মঙ্গলবার, ৩১ মে, ২০১৬

পরাণকালী

|| পরাণকালী ||

হটাতই দেখা হয়ে গেল ভবতোষের সাথে । মুচিপাড়ায় গিয়েছিলাম ইলেকট্রিকের বিল জমা দিতে । ফিরে আসছি, বড় রাস্তায় বাস ধরব বলে । সামনে দেখলাম একটা আদুড় গায়ে ছেলে, কোমরে ঘুনসিতে কড়ি বাঁধা, একটা বুড়ো মানুষের পিছন পিছন চলেছে, হাতে এলুমিনিয়ামের বাটি । যদিও মনে হল না ও কিছু চাইছে, তবুও বুড়ো মানুষটা থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বন্ধ ছাতাটা উঁচিয়ে ছেলেটাকে মারার ভয় দেখাচ্ছে । ছেলেটা থমকে দাঁড়িয়ে থেকে একটু পরে আবার বুড়ো মানুষটার পিছু নিচ্ছে । ওই ছাতা উঁচানো ভঙ্গি দেখে মজা লাগলে কিছু একটা কথা পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ল না । বাস স্ট্যান্ডে যখন পৌঁছলাম, বুড়োটা দেখি দুই হাঁটুর মাঝে ছাতাটা ধরে ধুতির কোঁচা তুলে মুখের ঘাম মুছছে । ব্যাস, মনে পড়ে গেল স্কুলের সহপাঠী ভবতোষের কথা । কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা, কি শীত – ভবতোষ স্কুলে ছাতা আনতো । পাছে আমরা ওটা লুকিয়ে ফেলি, ও ছাতাটা সব সময় আঁকড়ে থাকত । মাঝে মাঝে আমাদের ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে হাত তালি দিতে দুই হাঁটুর মাঝে ছাতাটা চেপে ধরত । আর বেশি বিরক্ত করলে, ঠিক এই ভাবে ছাতা উঁচিয়ে আমাদের মারবার ভয় দেখাতো ।

বুড়োটা ঘাম মুছে কোঁচা ছেড়ে আমার দিকে তাকাল | অবাক হয়ে, 'আরে ওই বাচ্চাটা হটাত করে বুড়ো হয়ে গেল কী করে ?' এইরকম মুখের ভাব করে ঘুরে ফিরে দেখল, না বাচ্চাটা ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে । বিরক্ত হয়ে বাচ্চাটাকে বলল, “এই যা পালা । ওই দ্যাখ বাস আসছে । আমি উঠে গেলে তুই কী করবি ? হ্যাঁ ?” বাচ্চাটা বুড়োটার দিকে ছদ্ম অভিমানের চোখে দেখল | যেন ওকে বলল, ‘কেন ? তুমি আমার ভাড়াটা দিলেই তো হয় ! চল না, সাথে নিয়ে, দাদু !’

“ওফ, কী জ্বালাতন রে বাবা ... দেখছেন আপনি, কী আপদ জুটেছে ?” বলে ভবতোষ আমার মুখের দিকে তাকিয়েই, ভ্রু কুঁচকে, চালশে চোখ দুটো ছোট করে বলল, “মহাদেব না ? হটাত কোথা থেকে উদয় হলি ?” আমি হেসে বললাম, “আমি তোর পিছন পিছন আসছিলাম । তুই ছাতা দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছিলি, তাই লক্ষ্য করিস নি ।” “মাছি ?”, বলে ও অবাক হয়েই হেসে ফেলল | বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস । এক এক দিনে এক এক জ্বালা !” “কিসের জ্বালা ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম । কথাটা যেন শুনতে পায় নি সেই ভাবে ভবতোষ বলল, “তা, এদিকে কোথায় এসেছিলি ? থাকিসই বা কোথায় । বাস ধরবি মানে দূরে কোথাও থাকিস নিশ্চয় ?” আমি বললাম, “থাকি ঘোষপাড়ায় । এসেছিলাম ইলেকট্রিকের বিল দিতে । তুইও তো এখানে থাকিস না । কোনও কাজে এসেছিলি ?” ভবতোষ আমার প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে বলল, “ওই তো বাস । আমিও যাব ওই বাসে । স্টেশনে নেমে মদনগোলা প্যাসেঞ্জার ধরব । ওখানেই আছি গত দু’বছর ।”

স্কুল ছেড়ে আমি সায়েন্স কলেজে গেলাম, আর ভবতোষ গেল বি-কম পড়তে । একটু আধটু যা দেখা সাক্ষাত হত বিয়ের আগে, বিয়ের পর আমি কলকাতায় গেলে আর তাও বজায় থাকে নি । তবে মাঝে মাঝে একটু আধটু এর ওর কাছ থেকে খবর পেতাম । শুনেছিলাম ব্যাঙ্কে যোগ দিয়ে বিয়ে করেছিল । ছেলের শখ ছিল, কিন্তু পর তিন তিনটে মেয়ে হয় । বেচারার প্রথম মেয়ের বিয়ে দেয়ার পর নাকি প্রায়ই বাপের বাড়ি ফিরে আসত । বলত স্বামী পছন্দ হয় নি । তারপর একদিন কারো সাথে উধাও হয়ে যায় । দ্বিতীয় মেয়েটা বছর তিরিশ বয়সে বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মারা যায় । আর তৃতীয় মেয়েটা মাধ্যমিকে ফেল করে প্রেম ট্রেম করে | তাতেও ফেল করে বিষ খায় । প্রত্যেকবার খারাপ খবর শুনে মনে হয়েছে একবার গিয়ে দেখা করে আসি । হয়েই ওঠেনি । শেষ দেখা একবার কলকাতা থেকে ফেরার ট্রেনে – সেও তো বছর তিন চার হবে । সেই চেহারা আর এখন নেই | এখন ভবতোষ যেন একটা আধ পোড়া চেলা কাঠ |

বাসে উঠে ফাঁকা সিট পেয়ে একসাথে বসে দুজনের দুটো টিকিট কেটে ফেললাম । স্টেশনটা পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিট | কিন্তু রাস্তাটা রেললাইনের এপার ধরে লেভেল ক্রসিং পার করে স্টেশনে ফিরে এসেছে লাইনের ওপার ধরে । তাই বাসে পরের পরের স্টপ । আমাকেও স্টেশনে নামতে দেখে ভবতোষ অবাক হয়ে বলল, “তুই যে বললি ঘোষপাড়ায় থাকিস ।” বললাম, “চল, তোর সাথে কত বছর পরে দেখা । আমি তো তোর মুখ দেখে চিনতেই পারতাম না, যদি না তোর ওই ছাতা ধরা মুদ্রাটা দেখতাম ।“ ভবতোষ একগাল হাসল | বললাম, “মদনগোলার গাড়ি তো যা জানি, ঘণ্টা দু'ঘণ্টায় আসে | চল, তাহলে ততক্ষণ তোর সাথে গল্প করে নিই |” “ কিন্তু, তোর ফ্যামিলি, মানে মিসেস ?”, ভবতোষ জানতে চাইল, “তোর দেরী দেখে চিন্তা করবে না ?” বললাম, “না, সে পাট চুকে । বউ সগ্গে গেছে এক বছর আগে । ছেলে কলকাতায়, মাঝে মধ্যে আসে । সারা সময় একাই থাকি । তোর খবর বল । এখানে মুচিপাড়ায় কার কাছে এসেছিলি ?”

