বসিয়ে দিয়ে আসছি |” এই বলে, ভিতরে যাওয়ার দরজা দিয়ে চলে গেল | আমি একবার চারিদিকে চোখ বুললাম | দেয়ালে একটা বিনে-ছবি বাংলা ক্যালেন্ডার | একটা ফ্রেমে বাঁধানো মুখি পরিবারের সাদা কালো ছবি, তাতে মলিনাদি শাড়ি পরা – দেখে মনে হল শেষ দেখা হওয়ার সময়ের | আর কারো কোন ছবি নেই | তাহলে কি ...
...

এক নিমিষেই আবছা স্মৃতির অনেক কথা দুর্বার বেগে ঝড়ের মতো উঠে আসতে পারে | ছোটবেলায় আমরা এক পাড়ায় থাকতাম | মুখি বাবুর বাড়ি ছিল আমাদের তিনটে বাড়ি পরে | অনেকটা এইরকম কোয়ার্টার | সামনে বারান্দা, তারপর পরপর বাইরের ঘর, ভিতরের ঘর, রান্নাঘর - পাশে এক ফালি সরু উঠোন, স্নানঘর, পায়খানা, আর পিছনের খিড়কি দরজা – সামনের থেকে খিড়কির, সব দরজা এক সারিতে |

যুধিষ্ঠির মুখি, মুখি বাবুর ছিল বড় পরিবার – পাঁচ মেয়ে আর এক ছেলে | প্রথমে মলিনাদি, তারপর বাবুয়া – আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট – তারপর আরও চার মেয়ে, নীলিমা, প্রতিমা, সরমা, আর সবশেষের জনের নাম বোধ হয় পুতুল | মাসীমা, মুখি বাবুর বউ, ছিল ক্ষীণকায়, ফর্সা, দুর্বল, টিকালো নাক আর সুন্দর চোখ-মুখের | তার ধারাটা অন্য মেয়েরা পেলেও, মলিনাদি নিয়েছিল বাবার ধারা – লম্বা, ময়লা, শান্ত, গভীর | খেলার জন্য বাবুয়াকে ডাকতে গেলে মলিনাদি ভিতরে ডাকত, “বাইরে কেন ? বাবুয়া খাচ্ছে - ভিতরে আয়, বোস ততক্ষণ |” আমি গিয়ে বসতাম বাইরের ঘরের একমাত্র চেয়ারে | ঘরটার বাকি অংশ জুড়ে ছিল একটা মস্ত খাট | ভিতরের ঘরে ছিল দুটো মাদুর পাতা চৌকি, একটা আলনা, আর অনেক জিনিস, এক কোনে মাসিমার ঠাকুরঘর – একটা ছোট কাঠের ঠাকুরবাড়ি | ঘরটায় সারাদিন ধূপ ধুনোর গন্ধ থাকত, আর থাকত ফুলের গন্ধ | বাইরের ঘর থেকে ভিতরের ঘরে যাওয়ার দরজাটার পরেই ছিল দেয়ালে ঝুলানো একটা বড় আয়না, তারপর আলনা | এই দরজাটায় একটা পর্দা থাকলেও তার অপর্যাপ্ত প্রস্থের পাশ দিয়ে আয়নাটা, আর তার প্রতিফলনে ভিতরের ঘরের কিছু অংশ দেখা যেত | তাই, আমি বসে থাকলে আয়নাটা একটু অস্বস্তির সৃষ্টি করত | বাবুয়া বেরোলেই এক লাফে উঠে বাইরে আসতাম |

কী ভাবে জানি না একটু একটু করে বুঝলাম মলিনাদির আমাকে নিয়ে একটা আগ্রহ হয়েছে | সেটা কোনদিন বাড়তে বা কমতে দেখলাম না | ব্যাপারটা কোনদিন খারাপও লাগে নি |

সেবার আমি ছুটির আগে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠে দূরের উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে যোগ দিয়েছি | বাবুয়া যাবে আরও দু বছর পরে | গরমের ছুটি হয়েছে | মলিনাদি আমাকে মাঝে মাঝে স্কুলের কথা জিজ্ঞাসা করে, মাস্টাররা কেমন, ছেলেরা কত বদমাইশ, আমি স্কুল পালিয়ে কোথাও যাই কিনা | প্রায় দুপুরেই মুখি মাসিমা নীলিমা, প্রতিমা আর সরমাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসে, মায়ের সাথে গল্প করতে | তিন বোন ইলার সাথে লুডো খেলে | একদিন মাসীমা বলল, “শোন ধ্রুব, মলিনা বলল তোকে পাঠিয়ে দিতে | বাবুয়া টিউশনে গেছে, ও একা আছে | যা, গল্প করবি তো |”

যেতেই মলিনাদি ভিতরের ঘরে নিয়ে গেল | একটা চৌকিতে পুতুল অঘোরে ঘুমোচ্ছে । মলিনাদি অন্য চৌকিতে উঠে কোলে একটা বালিশ টেনে আয়েস ঢালা গলায় বলল, “আয়, তোর কথা শুনি |”

কী গল্প করলাম মনে নেই | কিন্তু, সেবার প্রায় পুরো গরমের ছুটি কেটে গেল, দুপুরে আধো অন্ধকার ঘরে চৌকিতে বসে মলিনাদির সাথে গল্প করে | আমার কিছু তেমন বলার থাকত না, বিশেষ করে স্কুল বন্ধ বলে | তাও মলিনাদি যে কত প্রশ্ন করত | তখন আমার বয়স হয়ত তেরো, মলিনাদি বছর দুয়েক আগে স্কুল পাশ করেছে, তাই হয়ত ওর আঠেরো | মা বলত মলিনাদি আমার থেকে পাঁচ বছরের মত বড় |
...

এই সব চিন্তার স্রোতে ব্যাঘাত করে মলিনাদি ডাকল, “তুই চায়ে চিনি খাস তো ?” বললাম, “হ্যাঁ, তবে একটু কম দিও, চায়ের চামচের এক হলেই হবে |”
...

আমি জানি না মলিনাদি কেন কলেজে যায় নি | শুনতাম ওর জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে | মলিনাদি অবশ্য সেই নিয়ে কোন কথা বলত না | আমার একটুও মনে নেই আমরা কী নিয়ে গল্প করতাম | কিন্তু, এটাও ঠিক কোন মেয়েলি বা ঘরোয়া ব্যাপার নিয়ে কোন গল্প ছিল না | এইটুকু বুঝতাম মলিনাদি আমাকে একটু অদ্ভুত ভাবে স্নেহ করত – বা, শুধু স্নেহ হয়ত নয়, সাথে একটু সমীহ করত, কেন না আমি লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম | খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমি কী বই পড়ছি জানতে চাইত, আমাকে বলত, “তোর পড়া হয়ে গেলে আমাকে একটু দিস তো |” তাও আমি মলিনাদিকে বই পড়তে দেখি নি কোনদিন, যদিও মাসিমা বাড়িতে উল্টোরথ, আর নবকল্লোল রাখত |

ক্লাস এইটে উঠে আমার কবিতা লেখার শখ হল, ক্লাসের আর পাঁচটা ছেলের মত | শীতের ছুটিতে এক দুটো লিখেও ফেললাম, দুপুর বেলায় সামনের বারান্দায় রোদে বসে | একদিন মলিনাদি মায়ের কাছে উল বোনা শিখতে এসে দেখে ফেলল | “দেখি, কী লিখছিস | কবিতা ?” বলে আমার হাতের খাতাটা নিতে চাইল | আমি কিছুতেই দেব না | টানাটানিতে আমার খাতা ধরা হাতের মুঠো মলিনাদির বুকের মাঝে দুম করে লেগে গেল জোরে | “উঃ” বলে ব্যথায় ককিয়ে উঠে মলিনাদি আমার খাতাটা ছেড়ে দিল | মা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে মলিনা ? জোরে লেগেছে ? দেখি দেখি |” দেখলাম যন্ত্রণায় মলিনাদির চোখে জল এসে গেছে | তাও, “কিছু না |” বলে মলিনাদি উঠে পড়ল | বলল, “আসি মাসিমা |”

মা আমাকে কিছু না বললেও কদিন আমি খুব মন খারাপ করে পড়ে থাকলাম | বুঝলাম না, মলিনাদির কোথায় ব্যথা দিয়ে ফেলেছি | নাকি গায়ে হাত লেগেছে বলে | কিন্তু, যখন দুপুরে আধো আঁধার ঘরে মলিনাদির সাথে গল্প করেছি কতদিন মলিনাদি আমার কথায় বিশ্বাস না করে আমার হাতের পাতা জামার বুকে চেপে ধরে বলেছে, “গা ছুঁয়ে বল, সত্যি বলছিস !” আমি ওর গা ছুঁয়ে “সত্যি !” বলেছি | কতদিন, যখন উঠে পড়েছি, মলিনাদি আমার গাল বুকে চেপে বলেছে, “আয় এবার | কাল আসবি তো ?”

তা হলে ? তাহলে কী ? সেই যে একদিন এমনি মলিনাদি আমার মাথা গাল নিজের বুকে চেপে ধরলে আমি বলেছিলাম, “মলিনাদি তোমার বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছি |” মলিনাদি বলেছিল, “আর কিছু ?” আমি মাথা নেড়েছিলাম | মলিনাদি বলেছিল, “খুব কান পেতে শুনলেও না ?” আমি মাথাটা তুলে বলেছিলাম, “কিসের শব্দ ?” মলিনাদি একটু চাপা হাসি হেসে বলেছিল, “একটা ছোট্ট গুটি পোকার বুকের ধুকপুক |” আমি অবাক হয়ে বললাম, “গুটি পোকা ?” মলিনাদি বলল, “গুটি পোকা ... শতপদ ... থাক, তুই বুঝবি না |”

এক নিমিষেই এই সব অনেক কথা মনের মধ্যে বৈশাখের দুপুরের অশরীরী তপ্ত হাওয়ার ঘূর্ণিপাকের মত পাক খেয়ে গেল, জমে থাকা ধুলো পাতা উড়িয়ে ওলটপালট করে দিয়ে | আমি বসে রইলাম এক অন্য কোয়ার্টারে, অনেক সময় পিছিয়ে গিয়ে |
...

মলিনাদি একটা ট্রেতে দু’কাপ চা আর একটা প্লেটে কটা নিমকি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, “এবার কেমন গরম পড়েছে রে | সারাদিন ঘর বন্ধ করে অন্ধকারে বসে থাকি, আর দিন গুনি কবে একটু বৃষ্টি নামবে |”

আমি দেয়ালে চোখ বুলিয়ে বললাম, “শুধু তোমাদের মা-বাবা, ভাই-বোনের ছবি, আর কারো নেই কেন ?” মলিনাদি আঁচলে ঘাম মুছে বলল, “আর কার হবে বল | বিয়ে তো করি নি, মানে করা হয়ে ওঠে নি |”
-  “তাহলে এই কোয়ার্টার ? কার নামে ?”
-  “আমারই নামে | ও, তুই তো জানবি না । বাবা মারা গেলে আমি করেসপন্ডেন্স কোর্সে বিএ, বিএড করলাম । তারপর স্কুলে মাস্টারি । এখন আমি পাশেই  কস্তুরবা গার্লস স্কুলে পড়াই | ছ’বছর এক্সটেনশনে আছি | যতদিন রাখে, চিন্তা নেই | যাক, তোর খবর বল – বউ, ছেলেমেয়ে – কে কোথায় আছে, কী করে | তুই ইলার কথা বললি, ও কী তোর সাথেই আছে |
-  “হ্যাঁ | আমার তো এক ছেলে, দুর্গাপুরে কাজ করে | বউ মারা গিয়ে সাত বছর হয়ে গেল | তারপর ইলার বর মারা গেলে ওকে এনে রেখেছি সাথে | তোমার বোনেরা ? বাবুয়া ? ওরা সব কেমন আছে ?”

