শুক্রবার, ২৯ মে, ২০১৫

জোছনা

|| জোছনা ||


অতলান্ত নিদ্রায় হুঁশ হীন নিজ্ঝুম রাতে
জেগে শুনি, শুয়ে দক্ষিণ কাতে
কে বাজায় তার একতারাতে
জোনাকি মাতানো সুর

দেখি ভেঙ্গে জানালার কপাট সপাট
বেদখল কামরায় জোছনার হাট
চতুর্দশী চাঁদ, রুপালী বিভ্রাট
হানা দেয় অন্তঃপুর

সাদা ধবধবে আনকোরা ফরাসখানায়
থৈ থৈ উপচানো আলোর ফেনায়
এলোমেলো মেঘ সীমানায়
ঘেরা মুখ তার প্রেমাতুর

ঘুম ভাঙিয়ে সে, বসে আলাপন রাসে
উপচিয়ে রোশনাই এক নিশ্বাসে
সহসা বলে উচ্ছল উল্লাসে
‘আমি চললাম বহুদূর’

প্রভাত হয়ে কাটে এই নিশি-কুহেলিকা
নিদারুণ বিদায়ী ক্রমে ধূসর ফিকা
অন্তিমে আমি বুক-ভাঙ্গা একা
বরষার বুভুক্ষু ময়ূর

যাপিত নিশীথের বেভুল, বেহিসেবী চুম্বনে
ঠোঁটে আস্তীর্ণ অশ্রুর লবণ কণে
বুকে ঘুমন্ত শরণার্থীর চন্দ্রাননে
জোছনাস্মৃতি জাগে সুমধুর ||


-----------------------------------
২৯ মে ২০১৫ / © ইন্দ্রনীর

বৃহস্পতিবার, ২৮ মে, ২০১৫

সুলতা

|| সুলতা ||


সুলতা, তোমার নাম কে রেখেছিল
তার কথা এখন আর মনে পড়ে কি ?

কী চোখে যে সে তোমায় দেখেছিল -
দেখেছিল কি তোমার লতিকা শরীর
তোমার কাঁধে ঢলে পড়া খোঁপাটি
দেখেছিল কী তোমার চুলের গোছা
তোমার কানে গোঁজা দুই দোপাটি

সুলতা, তোমার নাম যে রেখেছিল
মনে করে দেখ তার সব ছল কপাটি

মনে পড়ে কি একদা সান্ধ্য বেলায়
শুশুনিয়া নদী পারে গাজন মেলায়
যখন পালিয়েছিলে চুড়ি হারাতে
সে ধরেছিল হাতে তোমার হাতটি
তখনও আলতো, তখনও ভেজা
তোমার কুসুম চরিত আতপ্ত মুঠি

সে হাত ছেড়ে তুমি এগিয়ে গিয়ে
দীঘল হয়েও আনত নয়ন হয়েছ
বিম্ব ওষ্ঠে প্রগলভ না হয়ে তুমি
‘ছুঁয়ো-না-আমায়’ মিমোসার মত
শিউরে শিউরে শুধুই শীর্ণ হয়েছ
কেন. কোন প্রত্যাদেশ শুনেছ কি

সুলতা, চলো ফিরাই সময়ের কাঁটা
চলো পিছু পায়ে দুজনায় দিই হাঁটা
ফিরে গিয়ে দেখি কোথায় হারিয়েছ
তোমার সেই গুপ্ত গোলাপি দোপাটি
.
সুলতা, তোমায় কামনা যে করেছিল
চলো খুঁজে আনতে তাকে, সোনাটি  ||


--------------------------------
২৮ মে ২০১৫ / © ইন্দ্রনীর

বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫

কোলেস্টেরল

|| কোলেস্টেরল ||

আগে ছিলে তুমি স্বাস্থ্যবতী
আজকাল লাগছ বড্ড স্লিম
ছেড়ে দিয়েছ কি ভোগ করা
তেল, ঘি, হাঁস-মুরগীর ডিম
কোলেস্টেরলের ভয়ে-ডরে
গিয়েছ নিশ্চয় তুমি সিঁটিয়ে
জম্পেশ খাওয়া-দাওয়ার
সব আশ দিয়েছ মিটিয়ে

আশ কে দিতে পার আস্কারা
‘মা ভৈ’ বলেছ এক গবেষক
তেল, ঘি, ডিমে দোষ নেই
যদিও তাহারা স্নেহ বর্ধক
তোমার ওই স্নেহের মাধুর্যে
আমি মজেছিলাম একদিন
তাতেই ধরল মধুমেহ রোগ
এখন মাধুরী করে দশা সঙ্গিন

আমি চাই তুমি সবই খাও
বানাও লাশখানা দশাসই
শুধু লিখ স্বীকারোক্তিতে
“এর মৃত্যুর জন্য দায়ী সই”  ||


------------------------------------
২৭ মে ২০১৫ / © ইন্দ্রনীর

শনিবার, ২৩ মে, ২০১৫

শেষ গতি

|| শেষ গতি ||


পিওন এসে একটা অচেনা হাতে ঠিকানা লেখা ওঁ-গঙ্গা মার্কা খাম, আর একটা বড় পার্সেল দিয়ে গেল যার মোড়কের উপর হাতের লেখা অতি পরিচিত | প্রাপকের জায়গায় – বাংলায় ‘কাকিমা’, আর তার নিচে ইংরেজিতে মায়ের নাম ঠিকানা লেখা | প্রেষকের জায়গায় বড়দার নাম ঠিকানা |

প্রথমে শ্রাদ্ধের খামটা খুলে কার্ডটা পড়েই চমকে উঠলাম |

সময়োচিত নিবেদন -
মহাশয় / মহাশয়া,
গত ১লা চৈত্র ১৪১৯ সন (ইং ১৫ই মার্চ ২০১৩) শুক্রবার আমার পরমারাধ্য পিতৃদেব শ্রী সঞ্জীব কুমার দাস প্রাতঃ ০৫-৩০ ঘটিকায় সাধনোচিত ধামে মহাপ্রয়াণ করিয়াছেন | আগামী ১৩ই চৈত্র ১৪১৯ সন (ইং ২৭ মার্চ ২০১৩) বুধবার, তাঁহার আদ্যশ্রাদ্ধ ও পারলৌকিক ক্রিয়াদি অনুষ্ঠিত হইবে | অতএব আপনি / সপরিবারে শ্রাদ্ধবাসরে উপস্থিত থাকিয়া তাঁহার আত্মার শান্তি কামনা করিয়া আমাদিগকে পিতৃদায় হইতে উদ্ধার করিবেন |
পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয় |
ইতি –
ভাগ্যহীন
রাজীব কুমার দাস ও শোকসন্তপ্ত পরিবার

… ‘কী সর্বনাশ ! বড়দা মারা গেছে, আর আমরা তার বিন্দুমাত্র আভাসও পাই নি | তাহলে পার্সেলটা কবেকার ?’