ভবতোষ ছাতাটা মাটিতে ঠেকিয়ে হাতলটা দু হাতে ধরে আকাশের দিকে মুখ তুলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তার মানে, আমাদের সেই স্কুল থেকে এক যাত্রায় এই একটা ফল অন্তত পৃথক হয় নি, তাই না ? আমারও গিন্নি গত বছর বিদায় নিয়েছে ।”

বুঝলাম, ভবতোষ বোধহয় বলতে চায় না কী কাজে এসেছিল । না বলবে, না বলুক । প্রসঙ্গ বদল করতে বললাম, “তোর এই ‘সম্বৎসর’ ছাতা বয়ে বেড়ানোর অভ্যাসটা কিন্তু রয়ে গেছে ।” ভবতোষ বলল, “আর বলিস না । এখন রোদ বিষ্টি তেমন গায়ে লাগে না | তার থেকে অনেক বেশি অন্য সব আপদ বিপদ, পদে পদে । কোথাও বিড়াল, কোথাও বাছুর, কোথাও কুকুর, এমন কি ভিখিরি বাচ্চা অব্দি আমাকে পথে ঘাটে নিস্তার দেয় না ।”

প্ল্যাটফর্মে ঢুকে আমাকে একটা বেঞ্চ দেখিয়ে বসতে বলে ভবতোষ টিকিট কাটতে চলে গেল । ফিরে এসে আমাকে দূরে একটা বাচ্চা দেখিয়ে বলল, “কাণ্ডটা দেখ । কী ভাবে পা ঝুলিয়ে বসে আছে । এইসব বাচ্চাদের মায়েরা কী করে যে ওদের ছেড়ে দেয় ।” দেখলাম একটু দূরে ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে একটা ছোট ছেলে একটা বাটি থেকে কিছু খাচ্ছে । আমি বললাম, “ওর মায়ের মত কাউকে তো দেখছি না ধারে কাছে ।” ভবতোষ বলল, “আরে, ওই সব মায়েদের কী – একটা বাচ্চা গেলে আরেকটা পেতে কোনও অসুবিধা তো হয় না । আমাদেরই যত ঝামেলা ... আমার গুলোর কথা তো শুনেছিস নিশ্চয় । তিন তিনটে চলে গেল, ধরে রাখতে পারলাম না । ঠাকুর কে যে কত ডেকেছি ।”

আমি বললাম, “ঠাকুর ! ঠাকুর কী করবে ? মরা মানুষ ফিরিয়ে দেবে ?”

ভবতোষ বলল, “প্রশ্নটা জানি | তুই হয়তো উত্তরটাও জানিস তাই ঠাকুর দেবতা মানিস না । কিন্তু আমি মানি । বৌটা মারা যাওয়ার পর থেকে একে তো চরম একা হয়ে পড়েছি, তার উপর হাতে অঢেল অচল সময় । আকছার বসে বসে ঠাকুরকে ডাকি - একটা কারো সঙ্গ দাও । এত একা কী থাকা যায় ?”

আমি প্রশ্রয় না দিলে ভবতোষ বলল, “তুই জানিস না, বৌটা মারা যাওয়ার পর বাড়িটা আমার কী ভাবে ফাঁকা হয়ে গেল । একটা দুধ-গরু ছিল । তার সদ্য বাছুরটা কোথায় কী খেয়ে পেট ফুলে মারা গেল । তার দুঃখেই কিনা জানি না, গরুটা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল । সারাদিন অস্থির হয়ে চোখ পাকিয়ে পা দাপাত, আর চোখের জল বের হাম্বা হাম্বা করত । তারপর একদিন দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে গেল । বউয়ের পোষা বিড়ালটা বয়েস হয়ে খুব মোটা হয়ে গিয়েছিল । একদিন কার্নিশে পায়রা ধরতে গিয়ে পড়ে মারা গেল । চোখে কম দেখত হয়তো । শেষে বাড়ির কুকুরটা, ছোট ছানা ছিল যখন আমি মুঠোয় করে ঘরে এনেছিলাম, সেও মারা গেল ।”

ভবতোষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম । মনে হল এখন আর পুরানো কথার কোন মানে হয় না । ভবতোষের পক্ষে অতীত দুঃসহ । ও এখন বর্তমানে থাকতে চায় ।

স্টেশনের ঘণ্টা বাজিয়ে জানালো গাড়ি আসছে । ভবতোষ উঠলো । দেখলাম দূরে বাচ্চাটা তখনও প্ল্যাটফর্মের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে । ট্রেন আসছে সে হুঁশ নেই, না তার, না তার মায়ের । “আশ্চর্য !” বলল ভবতোষ । তারপর আমার চোখে সোজা তাকিয়ে বলল, “তুই জিজ্ঞাসা করছিলি আমি মুচিপাড়ায় কোথায় গিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম তুই নাস্তিক, তোকে বলে কি হবে ? কিন্তু শোন । গিয়েছিলাম ওখানে পরাণকালী মায়ের মন্দিরে । মাঝে মধ্যেই যাই । তুই যাস কি ?” আমি মাথা ঝাঁকালাম । বললাম, “শুনেছি মা নাকি জাগ্রত । আমার বউ যেত ।”

ভবতোষ মাথা নাড়ল, অনেকক্ষণ, নিজের মনে, তালে বেতালে ।

তারপর বলল, “আমিও শুনেছি । তাই মায়ের কাছে মানত করেছি । বলেছি, মা আমার এই একা জীবন এবার শেষ করো । হয় আমাকে নাও, নইলে আমাকে কারো সঙ্গ দাও – যার সাথে থাকলে একটু কম একা লাগবে ।” আমি বললাম, “তোর আত্মীয় স্বজন ?” “ধ্যুত, যত্ত সব স্বার্থপরের দল ।” তিড়বিড় করে জ্বলে উঠল ভবতোষ । তারপর হাতের ছাতাটা একটু উঁচিয়ে ভাঁড়ের মত বলল, “যতদিন আমার হাতে এই অস্ত্র আছে, কাউকে ঘেঁষতে দেব না মোর ধারে কাছে ।” আমি থাকতে না পেরে হেসে ফেলে বললাম, “যেমন বাস স্ট্যান্ডের বাচ্চাটা ?” ভবতোষ বলল, “আর বলিস না ... জানি না আমার মধ্যে কী যে আকর্ষণ আছে । ওই মন্দির থেকে বেরিয়ে এক একদিন এক এক কাণ্ড হয় । একদিন একটা বাছুর আমার পিছু নিলো । নাছোড়বান্দা । ছাতা দেখিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টায় কোন কাজ হল না । এই রকমই আরেকদিন একটা বেওয়ারিশ ছাগল ছানা । ম্যাঁ, ম্যাঁ করে আমায় ডেকে অস্থির | একদিন একটা ছোট্ট বিড়ালছানা মিউ মিউ করে আমার পায়ে গা ঘষে একাকার করল । এমন কি একদিন একটা পায়রাও হেঁটেছে আমার পিছন পিছন, গুটি গুটি পায়ে । ওই ভয়ে আজ আমি বাস ধরলাম | নইলে আমি স্টেশন হেঁটেই আসি |”

হা হা করে হেসে উঠে ভবতোষ বলল, “জানিস, আজ আমি মন্দিরে মাকে প্রণাম করে বললাম, 'জানি না মা, তোমার মনে কী আছে । তুমি আমাকে এই সব কেন দিচ্ছ ? ভালো কিছু নেই কি তোমার কাছে ?' কথাগুলো মনে মনে ক’বার বলে মন্দির থেকে বেরোতেই ব্যাস, ওই বাচ্চা ছেলেটা পিছন পিছন আসতে শুরু করল ।” আমি বললাম, “দুটো পয়সা দিয়ে দিলেই চলে যেত ।” “বের করেছিলাম তো একটা টাকা, ওকে দিতে”, ভবতোষ বলল, “তা এমন বেয়াড়া ছেলে, টাকাটা দেখে পিছন ফিরে মা বলে চিৎকার করে ডাকল । দেখি দূরে একটা গরিব মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে । সে আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, 'এমনিই নিয়ে যাও বাবা, ছেলেটাকে । তোমার কাজে দেবে ।' বোঝ, আবদার !”