এইভাবে কথায় কথায় একটা বেজে গেল | বললাম, “তোমার খাওয়ার সময় হয়ে গেল | উঠি |” মলিনাদি বলল, “হ্যাঁ, আয় | আবার কবে আসবি বল | বাড়িটা তো চিনে গেলি | একদিন দুপুরে আয়, খুব গল্প করা যাবে | ইলাকেও আনিস |” আমি বললাম, “আসব | ইলা হয়ত আসতে চাইবে না – বাতের ব্যথায় ও আর বেরোতে চায় না | তোমার কি সুবিধা হবে দুপুরে এলে ?” মলিনাদি হেসে বলল, “আয় না দুপুরে, সেই ছোটবেলার গরমকালের মত |”

বাসে উঠে ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম | সেকালে শুকনো গরম পড়ত | আমার মোটেও কষ্ট হত না | খালি গায়, কি গেঞ্জি গায়, থাকতাম | মলিনাদি তখন শাড়ি পরত না | প্রায় গোড়ালি অব্দি লম্বা ফ্রক পরত | আজকাল তাকেই গাউন বলে, বোধহয় । পাড়ার আর সব সমবয়সী মেয়েরাও ওইরকম ফ্রক পরত | মলিনাদি খুব উঁচু গলার ফ্রক পরত | মা মাঝে মাঝে বলত, “কী রে মলিনা, এত গরমে গলা উঁচু ফ্রক পরে তোর গরম লাগে না ?” মলিনাদি কথায় উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ত  | খালি সরস্বতী পুজোর দিন পাড়ার মেয়েদের সাথে মলিনাদি শাড়ি পরত | কেন জানি না, সেদিন আমি মলিনাদির থেকে নিজেকে আলাদা মনে করতাম । মনে করতাম এক সাথে গল্প করলে কী হবে, মলিনাদি আমার থেকে অনেক অনেক বড় | তবুও সেবার পুজোর দিন সকালে মলিনাদি বাবুয়াকে দিয়ে আমাকে বলে পাঠালো যে আমি যেন ওকে প্যান্ডেলে নিয়ে যাই অঞ্জলি দেয়ার জন্য | আমি বাবুয়াকে বললাম, “তুই থাকতে আমি কেন ?” বাবুয়া একটা কাঁধের ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “দিদিকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিস |”

আমি স্নান করে পাঞ্জাবি পায়জামা পরে মুখি বাবুর বাড়ির দরজার গায়ে কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে মলিনাদি বলল, “চলে আয় | দরজা ভেজানো আছে |” আমি ঢুকে চেয়ারে বসে বললাম, “দরজাটা ভেজিয়ে দেব কি |” মলিনাদি বলল, “না থাক | তুই আছিস তো | বোস তুই,  লিপি আমায় শাড়ি পরাচ্ছে | পরা হলেই বেরব |” লিপি, মানে লিপিকাদি, থাকত মলিনাদির পাশের বাড়িতে, মাঝখানে একটা গলি ছেড়ে | ওর ভাই ছিল পাড়ার একমাত্র গুণ্ডা ।

মনে হল বাড়িতে শুধু মাসিমা আছে, রান্নাঘরে ব্যস্ত | ভিতরের ঘরটা অন্ধকার দেখে বুঝলাম উঠোনে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ । দেখলাম ভিতরের ঘরের গলির দিকে জানালাটাও বন্ধ | বন্ধ জানালাটা চোখে পড়তেই চমকে উঠে বুঝলাম যে দুই ঘরের মাঝের পর্দাটা সরানো, তাই ভিতরের ঘরের দেয়ালে টাঙানো আয়নাটা পুরো দেখা যাচ্ছে চেয়ারে বসে | যদিও আয়নায় কাউকে দেখতে পেলাম না, ভিতর থেকে লিপিকাদি চেঁচিয়ে উঠল, “এই, খবরদার ! আয়না দিয়ে দেখবি না |” তারপরেই শুনলাম ভিতরে দুজনের চাপা গলায় হিসহিস করে কথাবার্তা |

সেদিন খুব অস্বস্তি সামলে দুই দিদিকে নিয়ে পাড়ার পুজোয় অঞ্জলি দিয়ে ফিরলাম | লিপিকাদি বাড়ি চলে গেল | মলিনাদি বলল, “ভিতরে আসবি না ?” আমি বিব্রত মুখে বললাম, “না |” মলিনাদি “বেশ” বলে বাগানের গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকে  আমায় বলল, “শোন, কাছে আয় তো |” আমি কাছে গেলে চাপা স্বরে বলল, “কিছু দেখিস নি তো আয়না দিয়ে ?” তারপর গম্ভীর চোখে আমার গালে আলতো করে তালি মেরে বলল, “যা, বাড়ি যা |”

এই ছোট ঘটনাটার পর আমি মলিনাদিকে একটু এড়িয়ে চললাম, যদিও ওর দিকে থেকে আন্তরিকতায় কোন পরিবর্তন দেখলাম না | আমায় দেখলেই বলত, “আর আসিস না কেন ?”, কিম্বা, “খুব পড়াশুনা করছিস বুঝি ?”

আমি ক্লাস টেনে উঠলে মুখি বাবু একটু বড় কোয়ার্টার পেয়ে অন্য পাড়ায় চলে গেল | তার কয়েক বছর পরে আমারও সেই পাড়ায় গেলাম | তখন আমি কলেজে তৃতীয়-বর্ষে পড়ি | গরমের ছুটিতে বাড়ি এলে সকাল-বিকেল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যাওয়া আসার পথে মুখি বাবুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাই | কাউকে দেখি না | কোনদিন মুখি মাসিমা আসে মায়ের কাছে দুপুরে গল্প করতে | কিন্তু, আমাকে আর বলে না, “যা, মলিনা বাড়িতে একা আছে | গল্প করবি তো যা |” তাও একদিন মলিনাদির সাথে দেখা হয়ে গেল | বিকেলে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল | মাথায় বেলি ফুলের মালা দেখে অবাক হলাম | মলিনাদিকে কোনদিন লোকদেখানো সাজতে দেখি নি | চেহারাটা দেখলাম শুকিয়ে গেছে | মুখটা ভর্তি ব্রণ | তবুও তারই মধ্যে চোখ দুটো আগেকার মত করুণাময় হয়ে আছে | আমায় দেখে একটু হাসল | তারপর হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, “শুনেছি তুই এসেছিস | কই একদিনও তো এলি না দেখা করতে | এখন কোথায় যাচ্ছিস ?” বললাম, “এই ... স্কুলের বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দেব | তুমি কার জন্য দাঁড়িয়ে আছ ?”

-  "কার জন্য আর ? আমায় দেখতে আসবে ... তাই হত্যে দিয়ে পড়ে আছি ।"
-  "তাহলে আমি যাই । পরে তোমার সাথে কথা বলব ।"
-  “কী বলবি ? কী গল্প করিস তোরা আড্ডায় ? শুধু গল্প করিস, না চা, সিগারেটও খাস |”
-  “তাও খাই ... পয়সা থাকলে |”
-  “হ্যাঁ, মায়ের মুখে শুনলাম, মাসিমা দুঃখ করেছে যে তুই খুব সিগারেট খাস | শোন, খেলে খাবি, কিন্তু কম সম |”
-  “কমই তো খাই | আজ দেখো না, পকেটে পয়সা নেই | বন্ধুদেরও একই অবস্থা হলে আজ আর ...”
-  “তাই ? দাঁড়া |” বলে মলিনাদি ভিতরে চলে গেল | টুক করে ফিরে এসে হাতের মুঠো এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নে | কিন্তু, প্রমিস কর, কম খাবি |”
-  “তুমি কেন পয়সা দেবে ?” আমি বিব্রত হয়ে বললাম |
-  “যা না, মাত্র আট আনা তো | আবার লাগলে চাইবি |”

আট আনায় সেদিন পুরো এক প্যাকেট সিগারেট কিনলে পরে বন্ধুরা জেনে গেল | যেদিনই কারও  কাছে পয়সা থাকে না সবাই আমাকে বল, “ধ্রুব, যা না | একটা টাকা চেয়ে নিয়ে আয় |” বলতে হয় না | মাঝে মধ্যেই মাথায় বেলি ফুলের মালায় সেজে মলিনাদি গেটে দাঁড়িয়ে থাকে, আমাকে দেখে ডাকে, জিজ্ঞাসা করে, “ভালো আছিস ?” তারপর আমার ইতস্তত ভাব দেখলে, “আজ হাত খালি বুঝি ?” বলে ব্লাউজের গলায় হাত ঢুকিয়ে টুক করে একটা টাকা বের করে দিয়ে বলে, “যা, পালা |” একদিন এই ভাবেই টাকাটা বের করতে গিয়ে মলিনাদি হটাত ব্যথায় মুচড়ে উঠল | হাতটা ব্লাউজের গলায় আটকে রইল এক মুহূর্তের জন্য | আমি ভয় পেয়ে বললাম, “কী হয়েছে, মলিনাদি ?” মলিনাদি বলল, “কিছু না | টাকাটা ভাঁজ করে রেখেছিলাম, তার কোনায় একটু খোঁচা লেগে গেল পুরানো ব্যথার জায়গাটায় |”

সেদিন বাড়ি ফিরে ইলাকে বললাম সব কথা, আগে প্রমিস করিয়ে নিয়ে যে ও মাকে কিছু বলবে না | সব বলে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই কিছু জানিস ? মলিনাদি কিসের পুরানো ব্যথার কথা বলল ?” ইলা মাথা নাড়ল | না, ও কিছুই জানে না | বলল, “তুই বললে আমি মাসীমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি |” আমি বললাম, “থাক, দরকার নেই |”
...

বাড়ি ফেরার বাসে বসে সেই সব কথা ভাবতে ভাবতে মনটা খুব টানটান হয়ে  উঠল পুরানো দিনগুলোর জন্য | যদি আবার একবার সেই গরমকালের দুপুরের আধো অন্ধকার দিনে মলিনাদির চৌকির উপর বসে গল্প করার সময়ে ফিরে যেতে পারতাম | তাহলে মন দিয়ে ওর সব কথা শুনে মুখস্থ করে নিতাম, পরে জাবর কাটার জন্য | তাহলে হয়ত সেদিন না বুঝলেও আজ নিশ্চয় বুঝতে পারতাম মলিনাদির বুকে কোথায় ব্যথা ছিল | বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঠিক করে নিলাম, ‘না, এরপর দেখা হলেই মলিনাদিকে জিজ্ঞাসা করব |’

কিন্তু অনেক দিন কেটে গেল | কতবার মলিনাদির কাছে গিয়ে এটা সেটা গল্প করে ফিরে এসেছি |
...

সদ্য বৃষ্টি শুরু হয়েছে | দুপুরে আর ঘুম আসে না | ভাবছি কাল মলিনাদির বাড়ি যাব দুপুরে | আমায় দেখে খুব খুশি হবে, “তুই এসেছিস | আমি তো ভাবছিলাম তুই আর দুপুরে আসবি না | আয়, ভিতরে আয় |” আমাকে বসিয়ে রেখে মলিনাদি ভিতরে চলে যাবে | ফিরে এসে বলবে, “এখনই চা খাবি, না একটু পরে ?” আমি বলব, “চা খাব ? এই ভর দুপুরে ?” মলিনাদি বলবে, “তাহলে থাক | তবে তুই খেলে আমিও খেতাম | এই বৃষ্টির জোলো হওয়ায় ... যদি বলিস কফি করতে পারি |”
আমি বলব, সুযোগ পেয়ে, “আচ্ছা, অবেলায় যা দেবে খাব, যদি একটা প্রশ্নের জবাব দাও |”
“ও, বাবা !” মলিনাদি বলবে, “এত বছর পরে এই সবে দেখা | এতদিনের সব কথা এখনও জানা বাকি | তার আগেই প্রশ্ন ? কী নিয়ে রে ?”
আমি বলব, “তোমার কি পুরানো কথা সব মনে আছে ? আমি যখন কলেজে, তুমি আমাকে মাঝে মধ্যেই বিকেলে আট আনা কি এক টাকা দিতে, আমার সিগারেট খাওয়ার জন্য ? ব্লাউজে ভাঁজ করে টাকা গুঁজে রেখে তুমি বাগানের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে |”
মলিনাদি মাথা হেলাবে, “মনে আছে |”
আমি বলব, “একদিন টাকাটা বের করতে গিয়ে তার ভাঁজের কোনে খোঁচা লেগে তুমি খুব ব্যথা পেয়েছিলে | বলেছিলে পুরানো ব্যথার জায়গায় খোঁচাটা লেগেছিল |”
মলিনাদি হাসবে, "হবে হয়তো |"
আমি বলব, “আর তার অনেক আগে - সেই পুরানো পাড়ারও টুকিটাকি কথা তোমার সাথে সেদিন দেখা হয়ে মনে পড়ে গেল - একবার আমার কবিতার খাতা নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে তোমার গলার নিচে আমার হাতের ধাক্কা লেগেও তুমি খুব ব্যথা পেয়েছিলে |”
মলিনাদি বলবে, “হ্যাঁ, ওটা মনে আছে ... কিন্তু, তার কথা এখন জেনে কী করবি ? ব্যথা তো একটা ছিল ... কিন্তু সে তো পুরানো হয়ে সয়ে গেছে | থাক না, অন্য কথা বল |”
আমি বলব, “না মলিনাদি | কথাটা ব্যথার শুধু নয় | তুমি সেই সময় আমাকে একটা গুটি পোকার কথা বলেছিলে একদিন | কিসের গুটি পোকা ?”
মলিনাদির দৃষ্টি কোমল করে বলবে, “ও ! ... সেই গুটি পোকাটা ? দেখবি ? দেখবি তুই গুটি পোকাটা ?”
আমি মাথা হেলাব |
...