কার্ডটার নিচে দেখি pto লিখে পাশে একটা ছোট তীর আঁকা | পালটিয়ে দেখলাম পিছনে লেখা –

শ্রীচরণেষু  কাকু,
বাবা হটাতই চলে গেল | ঠাকুরমা শক পাবে বলে খবরটা জানাই নি | কিন্তু, প্রথা অনুযায়ী শ্রাদ্ধের চিঠি না পাঠিয়ে পারলাম না | ঠাকুরমাকে বোলো না | পারলে অন্তত তুমি এসো | সব খবর সাক্ষাতে বলব |
ইতি
তোতন

মা ভিতর ঘর থেকে জিজ্ঞাসা করল, “কে ছিল, খোকন ?” আমি বললাম, “পিওন, মা | একটা পার্সেল দিয়ে গেল |” মা জিজ্ঞাসা করল, “হটাত পার্সেল ! কে কী পাঠাল আবার ?” … কে, সে কথা মাকে কী করে বলি ?

এই বড়দা, বড়-জ্যাঠার বড় ছেলে, ছিল আমার ছোটবেলার প্রথম সূরী – ছ’ফুটের মত লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, চওড়া চিবুক, পুরু ঠোঁট, প্রবল নাক, সংকুচিত কপালের নিচে জোড়া ভুরু, তার নিচে অতল বুদ্ধিদীপ্ত চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা ; মাথা ভরা ঢেউ খেলান চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ান | চেন স্মোকিং করার ফলে গা থেকে সব সময় নিকোটিনের চুম্বক গন্ধ | বাবার ছিল দুই দাদা আর দুই দিদি | শুনেছি, বড়-জ্যাঠা আর বাবার মধ্যে এতই বয়েসের পার্থক্য ছিল যে জেঠিমা বিয়ে করে সংসারে ঢুকে প্রথম যে বাচ্চাকে কোলেপিঠে মানুষ করে সে ছিল বাবা | আমি জ্ঞান হওয়ার পর দেশে গ্রামে গেলে দেখেছি জেঠিমা তখনও বাবার পিছনে প্রায় নিজের মায়ের মতই ঘুর ঘুর করত, “হ্যাঁ রে গোপাল, ঘুম হয়েছে কাল রাতে ?” ; “গোপাল, জলপান করেছিস ?” ; “গোপাল, কত বেলা হল, দ্যাখ দিকি | নাইতে যাবি না ?”

একটু বড় হয়ে মা আর বড়দা’র মধ্যে এই একই মা-ছেলের সম্পর্ক দেখি, যদিও বড়দা বয়েসে মায়ের থেকে তেমন ছোট ছিল না | আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, বড়দা গ্রাম থেকে স্কুল সেরে, মফস্বলে কলেজ থেকে বি এ পাশ করে বাবার কাছে রাঁচিতে চলে এসেছে চাকরির খোঁজে | কিছুদিন বসে থেকে, চাকরিও যোগাড় করে ফেলেছে একটা ওষুধের কোম্পানিতে | তার ক’বছর পরে ওই চাকরিতেই পাটনা বদলি হয়ে চলে গেল | মা ক’দিন কী কেঁদেছিল, যেন নিজের ছেলেই চলে গেল দূর দেশে | আমিও মন খারাপ করেছিলাম, তবে অন্য কারণে | বড়দার জিনিস পত্রের মধ্যে একটা স্যুটকেসে অনেক বই ছিল – কিছু ছাত্রাবস্থায় কেনা, বাকি বেশির ভাগ চাকরিতে ঢুকে | বড়দা আমাকে সেগুলো কখন সখন ধরতে দিলেও পড়তে দিত না, কেন না আমি তখনও ছোট, আর ইংরেজি তো পড়তেই পারি না | পাটনা যাওয়ার আগে বড়দা আমাকে তারই মধ্যে থেকে একটা বই দিয়ে যায় | সেটা ছিল বাবার স্কুলের পাঠ্য Shakespeare এর নাটকের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ – ততদিনে তার মেরুদণ্ড উধাও, বিস্তর পাতা পোকায় কাটা | তার কোথাও কোথাও “This book belongs to” লেখার নিচে বাবার নাম কেটে বড়দার নাম লেখা ছিল | এ ছাড়া ছিল, মার্জিনে মার্জিনে বড়দার হাতে লেখা নোট | সেগুলো দেখে দেখে বড়দার হাতের লেখা আমার খুব পরিচিত হয়ে গিয়েছিল | আমার মন খারাপ হয়েছিল, আমি বড় হওয়ার আগেই বইগুলো নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় |

এর প্রায় দশ বছর পর আমি বড়দাকে দেখি, যখন আমি কলেজে | এক শীতের ছুটিতে বড়দার কাছে  ধানবাদে বেড়াতে গেলাম | বড়দার ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে | কয়েক বার বিহার স্টেট সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষা দিয়ে অসফল হয়ে, ওষুধ বিক্রির  লাইনেই ধানবাদে পোস্টেড | উপার্জনে উন্নতি হয়ে বড়দার বইয়ের সংকলন ততদিনে বেড়ে এক আলমারি হয়ে উঠেছে | আমার পড়ার আগ্রহ দেখে বড়দা আমার ফেরার সময় নিজের বইয়ের মধ্যে থেকে একটা – Erich Maria Remarque এর Heaven Has No Favorites – দিয়ে বলেছিল, “এটা পড়িস | আমার খুবই প্রিয় | তবে, আবার যখন আসবি বইটা অবশ্য ফেরত আনিস |” পরের গরমের ছুটিতে বইটা আমার পাড়ার এক বন্ধু পড়তে নিয়ে বহুদিন পরে ফেরত দিয়েছিল | বইটা ততদিনে দুমড়ে, মুচড়ে, আর কী ভাবে জলে ভিজে বিবর্ণ হয়ে একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল | আমি আর বড়দাকে সেই বই ফেরত দেয়ার সাহস করি নি | মাকে বইটা দিয়ে দিয়েছিলাম, যে যদি বড়দা কখনও জিজ্ঞাসা করে |