হুট করে ট্রেনটা 'পোওওওঙ .. পোওওওঙ' করে হল্লা করতে করতে এসে স্টেশনে ঢুকে পড়তেই দুজনে তাকালাম । প্ল্যাটফর্মটা এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা । ছেলেটা কখন সরে গিয়েছে ।

কই না তো ! ওই তো, বাচ্চাটা ভবতোষের দিকে এগিয়ে আসছে । অন্তত, আমার তাই মনে হল । ওর হাতে একটা বাটি । আর কোমরে সকালের বাস স্ট্যান্ডের বাচ্চাটার মতই ঘুনসিতে কড়ি বাঁধা । দূরে একটা গরিব বউ দাঁড়িয়ে দেখছে মুখে আশার হাসি ফুটিয়ে |

বৌয়ের কথা মনে পড়ল | বলত ভক্তদের নাকি মা নানান রূপে দেখা দেয় ।
 

------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩১ মে ২০১৬

রবিবার, ২৯ মে, ২০১৬

ওথেলোর একালাপ

|| ওথেলোর একালাপ ||

সকালে ঘুম ভাঙ্গার মুখে তোর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম | স্নান সেরে শাড়ি কাপড় পরে এলো চুলে রোদে দাঁড়িয়ে চুল শুকচ্ছিস | রোদ দেখে মনে হল শীতের রোদ – যদিও ছবিটা সাদায় কালোয় | বয়েস তোর আন্দাজ আটাশ – কি তিরিশ | কোমর, কাপড়ের কুঁচি বাদ দিলেও, “ঈষৎ স্ফীত” | ছবিটা কী তোর জন্মের পর, না কী তুই জন্ম দেয়ার পর ? ভাবতে ভাবতে বুঝলাম গুলিয়ে ফেলেছি – তোর কথা ভাবছি তোকে মাতৃত্বের রূপে স্বপ্নে দেখে | তুই, তোর মা, সব আজকাল গুলিয়ে যায় |

মাঝে মাঝে তোর ছবিগুলো বার করে দেখি | কোথায় রেখেছি ছবিগুলো, কবে শেষ দেখেছি মনে নেই | তবে চোখ বুজলেই একটা বড় বাক্স হাতে পাই | তার ভিতরে থরে থরে ছবি সাজানো – তোর, আমার, আমাদের মায়েদের, আমাদের বাবাদের, আরও কত কার কার ছবি আছে | তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে তোর ছোটবেলার ছবি – পুতুলের মত ; তোর একটু বড় হয়ে ছবি – ডাগর চোখ, ফ্রকের তলায় লম্বা পা, আর ঠোঁটে একটা – তখনই ফুটছে – সেই হৃদয়সমুদ্র মন্থন করার ঠোঁট টেপা মৃদু, মিষ্টি, আলগোছ হাসি, “দূরে থাক ! খবরদার, কাছে আসবি না |” ওই হাসিটা এখনও তেমনি আমার বুকে হাতুড়ি পেটায় – অথচ তুই জানতিস না | তুই তো পালিয়ে বেড়াতিস – “চল খেলবি”, বলে কোথায় যে উধাও হতিস, ভালো করে জেনে যে তোকে আমি খুঁজে বেড়াব | আজও খুঁজি | খুঁজতে খুঁজতে ওই বাক্সয় হাতড়াই | কখনও তোর বড় হয়ে ওঠার ছবি পাই না – সেখানে পাই তোর মায়ের ছবি – কিন্তু হাসিটা গুলিয়ে দেয়, ভুল করিয়ে দেয়, যে ওটা তুই |

কী গান্ধারী ওই চেহারা | টিকালো নাক, উঁচু গালের উপর লম্বা পলকের ছায়ার শিরোনাম, পলকের নিচে কটা কটা চোখের মণি | আর ঠোঁটের কথা নাই বললাম | তুইও হয়তো তোর ঠোঁটের কথা জানতিস না | নইলে কী আমায় এগোতে দেখলেই ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে চুপ করতে ইশারা করতে গিয়ে উল্টে আমার টানটা আরও অদম্য করতিস ?

আমি আর তুই – যেন ওথেলো আর দেসদিমোনা | আচ্ছা বলতো, একই সম্পর্কের জালে কী ভাবে দু’রঙা সুতো থাকতে পারে, কালো আর লাল | কী করে সবাই হতে পারে হয় সুন্দর, নয় কুৎসিত ? আর কেন, তুই প্রথম দলে, তো আমি দ্বিতীয় দলে ? কোথায় আমাদের ধারা আলাদা হল ? কেন হল, এমন ? কেন হল এমন যে কাকা, পিসি, মামা, মাসি আর আরও সবাই – হয় রূপের পক্ষে, নয় বিপক্ষে ?

তুই কী লক্ষ্য করেছিস এই জালে সব সহোদর এক সুতোর নয় ? কেউ কালো, অপুষ্ট, শ্রীহীন, ক্ষীনপ্রাণ তো কেউ রূপের জেল্লায় লাল, ফেটে পড়ছে |

এই কথাতে  এসে আমার ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে যায় | রান্নার মাসি উনুন ধরিয়েছে পাট কাঠির মাথায় পাট জড়িয়ে কেরোসিন ঢেলে | তারপর চেলা কাঠ চাপিয়ে চলে গেছে | তোকে আর আমাকে বলে গেছে দেখতে যেন আগুনটা ধরে | আমি সামনে বসে পাটকাঠি দিয়ে ফুঁ দিচ্ছি গাল ফুলিয়ে – পরনে হাফ প্যান্ট, গা উদোম | তুই পাশে উবু হয়ে বসে দেখছিস – পরনে তোর লেস দেয়া হাতকাটা শেমিজ | কী কুক্ষণে যে তোর পায়ের দিকে আমার নজর গিয়েছিল, আর তুই লেসের হেম ধরে শেমিজ টেনে নামিয়ে হাঁটু গেড়েছিলি, পাছে আমার দৃষ্টি দুই ধারা কে কাছে টানে | তখন দেখছিলাম ওই আগুনে উজ্জ্বল হয়ে চেলা কাঠের বুক ফাটলো, তার স্ফুলিঙ্গ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ল, আর তোর গালে তার আগুন লাগলো | গালে ফুটে উঠল অজস্র লাল বিন্দুর স্ফুলিঙ্গ | তোর চোখও যেন জ্বলে উঠল | আমায় বললি, “মুখপোড়া হনুমান !” তারপর ছুটে পালিয়ে গেলি | তখনই তুই বলে গেলি – তুই শুভ্র, আমি কৃষ্ণ – আমরা জাতে, পঙক্তিতে আলাদা | আমরা ভিন্ন পথের পথিক |

অথচ আমি জানি, একদিন দুই ভিন্ন পথের পথিক – এক রূপসী আর এক দানো – এক হয়ে রক্তের ধারা এক করতে চেয়েছিল | তবুও কালো রক্তে লাল রক্ত মিশ খায় নি | দুটো ধারা আলাদা রয়ে গেছে | তাই তাদের প্রজন্মে দুই ধারা আলাদাই রয়ে গেছে |

তবুও তো আমার রক্তে রয়ে গেছে ওই অন্য রক্তের ডাক | আমার রক্ত ডাকে, আর এক রক্তের সাথে এক হতে – যাতে ওথেলো আর দেসদিমোনা আর আলাদা না থাকে |

ওই ডাক শুনে বিছানায় যাই | ওই ডাক শুনে ঘুম আসে | ঘুমে ছবির বাক্সটার ডালা খুলে ছবি দেখি | কিন্তু ওখানে তো তোর আর কোন ছবি নেই | তাই জানি না তুই কবে মায়ের রূপ ধরলি – আর কার সাথে এক হয়ে মা হলি | স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে আমি বুঝি – দুই রক্ত কোনদিন এক হবে না | ওথেলোরা চিরকুমার থেকে যাবে, আর দেসদিমোনারা চিরকুমারী |

তবুও বুকের চরে ভাঁটা পড়া রক্তের স্রোত বয়েই যায় – হয়ত এগোতে এগোতে তোর স্রোতের সাথে দেখা হবে, দুই স্রোত এক হবে |

