রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

কুহেলিকা

|| কুহেলিকা ||


নাড়ু নস্কর লেনে থাকত সে, একাকিনী বাসিন্দা কুহেলিকা
আসত না সে জানালায়, না ঝুল বারান্দায় কভু দিত দেখা

দেখেছি তাকে কখন-সখন পাড়ার পথে যেতে আত্মমগনে
নিরিবিলি বেলা, বড় রাস্তার ছায়া ঘন তরুবীথির শূন্য অরণ্যে
ফুটপাথের শৈবালে, ছায়ার ফুকরে, নম্র রোদের ফিকে আঁচে
ফ্যাকাসে পায়ের পাতা মেলে যেত, বিড়াল পা ফেলার ধাঁচে
খোলা চুলে বেলি, মালায় চামেলি, সাজাত সে সেরে স্নানটি
দু’ বাহু নিরাভরণ, থাকত আঙ্গুলে না পালিশ, না কোন আংটি

যখনই দেখেছি তাকে, সে যেত, সে আসত চেহারা লুকিয়ে
মুখ কখনই দেখিনি তার, তাই পারব না তাকে দিতে চিনিয়ে
তবু, নাড়ু নস্কর লেনের সাথে অস্তিত্বের ছিল যত টুকু টান
সে শুধু কুহেলিকার রূপ দেখবার, দুর্বার ইচ্ছা এক আনচান

একদিন আমি একা দাঁড়িয়ে ব্যালকনিতে, বড্ড ফাঁকা মনটা
করছি অপেক্ষা শোনার জন্য, অতি চেনা একটি ট্রামের ঘণ্টা
নামবে কুহেলিকা, আসবে ওই বাঁ দিকের গলি দিয়ে বেরিয়ে
সেই হাতেই ঘুরে চলে যাবে সে, আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে

দেখলাম সে এলো কি, মাথাটা ডোবাল তুলে দুই ত্রস্ত হাত
যেন কোন অনাহূত ভ্রমরের সাথে, হয়েছে তার মোলাকাত
এড়াতে তাকে কুহেলিকা বেঁকে, ঝুঁকে, ঘুরিয়ে মুখ চকিতে
তাকাল আমার ব্যালকনির দিকে বিব্রত, বিপন্ন দুই আঁখিতে

দেখা হল না তার চিবুক, ঠোঁট, নাক ; না কালো ঘন বুনো চোখ
দেখলাম শুধু তার চাঁদনী কপালে, কপোলে খোদিত এক শোক
কোনও বসন্তের, দাগ বসন্তের,  যে দাগ যাবে না  শত ধুলেও
তাই কি সে কখনও তোলে নি মুখ ? দেখে নি আমায় ভুলেও

নাড়ু নস্কর লেন থাকবে থাকুক না – কুহেলিকাও থাকুক একা
আমি কি করব ? আমি অপারগ – হয়ে গেছে যে পাকা দেখা ||


------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ২৯ জুন ২০১৪





















বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০১৪

হারানো লাল ছাতা

|| হারানো লাল ছাতা ||


ছিঁড়ে অঝোর বৃষ্টির পর্দায় নিভৃত সময়
হাওয়া ভিজে, এলোমেলো, ইতস্তত বয়
ভিজে হয় ইতি, বৈশাখী শুকনো স্মৃতি
ডাক আসে মেলাতে পুরানো পরিচিতি |
যাই হেঁটে তুমি আমি, সুস্পষ্ট, ছাতা মাথায়
বাকি সব লুকিয়ে বর্ষার ধোঁয়াটে কুয়াশায়
আধো ফোটা ছবি | আমাদের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত
কাছে আসার অছিলায় জোড়া একাকীত্ব |
রাখে দূরত্ব, ছিটে-বৃষ্টির শিশিরে সিক্ত সাকি
কিন্তু কল্পনায় তার হাতও ধরতে পারি না কি ?
কি করে জানব ? আমাদের অস্তিত্ব যে মেকী,
আর আমার প্রেম ? সে তো পুরনো, সাবেকি |
তাই শুধু চেয়ে দেখি তোমার প্রতি পদক্ষেপে
নেমে আসে বৃষ্টির ফোঁটা | ব্যাকুল আক্ষেপে
মেশে তোমার কামিজে শেষ গ্রীষ্মের স্বেদে |
ফুলকো সালোয়ার হয় কাবু, ঝটিকার জেদে
তোমার উড়নি বেসামাল অসহিষ্ণু হাওয়ায়,
যে চায় আশ্রয় তোমার বুকের কবোষ্ণতায়
তোমার সোনা পায়ের সবুজ, শুক-সবুজ চটি
আগলে বুকে, ছোটে সুখে, চপল টিয়ার জুটি,
আঙ্গুলের নখের লাল টুকটুকে নেল-পালিশে
রক্তবর্ণ শালুক | রাস্তার জমা জলের আকাশে
ভাসমান মেঘের শিহরিত ছায়ার শত তরঙ্গে
চোখ টেপে ট্র্যাফিক সিগন্যাল, অশ্লীল রঙ্গে
রং বদলায় লাল থেকে সোনালী হয়ে সবুজে
তবু থামাই গাড়ি, নামাই কাঁচ, দেখতে খুঁজে

কেউ কি দাঁড়িয়ে, খোঁপায় লাল ছাতা গুঁজে ?

-------------------------------------------------------------------------------------
ইন্রনীর / ২৬ জুন ২০১৪

মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০১৪

অশ্রু

|| অশ্রু ||


কার প্রতীক্ষায় আমি এতদিন একা
কত সবুর, আশা, বর্ষায় পাব দেখা

কাটিয়ে সমগ্র বর্ষের বিরহ অকাল
আসবে গড়িয়ে এক মেদুর সকাল
আকাশের মেঘে তার এলানো চুল
হাওয়ায় আর্দ্র অছিলা, ত্রস্ত, ব্যাকুল
বজ্রের নির্ঘোষে তার আসার ডঙ্কা
বিজলিতে শিহরিত আঁখিতে শঙ্কা
দুলিয়ে পাতার কানে কদমের দুল
পায়ে পায়ে মাড়িয়ে লাল জামরুল
মাটিতে নিংড়ে তার শাড়ির শিঞ্জন
মদিরা আসক্ত ঝিমঝিম মৃদুল গুঞ্জন

‘ওই, এলো সে’, বলে
আমি ছুটে যাই | খুলি দরজা, জানালা
কই সে ? বাইরে শুধু বৃষ্টি, এক পশলা !

সে কি আসবে না, এই বার্তা কি তারই
তাইলে আকাশ ঝরায় কার বিদায়ী বারি ?

-------------------------------------------------------

ইন্দ্রনীর / ২৪ জুন ২০১৪

রবিবার, ১৫ জুন, ২০১৪

দার্জিলিং স্টোন

বেণু বলেছিল, “ব্যাপারটা সে’রকম ?”

বেণুর এই “ব্যাপারটা সে’রকম ?” ব্যাপারটা আসলে একটু অন্য রকম | বেণু আর আমি একসাথে, মানে একে অপরকে, বিয়ে করে থাকলেও, আমরা একসাথে বড় হইনি | শুরুতে ঠোকাঠুকি লাগত | ক্রমে, সময়ের স্রোতে একসাথে গড়িয়ে গড়িয়ে, দুজনেই কিছুটা গোল নুড়ি পাথর হয়ে গেছি ; এখন আর ঠোকাঠুকি হলে কষ্ট হয় না | কিন্তু, ভিতরে ভিতরে আমরা আলাদা পাথর রয়েই গিয়েছি | যখন আমার কোনও ব্যাপার বেণুর গ্রাহ্য হয় না, ও বলে, “ব্যাপারটা সে’রকম ?” এটা কিন্তু কোনও প্রশ্ন নয়, এটা একটা আপোষে পৌঁছানোর ইঙ্গিত, যার অর্থ এই যে, ‘আমি তোমার সাথে একমত নই, কিন্তু বলছ যখন, তখন ...’

এখন শুরু করি শুরু থেকে |

সকালে পেট পুরে হোটেলের প্রাতরাশ গিলে ঠিক হল, ময়দানে যাই | হাঁটতে চাইলে
হাঁটো, বসতে চাইলে বসো | শীতের সকালে এমন রোদের ছড়াছড়ি, সবুজের ভিতরে ভিতরে | যেখানে রোদ পড়ছে, গাছের মাথা, ঘাসের ডগা, উজ্জ্বল সবুজ | আবার গাড় সবুজ, গাছের তলার পাতায় আর ছায়ার ঘাসে ঘাসে |

তাই আমরা বসছিলাম, আবার উঠছিলাম, আর হাঁটছিলাম | উদ্দেশ্য বিহীন | সাথে কন্যা বুবাই | তার বিশেষ হাঁইচাঁই নেই, স্কুলের ছুটি, কাজেই মাথারও ছুটি | ও দিব্যি সাথে সাথে থেকেও, আমাদের দুজনের কথাবার্তা এড়িয়ে এড়িয়ে, সাথে না থাকার চেষ্টাই করছিল | হটাত ও মায়ের গলার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “মাম্মা, তোমার হার ! হোটেলে রেখে এসেছ কি ?” বেণু থমকে গলায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আমায় বলল, “সে কী ? আমি তো
হারটা পরেই বেরিয়েছিলাম !”

আমারও মনে পড়ল জলখাবার খাওয়ার সময় ওয়েটারগুলো বেণুর গলার দিকে তাকাচ্ছিল, আর বেণু অপ্রতিভ হয়ে হারের লকেটটা আঙ্গুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল |

হারটা চোখে পড়ার মত | পেটানো গানমেটালের চাদরে অজস্র শঙ্খের আকারে দার্জিলিং স্টোন বসান একটা লকেট, যার আকারটা খানিকটা পুরানো হাতপাখার মত | তার দু’কানের ফুটো দিয়ে একটা সোনার চেন পরানো, পিছনে হুক দেয়া | আমার কাছে দার্জিলিং স্টোনের গল্প শুনে শুনে বেণু বায়না ধরেছিল যে ওকে তার একটা হার বানিয়ে দিতে হবে | সেটা হয়ে ওঠেনি | সেবার দিল্লিতে কনট প্লেসে এক ফুটপাথের ফেরিওয়ালার কাছে এই লকেটটা দেখে ওর খুব পছন্দ হয়েছিল | অথচ, আমার ভারী অপছন্দ – কেন না গানমেটালের পাঁশুটে রংটা পাথরগুলোর জেল্লা মাটি করছিল | আমি বেণুর হাত ধরে টানতেই বুবাই বলল, “বাপি ! উঁহুঁ ... পালাবার চেষ্টা কোরো না |” তারপর বেণুকে বলল, “মাম্মা এটা নিয়ে নাও, তোমার দার্জিলিং স্টোনের শখ পূর্ণ হবে |” আমি বললাম, “তাই বলে এতগুলো ছোট ছোট পাথর, কখন কোনটা খসে যাবে |” বুবাই আবার মাকে ঠেলা দিল, “নিয়ে নাও | বাকি ব্যবস্থা আমি করে দেব |” বুবাই আর কি করল, আমাকে দিয়ে ল্যাকার কিনিয়ে, তুলি দিয়ে বেশ কদিন লকেটটার সারা মুখে মাখাল আর শুকালো, মাখাল আর শুকালো | তারপর একদিন আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বাপি এবার বল, কেমন লাগছে ? বেশ জেল্লা দিয়েছে না ? আর, দেখ এখন পাথরগুলোর আর খসে যাওয়ার চান্স নেই |” আমি বললাম, “ভাল হয়েছে | এর পর ?” বুবাই বলল, “এবার তুমি মাম্মাকে একটা সোনার চেন গড়িয়ে দাও, যাতে লকেটটা মাম্মা পরতে পারে |” তাও হল |

কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল | কেনার সময় দেখা হয়নি যে লকেটটা বেশ ভারী ; আর, পরে ওই ল্যাকারের প্রলেপে তার ওজন আরও কত বাড়ল | ফল হল এই যে, বেণু ওটা পরে ঠিকই ; কিন্তু যেই ওর মনে হয় যাদের যা দেখার দেখে নিয়েছে, যা প্রশ্ন করার (‘বা বেশ তো ! এটা কোথায় কিনেছ ?’) করে নিয়েছে, আমায় একপাশে ডেকে বলে, “এবার আমার হারটা খুলে দাও |“ আমি হারটা খুলে দিলে ও ওটা হাতব্যাগে রেখে নেয় | লক্ষণীয় যে, বেণু কখনও বুবাইকে বলে না হারটা খুলে দিতে | কেন জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, “আমার যা ভালো লাগে তাতে তোমার কী !”

