শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৪

পদাতিক পিপীলিকা

|| পদাতিক পিপীলিকা ||


পদাতিক পিপীলিকা, দেয়ালে এঁকে রেখা
চলেছে সুদীর্ঘ অজানা পথে কী তীর্থযাত্রায়
আমার কপালে লেখা, তাই শুধু একা একা
অস্থির হয়ে আছি মরুতীর্থের বালুকা বেলায়

হাতের মুঠোয় বালু, চুলে হাওয়া আলুথালু
তারই অশান্ত ঢেউয়ে এই শরীর আছড়ায়
শূন্য দেয়াল বেয়ে, ওরা যে চলেছে ধেয়ে
কোন অজানা দেবের ডাকে আবদ্ধ মায়ায়

এক পঙক্তির শৃঙ্খলা, সারিবদ্ধ ভক্তির মালা
সুদূর লক্ষ্যে নিবদ্ধ স্নিগ্ধ, স্মিতহাস্য দূরদৃষ্টি
আমার হাতে অঞ্জলি, কিছু রৌদ্রে তপ্ত বালি
পূজার মন্ত্র ভুলে করি যত পাপের অনাসৃষ্টি ||


----------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩১ জানুয়ারি ২০১৪

রবিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৪

অন্বেষণ

আরামবাটী থেকে ফেরার ট্রেন ছিল বিকেল সাড়ে পাঁচটায় | উঠে একটা জানলার ধারে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম | গাড়িটা ছাড়লে জানালা দিয়ে হুহু করে ধান ক্ষেতের মেঠো হওয়া ছুটে এলো | গাড়ির গতিকে অগ্রাহ্য করে জানালা দিয়ে ঢুকে আমার গায়ে মুখে এমন হানা দিল যে তার উৎপাতে না বলে চলে আসা কিছু কথা মন থেকে আবছা হয়ে হারিয়ে যেতে লাগল | বিরক্ত হয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম, চোখ বুজে কথাগুলো ভাববার জন্য | বন্ধ জানালার বাইরে হাওয়াটা তীক্ষ্ণ সুরে ঘুম পাড়ানি গান শুরু করল | ঘুম পেতে পেতে পারুলের কথা মনে পড়ল, বাড়ি গিয়ে ওকে সব বলতে হবে |

আমি আর পারুল আমরা সারাদিনের সব কথা গল্প করি | কোনও কথা বাদ যায় না | নতুন কোন আলাপ হলে তা নিয়েও কথা হয় | আমার ক্ষেত্রে সেই জন কোন স্ত্রী হলে পারুল আমার মুখ দেখে টের পায় | তাই মনে মনে আমি আগেই কথা সাজাই যে বাড়িতে গিয়ে পারুলকে কী বলব | আজ হয়ত পারুলের সাথে আমার কথা হবে এই ভাবে –
পারুল – “কেমন দেখলে সব ?”
আমি – “কোথায় ?”
পারুল – “আরামবাটীতে | ভদ্রমহিলাকে পেলে ?”
আমি – “হ্যাঁ |”
পারুল – “কে কে আছে বাড়িতে ?”
আমি – “ওর কেউ ছিল না |”
পারুল – “কেন ?”
আমি – “বাড়িটা ওর নয় |”
পারুল – “তাহলে কার ?”
আমি – “ওর দিদি, জামাইবাবুর |”
পারুল – “আর ওর বর ? তাকে দেখলে না ?
আমি – “না |”
পারুল – “ওর বর ছিল না ? নাকি নেই ?”
আমি – “হ্যাঁ ?”
পারুল – “কী হল ? তুমি মুখ ফুটে কিছু বলবে ? নাকি হ্যাঁ, না দিয়ে কাজ সারবে ?”
আমি – “বলছি তো ... জানো, ওর নাম শেফালী নয় | ওর নাম শিউলি | শেফালী ওর দিদির নাম |”
পারুল – “বাহ | বেশ মিষ্টি নাম তো | দেখতে কেমন ?’
আমি – “সেটা নিয়েই তো মুশকিল ... মানে বলা মুশকিল |”
পারুল – “কেন ? তুমি ভালো করে দেখনি বুঝি ?
আমি – “দেখেছি | কিন্তু তোমাকে বলার মত করে দেখিনি |”
পারুল – “তাহলে কাকে বলার মত করে দেখেছ ?”
আমি – “কাউকে বলার মত করে নয় |”
পারুল – “এ আবার কেমন কথা ?”
আমি – “বলছি ... মনে করো, ওকে দেখতে ওর মায়ের মত |”
পারুল – “কিন্তু ওর মাকে তো আমি দেখিনি |”
আমি – “আমি দেখেছি | ওনার বয়েস হয়েছে, মুখে তার ছাপ | তারই সাথে একটা দুঃখ কোথাও লুকিয়ে আছে ওনার চেহারার মধ্যে |”
পারুল – “তুমি বললে ওর কেউ ছিল না ওখানে |”
আমি – “না আমি বহরমপুরের কথা বলছি | বহরমপুরে ওর বাবা মা থাকে |”
পারুল – “তুমি বহরমপুরে গিয়েছিলে ?”
আমি – “আজ নয় | আগে, কিছুদিন আগে বহরমপুর গিয়েছিলাম | কাজে |”
পারুল – “কই, আমায় তো বলনি |”
আমি – “তুমি থাকলে তো |”
পারুল – “ও |”
আমি – “কী বলছিলাম ? হ্যাঁ, ওর মায়ের চেহারা প্রতিমার মুখের মত | আর ওকে দেখতে ওর মায়ের মত | এবার বুঝতে পারছ ?”
পারুল – “না | তুমি সোজাসুজি বলো না, শিউলিকে কেমন দেখেছ |”
আমি – “আমি শুধু ওর চোখ দুটো দেখেছি |”
পারুল – “ধ্যাত ! আমি কাউকে দেখে ওরকম বলতে পারি, ‘আমি শুধু ওর চোখ দেখেছি’ ? ... কেন, ওর চিবুক, ঠোঁট, গাল, কপাল ?”
আমি – “না | আমি যতবার ওর মুখের দিকে তাকিয়েছি, শুধু ওর চোখ দুটো নজরে পড়েছে | অতল গভীর থিতানো চোখ নিয়েই যেন ওর সারা চেহারাটা | সেই চেহারায়, ওর চিবুকে, গালে, কপালে ছড়ানো ওর ঠোঁটে আটকে থাকা একটা বিব্রত হাসির সংকোচ |”
পারুল – “তোমার ভাল লেগেছে ?”
আমি – “কী ?”
পারুল – “যা দেখেছ, যেটুকু দেখেছ |”
আমি – “জানি না |”
পারুল – “তুমি কি সত্যি গিয়েছিলে ?”
আমি – “হ্যাঁ | কেন সন্দেহ করছ ?”
পারুল – “কই টিকিটটা দেখি |”
আমি – “টিকিট ?
পারুল – “হ্যাঁ | টিকিটটা দেখি |”

কেউ ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলল, “ও মশাই ! ঘুমের ঘোরে কী বলছেন ? দেন দেখি, টিকিটটা |” উত্তর না দিয়ে টিকিট দেখালাম | টিটিই চলে গেল |

আশেপাশের যাত্রীদের কৌতূহলী চোখ এড়াতে বন্ধ জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে তাকালাম | বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার | তার মধ্যে একমাত্র ছবি কাঁচে কামরার প্রতিফলন | সেই ছবির ভিতর দিয়ে কামরার আলো বাইরে একটা চৌকো আলোর মালা গেঁথেছে, যেটা অসমান জমির গায়ে কোথাও লাফিয়ে উঠে, কোথাও আছড়ে পড়ে, ছুটে  ছুটে চলেছে ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে | কামরার প্রতিফলনের পিছনের অন্ধকারে ছেয়ে আছে শিউলির মুখ | মুখ না মুখের বাদল, অসীম যার ব্যাপ্তি | তার মেঘে মেঘে বাকি সব অস্পষ্ট | ওর চোখ, বিশেষ করে ওর অতল গভীর চোখের তারা মিলিয়ে গেছে সেই মেঘের সম্ভারে | হয়ত ওর চোখের তারার আলো দেখা যাবে জানালাটা খুললে আকাশের তারায় | কিন্তু ভয়, আকাশ হতে তারার বর্ষা, আর খোলা জানালার সুযোগ নিয়ে ছুটে আসা ওই ধান ক্ষেতের বাদলা হাওয়া আমার চিন্তাধারাকে বিহ্বল করে দেবে | স্বপ্নটা কেটে যাবে |

আমি আবার চোখ বুজলাম পারুলের সাথে কথাটা শেষ করতে |

আমি – “কেন তুমি জানতে চাইলে আমি গিয়েছিলাম কিনা ?”
পারুল – “কেন না আমি দেখছি তুমি কিছু না নিয়েই ফিরে এসেছ |”
আমি – “কী নিয়ে আসতে হত ?”
পারুল – “ওর পরিচয় |”
আমি – “পরিচয় হয়নি ভাবছ ?”
পারুল – “না | দেখছি শুধু আলাপ হয়েছে |”
আমি – “আলাপ আর পরিচয়ের মধ্যে পার্থক্য ?”
পারুল – “অনেক | আমার তোমার সাথে পরিচয় আছে, শিউলির, শুধু আলাপ |”
আমি – “কী করে বলছ ?”
পারুল – “আমি জানি তুমি যা চাও | শিউলি কী জানে তুমি কী চাও ?”
আমি – “বলো, আমি তোমার কাছে কী চাই |”
পারুল – “আমার কাছে বলে নয় | তুমি যা চাও তা চাও – কি আমি, কি শিউলি |”
আমি – “সেই যুক্তিতে তো তুমি আর শিউলি এক |”
পারুল – “বা রে | তা কী করে হবে ?”
আমি – “হবে না ? ... হয়ত নয় | সে কথা কি আমি জানি ? আমি কি জানি আমি কী চাই ? যদি কেউ বলে দিত ...”
পারুল – “আমি তো কত চেষ্টা করলাম | এখন হয়ত শিউলি পারবে |”
আমি – “কী ভাবে ?”
পারুল – “পরিচয় করে দেখো | ওকে জানো | আরও, আরও জানো |”
আমি – “তুমি যদি জানতে তো দিলে না কেন ?”
পারুল – “কী দিলাম না ?”
আমি – “যা আমি চাই |”
পারুল – “হয়ত কোথাও খটকা ছিল যে সেটা দেয়া আমার পালা নয়, অন্য কারোর |”
আমি – “শুধু খটকা ?”
পারুল – “নয় ভবিতব্য |”
আমি – “ভবিতব্য কী ভাবে ?”
পারুল – “কেন না যখন আমি অপারগ হয়েছি, আমরা, অন্তত আমি, বাস্তবে যে শিউলি আছে সে কথা জানতাম না | না হলে হয়ত ...”
আমি – “কিসে অপারগ ?”
পারুল – “তোমাকে তোমার জীবনের শেষ পাওয়া পাইয়ে দিতে | এখন হয়ত সেটা হবে |”
আমি – “তুমি কি আমাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছ ?”
পারুল – “না | জেগে ওঠো | দু’চোখে চেয়ে দেখো |”
আমি – “তাই তো করতে গিয়ে, দু’চোখ দিয়ে, দু’চোখে চেয়ে ...”