যেখানেই থাক, বইতে থাক, থামিস না |


----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৯ মে ২০১৬

সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

অপেক্ষা

|| অপেক্ষা ||


হঠাত করে মলিনাদির সাথে দেখা হয়েছিল |

কিছু কাগজের কাজ নিয়ে কোর্টে গিয়েছিলাম | উকিলের সাথে কথা বলে বেরিয়ে বড় রাস্তার কাছে এসে মনে হল পেনটা ফেলে এসেছি, তাই ফেরত যাচ্ছিলাম পকেট হাতড়াতে, হাতড়াতে | উল্টোদিক থেকে মলিনাদি আসছিল | বয়েসের ছাপ তেমন না পড়লেও বেখেয়ালে আমি ঠিক লক্ষ্য করি নি |  মলিনাদি পাশ দিয়ে গিয়ে পিছন থেকে ডাকল, “ধ্রুব না ? এই ! তুই ধ্রুব না ?” যেই আমার হাতে পেনটা ঠেকল, শুনতে পেয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম । দেখে চিনতে একটুও অসুবিধা হল না |

তবে, সেই রকমই আছে তা বলবো না | শেষ দেখা হয়ে মনে হয় চল্লিশ – বিয়াল্লিশ বছর কেটে গেছে | এখন যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্মিত মুখে, তার রং সেই সময়ের তুলনায় বেশ কালো | মাজা, ঋজু চেহারাটা না হলেও পঁয়ষট্টি বছরের | মণিবন্ধের হাড় শক্ত, ব্লাউজের হাতার শেষে কনুইটা চওড়া | গাল একটু বসে গিয়ে মুখের চোয়াল আরও প্রশস্ত হয়েছে, আর তাকে দৃঢ় সমর্থন যোগাচ্ছে চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা | মাথার মসৃণ চুলে একটু পাক ধরলেও বেশিরভাগ কালো | এত গরমেও শাড়ির আঁচলটা গলায় পাকিয়ে বুকের উপর ছড়িয়ে ফেলা । শুধু এই আব্রুটুকু এই বয়সের তুলনায় বেমানান |

আমার চিনতে অসুবিধা হচ্ছে ভেবে মলিনাদি চোখ থেকে চশমাটা খুলে বলল, “এবার চিনতে পারছিস ?” সেই মমতা ভরা কালো গভীর চোখ ... যার চোখের লম্বা লম্বা পলক যে কোন মুহূর্তে ধীরে ধীরে নেমে এসে সেই মমতার হদিস হারিয়ে দিতে পারে | আমার কৈশোরের মলিনাদি – মলিনা মুখি – পাড়ার মুখি বাবুর বড় মেয়ে, আমার খেলার মাঠের সাথী বাবুয়ার দিদি |

আমি বললাম, “চিনব না কেন ? আসলে আমি পেনটা হারিয়ে ফেলেছি ভেবে একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই তোমাকে লক্ষ্য করি নি | কোথায় এসেছিলে ?”
মলিনাদি বলল, “একটু এফিডেভিটের কাজ ছিল | হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরছি | তুই ?”
আমি বললাম, “আমিও বাড়ি ফিরছি |”
-  “কতদিন পরে দেখা বল তো !"
-  "চল্লিশ বছর ?"
-  "বাড়ি ফেরার তাড়া আছে তোর ?”
-  “না, তেমন না | ইলাকে বলে এসেছি কোর্টের কাজ, সময় লাগতে পারে | কেন বলো তো ?”
কব্জির ঘড়িটায় চোখ রেখে মলিনাদি বলল, “কেমন আছিস ? চা খাবি ? খেতে খেতে বলবি ?”
আমি বললাম, “চা, এখানে ?”
-  “না, না ... কাছেই আমার বাড়ি, গেরুয়া রোডে | যাবি ?”
-  “কেন, তোমার আর কাজ নেই বুঝি বাড়িতে ?”
-  “কাজ ? একা মানুষের আর কাজ কী রে ? চল না, চল !”
-  “ঠিক আছে | তবে একটা কথা, পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দেবে তো ?”
-  “হ্যাঁ, হ্যাঁ ... এই রিক্সা !”

মলিনাদির বাড়ি কোর্টের রাস্তাটার উল্টোদিকে একটা বড় মাঠের ওপারে | রিক্সা থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইটুকু পথের জন্য রিক্সা নিলে কেন ?” মলিনাদি বলল, “আসলে আমার ওই গাড়ি ঘোড়ার রাস্তাটা পার হতে ভয় করে | বয়স হয়েছে, একা মানুষ, কে কোথায় ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে |”

“আয় |” বলে মলিনাদি বাগানের গেটটা খুলল | ছোট্ট কোয়ার্টার, সামনে একটু বাগান, তাতে কিছু ফুলের গাছ | দু ধাপ সিঁড়ি উঠে ছোট বারান্দা | দরজা খুলে সামনের ঘরে ঢুকলাম | এক সেট সোফা, একটা ডিভান, দু একটা ঘর সাজানোর জিনিস আর একটা ছোট পড়ার টেবিল চেয়ার – ছিমছাম সাজ-সজ্জাহীন | সিলিং ফ্যান চালিয়ে দিয়ে মলিনাদি বলল, “দাঁড়া, চায়ের জলটা বসিয়ে দিয়ে আসছি |” এই বলে, ভিতরে যাওয়ার দরজা দিয়ে চলে গেল | আমি একবার চারিদিকে চোখ বুললাম | দেয়ালে একটা বিনে-ছবি বাংলা ক্যালেন্ডার | একটা ফ্রেমে বাঁধানো মুখি পরিবারের সাদা কালো ছবি, তাতে মলিনাদি শাড়ি পরা – দেখে মনে হল শেষ দেখা হওয়ার সময়ের | আর কারো কোন ছবি নেই | তাহলে কি ...
...

এক নিমিষেই আবছা স্মৃতির অনেক কথা দুর্বার বেগে ঝড়ের মতো উঠে আসতে পারে | ছোটবেলায় আমরা এক পাড়ায় থাকতাম | মুখি বাবুর বাড়ি ছিল আমাদের তিনটে বাড়ি পরে | অনেকটা এইরকম কোয়ার্টার | সামনে বারান্দা, তারপর পরপর বাইরের ঘর, ভিতরের ঘর, রান্নাঘর - পাশে এক ফালি সরু উঠোন, স্নানঘর, পায়খানা, আর পিছনের খিড়কি দরজা – সামনের থেকে খিড়কির, সব দরজা এক সারিতে |

যুধিষ্ঠির মুখি, মুখি বাবুর ছিল বড় পরিবার – পাঁচ মেয়ে আর এক ছেলে | প্রথমে মলিনাদি, তারপর বাবুয়া – আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট – তারপর আরও চার মেয়ে, নীলিমা, প্রতিমা, সরমা, আর সবশেষের জনের নাম বোধ হয় পুতুল | মাসীমা, মুখি বাবুর বউ, ছিল ক্ষীণকায়, ফর্সা, দুর্বল, টিকালো নাক আর সুন্দর চোখ-মুখের | তার ধারাটা অন্য মেয়েরা পেলেও, মলিনাদি নিয়েছিল বাবার ধারা – লম্বা, ময়লা, শান্ত, গভীর | খেলার জন্য বাবুয়াকে ডাকতে গেলে মলিনাদি ভিতরে ডাকত, “বাইরে কেন ? বাবুয়া খাচ্ছে - ভিতরে আয়, বোস ততক্ষণ |” আমি গিয়ে বসতাম বাইরের ঘরের একমাত্র চেয়ারে | ঘরটার বাকি অংশ জুড়ে ছিল একটা মস্ত খাট | ভিতরের ঘরে ছিল দুটো মাদুর পাতা চৌকি, একটা আলনা, আর অনেক জিনিস, এক কোনে মাসিমার ঠাকুরঘর – একটা ছোট কাঠের ঠাকুরবাড়ি | ঘরটায় সারাদিন ধূপ ধুনোর গন্ধ থাকত, আর থাকত ফুলের গন্ধ | বাইরের ঘর থেকে ভিতরের ঘরে যাওয়ার দরজাটার পরেই ছিল দেয়ালে ঝুলানো একটা বড় আয়না, তারপর আলনা | এই দরজাটায় একটা পর্দা থাকলেও তার অপর্যাপ্ত প্রস্থের পাশ দিয়ে আয়নাটা, আর তার প্রতিফলনে ভিতরের ঘরের কিছু অংশ দেখা যেত | তাই, আমি বসে থাকলে আয়নাটা একটু অস্বস্তির সৃষ্টি করত | বাবুয়া বেরোলেই এক লাফে উঠে বাইরে আসতাম |