পাটনা চলে যাওয়ার পর বড়দা মাকে নিয়মিত চিঠি লিখত | তার ভাষা আর বিষয় বস্তু হত যেমন কোনও মায়ের কাছে লেখা ছেলের চিঠিতে হয় | বড়দার বিয়ে হওয়ার পর সেই চিঠি আসা ক্রমে ক্রমে কমে যায় | আর, যতদূর মনে পড়ে, বড়দা পাটনা থেকে ধানবাদে এসে একবারও এত কাছে আমাদের বাড়িতে আসে নি |

বছর দশেক আগে বাবা মারা গেলে মৃত্যু সংবাদ পেয়েই বড়দা ছুটে এসেছিল | ততদিনে বৌদি মারা গিয়েছে, বড়দা নিজের বাড়ি করে একমাত্র ছেলে তোতনের পরিবার নিয়ে থাকে | বড়দার সাথে সেই শেষ বার দেখা, হিসেব করলে কলেজের বারের প্রায় আটত্রিশ বছর পরে | ফিরে গিয়ে প্রথম প্রথম বড়দা মাঝে মধ্যে ফোন করত – মায়ের সাথে কথা বলত | পুরানো কথা উঠলেই তার স্মৃতি নিয়ে মা মুহ্যমান হয়ে চোখ ঝাপসা করে বসে থাকত, কাপড়ের খুঁট নিয়ে ঘাঁটত – কিছু কথা বলত না | আমি ফোন তুললে বড়দা একটাই কথা বলত, “শোন খোকন, কাকিমা কে নিয়ে ক’দিন ঘুরে যা |”

তারপর কিছু দিন গেলে আবার যে কে সেই – তেমন যোগাযোগ থাকল না | মাস ছয়েক আগে বড়দা একদিন ভর দুপুরে ফোন করল, “খোকন, কাকিমা কেমন আছে ? তোরা সব ভালো তো ?” আমি বেশ অবাক হলাম, “মা ভালই আছে | তোমরা কেমন আছ ? মা’র সাথে কথা বলবে ?” বড়দা বলল, “না, থাক | কাকিমা নিশ্চয় ঘুমচ্ছে | তোর সাথেই কথা বলি |” কথা বলে ফোন নামিয়ে রাখার আগে জিজ্ঞাসা করলাম, “বড়দা এতদিন পরে কী ভেবে ফোন করলে ?” বড়দা বলল, “এমনিই ... বয়েস তো অনেক হল | প্রায়ই মনে হয়, আজ আছি কাল নেই – যাওয়ার আগে সব ঠিক ঠাক করে গুছিয়ে দি’, যাকে যা বলার বলে দি’, যাকে যা দেয়ার দিয়ে দি’ | এই আর কী |”
আমি – “তুমি আবার কাকে কী দেবে ? তোমার সবই তো তোতন পাবে |”
বড়দা – “না রে, কিছু জিনিস এমনও আছে যা ওকে দেয়ার মত নয় ... যাক গে, তুই আয় কাকিমাকে নিয়ে | তখন সব কথা হবে | আজ রাখছি |” আমি আর কথা বাড়ালাম না | মা শুনে বলল, “হ্যাঁ, আমার যদি ছিয়াত্তর হয় তাহলে সঞ্জুর কত হবে ? সত্তর ? যাওয়ার সময় তো ওরও এগিয়ে আসছে | তবে, ও কিসের কথা বলছে কাকে দিয়ে যাবে, কে জানে |”

এরপর প্রতি সপ্তাহ, দশদিন পরেই বড়দা ফোন করে, আর বলে, “তোরা আসছিস ? বেশি দেরী করিস না | যাওয়ার আগে সব ঠিক ঠাক গুছিয়ে, যাকে যা বলার বলে, দেয়ার দিয়ে যেতে চাই |” আমি বলি, “তুমি তো জানো. মায়ের বাতের ব্যথা নিয়ে বাসে, ট্রেনে যাত্রা সম্ভব নয় |” বড়দা বলে, “তাহলে তুই গাড়িতে চলে আয় | রাঁচি থেকে ধানবাদ তো খুব লম্বা রাস্তা নয় | সমীর চালিয়ে আনতে পারবে না ?” আমি বলি, “সমীর সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে, আমি চাই না ওর প্রস্তুতিতে ব্যাঘাত হোক |” বড়দা বলে, “কিচ্ছু হবে না | বরঞ্চ এলে সমীরের ভালই লাগবে | ওর লাভ বই ক্ষতি হবে না, দেখিস |” বড়দার সাথে এর বেশি কথা বললেই ফোনটা তোতনের বৌ রমাকে দিয়ে দেয় | ও বলে, “কাকু, বাবা আজকাল কানে কম শোনে | তুমি কী বলছ বুঝতে পারছে না | বলো, কী বলছিলে |”

একদিন এইসব কথার মধ্যে কী মনে হল, মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “মা, বড়দা কেন পাটনা থেকে ধানবাদে চলে আসার পরও একবারও আমাদের এখানে আসে নি ?” দেখলাম মায়ের চোখে ভিজে গেল | চোখ মুছে বলল, “ওই যে ওর গল্প বইয়ের নেশা নিয়ে রাগ করেছিলাম | ওই গল্প বইয়ের নেশাই তো ওকে বিহার সিভিল সার্ভিস পাশ করতে দিল না | তোর বাবা আর আমি কত বোঝাতাম | শেষে একদিন তোর বাবা রেগে বলেছিল, ‘তুই ওই গল্প বইয়ের নেশা করে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করলি | আর তোর ঠিক সাগরেদ হয়েছে খোকন | তোরও কিস্সু হল না, ওটার দ্বারাও বড় কিস্সু হবে না |’ জানি না তাতেই হয়ত ওর কোনও অভিমান হয়েছিল | এ ছাড়া তো আর কোন কারণ ভাবতে পারি না |”
...