সহযাত্রীদের ব্যস্ততায় স্বপ্নটা কেটে গিয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল | দেখলাম ট্রেনটা বর্ধমানে ঢুকছে | রাত হয়ে আসা প্ল্যাটফর্মে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় অশান্ত যাত্রীরা উসখুস করছে ট্রেনটা থামার জন্য | একটু ধাক্কাধাক্কি করে নামতে হল | বাড়ির তালা খুলে ঢুকে বাতি জ্বেলে দেখলাম দেয়াল ঘড়িতে প্রায় এগারোটা | হাত মুখ ধুতে গিয়ে বাথরুমের আয়নায় মুখ দেখলাম | একদম অচেনা চেহারা | এমন অচেনা, মনে হল খুব পরিচিত লোকও চিনতে পারবে না আমাকে এই মুহূর্তে | মুখের উন্নত অংশের ছায়া অবনত অংশে | অনেক ভাঁজ আর রুক্ষতা সর্বত্র ছড়িয়ে | আমার মধ্যে আর আমি নেই | জামাকাপড় বদলাতে গিয়ে দেখলাম সব কিছু ধুলোয় ভরে আছে | বিছানায় ধুলো | চাদরে ধুলো | নিজের শরীরের দিকে আর তাকালাম না | বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম |

ভেবেছিলাম স্বপ্নে কথা হবে না জানি কার সাথে | স্বপ্নে কেউ দেখা দিল না, এক যিশু ছাড়া | সেও শুধু একবার চোখ খুলে ভুরু কুঁচকে একটু দেখে, আমায় কি না জানিনা, মুখ আধ-ফাঁক করে জিভ ভেংচে ছোট্ট একটা হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়ল | আমিও তাই করার চেষ্টা করলাম | সব কিছুই নকল করলাম, কিন্তু অনেক হাই তুলেও বুক ভরল না | বুকের ভিতরের ফাঁকা ভাবটা থেকেই গেল | ভাবলাম যিশু কে দেখতে শিউলি আসবে | শিউলি এলোও, কিন্তু আমার দিকে পিঠ করে বসে যিশুকে কোলে শুইয়ে খাওয়ানোতে মন দিল | আমি আর যিশু কে দেখতে পেলাম না | শুধু শিউলির কোমরের এক পাশে দেখলাম মাঝে মাঝে যিশুর ছোঁড়া পায়ের আস্ফালন | আর, তাই থামাতে ফলের ভারে গাছের ডালের মত শিউলিকে পিঠ বেঁকিয়ে সামনে নুইয়ে যেতে | একটু পরে শিউলি হাঁটু দুলিয়ে যিশুকে ঘুম পাড়াতে লাগল | তাই দেখতে দেখতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম |

পরদিন অফিসে অজিতকে এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভেবে কোন লাভ দেখলাম না | অজিতকে এড়িয়ে আমার বরঞ্চ ক্ষতি হবে, কেন না গত রাত্রের পারুলের সাথে কথার হেঁয়ালির থেকে যাবে | শেষে নিজের সাথেই একটা বোঝাপড়া করলাম | অজিত আরামবাটীর সব কথা, আমার কথা, মন দিয়ে শুনল | শুনে চুপ করে থাকলে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী রে | কিছু বলবি না ?”
অজিত – “এই যে তোর বর্ণনা, ‘শিউলি কে দেখতে কেমন জানি না, আমি শুধু ওর চোখ দেখেছি’ – সত্যি করে একটা কথা বলবি ?”
আমি – “কী ?”
অজিত – “তুই ওর মধ্যে কী খুঁজছিস ?”
আমি – “কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করছিস ?”
অজিত – “কেন না, যখন কেউ কিছু খোঁজে কারো অন্তরে, তখন সে তার বাইরের রূপটাকে ঠিক করে ঠাহর করে দেখে না |”
আমি – “আমি তো কোনও ভাবে ওকে খুঁটিয়ে দেখিনি |”
অজিত – “তুই এটা তো মানছিস, যে তুই কিছু খুঁজতে গিয়েছিলি ?”
আমি – “হয়ত |”
অজিত – “পেলি ?”
আমি – “যা পেলাম তা শিউলির মধ্যে নয় |”

আমাদের কথার মাঝে বেয়ারাটা চা দিয়ে গেল |

অজিত – “তুই বলছিলি, তুই যা খুঁজতে শিউলির কাছে গিয়েছিলি তা পেলি, তবে শিউলির মধ্যে নয় | কোথায় পেলি ?”
আমি – “যিশুর মধ্যে |”
অজিত – “যিশু ?”
আমি – “হ্যাঁ | শিউলির ছেলে |”
অজিত – “কত বড় ?”
আমি – “মাস খানেক |”
অজিত – “তাহলে তো তুই যা পেলি তা প্রথম দেখায় শিউলির মধ্যে ছিল | তখন কি তুই তা খুঁজছিলি না ?”
আমি – “আমি তো বহুদিন ধরে খুঁজে আসছি | শিউলিকে যখন দেখলাম, তার খোঁজ পেয়েও বুঝতে পারিনি |”
অজিত – “আর, এখন তা শিউলির মধ্যে নেই ?”
আমি – “না নেই |”
অজিত – “তুই কি আবার শিউলির কাছে যাবি ?”
আমি – “তুই দুটো জিনিস গুলিয়ে ফেলছিস | আমি খুঁজছিলাম কিছু | প্রথম দেখায় শিউলির মধ্যে হয়ত তার খোঁজ পেয়েও বুঝি নি | তাই গিয়েছিলাম শিউলির কাছে | ওর কাছে গিয়ে যা পেলাম, তা ওর মধ্যে পেলাম না |”
অজিত – “যিশুর মধ্যে পেলি ?”
আমি – “ঠিক |”
অজিত – “এরপর তুই কোথায় খুঁজবি ?”
আমি – “কী ?”

অজিত একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপ করে থাকলে আমি পারুল কে মনে মনে ডেকে আলোচনাটা চালিয়ে গেলাম |

পারুল – “এরপর তুমি কোথায় খুঁজবে ?”
আমি – “কী ?”
পারুল – “যা খুঁজছ | আমাকে তো বলোনি কী খুঁজছ |”
আমি – “সেটাই তো বুঝতে পারছি না, নিজে নিজে একা একা |”
পারুল – “কী বুঝছ না ?”
আমি – “যা আমি খুঁজছি, হয়ত তাই আমি শিউলির মধ্যে দেখেছি, তখন | এখন নেই | আবার যদি সেই জিনিস শিউলির মধ্যে খুঁজি তাহলে সেটা কি শিউলিকে খোঁজা হবে না ? যাই খুঁজছি তার জন্য একই মানুষ কে, বা একই মানুষের মধ্যে, কতবার খুঁজব ?”
পারুল – “তুমি আমার মধ্যে সেই জিনিস খুঁজবে না ?”
আমি – “না | আমি তো ওর মধ্যে এমন কিছু খুঁজতে গিয়েছিলাম যা তোমার মধ্যে পাইনি | ছিল কি ?”
পারুল – “আমি জানি না তুমি আমার মধ্যে কী খুঁজেছিলে |”
আমি – “কিন্তু কাল তুমি যে বললে, তুমি জানতে আমি কী চাই ?”
পারুল – “আমি ভেবেছিলাম | কিন্তু আমার ভাবা আর তোমার ভাবা কি এক ?”
আমি – “তুমি জানতে না আমি তোমার মধ্যে কিছু খুঁজছিলাম ?”
পারুল – “জানতাম | সেটা জানতাম | যা জানতাম না তা হল কী তুমি খুঁজছিলে |”
আমি – “তবে তুমি কেন চলে গিয়েছিলে ?”
পারুল – “হয়ত বুঝে, যে আমি চলে গেলে তুমি অন্য কোথাও খুঁজবে, খুঁজে পাবে |”
আমি – “পেলাম | কিন্তু যার মধ্যে যা খুঁজছিলাম সে আর সেই জিনিস এখন আলাদা হয়ে গেছে |”
পারুল – “দেখো আবার চেষ্টা করে, এক করা যায় কি না |”

অজিত আমার হাতে হাত রেখে বলল, “এই প্রবাল | কী হল ? বিড়বিড় করে কী চিন্তা করছিস ? নে, চা টা শেষ কর | জুড়িয়ে গেছে নিশ্চয় এতক্ষণে |”

বহুদিন অসুস্থ মানুষের মত অফিস করলাম | খিদে নেই, তাও খেলাম | খিদে বা হজমের কোন তারতম্য হল না | খাওয়ার একটু পরে মনেও করতে পারলাম না কী খেয়েছি, কখন | ঘুম পেল না, তাও ঘুমলাম, ঘুমে কোন ব্যাঘাত হল না | উঠে কোন স্বপ্ন দেখেছি বলেও মনে হল না | কাজে মন লাগল না, তাও দিব্যি কাজ করলাম ভুল চুক না করে |  কিন্তু কাজ হল খুব আস্তে আস্তে, যে ভাবে লোকে কাজ করে, কারো ফোন আসার অপেক্ষা করতে করতে | তাই কি, না কাছে এসে, বেঞ্চে পাশে বসে, ‘আমি এবার এগোই’ বলে চলে যাওয়া একজনের ? বুঝলাম না |

একদিন, একটু তাড়াতাড়ি অফিস ছেড়ে লোকালে মাঝপথে নেমে স্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা রিকশা নিয়ে পরের স্টেশন অব্দি যেতে বললাম | রিকশাওয়ালা প্রায় আধ ঘণ্টা পর আমায় একটা খুব ছোট গ্রামের বাইরে নামিয়ে গ্রামে যাওয়ার পায়ে হাঁটা রাস্তাটা দেখিয়ে বলল ওটা দিয়ে একটু গেলেই স্টেশনটা পেয়ে যাব | আমি রাস্তাটা ধরে গ্রামটা পার হয়ে একটা ধান ক্ষেতের মধ্যে পড়লাম | একটা লোককে দেখে দাঁড়ালাম পথ জানতে | পিছন থেকে কী একটা হালকা সুগন্ধ হাওয়ায় ভেসে এসে আমায় শিউলির কথা মনে করিয়ে দিল | সুগন্ধের ঢেউটা এগিয়ে যেতে যেতে আমাকে সামনে যেতে টানল | লোকটাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম স্টেশনটা সামনে, পায়ে হেঁটে তিরিশ মিনিটের পথ | দেখলাম ফেলে আসা পথে ফেরা, আর এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই | আমি মনে মনে শিউলিকে প্রশ্ন করলাম, ‘বাতাসে শিউলির সুগন্ধ | কী করে এমন হল ?’ সুগন্ধ জড়িয়ে শিউলি পিছন থেকে এসে আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল | আমি হাওয়ায় ওর শাড়ির আঁচলের ওড়া দেখতে না পেয়ে জোর পায়ে এগিয়ে ওর পাশে হলাম | দেখলাম ও যিশুকে কোলে নিয়েছে আঁচলে মুড়িয়ে | আমাকে দেখে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চোখের ভাষায় বলল, ‘এখুনি ঘুমিয়ে পড়বে |’ তখন কথা বলে যাবে এই আশায় চুপ করে  একসাথে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম অস্ত যাওয়া রোদে ধানের শিষে রং ধরছে | আমার গায়ে রোদটা একটুও লাগছে না দেখে অনুভব করলাম হাওয়ায় নেমে আসা সন্ধ্যার শিরশিরে ঠাণ্ডার সাথে সাথে সেই সুগন্ধটা ক্রমে হালকা হয়ে আসছে | সুগন্ধটার সাথে সাথে শিউলি একটু একটু করে পিছিয়ে পড়তে পড়তে মনে করিয়ে দিল আমি বহুদিন শিউলিকে দেখিনি, শিউলি ফুলও না | আমি পিছন ফিরে তাকালে ও আমায় ইশারা করল এগিয়ে যেতে | স্টেশনে পৌঁছে পিছন ফিরে আর ওকে দেখতে পেলাম না | মনে হল নিশ্চয় যিশু ঘুমিয়ে পড়েছে, আর শিউলি রয়ে গেছে যতক্ষণ না যিশু জাগে | একবার মনে হল ফিরে যাই | কিন্তু, ভাবলাম, গিয়ে যদি যিশুকে ওর কোল থেকে নিতে হাত বাড়াই, আর ও বলে, ‘এ তো আপনার নয়’ ?

লোকালে উঠে লোকজনের ভিড়ে আমার মনের মধ্যে গুমরাতে থাকল সব প্রশ্ন, ‘আমি কাকে চাই – শিউলি ? না যিশু ? নাকি শিউলির সুরভি মাখা যিশু ? আমার নিজস্ব শিউলির সুরভি মাখা যিশু কই ?’ সেই রাতে ছমছমে ঠাণ্ডায় ফাঁকা স্টেশনে নেমে আমার বেঞ্চটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম ওটার কাজই কি ছিল আমার মনের মধ্যে এই সব বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা ?