কী ভাবে জানি না একটু একটু করে বুঝলাম মলিনাদির আমাকে নিয়ে একটা আগ্রহ হয়েছে | সেটা কোনদিন বাড়তে বা কমতে দেখলাম না | ব্যাপারটা কোনদিন খারাপও লাগে নি |

সেবার আমি ছুটির আগে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠে দূরের উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে যোগ দিয়েছি | বাবুয়া যাবে আরও দু বছর পরে | গরমের ছুটি হয়েছে | মলিনাদি আমাকে মাঝে মাঝে স্কুলের কথা জিজ্ঞাসা করে, মাস্টাররা কেমন, ছেলেরা কত বদমাইশ, আমি স্কুল পালিয়ে কোথাও যাই কিনা | প্রায় দুপুরেই মুখি মাসিমা নীলিমা, প্রতিমা আর সরমাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসে, মায়ের সাথে গল্প করতে | তিন বোন ইলার সাথে লুডো খেলে | একদিন মাসীমা বলল, “শোন ধ্রুব, মলিনা বলল তোকে পাঠিয়ে দিতে | বাবুয়া টিউশনে গেছে, ও একা আছে | যা, গল্প করবি তো |”

যেতেই মলিনাদি ভিতরের ঘরে নিয়ে গেল | একটা চৌকিতে পুতুল অঘোরে ঘুমোচ্ছে । মলিনাদি অন্য চৌকিতে উঠে কোলে একটা বালিশ টেনে আয়েস ঢালা গলায় বলল, “আয়, তোর কথা শুনি |”

কী গল্প করলাম মনে নেই | কিন্তু, সেবার প্রায় পুরো গরমের ছুটি কেটে গেল, দুপুরে আধো অন্ধকার ঘরে চৌকিতে বসে মলিনাদির সাথে গল্প করে | আমার কিছু তেমন বলার থাকত না, বিশেষ করে স্কুল বন্ধ বলে | তাও মলিনাদি যে কত প্রশ্ন করত | তখন আমার বয়স হয়ত তেরো, মলিনাদি বছর দুয়েক আগে স্কুল পাশ করেছে, তাই হয়ত ওর আঠেরো | মা বলত মলিনাদি আমার থেকে পাঁচ বছরের মত বড় |
...

এই সব চিন্তার স্রোতে ব্যাঘাত করে মলিনাদি ডাকল, “তুই চায়ে চিনি খাস তো ?” বললাম, “হ্যাঁ, তবে একটু কম দিও, চায়ের চামচের এক হলেই হবে |”
...

আমি জানি না মলিনাদি কেন কলেজে যায় নি | শুনতাম ওর জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে | মলিনাদি অবশ্য সেই নিয়ে কোন কথা বলত না | আমার একটুও মনে নেই আমরা কী নিয়ে গল্প করতাম | কিন্তু, এটাও ঠিক কোন মেয়েলি বা ঘরোয়া ব্যাপার নিয়ে কোন গল্প ছিল না | এইটুকু বুঝতাম মলিনাদি আমাকে একটু অদ্ভুত ভাবে স্নেহ করত – বা, শুধু স্নেহ হয়ত নয়, সাথে একটু সমীহ করত, কেন না আমি লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম | খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমি কী বই পড়ছি জানতে চাইত, আমাকে বলত, “তোর পড়া হয়ে গেলে আমাকে একটু দিস তো |” তাও আমি মলিনাদিকে বই পড়তে দেখি নি কোনদিন, যদিও মাসিমা বাড়িতে উল্টোরথ, আর নবকল্লোল রাখত |

ক্লাস এইটে উঠে আমার কবিতা লেখার শখ হল, ক্লাসের আর পাঁচটা ছেলের মত | শীতের ছুটিতে এক দুটো লিখেও ফেললাম, দুপুর বেলায় সামনের বারান্দায় রোদে বসে | একদিন মলিনাদি মায়ের কাছে উল বোনা শিখতে এসে দেখে ফেলল | “দেখি, কী লিখছিস | কবিতা ?” বলে আমার হাতের খাতাটা নিতে চাইল | আমি কিছুতেই দেব না | টানাটানিতে আমার খাতা ধরা হাতের মুঠো মলিনাদির বুকের মাঝে দুম করে লেগে গেল জোরে | “উঃ” বলে ব্যথায় ককিয়ে উঠে মলিনাদি আমার খাতাটা ছেড়ে দিল | মা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে মলিনা ? জোরে লেগেছে ? দেখি দেখি |” দেখলাম যন্ত্রণায় মলিনাদির চোখে জল এসে গেছে | তাও, “কিছু না |” বলে মলিনাদি উঠে পড়ল | বলল, “আসি মাসিমা |”

মা আমাকে কিছু না বললেও কদিন আমি খুব মন খারাপ করে পড়ে থাকলাম | বুঝলাম না, মলিনাদির কোথায় ব্যথা দিয়ে ফেলেছি | নাকি গায়ে হাত লেগেছে বলে | কিন্তু, যখন দুপুরে আধো আঁধার ঘরে মলিনাদির সাথে গল্প করেছি কতদিন মলিনাদি আমার কথায় বিশ্বাস না করে আমার হাতের পাতা জামার বুকে চেপে ধরে বলেছে, “গা ছুঁয়ে বল, সত্যি বলছিস !” আমি ওর গা ছুঁয়ে “সত্যি !” বলেছি | কতদিন, যখন উঠে পড়েছি, মলিনাদি আমার গাল বুকে চেপে বলেছে, “আয় এবার | কাল আসবি তো ?”

তা হলে ? তাহলে কী ? সেই যে একদিন এমনি মলিনাদি আমার মাথা গাল নিজের বুকে চেপে ধরলে আমি বলেছিলাম, “মলিনাদি তোমার বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছি |” মলিনাদি বলেছিল, “আর কিছু ?” আমি মাথা নেড়েছিলাম | মলিনাদি বলেছিল, “খুব কান পেতে শুনলেও না ?” আমি মাথাটা তুলে বলেছিলাম, “কিসের শব্দ ?” মলিনাদি একটু চাপা হাসি হেসে বলেছিল, “একটা ছোট্ট গুটি পোকার বুকের ধুকপুক |” আমি অবাক হয়ে বললাম, “গুটি পোকা ?” মলিনাদি বলল, “গুটি পোকা ... শতপদ ... থাক, তুই বুঝবি না |”

এক নিমিষেই এই সব অনেক কথা মনের মধ্যে বৈশাখের দুপুরের অশরীরী তপ্ত হাওয়ার ঘূর্ণিপাকের মত পাক খেয়ে গেল, জমে থাকা ধুলো পাতা উড়িয়ে ওলটপালট করে দিয়ে | আমি বসে রইলাম এক অন্য কোয়ার্টারে, অনেক সময় পিছিয়ে গিয়ে |
...

মলিনাদি একটা ট্রেতে দু’কাপ চা আর একটা প্লেটে কটা নিমকি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, “এবার কেমন গরম পড়েছে রে | সারাদিন ঘর বন্ধ করে অন্ধকারে বসে থাকি, আর দিন গুনি কবে একটু বৃষ্টি নামবে |”

আমি দেয়ালে চোখ বুলিয়ে বললাম, “শুধু তোমাদের মা-বাবা, ভাই-বোনের ছবি, আর কারো নেই কেন ?” মলিনাদি আঁচলে ঘাম মুছে বলল, “আর কার হবে বল | বিয়ে তো করি নি, মানে করা হয়ে ওঠে নি |”
-  “তাহলে এই কোয়ার্টার ? কার নামে ?”
-  “আমারই নামে | ও, তুই তো জানবি না । বাবা মারা গেলে আমি করেসপন্ডেন্স কোর্সে বিএ, বিএড করলাম । তারপর স্কুলে মাস্টারি । এখন আমি পাশেই  কস্তুরবা গার্লস স্কুলে পড়াই | ছ’বছর এক্সটেনশনে আছি | যতদিন রাখে, চিন্তা নেই | যাক, তোর খবর বল – বউ, ছেলেমেয়ে – কে কোথায় আছে, কী করে | তুই ইলার কথা বললি, ও কী তোর সাথেই আছে |
-  “হ্যাঁ | আমার তো এক ছেলে, দুর্গাপুরে কাজ করে | বউ মারা গিয়ে সাত বছর হয়ে গেল | তারপর ইলার বর মারা গেলে ওকে এনে রেখেছি সাথে | তোমার বোনেরা ? বাবুয়া ? ওরা সব কেমন আছে ?”