এই সব কথা ভাবতে ভাবতে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলাম বোধহয় | মা আবার কিছু জিজ্ঞাসা করল | পার্সেল শব্দটা শুনে “দাঁড়াও মা” বলে পার্সেলটা খুলতে গিয়েও রেখে দিলাম | তোতন কে ফোন করলাম | ও ফোন তুললে বললাম, “এই, আমি খোকন কাকু বলছি | কী হয়েছিল বড়দার ? আগে কোনও খবর কেন দিস নি ?” তোতন বলল, “আগে খবর কী দেব ? ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক – আমরা বুঝতেই পারি নি |”
আমি – “না, না, সব খুলে বল, মৃত্যু কী ভাবে হল | জানিস, তোর শ্রাদ্ধের চিঠির সাথে বড়দার পাঠানো একটা পার্সেল পেয়েছি ? এখনও খুলি নি | ওটাই বা কিসের ?”
তোতন – “ও, বাবা তাহলে তোমাকে বই পাঠিয়েছে | তুমি তো জানোই বাবার বই নিয়ে কী এক ঝোঁক ছিল ; আর দুঃখ, যে আমি বই পড়া ভালবাসি না | ক’মাস আগে বাবার মাথায় ঢুকল, বাবা মারা গেলে বইগুলোর কী হবে | রমা বলল সব বিলিয়ে দিতে | বাবা বলল, ‘তা করব না, আমি যাকে দেয়ার দিয়ে দেব |’  বাবা গত সোমবারে দুটো রিক্সা বোঝাই করে সব বই নিয়ে রওয়ানা দিল | ফিরল দুপুর দুটোয় – ঘেমে নেয়ে একসা, চোখ লাল | কোনমতে স্নান করে না খেয়েই শুয়ে পড়ল | গা গরম দেখে ডাক্তার ডেকে আনলাম | রমা ঘাবড়ে গিয়ে বাবাকে বলল, ‘কী দরকার ছিল বাবা, এত গরমে এই সব করার ? একটু বৃষ্টি নামলে হত না ?’ বাবা শুধু বলল, ‘যাক গে, যাকে যা বলার ছিল বলে দিয়েছি, যাকে যা দেয়ার ছিল দিয়ে দিয়েছি | আমার কাজ শেষ, এবার আমি শুধু আরাম করব, বিশ্রাম করব |’ কিন্তু সেই রাত্রি না কাটতেই বাবা চলে গেল | ভোর হলে আর ঘুম থেকে উঠল না ... এই হল ঘটনা ... তা, তোমরা আসছ তো, অন্তত তুমি আর কাকিমা ?”
আমি বললাম “দেখছি | কিন্তু, মায়ের যা অবস্থা, কী করে যে খবরটা ভাঙ্গব ... আচ্ছা, তোকে আমি জানাব | এখন রাখছি |”

কিছুক্ষণ ভাবলাম পার্সেলটা নিয়ে কী করব | মায়ের নামে, কিন্তু ভিতরে কী আছে না আছে না জেনে মাকে কী করে কিছু বলি | দেখার পর মা যদি ‘সঞ্জুর কী দরকার ছিল, এইসব পাঠানোর ?’ বলে বড়দার সাথে কথা বলতে চায় |

একটু ইতস্তত করে পার্সেলটা খুললাম | ভিতরে তিনটে বই, দুটো ইতিহাসের আর একটা “A Guide to The Civil Services Examination of Bihar” 1962 edition | তার ভিতরে একটা ভাঁজ করা চিঠি | চিঠিটা খুললাম –

শ্রীচরণেষু কাকিমা,
সর্বাগ্রে আমার প্রণাম নিও | ভালো আছ তো ? আমি বলেছিলাম না, যাকে যা দেয়ার দিয়ে যাব | আজ তোমার চক্ষুশূল সব বইগুলো বিদায় করব | ভেবেছিলাম খোকন কে বলব ‘এসে নিয়ে যা |’ কিন্তু সেদিন বইগুলোর মধ্যে তোমার ফেরত পাঠানো ওই বইটা পেলাম, যেটা খোকনকে কলেজের সময় দিয়েছিলাম, পরে তুমি ডাকে ফেরত পাঠিয়েছিলে | ওটা দেখে মনে হল, থাক, ওই বাঁদরটার গলায় মুক্তর হার দিয়ে লাভ নেই | আর, কে জানে, তুমি যদি আবার রাগ করো | তাই ওগুলো এখানকার বেঙ্গলী ক্লাবের লাইব্রেরিতে দিয়ে দেব | কথা হয়ে গেছে |
শুধু তিনটে বই পাঠাচ্ছি | ধানবাদে এসেই বিহার সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার জন্য কিনেছিলাম | জানি না এখন আর এগুলোর সমসাময়িকতা কত | তবুও যদি সমীরের কাজে লাগে | কাজে লাগবেই, আমার মন বলছে | আমার কাজে লেগেছিল | এক চেষ্টায় আমি পরীক্ষাটা পাশ করেছিলাম | ভেবেছিলাম একেবারে পোস্টিং পেলে গিয়ে তোমায় জানিয়ে, প্রণাম করে, আশীর্বাদ নিয়ে কাজে যোগ দেব | কিন্তু পোস্টিং হল তো হল রাঁচিতে | শুনেই তোমার বৌমার যত রাগ অভিমান,  ‘আবার ঘুরে ফিরে সেই কাকিমার আঁচল | না, আমি সেটা হতে দেব না | দরকার নেই এই চাকরির |’ তখন তোতন ওর পেটে | আমি শত বুঝিয়ে শেষে নিরুপায় হয়ে ছেড়ে দিই | তোমায় বলি নি | আজ এতদিন বাদে বলছি কেন না জানি যে, যাকে যা বলার না বলে আমি চলে যেতে পারব না | কবে যাব জানি না, কিন্তু তুমিই বলো, শেষ গতির কাজ শেষ অব্দি ফেলে রাখব কেন ?
তুমি এই নিয়ে আবার আমার উপর রাগ কোরো না | একবার করেছিলে, সে কথা ভেবে আজও বড় কষ্ট পাই |
আবার প্রণাম জানিয়ে শেষ করছি | খোকন, প্রতিমা, সমীর আর বৌমাকে আমার আশীর্বাদ জানিও |
ইতি
সঞ্জু