শীত কমে আসার সাথে সাথে আমার স্টেশনের বেঞ্চটার মায়া কমতে লাগল | নাকি অন্য কিছু হল বুঝলাম না | একদিন আমি বেঞ্চটার কাছে গিয়েও বসতে পারলাম না | মনে হল খুব তাড়াতাড়ি এসে গেছি, অপেক্ষা করে দেখি যদি কেউ আসে | কেউ এলো না | আমি অপেক্ষায় রয়ে গেলাম | পরদিন জোর করে বসলাম, একপাশে | প্ল্যাটফর্মে লোকাল এসে হৈচৈ শুরু হলে নিজের অজান্তে বেঞ্চে রাখা স্যুটকেসটা কাছে টেনে আনতে গিয়ে দেখলাম কোন স্যুটকেস নেই | সম্বিত ফিরে পেয়ে চমকে প্ল্যাটফর্ম বরাবর চোখ মেলে কাউকে দেখতে পেলাম না, কোন ক্লান্ত অবিন্যস্ত মহিলা কে | ব্যাকুল হয়ে চারিদিকে তাকালাম, কিন্তু কোথাও কাউকে দেখলাম না ধীর গতিতে আসতে আমার বেঞ্চের দিকে, যাকে দেখে বুঝব কাকে আমি খুঁজছি | ‘আমি খুব দেরী করে ফেলেছি’, ভেবে ফাঁকা বুকটা নিশ্বাস নিয়ে ভরে নিতে চাইলাম | না পেরে ছটফট করে উঠে দাঁড়ালাম | ভাবলাম এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাই, গিয়ে দেখি টেলিগ্রাম অফিসের জানালায় | কিন্তু কী দেখব ভেবে পেলাম না | বেঞ্চটায় বসে পড়ে হাঁটুতে কনুই রেখে দু’হাতে মাথা ধরে চোখ দুটো বুজলাম | অকারণে দুর্বার এক কান্নায় পেয়ে বসল | যে কান্নাটা বুকে জমে ছিল | এক পশলা কান্না | খুব তীব্র আবেগে শুরু হয়েই একটু পরে হটাত থেমে গেল, যেমন হটাত পেয়েছিল | রুমালটা বের করে চোখ মুছতে গিয়ে দেখি চোখ শুকনো | ‘তবে কি আমি ভুল বুঝেছিলাম ? তা কী করে ? আমার যে এত শূন্য লাগছে, যেন কত দুঃখ পার করে এসেছি |’ মাথা তুলে দেখলাম আমার সামনে একটা কুকুর দাঁড়িয়ে শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে | ‘কুকুরটাও কি ভুল করে আমি কাঁদছি ভেবে কাছে এসেছিল ?’ আমি মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে কুকুরটাকে হাত নাড়লাম চলে যেতে বলতে | ও গেল না | শরীরটা মাটিতে নামিয়ে সামনে দু’পা জড়ো করে বসে আমার দিকে তাকাল | বুঝলাম যে আমি ওকে খেদিয়ে ঠকাতে পারব না |  ‘তাই তো | আমি তো ওকে ঠকানোর চেষ্টা করেছি | ওকে বলে আসি নি যে আমি আবার যাব দেখা করতে | কেন না, যেতে আমাকে হবেই |’ আমার শরীরের ঝাঁকুনিতে চমকে কুকুরটা তড়াক করে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে শরীরটা লম্বা করে আড়মোড়া ভেঙ্গে মাথা নাড়ল | আমি হাত নেড়ে ওকে যেতে বললাম | কুকুরটা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে বোধহয় আশ্বস্ত হয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল |

গরম পড়তে শুরু করল | একদিন অফিসে পৌঁছে সবে কাজে বসেছি, রিসেপশন থেকে ফোন করে বলল কেউ এসেছে আমার সাথে দেখা করতে | নিচে গিয়ে দেখি লবিতে সোফায় বসে এক বয়স্ক দম্পতি | আমি লিফট থেকে বেরোতেই হাতের ইশারায় রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলা ভদ্রলোকের ধ্যান আমার দিকে আকর্ষণ করল | দু জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে দেখল – এক জোড়া পুরু চশমার পিছনে উদ্ভ্রান্ত, আর অন্য জোড়া বেদনায় লীন |  চিনে, আশ্চর্য হয়ে বললাম, “একি, হারাধন বাবু,  আপনারা হটাত এ ভাবে কোথা থেকে ?”
সরমা বললেন, “বাবা, খুব বিপদে পড়ে ছুটে এসেছি |”
হারাধন – “কোথাও বসে একটু কথা বলা যাবে ?”
আমি – “এখনই ? এখানে বলা যায় না ?”
হারাধন – “খুব জরুরী কথা | যদি নিরিবিলি কোথাও একটু ...”

রিসেপশনিস্টকে বললাম অফিসে খবর দিতে যে আমি একটু বাইরে যাচ্ছি | ওনাদের নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে উল্টোদিকে মিষ্টির দোকানে একটা চায়ের টেবিলে বসালাম | এই সময় তেমন ভিড় থাকে না  | সরমা ইতস্তত করে বললেন, “এখানে কথা বলে যাবে ?”
আমি – “কাছে পিঠে আর তো আর তেমন কোন জায়গা নেই | এখন অত খদ্দেরের ভিড় হবে না | বলুন, আপনি কী বলতে চান |”
সরমার চোখ ছলছল করে উঠল | তিনি নিঃশব্দে আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন | হারাধন অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলেন | আমি উঠে কাউন্টারে চা দিতে বলতে গিয়ে এদিক ওদিক করে কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে এসে বসলাম | হারাধন সরমার পিঠে হাত রেখে বললেন, “সরমা, ওনাকে যা বলার বলো | উনি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছেন | ওনাকে বেশিক্ষণ ধরে রাখা উচিত হবে না |”
আমি – “আপনারা আমার অফিসের ঠিকানা পেলেন কোথায় ?”
হারাধন – “তুমি আমাদের ওখানে যাওয়ার পর মাস খানেক কেটে গেলে একদিন পাড়ায় একটা রিকশাওয়ালা কে দেখে চেনা চেনা মনে হল | আমি ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমাকে আমার বাড়িতে আনার কথা | ও প্রথমে মনে করতে পারল না | আমি ওকে আন্দাজে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এক বাবু কে হোটেল থেকে এনে আবার ফেরত নিয়ে গিয়েছিলে | মনে আছে ?’ তখন ও মনে করতে পারল | আমি ওকে নিয়ে ওই হোটেলে গেলাম | আপনার নাম আর আসার দিন বলে জানতে চাইলাম আপনার ঠিকানা | প্রথমে ওরা রাজী হল না কিছু বলতে | আমি মিনতি করলাম যে আপনি আমার মেয়ের খবর জানেন, যা আমার জানা খুব দরকার | তখন ওরা ওদের খাতায় আপনার নাম খুঁজে অফিসের ঠিকানাটা দিল | বলল বাড়ির ঠিকানা নেই |”
আমি – “সে তো অনেক দিনের কথা |”
হারাধন – “আমি তো তখনই আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সরমা এতদিন চায় নি | আশা করছিল শিউলি ফিরে আসলে তার দরকার হবে না |”
সরমা – “বাবা, আমাদের খুব ভুল হয়ে গেছে, সেদিন ও ভাবে তোমাকে তাড়িয়ে দেয়া | তুমি বল, শিউলি কোথায় আছে | তোমার কাছে ?”
আমি – “না, না | আমার কাছে কী করে হবে ?”
সরমা – “তবে কোথায় ? তুমি যা জানো বলো |”
আমি – “আমি ওকে শেষ দেখেছি  ... কিন্তু সে ও তো কয়েক মাস হয়ে গেল |”
সরমা – “কোথায়, শেষ কোথায় দেখেছ | বলো, বাবা বলো | আমার বুক ফেটে যাচ্ছে জানতে ও ঠিক আছে কি না ? ওর শরীর স্বাস্থ্য ...”
আমার মনে পড়ে গেল যিশুর কথা | বললাম, “আচ্ছা আপনি সেদিন কেন বলেছিলেন আপনাদের মেয়ে ছিল ?”
সরমা – “বলছি বাবা, সব বলছি | ও আমাদের একমাত্র মেয়ে ... আমরা ওকে ত্যাগ করে – করেছিলাম – সব জেনে, সইতে না পেরে | এখন আর থাকতে পারছি না, ও কোথায় আছে, কেমন আছে না জেনে |”
আমি – “সব কী জেনে ?”
হারাধন – “সরমা, মনে হয় না প্রবাল সব জানে, তুমি যেমন ভাবছ |”
ভদ্রমহিলা চমকে উঠে প্রশ্ন করলেন – “কী ? তবে যে তুমি টেলিগ্রামটায় লিখেছিলে ...” ভদ্রমহিলা কাঁপা হাতে নিজের ব্যাগটা খুলে একটা ভাঁজ করে রাখা কাগজ আমায় দিলেন | সেই টেলিগ্রামটা, যাতে লেখা – ‘... যার জন্য আর যার সাথে বেরিয়েছি সেই জন আমার ভরসা ...’
সরমা – “তুমি কি সেই জন নও যার সাথে আর যার ভরসায় শিউলি বেরিয়েছিল ?”
‘যার সাথে আর যার ভরসায় শিউলি বেরিয়েছিল – সে কি যিশু ?’ | মনের প্রশ্নটা চেপে বললাম, “আপনি ভুলে গেছেন | আমি সব বলেছিলাম | বর্ধমান স্টেশনে আপনার মেয়ের সাথে আমার কী কথা হয় | কথা মানে, উনি কী ভাবে ওনার ট্রেনে ওঠার আগে টেলিগ্রামটা পাঠাতে না পেরে আমাকে দেন আপনাদের পাঠাতে |”
সরমা বিভ্রান্ত স্বরে বললেন,  “তুমি শিউলির সেই জন নও ? শিউলি তোমার ...”

একটা ছেলে চা দিতে এলে সরমা কথা চাপলেন | কী বলব ভেবে না পেয়ে উত্তর দেয়া এড়িয়ে যেতে আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম | ফুটন্ত গরম বিস্বাদ চায়ে জিভটা পুড়ে গেল | হারাধন বাবু আমার বিকৃত মুখভঙ্গি দেখে চায়ের কাপ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন | আমি বুঝলাম না, ‘সব কথা’ না জেনে, আরামবাটীর কথা বলা উচিত হবে কিনা |

সরমা ততক্ষণে পাথরের মত জড় হয়ে বসেছেন | হারাধন বললেন, ‘সরমা, তোমাকে আমি আগেই বলে ছিলাম আমার মনে হয় না প্রবাল ...”
সরমা খুব ঠাণ্ডা, নিচু অথচ শক্ত গলায়, “তাহলে শিউলির গর্ভধারণের কারণ তুমি নও ...” বলে উঠে দাঁড়ালেন |
আর কিছু বলার না পেয়ে হারাধন ও উঠে দাঁড়ালেন | দু’জনে ধীর পায়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন | আমি উঠে কাউন্টারে গেলাম চায়ের দাম দেয়ার জন্য | হারাধন বাবু ফিরে এসে বললেন, “প্রবাল, সরমার কথায় তুমি কিছু মনে কোর না | তুমি চলে আসার পর সরমা টেলিগ্রামটা বারবার পড়ে একটা ধারণা করে যে শিউলির সাথে যা ঘটেছে তা তুমিই ঘটিয়েছ | যাই হোক, শিউলির যদি কোন খবর পাও, জানি না কী ভাবে, তাহলে জানিও |”
আমি – “কী করে জানাব ? আমার কাছে তো আপনার নম্বর নেই |”
হারাধন বাড়ির ফোন নম্বর একটা রসিদের পিছনে লিখে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন | আমি জিজ্ঞাসা করলাম না ফোনটা ঠিক হয়েছে কি না |

বাড়ি ফিরে ক্যালেন্ডারে দেখলাম আরামবাটী থেকে এসে দু’মাস কেটে গেছে | অসহ্য প্রতীক্ষা নিয়ে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে উঠে ছ’টার আরামবাটী এক্সপ্রেস ধরলাম | রাস্তায় দেরী করে ট্রেনটা আরামবাটী পৌঁছল দেড়টায় | দীনবন্ধু লজে উঠে স্নান করে বেরোতে বেরোতে প্রায় আড়াইটা | ভর দুপুরের গরমে চট করে অটো পেলাম না | একটা রাজী হল মাত্র মৌলিপাড়া অব্দি যেতে | বলল ওখান থেকে রিকশা পাব | রিকশা নিয়ে যখন পশ্চিম বঙ্গ বিদ্যুৎ পর্ষদের অফিসের রাস্তায় শেফালীদের বাড়ির সামনে নামলাম, দেখলাম তিনটে বেজে গেছে | হটাত দ্বিধা দেখা দিল  – এই দুপুরে স্বল্প পরিচিত কারো বাড়িতে কী অজুহাতে নিজেকে উপস্থিত করব ? কী করব ভাবতে ভাবতে সামনে একটা বকুল গাছ  দেখে ওদিকে পা বাড়ালাম | আমি ওর ছায়ায় দাঁড়ালে রিকশাওয়ালা পিছন পিছন এসে বলল, “বাবু, ভাড়াটা দিয়ে আমায় ছেড়ে দিন |” আমি কিছু বলার আগে একটা খোলা জানালা দিয়ে কেউ ডাকল, “এই রিকশা !” একটু পরেই দরজা খুলে কোলে যিশুকে নিয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলো শিউলি | এসে ওকে রিকশার সিটে শুইয়ে তাড়াতাড়ি উঠে বসে ওকে কোলে নিলো | তারপর রিকশাওয়ালাকে খুঁজতে চারিদিকে তাকিয়ে আমাদের দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, মুখে সেই বিব্রত হাসি ফুটিয়ে বলল, “এ কী ? আপনি ? এখানে ?”