মলিনাদি উঠে গিয়ে পাশের জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে এল | তারপর গলার পাক খুলে বুকের আঁচলটা একটু আলগা করে টেনে নামিয়ে দিয়ে বলল, “এই দেখ |” দেখলাম ব্লাউজের গলা খুব নিচু | তার উপরে বুকে একটা জড়ুল | না, গুটি পোকা নয়, শতপদও নয় | জোঁকের মত তেল চুকচুকে, কালো, কোঁচকানো গা একটা মস্ত জড়ুল | গাটা শিরশির করে উঠল | হয়ত শিউরে উঠেছিলাম | চট করে আঁচলটা তুলে গলায় জড়িয়ে নিয়ে মলিনাদি বলল, “তোকে ডেকে যে গল্প করতাম তা ছিল এই আশায় যে একদিন তুই ওটা টের পাবি | তখন তোকে ওটা দেখাবো | কেন জানি না, একটা বিশ্বাস হয়েছিল যে তুই দেখলেই ওটা সেরে যাবে | আমি ভালো হয়ে গিয়ে দিব্যি বিয়ে করতে পারব |”

আমি এক্কেবারে অবাক হয়ে বললাম, "তোমার মনে এই কুসংস্কারের ধারণাটা এসেছিল কী ভাবে ? আমি তখন জানলে কথাটা একদম উড়িয়ে দিতাম ।" মলিনাদি বলল, "আরে, ওই লিপিকা - ওই আমার মাথায় এইসব বুদ্ধি ঢোকাত । তোর কি মনে আছে একবার সরস্বতী পুজোর দিন – লিপিকা আমাকে শাড়ি পরাচ্ছিল, বাইরের ঘরের দরজা খোলা রেখে । আর তুই বাইরের ঘরে বসেছিলি | " আমি বললাম, "হ্যাঁ, লিপিকাদি তো আমাকে বলেছিল আমি যেন আয়না দিয়ে না তাকাই ভিতর ঘরের দিকে ।" মলিনাদি বলল, "সব ছল । ও বলেছিল, তোকে মানা করলে তুই ঠিক লুকিয়ে দেখবি । তুই দেখেছিলি কি, তাও ?" আমি বললাম, "কী যে বলো, মলিনাদি ! সেদিন আমি এত অস্বস্তিতে কাটিয়েছিলাম । সারাদিন ভেবেছিলাম তুমি আমাকে কতো খারাপ ভাবলে ।"
মলিনাদি বলল, "ওরে বোকা । তা কেন ভাববো ?"
আমি আশ্চর্য হলাম, "মানে ? তুমি কিছু মনে করো নি ?"

মলিনাদি মাথা নাড়ল, কথা বলল না । তারপর কোলে হাত জড় করে নিচু গলায় বলল, "আমিও তো ভাবতাম ... আমার এই জড়ুলের জন্য কোন ছেলে আমাকে শেষ পর্যন্ত পছন্দ করবে না, কেন না আমার সত্যবাদী পিতৃদেব পাকা দেখা হওয়ার আগেই পাত্রপক্ষকে বলে দিত আমার বুকে মস্ত একটা জড়ুল আছে । তাতেই সব ছেলে পালিয়ে যেত । তাই ভাবতাম – তুইও তো ছেলে । তুই যদি ওটাকে দেখে খারাপ মনে না করিস, দুরে না সরে যাস, তাও আমার কাছে আসিস, তাহলে জানতাম  ..."
...

আমি আর জিজ্ঞাসা করব না, "কী জানতে ?"
মলিনাদিও আর বলবে না, "জানতাম – যে সব ছেলের দৃষ্টি এক নয় । আর জানতে পারলে তোর মত একটা ভালো ছেলের আশায় অপেক্ষা করতাম ।"


------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ মে ২০১৬

বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬

বুগেনভিলিয়া

|| বুগেনভিলিয়া ||


মোহন মাস্টার বিয়ে করে নি | চাপাচাপি করলেও কারণটা বলে না | বলে সময় হয় নি, বা পয়সা ছিল না, বা বয়স হয়ে গিয়েছিল প্রয়োজন বোধ করার আগে | আবার এও বলেছে, দরকারই পড়ে নি তেমন |

কিন্তু সেদিন আমাদের অন্য কথা বলল | অন্য প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল | মেয়েদের নিয়ে | এই বয়সে তো আর তেমন উত্তেজক কথা হয় না | তাও একজন কিছু বললে, অন্যজন তাতে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু মনে পড়ায় হটাত করে জেগে উঠে বলছিল, “জানেন, আমার একবার এমন হয়েছিল ... |”

শুনতে শুনতে কেমন উসখুস করে উঠে মোহন মাস্টার বলে বসল, “জানেন কি, মেয়েদের একটা মর্মস্থল হয় – kernel যাকে বলে ?”
“তাই ?” নিরুৎসাহে আমরা জানতে চাইলাম |
“হ্যাঁ !” বলল মোহন মাস্টার, “ফুলের মধ্যে ফুল | বুগেনভিলিয়ার ফুলে যেমন হয়, চারিদিকে বড় বড় পাপড়ি, আর তার মাঝে ছোট্ট একটা ফুল, অনেক সময় সাদা – একেবারে বিমল সাদা মাটা সাদা |”

একটু থেমে মোহন মাস্টার বলল, “আমি একবারই দেখেছিলাম ... অনুভব করেছিলাম একটা ফুলের মধ্যে অন্য আরেক ফুল ফুটছে | সেটাই মেয়েদের মর্মস্থল |”

আমাদের চেপে ধরা লম্বা নিঃশ্বাস মোহন মাস্টার কেড়ে নিয়ে বলল, “মেয়েরা যে প্রকৃতি নিয়ে জন্মায়, যা রূপ, গুণ আর পরিচয় নিয়ে, সেটা হল ওই বাইরের রঙিন পাপড়ি | সেটা নিয়েই বড় হয়, কারো মেয়ে থেকে কারো জীবনসঙ্গিনী হয়, পরে মা হয়, ঠাকুমা-দিদিমা | কুমারী থেকে যুবতী, একসময়ে পূর্ণযৌবনা, তারপর ভাঁটা পড়তে শুরু করে | কারো জন্মের রূপ, গুণ শেষদিন অব্দি থেকে যায় | কারো অল্পেই তার শেষ হয়, অনেক আগেই | এরই মধ্যে একসময় ওই ভিতরের ফুলটা ফোটে | সেটাই মেয়েদের মর্ম | তার নির্দোষ রূপ, গুণ, মায়া, মমতা, ভালবাসা দেখতে এক অন্য চোখ লাগে | আমি একসময় সেই চোখ পেয়েছিলাম, আর দেখেছিলাম ভিতরের ফুলটা একজনের মধ্যে |”

মোহন মাস্টার চুপ করে গেলেন | আমারও চুপ করে রইলাম | ‘কে সে ?’ সবাই ভাবছি, কিন্তু মুখে প্রশ্নটা আসছে না, যে যদি মোহন মাস্টারের ঘোরটা কেটে যায় |

কাটল না | মোহন মাস্টার আবার বলতে শুরু করল |

“দাদুর বাড়ির দোতলা থেকে পাশের একতলার বাড়িতে মেয়েটাকে দেখতাম | শুধু সকালে | সে স্নান করে এসে কাচা শাড়িটা পিছনের উঠোনে মেলত | আমি দেখতাম | আর তার চোখে ধরা পড়লে, সে মেলা শাড়িটার আড়ালে চলে যেত | চুপ করে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত | আমিও থাকতাম | শেষে আমাকে হার মানতে হত | দাদু ছিল খুব অবস্থাপন্ন | ওরা ছিল ভীষণ গরিব | তাই আমি ভাবতাম আমার জোর খাটানো উচিত নয়, সরে যাওয়াই ভালো | একদিন কী যে হল, মেয়েটা সরল না | শাড়ি মেলার ভঙ্গিতে তারের উপর হাত ধরে আমার দিকে তাকাল | আমি ওর ভিজে চুলে ঘেরা মুখটা দেখলাম | আর দেখলাম ওর চোখ, ওর চিবুক, গলা ... বাইরের ফুলটা পুরো দেখলাম সেদিন | আর দেখলাম একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি, কিছুটা আমাকে দোষারোপ করার আঁচ ছিল তাতে |

“তখন আমি সাইকেল চালান শিখছি | একদিন ওদের বাড়ির সামনে পড়ে গেলাম, বোকার মত চিতপটাং হয়ে | সেই সাথে শুনলাম কেউ খিলখিল করে হেসে উঠল | তাকিয়ে দেখি মেয়েটা জানালা দিয়ে আমার দুরবস্থা দেখে হাসছে, ভাবটা এই যে, এখন তো তুমি আমার চেয়েও অসহায়, দুর্বল | আর সেই মূহুর্তে ওর হাসির মধ্যে আমি ওর পরিমল মর্মস্থল দেখলাম | ক্ষণিকের জন্য ফোটা একটা ফুলের ভিতরের ছোট সাদা ফুল, কোন রেণু নেই, কুমারীর সিঁথির মত পরিষ্কার, নিষ্পাপ |

আমার যে কী মনে হল | মনে হল এই মর্ম একদিন মিটে যাবে, শেষ হয়ে যাবে, আর আমি কিছু করতে পারব না, একে ধরে রাখতে পারব না | বাইরের ফুল দেখে ভোমরা আসবে, আর মর্মের ফুলটা শেষ করে দিয়ে যাবে | আমি কিছু করতে পারব না |

“এরপর আমি চলে আসি | মনে কথাটা থেকে যায় | আর মন থেকে অন্য কোন ফুল দেখার, বা গ্রহণ করার বাসনাটা চলে যায় চিরকালের মত |”


-------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৯ মে ২০১৬

শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬

দেখা

|| দেখা ||


স্টাফ-রুমে  ঢুকে বুকে চেপে ধরা বইগুলো নামিয়ে চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে নীতা দেখল বড় টেবিলটার এক কোনে দীপা চুপ করে বসে আছে | সামনে একটা খোলা খাতা, হাতে ধরা কলম, কিন্তু শরীরের নিস্তেজ ভঙ্গি দেখে মনে হল ওর মন ওই দুটোর মধ্যে নেই | নীতা চেয়ার টানলে একটু আওয়াজ হল, কিন্তু দীপা ধ্যানস্থ হয়েই বসে রইল, নড়ল না, তাকাল না | নীতা বসে পড়ে বলল, “এই, কী হয়েছে তোর ?” একটু পরে মাথাটা খুব আস্তে ঘুরিয়ে দীপা বলল, “হরষে-বিষাদ কথাটার মানে কী জানিস ?” নীতা বলল, “হরষে-বিষাদ . . . আমি তো জানি হরিষে বিষাদ . . . যাকগে, হটাত এই কথাটার মানে কেন জিজ্ঞাসা করছিস ? কিছু হয়েছে ? তোর মেয়ে কেমন আছে ?”