-------------------------------
২৩ মে ২০১৫ / © ইন্দ্রনীর

বৃহস্পতিবার, ১৪ মে, ২০১৫

ফেসবুকের অরণ্যে

|| ফেসবুকের অরণ্যে ||


সবাই চায় বন্ধু হতে, তুইও কি তাই চাস
তবে কেন এড়িয়ে চোখ লুকাস রে উচ্ছ্বাস
কেন রে তবে তুচ্ছ প্রশ্ন, কী বলে ডাকবি
আমি কি তোর বোন, দিদি, নাকি বান্ধবী
এই যে ভাবিস আমার পাতা সভা স্বয়ম্বর
দিবালোকে লিখিস সেথা, “তুমি কী সুন্দর”
আচ্ছা তুই ভাবিস কেন, আমি কচি মেয়ে
এক ইশারায় যাব গলে, ঢলব ঘেমে নেয়ে
না, না তোর ভাব গতিক নয়কো সুবিধের
দেখি এমনতর রোমিং রোমিও রোজ ঢের
সাহস থাকলে আয় আমার পাড়ার সাকিনে
হিসেব দিতে পিরিত কত আছে তোর মনে
কী বললি, “পিরিত ফিরিত বেকার ব্যাপার”
আমায় নিয়ে নেইকো তোর কোনও কারবার
ঠিক বুঝেছি, আমায় নিয়ে ধরেছিলিস বাজি
“মিয়া, বিবি নারাজ তো ক্যা করেগা কাজী”
আমার হালত সঙিন করে তুই দিবি চম্পট
ওরে ও হাড় হাবাতে, ও ধোঁকাবাজ লম্পট
যাচ্ছি আমি তোর পাতাতে লিখতে নিবেদন
“প্রথম প্রেমের পরিণতি – অরণ্যে রোদন” ||


------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৪ মে ২০১৫

বুধবার, ১৩ মে, ২০১৫

প্রশ্ন



|| প্রশ্ন ||


এক পশলা বৃষ্টি ঢেলে, তারপরই রোদ্দুর
চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, যেদিক, যদ্দুর
তোমার হাসি ছড়িয়ে, ভেজা ঘাসে ঘাসে
তোমার শ্বাসের সুগন্ধ বয় বাদলা বাতাসে
বুঝি আমি, বুঝি সবই, কেমন করলে মন
বায় উঠলে, আর সয় না বাঁধন, নির্যাতন
তখন নামে মেঘ না হতেই বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে
সৃষ্টি ওঠে ককিয়ে কেঁদে, ফুলে, ফুঁপিয়ে
কিন্তু তুমি সৃষ্টি তো নও, তুমি অনাসৃষ্টি
তবে কেন হাসি ভেঙ্গে নামাও পশলা বৃষ্টি ?


---------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৩ মে ২০১৫

রবিবার, ১০ মে, ২০১৫

অগ্রিম চিঠি

|| অগ্রিম চিঠি ||

নীলাকাশচারী লালপরী তুমি কেন নেমেছিলে নিচে
বলতে, “আমায় মা বলে ডাক”, জেনেও যে তা মিছে
আকাশ পাতাল মর্তভূমে ছড়িয়ে তোমার স্নেহাঞ্চল
পোষ মানিয়েছিলে বিবশ করে, যতই ছিলাম চঞ্চল
আমি হাসলেই ঠোঁট দুটি তোমার কাঁপত তিরতির
আমার দুঃখে ভরে উঠত তোমার দু’চোখে শিশির
তোমার নয়নে আমি হলে হারা, সবকিছু তোলপাড়
আবার আমায় খুঁজে পেয়ে তুমি জুড়াতে তোমার হাড়
তোমার রক্ত, তোমার মাংস, তোমারই অস্থি-মজ্জা
যা কিছু আমার সবই তোমার, বলতে নেইকো লজ্জা
মুখে শুধু কভু ফোটে নি তোমার শেখানো প্রথম বুলি
অযুত শব্দের মধ্যে কেন যে শুধু সেটাই ছিলাম ভুলি
জীবন কাটিয়ে, কখনও তোমাকে না মা বলে ডেকে
আজ শুনি কাঁদে মা মা বলে কেউ এই অধোলোকে
নীলাকাশচারী লাল পরী তুমি কবেই উবেছ ঈশ্বরে
শুধু চরাচর জেগে রয়েছে দেখ ওই একাকীর স্বরে
এখন আমি, মা, প্রস্তুত হচ্ছি আসতে তোমার কাছে
অগ্রিম চিঠি ডাকে দিলাম মা, ভুলে গিয়ে থাক পাছে ||


--------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১০ মে ২০১৫ – মাতৃদিবস

শুক্রবার, ৮ মে, ২০১৫

শান্তির মুখ

|| শান্তির মুখ ||

শঙ্কর বাবু, শঙ্কর সমাদ্দার, নিজের মনেই হাসলেন | সকালে বেড়াতে বেরলেই নানান কথা মনে পড়ে | আজ একটা কথা ভেবেই মনে পড়ল তাঁর বাবা বলতেন, “দেখ খোকা, যতদিন নিজের উপর হাসতে পারবি, হাসির অভাব হবে না |” তাই, শঙ্কর হাসলেন, কেন না তিনি রোজকার মত ভাবছিলেন, “আমার আর শান্তির মুখ দেখা হবে না |”

মুখ দেখার ব্যাপারটা পুরানো | উনি মুখ না দেখে সাবিত্রীকে বিয়ে করেছিলেন | তারপর ঘুম থেকে উঠে প্রথম তার মুখ দেখে পরম শান্তিতে তিরিশ বছর কাটিয়ে, বছর পাঁচেক আগে সাবিত্রী কোমরের নিচে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে, সেই শান্তি হারিয়েছেন |

ওই একই পাঁচ বছর আগে শুরু করা অভ্যাসে শঙ্কর ভোর সকালে হাঁটতে বেরন | তার মেয়াদ বাড়তে বাড়তে, এখন প্রায় দু’ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে | সমস্ত পথটাই – বনবিথী, লাবনি স্ট্রিট, উডরো স্ট্রিট, হরিদাসী লেন – সব পাড়া-ঘরের রাস্তা, ভোরে নির্জন | শুধু হরিদাসী লেনের শেষে বড় রাস্তা যানবহুল অশোক এভিনিউ  – সরু ফুটপাথ, প্রায়ই গাড়িঘোড়ার মধ্যে হাঁটতে হয় – কয়েক মিনিটই, তারপরই তিনি পার্কে ঢুকে পড়েন |