রিকশার ছাউনিটা টানা থাকলেও দেখলাম সেই কয় মুহূর্তের মধ্যে শিউলির চেহারায় একটা হালকা ঘামের আর্দ্রতা ছড়িয়ে গেল | ওর চোখের দৃষ্টিতে কী দেখতে পেয়ে জানি না আমার ম্রিয়মাণ বুক তার স্পন্দনের অবসান হওয়ার শেষ তরঙ্গ ছড়াতে কেঁপে উঠে নিস্পন্দ হল | হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম |

শিউলি রিকশায় একটু নড়ে নামার জন্য উদ্যত হয়ে বলল, “ও কী ? দাঁড়িয়ে রইলেন কেন ? এসে ধরুন, আমি নামব |” আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে রিকশার কাছে গিয়ে ওর কাছ থেকে যিশুকে নেয়ার জন্য হাত বাড়ালাম |
শিউলি বলল, “আরে না | রিকশাটা ধরুন |”
ততক্ষণে রিকশাওয়ালাটা এসে গেছে | ও রিকশাটা ধরল | আমি চুপ করে এক পাশে দাঁড়ালাম | শিউলি যিশুকে সীটের উপর শুইয়ে চট করে নেমে ওকে কোলে নিতে গেল | আমি বললাম, “এ কী করছেন ? কোথায় যাচ্ছিলেন যান |”
শিউলি – “বা রে | আপনি এসেছেন আর আমি চলে যাব | আমি রিকশা না পেয়ে অপেক্ষা করে করে, এটাকে দেখে আপনাকে লক্ষ্যই করিনি | চলুন, বাড়ি চলুন | আমার পরে গেলেও হবে |”
আমি – “তার আগে বলুন, যাচ্ছিলেন কোথায় ?”
শিউলি – “এই যে, একে নিয়ে যাচ্ছিলাম হেলথ সেন্টারে দেখাতে |”
আমি – “ও, তো আপনি একাই যাচ্ছেন ? শেফালীদি’ ?”
শিউলি – “দিদির খুব জ্বর | অরুণদা’র কাজের চাপ, আমাকে কোনমতে একটা রিকশা ডেকে পাঠিয়ে দিয়েছিল | তার চেন ছিঁড়ে গেল | সেই থেকে আমি এদিক ওদিক করছি রিকশার জন্য |”
শিউলি রাস্তার দু’দিকে চোখ ফেলল, বোধহয় আর রিকশা দেখতে | আমি বললাম, “এমন হয় না, আমি গেলাম আপনার সাথে ? তারপর ফিরে এসে না হয় ...”
শিউলি বাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল | তারপর বলল, “তাও হয় |” ও উঠে বসে যিশুকে কোলে নিলে আমি রিকশায় উঠে ওর পাশে বসলাম | শিউলি রিকশাওয়ালা কে বলল এগিয়ে যেতে |

বিশ্বাস হল না যা ঘটছে | মনটা চলে গেল কয়েক মুহূর্ত আগেকার  সময়ে, যখন আমি ওই গাছের ছায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, না ভেবে পেয়ে যে কী ভাবে শিউলির সাথে দেখা হবে | ‘আবার কি সেই মুহূর্ত ফিরে আসতে পারে ? আর, এমন হয় যে আমি ফিরে চলে যাই ? এই দেখা কি হওয়ারই ছিল ? নাহলে কেন হচ্ছে এইভাবে ?’

একটা গর্তে পড়ে রিকশাটা খুব জোরে দুলে উঠল, আর শিউলির মাথা আমার কাঁধে লাগল | ওর মিহি, কোঁকড়ানো, উড়ো কিছু বেসামাল চুলের স্পর্শে বহুদিন পরে চূর্ণকুন্তল শব্দটা মনে পড়ল | সেই  চুলে একটা চেনা হালকা ফুলেল গন্ধ | শিউরে উঠে আমি ওর দিকে তাকালাম | শিউলি যিশুকে কোলে ঠিক করে নিতে নিতে বলল, “কী এত ভাবছেন ?”
আমি – “এই ভাবে আপনার সাথে দেখা হওয়ার কথা |”
শিউলি হেসে বলল, “এই ভাবে মানে বকুল গাছের ছায়ায় ?”
আমি – “আসলে, আমি এসেছিলাম ঝোঁকের মাথায় | আপনার বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে অপ্রস্তুত বোধ করলাম | গাছের ছায়া পেয়ে মনে হল একটু দাঁড়িয়ে ভেবে দেখি কী করতে চলেছি | এত শান্ত ওই ছায়া যে তন্ময় হয়ে পড়লাম | ... আপনি কেমন আছেন ?”
শিউলি – “ও ! ... আমি ? আমি ভালো আছি ... আর আপনি ?”

পথে যেতে যেতে আমি নিজের চিন্তায় মগ্ন থাকলাম, শিউলি যিশুর যত্নে | মাঝে মধ্যে গর্তে ভরা রাস্তাটা | গর্তে পড়ার ধাক্কা খেতে খেতে প্রথম প্রথম শিউলি সচকিত হয়ে উঠে একটু সরে বসার চেষ্টা করল | তার মাঝে একবার যিশুর মাথা আমার দিক থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে ওকে আমার গায়ে ঠেস দিতে হল | যিশুকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার বসতে অসুবিধা হচ্ছে, না ?”
আমি বললাম – “না, না | আপনি ওকে ঠিক করে নিয়ে বসুন |”
তখন শিউলি একটু শিথিল হয়ে বসল | আমার গায়ে ওর কৃশাঙ্গ দেহলতার হালকা চাপটা নিয়ে বিচলিত মনটাকে বিক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করে বললাম, “হেলথ সেন্টারে কী দেখাবেন ?”
শিউলি – “এমনি ... ওর ওজনটা নেব, আর একটু ডাক্তার কে জিজ্ঞাসা করব ডি পি টি দ্বিতীয় বার কবে নিতে হবে |”
আমি – “ওর কত বয়েস হল ?”
শিউলি – “তিন মাস | সময় হয়ে গেছে বোধহয়, কিন্তু গত সপ্তাহে একটু গা গরম ছিল বলে নিয়ে আসি নি |”
আমি – “আপনার প্রথম ?”
শিউলি চমকে উঠে বলল, “কী ?” আমার গায়ে লাগা ওর শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে গেল | মুখ ঘুরিয়ে ওর মুখে তাকাতে না পারলেও দেখলাম যিশুর উপর হালকা করে রাখা ওর নিরাভরণ হাতের রোমকূপে কাঁটা দেয়ার চিহ্ন |
নড়ে, সরে বসে, শিউলি বলল, “এই প্রশ্নটা না করলেও পারতেন |”
আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, “স্যরি ! না জেনে অহেতুক প্রশ্ন করে আমি কী ভুল করেছি জানিনা, কিন্তু মাফ চাইছি | আর এরকম হবে না |”

কিছুক্ষণ পরে সহজ গলায় শিউলি বলল, “এসে গেছি |”
দেখলাম সামনে কিছু বাড়ি ঘর শুরু হচ্ছে | তার মধ্যে একটার পোস্টার মারা দেয়ালে লেখা ‘মৌলিপাড়া প্রাইমারী হেলথ সেন্টার’ | বাইরে কিছু নিশ্চল লোক আর কয়েকটা উদ্দেশ্যহীন বেওয়ারিশ কুকুর |
রিকশা থামলে আমি আগে নামলাম | শিউলি নেমে ঘড়ি দেখে বলল, “আপনি দাঁড়ান, আমি যাব আর আসবো | আপনার চিন্তা নেই | মনে হয় ফিরে ট্রেন ধরতে পারবেন |”
কুকুরগুলো দেখিয়ে বললাম, “না, আমি আপনার সাথে যাব |”
শিউলি ভিতরে গিয়ে সোজা ডাক্তারের ঘরে ঢুকে গেল | আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলাম ভিতরে মহিলা ডাক্তারটি একজন রুগী দেখছে | শিউলির সময় হলে ডাক্তার হাসি মুখে আমাকে বলল, “ওখানে দাঁড়িয়ে কেন ? ভিতরে আসুন |” আমি একটু ইতস্তত করে ঢুকলাম | ডাক্তার যিশুকে দেখতে দেখতে কৌতূহলী চোখে আমাকে দেখল এক দু বার | শিউলিকে বলল, “আসছে সপ্তাহে আসুন ডি পি টি দেয়াতে | ওনাকে নিয়ে আসবেন | ওনাকে তো দেখাই যায়না |”

ডাক্তারের ঘর থেকে শিউলি যখন বেরল দেখলাম ওর থমথমে মুখময় লাল আভা | আমি ভেবে পেলাম না, ওর সাথে ডাক্তারের কাছে আসার জন্য ক্ষমা চাইব কিনা |

রিকশার কাছে এসে শিউলি বলল, “ওকে একটু রাখবেন ? আমি ভিতরে গিয়ে শাড়িটা ঠিক করে নিতাম |”
আমি হেসে বললাম, “তাহলে তো সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয় |”
শিউলির থমথমে মুখে একটু হাসির আভাস দেখা দিল | বলল, “না, সেরকম কিছু ব্যাপার নেই | আর, ওর প্রথম দু’মাস তো কেটে গেছে, যখন সব থেকে বেশি চিন্তা থাকে |”
শিউলি যিশুকে সীটে শুইয়ে আমাকে বলল সীটের ধারে একটা হাত রাখতে | আমি যিশুর পাশে হাত রেখে ওর মুখের দিকে চাইলাম | অঘোরে ঘুমিয়ে | ওর ছোট বুকের ওঠাপড়া দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম না শিউলি ভিতরে গিয়ে ফিরে এসেছে | পাশে এসে দাঁড়িয়ে যিশুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “এবার ছাড়ুন |” আমি চমকে হাত সরিয়ে নিতে গিয়ে ওর হাতে আমার হাত লেগে গেল | আমি অপরাধী দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকালাম | ও অতল চোখে গভীর বিস্ময় মাখিয়ে আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে রিকশায় উঠে যিশুকে কোলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে ?”
আমি মাথা নেড়ে, ‘কিছু না’ জানিয়ে রিকশায় উঠে বসলাম |

বলার বিশেষ কিছু না পেলেও ফেরার পথে রাস্তার ভাঙ্গাচোরা অংশটা যেন চট করে শেষ হয়ে গেল | শিউলি একটু সরে বসল | তারপর সামনে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এবার বলুন |”
আমি – “কী বলব ?”
শিউলি – “এই যে ... কী জন্য এসেছিলেন, কাকে দেখতে, কেন ?”
আমি – “এত প্রশ্ন, একসাথে ?”
শিউলি – “কেন ? আসার উদ্দেশ্য কী একটাই ?”
আমি – “যদি বলি তাই |”
শিউলি – “কী সেই উদ্দেশ্য ?”
আমি – “আপনাকে জানাতে, যে গতকাল আপনার বাবা মা এসেছিলেন আমার অফিসের ঠিকানা খুঁজে |”
শিউলি চমকে উঠে ওর বাঁ হাতে আমার ডান হাত চেপে ধরল | পেলব হাতের তালু, সামান্য আর্দ্র, আঙ্গুলের নখে ধার নেই | আমি নিশ্চল ঋজু  হয়ে সামনে তাকালাম, দেখতে যে ও কী দেখে এই রকম করল | সেরকম কিছুই দেখতে পেলাম না | শিউলি কিছু না বলে চুপ করে থাকল, আমিও তখনই বলার মত আর কিছু খুঁজে পেলাম না |