উত্তর না দিয়ে দীপা মাথা নামিয়ে খোলা খাতায় একটা টিক দিল, তারপর পাতা ওলটাল | নীতা উঠে গিয়ে দীপার পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলল, “কিছু বলবি না ?” দীপা মুখটা তুলে একটু হাসল – ম্লান হাসি, যেমন মেঘলা দিনে চর জেগে ওঠা গাঙের বুকে দূরের জল চিকচিক করে ওঠে কোন অদৃশ্য সূর্যের ছটায় | তারপর পাশের চেয়ারটা টেনে বলল, “কাছে বোস, বলছি |” নীতা বসলে দীপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল -

কাল রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি | দেখেছি ওর সাথে কোথাও বেড়াতে গিয়েছি | আমরা একটা হোটেলে উঠেছি | তার চারিদিকে ঢালাও খোলামেলা প্রকৃতি, হাতছানি দিচ্ছে বেড়াতে যাওয়ার জন্য | কী সুন্দর সিন্যরী ! আমরা লবিতে বসে দেখছি, আর ভাবছি কখন বেরব | আমি ওয়াশরুমে গেলাম | ওয়াশরুমেও বড় বড় জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে | তখন দেখি ওয়াশরুমের পিছন দিকে একটা দরজা | কী কৌতূহলে দরজাটা খুললাম | পিছনে চারিদিক একেবারে গাছে গাছে ঢাকা, সবুজে সবুজ, মুগ্ধ করে দেয়ার মত | আর ওই দরজা থেকে একটা পায়ে হাঁটা পথ তার মধ্যে চলে গেছে | আমি ওর কথা ভুলে গেলাম, কোথায় আমি, কী করছিলাম সব ভুলে গেলাম | সব ভুলে গিয়ে ওই পথ ধরে রওনা দিলাম, যেন আমি জানি কোথায় যেতে হবে | কী সুন্দর, কী পরিষ্কার চারিদিক, কোথাও কোন আগাছা নেই, নিচে সবুজ ঘাসে একটা ময়লা, একটা খড়-কাঠি, একটা কুটো, কি একটা শুকনো পাতা নেই, চারিদিক শুধু সবুজ পাতা ছাওয়া বড় বড় গাছ | এইভাবে বাইরেটা আমাকে সব ভুলিয়ে দিয়ে টেনে নিয়ে চলল | কিসের টানে যে আমি কোন ভয় না করে এগিয়ে গেলাম তা আমি জানি না | কতদূর চলে গিয়েছি এই ভাবে হুঁশ হারিয়ে | তারপর দেখলাম গাছগুলো একটু ফাঁকা হচ্ছে, মাঝখানে বেশ খানিকটা পরিষ্কার জায়গা, যেন কেউ ওই ভাবে জায়গাটা তৈরি করেছে | গাছগুলো যত্ন করে সাজানো, নিচে কেয়ারি-করা ফুলবাগান  আর সমান করে ছাঁটা ঘাস, তার মধ্যে একটা বসার বেঞ্চ | বুঝলাম আমি কোন পার্কে পৌঁছেছি | সেই বেঞ্চে একটা বউ বসে, আর তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একজন হাবভাব ভঙ্গিতে বয়স্ক লোক, যে কোন কারণে বউটার থেকে সরে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে – যাকে সে সাথে করে নিয়ে এসেছে, কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না, অপেক্ষা করছে কখন সে ফিরে যেতে চাইবে | লোকটার মুখটা দেখতে না পেলেও বুঝলাম লোকটা মনের দৃষ্টিতে বউটার দিকে তাকিয়ে আছে, সেই দৃষ্টিতে একসাথে বিস্ময়, কৌতূহল, অপেক্ষা, আকাঙ্ক্ষা সব মিশে আছে | দুজনেই চুপ |

আমি কাছে যেতেই বউটা আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আর উঠে দাঁড়াল | অল্প বয়েস | লম্বা, সুঠাম, সুন্দর চেহারা | গায়ের রঙ ফর্সা নয় ময়লা, কিন্তু মুখের আদল অপূর্ব সুন্দর – যেন তার সব কটা বৈশিষ্ট্য কোন শিল্পীর খুব যত্ন করা হাতে ছেনি দিয়ে ছিলা-কাটা | মাথা ভরা কোঁকড়ানো চুল কাঁধ ছাপিয়ে উপচে পড়ছে | আর কী শান্ত চোখের দৃষ্টি, কত সৌম্য মুখের ভাব | আমি এমন সুন্দরী আর একজন দেখি নি | আমি ওকে দুচোখ ভরে দেখছি দেখে ও একটু হাসল | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “সুখবরটা পেয়েছেন তো ?” ও মাথা নাড়ল, যেন খবরটা কেউ না বললেও
ওর জানা | আমি বললাম, “আপনি খুশি ?” ও বলল, “আমি খুউব খুশি |” আমি বললাম, “আপনার ছেলে আপনাকে মিষ্টিও পাঠাবে |” ও বলল, “পাঠাবে ? আমি মিষ্টি পাবো ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ পাবেন, ও নিশ্চয় পাঠাবে |” ও বলল, “তবে তুমি ওকে বোলো দুটোর বেশি নয় |”

ওর কথা শুনতে শুনতে আমি চোখ ফেরাতেই পারছি না | এত সুন্দর মুখশ্রী, আর তাতে এত আনন্দ | কিন্তু এই শেষ কথাটা বলতে গিয়ে ওর মুখে একটা ছায়া পড়ল | ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি যাচ্ছেন তো ?” আমি বললাম, “আমি যাব, খুব শিগগিরই যাব | আপনি যাবেন না ?” ও বলল, “আমিও যাব |”

আমার হটাত মনে হল, এর টানেই কি আমি সব ভুলে ছুটে এসেছি | না হলে, আমি কেন ওর  মুখ থেকে আমার দৃষ্টি সরাতে পারছি না ? আমি কি ওকে আগে কখনও না দেখে থাকলেও সেই মুহূর্তে চিনেছিলাম ? এই সব প্রশ্নের চিন্তায় আমি একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম হয়ত, হয়ত আমার দৃষ্টিটা এক মুহূর্তের জন্য আবছা হয়েছিল | আবার দৃষ্টি স্পষ্ট হলে দেখলাম দুজনে নেই | আমি তখন ওই পথেই তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে এলাম |

দীপার বলা শেষ হলে নীতা জিজ্ঞাসা করল, “তুই কবে যাচ্ছিস মেয়ের কাছে ?”
দীপা, “এখনও দেরী আছে |”
নীতা, “ডেট কবে দিয়েছে ?”
দীপা, “বলছে তো এক্সপেক্টেড ডেলিভারি আশ্বিনের মাঝামাঝি, তবে এক আধ সপ্তাহ আগেও হতে পারে |”
নীতা, “তুই তোর মেয়েকে স্বপ্নটার কথা বলবি ?”
দীপা, “কী বলব ? যে ওর শাশুড়িকে স্বপ্নে দেখেছি | ওনাকে তো আমি দেখিই নি | শুনেছি, উনি আমার জামাইকে জন্ম দিয়ে মারা যান |”
নীতা, “তবে কী করে মনে করছিস যে ওটা তোর বেয়ান ছিল ?”
দীপা, “কে জানে, হয়ত ওই জামাইয়ের মত কোঁকড়া চুল, ওর হাসি, ওরই গায়ের রঙ . . . জানি না রে . . . বা, হয়ত ওর কাছে যে বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে ছিল সে আমার বেয়াই ছিল | সেই রকমই লাগছিল তার দেহভঙ্গি দেখে |”

এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে নীতা আবার দীপাকে স্টাফ-রুমে একা পেয়ে বলল, “কেমন আছে তোর মেয়ে ?”
দীপা, “ভালো আছে | এই তো স্কুলে আসার আগে ফোনে কথা হল |”
নীতা, “কিছু মনে করিস না . . . জিজ্ঞাসা করছি  . . . তোর সেই স্বপ্নের কথাটা তুই মেয়েকে বলেছিস ?”
দীপা, “হ্যাঁ বলেছি | আমার বরও আমাকে চাপ দিচ্ছিল | ক’দিন আগে মেয়েকে বললাম | বললাম, জামাইকে বলিস | ও বলল, ওকে ফোনটা দিচ্ছি, তুমি নিজের মুখে বল | জামাইকে বললাম | শুনে জামাই একটু চুপ করে থেকে বলল, মা, আপনি বাবাকে একটু বলবেন এই কথা ? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কিছু মনে করবেন না তো ? ও বলল, না | আমি বললাম, কিন্তু বলার দরকার আছে কি ? জামাই বলল, আপনি বলে দেখুন, বাবা হয়ত কিছু বলতে পারে |”
নীতা, “তুই বললি, তোর বেয়াই কে |”
দীপা বলল, “আমি বলি নি | আমার বর বলেছে | পরে বড় আমাকে বলল, স্বপ্নের কথা শুনে বেয়াই নাকি একদম চুপ করে গেলেন | তারপর ফোনটা ছেড়ে দিলেন আর কোনও কথা না বলে |”
নীতা, “আশ্চর্য তো !”
দীপা, “আশ্চর্য নয় | বা বলতেও পারিস . . . | কাল মেয়ের কাছে শুনলাম, জামাই ওকে বলেছে, প্রথম দুই মেয়ের জন্ম দেয়ার পর আমার বেয়ানের শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়, ডায়াবেটিসে ধরে | এইটুকু আমিও জানতাম | জানতাম না যে ওনার শ্বশুর চাইছিলেন নাতি | কিন্তু বেয়ান আর সন্তান চাইছিলেন না | শ্বশুরের শখ পূর্ণ করে দিয়ে আমার বেয়ান আর বেশি দিন বাঁচেন নি |”

দুজনেই চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ | তারপর দীপা বলল, “আর জানিস, আমি ভেবেছিলাম স্বপ্নে উনি মিষ্টির কথা বলছিলেন . . . যখন বললেন, ‘তবে তুমি ওকে বোলো দুটোর বেশি নয় |’ ”


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩০ এপ্রিল ২০১৬

রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৬

মেনি বিড়াল

|| মেনি বিড়াল ||


আমার বিছানায় জুটেছে এক বিড়াল
বড় দুর্বিনীত, অসভ্য তার আচরণ
শোনে না কোন কথা, আমায় চাটে
না আগে, না পরে করে আচমন
গায়ে হাত বুললে লেজ খাড়া করে
কষে পিঠ বেঁকিয়ে রুঠে সে দাঁড়ায়
চোখ সরিয়ে নিলে এসে গা ঘষে
ককিয়ে প্রেম, করে পাড়া মাথায়
তার ব্যবহারে সে মনে করায় কিছু
তোমার সঙ্গর ছোট বিস্মৃত কথা
কাছে থেকে তুমি হলে না গা-লাগা
চলে গেছ, সারা গায়ে এখন ব্যথা
ওর সাথে তোমার একটাই তফাৎ
মনে হয় ওর আমি ছাড়া কেউ নেই
তোমার স্তাবক মেনি হুলো বিড়াল
ইংরেজির মেনি মানে জানতোই !


--------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৭ এপ্রিল ২০১৬

শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৬

বুকা

|| বুকা ||


ভেবেছিলাম কথাগুলো কী ভাবে গুছিয়ে লিখব | কতদিন আগেকার কথা | আমার কী না কী মনে আছে | তোমাকে বললে তুমিই কি মনে করতে পারবে ? আর, কী ভাবেই বা বলব ? কেটে গেল সাতাশ থেকে সাতান্ন – তোমার খোঁজ নিতে আজ অব্দি কাছে যেতে পারি নি | কেন, সে কথা এখন থাক ... বা, একটু পরে না হয় !