মাস খানেক আগে ঠিক ওই বড় রাস্তার মোড়ে তিনি প্রথম দেখেছিলেন মহিলাটিকে | পিছন থেকে - লম্বা, ঋজু, দোহারা শরীরটায় পিঠটা সামান্য সামনে বাঁকা | পরনে কমদামী সিনথেটিক শাড়ি | মাথার পিছনে সোজা করে আঁচড়ানো খোলা চুল টেনে একটা ছোট ক্লিপ দিয়ে গুছি করে ঝোলানো চামর | গায়ের রং ময়লাটে | কোমরে যেন সংসার খাটা মেয়েমানুষের  গতরের কাজে বিরামের প্রথম আভাস, এক রতি মেদ | শরীর অনুযায়ী বয়েস মনে হয় তিরিশের মাঝামাঝি | মহিলাটি কাঁধে ব্যাগ, হাতে মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বাহনের অপেক্ষায় | শঙ্কর তার পিছন দিয়ে যেতে যেতে তার মুখটা দেখতে না পেয়ে অনুমান করার চেষ্টা করেছিলেন |

এটা তাঁর এক রকম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে | মেয়েমানুষের মুখ না দেখলে তাঁর মনে কী যেন একটা অশান্তি  লেগে যায় | আসলে, সাবিত্রী শয্যাগত হওয়ার পর থেকে শঙ্কর বেড়িয়ে ফিরলেই খুঁটিনাটি জানতে চান | চেনা অচেনা কার সাথে দেখা হল ? এমন তো হয়না যে পথে ঘাটে শুধু পুরুষমানুষই ঘুরে বেড়ায় | মেয়েমানুষও ছিল নিশ্চয় ! তেমন কেউ চোখে পড়েছিল কি ? সকলের কথাই বলতে হয় | চেপে গেলে তাঁর মুখ দেখে সাবিত্রী বুঝতে পারেন | শুধু বলেন, “কিছু ভুলে যাও নি তো ?” তাই, তাকে বলে বলে এমন হয়েছে যে এখন কিছু না বললে শঙ্করের মনে একটা অশান্তি খটখট করে |

সেইদিন প্রথম দেখার পর থেকে অশান্তিটা প্রায় নিত্যকার হয়ে উঠেছে | রোজই দেখেন একই ভাবে বড় রাস্তার মোড়ে তাঁর শান্তির উৎস  দাঁড়িয়ে আছে, হরিদাসী লেনের দিকেই তাকিয়ে | রোজই দূর থেকে মনে হয় কাছে এলে তার মুখটি দেখতে পাবেন | কিন্তু কাছে পৌঁছানোর একটু আগে সে তার মুখটা বড় রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে নেয় ... কখনও মুখের সামনে মোবাইলটা তুলে ধরে সেলফি তোলার ভঙ্গিতে | বেশ বড় সাইজের মোবাইল | তিনি মনে করেন সে যেন সব ইচ্ছে করেই করে | তাই শান্তির  পিছন দিয়ে যেতে যেতে তার মুখটা দেখতে না পেয়ে শঙ্কর অনুমান করার চেষ্টা করেন |

একদিন একটু সুযোগও হয়েছিল, কিন্তু সুযোগটা নিতে পারেন নি শঙ্কর | সেদিন উনি কী ভাবে কয়েক মিনিট আগে বেরিয়ে পড়েছিলেন | হরিদাসী লেনে পা দিয়েই দেখলেন ক’ পা আগে শান্তি  এগোচ্ছে বড় রাস্তার দিকে | মন্থর গতিতে সে চলেছে মাথা একটু নিচু করে | সেই ঋজু শরীরের শ্লথ গজগতির দিকে তাঁর দৃষ্টি আটকে গেলে শঙ্কর একটু অস্বস্তি বোধ করলেন |  ওখান থেকে বড় রাস্তা প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ | ততক্ষণ ঠিক এই ভাবে নির্জন রাস্তায় একটি মহিলার পিছন পিছন যাওয়া ঠিক মনে হল না | তিনি একটু গতি বাড়ালেন | শান্তির পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে ফুটপাথ ছেড়ে পথে নেমে তিনি চাইলেন আড়চোখে একবার তার মুখটা দেখেন | কিন্তু অদ্ভুত এক আড়ষ্টতায় তাকানো হল না |

সেদিন বাড়ি ফিরে শঙ্কর হাতঘড়িটা সাত মিনিট এগিয়ে দিলেন | কিন্তু আড়ষ্টতা রয়েই গেল | ক’দিন পরে অপরাধ বোধে আবার ঘড়ির সময়টা ঠিক করে নিলেন | তাঁদের প্রহসন এই ভাবে চলল – তিনি দূর থেকে শান্তিকে তাঁর আসার পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন (সত্যিই কি তাই ?) | কিন্তু তার কাছে পৌঁছাতেই সে এক অস্থির ভঙ্গিতে তার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে রাস্তার দিকে তাকায় | প্রায়ই ওই সেলফি তোলার ভঙ্গিতে মোবাইলটা মুখের সামনে তুলে ধরে ; কানের পাশে চুল গুঁজে নেয় ; কপালের টিপ ঠিক করে | ক্রমে ক্রমে শঙ্করের মনে একটা কেমন সন্দেহ দানা বাঁধল | তাহলে কি শান্তি তাঁর অভিপ্রায় জেনে ফেলেছে ? তাহলে তো তার মুখটা কোনদিনই দেখা সম্ভব হবে না | ভারী মুশকিলের কথা ! এই ভাবে কতদিন সবিত্রীকে না বলে থাকা যায় ?

আরও একটা ব্যাপার জানার ছিল | ওই শান্তির চুলের ক্লিপটার রংটার নাম কী | খুব উজ্জ্বল সবুজের মধ্যে কালচে ছোপ, সকালের প্রথম রোদে কালো চুলের মাঝে জ্বলজ্বল করে  | ক’দিন ধরেই ভাবছেন পাশের বাড়ির পিপিলী কে জিজ্ঞাসা করবেন | ছ’বছরের মেয়েটা একবার তাঁকে বুঝিয়েছিল হালকা রানী-কল্যর আর বেবি-পিঙ্কের মধ্যে তফাত কী | ওই  ঠিক বলতে পারবে এই জ্বলজ্বলে সবুজ রংটার নাম |