আজও তাই হয়েছে ভেবেও, আমি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কোথায় হারটা খুলেছি | বুবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায় হারটা খুলেছি মনে করতে পারিস |” বুবাই কল্পিত কোনও ডাঁসা পেয়ারায় কামড় দেয়ার অন্যমনস্কতায় বলল, “আমি কী করে বলব ? তোমরা কী করছ না করছ আমি কি তা দেখছিলাম ?”
আমি – “তাহলে তুই কী দেখছিলি ?”
বুবাই – “বা রে ! এত সুন্দর ময়দান | কত গাছপালা, কুকুর, গরু, ভেড়া, ফুচকাওয়ালা, বেলুনওয়ালা, হরি-মটর, ঝালমুড়ি | লোকে যাচ্ছে, আসছে ...”
বেণু – “আহ ! তোমাদের এই কথার পিঠে কথায় ... প্লিজ, তাড়াতাড়ি করে খোঁজো | ওটা কোথায় পড়ে গেছে দ্যাখো |”
বুবাই – “আমি বড় জোর বলে দিতে পারি কোন পথে আমরা এসেছি, কোথায় কোথায় বসেছি | বাকি তোমরা বুঝবে |”
আমি – “তাই বলে দে ... কত তো ভারী দামের লকেট, এখন পুরো সকালটাই মাটি করবে |”

বুবাই আমাদের গাইড করে নিয়ে চলল | প্রথমে অনেকটা হেঁটে এসে একটা রাস্তা পার হতে হল | আমি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে বুবাই বলল, “মনে আছে এখানে আমাদের আগে আগে একটা কুকুর পার হচ্ছিল ? গাড়ির খুব ভিড় আছে দেখে থমকে পাশের ওই গাছটার গায়ে গিয়ে ...”
বেণু বলল, “থাক, থাক !”
আমি আড় চোখে গাছটার নিচে গুঁড়িতে তাকালাম | কোনও আর্দ্রতা দেখতে না পেলেও, রাস্তাটা পার হওয়ার সময় মনে হল জায়গাটা বুবাই ঠিকই বলেছে | ওখানে নিরবচ্ছিন্ন ডিভাইডারটা কাটা ; সজ্জন লোকে কেটেছে, সহজে রাস্তা পার হওয়ার জন্য | রাস্তা পার হয়ে বুবাই রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে ডান হাতটা পিছনে দিকে একটু ঘুরিয়ে বলল, “বাপি, আমরা ওদিক থেকে এসে রাস্তাটা পার হয়েছিলাম |” ওদিকে - অর্থাৎ ‘স্লাইট টু দ্য লেফট’, যেমন গুগল ম্যাপস এ বলে - একটু এগিয়ে কতকগুলো গাছের জটলা দেখিয়ে বুবাই বলল, “এখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম, আমি বাদাম কিনতে চাইলাম, মাম্মা বলল, ‘এই তো লেস চিপস খেলি’ |” ঠিক কথা, একটু একটু মনে পড়ল | তার আগে আমরা আর একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলা দেখেছিলাম | কিন্তু এখন তারা নেট গুটিয়ে সরে গেছে, কোথায় খেলছিল বুঝবার উপায় নেই | তবু বুবাই টেনে নিয়ে গিয়ে দেখালো শুকনো ঘাসে একটা পিচ কাটা | আন্দাজে, যেখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে গিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কিছু পাওয়া গেল না | আবার হাঁটা দিলাম | প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেছে খোঁজা শুরুর করার পর থেকে, আর আমি সন্দেহ করতে শুরুর করেছি হারটা এতক্ষণ পড়ে থাকবে কি না | আমি, ‘কটা বাজে রে, বাবা ?’, ভাবা মাত্র বেণু ঘড়ি দেখে বলল, “দেখ, প্রায় সোয়া এগারোটা হতে চলল |” তখনি বুবাই বলল, “বাপি, মনে পড়েছে | আমি যেখানে লেস চিপসটা খাওয়া শেষ করেছিলাম ওখানে চলো |” আমি বললাম, “চলো কী, তুই তো পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিস | আমার কাছে তো চারিদিক সেই একই ময়দান মনে হচ্ছে |”  “ঠিক আছে, এসো তো”, বলে বুবাই এগোল |

আরও কয়েকটা জায়গায় ঘুরঘুর করে আমরা সেই জায়গায় পৌঁছলাম | একটা বড় তেঁতুল জাতীয় গাছ | তার থেকে একটু দূরে একটা জল ছিটানো ছোট্ট সবুজ ঘাসের লন | সেই জল ছিটানোর ফোয়ারায় হাওয়া আরও ঠাণ্ডা হয়ে গাছের তলায় বয়ে আসছে | বুবাই ওখানে এসে বসে পড়ে ওর বিশেষ যত্নে, ধারটা একটুও না ছিঁড়ে, চিপসের প্যাকেটটা খুলেছিল | পরে ও যখন বলেছিল, “বাপি, মাম্মা, তোমরা খাবে তো খাও, আমার হয়ে গেছে”, আমি আর বেণু বসে পড়ে বাকি চিপস শেষ করতে যোগ দিয়েছিলাম | একটা পড়ে থাকা চিপসের খালি প্যাকেট দেখিয়ে বেণু বলল, “ওই তো, মনে হচ্ছে ওটা সেই প্যাকেটটা | এখানেই তো বসে পড়ে তোমাকে বলেছিলাম হারটা খুলে দিতে |”

তিনজন মাথা ঝুঁকিয়ে গাছতলার সমস্তটাই খুঁজলাম | কিছুই নেই | গাছটার তলায় ঘাস নেই বললেই হয় | লোকজনের ফেলা কাগজের টুকরো, বাদামের ঠোঙ্গা, শালপাতা, যা ময়দানের সর্বত্র বিরাজ করছে বা উড়ে বেড়াচ্ছে, সেসব কিছুই নেই, এক ওই একটা চিপসের খালি প্যাকেট ছাড়া | বুবাই একবার ওটার কাছে গিয়ে ঝুঁকে কিছু দেখল, তারপরে ফিরে এসে বলল, “বাপি, ওটা আমার প্যাকেটটাই |”
আমি – “কি করে বুঝলি ?”
বুবাই – “দেখেই চিনেছি, আমি যেভাবে প্যাকেট খুলি, ধারটা না ছিঁড়ে ...”

একটু পরে বুবাই বলল, “আচ্ছা বাপি, শুধু ওই প্যাকেটটা কি করে রয়ে গেছে, হওয়ায় উড়ে যায়নি কেন ?”
সত্যিই তো | হাওয়াটা প্যাকেটটাকে নড়াচ্ছে, কিন্তু সরাতে পারছে না | আমি এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটার কাছে মুখ নামিয়ে দেখলাম | একটু ফোলা | খোলা মুখে হাওয়া ঢুকে ওটাকে ফোলাচ্ছে, কিন্তু যেন কোনও ভারের চাপে প্যাকেটটা মাটি আঁকড়ে রয়েছে | একটু অস্বস্তি নিয়ে (‘কে জানে, কার না কার খাওয়া এঁটো প্যাকেট’) ওটার মুখটা এক আঙ্গুলে খুলে ভিতরে উঁকি দিলাম | কিছু দেখতে পেয়ে একটু প্যাকেটটা তুলে কাত করলাম | চেন সমেত লকেটটা পিছলে বেরিয়ে মাটিতে পড়ল | বেণু অধীর আগ্রহে বলল, “পেয়েছ ?” বুবাই বলল, “বাপি দেখলে, আমি ঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছিলাম ?” লকেটটা তুলতে তুলতে আমি বললাম, “কিন্তু এটা প্যাকেটের মধ্যে এলো কী করে ?”

যে ভাবে সুদক্ষ গোয়েন্দা কোনও সন্দেহজনক প্রমাণ সংগ্রহ করে, সেই ভাবে বেণু লকেটটা সযত্নে একটা টিস্যু পেপারে মুছে হাতব্যাগে চালান করল | তারপর টিস্যু পেপারটা প্যাকেটটার মধ্যে ঢুকিয়ে সেটা মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, “শুধু কাগজটা মাটিতে ফেললে বিচ্ছিরি দেখাত |"

আমি হাত তুলে জামার হাতা সরিয়ে মণিবন্ধে তাকালাম, সময় দেখতে | হাতে ঘড়ি নেই ! ‘হাতের ঘড়ি কই ?’

“এ কী ? কেউ আমার হাতঘড়িটা দেখেছ ?” আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম | বুবাই শান্ত গলায় বলল, “বাপি, তুমি তখন মাম্মার হারটা খোলার সময়, তোমার ঘড়িতে
মাম্মার চুল ওতে আটকাচ্ছিল বলে, ঘড়িটা খুলেছিলে | মনে নেই ? তোমার প্যান্টের পকেটগুলো চেক করো |”

‘তাই তো’, আমার মনে পড়ল | ‘তাহলে কি ওটা পকেটে রেখে আর বের করিনি ? কিন্তু, তার পরেও তো সময় দেখেছি মনে হচ্ছে |’ ট্রাউজারের পকেট দুটো ঘাঁটলাম ভালো করে, বেশ ক’বার | তারপর পকেট থেকে টাকার ব্যাগ, রুমাল, চিরুনি, হোটেলের চাবি সব বের করে পকেটের কাপড়গুলো উল্টিয়ে বার করলাম | না, ঘড়িটা পকেটে নেই | ততক্ষণে বেণুও নিজের হাতব্যাগ খুঁজছে | মাথা নেড়ে বলল, “আশ্চর্য ! আমার কাছেও তো ঘড়িটা তুমি রাখনি | তাহলে ওটা গেল কোথায় ?”

আবার সবাই মিলে আবার গাছতলায় ঘুরে ঘুরে খুঁজতে লাগলাম, যদি ওটাও পাওয়া যায় |

ইতিমধ্যে এক সৌম্য বয়স্ক ভদ্রলোক এসে আমাদের এই গোরুখোঁজা ব্যাপারটা দেখতে লেগেছেন | তার হাতে দড়িতে বাঁধা একটা কুকুর | সে নিঃশব্দে উসখুস করছে আমাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য | একটু পরে উনি বললেন, “বেঙ্গলী ?” আমি মুখ তুলে তাকিয়ে বললাম, “হ্যাঁ |”
উনি – “কী খুঁজছেন ? কিছু হারিয়েছে কি ?”
আমি – “হ্যাঁ | একটা ঘড়ি |”
উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, “দামী, না সেন্টিমেন্টাল ?”
বেণু – “বিয়েতে বাবা ওকে দিয়েছিলেন ...”
বুবাই – “রোলেক্স, পার্পেচ্যুয়াল |”
উনি – “কী করে হারাল ?”
আমি – “মনে করতে পারছি না | একটু আগে এখানে বসে গল্প করতে করতে ওটা হাত থেকে খুলেছিলাম | তারপর ...”
উনি – “ও | কতক্ষণ আগে ?”
আমি – “কত ? ঘণ্টা খানেক হবে, কি সোয়া এক ঘণ্টা |”
উনি – “এত আগে ? তাহলে কি আর এতক্ষণ ওটা কারো চোখে না পড়ে থাকে ? তাও দেখুন ভাল করে ...”
আমি – “সেই ... আর একটু দেখি, তারপর ...”
উনি – “তারপর, না পেলে অবশ্য থানায় একটা খবর দেবেন | বলা যায় না, কেউ যদি পেয়ে জমা দিয়ে থাকে |”
আমি – “কিন্তু আমরা তো এখানে থাকি না, বেড়াতে এসেছি |”
উনি – “ও ! আচ্ছা ... তাও ...”
একটু পরে, “চলি ... গুড লাক !” বলে ভদ্রলোক কুকুরটাকে টানতে টানতে এগিয়ে গেলেন |

বুবাই আমার হাত ধরে টেনে বলল, “চল বাপি, তাহলে তাই করি |”
আমি – “তাহলে তো ...”
বেণু – “তাহলে কী ?”
আমি – “তাহলে তো, পুলিশকে হারের কথাও বলতে হয় |”
বেণু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, “হারের কথা আবার কাউকে বলার কী আছে ?”
আমি – “না মানে ‘কেস অফ লস্ট এন্ড ফাউন্ড’ তো |”
বেণু – “ব্যাপারটা সে’রকম ?”
(ওই, সেই কথা, যা দিয়ে ঘটনাটার বৃত্তান্ত শুরু করেছিলাম)

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বেণু বলল, “বুঝি না বাপু, নিজের জিনিস হারিয়ে আবার নিজেই ফিরে পেয়েছি, এতে কাউকে বলার কী থাকতে পারে |”
আমি – “তুমি কিছু চিন্তা কোরো না |”
বেণু – “আমি চিন্তা করব না তো কে করবে ?”
আমি – “কেন, আমি কি বাজে কথা বলছি ?”
বেণু – “বাজে কথা ? আমি দেখছি তুমি সেই কাল রাত থেকে ...”
বুবাই – “আহ ! মাম্মা, তুমি আবার শুরু
কোরো না | বাপি, চলো তো | যা করবে করো ... কিচ্ছু বেড়ানো হচ্ছে না |”

কিন্তু থানা কোথায়, মানে সঠিক থানা ? যে সে থানায় গেলে তো বলবে, “এ তো আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে |”

রাস্তায় ফিরে এসে বাস ধরার চেষ্টা করে লাভ হল না | বাস থামে তো কন্ডাক্টর ‘থানা’ কথাটা শুনেই উত্তর না দিয়ে দুমদুম করে বাসটাকে পিটিয়ে উঠে পড়ে | বাসটা ছেড়ে দেয় | দুপুরের কাছাকাছি সময়ে ট্যাক্সিও বিরল | শেষে একটা রিক্সা ধরে বললাম, “কাছে কোথায় থানা আছে, নিয়ে চল |” রিকশাওয়ালা একটু থমকে ভেবে বলল, “বাবু, তিরিশটা টাকা দেবেন ?”
আমি – “কেন ? খুব দূরে কি ?”
লোকটা গাছগাছালির নীচ দিয়ে ময়দানের ওপারের বাড়িগুলোর দিকে দেখিয়ে বলল, “ওইখানে, তবে সারা ময়দানটা ঘুরে যেতে হবে |”
রাজি হয়ে উঠে পড়লাম |