একটা জায়গা এলো যেখানে রাস্তার ধারে ঝিলের দিকটায় জমিটা একটু উঁচু | সেখানে একটা পুরনো বটগাছ, অজস্র ঝুরি নিয়ে | চারিদিকে তার শুকনো পাতা ঝরিয়ে গাছটা গরম হাওয়ার ঢেউয়ে দুলছে থেকে থেকে | গাছটার তলা দিয়ে একটা পুরনো কয়েক ধাপের ইটের সিঁড়ি ঝিলটার পাড়ে উঠে গেছে | মনে হল সিঁড়িটা ওদিকে নেমে গেছে ঝিলের জলে | রিকশাওয়ালা রিকশাটা গাছটার শতচ্ছিন্ন ছায়ায় দাঁড় করিয়ে বলল, “বাবু, আমি একটু আসছি |” ও সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল | আমি আস্তে করে শিউলির হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে রিকশা থেকে নেমে পা সোজা করলাম | বাচ্চাটা মনে হল ঘুমিয়েই আছে | শিউলিকে স্থাণু হয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কী আর কিছু শুনতে চান না ?” শিউলি শুকনো গলায়, “কী বললেন ওনারা ?” বলে সামনে থেকে দৃষ্টিটা নামিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকাল |

আমিও ওর পায়ের পাতার দিকে তাকালাম | ঈষৎ গর্বিত লম্বাটে বুড়ো আঙ্গুলে রক্তিম লাল নেল পলিশের অবগুণ্ঠন | বাকি চারটে সলজ্জ আঙ্গুল সামনের দিকে অনাবৃত নখে ঢাকা মাথা নত করে কুঁকড়ে গোল হয়ে রয়েছে | যেন সব ফুলের কুঁড়ি, একটি আধফোটা পরিণীতা, বাকি ফোটার অপেক্ষায় কুমারী | ভীষণ ইচ্ছে করল লজ্জায় সংকুচিত আঙ্গুলগুলোর মুখ তুলে সোজা করে সাজিয়ে দেখি পুরো পায়ের পাতা | শিউলি তার আগেই বাচ্চাটাকে এক হাতে বুকের কাছে তুলে নিয়ে অন্য হাতে শাড়িটা হাঁটুর সামনে একটু টেনে পায়ের পাতা দুটো ঢাকতে নামিয়ে দিল |
আমি ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “কালকে ... আপনার মা আমাকে সেই টেলিগ্রামটা দেখালেন |”
শিউলি – “ও |”
আমি – “ওটাতে আপনি কারো সম্বন্ধে লিখেছিলেন ‘... যার জন্য আর যার সাথে বেরিয়েছি সেই জন আমার ভরসা ...’ “
শিউলি – “হুঁ |”
আমি – “তিনি বা সে কে ? আপনার মা ভেবেছিলেন সে আমি | সে কে ?”
শিউলি এবার আমার দিকে দৃষ্টি তুলল | কোলের বাচ্চাটাকে আরও বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল, “মা যাই ভাবুক, আপনি কী ভেবেছিলেন ?”

রিকশাওয়ালাটা সিঁড়ি বেয়ে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে এসে বলল, “রিকশায় বসুন বাবু | আমি একটু মাথাটা ধুয়ে নিলাম | খুব গরম লাগছিল |”

আমি উঠে বসলে শিউলি আবার আমার ডান হাত ওর বাঁ হাত দিয়ে ধরল, আগের মত, তবে আলতো করে | আমার গায়ে ওর ভরসার ভার ফিরে এসে হালকা কুয়াশার মত আমায় গ্রাস করল | গ্রস্ত হতে হতে শুনলাম শিউলি জিজ্ঞাসা করল, “বলুন, আপনি কী ভেবেছিলেন |”
আমি কিছু উত্তর না দিয়ে বসে থাকলাম, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে |
একটু পরে শুনলাম যেন শ্রুতির নেপথ্যে শিউলির স্বগতোক্তি,  “কেন যে, যেই একটা ভরসা পাই, এক নিমেষেই সেটা মেকী মনে হয় ?”
আমি তাও কিছু বলার মত পেলাম না | অনুভব করলাম আস্তে আস্তে আমার বাস্তব জগত, আর কল্পনার জগত সব একটা নিরবচ্ছিন্ন স্বপ্নে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, যেখানে আমাকে বাকি জীবন একটা অন্বেষণে কাটাতে হবে জানতে আমি কী চাই | কেন না, যে আমার ভরসা চাইছে সে এগিয়ে আসবে না আমার যা প্রাপ্য তা আমাকে পাইয়ে দিতে |

ওদের বাড়ি এসে গেলে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালাম | শিউলি নামল | আমি ঘড়িতে দেখলাম প্রায় পাঁচটা বাজে | শিউলিও ঘড়ি দেখল, বলল, “আপনি এখনই রওনা হলে হয়ত সাড়ে পাঁচটার ট্রেনটা পাবেন | যান, এগিয়ে যান | ... ও ! রিকশার ভাড়াটার কী হবে ?”
আমি হেসে বললাম, “হয়ত আবার আসবো | টেলিগ্রামের হিসাব ও তো বাকি আছে |”
শিউলি – “টেলিগ্রামের ?”
আমি – “টাকার নয়, কথাগুলোর | সব যোগ করে একদিন চুকিয়ে দেবেন |”
শিউলি – “কবে ?”
আমি – “কেন ? আপনি আর কতদিন আছেন ? এখানে ?”
শিউলি – “এর অন্নপ্রাশন অব্দি |”
আমি – “আমাকে ডাকবেন তো ?”
শিউলি একটু ম্লান হেসে বলল, “জানি না | ... যান, আর দেরী করবেন না |”

আমি রিকশায় উঠতেই দুরে এক দল লোকের রেহাই পাওয়ার কলরোল শুনলাম | শিউলি, “ওই বোধহয় অরুণদা’র অফিসে ছুটি হল” বলে হাত নাড়ল বিদায় জানাতে | ওর কোলে যিশু নড়ে উঠল | শিউলি ওকে দেখতে মাথা নামাল | যিশুকে একটা চুমু খেয়ে আমার জগত থেকে নিজের জগতে মিলিয়ে গেল |

বিদ্যুৎ পর্ষদের গেটের কাছে এসে দেখি লোকজন বেরচ্ছে | তাদের মধ্যে থেকে একজন আলাদা হয়ে আমাকে হাত নাড়ল | অরুণ | আমি রিকশা থামাতে বললাম | অরুণ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, “দেখতে এসেছিলেন বুঝি ?”
আমি প্রশ্নটা না ধরতে পেরে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলাম | অরুণ আবার প্রশ্ন করল, “কেমন দেখলেন, যিশুকে ?”
আমি – “যিশু ? ও হ্যাঁ ... ঠিকই তো মনে হল |”
অরুণ – “আচ্ছা | ... আর আপনি কেমন আছেন ?”
আমি – “ভালো | আপনি ?”
অরুণ – “আমি, আমরা দুজনেই, ভাল আছি | আমরা আপনাকে আরও আগে আশা করছিলাম |”
আমি – “ও | আমি তো সেরকম কোন আভাস পাইনি সেবার |”
অরুণ – “বা রে | আপনি যে ফিরে যাওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি আবার আসতে পারেন কি না যিশু কে দেখতে |”
আমি – “বলেছিলাম বুঝি ?”
অরুণ – “হ্যাঁ | আমরা তাই ভেবেছিলাম আপনি এসে মাঝে মধ্যে দেখে যাবেন যিশুকে |”
আমি – “ওর নাম তাহলে যিশুই রাখলেন ?”
অরুণ – “হ্যাঁ, দুজনেরই, মানে আমার আর শেফালীর নামটা খুব পছন্দ |”
আমি – “আর শিউলির ?”
অরুণ – “শিউলির ...  ও তো ওর ভূমিকা শেষ হলেই চলে যাবে |”
আমি – “ওর ভূমিকা শেষ হলেই ... ”
অরুণ – “হ্যাঁ, তিন মাস তো কেটেই গেল | আর তিন মাস |”
আমি – “আচ্ছা, যিশুর জন্ম কি বাড়িতে হয়েছে ?”
অরুণ – “কেন ?”
আমি – “দেখলাম শিউলি যিশুকে হেলথ সেন্টারে দেখাচ্ছে |”
অরুণ – “না, না | বাড়িতে কেন হবে ? শিউলি আপনাকে বলেনি ? ওকে আমরা দিয়েছিলাম এখানেই, একটা ভালো নার্সিং হোমে |”
আমি – “ও ! আমি জানতাম না |”
অরুণ – “হ্যাঁ | ... আপনি তো সাড়ে পাঁচটার গাড়িটা ধরবেন বোধহয় ? তা না হলে বাড়িতে এক কাপ চা খেতে ডাকতাম |”
আমি – “আজ থাক |”
অরুণ – “আচ্ছা, তাহলে চলি | আমাকে আবার চা খেয়েই অফিসে ফিরতে হবে | ... পরে কখনও কথা হবে |”

আমাকে মৌলিপাড়া অব্দি রিকশায় যেতে হল না | পাওয়ার সাপ্লাই লেন থেকে হাইওয়েতে উঠেই একটা অটো পেয়ে গেলাম | পিছনে তাকিয়ে দেখলাম অরুণকে তখনো দেখা যাচ্ছে রাস্তায়, ওর বাড়ি প্রায় পৌঁছে গেছে | চট করে রিকশা থেকে নেমে ভাড়ার উপর কিছু বেশি টাকা বের করে রিকশাওয়ালাকে দিলাম | লোকটা টাকা গুনে অবাক হল, তারপর খুশি | আমার একটা কার্ড বের করে হাত দিয়ে অরুণ কে দেখিয়ে বললাম, “যাও | এই এটা ওকে দিয়ে দাও |” ও হাসিমুখে কাজটা নিয়ে রিকশা ঘুরিয়ে চলে গেল | দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম অরুণ বাড়িতে ঢুকল, রিকশাওয়ালা পৌঁছল, শিউলি বেরিয়ে এলো | আমি অটোর ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে  বললাম, “স্টেশন চলো, সাড়ে পাঁচটার গাড়িটা ধরতে হবে |”

স্টেশন পৌঁছতে পৌঁছতে পাঁচটা চল্লিশ হয়ে গেল | ট্রেনটা পাওয়ার আশা আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম | অটোর ড্রাইভার স্টেশনের প্রথম প্রান্তে নামিয়ে বলল, “স্যার, ভাড়াটা চট করে দিয়ে ছুটে যান | গাড়িটা এখনো ছাড়ে নি | দৌড়লে পেয়ে যাবেন |” নেমে টাকা দিয়ে ছুটলাম ওই প্রান্ত থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠে | দেখলাম পার্সেল ভ্যানে মাল তোলা হচ্ছে | কামরায় উঠেও হাতে একটু সময় পেলাম | জায়গা খুঁজে বসলাম | ট্রেন ছাড়ল |

ছ’টা নাগাদ মোবাইলটা বাজল | অপরিচিত নম্বর | তুলে বললাম, “প্রবাল” | আবছা মেয়েলি গলায় বলল কেউ, “ট্রেনটা ধরতে পেরেছেন ?”
আমি – “কে শিউলি ? ... হ্যাঁ, কোনমতে |”
শিউলি – “আপনার খুব ছুটোছুটি হল, না ?”
আমি – “না তো |”
শিউলি – “বসার জায়গা ?”
আমি – “পেয়েছি |”
শিউলি – “আর কিছু, বলার মত ?”
আমি – “এই তো কথা হল ...”
শিউলি – “তাহলে রাখি ?”
আমি উত্তর দেয়ার আগে শিউলি ফোন রেখে দিল | আমি নম্বরটার সাথে অরুণের নাম লিখে রাখতে গিয়ে খেয়াল হল ওর পদবীটা মনে নেই | তখন লিখলাম ‘অরুণ – যিশু’ | ঠিক পছন্দ হল না | অরুণের অফিসে ফিরে যাওয়ার কথা মনে পড়ায় শেষে লিখলাম ‘শিউলি – আরামবাটী’ |