আমি শুধু একটা প্রশ্ন করতে তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম – ওই কোকিলটা কোথা থেকে এলো ? আর এলো তো এলো, আমাকে ছাড়ে না কেন ? জানো, বছরের বড় জোর এক দু’ মাস – শ্রাবণে তুমুল বর্ষা নামার পর থেকে হেমন্তের শেষ অব্দি শুধু – কোকিলটা থাকে না | তারপর একদিন হঠাত এক ছিমছাম অমল সকালে শুনি তার হালকা গলায় প্রথম সংশয়ী কূ ডাক | ওই ডাক এক মূহুর্তে আমার মাস দুয়েকের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ভাঙিয়ে দিয়ে আমাকে সচকিত করে দেয় | ডেকেই একটু পরে ও আবার ডাকে, যেন আস্কারা চেয়ে ; আবার ডাকে একটু পরে | ক্রমশ ওর ডাক জোরালো হয়, ওর যে কী জেদই চাপে, আর ওর ডাকের লয় কত যে দ্রুততর হয় | শেষে গলাটা সপ্তমে তুলে চমকে উঠে ও ডাক থামিয়ে দেয় | কিছুক্ষণ পরে, যেন বুকে দম ভরে নিয়ে, ও আবার ফিরে ডাকে | ওর ওই ডাকের ওঠা নামা, ওর আসা যাওয়ার টানা পোড়েন আমাকে টেনে নিয়ে যায় এক অপার সময় সমুদ্রের কিনারে |

মনে পড়ে যায় পিয়ারুল, প্রত্যেক বার নতুন করে | নামটা কী মিষ্টি | বাবা সেবার বলেছিল আমরা গরম পড়লে পিয়ারুলে বেড়াতে যাব | সেখানে নাকি যে দিকেই তাকাও শুধু শাল গাছ | তখন কেন জানি আমার বুক ঢিপঢিপ করে উঠেছিল হটাত | সেই বয়সটায় আমার ওইরকমই হত হয়ত | ক’দিন আমার সবকিছু কেমন টানটান হয়ে উঠেছিল এক উৎসুক কাতরতায় | আর, বেশ কয়েক রাত আমি স্বপ্ন দেখছিলাম যে আমার মাথার উপর শালের মঞ্জরী, তার মাঝে কেউ লুকিয়ে আছে | আমি যেন জানি যে সে গাছের ডালে, পাতার ফাঁকে কোথাও লুকিয়ে আছে | কিন্তু মাথা তুলে দেখতে সাহস পাচ্ছি না, যদি সে পালিয়ে যায়, মাথায় মঞ্জরী খসিয়ে |

প্রথম দিন তুমি এলে, আর ছোট পিসি তোমার পরিচয় দিয়ে আমায় আভাস দিল যে তুমি আমার চেয়ে বড় | হয়ত ছিলে | মাথায় তো ছিলে, কিন্তু চোখ দেখে মনে হল না | তোমার চোখে দেখলাম একটা লুকানো কিছুর রহস্যময় বিহ্বলতা, যেমন লক্ষ্মী ট্যারার দৃষ্টিতে হয়, যেন তুমি এমন কিছু দেখে নিয়েছ যা চাও না আর কেউ দেখুক | আমার প্রথমেই ভয় হল তুমি আমাকে সরল মনে নেবে না | আমাকে নেয়ার কথা কেন ভেবেছিলাম তা মনে নেই | তবে ছোটবেলায় আমার একটা ভয় ছিল আমাকে ভালো কেউ নেবে না | আসলে মা আমাকে ছোটবেলা থেকে শাসন করার বদলে ভয় দেখিয়ে বলত, তোকে ভালো কেউ নেবে না | কিন্তু, তা তো হল না | দু’দিনেই – আমার ঠিক মত ভাবও হয় নি – তুমি এসে পিসিকে বললে, রবার্টসন সাহেবের বাড়িতে নাকি একটা সাদা ময়ূর এসেছে – সে ভারী সুন্দর, আর আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি সাদা ময়ূর দেখেছি কিনা | আমি দ্বিধায় মাথা নেড়েছিলাম | ভয় ছিল সত্যি বললে যদি কিছু হয়, যদি তুমি আমার কথা অবিশ্বাস করো | আমি যে চাইছিলাম তোমার সাথে যেতে | কোথাও |

পরদিন আমি পিসিকে বলে তোমার সাথে গেলাম সাদা ময়ূর দেখতে | মেম-ঝিলের পাশ দিয়ে সাতটা কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচ দিয়ে কত দূরে আমার চলে গেলাম | আমরা কোন কথা বলি নি | তুমি আমাকে মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছিলে | শুধু একবার আমাকে তুমি বললে, “হারিয়ে গেলে একা ফিরতে পারবি ?” আমি মাথা নেড়েছিলাম | শীলঘাটা হলে অন্য কথা ছিল | ওখানে অনেক রিকশাওয়ালা আমাদের বাড়ির সবাইকে চেনে | কিন্তু পিয়ারুলের রিকশাওয়ালারা তো সব অচেনা | ওদের সাঁওতাল হাসি আমি বুঝতাম না | সারাদিন অলস বসে থাকত, আধো স্বরে কথা বলত, আর ঝকঝকে
সাদা দাঁত বের করে হেসে থুতু ফেলে আবার হাসত | মনে হত না ওরা কোনও কাজের লোক | হয়ত রিক্সায় উঠলে আধপথ নিয়ে যাবে | পরদিন পিসির বাড়ি এসে তুমি দেখবে আমি নেই | আর রিকশাওয়ালাদের জিজ্ঞাসা করলে ওরা থুতু ফেলে হাসবে |

তো, সেই লাল ইটের দেয়ালে ঘেরা বাংলোর উঠোনে আমি দেখলাম সাদা ময়ূরটা, দিব্যি দর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে | আমার কেন জানি না ঠিক ভালো লাগেনি | আমার বেশি ভালো লেগেছিল, পিছু টানছিল মেম-ঝিল, লেক ঘিরে কৃষ্ণচূড়ার সাতনরী – তুমি বলেছিলে কথাটা, ভুল বলেছিলে | আর, ভালো লেগেছিল বুকা মাহাতোর শালের বাগানের ভিতর দিয়ে শর্টকাট | শর্টকাট কথাটা সেই প্রথম তোমার কাছে শুনেছিলাম |

আমি কি তখন জানি যে ওই বুকা মাহাতোর শালের বাগান আর থাকবে না | আর তার কোকিলটা – ওখানেই আমি প্রথম যার ডাক শুনেছিলাম – আমার চেতনায় ঠাঁই নেবে | একই কোকিল, না অন্য কোন ? কোকিল ক’বছরই বা বাঁচে ?

ন’বার যখন তুমি আমায় নিয়ে যাচ্ছিলে রবার্টসন সাহেবের বাড়ি, ওই বুকা মাহাতোর শালের বাগানে হঠাত শুনলাম সর্বাঙ্গ শিউরে দেয়া একটা মায়াডাক | আমি চমকে উঠে উপরে তাকালাম উৎসটা দেখার জন্য | সোজা সোজা উঠে যাওয়া ঋজু শালের গুঁড়ির মাথায় অনচ্ছ সবুজ ছাউনির আকাশ | আমি তাকিয়ে রইলাম বুকের ঢিপঢিপ চেপে | তুমি আমার হাত ধরে টেনে বললে, চল, কিছু দেখতে পাবি না | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ও কে ডাকল ? তুমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, সে কী, তুই জানিস না ওটা কোকিল ? আমি জানতাম না | তাই বললাম, আমি কোকিল দেখব | তুমি বললে, আচ্ছা, ফেরার পথে দেখিস |

ফেরার পথে তুমি আমাকে নিয়ে শাল বাগানে দাঁড়ালে, আর বললে চুপ করে থাকতে | চুপ করেই ছিলাম, হটাত পায়ের কাছে জমিতে পড়া শুকনো শালপাতার মধ্যে থেকে সরসর করে একটা শব্দ হল | আমি ভয় পেয়ে তোমার গা ঘেঁসে দাঁড়ালাম | তুমি আমাকে টেনে তোমার গায়ে এক করে চুপ করে থাকলে | সে কতক্ষণ ! তারপর তুমি আমাকে দেখালে দূরে একটা বাদামী হলুদ সাপ | তার সারা শরীরের উপর কালো কালো ছাপ | আর, পিঠের উপর দিয়ে দুটো হলুদ ডোরা চলে গেছে লেজ অব্দি | আমাকে বললে, ওই দেখ, সাপটা চলে যাচ্ছে | চল এবার বাড়ি যাই | আমি তখন তোমার স্পর্শে, শাল মঞ্জরীর গন্ধে, বৈশাখের উত্তাপে আড়ষ্ট |  তোমার মা হতে তৈরি বুকে আমার মাথাটা মিশে যেতে দেখে তুমি চাপা এক হাসিতে হিলহিল করে উঠে বললে, এই ঢোঁড়া সাপ ! তুইও কি ঢোঁড়া সাপ ? তুই এমন চুপ করে গেছিস কেন ?

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, তুমি কি কোকিল দেখাবে না ? তুমি বললে, সেই লুকানো কিছুর অদ্ভুত আলো আঁধার ভরা মায়াচোখ নাচিয়ে, বুকা, জানিস না, কোকিল এমনি দেখা দেয় না | কোকিলের ডাক শুনতে পাবি, দেখা পাবি না |

কথাটা ঠিক তাই হল | আমি কত বনে জঙ্গলে যে ঘুরেছি – আম কাঁঠালের গাছে ঠাসা বাগানে গিয়ে বসে থেকেছি, কখনও কখনও হাতে ক্যামেরা নিয়ে | না | ছবির বইয়ে কোকিলের ছবি দেখেছি | অথচ, আমার কোকিলটা আমার সাথে থেকেছে, দেখা দেয় নি | তাই সন্দেহ হয়, কোকিলটা কি সত্যি | নাকি এটা আমার একটা ভ্রম | আমি যে মাঝে মাঝে ওর ওই নিঃসঙ্গ ডাক সহ্য করতে পারি না |

কী করতে পারতাম ? আবার পিয়ারুল যেতাম ? তোমাকে বলতাম ? তোমাকে বললে কি তুমি দেখিয়ে দিতে ? আমার কোকিলটাকে আমার থেকে আলাদা করে দিতে পারতে ? কিন্তু তাই বা কী করে হত | কোকিলটা তো এলো আরও ষোল বছর পরে, আমার সাতাশ পার হতেই |

সে দিন থেকে জীবনের এই রোগ লক্ষণ শুরু, সে কবেকার কথা | আমার আঠাশতম জন্মদিন ছিল সেটা | বন্ধুদের সাথে পুরী বেড়াতে গিয়ে হোটেল থেকে মাকে ফোন করেছিলাম | ফোনটা তোলার ঠিক আগে শুনলাম জানালার বাইরে ভুলে যাওয়া পিয়ারুলের কোকিলের ডাক | মনে পড়ে না পিয়ারুলের পরে এর আগে কখনও আমি কোকিলের ডাক শুনেছি | তাই মনে হয় সেইদিনই ওই কোকিলটা আমার সঙ্গ নিলো | সেই ডাকটা ছিল তীক্ষ্ণ আর আর্ত – যে ভাবে ভূমিকম্পের সময় মায়ের শঙ্খধ্বনিতে বাজতে শুনেছি – যেন কোকিলটা বলতে চাইল আমার দুঃসময় আগত |

কিন্তু, ফোনে আমার মৌখিক প্রণাম নিয়েই মা বলল, ভালো খবর আছে, তোর জন্য একটা মেয়ে খুব পছন্দ হয়েছে | খুব স্মার্ট আর ফর্সা | তুই কবে দেখতে আসবি বল | আমি একদম ছুটি পাই নি সে বছর | তাই আভাকে দেখতে গেলাম প্রায় এক বছর পরে | আমার বিপরীত, অসম্ভব সপ্রতিভ | এর পর ওকে দেখলাম বিয়ের রাত্রে | আমাদের ফাল্গুন মাসে বিয়ে হয়েছিল | বিয়ের লগ্ন ছিল গভীর রাতে | বিয়ের মন্ত্র পড়ব কি, কাছেই কোথাও কোকিলটা এসে জুড়ে বসল, আর ক্রমাগত ককিয়ে ডেকে গেল | কী বুক ভাঙ্গা সেই ডাক |

বাসর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, আভাও আমার পাশে পিঠে বালিশ দিয়ে ওর খোঁপায় ভারী মাথা আমার কাঁধে রেখে চোখের পাতা নামাল | কোকিলটা আবার ভর করল, পাগল করল ডেকে ডেকে | একবার ভাবলাম উঠে গিয়ে দেখি | কিন্তু আমি তো ইতিমধ্যে আভার সাথে গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়ে গেছি |

ফুলশয্যার রাত্রে আভাকে প্রথম দেখলাম ঠিক করে | বা বলা যায়, প্রথম সবার থেকে আলাদা করে | আমি ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিতেই কোকিলটার ডাক শুনলাম | একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম কিনা জানি না | আভার চন্দনে সাজানো অসম্ভব ফর্সা মুখে মনে হল কিছুর একটা ছায়া পড়ল | বলল, কখন থেকে ওই কোকিলটা বড্ড বিরক্ত করছে ডেকে ডেকে | এই জানালার বাইরেই কোথাও আছে | বন্ধ করে দিই ? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ও উঠে জানালটা বন্ধ করে দিল | আমি ক্লান্ত ছিলাম | বিছানায় গা এলিয়ে বালিশে মাথা ফেললাম | আভা পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে শাড়ির খসখস, চুড়ি বালার রিনরিন আর পান খাওয়া মুখের গোলাপজলের গন্ধের জাল ফেলে আমাকে ঘিরে ফেলে জিজ্ঞাসা করল, ঘুম পেয়েছে ? আমি বললাম, একটু | ও খুব হালকা ঠাট্টার গলায় জিজ্ঞাসা করল, আর ফুলশয্যার আদর ? পাচ্ছে না ?