সময় লাগল প্রায় কুড়ি মিনিট | একটা মস্ত কয়েক তলা বাড়ির সামনে লোকটা আমাদের নামিয়ে দিয়ে দেখালো বাড়িটার নীচে চলে যাওয়ার একটা সিঁড়িতে ঢোকার মুখে লেখা রয়েছে – “আদিপুর থানা” | ভাড়া চুকিয়ে ওকে ছেড়ে দিলাম | সিঁড়ির মুখে বেণু জিজ্ঞাসা করল, “আমরাও যাব ?” আমি বললাম, “এস না | এসব ব্যাপারে কতক্ষণ লাগে তা তো জানি না | তুমি কি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে ? আর, কোথায় কী বলতে, কী বলে বসব | তুমি থাকলে ...” বুবাই বেণুর হাত ধরে বল, “চলো, চলো মাম্মা | গিয়ে দেখি না, থানায় কী হয় |”

নীচে নেমে দেখি থানা বলতে মস্ত একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং এর মত জায়গা | চারিদিকে দেয়াল, আর মাথায় ছাত নিয়ে মস্ত খোলা জায়গাটা শুধু থামে আর থামে ভর্তি | তারই মধ্যে, থামের লাইন বরাবর বেঞ্চ কি চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা, কোথাও এক দু’টো টেবিল আর আলমারি | এখানে সেখানে উর্দি পরা লোকেরা বসে কাজ করছে | এ ছাড়াও প্রচুর সাধারণ বেশে লোকজন | কোথাও কাউকে দেখে অপরাধী গোছের মনে হল না | কোনও গারদও দেখতে পেলাম না | ঠিক উল্টো দিকে দূরে এক কোনে আর একটা উপরে ওঠার সিঁড়ি | তার পাশে একটা ঘর – একমাত্র ঘর সমস্ত জায়গাটার মধ্যে | মনে হল তার দরজায় একটা ফলক লাগানো, কারো নামের, যা এত দূর থেকে পড়া গেল না |

আমাদের দেখে একটা উর্দি পরা লোক আঙ্গুলের ইশারা করে একটা চেয়ারে বসা বাবুকে দেখিয়ে দিল | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “উনিই এখানকার দারোগা ? আমি দারোগার সাথে কথা বলতে চাই |” লোকটা মাথা নেড়ে আবার সেই একই ইশারা করল | আমি ইতস্তত করে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম | লোকটা মুখ তুলে চাইলে দেখলাম ওর বুকে নাম ফলকে নাম লেখা, ‘রবি বোস’ | আমি বললাম, “বোস বাবু, আমার একটা ঘড়ি হারিয়ে ফেলেছি ... দামী ঘড়ি, আমার বিয়ের | যদি কেউ ...”
রবি বেণু আর বুবাইকে অগ্রাহ্য করে, তার একমাত্র অন্য চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, “বসুন | বসে কথা বলুন |” তারপর মুখ ঘুরিয়ে কাউকে বলল, “এই, এখানে দুটো চেয়ার দিয়ে যা তো ... হ্যাঁ, বলুন, কী বলছিলেন |”
আমি সংক্ষেপে ঘটনাটা বললাম | রবি সব কথা চুপ করে শুনে বলল, “তার মানে তিনটে ঘটনা ?”
আমি – “তিনটে ?”
রবি – “ওই যে বললেন, আপনার স্ত্রীয়ের হার হারানো, একটা হার খুঁজে পাওয়া, আর আপনার ঘড়ি হারানো | হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ এক সাথে, নয় কি ?”
আমি – “একটা হার নয়, আমার স্ত্রীয়ের হারানো হারটাই খুঁজে পেয়েছি |”
রবি – “একবার দেখতে পারি হারটা |”
বেণু হাতব্যাগ থেকে হারটা বের করে রবিকে দিল | রবি সেটা উল্টে পাল্টে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “এই হার, আর ওনার হারানো হার এক জিনিস ?”
আমি – “নিশ্চয়ই | না হলে আমরা এটা তুলে আনব কেন ? কত জিনিসই তো রাস্তা ঘাটে পড়ে থাকে ...”
রবি – “ঠিক ... কিন্তু আপনাদের কাছে কোনও প্রমাণ আছে যে এই হারটাই আপনার স্ত্রীয়ের ?”
আমি – “দেখুন, আপনি হারটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না | ওটার ব্যাপারে আসিনি | এসেছি আমার হারানো ঘড়ির জন্য |”
রবি – “বেশ ... ঠিক আছে ... তাও আমি আপনার সমস্ত বিবৃতিই নিয়ে নেব | ইয়ে ... আপনি বলবেন আমি লিখব, না আপনি নিজে লিখতে চান ?”
আমি – “আমি লিখে দিতে পারি | কিসে লিখব ?”
রবি একটা ড্রয়ার খুলে গুনে গুনে ছটা কাগজ বের করল | প্রথম দুটোর মাঝে একটা কার্বন পেপার রেখে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নিন তাহলে, লিখুন | উপরে আজকের তারিখ আর সময় লিখবেন, আর আমি লেখাটা চেক করে ঠিক হয়েছে কিনা বলার পর, নীচে সই করবেন |”

তারপর ও হারটা তুলে, “এটা এখন আমাদের কাছে থাক” বলে ড্রয়ারে রেখে সেটা বন্ধ করে দিল |
বেণু আঁতকে উঠে বলল, “আরে, আপনি হারটা কেন নিয়ে নিলেন ? ওটার জন্য তো আসিনি আমরা !” রবির উত্তর না পেয়ে বেণু আমাকে ঠেলা দিয়ে বলল, “এই, তুমি কিছু বলছ না কেন ?”
বুবাই – “মাম্মা, তুমি একটু চুপ করো না | আগে বাপিকে লিখতে দাও | নইলে সব গুলিয়ে যাবে |”

আমি ঠিক কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে রবি বোসকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই তিন জোড়া কাগজ কেন ?”
রবি – “ওই যে তিনটে ঘটনা | প্রত্যেকটার জন্য আলাদা বিবৃতি | আর হ্যাঁ, সময়গুলো ক্রনলজিক্যালি লিখবেন, মানে প্রথমে হবে ওনার হার হারানোর সময়, তারপরে ঘড়ি হারানোর সময়, এবং সব শেষে এই হারটা খুঁজে পাওয়ার সময় | একটা বিবৃতিতে শুধু একটাই জিনিসের কথা লিখবেন, এক জিনিসের সাথে অন্য জিনিস মিলিয়ে মিশিয়ে তালগোল পাকাবেন না কিন্তু | তাহলে তার জট ছাড়াতে আমাদের মুশকিল হবে |”

বেণু আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রবি বোসের নিরস দৃষ্টি দেখে চুপ করে গেল | আমি চোখের ইশারায় বুবাইকে মিনতি জানালাম যে ও বেণুকে একটু সামলে রাখুক | তারপর তিনটে বিবৃতি লিখলাম, এক এক করে | প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল | রবি বোস তারমধ্যে বার কয়েক উঠে কোথাও গিয়ে আবার ফিরে এসে বসল | আমার লেখা শেষ হলে তিনটে পড়ে দেখে বলল নীচে সই করতে | আমার সই করা হলে ও কাগজগুলো ড্রয়ারে পাচার করল | আমি ত্রস্ত হয়ে বললাম, “আমি বিবৃতিগুলোর একটা নকল পাব না |” রবি বোস চেয়ারটা ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “নকল নিয়ে কী করবেন ?” আমি বললাম, “তা হলে কী ভাবে ... ?”
রবি – “আপনারা এখন আসতে পারেন | দিন কয়েক পরে খোঁজ নেবেন |”
আমি – “কিন্তু আমরা তো এখানে থাকি না | বেড়াতে এসেছি, কাল ফিরে যাচ্ছি |”
রবি – “ও ! তা হলে আপনি কাগজ গুলোয় স্থানীয় ঠিকানা আর স্থায়ী ঠিকানা লিখেছেন ?”
আমি – “হ্যাঁ, দুটোই লিখেছি ... আপনি বোধহয় লক্ষ্য করেননি |”
রবি – “না, না আমি দেখেছি | তাও জিজ্ঞাসা করে রাখলাম | যাক, তাহলে চিন্তা কিসের ? আপনারা আসুন | কাল ফিরে যাওয়ার আগে একবার খবর নেবেন | ততক্ষণে কেসটার সুরাহা না হলে আমরা আপনার সাথে স্থায়ী ঠিকানায় যোগাযোগ করব | হয়ত আরও কোনও তথ্য লাগবে | এমন কিছু আছে কি যা আপনি বলেননি ?”
আমি – “যা বলার সবই বলেছি |”

আমরা বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসেছি কি বেণু ক্ষোভে ফেটে পড়ল, “এ তুমি কী করলে ? আমার হারটা কেন দিয়ে দিলে ?”
বুবাই বলল, “মাম্মা, বড্ড খিদে পেয়েছে | কোথাও বসে খেতে খেতে কথা বললে হয় না ?”
আমি – “সেই ভালো | চল, বেরিয়ে দেখি কাছে পিঠে কোনও রেস্টুরেন্ট আছে কি না | তারপর না হয় ফিরে এসে একবার চেষ্টা করা যাবে হারটা ফেরৎ নেয়ার |”

একটু হেঁটেই কাছে একটা খাওয়ার জায়গা পাওয়া গেল | খুব ভিড়, নিরিবিলি টেবিল নেই কোনও |
অন্য লোকদের সাথে শেয়ার করে একটা টেবিলে আমি একা বসলাম, আর একটায় বেণু আর বুবাই | অর্ডার দিতে, খাবার পেতে খুব দেরী হল | তাও ওয়েটার অর্ধেক খাবার দিয়ে কোথায় যে চলে গেল, শেষে উঠে কাউন্টারে বলে এসে বাকি খাবার পেলাম | খেয়ে দেয়ে যখন বেরলাম প্রায় চারটে বাজে | শীতের সন্ধ্যা নামব নামব করছে | রাস্তায় দু’ধরনের ভিড় – যারা বাড়ি ফিরছে কাজ সেরে, ক্লান্ত, আর যারা বেড়াতে বেরিয়েছে, অদম্য | আমরা কোনও দলেই নই | বেরিয়েই বেণু বলল, “থানায় ফিরে চল | আমি ওই হার ফেরত নিয়েই হোটেলে ফিরব |”
আমি – “প্রমাণ ? দারোগাটা বলল না প্রমাণ চাই |”
বেণু – “ও তো গায়ের জোরের কথা | কেমন জোর করে হারটা নিয়ে রেখে নিলো | আর তুমি চুপ করে দেখলে, কিছু বললে না | এক এক সময় তোমার কী যে হয় | আপদ যত ... হারটা ফিরে পেলাম তো ঘড়িটা হারিয়ে গেল |”
আমি – “তা না হলেও তো থানায় গিয়ে ‘হারানো-প্রাপ্তি’র’ খবরটা জানাতে হত |”
বেণু – “আহ ! কী হয়েছে তোমার বলত ? সেই কাল থেকে উল্টোপাল্টা বকছ ... তখনই বলেছিলাম ছাইপাঁশ ...”
বাবুই – “তোমরা না থামলে কিন্তু আমি ... চলো বাপি, থানায় চলো | মাম্মা মনে হচ্ছে কিছু একটা  হেস্তনেস্ত করবে |”

অগত্যা ...

থানায় এসে দেখা গেল, রবি বোস স্থানে নেই | চেয়ারগুলোও নেই | ওর টেবিলের সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দুটো লোক একটা লম্বা লিকলিকে বেঞ্চ বয়ে এনে রেখে বলল, “আপনারা এইটেতে বসুন | সাহেবের ঘরে মিটিং চলছে, সব লোকজন, আর চেয়ার ওনার ঘরে |”

বসে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না, হটাত কেউ কাঁধে টোকা দিল | চোখ খুলে দেখি আরও দু’জন আমার দেখাদেখি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে | টোকা দাতা রবি বোস বলল, “কই, প্রমাণ এনেছেন ?” কথাবার্তা শুনে বেণু আর বুবাই ধড়মড় করে উঠে বসল | বেণু বিরক্ত গলায় বলল, “প্রমাণ কিসের ? আমার জিনিস আমায় ফেরত দিন |”
রবি – “তা কী করে সম্ভব ?”
বেণু – “সে আপনি বুঝবেন | আমি আমার হারটা না নিয়ে যাচ্ছি না |”
রবি – “আপনি থাকুন, কোনও অসুবিধা নেই | থানা তো চব্বিশ ঘণ্টা খোলা | তবে, আমি দশটা নাগাদ চলে যাব | যিনি রাত্রে ডিউটিতে থাকবেন তাকে সব বুঝিয়ে বলবেন ... কেসটা কী, কেন আপনি বসে আছেন, ইত্যাদি |”
বেণু – “না, অত সহজে আমি ছাড়ছি না | আপনার বড় সাহেব কে ? আমি তার সাথে কথা বলব | নিয়ে চলুন |”
রবি বোস সেই দূরের কামরাটা দেখিয়ে বলল, “ওই তো ওনার রুম | যান |”
বেণু – “না আপনাকেও আসতে হবে |”
রবি আশ্বস্ত করার হাসি হেসে বলল, “ভয় নেই, আপনি যান | আমি কাগজপত্র একটু গুছিয়ে আসছি |”