সারা রাস্তায় কতবার যে মনে হল মোবাইলটা বাজছে, আর বের করে দেখলাম |

বাড়ি ফিরে জামা কাপড় বদলে, মুখ হাত ধুয়ে, ফ্রিজ থেকে কিছু একটা বের করে খেয়ে শুয়ে পড়লাম | আবার উঠে মোবাইলটা বালিশের তলায় নিয়ে শুলাম | দেখলাম ওতে সময় দেখাচ্ছে সাড়ে বারোটা | আর ফোন আসার আশা নেই মনে হল | সবে তন্দ্রা এলো আর মোবাইলটা বাজল | তুলে দেখলাম নামটা,  ‘শিউলি – আরামবাটী’ | এত রাত্রে ! ফোনটা তুলে সাবধানে বললাম, “প্রবাল” |
শিউলি – “শুয়ে পড়েছিলেন ?”
আমি – “হ্যাঁ, সবে ঘুমটা এসেছিল |”
শিউলি – “আমি জাগিয়ে দিলাম ?”
আমি – “না, বলুন | এত রাত অব্দি আপনি জেগে ?”
শিউলি – “ও আজ কিছুতেই ঘুমচ্ছিল না | এতক্ষণে ঘুম পাড়িয়ে সময় পেলাম |”
আমি – “ও বলতে যিশু ?”
শিউলি – “আপনি কি ওকে যথার্থ যিশু মনে করেন ?”
আমি – “কোন অর্থে জানি না | ওকে প্রথম দেখে ওই নামটাই মাথায় এসেছিল |”
শিউলি – “কেন ?”
আমি – “আচ্ছা, আপনি কি এই কথা জানতে এত রাত্রে ফোন করেছেন ?”
শিউলি – “না, তা নয় | আমি একটু উদ্বিগ্ন ...”
আমি – “কেন ? আপনি তো জেনেই গিয়েছিলেন আমি ট্রেনটা ধরতে পেরেছি |”
শিউলি – “ওই একটা কথায় কি উদ্বিগ্নতা কাটে ?”
আমি – “কিসের উদ্বিগ্নতা ?”
শিউলি – “আপনার চেহারা এত খারাপ হয়ে গেছে | এবার আপনাকে দেখে আমি চট করে চিনতে পরিনি | মনে হল অনেকদিন ঘুম, খাওয়া দাওয়া কিছুই হয়নি ঠিক করে | ... বাড়ি ফিরে আপনি কিছু খেয়েছেন ?”
আমি – “হ্যাঁ |”
শিউলি – “ঘুম পেয়েছে ?”
আমি – “না বলি কী করে ?”
শিউলি – “তাহলে আমি রাখি ?”
আমি – “আমি কিন্তু এখনো জানতে পারলাম না আপনি কেন এতো রাত্রে ফোন করেছেন |”
শিউলি – “যদি বলি, ঘুম আসছে না | যদি বলি, কিছু কথা বলে দেয়ার কেউ নেই |”
আমি – “কী কথা ?”
শিউলি – “এলোমেলো জটিল সব প্রশ্ন |”
আমি – “শুনি তাহলে | দেখি উত্তর পাই কি না |”
শিউলি – “যেমন,আপনি কেন আমায় বলবেন না আপনি কী ভাবেন আমার ওই টেলিগ্রামের কথা নিয়ে ? যেমন, কেন আজ আপনি আমার হাতে আপনার হাত ঠেকলে এত সংকুচিত হয়েছিলেন ? পরে আপনি আমার পায়ের পাতায় কী দেখছিলেন ? কেন সব সময় আপনি আমার দিকে তাকালে আমার চোখের দৃষ্টি ধরে আমার ভিতরে উঁকি দেন ?”
আমি – “শুধু এই কটা প্রশ্ন ?”
শিউলি – “এই রকমই আরও কত কী ... সব প্রশ্নের শেষ প্রশ্ন, আপনি কী খুঁজছেন আমার মধ্যে, বারে বারে এসে ?”
আমি – “হয়ত খুঁজছি কিছু |”
শিউলি – “কী ?”
আমি – “সেটাই তো জানি না |”
শিউলি – “আমার সেই ভয় | ভয়, ওই অজানার খোঁজে আপনি আবার আসবেন | আসবেন, যখন আমি আর থাকব না |”
আমি – “আপনার কি মনে হয় না তাতে আমার এই অন্বেষণের ইতি হবে ?”
শিউলি – “মনে হয় ? ভয় হয় | ভয়, যে আপনি হয়ত এই খোঁজে নিজেকে শেষ করবেন | নয়, আমার মধ্যে আপনার খোঁজা শেষ হলে আমরা দু’জনেই শেষ হব | এই নিয়ে আমার আসল উদ্বিগ্নতা ... তাই এতো রাত্রে ফোন করেছি |”
আমি – “শিউলি ! ... এত কথা তো একবারে বলার মত নয় |”
শিউলি – “না নয় | তা আমি জানি | তবু আমার যা বলার তা বলতে আর দেরী করতে চাইনি | বলা হল | এখন রাখছি |”

------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৬ জানুয়ারি ২০১৪






রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৪

প্রথম চিঠি


“...

ইতি, স্বাতী বোস |”

একি ! স্বাতীর চিঠি ! আমাকে লেখা ! আশ্চর্য তো ! কবে, কি ভাবে, কি ব্যাপার ...

“ ... আমার চিঠি পেয়ে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই | আমি আপনাকে অবাক করে দিতে চাই না | আমি 

এই চিঠি লিখতেও চাইনি | কিন্তু, বিশ্বাস করুন, আর কোন উপায় ছিল না | ...”

আমার হাত কাঁপতে শুরু করেছে | কিসের উপায় ? আমি কি ভাবেই বা বিশ্বাস করব এই দুর্বোধ্য জিনিষটাকে ?

“ ... আমার এই চিঠি লেখার উদ্দেশ্য, কি বলব, আমি চাই না এই বিয়ে, আমাদের বিয়ে হোক | 

আপনি আমার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না | আমি আপনার সর্বনাশ চাই না | ভগবানের দোহাই, আপনি
এই বিয়ে থামান | কারণ এই -

আমি বাড়ি পালানো মেয়ে | এক কালে কৈশোরের দুঃসাহসিকতায় আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম |
সুদীর্ঘ দু’বছর পরে বাড়ি ফিরি নিজের বিফলতায় হতাশ হয়ে | আমি যাকে চেয়েছিলাম তিনি তখন
যৌবনের মায়া কাটিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের এক আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত সন্ন্যাসী | তিনি আমাকে গ্রহণ করেননি |

যাক এই যথেষ্ট | আমার মনে হয় না কারণটার আর কোন বিস্তৃতির প্রয়োজন আছে | হটাত একটা
মনের আবেগে আপনাকে চিঠিটা লিখলাম | মনের আবেগটা একান্ত নিজস্ব | ওটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা
করবেন না | এর আগে আমার দুটো বিয়ের সম্বন্ধ হয় ও ভেঙ্গে যায় | এবার আশা করে আশাহত
হতে চাই না | হয়ত এই আবেগ কেটে গেলে নিজেকে বোকা মনে করব | আপনি তার আগেই আশা
করি একটা কিছু করবেন | আর একটা কথা – হয়তো মনে করছেন আমি আপনার মুখোমুখি হলাম
না কেন | আমার সে সাহস নেই | সমস্ত ঘটনাটার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি |
 
ইতি, স্বাতী বোস |”

ডাকঘরের ছাপটা পনের দিন আগেকার | গতকাল আমার বিয়ে হয়ে গেছে এই স্বাতীর সাথে | সেই সাথে ঠিক হয়ে আছে আমরা আগামীকাল হানিমুনে যাবো | যাবো কাঠগুড়ি | নাম-না-জানা ছোট্ট একটা হিল স্টেশনে হেমন্তের রোদে স্নান করে সদ্য-পরিচয়ের শীতলতা ভাঙ্গতে |

কাঠগুড়ি | কাঠগুড়ি | যেখান থেকে সহ্যাদ্রির চূড়া দেখা যায় | আমার বুকের মধ্যে সব একাকার হয়ে যাচ্ছে যেন | এই চিঠিটার অর্থ কি ? এখনই বা এলো কেন ? এর কি কোন প্রয়োজন ছিল ? এতো দেরী হয়ে গেছে |

আমার হাতটা চিঠিটা ধরে আছে, কিন্তু কোন অনুভূতি নেই | শুধু মনে হচ্ছে আমার বাস্তবতার পৃথিবীটা দ্রুত বেগে সরে যাচ্ছে | আর আমার ভাবনা চিন্তায় স্পর্শবোধহীনতার একটা গ্রহণ লাগছে |

*    *    *

ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করল | সেই কখন থেকে এই ভাবে চলে আসছে – একটু থেমে আবার গড়িয়ে | আকাশে বিকেল গড়িয়ে আসছে সেই সাথে | ট্রেনটা যখন থেমেছিল, দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম | ঘাসে হাওয়া লেগে শিরশির করে একটা আওয়াজ উঠছিল | মনের অস্থিরতার কথা ভেবে হটাত ইচ্ছে হচ্ছিল নেমে আস্তে আস্তে মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই | মাঠের শিরিষ গাছগুলোর ছায়া আহ্বান জানাচ্ছিল গিয়ে বসার জন্য, একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য, এলোমেলো ভাবনা চিন্তাগুলো গুছিয়ে নেয়ার জন্য | ট্রেনটা চলতে শুরু করেই মনের নিরুপায় ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে দিল | মাথা নিচু হয়ে আছে | ঘুমের মত একটা বিভ্রান্তি লাগছে | বুকের ভিতর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস না উঠে আসা বুদবুদের মত আটকে রয়েছে |

একটা সিগারেট ধরানো যাক | দেশলাইটা কোথায় রাখলাম আবার ? ওই তো ! স্বাতীর পায়ের কাছে | স্বাতী বেশ পা মুড়িয়ে বসেছে – হাঁটুর উপর কনুই রেখেছে | হাতের তালুতে চিবুক রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে | মাঝে মাঝে কপালের চুলগুলো সরানোর চেষ্টা করছে | ওর জানালাটা খোলা, বাইরের হাওয়া এসে চুলগুলো আবার কপালে ফিরিয়ে দিচ্ছে | ওর অন্যমনস্ক ভাবটা ঠিক বুঝতে পারছি না | কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকালেই বুকের উপর রাখা পাথরটা আরও ভারী হয়ে যাচ্ছে | আমার ঈষৎ ব্যস্ততায় মুখ ঘোরাল |

[
“ও কি ? পার্থ, ও রকম জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছ কেন ?”
“কই না তো |”
ও কি ধরে ফেলছে সব কিছু | এমন কি আমার চিন্তাটা যে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছা থেকে ওর কাছে ফিরে গেছে | অনেকক্ষণ থেকেই এই রকম ভাবে আমি মনে মনে লুকিয়ে ওর চিন্তাগুলো দেখবার চেষ্টা করছি |
]

দুজনে দুজনের দিকে তাকালাম | স্বাতী আমার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল বোধহয় | বলল, “তোমার জানালাটা খুলে দাও না | রোদ পড়ে এসেছে |”
“না থাক | বড্ড ঘুম পাছে | চোখ বুজে এলে, ভাবছি, বসে বসে জানালাটায় মাথা রেখে ঘুমবো একটু |”
“এই ভরা সন্ধ্যাবেলায় ?”
“তাতে কি?”
“তা হোক | দেখি সরো তো, জানালাটা খুলি |”

আমার মুখটা ওর ঠাণ্ডা চুলে ডুবে গেল মুহূর্তের জন্য | তারপর ওর গলাটা আমার কপালে লাগল | আমরা প্রথম, এই প্রথম, একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই প্রথম, একজন আরেকজন কে ছুঁলাম | জানালাটা খুলতে এত সময় লাগছে কেন ?

স্বাতী জানালাটা খুলে নিজের সীটে গিয়ে বসল | পাশের দিক থেকে এখন হাওয়াটা আসছে | ওর পায়ের কাছে শাড়িটা হটাত হাওয়াটায় কাঁপতে শুরু করল |
“আর কতক্ষণ লাগবে ?”
“ঘণ্টা দুয়েক বোধহয় |”

আমার চোখের দৃষ্টিটাকে স্বাতীর মুখ থেকে ফিরিয়ে নিলাম | একটা শুকনো নদী | ব্রিজের গুমগুম আওয়াজ | ট্রেনের স্পীড বাড়ছে | সূর্যের শেষ আলোটা নদীর চিরচিরে জলটাতে একবার ঝিকমিক করে উঠে মিলিয়ে গেল | স্বাতী হাত জোড় করে পশ্চিম দিকে প্রণাম করল | আমার মনে পড়ে গেল চিঠিটার লাইনটা – “ভগবানের দোহাই আপনি ...” | ভগবান ওর দোহাই শুনতে পায় নি | ও কিসের আশায় প্রণাম করল ?

