বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০১৪

সব সম্পদে

|| সব সম্পদে ||


এখনও নিজেকে মনে হয় স্বাস্থ্যবান, সুপুরুষ, এবং সুস্থ
নেই কোন দুশ্চিন্তা, অর্থাভাবে নই আমি একটুও দুঃস্থ

ভগবানে রাখি বিশ্বাস, মানি আছে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ
আমার প্রতি অণুকুল, সদয়, সহিষ্ণু আবাসিক পরিবেশ
নেই কোনও পরিবার, কোন আত্মীয় সম্পর্কের দায়িত্ব
তাহলে, ভুল হবে কি ভাবলে, জীবনে পেয়েছি স্থায়িত্ব

তবু যখন খুলি দেরাজটা,  পাই সেই প্যেপার-মাশে ডিবে
ভয়, খুলে তার ঢাকনি কতই ইতি-হীন চিঠিরা উড়ে যাবে

তুমি লিখতে কোন অচিন ভাষায়, আমি লিখতাম বাসনায়
দু’ভাষার ব্যবধান ঘুচাতে উঁকি দিতাম মানসের জানালায়
খুঁজতাম, তার ভিতরে আছ নাকি উদ্ধত কলমটি বাগিয়ে
চিঠির শেষটা লিখিয়ে নিই যদি, কটা সাদা পাতা ধার দিয়ে

কেন না, তোমার কোনও চিঠিতেই, হত না শেষের ‘ইতি’
কল্পনা নিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম তোমার সব ইতি-উতি বিবৃতি
খাপ ছাড়া ছাড়া, অসংলগ্ন ছবির মত সব তোমার প্রলাপে
হন্যে হয়ে খুঁজতাম শ্রী আর ছন্দ, সহস্র শতচ্ছিন্ন সংলাপে

আভাসের অভাবে কিছু অনুমানে, কিছু আন্দাজে, গাঁথতাম
বিশেষ্য বিশেষণের কোলাজে তোমার সৌন্দর্যের শতনাম


… …
তোমার হাতের পাতে জরদ মেহেন্দি, কানড় খোঁপায় বকুল
লতানো জুলফির সর্পিল ঝুরি চুমে দোলে কানে লবঙ্গের দুল
চিকণ ললাটে ভ্রু-রেখা উদগ্র, কী বিহ্বলতায়, কী কৌতূহলে
দক্ষ হাতের সুনিপুণ কাজ, এক ঈষৎ টোল দক্ষিণ কপোলে
কমলার কোয়া ওষ্ঠে ও অধরে গোলাপি সুরার সিক্ত আবেশ
কাজল কলঙ্কে লিপ্সু আঁখির অস্থির করা চাহনি কী অনিমেষ
আঁখি পাতে পেলব পলকে বর্বরতা পোষ মানানোর অনুরাগ
লতিকা কৃশাঙ্গে কাঁচুলিতে ঢাকা ব্রণ – জুটি ভেলভেটি বাগ
ওই স্বচ্ছ আবরণ মানে না দেহ সাগরে উতলা মেদের ঢেউ
কে দেবে পাড়ি, দুঃসাহসী কাণ্ডারি, এমনও আছে কি কেউ
… …


এই সবেরই রূপ-গাথা নীলকান্তমণি রেখায় ইনিয়ে-বিনিয়ে
ইতি-হীন বৃত্তান্তে আঁকতে তোমার হাত কে দিত থামিয়ে
থেমে থেমে চলা, অসম্পূর্ণ,  রূপের ঐশ্বর্যের সে কাহিনী
কিন্তু আমার জীবনী তো শেষ, থামিয়ে দিয়েছি যে লেখনী

এখন আমার বাকি সাদা পাতা, লিখে ভরবার কেউ নেই
সব-সম্পদে-পূর্ণ এ সুখে আমি কোথায় হারিয়েছি খেই ?