কামরাটার দরজায় নাম ফলকে লেখা ‘অর্জুন ভড়’ | দরজায় টোকা দিতেই ভারী গলায় কেউ বলল, “ইয়েস, কাম ইন |”
ঢুকে দেখি ভিতরে উর্দি পরে এক ভদ্রলোক বসে | মাঝবয়েসী শক্তপোক্ত অবাঙালি চেহারায় চাপা বাঙালিয়ানা | মাথার কোঁকড়ানো চুলে বেশ ভালো রকম তেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা, জুলপিতে তার ধারা চুইয়ে নেমে আসছে | আশ্চর্য যে তাতে পিঁপড়ে ধরেনি | ঘন দাড়ি নিখুঁত করে কামানো | টুথব্রাশ গোঁপ | চাউনি সন্দিগ্ধ, সাক্ষী কপালে তিনখানা গভীর ভাঁজ |

কড়া সিগারেট খাওয়া ধরনের গাড় গলায় অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন, “কী চাই ?”
আমি – “ওই ...”
বেণু আমায় থামিয়ে বলল, “আমাদের রবি বোস পাঠিয়েছেন |”
“ও” বলে অর্জুন নিরাসক্ত ভাবে নিজের কাজে মন দিলেন | বেণু একটা চেয়ার দখল করে বুবাইকে বলল, “এই ! বসে পড়, আর তোর বাবাকে বসতে বল |”
অর্জুন একবার চোখ তুলে চাইলেন, ভাবটা ‘বুঝলাম, কথাবার্তা কে চালাবে |’ আমিও বুঝলাম বেণু ‘ব্যাপারটা সেই রকম’ মেনে চুপ করতে থাকতে আর রাজি নয় | আমাকেই চুপ করে থাকতে হবে |

একটু পরে অর্জুন টেবিলের ঘণ্টিটা বাজালেন | আর্দালি ঢুকলে বিরক্তির স্বরে বললেন, “যা, রবি বোসকে আসতে বল |”
রবি বোস এসে আমাদের অগ্রাহ্য করে অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার, ডেকেছিলেন ?”
অর্জুন মুখ থেকে কলমটা বের করে সেটার লেজ দিয়ে দিয়ে আমাদের দিকে হাওয়ায় একটা খোঁচা দিলেন, “কেসটা কী ?”
রবি – “স্যার, এনারা একটা হার ময়দানে কুড়িয়ে পান | এনে জমা দিয়ে বলছেন, হারটা এনাদের, ফেরৎ দিতে হবে |”
বুবাই – “জাস্ট কুড়িয়ে নয় | ওটা আমার ফেলে দেয়া লেস চিপস এর প্যাকেটে রাখা ছিল ... মনে হয় কেউ হারটা পেয়ে ওই প্যাকেটটার ভিতরে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল, যে পরে এসে নিয়ে যাবে |”
অর্জুন – “ও ! হারটা এখন কোথায় ?”
রবি – “আমার কাছে স্যার |”
অর্জুন – “যাও, ওটা নিয়ে এস |”
রবি – “নিয়েই এসেছি স্যার | এই দেখুন |”
রবি পকেট থেকে হারটা বের করে টেবিলে রাখতেই টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় পাথরগুলো সমস্বরে ঝলমল করে উঠল | রবি এবার হাত থেকে তিনটে কাগজ হারটার পাশে সাজিয়ে রেখে বলল, “আর স্যার, এই তিনটে ওনাদের বয়ান |”
অর্জুন কুঞ্চিত ভুরু আরও কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলেন, “তিনটে বয়ান ? তিনটে কেন ?”
রবি – “হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ, এক সাথে তিনটে কেস, স্যার ! ভাবা যায় না |”
আমি বুঝিয়ে বলতে যাওয়ার আগেই বেণু বলল, “দেখুন, ওর, মানে আমার স্বামীর, মাথা ঠিক নেই | হারটা খুঁজে পেয়েই ও দেখল যে ওর হাতঘড়িটা নেই, মানে হারিয়ে গেছে | একটু আগে ময়দানে বসে ও আমার হারটা খুলেছিল | তখন হাতের ঘড়িটা খুলে কোথায় যে রাখল ... | সেই ঘড়ি হারানোর কথাটা রিপোর্ট করতে এলে, এই এত ঝামেলার সৃষ্টি করলেন আপনার দারোগা | তিন তিনটে বয়ান লেখালেন |”
অর্জুন – “হারটা ফেলে দেয়া খালি চিপসের প্যাকেটে রাখা ছিল বললেন না ? ঘড়িটা ছিল না ওর মধ্যে ?”
বেণু – “না | ছোট্ট প্যাকেট তো, ওই যেটার কুড়ি টাকা দাম | আমরা ভালো করে ওটা ঝেড়ে দেখেছি | তারপর তো, যে টিস্যু পেপারটা দিয়ে হারটা মুছে আমার হাতব্যাগে রেখেছিলাম, সেটা ওর মধ্যে ঢুকিয়েই ফেলে দিলাম | না, ঘড়িটা ওই প্যাকেটের ভিতরে ছিল না |”
অর্জুন – “আশ্চর্য ! যে হারটা চিপসের প্যাকেটে ঢুকিয়ে রেখে গেল, সে কি তাহলে ঘড়িটা পরে চলে গেল ? অবভীয়াসলি, কোন পুরুষের কাজ ... মেয়ে হলে ঘড়িটা রেখে, হারটা পরে চলে যেত | কিন্তু হারটা যখন রেখে গেল তখন নিশ্চয় কোনও মেয়ে সাথী আছে, যে সুযোগ দেখে পরে এসে হারটা পরে চলে যেত ? ... বুঝলে রবি, আমি কি ভাবে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা দেখছি সেটা ধরতে পারছ ?”
রবি – “একদম ঠিক স্যার | তাই তো আমি হারটা রেখে নিলাম | একে তো এনাদের কাছে কোনও প্রমাণ নেই ... কে জানে এঁরাই হয়ত এইভাবে থানায় জমা দিয়ে হারটা ক্লেম করতে চান, যাতে আমরা পুরো ব্যাপারটা ধরতে না পারি | আপনি কিন্তু একদম হান্ড্রেড টেন পার্সেন্ট ঠিক ধরেছেন স্যার | ওই পুরুষ আর স্ত্রী’র অ্যাঙ্গলটা, বিশেষ করে | এনাদের সাথে একদম মিলে যাচ্ছে |”
বেণু – “কী যা তা বলছেন, হ্যাঁ ? আমরা যখন খোঁজাখুঁজি করছি, ওই ময়দানের এক ভদ্রলোক দেখেছেন | তিনিই বললেন থানায় এসে খবর দিতে | ওনার কথা শুনেই  তো এ আমাকে বলল যে থানায় খবর দিলে সব কথা জানাতে হবে | কাল রাত থেকে এ এই রকম উল্টোপাল্টা সব কথা বলছে | নইলে কেউ হারানো জিনিস ফিরে পেয়ে থানায় ডায়েরি লেখায় ? ... এখন ঘড়িটা গেলে যাক | আপনি বলুন এই হারটা ফেরত পাওয়ার জন্যে আমাদের কী করতে হবে |”
অর্জুন – “কী বললেন ? আপনার স্বামী কাল রাত থেকে এইরকম উল্টোপাল্টা কথা বলছেন | কী হয়েছিল কাল রাত্রে ?”
বেণু – “ওই হারটার দার্জিলিং স্টোন নিয়ে তর্ক | ও বলছিল দার্জিলিং স্টোন দার্জিলিং থেকে আসে না, আসে কাশ্মীর থেকে | তাই নিয়ে দুজনের মধ্যে খুব তর্ক বাধল |”
অর্জুন – “কেন ?”
আমি – “বেণু, আমায় বলতে দাও ... আসলে, আমরা যখন ছোট তখনকার কথা | আমার এক মেসো রেলে চাকরি করতেন আর মাসিকে নিয়ে প্রত্যেক বার রেলের পাস নিয়ে বেড়াতে যেতেন, হয় দার্জিলিং, নয় কাশ্মীর, নয় মুসৌরী – মানে হিমালয়ে কোথাও না কোথাও | বেশির ভাগ দার্জিলিং | ফিরে এলে মা মাসিকে বলত, ‘হ্যাঁ রে, ওখানে দার্জিলিং স্টোন পাওয়া যায় না ?’ মাসি বলত, ‘কই দেখিনি তো | দেখলে তোমায় এনে দেব |’ তারপর একবার মাসি শ্রীনগর থেকে ফিরল অনেক অনেক দার্জিলিং স্টোন নিয়ে, সবাই কে দিল | বলল কাশ্মীরে নাকি অঢেল পাওয়া যায় | তাই আমি জানি দার্জিলিং স্টোন দার্জিলিং থেকে আসে না, আসে কাশ্মীর থেকে | সেই কথাই কাল সন্ধ্যায় আমি ওকে বলছিলাম, তো ও তর্ক করতে লাগল যে,  ‘তাহলে নামটা কাশ্মীর স্টোন কেন হল না ?’ আমায় বলল, আমি নাকি ছোটবেলার কথা ভুলে গেছি |”
অর্জুন – “আমি কিছুই বুঝছি না | আপনি ... আপনি কাল রাত থেকে উল্টোপাল্টা কথা বলছেন বুঝলাম | কিন্তু, কেন ?”
বেণু – “আমি বলছি | ও কাল রাত্রে ওই তর্ক হওয়ার পর রেগে গিয়ে ড্রিংক করল | তারপর উল্টোপাল্টা যত কথা |”
অর্জুন অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি ড্রিংক করেন ?”
আমি – “না ... মানে ক্বচিৎ কদাচিৎ | এই যেমন, আমি এখন কোম্পানির হলিডে-প্ল্যানে বেড়াতে এসেছি | ওতে হোটেল থেকে কিছু কমপ্লিমেন্টরী ড্রিংক দেয় | তবে আমি এতদিন আছি, একদিনও খাইনি | কাল খেলাম, কেন না আমার সন্দেহ হল, সত্যি কি আমি ছোটবেলার কথা মনে করতে পারছি না | আসলে বুঝলেন, ড্রিংক করলে না আমার মাথাটা খোলে, খুব পুরানো কথাও পরিষ্কার মনে পড়ে যায় |”
অর্জুন – “তাই বলে আপনি কি এত ড্রিংক করেছিলেন যে আজ সকাল অব্দি তার ইয়ে ছিল ?”
আমি – “না, না, মোটেই নয় |”
অর্জুন – “মাফ করবেন | এ ভাবে আমাদের পক্ষে কিছু নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয় ... না, না রবি, এনাদের এখন যেতে বল | মনে হচ্ছে এনার এখনও ড্রিংকের ঘোর কাটেনি | পরে কখনো দেখা যাবে ... এখন আপনার আসুন | হারটার প্রমাণ নিয়ে এসে দেখা করুন রবির সাথে |”

আমি উঠে দাঁড়ালাম, বুবাই ও | কিন্তু বেণু অনড় হয়ে বসে রইল |

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে অভ্যাস বসত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ভাবছি কী করব, তখনই ওটায়
অ্যালার্ম বাজল | বেণু বলল, “এই ওঠো | আর কত ঘুমবে ? মনে নেই বারোটায় হোটেল ছাড়তে হবে ? ভাবছি তার আগে একটু বেরব, টুকিটাকি কিনতে ... জানো, আমার হারটা খুঁজে পাচ্ছি না | তুমি কি দেখেছ ?”

আমি চোখ খুলে বালিশের তলায় হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজলাম, সময় দেখতে | হাতে হারটা ঠেকল, আর হাতঘড়িটাও | মনে পড়ল, গতকাল রাত্রে শুয়ে পড়ে বেণু বলেছিল ওর হারটা খুলে দিতে | একটু বেশি পান করে ফেলেছিলাম বলে কিনা জানিনা, হারটা খুলতে গিয়ে বারবার ঘড়ির স্ট্র্যাপে বেণুর চুল জড়িয়ে যাচ্ছিল | তখন ঘড়িটা খুলে, তারপর বেণুর হারটা খুলেছিলাম, আর দুটোই বালিশের তলায় রেখেছিলাম | বেণু জিজ্ঞাসা করেছিল, “নেশার ঘোরে হারটা কোথায় রাখলে ? ঘুম থেকে উঠে মনে করতে পারবে ?” আমি বেণুর কথা শুনতে শুনতে অতল ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম - ওর চুল, ওর কাশ্মীরি গলা, ওর দার্জিলিং স্টোনের লকেট, এই সবের কথা গুলিয়ে নিয়ে |


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ১৫ জুন ২০১৪

উনসত্তরের ইতিহাস

|| উনসত্তরের ইতিহাস ||


তুমি যখন,
উল্লাসে ছিঁড়ে ফেলে জামা, দাবড়ে শীর্ণ বুক
আঙ্গুল রেখে বাঁকা ঘোড়ায়, নামিয়েছ বন্দুক
দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছ মাছিতে; দেগেছ নিশানা
কালো রুমালে বাঁধা অন্ধ, আধমরা লাশখানা
পেয়ে পোড়া বারুদের গন্ধ বাতাসের প্রশ্বাসে
কুঁকড়ে এগিয়েছে তোমারই দিকে, অবিশ্বাসে
তুমি তাও অবিচল, বন্দুক স্থির, লক্ষ্য অব্যর্থ
কান ফাটানো আওয়াজে এক মুহূর্তের অনর্থ
করেছে অর্ধনমিত বন্ধুত্বের অভিজ্ঞান, পলকে
নলচের নীল ধোঁয়ায়, লালচে আগ্নেয় ঝলকে

তুলে তার মাথা, নেতিয়ে পড়া, মৃত্যুর আলসে
জানিয়েছ অভিনন্দন, রক্তাক্ত হাতের কুর্নিসে

তখন,
আমি সবে পা দিয়েছি আমার একমাত্র উনিশে
শরীরটা বাঁধা মাটিতে, মন উড়ু উড়ু আকাশে
বুকের পাঁজরে যত অনাবিল আবেগের উচ্ছ্বাস
‘কিছুতেই দমব না !’, দৃঢ় মুঠোয় আত্মবিশ্বাস
যৌবনের সূর্য মধ্যাকাশে, দূর অস্ত্ তার অস্ত
বন্ধুত্বের বাড়ানো হাত, হোক যতই অনভ্যস্ত
প্রেম, চেতনার দিগন্তে ডুমুরের ফুলের কল্পনা
সুবাসিত না-খোলা খামে বন্ধ ফুল এক অচেনা
তাই চাকরি, উচ্চাশা, সংসার চিন্তা সরিয়ে দূরে
একাগ্রচিত্তে ‘বন্ধুই সব’, এ’কথা রেখেছি ধরে

কিন্তু,
ওই কান ফাটানো আওয়াজে, মুহূর্তের অনর্থে
উড়ে গেল শান্তির পায়রারা পাক খেতে আবর্তে
সত্য অসত্যের তুলকালাম রণে আমরণ যুঝে
নিরীহ নিরপেক্ষ মানুষেরা প্রাণ দিল চোখ বুজে

আর
আমি এগোলাম একধাপে উনিশ থেকে উনত্রিশে
নিটোল অতীত হয়ে ভঙ্গুর, ভবিষ্যতে গেল মিশে
অনাগত বঁধু নাবালিকা, যে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিতা
অপেক্ষায় রয়ে গেল সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বাগদত্তা

কেন
পাষাণ হয়ে গেল যা প্রথম প্রাণে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ?
দশটা বছর লাগল ভুলতে শুধু সেই একটা মুহূর্ত ?
 