তার কথা আগে ভাবি নি, বা ভেবে থাকলেও সেই মূহুর্তে মাথায় আসে নি, হয়ত ক্লান্তিতে | কী উত্তর দেব ভাবার আগেই আভা মুখটা নামিয়ে নিয়ে এলো | নিশিবাতির স্নিগ্ধ আভায় উদ্ভাসিত বিছানাটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো বহ্নিশিখায় | আর সেই রাত, সারা রাত, একটা সাদা ময়ূর আমাকে ঠুকরে ঠুকরে খেল | নিজেকে মনে হল আমি এক নির্জীব সাপ হয়ে পড়ে আছি ওই সাদা ময়ূরের ধারালো চঞ্চু আর নখের নিচে |

আশ্চর্য হলাম না মোটেই, যখন খুব শিগগিরই আভা ধরে ফেলল যে আমি প্রায় সারা বছর, দিনরাত কোকিলের ডাক শুনি | ধরে ফেলল, কেন না ডাকটা শুনলেই আমি ব্যাকুল হয়ে আমার স্মৃতিতে বুকা মাহাতোর শালের বাগানে ফিরে যাই | তখন আমার চোখের মণিতে তাকালে দেখা যাবে আকাশভেদী শাল গাছের গুঁড়ি, আর তার উপরে ছাওয়া সবুজ শালের পাতা – যার মাঝে কোকিলটা লুকিয়ে | আভা মাকে কিছু জানালো না | আভা কাউকে কিছু বলার মত মানুষ নয় | ও চুপচাপ কাজ করার মানুষ | তাই ও সাদা ময়ূরটাকে বাগ মানাতে শুরু করল | বুনো ময়ূরটা কী ভাবে ওর যে বশ হয়ে গেল জানি না | কিন্তু তিন পক্ষের খেলা ঘোর হয়ে উঠল | কোকিলটা, একটা সাদা ময়ূর আর আমি, এক নির্জীব ঢোঁড়া সাপ | বশ মানানো ময়ূর বড় ভয়ঙ্কর হতে পারে, বড় হিংস্র হয়ে খেলাতে পারে তার শিকারকে | সেই খেলায় যেন সাপটাও আমার থেকে আলাদা হয়ে ক্রমে ক্রমে পাকা সেয়ানা হয়ে উঠল | রোজ রাতে যখন কোকিলটা ডাকে, আভা সংসারের কাজ গুছিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে জানালাটা বন্ধ করে | তারপর নীল নিশিবাতিটা জ্বেলে রূপ বদলে সাদা ময়ূর হয়ে ঘনিয়ে আসে পরিশ্রমের বিছানায় | সাপটা তার উপর চোখ বুজে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে আছে | জানে ময়ূরটা এসে নখর নখে তাকে ধরে, নামিয়ে আনবে তার শরীরের উপর দুই ধারালো চঞ্চু | তারপর সেই চঞ্চু একটু একটু করে সাপটার খোলস ছাড়াবে | চাপা শীৎকারের সাথে সাথে ছটফট করে সাপটার শরীর ছিঁড়ে ফালাফালা করবে | বাইরে কোকিলটাকে বোবা করে রাত গভীর হবে | তারপর ময়ূরটা, প্রোথিত বিমথিত ময়ূরটা, এক জৈবিক নির্যাস নিকষিত করে নেতিয়ে নিজের মসৃণ মসলিন আবরণে ঢুকে পড়বে | সাপটা তার ফালি ফালি শরীরটা জড়ো করে একটা জামায় পুরে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে, ধুঁকবে | তখন কোকিলটা আবার ডাকবে, জানাবে, ও জেগে থেকেছে, সব শেষ হতে দেয় নি | চাঁদের আলো মেঘের আড়াল থেকে সাবধানে উঁকি মেরে পরিস্থিতি সহজ দেখে লাফ দিয়ে বেরিয়ে স্বস্তির হাসি হেসে চারিদিক আলো করবে | গাছের পাতায় শিরশির করে হাওয়া বলবে, ভোর হতে চলল | সেই খুশিতে কোকিলটা চঞ্চল হয়ে আবার ডাকবে | সাপটা বুকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বুকা মাহাতোর শাল বাগানে ফিরে যাবে |

এই ভাবেই আমি রোজ ঘুমিয়ে পড়েছি বছরের পর বছর | আর চেয়েছি বার্ধক্য | কিন্তু, ফিরে যেতে পারি নি পিয়ারুলে | পিসির মেয়ে সুরুচির কাছে খবর চেয়ে পেয়েছি – তোমার সেবায় থেকে রবার্টসন সাহেব মারা যাওয়ার পর তোমার কোন খবর নেই | সাহেবের বাংলো ভেঙ্গে পড়েছে | বুকা মাহাতোর শাল বাগান গাছ কেটে কেটে শেষ |

কাল রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম | একটা শ্যামবর্ণ হাতের পাতা চিত করে ধরা, যার রেখাগুলো সুগভীর | তার উপর চন্দন রঙের একটা ভারী সুন্দর সাপ বুক পেতে শুয়ে | নির্মোক হীন সাপটার বাকি দেহ সেই হাতেরই কব্জি জড়িয়ে | যেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্লীওপাত্রার হাতের এক আভরণ | আর একটা তেমনই শ্যামবর্ণ হাত সাপটার মাথার উপর আলতো করে রেখে বুলিয়ে ওকে আদর করছে | আমি বললাম, কী করছ ? তুমি বললে, ওকে বলছি, আমার ভাগ্যরেখায় পড়ে থাকিস না, সরে যা |

সারাদিনে অনেকবার আভা এসে দেখে গেছে আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছি | ওর কোন কৌতূহল নেই কাগজ পত্রে | ও শুধু জানে আমি একটা চিঠি লিখছি কাউকে, যার ঠিকানাটা সুরুচিকে বলেছি দিতে | আভা একবার দু’বার জিজ্ঞাসা করেছে, কতদিন ধরে চিঠিটা লিখছ | শেষ করবে না ?

ঠিক কথা, কিন্তু, একটু আগে সুরুচি ফোন করেছিল | বলতে, তুমি আর কোনও ঠিকানায়ই নেই |

তবুও কলমটা তুলেছি | একটা কথা না লিখলেই নয়, যা কাল হটাত মনে পড়েছে, আর আমি ধরে ফেলেছি কোকিলটাকে |

সেবার শেষদিন যখন আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে দেখাবে না কোকিল ? তুমি বলেছিলে, চল তাহলে বুকা মাহাতোর বাগানে | কই, ওখানে গিয়ে তো তুমি আমাকে কোকিল দেখালে না | শুধু, চারিদিক দেখে, তোমার কাছে আমায় টেনে তোমার হাতের তালু আমার বুকে চেপে বললে, বুকা কোথাকার ! কোকিল এখানে থাকে | বুঝিস না, তুই ?

আমি বুঝেছি, এখন বুঝছি, সেদিন তুমি তোমার হাতের তালু দিয়ে ঠেলে আমার বুকের কপাট খুলে একটা কোকিল ঢুকিয়ে দিয়েছিলে | সে ডাকত, আর আমি বুকার মত তাকে বাইরে বাইরে খুঁজতাম | তাই না, আয়াদি ?


-----------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৬ এপ্রিল ২০১৬

রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৬

তুষার সন্ধ্যায় বনানী সমীপে বিরাম

|| তুষার সন্ধ্যায় বনানী সমীপে বিরাম ||


এই বনানী যার, যেন মনে হয় তাকে আমি চিনি
নিবাস তার ওই গ্রামে যে সে কথা যদিও মানি
সে দেখবে নাকো আমি এখানে নিয়েছি বিরাম
দেখতে বনানী ঢেকে দেয় তুষারপাত অবিরাম

আমার ছোট্ট ঘোড়াটা নিশ্চয় ভাবে কী আশ্চর্য
বিরাম, যখন কাছেপিঠে নেই কোন খামারের জো
বনানী আর বরফ-জমা এই হ্রদের ঠিক মাঝে
বছরের সবচেয়ে অন্ধকারতম সঙ্গিন এক সাঁঝে

অধৈর্য হয়ে সে ঝাঁকায় তার ঘণ্টি বাঁধা লাগাম
শুধাতে আমাকে আমি কি কোন ভুল করেছিলাম
এছাড়া যে শব্দ শুনি তা ঝাঁট দিয়ে যাওয়া বাতাস
অবাধ, আর তার সঙ্গে পলকের মত তুষারের রাশ

এই বনানী কত সুন্দর, কত গহীন, কত অন্ধকার
কিন্তু আমি যে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ, করেছি অঙ্গীকার
এখনও যোজন যেতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে
এখনও যোজন যেতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ||


(অনুবাদ - Stopping by Woods on a Snowy Evening by Robert Frost)
----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১০ এপ্রিল ২০১৬

শনিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৬

সাপ

|| সাপ ||

উষ্ণ, উত্তপ্ত একদিন, যখন খরতাপে আমি ছিলাম পায়জামায়,
আমার জলাধারে এসেছিল সাপ এক
জল খেতে

বিশাল, নিরালোক তেঁতুল গাছের সুনিবিড় অচিন-গন্ধী ছায়ায়
আমি নেমেছিলাম সিঁড়ি বেয়ে, জলের পাত্র সমেত
কিন্তু যেহেতু ও ছিল জলাধারে আমার আগে, আমাকে দাঁড়াতে, অপেক্ষা করতে হয়

মেটে-দেয়ালের এক ফাটল থেকে ও নেমে এসেছিল আবছায়ায়
আর পাথরের জলাধারটার কানার উপর ও লতিয়ে নিয়ে গিয়েছিল
ওর পীতাভ-পিঙ্গল শিথিলতা, ওর নমনীয় পেট উপুড় করে
আর, রেখেছিল ওর গলা  নিচের পাথরের উপরে
এবং, যেখানে নল থেকে জল চুয়ে পড়েছিল, সেখানে এক সংকীর্ণ স্বচ্ছতায়
ও চুমুক দিয়েছিল ওর সরল মুখে
মৃদু ভঙ্গিতে সরল মাড়ির ভিতর দিয়ে,
ও শুষে নিয়েছিল ওর লম্বা ঢিলে শরীরের অন্তরে
নিঃশব্দে

কেউ তো ছিল আমার জলাধারে আমার পূর্বগামী
আর, দ্বিতীয় এক আগতের মত, প্রতীক্ষায় আমি

ওর জল পান থেকে ও উঁচিয়েছিল ওর মাথা, যেমন করে গবাদি পশু
আর দেখেছিল আমার দিকে ভাসাভাসা দৃষ্টিতে, পানরত গবাদির মত
ওর ঠোঁট থেকে লকলক করে উঠেছিল ওর দ্বিশৃঙ্গ জিভ
এবং মুহূর্তের জন্য  ও তন্ময় হয়েছিল
আর, ঝুঁকে আরও একটু জল খেয়েছিল
সেই সিসিলিয় জুলাইয়ের দিনে, যখন এতনা ধূমায়িত
জ্বলন্ত ভূগর্ভ হতে নিঃসৃত ওর মেটে-পিঙ্গল, মেটে-স্বর্ণাভ আভা দেখে
আমার শিক্ষাদীক্ষা সরবে আমায় বলেছিল
ওকে বধ করতে হবে
কেননা সিসিলিতে কৃষ্ণ-কালো সাপেরা নির্দোষ, আর সোনালীরা বিষধর

আর আমার অন্তরের স্বরেরা বলেছিল আমায়, তুমি যদি প্রকৃত পুরুষ হতে
তুমি হাতে লাঠি নিতে, ওকে ভেঙ্গে ফেলতে, ওকে শেষ করতে

কিন্তু, আমাকে কি স্বীকার করতেই হবে ওকে আমার কত ভালো লেগেছিল
কত খুশি হয়েছিলাম আমি, যে ও অতিথির মত নীরবে এসেছিল
আমার জলাধারে জল খেতে
আর শান্ত, প্রশমিত হয়ে অকৃতজ্ঞের মত ফিরে যেতে
পৃথিবীর জ্বলন্ত গর্ভে?