এইভাবে কথায় কথায় একটা বেজে গেল | বললাম, “তোমার খাওয়ার সময় হয়ে গেল | উঠি |” মলিনাদি বলল, “হ্যাঁ, আয় | আবার কবে আসবি বল | বাড়িটা তো চিনে গেলি | একদিন দুপুরে আয়, খুব গল্প করা যাবে | ইলাকেও আনিস |” আমি বললাম, “আসব | ইলা হয়ত আসতে চাইবে না – বাতের ব্যথায় ও আর বেরোতে চায় না | তোমার কি সুবিধা হবে দুপুরে এলে ?” মলিনাদি হেসে বলল, “আয় না দুপুরে, সেই ছোটবেলার গরমকালের মত |”

বাসে উঠে ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম | সেকালে শুকনো গরম পড়ত | আমার মোটেও কষ্ট হত না | খালি গায়, কি গেঞ্জি গায়, থাকতাম | মলিনাদি তখন শাড়ি পরত না | প্রায় গোড়ালি অব্দি লম্বা ফ্রক পরত | আজকাল তাকেই গাউন বলে, বোধহয় । পাড়ার আর সব সমবয়সী মেয়েরাও ওইরকম ফ্রক পরত | মলিনাদি খুব উঁচু গলার ফ্রক পরত | মা মাঝে মাঝে বলত, “কী রে মলিনা, এত গরমে গলা উঁচু ফ্রক পরে তোর গরম লাগে না ?” মলিনাদি কথায় উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ত  | খালি সরস্বতী পুজোর দিন পাড়ার মেয়েদের সাথে মলিনাদি শাড়ি পরত | কেন জানি না, সেদিন আমি মলিনাদির থেকে নিজেকে আলাদা মনে করতাম । মনে করতাম এক সাথে গল্প করলে কী হবে, মলিনাদি আমার থেকে অনেক অনেক বড় | তবুও সেবার পুজোর দিন সকালে মলিনাদি বাবুয়াকে দিয়ে আমাকে বলে পাঠালো যে আমি যেন ওকে প্যান্ডেলে নিয়ে যাই অঞ্জলি দেয়ার জন্য | আমি বাবুয়াকে বললাম, “তুই থাকতে আমি কেন ?” বাবুয়া একটা কাঁধের ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “দিদিকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিস |”

আমি স্নান করে পাঞ্জাবি পায়জামা পরে মুখি বাবুর বাড়ির দরজার গায়ে কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে মলিনাদি বলল, “চলে আয় | দরজা ভেজানো আছে |” আমি ঢুকে চেয়ারে বসে বললাম, “দরজাটা ভেজিয়ে দেব কি |” মলিনাদি বলল, “না থাক | তুই আছিস তো | বোস তুই,  লিপি আমায় শাড়ি পরাচ্ছে | পরা হলেই বেরব |” লিপি, মানে লিপিকাদি, থাকত মলিনাদির পাশের বাড়িতে, মাঝখানে একটা গলি ছেড়ে | ওর ভাই ছিল পাড়ার একমাত্র গুণ্ডা ।

মনে হল বাড়িতে শুধু মাসিমা আছে, রান্নাঘরে ব্যস্ত | ভিতরের ঘরটা অন্ধকার দেখে বুঝলাম উঠোনে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ । দেখলাম ভিতরের ঘরের গলির দিকে জানালাটাও বন্ধ | বন্ধ জানালাটা চোখে পড়তেই চমকে উঠে বুঝলাম যে দুই ঘরের মাঝের পর্দাটা সরানো, তাই ভিতরের ঘরের দেয়ালে টাঙানো আয়নাটা পুরো দেখা যাচ্ছে চেয়ারে বসে | যদিও আয়নায় কাউকে দেখতে পেলাম না, ভিতর থেকে লিপিকাদি চেঁচিয়ে উঠল, “এই, খবরদার ! আয়না দিয়ে দেখবি না |” তারপরেই শুনলাম ভিতরে দুজনের চাপা গলায় হিসহিস করে কথাবার্তা |

সেদিন খুব অস্বস্তি সামলে দুই দিদিকে নিয়ে পাড়ার পুজোয় অঞ্জলি দিয়ে ফিরলাম | লিপিকাদি বাড়ি চলে গেল | মলিনাদি বলল, “ভিতরে আসবি না ?” আমি বিব্রত মুখে বললাম, “না |” মলিনাদি “বেশ” বলে বাগানের গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকে  আমায় বলল, “শোন, কাছে আয় তো |” আমি কাছে গেলে চাপা স্বরে বলল, “কিছু দেখিস নি তো আয়না দিয়ে ?” তারপর গম্ভীর চোখে আমার গালে আলতো করে তালি মেরে বলল, “যা, বাড়ি যা |”

এই ছোট ঘটনাটার পর আমি মলিনাদিকে একটু এড়িয়ে চললাম, যদিও ওর দিকে থেকে আন্তরিকতায় কোন পরিবর্তন দেখলাম না | আমায় দেখলেই বলত, “আর আসিস না কেন ?”, কিম্বা, “খুব পড়াশুনা করছিস বুঝি ?”

আমি ক্লাস টেনে উঠলে মুখি বাবু একটু বড় কোয়ার্টার পেয়ে অন্য পাড়ায় চলে গেল | তার কয়েক বছর পরে আমারও সেই পাড়ায় গেলাম | তখন আমি কলেজে তৃতীয়-বর্ষে পড়ি | গরমের ছুটিতে বাড়ি এলে সকাল-বিকেল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যাওয়া আসার পথে মুখি বাবুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাই | কাউকে দেখি না | কোনদিন মুখি মাসিমা আসে মায়ের কাছে দুপুরে গল্প করতে | কিন্তু, আমাকে আর বলে না, “যা, মলিনা বাড়িতে একা আছে | গল্প করবি তো যা |” তাও একদিন মলিনাদির সাথে দেখা হয়ে গেল | বিকেলে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল | মাথায় বেলি ফুলের মালা দেখে অবাক হলাম | মলিনাদিকে কোনদিন লোকদেখানো সাজতে দেখি নি | চেহারাটা দেখলাম শুকিয়ে গেছে | মুখটা ভর্তি ব্রণ | তবুও তারই মধ্যে চোখ দুটো আগেকার মত করুণাময় হয়ে আছে | আমায় দেখে একটু হাসল | তারপর হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, “শুনেছি তুই এসেছিস | কই একদিনও তো এলি না দেখা করতে | এখন কোথায় যাচ্ছিস ?” বললাম, “এই ... স্কুলের বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দেব | তুমি কার জন্য দাঁড়িয়ে আছ ?”