কেন,
বন্ধুত্বের বলি নিয়ে বিধাতা করে তার শেষ পরিহাস,
যখনই এক বন্ধুর রক্তে লেখা হয় অন্যের ইতিহাস ?


--------------------------------------------------------------------------------------------------

ইন্দ্রনীর / ১৫ জুন ২০১৪

শুক্রবার, ১৩ জুন, ২০১৪

তোমায় খুঁজেছি

|| তোমায় খুঁজেছি ||


শুধু কল্পনায় –
ধোঁয়াটে কুয়াশায় এক ফালি রোদের ঝলকে
পিঙ্গল ময়দানে এক ফালি ঘাসের নামফলকে
বসন্তের যাই যাই শীতের শেষ শিথিল বাতাসে
প্রশান্ত ঝিলের নির্নিমেষ বুকের নীল আকাশে
বাতি নেভা গলিতে এক ফালি চাঁদের আলোয়
চিলে কুঠির ঘুলঘুলিতে নিশির অতিথি পায়রায়
লাল শালু লেপের কোরা খোলের উষ্ণ আবেশে
দুঃস্বপ্নে আছড়ানো ঢেউয়ের নিষ্ফল আক্রোশে
ছায়াবীথির সন্ধানে অবসন্ন পথিকের হতাশায়
ক্রন্দসী চাতকের মুহুর্মুহু তিক্ত জিভ পিপাসায়
ভ্রান্ত, ক্লান্ত চোখে চমকে শিউরে ওঠা পলকে
উদ্বেল কান্নায় থরথর ওষ্ঠাধরের নীচে চিবুকে
কেঁপে, থেমে, জমে যাওয়া হাসির উচ্ছ্বাসে
চুলে খুঁজে পাওয়া অবিমিশ্র সুরভির আভাসে

তোমায় খুঁজেছি, আর আরও খুঁজেছি এই ভেবে
যে জন্মান্ধ চোখের তারায় ওই ছবিরা নিভে গেলে
পাব কি তোমায় ঈশ্বরে ?

------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ১৩ জুন ২০১৪

বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০১৪

প্রতীক্ষা

|| প্রতীক্ষা||


আদিগন্ত ধুসর, তার চূড়ায় স্থাবর
ক্ষুদ্র এক পরিসর | চির নীল নশ্বর
                   সেখানে ভাসছে, টুকরো আকাশ
মেঘের দূরভাষে, সেচের অভিলাষে
গাছে পাতা ঝলমল, গাছও টলমল
                   পেয়েছে বৃষ্টির আশাবাদী আভাস
কিছু গাংচিল, করে আকাশে মিছিল
শিথিল হাওয়ায় স্থির ডানায় ভাসে
                  যেন তারা আজীবন উদ্দেশ্য বিহীন
জানালার পাট খুলে, এলোমেলো চুলে
চিরুনিতে কী যে মোছে. আলগোছে,
                রুগ্ন দুই হাত, ফ্যাকাসে, আভরণহীন

বছরে একবারই ভাঙ্গতে নির্জলা উপবাস
বৃষ্টির প্রতীক্ষায় স্তব্ধ পৃথিবী, অচল নিশ্বাস ||

---------------------------------------------------------------------

ইন্দ্রনীর / ১২ জুন ২০১৪

রবিবার, ৮ জুন, ২০১৪

বর্ষা

ফেসবুকে একটু লিখেছি এই দু'লাইন -

আজ বর্ষার ঘনঘটা সারা আকাশের আদলে
শুনব কি দ্রুততাল, ঝাঁপানো বৃষ্টির মাদলে ?


কি কবিতার বাঁধ খুলে গেল | সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল চড়বড় করে নামা বৃষ্টির মত | কেউ যেন আমার ঘোড়া টিপল ...
এই দ্যাখো তার পরিণাম

|| বর্ষা ||


বর্ষার আগমনীর তোড়জোড় চলছে
আকাশে কালো মেঘেরা শশব্যস্ত
পিতামহ ভীষ্ম, গ্রীষ্মের দিন ঢলছে
তবু, এখনও বিলম্বিত তার সূর্যাস্ত

পূবে’র জানলাটা খুললে সন্তর্পণে
নিঃসাড়ে হানা দেয় জোলো হওয়া
ভেসে আসে আবছা গানে গানে
“আয়ো সাঁওন, পওন চলে পুর্বাইয়া”

এই ঘর্মাক্ত কলেবরে শীতল মূর্ছনা
শোনায় সুদূরের অদৃশ্য সান্ধ্য বৃষ্টি
মনের জানালা খুলে পাতি বিছানা
উঁকি দেয় কারো মুখচ্ছবি কী মিষ্টি

তার ভালো নাম ছিল বোধহয় বর্ষা
ডাকনাম ছিল কিনা তা ভুলে গেছি
ভোরের আকাশের মত তার ফর্সা
মুখে অজস্র চোখের জল মুছেছি

অশ্রুধারায় স্রোতস্বিনী ছিল সে
জমান মেঘ বুকে গুমরে গুমরে
কাঁপিয়ে ঠোঁট, চোখে হেসে হেসে
আমার বুক ভিজিয়ে গেছে চিরতরে

এখন পূবে হাওয়ায় তার খোলা পশমি চুল
তার প্রশ্বাস উষ্ণ, আর্দ্র, কামনায় কাতর
জানি আমি চলেছি করতে আবার সেই ভুল
ঘ্রাণে গ্রাহ্য করে তার অনাঘ্রাত সোঁদা আতর ||
------------------------------------------------------------------------

ইন্দ্রনীর / ০৮ জুন ২০১৪

একটাই ঠিকানা

|| একটাই ঠিকানা ||


তোমায় খুঁজেছি কত, গ্রামে, গঞ্জে, শহরে
কিছু ঠিকানা ছিল ছেঁড়া মোড়ানো কাগজে
একটা মনের গহিনে লুকানো, অগোচরে

সে সব কাগজে লেখা ছিল না কিছুই দেখি
শুধু ছিল তাদের দুমড়ানো মুচড়ানো ভাঁজে
তোমার চেহারার চেনা হস্তাক্ষর, দুই আঁখি

ভেবেছিলাম, চেয়ে চেয়ে, চোখে চোখে
মেলাব ঠিকানা, পরিপূর্ণ শরীরের সাকিনে
হায়, দিন গেল দীঘল অবয়ব দেখে দেখে

দৃষ্টির নির্যাতনে হয়ে অন্তঃসলিলা, অবলা
গুটিয়ে তার সমস্ত শরীর ভ্রূণের ভঙ্গীতে
করল অন্তরে শত অশ্রুপাত, হল রজঃস্বলা

তোমায় খুঁজতে কাটল বেলা, গেল দিন
বিলীন হল আমার অস্তিত্ব, সব নারীত্বে
তুমি থেকে গেলে কোথাও, অস্তিত্বহীন

এখন একটাই ঠিকানা তোমার, অনুমানই
কৌমার্যে পরিপক্ব
চির অপেক্ষায়
উপেক্ষিতা
নারী ||


--------------------------------------------------------------------------------


ইন্দ্রনীর / ০৮ জুন ২০১৪

শুক্রবার, ৬ জুন, ২০১৪

শহর থেকে দূরে

|| শহর থেকে দূরে ||


এই উৎপাতের শহর থেকে দূরে
এমন জায়গা আছে কোন পুরে
যেখানে গোধূলি আজ ও রক্তিম

যেখানে মানুষের ধৈর্য অসীম
অন্ধ-রাগ নয় রক্ষিতা-প্রতিম
নির্লজ্জ মনের সুপ্ত কামনা
মুক্ত চিন্তা, যেন সিক্তবসনা
যেখানে ঘর্মাক্ত নয় করমর্দন
আলিঙ্গনে শিথিল করে পরিজন
দুর্বল পড়ে না সবলের কবলে
মেনে নিয়ে, বিধির বিধান বলে
যুক্তি তর্ক মুছে ফেলে পাপোষে
মামলার শেষ কথা হয় আপোষে
দিন শেষে নামে প্রশান্ত সন্ধ্যা
“আসুক রাত্রি”, ভয় পায় না বন্ধ্যা

যেখানে ধীরে ধীরে, বন্ধু ধীরে ধীরে
কথা সারে নিজের, যায় চুপ করে
শেষে বলে, “হ্যাঁ, বলো তোমার কথা |
ছেড়ে এসেছ তো শহরে সব ব্যথা ?”


-----------------------------------------------------------

ইন্দ্রনীর / ০৬ জুন ২০১৪

মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০১৪

দোনোমনা

|| দোনোমনা ||


রাত্রে তুমি নেই, আসবে সকালে ...
                                     ... শূন্য দু’পাশ, বিছানায়
আমি থাকি জেগে নিভৃতে, এক চিন্তার দোনোমনায়
 

দেখি
অসীম আয়ত সান্ধ্য পৃথিবীতে রুপালি জোছনায়
সবুজ মাঠের বুকে, হাওয়ার চাদর টেনে, প্রকৃতি ঘুমায়
আকাশের আবলুস বুকে অগুনতি তারার বসন্ত-ক্ষত
দুঃসাহসে খুঁটিয়ে চাটে চাঁদ, নির্লজ্জ কামুক, রবাহূত
আলিঙ্গনের আশে বাঁকা আকাঙ্ক্ষী ময়ূরাক্ষীর রেত
চুরিয়ে চায় পাশ ফিরে, নিঃসাড়ে, প্রৌঢ় ধানক্ষেত
কামিনী চপলা কপোতী, কপোত ঢাকে মেলে পাখা
অভিসারে নিষিক্ত নীড়ে | রোমাঞ্চে কাঁপে তরু শাখা
বিলের উপর ছায় এক মায়াবী কুয়াশা, বিদেহী রূপসী
তার ওড়নায় লুকিয়ে থোপা শালুকে সাজানো আরশি
তুমি যেন কাঁদ, না ককিয়ে, করে আলুনী অশ্রুপাত
নীরবে, শিশিরে ; নিশুতি বিরহে করে মূক প্রতিঘাত

আসক্তির জোয়ার উঠেছে ধমনীতে, তুমি পাশে নেই
কী কাম্য, সকালের প্রতীক্ষা, না, এই নিশির আশনাই ?