সেটা কি ছিল আমার কাপুরুষতা, যে আমি ওকে মারতে সাহস পাই নি ?
নাকি বিকৃতি যে আমি ওর সাথে আলাপের আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম ?
নাকি বিনম্রতা, এত সম্মানিত বোধ করায় ?
আমি কত সমাদৃত যে বোধ করেছিলাম !

কিন্তু সেই সব কণ্ঠস্বরেরা:
তুমি যদি না ভয় পেয়ে থাকতে, তুমি ওকে মেরে ফেলতে !

আর, সত্যিই তো আমি ভয় পেয়েছিলাম, বড় বেশি ভয়
অথচ তা সত্ত্বেও, আরও বেশি হয়েছিলাম সম্মানিত
যে ও আমার আতিথেয়তা চাইবে
গোপন জগতের আঁধার দুয়ার থেকে আগত

ও যথেষ্ট পান করেছিল
আর মাতালের মত মাথা উঁচিয়েছিল, স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে
এবং, ঠোঁট চেটে নেয়ার ভঙ্গিতে
বাতাসে ওর জিভ লকলক করেছিল দ্বিশৃঙ্গ নিশার মত, সে কী কালো
আর, ও দেবতার মত দেখেছিল, দৃষ্টিহীন, চারিপাশে বাতাসে
আর, ধীরে ওর মাথা ঘুরিয়েছিল
ধীরে, অতি ধীরে, যেন ত্রিগুণ স্বপ্নমগ্ন
এগিয়েছিল ও সর্পিল ভঙ্গিতে ওর মন্থর দৈর্ঘ্য টেনে নিতে
আর, আবার আমার দেয়ালের গায়ের ভাঙ্গা পাড়ে উঠে পড়তে

এবং, যেই ও ওর মাথা গুঁজল সেই ভয়ঙ্কর কোটরে,
যেই ও ধীরে থামল, ওর কাঁধে সর্পিল আয়েস মাখিয়ে, আর আরও ভিতরে সেঁধিয়ে গেল
এক ধরনের ভয়, এক ধরনের প্রতিবাদ – ওই ভয়ঙ্কর অন্ধকার কোটরে ওর প্রস্থানের বিরুদ্ধে,
সুচিন্তিত ভাবে অন্ধকারে ঢুকে পড়ে তারপর নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে –
আমাকে অভিভূত করল, যেই ওর পিঠ আমার দিকে ফিরল

আমি নামিয়ে রাখলাম আমার হাতের পাত্র, আমি ঘুরে দেখলাম,
আমি তুলে নিলাম একটা বেকায়দা চ্যালাকাঠ
আর সেটা ছুঁড়লাম জলাধারের দিকে সশব্দে

আমার মনে হয় তাতে ওর আঘাত লাগেনি
কিন্তু হঠাত ওর পিছিয়ে পড়া অংশটা এক অশালীন ব্যস্ততায় আন্দোলিত হল
মোচড় খেল বিদ্যুতের মত, আর তারপর মিলিয়ে গেল
সেই অন্ধকার কোটরে, আমার দেয়ালের গায়ে মেটে-ঠোঁটের মত ফাটলে
যা দেখে, সেই প্রখর স্তব্ধ দুপুরে, আমি চেয়ে রইলাম এক বিমুগ্ধ আকর্ষণে

আর সেই মুহূর্তেই আমার অনুতাপ হল
মনে হল আচরণটা কী সামান্য, কী অশোভন, কী ইতরই না ছিল
আমি ঘৃণা করলাম নিজেকে, আর আমার অভিশপ্ত মানুষী শিক্ষাদীক্ষার স্বরকে

আর আমার মনে পড়ল সেই সমুদ্রের পাখির কথা
আর আমি চাইলাম যে ও – আমার সাপ – ফিরে আসুক

কারণ, আমার আবার মনে হল যে ও রাজসিক
নির্বাসিত রাজা সম, অধোভুবনে মুকুটহীন
যার এখন আবার অভিষিক্ত হওয়ার সময় হয়েছে

আর, তাই আমি সুযোগ হারালাম জীবের প্রভুদের একজনের সাহচর্যের
এবং, আমায় খেসারৎ দিতে হবে কিছুর;
এক ক্ষুদ্র মানসিকতার |


(অনুবাদ - D. H. Lawrence, "Snake")

-------------------------------------
© ইন্দ্রনীর – ০৯ এপ্রিল ২০১৬

শুক্রবার, ২৫ মার্চ, ২০১৬

প্ল্যটনিক সন্নিধান



|| প্ল্যটনিক সন্নিধান ||

ঘটনাটা নয় নতুন, না আহামরি
প্রায়ই শুনি, “এই রে ! কী করি ?
কী হবে ? একদম গেছি ভুলে !”
বোনা থামিয়ে নিভা উল খোলে
বুঝি নিভার দিশা হীন দৃষ্টি হতে
ভুলে গেছে নিভা ঘর ফেলতে !

চিরকালই নিভারা ঘর তুলে যায়
সোজা বুনে যায় কাঁটায়, কাঁটায়
গোলাপি উলে গোলাপের নক্সা
ঘরে ঘর মেলে, বুনট হয় একসা
কিন্তু এক মুহূর্তে ঠিক ভুলে যায়
যে সময় এলে ঘর ফেলতে হয়

সেই ভুলেই কারাবন্দী হয়ে থাকি
কাঁটায়, গোলাপে অসহ্য একাকী
নিভার কোলের ওমে উত্তপ্ত উলে
চেষ্টা করি থাকতে স্বাধীনতা ভুলে
এক ভাই-বোন প্ল্যটনিক সন্নিধানে
সে বুনে যায়, খোলে আবার বোনে ||

© ইন্দ্রনীর / ২৪ মার্চ ২০১৬

বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০১৬

হোলি

|| হোলি ||


তোমার সঙ্গে আমি খেলি নি, খেলি না হোলি
তাও কী করে লেগেছে এত রং, শোন তা বলি

আবির উড়িয়ে পথের ধুলোয় তুমি নাচো গর্বে   
না জেনে, যার বুকে পা সে অকারণে জ্বলবে
হাতে যার পিচকারী, জানো না সে অন্য কৃষ্ণ
তার কুমকুম রং তরল, তার উত্তাল হৃদয় উষ্ণ
রঙের ধূম্রজালে রামধনু আঁকে সে একা একা
কী যায় আসে তার, তোমার সিঁদুর তো পাকা
সে দেখে আবিরে চিকচিকে খুদে অভ্রের কণা
জানে তুমি খেলবেই, কিছুতে করবে না মানা
জানে সে মুখ থেকে মুছে দিয়ে সব প্রণয়ের রং
তার রাঙা হাতের মঞ্জনে করবে আহরণ শিহরণ

আমি দেখে এই সব হই বিপর্যস্ত হতে পর্যদুস্ত
মুখ ঢাকি আনকোরা হাতের তালু করে প্রশস্ত
পরে দেখি আয়নায় ভীরু দুর্বল কাপুরুষ চিতে
মুখে লেগেছে কত রং, যত তুমি পার নি দিতে ||


-----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ মার্চ ২০১৬

বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

চুরি

|| চুরি ||

তোমাকে নিয়ে আমার দেহ মোহ ঘোর শর্বরী
ভোর যতক্ষণ হয় না, কাটে না তার খোয়ারি
কে বলেছিল ঘুমাতে খুলে রেখে সপাট দোর
কোথায় লুকাবে বলো নিশুতি রাতের চোর ?

খোলা ছিল তোমার সব কিছু, ছড়াচ্ছিল ঘ্রাণ
ভ্রূণ ভঙ্গিমার ভাঁজে শিথিল শরীরের আহ্বান
হাসনুহানা, কি শিউলি, কে ছিল আমার সাথী
দু’জনে দৃষ্টিহীন, আঁধারে লুটেরা দুই অতিথি

কী ছিল তিথি, অমাবস্যা, একাদশী, না পূর্ণিমা
মোহের কুণ্ডে বিসর্জিত ছিল তোমায় প্রতিমা
তোলপাড় তোমার শরীরে শুধু নিশ্বাসের ঢেউ
সাক্ষী একটাও রাখি নি, দেখে নি চুরিটা কেউ

পূব আকাশে লজ্জার লালিমা, উঠছে সোনা সূর্য
প্রকাশ্যে দিবালোকে পালাবো, তাই ধরেছি ধৈর্য
শর্বরী, তুমি ঘুমিয়ে থাকো, বিশৃঙ্খল রাখো অঙ্গ
কী ক্ষতি যদি এই ভাবে চুরাই তোমার অনুষঙ্গ ?

প্রমাণ হিসাবে হাতিয়েছি শুধু তোমার চুলের কাঁটা
খোলাচুলে ঝুলবারান্দায় এসো, যখন বাজবে নটা
আমি যাব নিচের পথে, পকেটে মনিহারী দোকান
শুনিও, “এই যে ... দুটো চুলের কাঁটা দিয়ে যান |”

------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৭ মার্চ ২০১৬

মঙ্গলবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

খাপ

|| খাপ ||


অভি প্রতিভাকে জিজ্ঞাসা করল, “সোমাকে দেখছি না |” প্রতিভা বলল, “সোমা রাজেশকে নিয়ে একটু বেরিয়েছে |” অভি ভুরু কুঁচকে বলল, “কাল মেয়েটার বিয়ে, আর আজ ছেলেবন্ধুকে নিয়ে বেরিয়েছে ?”  প্রতিভাও একটু বিরক্তির স্বরে বলল, “জানি না ... ওদের মধ্যে যে কী আছে | আজ কত বছর হয়ে গেল, এখনও একজন আরেকজনকে ছাড়তে পারে না | রোজ ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা | তারপরে ফেসবুক, চ্যাট, এসএমএস ... কী না !”
অভি – “কোথায় গেছে কিছু বলে গেছে ?”
প্রতিভা – “সোমা বলল রাজেশকে পার্কটা দেখিয়ে দেবে |”
 

ঘড়িতে এখন দুপুর তিনটে |
 
অভি – “পার্ক ? এই ভর দুপুরে ? তোমার কি মনে হয় ওদের মধ্যে কিছু ... ?”
প্রতিভা – “না, তা মনে হয় না | সোমা তো আমার সামনেই ওর সাথে ফোনে বকবক করে | তেমন তো কোনও লুকিয়ে কথা বলার ইচ্ছা, বা কোনও আড়ষ্টতা দেখি না ওর মধ্যে | এই যা, ছেলেটা সোমাকে খুব মানে | ওর কোনও ঝামেলা হলেই সোমাকে সেটা জানাবে, আর জিজ্ঞাসা করবে, ‘বল, এখন কী করি ?’ তারপর সোমা যা বলবে তাই করবে | এত বাধ্য ছেলে আমি দেখি নি |”
অভি – “কী রকম ঝামেলা ? কই আমি তো কিছু জানি না | ছেলেটা তো বেশ গোবদা-গাবদা | সারাদিন মুড়ি-মিছরির মত ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে খাচ্ছে | মনে হয় কিছু হেলথ প্রবলেম আছে | কিন্তু, এছাড়া ওর কিছু সমস্যা আছে বলে তো মনে হয় নি | তুমি জানলে কী করে ?”
প্রতিভা – “তুমি বাড়িতে থাকলে তো জানবে | এই তো দু মাস আগে রাকেশ ফোন করল, ওর ছোট বোন – বছর খানেকও হয় নি বিয়ে হয়েছে – বাড়ি ফিরে এসেছে | স্বামীর সাথে মানিয়ে নিতে পারে নি | রাকেশ ফোন করে বলল, ‘সোমা, বল তো এখন কী করি ? আমার তো মনে হচ্ছে সিম্মিকে (বোনের নাম) গলা ধাক্কা দিয়ে বরের কাছে ফেরত পাঠাই |’ সোমা ওকে খুব বকলো প্রথমে, তারপরে অনেক বোঝালো | এখন ভাই বোন দিব্যি আছে |”
অভি – “হ্যাঁ, রাকেশ কিছু একটা বলছিল, ওর বোনের সম্বন্ধে | মেয়েটা বোধহয় লেখাপড়া করা | এমএ না কী পাশ করেছে | বলছিল, বোনকে ওর আর ওর বাবার ব্যবসায়ে পার্টনার করে নেবে ... এই রকম কিছু একটা |”
প্রতিভা – “আমার কেন জানি না মনে হয় ছেলেটার বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কম |”
অভি – “কম ? কেন ?”
প্রতিভা – “ওই যে ... কেমন দুম করে ব্যাঙ্গালোরের অত ভালো চাকরিটা ছেড়ে বাড়িতে চলে এলো | এখন কোন চাকরি নেই | বাপের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে, আর বাপের টাকায় কী সব বিজনেস করার কথা ভাবছে | সোমা বলে ওর কোনও আইডিয়াই নেই | বাপের সব টাকা নষ্ট করবে ... সোমার কী যে দরকার ছিল, ছেলেটার চাকরি বাকরি কিছু নেই – তাকে বিয়েতে আসতে বলার | এসেই ও বলেছে ও যে উপহারটা দেবে সেটা তেমন কিছু দামী নয় |”