----------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩১ জুলাই ২০১৪


সোমবার, ২৮ জুলাই, ২০১৪

উর্বরতার আগমনী

|| উর্বরতার আগমনী ||


চিলের ডাক শুনি সারাটি দুপুর, অতি ক্রুর
মাটিতে নামে না তারা অজ্ঞাত কী হুতাশে
তাদের বিবর্ত চক্র ছড়িয়ে যায় দূর, বহুদূর
নিঃশব্দ ডানায়, মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ভেসে

শুনি শিয়ালের চিৎকার, রাত হয় যত স্থবির
অনিদ্রায় জ্বালা করে দৃষ্টি হীন দু’ আঁখিপাত
ঠাওরাতে চাই সময়ের অন্ধকূপ কত গভীর
বিলম্বিত হতে থাকে রাত, আসে না প্রভাত

গাড় আঁধার করে মেঘ ঢলে  পৃথিবীর বুকে
বিদ্যুৎ-দ্যুতিতে নিশ্চল হাওয়ায় ওঠে জমে
বুকে চাপা রুদ্ধশ্বাস | তার বারুদী গন্ধ শুঁকে
মৃত্যুর নেশা পেয়ে বসে মধ্যবর্তী দুই যামে

অরণ্যে উলঙ্গ গাছের কঙ্কাল হয় ঊর্ধ্ববাহু
ভ্রূণের ভঙ্গিতে কুঁকড়ে করি আত্মসমর্পণ
নেমে এসে ধরা গ্রাস করে আকাশের রাহু
ধুসর নিস্তরঙ্গ সমুদ্র, নিশ্চল সময়ের দর্পণ

আকাশে উড়ন্ত চিল, নীচে বিচলিত শিয়াল
এক ক্রুর নভোচারী, অন্য নিশাচর, ক্রুরতর
ঝরিয়ে বিষাক্ত লালা, রাঙিয়ে চোখ লাল
কী অন্বেষণে হন্যে তারা দিনের অষ্টপ্রহর

জানি না ওরা নিকট আত্মীয় কি – না কি দূর
কী করেই বা করি বিচার, ওরা আপন না পর
সবাই যে যার নৃশংস উৎসবে মত্ত ভরপুর
বন্ধ্যা পৃথিবীর বেআবরু বুকে আগ্রাসী যাযাবর

জানি, ওরাও লোলুপ আমারই মত কামনায়
‘কখন নামবে বৃষ্টি, হবে জীবন মরণের প্রণয়’
অধীর অস্থির হয়ে আছি সবাই বর্ষার লালসায়
জেগে জেগে কাটে না অষ্টপ্রহরে এ দুঃসময়

হটাত রাতে শুনি অগুনতি ব্যাঙের ঐকতান
মদ্দা ব্যাঙেরা, অন্ধকারে অদৃশ্য ঝোপঝাড়ে
আজ হয়েছে সমবেত, সরব - করি অনুমান
 “বৃষ্টি আসছে, বৃষ্টি !”, শুনি উল্লাস সমস্বরে

উতলা উর্বরা মাদী ব্যাঙ তা শুনে চায় রমণ
আনাচেকানাচে, চকিতে নামিয়ে অবগুণ্ঠন
হয় নির্লজ্জ ; চায় আগামী প্রজন্মের প্রজনন
“নামো বারি, নামো হে, কর কামনা প্রশমন”    ||

----------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৮ জুলাই ২০১৪

এই ছেলেটা

|| এই ছেলেটা ||


এই ছেলেটা, ভেলভেলেটা
হারিয়ে ভিটের চাবি
বাস তুলে দিয়ে, ভিন পাড়া চ’
মোর সাকিনে যাবি

আসন পেতে পায়েস দেব
বাটি কানায় ভরে
আয়েস করে চেঁছে পুঁছে
ঢুলবি ঘুমের ঘোরে

ছড়িয়ে শীতলপাটি মাদুর
মেঝেয় দেব পেতে
ঘুমপাড়ানি গান শোনাব
লুকিয়ে আঁচলেতে

নিবিড় হাতে জড়িয়ে ধরে
পায়রা বুকের ওমে
মান অভিমান ঘুচিয়ে দেব
যত যা আছে জমে

তোর মা নেই তো কী হয়েছে
হই যদি তোর দিদি
কি ছোটবোন, বৌ টুকটুকে, বা
পণের পাওনা বাঁদী