আমি থাকি জেগে নিভৃতে, ওই  চিন্তার দোনোমনায়
তুমি নেই, রাত্রির বাহুতে পিষ্ট আমি, একা বিছানায় |


-----------------------------------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ০৩ জুন ২০১৪

রবিবার, ১ জুন, ২০১৪

ক্ষণিকের অভিসার

|| ক্ষণিকের অভিসার ||


শিপ্রার সাথে আমার পরিচয় ছোটবেলা থেকে | প্রায় আমার সমবয়সী, হয়ত কয়েক মাস, কি এক বছরের ছোট | ওর বাবা, বাপির শ্রীধর দা’, কলেজে বাপির থেকে ক’ বছরের সিনিয়র ছিলেন | আমি ওনাকে শ্রী জেঠু বলে ডাকতাম |

১৯৪২ এর ডিসেম্বরে কলকাতায় জাপানী বোমা পড়া শুরু হলে বাপি কলেজের পড়া শেষ করতে পারে না  | বাপি জামশেদপুরে এক দূর সম্পর্কের মামার কাছে পালিয়ে আসে | তিনি বাপিকে তখনকার বর্ধিষ্ণু টাটার লোহার কারখানায় কারিগরি শিক্ষানবিস করে ঢুকিয়ে দেন |

সেই বছরই শ্রী জেঠু কলেজের পড়া শেষ করে ভারতীয় রেলে কমার্শিয়াল ক্লার্ক এর পদে যোগ দিয়েছিলেন | ওনার পোস্টিং হয় জামশেদপুর এর দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ১০০ মাইল দূরে কেঁকুঢগঢে | জেঠুর কাছে শুনেছিলাম কেঁকুঢগঢ নাকি জায়গাটার আদি নাম কিঙ্কর গড়ের অপভ্রংশ, যা ওখানকার কুঁড়ে, জাবর কাটা আদি বাসিন্দারা চিবানো তামাক আর তার রসে ভরা মুখে উচ্চারণ করতে পারত না |

শিক্ষানবিশি শেষ করে বাপি টাটার লোহার কারখানাতেই কাজ পায় | ফি বছর গরমকালে গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে যাওয়ার পথে, কিম্বা ফিরত আসার সময়, শ্রী জেঠু জামশেদপুরে নামতেন সপরিবারে | আমাদের সাথে কটা দিন কাটিয়ে যেতেন | ওদের বেড়িয়ে যাওয়ার সবচেয়ে প্রখর স্মৃতি, আমার যখন স্কুলের পাট শেষ হচ্ছে |

আমাদের তুলনায় ছয় ছেলেমেয়ের ওই পরিবারটা ছিল অনেক বড় | প্রথমে দুই ছেলে, তারপর দুই মেয়ে ও শেষে যমজ ছেলে ও মেয়ে | কলেজে পড়া বড় দুই ভাই, সৃজন দা’ আর সুজন দা’ আমার থেকে দাক্ষিণ্যে ভরা সৌহার্দ্যের দূরত্ব বজায় রেখে চলত | ছোট দুই ভাই বোন নিজেদের নিয়ে এতো মেতে থাকত যে আমার হওয়া না হওয়ায় তাদের কিছু এসে যেত না | তাই বাকি থাকত, শুভ্রা দি’ আর শিপ্রা, মাঝের দুই মেয়ে, আমার উপর ভাগ বসাতে |

জেঠিমা ছিলেন রোগা, ঘন শ্যামল বর্ণ, মেদ হীন মুখে কোটরে ঢোকা বড় বড় চোখ, শীর্ণ সূক্ষ্ম নাক, আর সরু চাপা ঠোঁট | আমি মাঝে মাঝে অনুমান করার চেষ্টা করতাম কালো না হলে কি জেঠিমা দেখতে ভালো হতেন | কিন্তু না, উনি ভীষণ কালো ছিলেন | সব ছেলে মেয়েই কম বেশি কালো ছিল, শুধু শুভ্রা দি’ আর শিপ্রা বাদ দিয়ে | ওদের গায়ের রং ছিল অনেক হালকা, আমার মায়ের ভাষায় ‘পাকা গমের রং’ | আমার দৃষ্টিতে ওদের গায়ের রঙে ছিল তপ্ত কাঁসার বর্ণাঢ্য |

বড় মেয়ে শুভ্রা দি’ আমার থেকে দু’ বছরের বড় ছিল | ভারী মিষ্টি ছিল ওর অচপল হাসি | হাসলে দাঁত দেখা যেত না | শুধু ঠোঁট দুটো দুপাশে আরও ছড়িয়ে যেত, আর তাদের দুই কোন একটু উঠে শুভ্রা দি’র চাপা গালে দ্বিতীয়ার চাঁদের মত টোল ফেলত | উচ্চতায়  ছোটখাটো, শুভ্রা দি’র চৌকো মুখটায় চোয়াল আর গালের হাড় ছিল খুব প্রকট  | ঢেউ খেলান চুল সবসময় শক্ত হাতে টেনে বিনুনি করে বাঁধা থাকত | কাঁধে আর  শ্রোণীতে শুভ্রা দি’র শরীরের কাঠামো ছিল বড্ড চওড়া | অথচ, শুভ্রা দি’র শরীর ছিল বয়েসের অপেক্ষায় অনুচ্চারিত, যা নিয়ে ও খুব আত্মসচেতন ছিল | শরীরে ভাস্কর্যে উন্নতি অবনতির এই অভাব তাই শুভ্রা দি’ ঢেকে রাখত মাড় দেয়া শাড়ির খোলের প্রলেপে | তবুও, সব নিয়ে, প্রখর গরমেও ওর কাছ ঘেঁষলে একটা ঝরঝরে স্বর্গীয় সুগন্ধ পেতাম | আসা আর যাওয়ার সময় শুভ্রা দি’ যে আমাকে জড়িয়ে ধরত, বলতে দ্বিধা নেই, আমি তার প্রতীক্ষায় থাকতাম |

শিপ্রা ছিল লম্বা, উচ্চতায় প্রায় আমার সমান, শরীর না হালকা না ভারী | আমার সেই বয়েসে ওর মুখের চেয়ে বেশি পরিষ্কার ঘরোয়া সাদামাটা চেহারা আমি আর দেখিনি | ওর ছোট মাথা থাকত লম্বা নমনীয় গলার উপর | গলায় কণ্ঠমণির নিচে হালকা মেদের স্তরে তিনটে কালচে গভীর খাঁজ ছিল, যার তুলনায় আশেপাশের ত্বক ফ্যাকাসে মনে হত | খুব গরমে ওই ত্বক আর্দ্র হয়ে চিকচিক করত |

ওর মধ্যে আমার যেটা ভালো লাগত তা ছিল ওর নিরস্ত্র করা সারল্য | ওর কিশোরী শরীরে কোনও আগ্রাসী আকর্ষণ ছিল না | প্রবণতায় প্রায়োগিক, পড়াশোনায় ওর তেমন প্রচেষ্টা ছিল না, আর তার সাধারণ ফল নিয়েও ওর কোনও লুকোচুরিও ছিল না | অথচ, আমি কোনও বুদ্ধিমত্তার কথা বললে দেখতাম ওর মুখ উষ্ণ উজ্জ্বলতায় ভরে উঠত | অবশ্য, ওকে বলার মত তেমন কথা আমি সচরাচর খুঁজে পেতাম না | আমার মনে হত আমাদের দুজনের কৌতূহল আর আগ্রহের বিষয়ের মধ্যে দুই মেরুর ব্যবধান |

আমাদের এই ব্যবধানের একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বাইরের আকর্ষণ | ও ভালবাসত পায়ে পায়ে দূরে বেড়াতে যেতে | প্রায় দিনই, সূর্যাস্তের আগে, যখনও বাইরে গরমকালের আলো খুব উজ্জ্বল, ও শাড়ি পরে এসে আমায় জিজ্ঞাসা করত আমরা হাঁটতে যেতে পারি কি না | তখন আমি আমার সাইকেল নিয়ে বেরতাম | আমি ধীরে ধীরে সাইকেল চালাতাম, আর ও হাঁটত, কয়েক পা পিছনে পড়ে | ও নিজের মনে ডুবে থাকত, কথা হত খুব কম | কখনো আমি থেমে পিছনে ফিরে তাকালে ও আমায় দেখে একটু হাসত, ওর সমতল দাঁতের সারি দেখিয়ে | একই সাথে, মাথা ঝাঁকিয়ে ও আমায় অনুনয় করত না থামতে |

কোনও কোনও দিন খুব দূরে চলে গেলে, ফেরার পথে আমি জোর করতাম ওকে সাইকেলে নিয়ে নেয়ার  জন্য | তখন ও উঠে আমার সামনে বসত বাঁ পাশে দু’ পা ঝুলিয়ে | আমি খুব জোরে প্যাডেল চালাতাম তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য, আর তখন কখনো ওর টানটান পায়ে আমার বাঁ হাঁটুর ঠোকা লাগত | জোরালো হাওয়া উঠলে, ওর পাট-রেশমি চুলের গুছি হাওয়ায় উড়ে, পিয়ানোয় বুলান আঙ্গুলের মত, আমার চেহারায় বিলি কেটে আমায় সম্মোহিত করত | বাড়ি পৌঁছে দেখতাম হৃদপিণ্ডটা অদ্ভুত এক স্নায়বিক দুর্বলতায় ছটফট করছে | সেই সন্ধ্যাগুলো আমি আনমনা হয়ে থাকতাম, আর খাবার টেবিলে ওর চোখ এড়িয়ে যেতাম | ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখতাম যে ওকে আমি সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছি | সাইকেলের ঘণ্টির নাগাল পেতে আমার হাত ওর কোমরের কাছ ঘেঁসে যেতে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলছে | ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে নিজেকে নিয়ে ঘৃণা হত যে একজন, যাকে আমার রুচিতে এত সাদামাটা আর আকর্ষণ হীন মনে হয়, তাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখছি |

তাও আমি ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারতাম না | যখন ওর দিদি আমাকে জড়িয়ে ধরত, ওর দৃষ্টি দেখে মনে হত যেন কোন অচিন জন ওকে অবজ্ঞা করে ওরই জিনিস ধরে আদর করার স্পর্ধা করেছে | ওর সেই দৃষ্টির স্ফুলিঙ্গ আমার সর্বাঙ্গে এক গুপ্ত উত্তেজনার অগ্নি সঞ্চার করত | সত্যি বলতে কি, ও আমায় এক হেঁয়ালির মত দখল করে রেখেছিল, যার জট আমি খুলতে চাইতাম না |

আমি কলেজে যাওয়ার পর, শ্রী জেঠুদের গরমে গ্রামে যাওয়া বন্ধ হলে, ওদের সাথে আমাদের দেখা সাক্ষাত ছিন্ন হল | আমার কলেজের শেষ বছর তার এক সুযোগ পেলাম | কোনও গণ্ডগোলে লোহার কারখানায় আমার হওয়ার ট্রেনিং হয়ে উঠল না | সে’ বছরের প্রচণ্ড গরমটা ঘন ঘন কালবৈশাখী হয়ে অনেকটা প্রশমিত হয়েছিল | বাপি বলল আমি গিয়ে দেখে আসতে পারি শ্রী জেঠু কেমন আছে, কী করছে | বাপি জানত শ্রী জেঠু আমার এক রকম প্রিয় ছিল | আসলে, আমার ভালো লাগত যে অনেক বিষয়ে যেখানে বাপি কোনও উচ্চবাচ্যও করত না, সেখানে জেঠু আলোচনা, বিতর্ক করতে পারতেন | আমার মনে আছে, একবার বাপির সাথে আমার খুব তর্ক হলে, জেঠু আমায় বলেছিলেন বদ্ধমূল ধারণা না পুষতে | পরে উনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন ওই কথার মানে কী | এও  বুঝিয়েছিলেন যে বদ্ধমূল ধারণা পোষা আর বাস্তববাদী হওয়ার মধ্যে কী তফাত | অতএব (ওনার ছয় সন্তান হওয়া সত্যেও) আমার ধারণা হয়েছিল যে উনি নিজেকে বাস্তববাদী মনে করেন | প্রকৃতপক্ষে উনি ছিলেন উগ্র নাস্তিক, এবং তখনকার বাঙালি হিন্দু সমাজে বর্তমান সব রকমের কুসংস্কার কে প্রকাশ্যে ধিক্কার করতেন |

আমি বাপির কথা শুনে এক ঝরঝরে সকালে কেঁকুঢগঢ যাত্রা করলাম | ট্রেনে ঘণ্টা চারেক লাগল | নামলাম প্রায় শূন্য এক প্ল্যাটফর্মে | স্টেশন মাস্টারের অফিসে জিজ্ঞাসা করে জানলাম শ্রী জেঠু রেলের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন | এখন উনি রেলে স্লিপার সরবরাহের ঠিকাদার হয়েছেন | রেলের কোয়ার্টার ছেড়ে উঠে গেছেন | লোকটা আমাকে বলে দিল কী করে জেঠুর বাসায় পৌঁছাতে পারব – স্টেশনের বাইরে থেকে আমায় একটা জীপ ভাড়া করতে হবে |

জীপের যাত্রা সবুজ শালের জঙ্গলের ধূলিধূসর পথে এক ঘণ্টা সময় কাটিয়ে, শেষ হল আদি কিঙ্কর গড় শহর পার করে |

শহরের শেষ অনেক দূরে ছাড়িয়ে, পুরনো দুর্গের কাছে জেঠুর বাড়ি | প্রায় মহলের সমান বাড়িটা ছিল রাজার দেওয়ানের | তার দুরবস্থায় বিক্রি করা বাড়িটা জেঠু জলের দরে পেয়েছিলেন | আগাছায় ভরা বিস্তীর্ণ জমিতে দাঁড়ানো বেশ কিছু বড় কামরার বাড়িটার দেখলাম মেরামত আর রং করানোর বেশ দরকার | তাও, প্রথম দৃষ্টিতেই শহরের ভিড় থেকে দূরে ওই বাড়িটার মায়াবী নিঃসঙ্গতা আমার নিশ্বাস কেড়ে নিলো |

জেঠু বাড়িতে ছিলেন না | জেঠিমা আমায় দেখে ভীষণ খুশি হলেন | আমি আশা করেছিলাম শুভ্রা দি’ ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরবে | ওকে দেখতে পেলাম না, আর বাড়িটা খালি খালি মনে হল | আমার ব্যাগ রেখে জেঠিমা আমায় চা এনে দিলেন | ধীরে ধীরে, আমি খেই ধরলাম গত চার বছরের | সৃজন দা’ আর সুজন দা’ চাকরি পেয়ে চলে গেছে, একজন রাউরকেলায়, আর অন্যজন কটকে | শুভ্রা দি’ কলকাতার কাছে এক স্কুলে মাস্টারি করছে, আর এক সহপাঠীকে বিয়ে করেছে | শিপ্রা কলেজে গেছে, শিগগিরই ফিরবে | যমজ ভাই বোন স্কুলে, ওরাও শিগগিরই ফিরবে |