সোমার সাথে রাকেশের আলাপ নর্থ-বেঙ্গলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে | সোমা অঙ্ক বুঝতে পারত না | ক্যালকুলাস নিয়ে একটা বিরাট সমস্যা ছিল | তখন ক্লাসে রাকেশের পাশে বসতে শুরু করে, কেন না রাকেশ ক্লাসে কোন পরীক্ষা হলে টুক করে পেপার লেখা শেষ করে জমা দিয়ে সিগারেট খেতে চলে যেত | সেই অঙ্ক দেখানো থেকে দুজনের বন্ধুত্ব | সোমা দ্বিতীয়-বর্ষে কলেজ ছেড়ে চলে এলেও রাকেশের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল | তারপর আট বছর কেটে গেছে | একসময় প্রতিভার মনে অনেক আশংকা দেখা দিয়েছে | কিন্তু সোমা হেসে বলেছে, “মা, রাকেশ খাঁটি পাঞ্জাবি | ও পাঞ্জাবি ছাড়া বিয়ে করবে না | আর আমারও ওর প্রতি কোন দুর্বলতা নেই | ও শুধু আমার বন্ধু মাত্র | কাজেই তুমি চিন্তা কোর না | দেখেছো তো ওকে আমি ভাইয়া বলে রাগাই |”

পার্কের বেঞ্চে বসে পড়ে কপাল থেকে ঘাম মুছে সোমা বলল, “বল, কী বলবি বলে কাল থেকে মাথা খারাপ করছিস ?” রাকেশ একটু অন্যমনস্ক হয়ে (নর্থ-বেঙ্গলে চার বছর থেকে শেখা পরিষ্কার বাংলায়) বলল, “তুই আমাকে তোর বিয়েতে কেন ডেকেছিস ?”
সোমা, অবাক হয়ে, “মানে ? আমার বিয়েতে তোকে ডাকব না তো কাকে ডাকব ?”
রাকেশ – “কাজটা কী ঠিক করলি ? কাকু, কাকিমা কী ভাবছে ? নিশ্চয় ভাবছে যে কেন এক ডাকে ছেলেটা ইন্দোর থেকে ছুটে এলো, তাও সারাটা পথ বিনা রিজার্ভেশনে, ট্রেনে |”
সোমা – “বা রে ! আমার বিয়েতে তুই আসবি না ? আচ্ছা, আমি যদি উল্টো প্রশ্ন করি, আমি ডেকেছি তো কী হয়েছে, তুই এত কষ্ট করে এত দূরে ছুটে এলি কেন ?”
রাকেশ – “শুধু একটা কথা জানতে |”
সোমা – “কী কথা ? ফোনে কেন জানতে চাইলি না ?”
রাকেশ – “এই জন্য যে হয়ত তুই উত্তর দিবি না ... এড়িয়ে যাবি | আর তাহলে আমার আর কোনও উপায় থাকবে না |”
সোমা – “কিসের উপায় ? কী তুই এত হেঁয়ালি করে কথা বলছিস ? এই জন্যই কি এই ভর দুপুরে পার্ক দেখতে চাইলি ?”
রাকেশ – “না | ভর দুপুরে পার্কে আসতে চাইলাম, কারণ আমি চাই একটু নিরিবিলিতে তোর সাথে কথা বলতে | আমি চাই দরকার হলে তোর উপরে জোর খাটাতে |”
সোমা – “জোর ? কিসের জোর ?”
রাকেশ হাতের হাতব্যাগটা থেকে খবরের কাগজে মোড়া একটা কিছু বের করে কাগজটা ছাড়িয়ে দেখালো, আর বলল, “এর জোর |”
সোমা অবাক হয়ে দেখল, একটা ছুরি, হাতলে কারুকার্য করা, সম্ভবত হাতির দাঁতের | সুন্দর দেখতে ছুরিটা | ফলাটা বেশ লম্বা – তার দুদিকই ধারালো | সোমা বলল, “বাহ | কোথায় পেলি এটা ?”
রাকেশ – “এটা একবার নেপাল গিয়েছিলাম
, তখন | যখন কিনেছিলাম, তোকে বলি নি | কেন না ....”
সোমা – “বলিস নি | তুই কি যাই কিনিস আমাকে জানাস ?”
রাকেশ – “না তা করি না | তবে এই ছুরিটা তোকে উপলক্ষ করে কিনেছিলাম ... তাই বলছিলাম |”
সোমা – “ওহ, হেঁয়ালির পর হেঁয়ালি ! দে, আমার জন্যেই এনেছিস তো আমায় দে |”
রাকেশ –“সাবধান ! হাত কেটে যেতে পারে ... দাঁড়া একটু | একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আছে | আগে তার উত্তরটা জেনে নিই | তারপর ছুরিটা হয় আমার কাছে থাকবে, নয় তোর কাছে যাবে |”
সোমা –“তার আগে বল, ছুরিটার খাপ নেই, আর তুই ওটাকে হাতব্যাগে নিয়ে রেখেছিস | যদি ব্যাগে হাত ঢোকাতে গিয়ে হাত কেটে যায় ?”
রাকেশ – “না, না, ছুরিটা এতক্ষণ আমার স্যুটকেসে ছিল | এখন নিয়ে এসেছি |”
সোমা – “এখানে কেন নিয়ে এসেছিস ?”
রাকেশ – “একটা নিষ্পত্তি করতে |”
সোমা – “কিসের নিষ্পত্তি ?”
রাকেশ – “এই যে ... না ! আগে শোন – একটা প্রশ্ন করব | যা উত্তর দিবি ভেবে চিনতে দিবি | আই’ম ভেরি সিরিয়াস | এটা একটা জীবন মরণের প্রশ্ন আমার কাছে | হয়ত তোরও |”
সোমা – “আমার জীবন মরণের প্রশ্ন ? কী ভাবে ? ও ! ভয় দেখাচ্ছিস ! সেই জন্যে এই ছুরিটা এনেছিস ? নাহ, তোকে নিয়ে আর পারি না | নে, চট করে প্রশ্নটা করে নে |”

রাকেশ একটু চুপ করে থেকে বলল, “জানিস এই ছুরিটার ফলাটা ফাঁপা ... মানে এর ফলাটা হল আসলে দুটো ধার-জোড়া দেয়া পাতলা পাতলা ফলা, দুটোই বাইরের দিকে একটু ফোলা | ছুরিটার ছুঁচলো আগাটায় একটা সূক্ষ্ম ফুটো আছে | সেই ফুটো দিয়ে যাকে মারা হবে তার শরীরের রক্ত ওই ফাঁপা ফলাটার ভিতর টেনে নেয়া যায় | মানে, ছুরিটা এমন ভাবে তৈরি করার উদ্দেশ্যেই তাই | এর হাতলে একটা কায়দা আছে | হাতলটার মাথায় একটা বোতাম মত আছে | এই দেখ |” রাকেশ দেখালো ছুরিটার হাতলের মাথায় একটা বোতাম – অনেকটা রান্নাঘরের গ্যাস লাইটারের মাথায় যেমন থাকে | রাকেশ বলল, “ধর, যদি আমি এই ছুরিটা তোর বুকে ঢুকিয়ে দিয়ে এই বোতামটা বার কয়েক টিপে ছেড়ে দিই, তাহলে ছুরিটার ফলার ভিতরটা তোর রক্তে ভরে যাবে |”

একটা অস্বস্তিতে গলাটা ধরে এলেও, সোমা নীরস গলায় বলল, “কী করবি সেই রক্ত দিয়ে ?” প্রশ্নটা শুনে খানিকক্ষণ একটু বোকার মত মুখ করে থেকে রাকেশ হটাত হা হা করে হেসে উঠল | তারপর বলল, “জানি না | তবে আমাকে এই ছুরিটা যে বিক্রি করেছিল সে বলেছিল, আগেকার দিনে শত্রুকে মেরে তার রক্ত দিয়ে মা কালীর পুজো করার চল ছিল নাকি | আবার অনেক সময় কোন মেয়েছেলের সাথে কেউ খারাপ কাজ করলে, তার দাদা, ভাই কি স্বামী সেই অপরাধী কে মেরে তার রক্ত নিয়ে গিয়ে বোন বা স্ত্রীকে দেখাত – সর্ট অফ লাইক এ প্রুফ – বুঝেছিস | তুই তো জানিস এমনিতে খোলা হাওয়ায় রক্ত চট করে জমে যায় | কিন্তু, এই ছুরি দিয়ে শুষে নেয়া রক্ত নাকি অনেকদিন তরল থাকে |”
সোমা –“বুঝলাম | কিন্তু, কারো ব্যবহার করা ছুরি তুই কিনলি কেন ? সেও আমার জন্য ...”
রাকেশ –“কে বলল ছুরিটা ব্যবহার করা ? আর আমি কখন বললাম তোর জন্য ছুরিটা কেনা ? আমি বললাম যে তোকে উপলক্ষ করে ছুরিটা কেনা ... কিন্তু এখন একটা মুশকিল হয়েছে |”
সোমা –“আবার মুশকিল ? কী মুশকিল ?”
রাকেশ –“ভাবছি, তোকে কী দেব তোর বিয়ের উপহার হিসাবে ?”
সোমা –“না বাবা, আর যাই দিস এই খাপ খোলা ছুরিটা আমায় দিস না | এবার, নে, চট করে প্রশ্নটা কর, যা করতে চাস |”
রাকেশ –“আমি ... আমি জানতে চাই, আমাদের দু’জনের মধ্যে যা ছিল, যা আছে ... সেটা কী ? মানে, আমাদের সম্পর্কটা কী ?”
সোমা –“কী আজেবাজে প্রশ্ন করছিস তুই ! তুই আমার বন্ধু, আমি তোর বন্ধু | ব্যাস !”
উত্তরটা শুনে রাকেশ একটু থতমত খেয়ে অন্যদিকে তাকালো | তারপর, ছুরিটার ছুঁচলো আগাটা বাঁ হাতের মণিবন্ধে শিরার উপর চেপে ধরল | সোমা চমকে দেখল সেখানে এক বিন্দু রক্তের ফোঁটা দেখা দিয়ে আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করল | তারপর অদ্ভুত ভাবে সেটা ছোট হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, যেন ছুরির ফলাটা রক্তটা শুষে নিলো | সোমা ব্যাকুল হয়ে রমেশের ছুরি ধরা ডান হাতটা টেনে সরাতে সরাতে বলল, “রাকেশ এ কী করছিস ?”
রাকেশ –“আগে তুই সত্যি উত্তরটা বল |”
সোমা হার মেনে সরে যাওয়ার ভঙ্গিতে নিজের হাত দুটো গুটিয়ে বলল, “থাক না | আমার ছুরিটা না হয় খাপে বন্ধ থাক |”


-----------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