সপ্তাহ খানেক পরে শঙ্কর নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে ঘড়িটা দু’মিনিট পিছিয়ে দিলেন | সেদিন সাক্ষাত না হওয়ায় বুঝলেন শান্তি হয়ত ওই মোড়ে মিনিট কয়েকের জন্যই দাঁড়ায় | শঙ্কর আবার ঘড়িটার সময়টা ঠিক করে নিলেন | এর পরই একদিন দূর থেকে দেখলেন একটা রেড ক্রস চিহ্নের গাড়ি এসে দাঁড়াল | শান্তি শাড়ি একটু তুলে গাড়িতে উঠে পড়ল, গাড়ি ছেড়ে দিল |

আজ শঙ্কর একটু আগে বেরিয়েছেন | খুব ভোরে উঠে পড়েছিলেন | আসলে, গত সন্ধ্যা থেকে শরীরটায় একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি | ঘুম উবে গেছে | পা দুটো ভারী, আর ঘাড়ের পিছনে একটা জমাট বাঁধা কষা চাপ | গাটা ঘামে ভিজে থাকছে | শুনে সাবিত্রী বলে দিয়েছেন আস্তে আস্তে হাঁটতে, আর বেশি দূরে না যেতে | তাই, ইচ্ছে পার্কের গেট অব্দি গিয়ে ফিরে আসবেন | শরীরের কথাই ভাবতে ভাবতে শুনতে পেলেন আগন্তুক এক মোটরসাইকেলের আওয়াজ | চোখ তুলে দেখে চমকে উঠলেন | তাঁর ফুটপাথের উপর হেডল্যাম্প জ্বেলে সবেগে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসছে একটা ছেলে | ভীষণ রাগ হল | ছেলেটা কাছে এসে একটু গতি কমালেও শঙ্কর ছিটকে এক পাশে সরলেন | ছেলেটাকে কড়া ধমক দেয়ার আগেই সে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে ফের গতি বাড়াল |

মোড়ের কাছে এসে শঙ্কর দেখলেন রেড ক্রস চিহ্নের গাড়িটা দাঁড়িয়ে | শান্তিকে দেখতে পেলেন না | মাথা পিছনে ঘুরিয়ে দেখলেন হরিদাসী লেন দিয়ে শান্তি আসছে, সেই একই মন্থর গতিতে, মাথা নামিয়ে | শঙ্কর একটু ইতস্তত করে এগোলেন পার্কের দিকে | ওদিকে মগজে ওই মোটরসাইকেল চালককে কিছু বলতে না পারার চাপা ক্ষোভ মাথা চাড়া দিচ্ছে | হটাত মাথাটা একটু টলে উঠল | কিছুদূর এগিয়ে আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন, যাক, শান্তি গাড়িতে উঠছে, তাঁর দিকে তাকিয়ে |

গাড়ির ড্রাইভার মদন বলল, “বাসন্তী, কী দেখছিস ? ওঠ তাড়াতাড়ি |”
বাসন্তী বলল, “ওই যে দেখছিস না, সামনে | নীল গেঞ্জি |”
মদন – “ও ... এই তোর রোজকার বুড়োটা ?”
মদন গিয়ার দিয়ে ক্লাচ ছাড়তে ছাড়তে বলল, “বাবা, ও যে টলছে রে | সকাল সকাল গিলেছে নাকি ? যদি বলিস তো একটু সাঁটিয়ে দিই |”
বাসন্তী – “কী সাঁটিয়ে দিবি ?”
গাড়িটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল | কয়েক বারের চেষ্টায় স্টার্ট করে গিয়ার দিতে দিতে মদন বলল, “সাঁটিয়ে মানে, গাড়িটা একটু বুড়োটার গা ঘেঁষে চালিয়ে দেব ... জাস্ট একটু ভয় দেখানোর জন্য | তুই খালি জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে তাকাস, যাতে তোকে দেখে বুড়োটা বুঝতে পারে |”
বাসন্তী আঁতকে বলল, “যাহ ! না, না | নিরীহ একটা লোক – একটু তাকানোর দোষ আছে হয়ত |”

শঙ্কর যেতে যেতে আবার ঘুরে তাকালেন – গাড়িটার এতো কেন দেরী হচ্ছে ? এতক্ষণে তো তাঁর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা | ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়িটা দেখতে গিয়েই তাঁর মাথা ঘুরে গেল | ভারসাম্য হারিয়ে ফুটপাথের ধার থেকে রাস্তায় পড়তে পড়তে দেখলেন, এক্কেবারে কাছে এসে যাওয়া গাড়িটা খুব জোরে ব্রেক কষে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল | তারপরই তাঁর দু’চোখে অন্ধকার নেমে এলো |

যখন জ্ঞান ফিরল, প্রথমে বুঝতে পারলেন না তিনি কোথায় | খাটে শুয়ে আছেন | হাতের আঙ্গুলে কিছু ছোট ছোট চিমটি লাগানো, যার থেকে এক গাদা তার গিয়ে একটা স্ট্যান্ডে ঝোলানো স্ক্রিনের নিচে ঢুকেছে | কালচে স্ক্রিনে সবুজ রেখা উঠে পড়ে আঁকিবুঁকি কাটছে | ছাতে পরপর অনেক পাখা ঘুরছে | মাথা কাত করে দেখলেন আসে পাশে অনেক লোক
খাটে শুয়ে | তাহলে তিনি হাসপাতালে ! কটা বাজে ? কতক্ষণ তিনি বাড়ির বাইরে ? সাবিত্রী কি খবর পেয়েছে ? কিন্তু ... শঙ্কর আর চিন্তা করতে পারলেন না, একটা অসম্ভব অবসন্নতা শরীরে চেপে আছে | খুব তেষ্টাও পেয়েছে |