*    *    *

ঘুম আসছে না | সিগারেটও ফুরিয়ে গেছে | স্বাতী ঘুমচ্ছে | শোয়ার আগে ও বলেছিল – “শোবে না ? আমার চোখ ঘুমে ভেঙ্গে আসছে |”

ম্যানেজারটা প্রথমে যে ঘরটা দেখিয়েছিল সেটাতে ডাবল বেড ছিল | পায়ের দিকের দেওয়ালে বিরাট একটা আয়না | আয়নার সাথে বিছানার সম্পর্ক ভেবে বুকটা গুলিয়ে উঠেছিল | জিজ্ঞাসা করেছিলাম – “আর কোন রুম নেই ?”
“আছে |”
তারপরে অস্বস্তি ভরা গলায় বলেছিল – “এটা নিলে পারতেন | সবাই নেয় | অন্য ঘরগুলো তে সিঙ্গল বেড, আলাদা আলাদা | আর, তাছাড়া এটা কে আমরা হানিমুন রুম বলি |”

লোকটা কি নির্লজ্জ |  স্বাতী ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল – “অন্য রুমগুলি দেখান | যেটা থেকে পাহাড় দেখা যাবে সে রকম কোন রুম |”

[
আমরা তাহলে হানিমুনে আসিনি | আমরা পাহাড় দেখে ফিরে যাবো |
]

স্বাতীর নিঃস্পৃহতা আমি বুঝতে পারি না | ও কি বুঝতে পেরেছিল আমি হাজার, শত সহস্র চেষ্টা করেও ওর সাথে শুতে পারবো না |

[
রাত্রে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় ঠাণ্ডা পাহাড় দেখব | মুখটা বিস্বাদ লাগবে বেশি সিগারেট খাওয়ার জন্য, তবু শুতে পারবো না এক সাথে, খাটে, আয়নায়, ম্যানেজারের মনে |
]

“এ কি ! তুমি এখনো শুয়ে পড়নি?”
“তুমি জেগে আছো ?”
“হটাত ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল | শুয়ে পড় |”
আমি বুঝতে পারছি না কি বলব |
“স্বাতী !”
“কি ?”
“ভালো লাগছে না | তোমাকে একটা কথা বলব বলব ভাবছি ...”
“এখানে এসো তো |”

[
“ আমি তোমাকে এখনো নিজের ইচ্ছায় ছুঁয়ে দেখিনি, জানো ? তোমার ইচ্ছা করছে না ?”
“ কি ?”
]

“সিগারেটগুলোও ফুরিয়ে গেল |”
“অত সিগারেট খেতে নেই | বাবার আজকাল বুকে ব্যথা হয় মাঝে মাঝে, জানো |”
স্বাতী উঠে এসে আমার হাত ধরে টানল | বিছানায়, ওর নয় আমার, এসে বসলাম |
“শুয়ে পড় |”

[
নারী ও মাতৃত্ববোধ আমাকে চিরকাল স্পর্শ করেছে | স্ত্রী পুরুষের অন্য সম্পর্কগুলো যেন অস্পষ্ট |
]

স্বাতী কম্বলটা টেনে দিল গলা অব্দি | আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একবার হাই তুলল | আতপ চালের মতো দাঁতগুলো – ছোট ছোট, পরিষ্কার | আমার এলোমেলো চিন্তার জট এক সহস্রাংশ খোলেনি | চোখ বুজলাম শান্তির আশায় | সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা হাত, স্বাতীর, কম্বলটা টেনে দিল পায়ের কাছে | চুপচাপ নিথর নিস্তব্ধতা | তারপর স্বাতীর চটির আওয়াজ, দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে চলে গেল |

*    *    *

আজ সকালে যখন উঠলাম, এখানে আসার পর তিনদিন কেটেছে | স্বাতী একটা শাল গায়ে দিয়ে জানালার ধারে বসেছিল | আমি গত তিন ভোরের মতই বেরোতে যাচ্ছিলাম | হটাত কি মনে হতে দরজার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকালাম | ফোলা ফোলা চোখে স্বাতী তাকিয়ে | চোখের নির্নিমেষ দৃষ্টি যেন নির্জন দ্বীপ থেকে পরিত্যাগ করে যাওয়া জাহাজের চলে যাওয়া দেখছে | বুকের ভিতর একটা মোচড় অনুভব করলাম | ওর এই দৃষ্টি আমি আগে দেখিনি | গলাতে একটা রুক্ষতা উঠছিল নিজের বিবশতার উপর রাগ হয়ে | তবু যথাসম্ভব চেষ্টায় গলাটা হালকা করে বললাম – “স্বাতী বেড়াতে বেরুবে আমার সাথে ?”

স্বাতী ঘাড় নাড়ল | তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল – “একটু দাঁড়াও | চটিটা বদলে নিই |”

বাইরে কুয়াশা সরে যাচ্ছিল | ঘাস ভিজে ছিল | আর সকালের স্নিগ্ধতায় ঘুমের আড়ষ্টভাবটা কেটে যাচ্ছিল | স্বাতী পাশে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে শালটা ঠিক করে নিচ্ছিল | আমার শাল ও পায়জামা ভেদ করে একটা গা মাখা ঠাণ্ডাভাব লাগছিল | আর তাই বুঝতে পারছিলাম না স্বাতীর শীত করছে কি না |

হাঁটতে হাঁটতে আমরা উপরের দিকে উঠছিলাম | একটা জায়গায় রাস্তাটা হটাত গোল হয়ে ঘুরে নিজের কাছেই ফিরে এসে শেষ হয়ে গেল | মাঝখানের গোল জায়গাটায় কটা কাঠের বেঞ্চ আর কিছু ছড়ানো ছিটানো গুলমোহর ধরনের গাছ | ভিজে ঘাসে লাল টকটকে ফুল পড়েছিল, অজস্র | ফুলগুলো দেখতে দেখতে স্বাতীর পায়ের লাল চটি দেখতে পেলাম | হুবহু এক রং |

আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেটা পাহাড়টার মাথার শেষ | চারিদিকে গাছে ঢাকা ঢালু জমি নেমে গেছে | একটা হাওয়া গাছগুলোর মাথায় চিরুনি বুলিয়ে দিচ্ছিল | একটা মচমচ শব্দ শুনে দেখলাম পাহাড়ি পথ বেয়ে একটা লোক আর তার বউ কাঁধে জিনিস নিয়ে চলেছে | ওরা জঙ্গলে মিলিয়ে গেল আস্তে আস্তে | জঙ্গলের নিস্তব্ধতা আবার প্রকট হয়ে উঠতেই হটাত নিজের নিঃসঙ্গতার কথা মনে হল | তাকিয়ে দেখলাম স্বাতী নিচু হয়ে ভিজে ঘাসে শালের আঁচল লুটিয়ে ফুল কুড়চ্ছে | খানিকক্ষণ পরে মুখ ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একটু ইতস্তত করে বলল – “তোমার রুমালটা একটু দেবে ? হাতে ফুলগুলো আঁটছে না |”
“কি করবে জংলা ফুল কুড়িয়ে ?”
“দুপুরে তো কিছু করি না | ভাবছিলাম একটা মালা তৈরি করব |”
“পরবে ?”
“না | এমনি সময় কাটানোর জন্য |”

বুঝলাম কি অসম্ভব নিঃসঙ্গতা, সময়বোধহীনতা আরোপ করেছি আমি স্বাতীর মনে | রুমালটা দিলাম | স্বাতী নিচু হয়ে ফুল কুড়ানোতে মন দিল | আমি বেঞ্চে বসলাম ওকে সাহায্য করার হটাত ইচ্ছাটা চেপে | নিস্তব্ধতা আবার ঘন কুয়াশার মত নেমে এলো |

*    *    *

চারটে দিন কেটে গেছে | মানে চারটে সকাল, চারটে দুপুর, চারটে বিকেল আর চারটে রাত | সূর্য উঠেছে চারবার আর ডুবেছেও চারবার | অথচ আমি এখনও এর মানে খুঁজে পাইনি | যে, কোন অপরিচিত একটি লোক একটি অপরিচিতা মেয়ের সাথে বিয়ের দু’দিন পরে নাম-না-জানা একটা হিল স্টেশনে হানিমুন করতে আসবে, ও এসে এতগুলো পর্ব যাপন করবে অসহ্য অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে, প্রাকৃতিক সমস্ত নিয়ম উপেক্ষা করে |

অথচ দিন ছয়েক আগে, বিয়ের সময় আমি স্বাতীর বা স্বাতী আমার এতোটা অচেনা ছিল না | কিন্তু, কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল |

এ সবই  কি শুধু একটা চিঠির জন্য ? স্বাতীর মুখ দেখলে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় একটা কথা | আমার মনে হয় ও বুঝতে পেরেছে যে আমি চিঠিটা পেয়েছিলাম | বিয়ের আগে | ও কি কিছুতেই বুঝতে পারছে না যে আমি চিঠিটা পেয়েছি বিয়ের পরে | যখন আর কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না |

*    *    *

আজ পঞ্চম দিন | সকালে উঠে স্বাতী স্নান করে গেরুয়া একটা শাড়ি পড়েছিল | তার উপর সাদা একটা উলের চাদর জড়িয়ে যথারীতি জানালার ধারে বসল গিয়ে | আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে পেপারটা নিয়ে বসলাম | ক’দিন ধরে পেপারটা আমার সঙ্গী হয়ে আছে | পেপারটা লোকাল | রোজ ভোরে দরজার বাইরে পড়ে থাকতে দেখি | উঠিয়ে নিয়ে খুঁটিনাটি পড়ি | তারপর স্বাতী স্নান করে বেরোলে নিচে নেমে ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট করতে যাই |

এই হোটেলের অলিখিত নিয়মে সদ্যবিবাহিতের দল একটু  বেলায় ব্রেকফাস্ট করতে নামে | তারপর কাঁচা রোদে বেড়াতে বেরোয় | অথচ আমরা এসে থেকেই সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করছি | আজ স্বাতী এসে ডাকল না | চুপচাপ জানালার ধারে গিয়ে মেঝেতে কার্পেটের উপর বসল | কার্পেটের উপর বসলে জানালা দিয়ে সমতলের কিছুই দেখা যায় না | শুধু সহ্যাদ্রির চূড়াটা দেখা যায় | বেশির ভাগ দিনই আবহাওয়া পরিষ্কার থাকছে এবং নীল আকাশে অসম্ভব কাটা কাটা চূড়াটা চোখে পড়ছে | রাত্রে চাঁদের আলোয় মনে হয় কালো ভেলভেটে মোড়া একটা রুপোর তৈরি বর্শার শলা | কিন্তু দিনের বেলায় সাদা, শুধু সাদা | প্রথম দিন তন্ময় হয়ে তাকিয়েছিলাম | দ্বিতীয় দিন থেকে লক্ষ্যে পড়ে না | তবে বুঝে উঠতে পারিনি স্বাতী ওটার মধ্যে অত কি দেখে | আজ জিজ্ঞাসা করলাম – “স্বাতী ! কি দেখছ ?”
“উঁ | কিছু না |”

[
“কিছু না ? আমি লক্ষ্য করেছি তুম পাহাড়টাকে তন্ময় হয়ে দেখ | কিছু দেখতে পাও না ওর মধ্যে ? নাকি ওটা তোমার ভাবনা চিন্তার আঁকিবুঁকি কাটার সাদা পাতা ?”
]

স্বাতী উঠে দাঁড়ালো | তারপর বলল – “চলো, নিচে যাই |”
“চলো |”
পেপারটা গুটিয়ে উঠে পড়লাম |

ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে একটা কথা মনে পড়ল | ঘুরে স্বাতীকে বললাম – “স্বাতী, হাট দেখতে যাবে ?”
“কাপড় বদলে না এমনি ভাবেই ?”
“এমনিই চলো |”

আমরা এসে অব্দি বিশেষভাবে জামাকাপড় পরিনি একবারও | যখনি বেরিয়েছি আমার পরনে থেকেছে পায়জামা, পাঞ্জাবি আর শাল | স্বাতীর পরনে শাড়ি আর শাল কিম্বা উলের চাদরটা |

বাইরে বেরোতেই সোনা গলা রোদে চোখটা জুড়িয়ে গেল | বাইরে সবুজ ঘাসের ডগায় নীলচে শিশিরের আস্তরণ রোদে চিকমিক করছে | রাস্তায় লোকজন কম এখন | পাহাড়ি লোকগুলোর আধবোজা চোখে আর বিস্তৃত মুখে হাসির আভাস | নিজের অজান্তেই মুখের ভাঁজে একটা হাসি ফুটে উঠল | তাকিয়ে দেখলাম স্বাতীর মুখে রোদের ছটায় আর হাসির বিচ্ছুরণে একটা কাটাকাটি চলছে | মনে হল ইচ্ছে করলে আমি একটা ন্যায়সঙ্গত ভাবে ওই লোভনীয় গালে হাত দিতে পারি | মনটা আচমকা একটা অধিকার বোধের খুশিতে ভরে গেল |

হাটটা দেখে মনে হল এক কথায় জনসমুদ্র | মাসে নাকি একবার এত জোয়ার আসে যখন হাট বসে | হটাত স্বাতী মেঘ কেটে ঝিকমিকয়ে ওঠা রোদের মত খুশি খুশি গলায় চেঁচিয়ে উঠল – “ও মা ! কত লোক !”