-  "কার জন্য আর ? আমায় দেখতে আসবে ... তাই হত্যে দিয়ে পড়ে আছি ।"
-  "তাহলে আমি যাই । পরে তোমার সাথে কথা বলব ।"
-  “কী বলবি ? কী গল্প করিস তোরা আড্ডায় ? শুধু গল্প করিস, না চা, সিগারেটও খাস |”
-  “তাও খাই ... পয়সা থাকলে |”
-  “হ্যাঁ, মায়ের মুখে শুনলাম, মাসিমা দুঃখ করেছে যে তুই খুব সিগারেট খাস | শোন, খেলে খাবি, কিন্তু কম সম |”
-  “কমই তো খাই | আজ দেখো না, পকেটে পয়সা নেই | বন্ধুদেরও একই অবস্থা হলে আজ আর ...”
-  “তাই ? দাঁড়া |” বলে মলিনাদি ভিতরে চলে গেল | টুক করে ফিরে এসে হাতের মুঠো এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নে | কিন্তু, প্রমিস কর, কম খাবি |”
-  “তুমি কেন পয়সা দেবে ?” আমি বিব্রত হয়ে বললাম |
-  “যা না, মাত্র আট আনা তো | আবার লাগলে চাইবি |”

আট আনায় সেদিন পুরো এক প্যাকেট সিগারেট কিনলে পরে বন্ধুরা জেনে গেল | যেদিনই কারও  কাছে পয়সা থাকে না সবাই আমাকে বল, “ধ্রুব, যা না | একটা টাকা চেয়ে নিয়ে আয় |” বলতে হয় না | মাঝে মধ্যেই মাথায় বেলি ফুলের মালায় সেজে মলিনাদি গেটে দাঁড়িয়ে থাকে, আমাকে দেখে ডাকে, জিজ্ঞাসা করে, “ভালো আছিস ?” তারপর আমার ইতস্তত ভাব দেখলে, “আজ হাত খালি বুঝি ?” বলে ব্লাউজের গলায় হাত ঢুকিয়ে টুক করে একটা টাকা বের করে দিয়ে বলে, “যা, পালা |” একদিন এই ভাবেই টাকাটা বের করতে গিয়ে মলিনাদি হটাত ব্যথায় মুচড়ে উঠল | হাতটা ব্লাউজের গলায় আটকে রইল এক মুহূর্তের জন্য | আমি ভয় পেয়ে বললাম, “কী হয়েছে, মলিনাদি ?” মলিনাদি বলল, “কিছু না | টাকাটা ভাঁজ করে রেখেছিলাম, তার কোনায় একটু খোঁচা লেগে গেল পুরানো ব্যথার জায়গাটায় |”

সেদিন বাড়ি ফিরে ইলাকে বললাম সব কথা, আগে প্রমিস করিয়ে নিয়ে যে ও মাকে কিছু বলবে না | সব বলে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই কিছু জানিস ? মলিনাদি কিসের পুরানো ব্যথার কথা বলল ?” ইলা মাথা নাড়ল | না, ও কিছুই জানে না | বলল, “তুই বললে আমি মাসীমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি |” আমি বললাম, “থাক, দরকার নেই |”
...

বাড়ি ফেরার বাসে বসে সেই সব কথা ভাবতে ভাবতে মনটা খুব টানটান হয়ে  উঠল পুরানো দিনগুলোর জন্য | যদি আবার একবার সেই গরমকালের দুপুরের আধো অন্ধকার দিনে মলিনাদির চৌকির উপর বসে গল্প করার সময়ে ফিরে যেতে পারতাম | তাহলে মন দিয়ে ওর সব কথা শুনে মুখস্থ করে নিতাম, পরে জাবর কাটার জন্য | তাহলে হয়ত সেদিন না বুঝলেও আজ নিশ্চয় বুঝতে পারতাম মলিনাদির বুকে কোথায় ব্যথা ছিল | বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঠিক করে নিলাম, ‘না, এরপর দেখা হলেই মলিনাদিকে জিজ্ঞাসা করব |’

কিন্তু অনেক দিন কেটে গেল | কতবার মলিনাদির কাছে গিয়ে এটা সেটা গল্প করে ফিরে এসেছি |
...

সদ্য বৃষ্টি শুরু হয়েছে | দুপুরে আর ঘুম আসে না | ভাবছি কাল মলিনাদির বাড়ি যাব দুপুরে | আমায় দেখে খুব খুশি হবে, “তুই এসেছিস | আমি তো ভাবছিলাম তুই আর দুপুরে আসবি না | আয়, ভিতরে আয় |” আমাকে বসিয়ে রেখে মলিনাদি ভিতরে চলে যাবে | ফিরে এসে বলবে, “এখনই চা খাবি, না একটু পরে ?” আমি বলব, “চা খাব ? এই ভর দুপুরে ?” মলিনাদি বলবে, “তাহলে থাক | তবে তুই খেলে আমিও খেতাম | এই বৃষ্টির জোলো হওয়ায় ... যদি বলিস কফি করতে পারি |”
আমি বলব, সুযোগ পেয়ে, “আচ্ছা, অবেলায় যা দেবে খাব, যদি একটা প্রশ্নের জবাব দাও |”
“ও, বাবা !” মলিনাদি বলবে, “এত বছর পরে এই সবে দেখা | এতদিনের সব কথা এখনও জানা বাকি | তার আগেই প্রশ্ন ? কী নিয়ে রে ?”
আমি বলব, “তোমার কি পুরানো কথা সব মনে আছে ? আমি যখন কলেজে, তুমি আমাকে মাঝে মধ্যেই বিকেলে আট আনা কি এক টাকা দিতে, আমার সিগারেট খাওয়ার জন্য ? ব্লাউজে ভাঁজ করে টাকা গুঁজে রেখে তুমি বাগানের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে |”
মলিনাদি মাথা হেলাবে, “মনে আছে |”
আমি বলব, “একদিন টাকাটা বের করতে গিয়ে তার ভাঁজের কোনে খোঁচা লেগে তুমি খুব ব্যথা পেয়েছিলে | বলেছিলে পুরানো ব্যথার জায়গায় খোঁচাটা লেগেছিল |”
মলিনাদি হাসবে, "হবে হয়তো |"
আমি বলব, “আর তার অনেক আগে - সেই পুরানো পাড়ারও টুকিটাকি কথা তোমার সাথে সেদিন দেখা হয়ে মনে পড়ে গেল - একবার আমার কবিতার খাতা নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে তোমার গলার নিচে আমার হাতের ধাক্কা লেগেও তুমি খুব ব্যথা পেয়েছিলে |”
মলিনাদি বলবে, “হ্যাঁ, ওটা মনে আছে ... কিন্তু, তার কথা এখন জেনে কী করবি ? ব্যথা তো একটা ছিল ... কিন্তু সে তো পুরানো হয়ে সয়ে গেছে | থাক না, অন্য কথা বল |”
আমি বলব, “না মলিনাদি | কথাটা ব্যথার শুধু নয় | তুমি সেই সময় আমাকে একটা গুটি পোকার কথা বলেছিলে একদিন | কিসের গুটি পোকা ?”
মলিনাদির দৃষ্টি কোমল করে বলবে, “ও ! ... সেই গুটি পোকাটা ? দেখবি ? দেখবি তুই গুটি পোকাটা ?”
আমি মাথা হেলাব |
...

মলিনাদি উঠে গিয়ে পাশের জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে এল | তারপর গলার পাক খুলে বুকের আঁচলটা একটু আলগা করে টেনে নামিয়ে দিয়ে বলল, “এই দেখ |” দেখলাম ব্লাউজের গলা খুব নিচু | তার উপরে বুকে একটা জড়ুল | না, গুটি পোকা নয়, শতপদও নয় | জোঁকের মত তেল চুকচুকে, কালো, কোঁচকানো গা একটা মস্ত জড়ুল | গাটা শিরশির করে উঠল | হয়ত শিউরে উঠেছিলাম | চট করে আঁচলটা তুলে গলায় জড়িয়ে নিয়ে মলিনাদি বলল, “তোকে ডেকে যে গল্প করতাম তা ছিল এই আশায় যে একদিন তুই ওটা টের পাবি | তখন তোকে ওটা দেখাবো | কেন জানি না, একটা বিশ্বাস হয়েছিল যে তুই দেখলেই ওটা সেরে যাবে | আমি ভালো হয়ে গিয়ে দিব্যি বিয়ে করতে পারব |”

আমি এক্কেবারে অবাক হয়ে বললাম, "তোমার মনে এই কুসংস্কারের ধারণাটা এসেছিল কী ভাবে ? আমি তখন জানলে কথাটা একদম উড়িয়ে দিতাম ।" মলিনাদি বলল, "আরে, ওই লিপিকা - ওই আমার মাথায় এইসব বুদ্ধি ঢোকাত । তোর কি মনে আছে একবার সরস্বতী পুজোর দিন – লিপিকা আমাকে শাড়ি পরাচ্ছিল, বাইরের ঘরের দরজা খোলা রেখে । আর তুই বাইরের ঘরে বসেছিলি | " আমি বললাম, "হ্যাঁ, লিপিকাদি তো আমাকে বলেছিল আমি যেন আয়না দিয়ে না তাকাই ভিতর ঘরের দিকে ।" মলিনাদি বলল, "সব ছল । ও বলেছিল, তোকে মানা করলে তুই ঠিক লুকিয়ে দেখবি । তুই দেখেছিলি কি, তাও ?" আমি বললাম, "কী যে বলো, মলিনাদি ! সেদিন আমি এত অস্বস্তিতে কাটিয়েছিলাম । সারাদিন ভেবেছিলাম তুমি আমাকে কতো খারাপ ভাবলে ।"
মলিনাদি বলল, "ওরে বোকা । তা কেন ভাববো ?"
আমি আশ্চর্য হলাম, "মানে ? তুমি কিছু মনে করো নি ?"