বোধহয় তাঁর নাড়াচাড়া দেখে একজন ডাক্তার এগিয়ে এলো | নাড়ি ধরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “কেমন বোধ করছেন  এখন ?”
শঙ্কর একটু মাথা নেড়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “বাড়িতে কি খবর দেয়া হয়েছে | আমার স্ত্রী তো পক্ষাঘাতে পঙ্গু, একা আছে | আর কেউ নেই |”
ডাক্তার বলল, “দেখছি ... আগে বলুন এখন কেমন লাগছে |”
শঙ্কর বললেন, “খুব দুর্বল | বেজায় তেষ্টা পেয়েছে | একটু জল পাব ?”
ডাক্তার ডাক দিল, “বাসন্তী, এনাকে এক গেলাস খাওয়ার জল দিন |”
একটা নার্স পাশে এসে বলল, “উঠে বসে খেতে পারবেন. না আমি খাইয়ে দেব ?”
শঙ্কর দেখলেন একটা ময়লা কমনীয় চেহারা – কিন্তু তারই মধ্যে পুরু ঠোঁটে, উঁচু হনুতে আর গালে মাথা উঁচানো কিছু বিদ্রোহী ব্রণে ফুটে উঠেছে একটা তীব্র কামনার আভাস | বিব্রত হয়ে বললেন, “একটু উঠিয়ে বসিয়ে দাও মা | দেখি চেষ্টা করে |”
বাসন্তী বুকের সামনের চুলের গোছা এক ঝটকায় পিছনে ফেলে ঘুরে চলে গেল জল আনতে | শঙ্কর দেখলেন তার পিঠে সাদা গাউনের উপর সোজা করে আঁচড়ানো খোলা চুল টেনে একটা ছোট ক্লিপ দিয়ে গুছি করে ঝোলানো চামর | ক্লিপটা খুব চেনা – কালচে ছোপ ছোপ উজ্জ্বল সবুজ রঙের |  শঙ্কর মনে মনে ভাবলেন বাড়ি ফিরে বলবেন, “সাবিত্রী, যে নার্সটা আমাকে দেখছিল তার নাম বাসন্তী | তাকে দেখতে মোটেও ভালো নয় |” সাথে সাথে পরম শান্তিতে তাঁর মন ভরে উঠল |

একটু পরে বাসন্তী এক গেলাস খাওয়ার জল এনে দেখল বুড়োটার মাথাটা নেতিয়ে বালিশ থেকে পড়ে গেছে |


--------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৮ মে ২০১৫

সোমবার, ৪ মে, ২০১৫

চারু বাক্ সুখ

|| চারু বাক্ সুখ ||


দরিদ্র পণ্ডিত মশাইয়ের সংসার ছোট – পণ্ডিত, তাঁর স্ত্রী ও এক ছোট ভাই | তবুও চাল আনতে ডাল ফুরয়, ডাল আনতে নুন – পণ্ডিত বাড়ি বলে পান্তা খাওয়ার চল নেই | ভাই এত ছোট যে সে এখনও উপার্জন যোগ্য নয় | তাই
পণ্ডিতের স্ত্রী বড়ই অসুখী | এমন নয় যে পণ্ডিত স্ত্রীয়ের কষ্ট বোঝেন না | কিন্তু অর্থাভাবের মধ্যে যা সম্ভব, মাঝে মাঝে স্বল্পশিক্ষিতা স্ত্রীকে দর্শন বুঝিয়ে গ্লানিমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন | ফল হয় না |

একদিন স্ত্রী পণ্ডিতকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁগা, ঠাকুরপোর বিয়ে কবে দেবে ?” পণ্ডিত পান চর্বণ করতে করতে চার্বাক দর্শন পাঠ করছিলেন | কিছু বললেন না, শুধু ভ্রুকুটি করে একবার দৃষ্টি ক্ষেপণ করলেন, যার অর্থ, “এখন জ্বালিও না |”

কিছুদিন পরে স্ত্রী আবার সেই প্রশ্ন করলেন | পণ্ডিত তেমন ব্যস্ত না থাকলেও আগামী দিনগুলির আয় ব্যয়ের চিন্তা করছিলেন | অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিলেন, “এখনও ওর বয়েস হয় নি | হলে দেখব খন |”

ক’দিন গেলে আবার সেই প্রশ্ন | রাত্রে শুয়ে কথা হচ্ছিল | এড়ানোর উপায় না পেয়ে, পণ্ডিত বিরক্ত হয়ে বললেন, “ওর বিয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছ কেন ? আরেকটা বউ আনলে খাওয়াবে কে শুনি ? আর তোমার তাতে কী লাভ হবে ?”
স্ত্রী গা ঘেঁষে বললেন, “তাহলে একটু সুখে থাকব |”
পণ্ডিত অবাক হলেন, “সুখে ... বলি ব্যাপারটা কী ?”
স্ত্রী বললেন, “কেন, তুমিই তো বলো, ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, জা বৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’ | তা ধার করে ঘি নাই বা খাওয়ালে, জা হয়ে দুই বৌয়ে সুখে তো থাকব |”







------------------------------------
© ইন্দ্রনীর ০৪ মে ২০১৫

শুক্রবার, ১ মে, ২০১৫

সুয়ো-দুয়ো

|| সুয়ো-দুয়ো ||

লাল টুকটুকে বউ আনতেই
মা বলল, “আয়, শুবি আয় ”
অমনি নতুন কনের উঠলো
নেকি নাকি সুরে বেদম বায় –

“আমায় যখন আনলে ধরে
ছাড়ো তখন তোমার মাকে |
নইলে দিলাম দিব্যি - ঠাকুর
করবেন না খ্যামা তোমাকে

বিয়ে না হতেই হলাম দুয়ো
যাই ফিরে তবে বাপের বাড়ি
তোমার আমার আজ থেকে
হোক জন্ম-জন্মান্তরের আড়ি”

বলে, মুখ কালো হাঁড়ি করে
বউ চলে গেল নিজের গাঁয়ে
আমি কী আর বলব রে ভাই 

কেঁদেছি আনাড়ি হবার দায়ে

বোঝাল মা, “পেটে ধরেছি,
রেখেছি আজ অব্দি কাছে
আজকে তোর বিয়ে হয়ে
সবই কি তুই করবি মিছে ?

মাদুর ছড়িয়ে, কাঁথা পেতে,
দিয়ে মাথার তলায় বালিশ
কত তোকে তেল মাখিয়ে
গাটা মলে করেছি মালিশ |

পেটের ভিতর, কোলে পিঠে
থাকিস না মেরে যতই লাথি
যতই আনিস টুকটুকে সই
আমিই যে তোর জনমসাথী”

মায়ের মুখে তাকিয়ে দেখি
বৌয়ের চেহারা মা’রই মত
দেখেই চোখ জলে ভেজে,
মায়ের পায়ে হয় মাথা নত

যাই ছুটে আমি শ্বশুর বাড়ি
বলি ধরে তার হাতে পায়ে
“বউ না সই, মায়ের মতই
থাকবে চলো আমার সায়ে”

এখন আমার সই জোড়া মা
সাদা থানে, আর লাল পাড়ে
নেই সুয়ো-দুয়োর রেষারেষি
দু’জনেই আমার মন কাড়ে ||


-----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০১ মে ২০১৫