আমরা ভিড় ঠেলে এগোতে লাগলাম | চুড়ি, মনিহারী, খাবারদাবারের দোকানে চারিদিক ঘেরা – মাঝখানে মাটির উপর জিনিস রেখে শাক সবজি, মাছ মাংস বিক্রি হচ্ছে |

অনেকক্ষণ থেকে ঘুরছি | ঘুরছি আর ঘুরছি | পা ব্যথা করছে একটু | তার উপর লোকের ধাক্কাধাক্কি | একবার স্বাতীর দিকে একটা গরু তেড়ে আসছিল | স্বাতী ভয়ে হটাত আমার বুকের মধ্যে এসে টুক করে পাখির মত ছোট্ট হয়ে মিশে গেল | গরুটা এগিয়ে আসতে আসতে থেমে আমার দিকে তাকাল | তারপর ঈর্ষা কাতর একটা দৃষ্টি হেনে ঘুরে চলে গেল | আমি গর্বের মধ্যে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেললাম |

*    *    *

কাল রাত্রে একটা স্বপ্ন দেখেছি | আমি সেই বেঞ্চটায় বসে | স্বাতী আপনমনে ফুল কুড়চ্ছে | নিচু হওয়ার প্রচেষ্টায় মুখটা ঈষৎ রক্তিম আর কপালে স্বেদ বিন্দু | কুড়চ্ছে, কুড়চ্ছে, শেষ নেই | হটাত কোথা থেকে একটা মাদলের আওয়াজ পেলাম | আস্তে আস্তে খুব আস্তে আস্তে জঙ্গল ঠেলে এগিয়ে আসছে | মৃদু তালের একটা আওয়াজ | জঙ্গলের মর্মর ছাপিয়ে ভাসছে | স্বাতী মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল | তারপর ফুলগুলো এনে আমার পায়ের কাছে রেখে বলল – কি বলল শুনতে পেলাম না | বোধহয় ফুলগুলো পাড়াতে মানা করল | তারপর আবার ফুল কুড়তে লাগল | আমার পায়ের কাছে রাখা ফুলগুলো থেকে একটা তুলে নাকের কাছে ধরলাম | মৃদু একটা সৌরভ | স্বাতী আবার এসে আরও কিছু ফুল রেখে গেল | স্বাতীর হাঁটা চলা যেন বদলে গেছে | স্বাতী নাচছে | মৃদু মৃদু মাদলের তালে তালে ঘাসের ডগার উপর ফুলগুলো এড়িয়ে স্বাতী ভেসে বেড়াচ্ছে শরতের হালকা মেঘের মত | নাচতে নাচতে ঘুরছে, দেখছে, খুঁজছে, কুড়চ্ছে, তুলে রাখছে ফুল আঁচলে | তারপর এসে আমার পায়ের কাছে ঢেলে দিচ্ছে | লাল লাল ফুল, অজস্র, টকটকে |

স্বাতীর নাচের তাল আস্তে আস্তে বাড়ছিল | মাদলের আওয়াজটা ভেসে আসছিল এতক্ষণ | এবার বয়ে আসছে | অনেক বেশি জোরালো এখন | স্বাতী লাল ফুল তুলছে গাছ কোমর শাড়ি পরে | ঘামে চুল কপালে আটকে গেছে | মাঝে মাঝে আমাকে একটা হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে | আমি সেই হাসির মধ্যে একটা আহ্বান পেলাম যেন | উঠে দাঁড়ালাম | কিন্তু স্বাতীর কাছে যেতে গিয়ে দেখলাম আমাকে ঘিরে চারিদিকে ফুল | আমার হাঁটু অব্দি | পাড়াতে মানা | স্বাতীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম এতক্ষণে হাসি, ফুল, শাড়ি সব এক হয়ে গেছে | সেখানে একটা ঘূর্ণি | উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে | মাদলের আওয়াজটা ঢেউয়ের মতো কানে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো | আমার চারিদিকে ফুলের স্তূপ উঁচু হতে হতে আমাকে ঢেকে ফেলছিল | ভেজা ভেজা ঠাণ্ডা ফুল | সৌরভটা পবিত্রতার মত শরীরটাকে ঘিরে ধরছিল | আমি আকণ্ঠ ফুলে ডোবা | মাদলের আওয়াজ আস্তে আসতে মিলিয়ে যেতে লাগল | শুধু রইল সৌরভটা | মুখে ফুলের স্পর্শে শিউরে উঠছিলাম | হটাত সব ঝড়, সব কোলাহল থেমে গেল | স্বাতীকে দেখতে পেলাম না |
স্বাতী কই ? স্বাতী কোথায় গেল ?

ঘুমটা ভেঙ্গে গেল | দেখলাম স্বাতী আমার বুকের একান্ত কাছে মুখ রেখে কাঁদছে | কান্নার শব্দে নয়, আর্দ্রতায় বুঝলাম | চুলগুলো আমার গালে মুখে ছড়ানো | তার থেকে সেই মৃদু সৌরভটা উঠছে |

*    *    *

[
“স্বাতী !”
“কি ?”
“আমি তোমার চিঠিটা পেয়েছিলাম |”
“কবে ?”
“বিয়ের পরদিন |”
“বলনি তো |” স্বাতীর গলায় কান্নার আভাস |
“সাহস হয়নি |”
“সাহসের কি দরকার ছিল ?”
“বিয়ের রাতে তোমাকে দেখে যে আশা পেয়েছিলাম তা ভাঙ্গতে সাহস হয়নি | ... তুমি আমাকে ভালোবাসো ?”
“এখন ? হ্যাঁ | তখন বাসতাম না |”
“তোমার কি দুঃখ হচ্ছে তখন বলিনি বলে ?”
“কখন ?”
“যখন চিঠিটা পেলাম |”
“একটুও  না |”
]

কাল আমরা চলে যাবো | আজ আমি আর স্বাতী বাজারে গিয়েছিলাম কটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে | ফেরার পথে উপর থেকে আমাদের হোটেলটা দেখতে পেলাম | স্বাতীকে বললাম – “এই ! রাস্তা ছেড়ে পাহাড় দিয়ে নেমে যাবে ? অনেক তাড়াতাড়ি হবে |”
“পড়ে যাব না তো ?”
“আমি ধরে রাখবো |”

পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে শুরু করলাম | এখানে পাহাড়টা একেবারেই খাড়া না | চারিদিকে খালি গাছ, গাছালি আর আকাশ বেঁধা গাছের গুঁড়ি | বড় বড় নুড়ি এখানে ওখানে ছড়ানো | কতকগুলো শেওলায় সবুজ হয়ে আছে | সমস্ত জঙ্গলটা ঠাণ্ডা আর গা ছমছমে | স্বাতী খানিকটা নেমে বলল – “একটু বসবে এখানে ?”
“কেন, পা ব্যথা করছে ?”
“না, এমনি | ... এখানে আবার কবে আসা হবে |”
“বেশ তো | চলো ওখানে |”
যে জায়গাটায় বসলাম সেখানে একটু রোদ এসে পড়ছে একটুখানি ঘাসের উপর | হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে রাখলাম | স্বাতী বসে হাঁটু দুটো জড়ো করে হাত দিয়ে ঘিরে ধরল | অন্যমনস্কতায়, ফিরে যাওয়ার হতাশায় কিছুক্ষণ কাটল | তারপর স্বাতী ফিসফিস করে বলল – “ আশ্চর্য |”
“কি আশ্চর্য ?”
“আমাদের এই প্রেমে পড়াটা | তাই না ?”
“হুঁ |”

আবার নিস্তব্ধতা | আমার গা সওয়া গরম রোদটায় একটা মদালস ভাব লাগছিল | শিরা উপশিরায় একটা আমেজ জড়িয়ে উপরে উঠছিল | স্বাতীকে কোলের কাছে টেনে নিলাম | স্বাতীর শরীরটা ফুলে মত নুইয়ে পড়ল | স্বাতী একটা ফুল, একটা পাখি, এক টুকরো মেঘ | আকাশের অসীম নির্লিপ্ততা আর প্রকৃতির পরিব্যাপ্তির মধ্যে আমি আর স্বাতী সোনালী সুখের সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখলাম | শরীরে স্পর্শের যে সুখানুভূতিটা মজ্জায় মজ্জায় মিশে যাচ্ছিল ঠোঁট দিয়ে তার এক চুমুক পান করলাম | স্বাতীর গালে গাল রেখে অনুভব করলাম প্রেমের প্রথম স্পর্শে শিরায় উপশিরায় উষ্ণ রক্ত ছুটে এসে ওর মুখে লজ্জার আবীর ছড়িয়ে দিল |

*    *    *

আমরা ফিরে চলেছি | ট্রেনটা জোরে ছুটছে | আশেপাশের গাছপালা, ঘর বাড়ি সব দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পাশ দিয়ে সমান্তরাল রেখায় ছুট যাচ্ছে | আমায় হাতের মুঠোয় যেন এরা এসেছিল, এখন মুঠোর ফাঁক দিয়ে গলে যাচ্ছে |

একটা ছোট্ট স্টেশন | মোরাম ঢাকা প্ল্যাটফর্ম | কাঠ-চাঁপা গাছ | কাঠবিড়ালি | স্টেশন মাস্টার | সবুজ ফ্ল্যাগ | জানালায় এসে বসা কৌতূহলী চড়ুইটা ট্রেনের নড়ে ওঠায় ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল | স্বাতী ফিক করে হেসে ফেললো |

স্বাতী জানালার ধারে বসে আছে | হেমন্তের ধান-হলুদ রোদ এসে গালে কপালে পড়েছে | গায়ের শাড়িটাও হলুদ | মাঝে মাঝে ঠোঁটের মাঝখানে একটু চাপা হাসি খুশির আভাস দিয়ে যাচ্ছে | আমি মাঝে মাঝে ওর চুলটাতে হাত দিচ্ছি, ধরে টানছি | স্বাতী ডুবে যাওয়া আরামের সুরে বলছে – “এই, ছাড় না |”

ট্রেনের স্পীড আর একটু বাড়লে উঠে স্যুটকেসটা  খুললাম | হাতড়ে হাতড়ে চিঠিটা বের করে পকেটে লুকিয়ে রাখলাম | তারপর কুপে থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে গিয়ে চিঠিটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়লাম | দরজাটা খুলে হাওয়াতে টুকরোগুলোকে ছেড়ে দিলাম | হটাত নিরালম্ব হয়ে টুকরোগুলো গতিহীন একটা অদ্ভুতভাবে ভাসতে লাগল | দূরত্বের জন্য টুকরোগুলো ছোট হয়ে আসছিল | তারপর মিলিয়ে গেল দৃষ্টি থেকে | দরজাটা বন্ধ করে কুপেতে ফিরে আসতে আসতে হটাত মনে হল স্বাতীর আমাকে লেখা প্রথম চিঠি ছিল এটা |

মনে হল না ছিঁড়লেও হত |
--