যমজ দুজন হইচই করতে করতে ফিরে শান্ত হলে, একটু পরে শুনলাম আবছা গেট খোলার কটকট আওয়াজ | হটাত কোন অজানা কারণে এক অস্বস্তিকর উদ্বেগ যেন তার মুঠিতে আমার পেটটা মুচড়ে ধরল | বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখলাম বাগানের পথ দিয়ে শিপ্রা আসছে | ওর স্পষ্টত গরম লেগেছে, গলার ঘাম শাড়ির আঁচলে মুছছে | বাগান থেকে বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির নিচে পৌঁছে, ও আমার উপস্থিতি অনুভব করে উপরে তাকাল | সাথে সাথে সর্বাঙ্গের সব আন্দোলন মুহূর্তে থামিয়ে ও স্থাণু হয়ে গেল |

আমি একটু হাসলাম | ও শুধু বলল, “তুমি !” তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল | ঘরের দরজায় পৌঁছে, থেমে, ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে চোখের পাতা নামিয়ে ইঙ্গিত করল যে আমি ওকে অনুসরণ করতে পারি |

প্রায় বন্দিত্বে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা আমার বিশেষ মনে নেই | শিপ্রা খুব ভোরে উঠত, আর আমি যতক্ষণে উঠতাম ও কলেজে চলে গিয়ে থাকত | যদি আমি উঠে দেখতাম ও তখনও বাড়িতে আছে তাহলে বিছানায় পড়ে থাকতাম ও চলে না যাওয়া অব্দি | ও বাড়ি ফিরত দুপুর দু’টোর সময় | ততক্ষণে আমি জেঠিমার চাপে পড়ে খেয়ে নিয়েছি | আমি ওকে দেখতাম বিকেলে, যখন ও আমার চা নিয়ে আসত | আমাদের বলার কথা খুবই কম ছিল, আর একের কলেজ নিয়ে অপরের যা কৌতূহল, তারও আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে শেষ হয়ে গেল | তাও, প্রত্যেক রাত্রে আমি যখন বিছানায় যেতাম, ও এসে আমায় জিজ্ঞাসা করত কিছু লাগবে কি না | ও তখন, আমার বিছানায় বসতে বলার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত | আমি ফিরে আসার আগের রাত্রে ও এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “এবার আর আমরা হাঁটতে গেলাম না |” আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আরও শোনার জন্য | ও জিজ্ঞাসা করল,  “কাল কি আমি তোমার সাথে স্টেশনে যেতে পারি তোমায় বিদায় জানাতে ?” আমি মাথা হেলাতেই ও ঘরের বাতি নিবিয়ে চলে গেল |

পরদিন সকাল সকাল আমরা জীপ নিলাম | আমি ধরব কলকাতা মেল, যেটা আসে ঠিক নটায়, আর থামে মাত্র এক মিনিট | ট্রেন থামতেই আমি ছুটে গিয়ে কাছের কামরার দরজায় পৌঁছে, ধরে ওঠার রডটা বাঁ হাতে ধরে ঘুরে তাকালাম ওকে বিদায় জানাতে | ও ততক্ষণে পিছনে এসে আমার বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে, আমার হাতে ওর বাঁ হাতের পাতা ফেলে চেপে ধরেছে, আর ডান হাতে খামচে ধরেছে আমার পিঠের জামা | শুনতে পেলাম, ও আমায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল  “যাও ...” | ইঞ্জিনের তীব্র কর্কশ বাঁশির শব্দে ওর বাকি কথা ডুবে গেল | আমি হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠে কাছের খোলা জানালার দিকে এগলাম | কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন জোর গতি নিয়ে ওকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে |

এরপর বহু বছর আর আমার ওকে দেখা হল না আবার ; ওদের পরিবারের কী হল, তাও জানতে পারলাম না |

আমি কলেজ পাশ করে ক’বছর এদেশে কাজ করলাম, তারপর আমেরিকা গিয়ে ডক্টরেট শেষ করলাম | থেকে থেকে খুব ইচ্ছে করত বাড়ি ফিরতে, কিন্তু ভেবে পেতাম না কী প্রত্যাশায় | ছবি তোলা আর বেড়ান, আমার এই দুই অবাধ্য নেশা আমাকে গ্রাস করল | কী ভাবে জানিনা আমার বিয়ের প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল আমায়, আর হয়ত আমার বাপি-মাদেরও | ওদের বয়েস হচ্ছিল, আর আমি ছিলাম দেরিতে হওয়া সন্তান |

হৃদরোগে বাপি মারা যাওয়ার ক’দিন পরে বাড়ি ফিরলাম – চিরকালের মত, যদিও সে কথা না জেনে | আসার পরিকল্পনা আমি আগেই করেছিলাম, তাই মা আমাকে বাপির মৃত্যুর কথা জানায়নি, শুধু বাপির মরদেহ হাসপাতালের মর্চ্যুয়ারীতে রেখে দিয়েছিল, যাতে আমি এসে পৌঁছে শেষ কৃত্য সম্পন্ন করতে পারি |

দাহ কার্যের কিছু দিন পর মায়ের সাথে বসেছিলাম | যেমনটা হয় কোন প্রিয়জনের মৃত্যুর পর, মা বসে বসে হিসাব করছিল মায়ের কালের আর কে কে দিন গুনছে | শ্রী জেঠুর কথা মনে পড়ায় মাকে তাঁর কথা জিজ্ঞাসা করলাম | “ও তো গত বছর মারা গেছে, তোর বাপির মতই, স্ট্রোক হয়ে”, মা জানাল | আমি ওনার পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এক শিপ্রা ছাড়া সব ছেলে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে | ও এখনও কেঁকুঢগঢে আছে, জেঠিমার দেখা শোনা করতে | ওদের কথা শেষ করে মা বলল, “তোর উচিত একবার গিয়ে ওদের দেখে আসা |”

ক’দিনের মধ্যে মায়ের কাছে আরও কাহিনী শুনলাম | আমি পাশ করার পর, আর আমেরিকা যাওয়ার আগে জেঠু জেঠিমার কাছে শিপ্রা ঘোষণা করে যে ও নিজের পছন্দে বিয়ে করবে ; ওনাদের ওর জন্য ছেলে খুঁজতে হবে না | শিপ্রা কলেজ শেষ করে একটা সরকারী চাকরি পেয়েছিল | সেই টাকায় ও শাড়ি, গয়না কিনতে শুরু করল – আপাতদৃষ্টিতে বিয়ের জন্য, কিন্তু তার শিগগির হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না | ওর কাকে পছন্দ তাও কাউকে জানতে দিল না | শুধু বলল ও তার জন্য অপেক্ষা করতে চায় | জেঠু খুব বিরক্ত হলেন | উনি অনেক উপযুক্ত ছেলের প্রস্তাব আনলেন, কিন্তু শিপ্রা সব নাকচ করে দিল | জেঠিমা চাইছিলেন ওর বিয়ে হলে মঞ্জুর বিয়ে হয়, তাই মঞ্জুর বিয়ে স্থগিত রইল | শেষে একদিন এই নিয়ে খুব তর্কাতর্কি হল, আর জেঠু ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন | রাগের মাথায় শিপ্রাকে বলে বসলেন, ও যতদিনই অপেক্ষা করুক না কেন, ওর মত সাদামাটা মেয়ের প্রতি কোনও ছেলে আকর্ষিত হবে না | শিপ্রা কেঁদে ভেঙ্গে পড়ল, নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল | পরদিন সকালে দেখা গেল ও বাড়িতে নেই | ওর সমস্ত গয়না আর ভালো সিল্কের শাড়ি রেখে গেছে, একটা চিরকুটে লিখে, যে ও সব মঞ্জুকে দিয়ে যাচ্ছে | জেঠু ওর অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলেন যে শিপ্রা সম্বলপুরে বদলী নিয়ে চলে গেছে | তার পরিকল্পনা ও নিশ্চয় আগেই করেছিল | জেঠু যখন মঞ্জুর বিয়ে স্থির করলেন, জেঠিমা অনেক মিনতি করে শিপ্রাকে লিখলেন বিয়েতে আসতে | ও এলো বিয়ের দিন, আর পরদিন ফিরে গেল | এর পর জেঠু মারা গেলে শিপ্রা আবার কেঁকুঢগঢে বদলী নিয়ে ফেরত এলো, জেঠিমার দেখা শোনা করার জন্য |

মা আমায় এই সব কথা শুনিয়ে বলল, “তোর একবার গিয়ে ওদের দেখে আসা উচিত |” আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি যাবে আমার সাথে ?”  মা মাথা নেড়ে বলল, “আমি না ... তোর যাওয়া উচিত, দেখে আসতে |”

কয়েক সপ্তাহ আমি খুব ব্যস্ত থাকলাম | আপাতত আমার আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে একবছরের অধ্যয়নের ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলাম | খুঁজে এক বেসরকারি কলেজে শিক্ষকের চাকরি জোগাড় করলাম, সাথে অতিরিক্ত দায়িত্ব, ছাত্র সম্বন্ধিত ব্যাপারে দেখা শোনা করার জন্য ডেপুটি ডীন হিসাবে | আমি যোগ দেয়ার জন্য এক মাস সময় চেয়ে নিলাম |

মায়ের দেখাশোনা করার জন্য একজন নার্সের ব্যবস্থা করে, মাকে বললাম এবার আমি যাব জেঠিমা আর শিপ্রাকে দেখতে | মা তো ভারী খুশি, জেঠিমাকে চিঠি লিখে আমার হাতে দিল | আর আমায় বলল শিপ্রার জন্য একটা শাড়ি কিনে সেটা ওকে পরিয়ে তার একটা ছবি তুলে আনতে | আমার মনে হল না শিপ্রার কাছে অত দাবি করা যাবে | তাও আমি আমার ক্যামেরাটা নিয়ে নিলাম ; পরে, আরও কিছু চিন্তা করে, তার সমস্ত সরঞ্জাম | ভেবে দেখলাম, অনেক দিন আমি কোনও ছবি তুলি নি |

ট্রেন থেকে নামলাম, প্রায় সেই শেষবারের মতই সময়ে | মনে করার চেষ্টা করলাম সে’ বারের সব কথা | কিন্তু আমার এই ভাবুক খেয়াল স্মৃতির নিঃস্ব দেয়ালে মিথ্যে মাথা ঠুকল | যে টুকু কেবল স্পষ্ট মনে পড়ল তা হল আমার ফেরার দিনে কথা, যেন সেটা সেই সেদিনের ঘটনা |

জীপের ড্রাইভার ঠিকানাটা চট করে চিনে, খুব পরিচিতের মত বলতে শুরু করল ওই বাড়ির ম্যাডামকে ও প্রায়ই স্টেশনে নিয়ে আসে, আর ফিরিয়ে নিয়ে যায় | বুঝলাম না কার কথা ও বলছে, জেঠিমা না শিপ্রা | দুটোরই সম্ভাবনা কম মনে হওয়ায় ওকে বললাম খুলে বলতে | ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে শুধু বলল, “আরে,ম্যাডাম আসেন শুধু কলকাতা মেল দেখতে, আর তারপর ফিরে যান |” হতভম্ব হয়ে আমি আর ওকে ঘাঁটালাম না |

পৌঁছে দেখলাম কখনো, সম্ভবত শেষ বিয়ের (মঞ্জু’র) সময়, রং করা সত্যেও, বাড়িটা নিষ্প্রভ আর জনমানবশূন্য মনে হচ্ছে | বাগানটা আগাছা, ঝোপঝাড়, আর নানান বুনো গাছ গজিয়ে আরও বন্য হয়েছে | কাঠের গেটটা ভেঙ্গে অর্ধনমিত হয়ে একপাশে নেতিয়ে পড়ে আছে | আমি যেই সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠলাম, একটা জানালার পিছন থেকে কারো মুখ সরে গেল | আমি কড়া নাড়ার আগেই শিপ্রা দরজা খুলল | ও কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল | আমি ওর মুখের দিকে চাইলাম, ওর গলার দিকে | আমার তৃষিত চোখ অস্থির হয়ে ওর সমস্ত শরীর খুঁটিয়ে দেখল | দেখলাম আমার মনে ধরে রাখা ওর সেই  অটুট স্বাস্থ্য আর নমনীয়তা নিয়ে ওকে যেন আরও সাদামাটা দেখাচ্ছে | ওর কণ্ঠমণির নিচে সেই তিনখানা খাঁজ এখনও আছে, এই মুহূর্তে তাদের চারিদিকে কিছু স্বেদের শিশিরবিন্দু, সম্ভবত রান্নাঘরের গরমে কাজ করে |

চোখ ফেরাতে অপারগ হয়ে, নিজের উপর জোর খাটিয়ে বললাম, “আমি ! প্রিয়ব্রত ?|” ও কোন কথা না বলে এক পাশে সরে আমায় ঢুকতে দিয়ে জেঠিমা কে ডাক দিল, “মা ! এসো, দেখো কে এসেছে |”

জেঠিমা এলেন, পা টেনে টেনে, হলঘর পার হয়ে | কত বয়স্কা আর হারিয়ে যাওয়া চেহারা হয়েছে ওনার | কাছে এসে উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, যতক্ষণ না শিপ্রা পর্দা সরিয়ে আলো আসতে দিল | তখন উনি আমায় জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ আঁকড়ে ধরে থাকলেন | শেষে শিপ্রা ওনাকে ছাড়িয়ে শোয়ার ঘরে নিয়ে গেল | ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করল, “গত বারের ঘরটাই ?” আমি ব্যাগ তুলে বললাম, “একটা হলেই হল, আমি আগে স্নান করতে চাই |”