মলিনাদি মাথা নাড়ল, কথা বলল না । তারপর কোলে হাত জড় করে নিচু গলায় বলল, "আমিও তো ভাবতাম ... আমার এই জড়ুলের জন্য কোন ছেলে আমাকে শেষ পর্যন্ত পছন্দ করবে না, কেন না আমার সত্যবাদী পিতৃদেব পাকা দেখা হওয়ার আগেই পাত্রপক্ষকে বলে দিত আমার বুকে মস্ত একটা জড়ুল আছে । তাতেই সব ছেলে পালিয়ে যেত । তাই ভাবতাম – তুইও তো ছেলে । তুই যদি ওটাকে দেখে খারাপ মনে না করিস, দুরে না সরে যাস, তাও আমার কাছে আসিস, তাহলে জানতাম  ..."
...

আমি আর জিজ্ঞাসা করব না, "কী জানতে ?"
মলিনাদিও আর বলবে না, "জানতাম – যে সব ছেলের দৃষ্টি এক নয় । আর জানতে পারলে তোর মত একটা ভালো ছেলের আশায় অপেক্ষা করতাম ।"


------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ মে ২০১৬

বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬

বুগেনভিলিয়া

|| বুগেনভিলিয়া ||


মোহন মাস্টার বিয়ে করে নি | চাপাচাপি করলেও কারণটা বলে না | বলে সময় হয় নি, বা পয়সা ছিল না, বা বয়স হয়ে গিয়েছিল প্রয়োজন বোধ করার আগে | আবার এও বলেছে, দরকারই পড়ে নি তেমন |

কিন্তু সেদিন আমাদের অন্য কথা বলল | অন্য প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল | মেয়েদের নিয়ে | এই বয়সে তো আর তেমন উত্তেজক কথা হয় না | তাও একজন কিছু বললে, অন্যজন তাতে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু মনে পড়ায় হটাত করে জেগে উঠে বলছিল, “জানেন, আমার একবার এমন হয়েছিল ... |”

শুনতে শুনতে কেমন উসখুস করে উঠে মোহন মাস্টার বলে বসল, “জানেন কি, মেয়েদের একটা মর্মস্থল হয় – kernel যাকে বলে ?”
“তাই ?” নিরুৎসাহে আমরা জানতে চাইলাম |
“হ্যাঁ !” বলল মোহন মাস্টার, “ফুলের মধ্যে ফুল | বুগেনভিলিয়ার ফুলে যেমন হয়, চারিদিকে বড় বড় পাপড়ি, আর তার মাঝে ছোট্ট একটা ফুল, অনেক সময় সাদা – একেবারে বিমল সাদা মাটা সাদা |”

একটু থেমে মোহন মাস্টার বলল, “আমি একবারই দেখেছিলাম ... অনুভব করেছিলাম একটা ফুলের মধ্যে অন্য আরেক ফুল ফুটছে | সেটাই মেয়েদের মর্মস্থল |”

আমাদের চেপে ধরা লম্বা নিঃশ্বাস মোহন মাস্টার কেড়ে নিয়ে বলল, “মেয়েরা যে প্রকৃতি নিয়ে জন্মায়, যা রূপ, গুণ আর পরিচয় নিয়ে, সেটা হল ওই বাইরের রঙিন পাপড়ি | সেটা নিয়েই বড় হয়, কারো মেয়ে থেকে কারো জীবনসঙ্গিনী হয়, পরে মা হয়, ঠাকুমা-দিদিমা | কুমারী থেকে যুবতী, একসময়ে পূর্ণযৌবনা, তারপর ভাঁটা পড়তে শুরু করে | কারো জন্মের রূপ, গুণ শেষদিন অব্দি থেকে যায় | কারো অল্পেই তার শেষ হয়, অনেক আগেই | এরই মধ্যে একসময় ওই ভিতরের ফুলটা ফোটে | সেটাই মেয়েদের মর্ম | তার নির্দোষ রূপ, গুণ, মায়া, মমতা, ভালবাসা দেখতে এক অন্য চোখ লাগে | আমি একসময় সেই চোখ পেয়েছিলাম, আর দেখেছিলাম ভিতরের ফুলটা একজনের মধ্যে |”

মোহন মাস্টার চুপ করে গেলেন | আমারও চুপ করে রইলাম | ‘কে সে ?’ সবাই ভাবছি, কিন্তু মুখে প্রশ্নটা আসছে না, যে যদি মোহন মাস্টারের ঘোরটা কেটে যায় |

কাটল না | মোহন মাস্টার আবার বলতে শুরু করল |

“দাদুর বাড়ির দোতলা থেকে পাশের একতলার বাড়িতে মেয়েটাকে দেখতাম | শুধু সকালে | সে স্নান করে এসে কাচা শাড়িটা পিছনের উঠোনে মেলত | আমি দেখতাম | আর তার চোখে ধরা পড়লে, সে মেলা শাড়িটার আড়ালে চলে যেত | চুপ করে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত | আমিও থাকতাম | শেষে আমাকে হার মানতে হত | দাদু ছিল খুব অবস্থাপন্ন | ওরা ছিল ভীষণ গরিব | তাই আমি ভাবতাম আমার জোর খাটানো উচিত নয়, সরে যাওয়াই ভালো | একদিন কী যে হল, মেয়েটা সরল না | শাড়ি মেলার ভঙ্গিতে তারের উপর হাত ধরে আমার দিকে তাকাল | আমি ওর ভিজে চুলে ঘেরা মুখটা দেখলাম | আর দেখলাম ওর চোখ, ওর চিবুক, গলা ... বাইরের ফুলটা পুরো দেখলাম সেদিন | আর দেখলাম একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি, কিছুটা আমাকে দোষারোপ করার আঁচ ছিল তাতে |

“তখন আমি সাইকেল চালান শিখছি | একদিন ওদের বাড়ির সামনে পড়ে গেলাম, বোকার মত চিতপটাং হয়ে | সেই সাথে শুনলাম কেউ খিলখিল করে হেসে উঠল | তাকিয়ে দেখি মেয়েটা জানালা দিয়ে আমার দুরবস্থা দেখে হাসছে, ভাবটা এই যে, এখন তো তুমি আমার চেয়েও অসহায়, দুর্বল | আর সেই মূহুর্তে ওর হাসির মধ্যে আমি ওর পরিমল মর্মস্থল দেখলাম | ক্ষণিকের জন্য ফোটা একটা ফুলের ভিতরের ছোট সাদা ফুল, কোন রেণু নেই, কুমারীর সিঁথির মত পরিষ্কার, নিষ্পাপ |

আমার যে কী মনে হল | মনে হল এই মর্ম একদিন মিটে যাবে, শেষ হয়ে যাবে, আর আমি কিছু করতে পারব না, একে ধরে রাখতে পারব না | বাইরের ফুল দেখে ভোমরা আসবে, আর মর্মের ফুলটা শেষ করে দিয়ে যাবে | আমি কিছু করতে পারব না |

“এরপর আমি চলে আসি | মনে কথাটা থেকে যায় | আর মন থেকে অন্য কোন ফুল দেখার, বা গ্রহণ করার বাসনাটা চলে যায় চিরকালের মত |”


-------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৯ মে ২০১৬