ধর না, আমি এক বাঁদী বিবাগী
খুঁজছি মনিব ছেলে
যার সই হয়ে পায়েস খাওয়াব,
ঘুম পাড়াতে কোলে

তাইতো পায়েস রেঁধে, ফেঁদে
বসে ছিলেম একা
অদ্ভুত তুই, কার কী খোঁজে
মেলালি চোখ চকা

করিস না লাজ, রাগ করিস না,
ধরিসনে গোঁ একরোখা
বোঝ - মা, দিদি, বোন, রাঙা-বৌ
সবই ফাঁদ রে, বোকা

...

এই ছেলেটা, ভেলভেলেটা
ফেলে দে ভিটের চাবি
খোঁজ গিয়ে যা ভিন পাড়াতে
তোর মনের মৃগনাভি ||


---------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ২৮ জুলাই ২০১৪

শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৪

আকাশের কান্না

|| আকাশের কান্না ||


কেন তুমি কেঁদে যাচ্ছ আকাশ,
ঢেকে মুখ, ক্রন্দসী শ্রাবণ মাসে
কেন তুমি কেঁদে যাচ্ছ আকাশ,
অচরিতার্থ কিসের অভিলাষে

কেঁদে কেঁদে কেন মলিন লাবনী
অযতনে অবিন্যস্ত তোমার কেশ
প্লাবিত কপোলে দেখি খরস্রোতা
অশ্রুধারায় শেষ কাজলের রেশ

ও কী বিরহের বার্তা নিয়ে, যবন
বাতাস হানা দেয় তোমারে দুর্বার
তারে জানিয়ে তুমি প্রত্যাখ্যান,
করেছ কী অভিমানী দুর্ব্যবহার

কার গর্জন শুনি ক্ষিতিজ হতে,
সে দূরবাণী কার সিক্ত অভিযোগ
এত অসহায় কেন বিক্ষোভ তার,
না পেরে সইতে, নীলের বিয়োগ

গহন রহস্যে রহস্যময়ী আকাশ
কেঁদে যাও ভরা ঝরনার লাস্যে
আমি অধীর মূক দর্শক একাকী
অজ্ঞ বারিদ-বেদনার গূঢ় ভাষ্যে

অথচ তুমি  থেকেই যাও নীরব,
চিপে, ঠোঁটে ঠোঁট, দাঁতে দাঁত
আমায়ও কর ততই প্রত্যাখ্যান,
না জানিয়ে, কে দিয়েছে আঘাত

যদি কেঁদে যাবেই, যাও আকাশ
আমি রয়েছি, থাকব তোমার নীচে
দোহাই, তোমার ওই কান্না দিয়ে
দিও একটু এ দেহের দহন সেঁচে

ঢেকে দিও আমার এ আগ্নেয় তনু
ওই ধুসর ধারার আলুলায়িত কেশে
জুড়িয়ে দিও আমার তীব্র তাপমান
ওই স্বচ্ছ, সুস্নিগ্ধ অভ্র বারির পরশে

আমি বিরহী, নিঃসঙ্গ, অনুতপ্ত যক্ষ
বুকের উত্তাপ সামলাতে সামলাতে
খুঁজে বেড়াই শুধু চিরস্থায়ী পরিত্রাণ
রেখে তোমায় কামনার লক্ষ্যেতে      ||


-----------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৬ জুলাই ২০১৪

শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০১৪

মেনকার বিড়াল

|| মেনকার  বিড়াল ||


মেনকার যখন বিবাহ হয়, তাহার বয়স নয়, যামিনীরঞ্জনের বিয়াল্লিশ | প্রথম স্ত্রী বিগত হইলে যামিনীরঞ্জন দ্বিতীয় দারগ্রহণের বাসনা ব্যক্ত করিলেন - এক স্বাস্থ্যবতী কন্যা চাই, যে বর্তমানে, ও ভবিষ্যতে তাঁহার অবর্তমানে, তাঁহার প্রথম পক্ষের পুত্র নলিনের দেখা শোনা করিবে ; এবং সেই কারণে নব বধূ ও পুত্রের বয়সের মধ্যে অন্তত দুই বৎসরের ব্যবধান হওয়া চাই | বস্তুত, বিবাহের সময় দেখা গেল বিমাতার বয়স নলিন হইতে তিন বৎসর কম | কিন্তু ততক্ষণে আপত্তির লগ্ন উত্তীর্ণ হইয়াছে |