আমি জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে নেয়ার পর প্রায় দুপুর দু’টোর সময় শিপ্রা এসে বলল খেতে দিয়েছে | আমার খাটে পড়ে থাকা ক্যামেরাটা দেখল | খেতে খেতে খুব কম কথা বললেও, আমি যখন খাওয়া শেষ করে জেঠিমার খাওয়া শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি, জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি ছবি তোলার প্ল্যান করেছ ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, ... আসলে, মা তোমার জন্য একটা শাড়ি পাঠিয়েছে | মা চায় তোমার একটা ছবি, ওই শাড়ি পরে |” ও চট করে থালায় চোখ নামিয়ে নিলো, আর আমার মনে হল ওই এক ঝলক লজ্জার সাথে যেন একটু  বিব্রত ভাব জড়িয়ে ছিল |

সেদিন আমি সারাদিন নিজের ঘরে থাকলাম | দ্বিতীয় দিন, রবিবার, দেখতে গেলাম গড়, যার উঁচানো মাথা আমার জানালা থেকে সবুজ গাছের সমুদ্রের উপর দিয়ে দেখা যায় | আমি শিপ্রাকে জিজ্ঞাসা করলাম ও সাইকেল চালাতে পারে কিনা | ও বলল, শীতকালে কখন-সখন ও সালোয়ার কামিজ পরে জেঠুর সাইকেলটা চালিয়ে অফিস যায় | কিন্তু আফসোস, বাড়িতে ওই একটাই সাইকেল | আমি সাইকেলটা নিয়ে নিলাম | রাস্তায় বেরিয়ে শিপ্রা বলল ও হাঁটবে | তখন সেই ওর শেষবার জামশেদপুরে বেড়ানোর মত – আমি সাইকেলে এগলাম, কখনো চালিয়ে, কখনো থেমে,  আর, ও এলো পিছনে হেঁটে, আমার সাথে সাথে থাকার চেষ্টা করতে করতে | গড়ে পৌঁছে আমি অনেক ছবি তুললাম, কিন্তু শিপ্রা সব ছবির চৌহদ্দির বাইরে থাকল | যখন ফিরছি, সূর্য অস্ত যায় যায় | আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম সাইকেলে বসবে কি | ও মাথা নেড়ে সূর্যের দিকে আঙ্গুল দেখাল | আমি ভুরু কোঁচকালে, ও কৌতুকে হেসে বলল, “ওই দেখো ! এখনও সূর্য অস্ত যায়নি |”

দিনগুলো কাটল প্রতিদিন অন্য দিনের মত | শিপ্রা উঠে জলখাবার আর দুপুরের খাবার করে ন’টা নাগাদ বেরিয়ে যায় | আমি প্রস্তাব দিই কিছু সাহায্য করার, কিন্তু ও রাজি হয় না | ও অফিস থেকে ফেরে ছ’টার একটু পরে | ওর অফিস স্টেশনের পথে, মাঝামাঝি | কোন কোন সন্ধ্যায় আমরা হাঁটতে বেরই | ও আমার আমেরিকায় থাকা নিয়ে তুচ্ছ সব প্রশ্ন করে | ও কখনও জানতে চায় না, আমি কেন বিয়ে করিনি, যেন সে প্রশ্ন ওর মনেই জাগে না |

একদিন সকাল থেকে খুব ভ্যাপসা গরম ধরল | শিপ্রা যখন অফিস থেকে ফিরল, সমস্ত আকাশ জুড়ে ভয়ঙ্কর কালো মেঘের ছাউনি, গরম হাওয়ায় বিদ্যুতের গন্ধ, আর বৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী | মনে হল বেরোনো অসম্ভব | আমার বারান্দায় বসে চা খেলাম | আমার ইচ্ছা করছিল ছাদ থেকে দৃশ্যটা দেখি ; মেঘ আর বিদ্যুতের প্রেক্ষাপটে গড়ের ছবি তুলি | আমি শিপ্রাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “একটু কি ছাদে যাওয়া যাবে ?” যেন বিষ কামড় খেয়েছে, সেই রকম আহত দৃষ্টিতে ও আমার দিকে তাকাল | দেখলাম ওর মুখ, বিদ্যুতে মোচড়ানো আকাশের মত, যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠেছে | আমি কি কিছু ভুল বলে ফেলেছি জিজ্ঞাসা করার আগেই ও ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে নড়বড়ে পায়ে অন্ধকার হলের মধ্যে ঢুকে মিলিয়ে গেল | আমি নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম, যতক্ষণ না তুমুল ধারায় বৃষ্টি নামল, আর তারপর আমি আমার ঘরে ফিরে গেলাম |

সেই রাত্রে আমি যথারীতি মাকে ফোন করলাম | মাকে ঘটনাটা বলতেই, মা বলল, “ওহো ! তোকে আমার বলা উচিত ছিল | জানি না কী ভাবে ভুলে গেছিলাম ... মঞ্জুর বিয়ের সন্ধ্যায় শ্রীধর দা’ শিপ্রা কে বলেছিল ছাতে চলে যেতে, আর যতক্ষণ না অতিথিরা বিদায় নেয়, নিচে না নামতে  ...” | অবাক হয়ে, আমি মায়ের কথা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন ?”  মা বলল, “শ্রীধর দা’র মনে হয়েছিল আইবুড়ো মেয়ে অলক্ষুণে ; ওর উপস্থিতি দুর্ভাগ্য আনতে পারে, অতিথিরা অসন্তুষ্ট হতে পারে, অনুষ্ঠানে কোন বিঘ্নও ঘটতে পারে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “শিপ্রা কি সত্যি রাত্রে ছাতে থেকে গিয়েছিল ?” মা বলল, “হ্যাঁ, সারা রাত্রি ছাতে ছিল | পরদিনই ও বাড়ি থেকে চলে যায়, এই প্রতিজ্ঞা করে যে ওই বাড়িতে ও আর কোনও দিন পা ফেলবে না |” বোকা বোকা শোনালেও, প্রশ্ন করলাম, “তুমি কি জানো, মা, সেই রাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল কিনা ?” মা বলল, “হয়ে থাকতেই পারে, সময়টা তো বর্ষাকাল ছিল |” আমি ক্ষীণ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম, “এ তো আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না | জেঠু এত বাস্তববাদী ছিলেন ... উনি ... উনি তো কোনও রকমের কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না |” মা শুধু পুনরাবৃত্তি করল, “না, না | তোকে আমার সব কথা বলা উচিত ছিল | কী জানি কি করে ভুলে গেছিলাম |”

পরদিন শনিবার | আসার পর সাতদিন কেটে গেছে, আমি ফিরে যেতে উৎসুক হয়েছি | ঘুম ভাঙল দেরিতে | উঠেই মনে হল সারা বাড়িটা শিপ্রার অস্তিত্বে ভরে আছে | কী অদ্ভুত অনুভূতি | শুনতে পেলাম, বাথরুমে জল পড়ার শব্দ ; কেউ রান্নাঘরের বেসিনে বাসন নামাল ; এফএম রেডিওয় গান বাজছে ; আর চাপা গলায় কথার আদান প্রদান, দুজনের মাঝে – শিপ্রা আর সকালে আসা কাজের মেয়েমানুষটা |

একটু পরেই চা নিয়ে ঢুকে শিপ্রা জিজ্ঞাসা করল, “তুমি আমার সাথে স্টেশনে যাবে ?” জীপের ড্রাইভারটার কথা মনে পড়ল | আমি মাথা নাড়লাম | আর ভাবলাম, ‘আজ তাহলে ওর স্টেশনে যাওয়ার দিন !’

আমরা যখন স্টেশনে পৌঁছলাম , কলকাতা মেল চলে গেছে, তার প্ল্যাটফর্ম জনশূন্য | আমার ইচ্ছা করলো জানতে ও কেন স্টেশনে এসেছে | কিন্তু গত রাত্রের কথা ভেবে আমি নিজেকে নিরস্ত করলাম | আমি ছবি তুলতে নিজেকে ব্যস্ত করলাম | ও উপর নিচ পায়চারী করতে করতে বারবার ঘড়ি দেখল, যেন সেটা ভুল সময় দিচ্ছে |

আমরা ওভারব্রিজ দিয়ে উঠে উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে গেলাম, যেখানে একটা ফাঁকা ট্রেন দাঁড়িয়েছিল | তার ধড়টা ক্রমশ সরু হতে হতে দূরে এক বিন্দুতে মিলিয়ে গেছে, যেখানে গরম হাওয়ার হলকায় অনেকগুলো রেল লাইন ঝিলমিল করছে | আমি ট্রেনটার এক প্রান্তে গিয়ে আমার ক্যামেরাটা তার তেপায়ায় বসালাম পুরো ট্রেনটার ছবি তুলতে | আমি ক্যামেরাটা ফোকাস করছি, শিপ্রা এগিয়ে এসে বলল,  “তুমি কি আমাদের দুজনের একসাথে ছবি নিতে পারবে ?” আমি তাকালাম ওর দিকে | ও বলল, “যেন ... যেন তুমি চলে যাচ্ছ, আর আমি তোমায় বিদায় জানাচ্ছি |” দেখলাম ওর মুখ শান্ত, দৃষ্টি অপলক | আমার গত বারের কথা মনে পড়ল | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “সেই ... যেমন গত বার আমি যখন ফিরে গেলাম ?” ও মাথা নেড়ে কাছের একটা কামরার খোলা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল | আমি ওর কাছে গিয়ে ক্যামেরার দিকে মুখ করে, আমার বাঁ হাত রাখলাম দরজার ধারের রডটার উপর | ওকে বললাম আমার পিছনে এসে বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে ওর বাঁ হাতের তালু আমার রডে রাখা হাতের উপর রাখতে | তারপর, “এই ভাবে থেকো”, বলে আমি ক্যামেরার কাছে ফিরে গেলাম | ক্যামেরা ওর উপর ফোকাস করে একটা ছবি তুললাম | ক্যামেরাটা ওর কাছে নিয়ে গিয়ে ডিসপ্লে তে ছবিটা ওকে দেখালাম |

ততক্ষণে কিছু ভবঘুরে বাচ্চা এসে একটু দূরে দাঁড়িয়েছে | গোগ্রাসী কৌতূহল নিয়ে ওরা মাঝবয়েসী আমাদের দুজনকে দেখতে লাগলো – একজন ভিনদেশী খাকি শর্টস, ধুসর টি-শার্ট আর মুখ পিছনে ঘোরানো বেসবল-ক্যাপ পরে, আর অন্যজন গতানুগতিক সুতির ডুরে শাড়ি পরে | প্রায় ব্যতিক্রম হীন অসীম নিস্তব্ধতার মধ্যে শুনলাম ধীরে ধীরে ক্লিক্-টিক্-ক্লিক্ শব্দ করতে করতে একটা দূরের শান্টিং ইঞ্জিন এগিয়ে আসছে, থেকে থেকে টুট্ টুট্ করে তার হর্ন বাজিয়ে |

আমি ক্যামেরাটা তেপায়ার উপর রেখে, তার ভিউ-ফাইন্ডার এ শিপ্রাকে এক ঝলক দেখে নিলাম | টাইমার এ ছবি তোলার জন্য কুড়ি সেকেন্ড সময় দিয়ে ওর কাছে ছুটে এলাম | তারপর ভঙ্গী করে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম দুজনে |

ক্যামেরার ছবি তোলার আওয়াজ শুনেছি মনে হওয়ার পর, আমি সহজ হয়ে, ধীরে ধীরে দরজার রড থেকে আমার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম | শিপ্রার হাতের তালু তখনও মুঠো করে আমার হাত ধরে | আমি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে  বললাম, “হয়ে গেছে |”

ঘুরে দেখলাম ও হাতের আলতো মুঠোয় দরজার রড ধরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে | কোনও চিন্তা না করে প্রশ্ন করলাম, “তোমার কি মনে আছে, গত বার আমায় বিদায় জানাতে এসে তুমি কিছু বলেছিলে ?”

আমি ভাবি নি ও উত্তর দেবে | কিন্তু, “হ্যাঁ ... আমার মনে আছে” ও বলল, সম্মোহিতের মত ; বিভ্রান্ত চোখ মেলে তাকাল মুহূর্তের জন্য ; তারপর ওর চোখের পলক নামিয়ে নিতে নিতে ব্যথায় ভেঙে যাওয়া স্বরে বলল “আমি বলেছিলাম – যাও ! ... শুধু আমায় বলে যাও আমি ...”

ওর কথা ছাপিয়ে শুনলাম সেই শান্টিং ইঞ্জিনটা ট্রেনটার দূরের প্রান্তে জোড়া লাগার জন্য ধাক্কা দিল | এক অদ্ভুত জর্জর যান্ত্রিক শিহরণ কামরা থেকে কামরায় সঞ্চারিত হয়ে ক্রমশ কাছে এগিয়ে এলো, আর আমাদের কামরাটায় পৌঁছে তার শরীরটা ঝাঁকিয়ে দিল | কামরার দরজার রডটা শিপ্রার আলতো মুঠির ভিতর থরথর করে কেঁপে উঠে ওর মুঠি ছাড়িয়ে, ভেঙ্গে দিল এক ক্ষণিকের অভিসার ||



(ইংরেজি অনুবাদ : An Ephemeral Tryst )


--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

ইন্দ্রনীর / ০১ জুন ২০১৪