ফুলশয্যার রাত্রে মেনকা বিছানায় বিকীর্ণ পুষ্প রাশি দেখিয়া বিচলিত হইল যে তাহাদের উপর শয়ন করিলে তাহারা নষ্ট  হইবে | অতএব সে বিছানার উপর হামাগুড়ি দিয়া পুষ্প চয়নে রত হইল | অচেনা সব পুষ্পের সুগন্ধ মেনকাকে এতই বিহ্বল করিল যে সে হামাগুড়ির ভঙ্গিতেই বিছানায় মুখ নামাইয়া তাহাদের ঘ্রাণ লইতে লাগিল | এমত অবস্থায় যামিনীরঞ্জন নব বধূর জন্য এক বাটি পরমান্ন হস্তে লইয়া কক্ষে প্রবেশ করিয়া এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখিতে পাইলেন | তাঁহার বোধ হইল যেন কোন হৃষ্টপুষ্ট মার্জার পুষ্পের ঘ্রাণ লইতে বিছানায় উঠিয়াছে | আশ্চর্য আদরে তাঁহার গদগদ কণ্ঠস্বর হইতে এই কথা বাহির হইল, “তুমি কি একটা মেনী নাকি ?” চকিতে মেনকা উঠিয়া সলজ্জে ঘোমটা টানিয়া কহিল, “আমায় বলছ, বুঝি ?”

ইহার পর মেনকা হইল যামিনীরঞ্জনের আদরের ‘মেনী’, ও বাটিকার দাস-দাসীদিগের, ‘মেনী-মাঠান’, কেন না যামিনীরঞ্জন মাঝে মধ্যে অনুসন্ধান করেন, “দ্যাখ গে গিয়ে তোদের মেনী-মাঠান কোথায় আছে, কি করছে |”

নলিনের সহিত মেনকার অবিলম্বে আলাপ হইলেও, সহজে ভাব হইবার সম্ভাবনা তেমন দেখা গেল না | মেনকার মধ্যে সেই মাতৃ রূপ কোথায় যাহা নলিনের স্মরণে সদাজাগ্রত ? বরঞ্চ, একদিন দ্বিপ্রহরে বিছানায় অর্ধ আসীন – অর্ধ শায়িত পিতৃদেবের ক্রোড়ে মেনকাকে ক্রীড়ারত দেখিয়া নলিনের মনে ক্ষোভ ও ঈর্ষার সঞ্চার হইল | সেই মুহূর্তে যামিনীরঞ্জন কী আদরে উদ্যত ছিলেন তাহা না দেখিয়াই, নলিন উদ্গত অশ্রু সম্বরণ করিয়া তৎক্ষণাৎ সেথা হইতে দ্রুত অপসরণ করিল |

ক্রমে ক্রমে, নলিন ও মেনকার মধ্যে একপ্রকার সন্ধির সম্পর্ক স্থাপিত হইল | নলিন যখন তাহার খেলনা লইয়া খেলে, মেনকা তাহার কাছে আসিয়া নিত্য নূতন কৌতূহল প্রকাশ করে | নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও নলিন তাহাকে কোন খেলনার আদ্যোপান্ত বিবরণ যোগায় – যথা খেলনাটি কত পুরাতন, কবে কে তাহাকে দিয়াছিল, কবে হারাইয়াছিল ও কবে আবার তাহার পুনর্প্রাপ্তি ঘটে | বলা বাহুল্য, সেই সকল খেলনা মেনকাকে তাহার পিতৃগৃহে ফেলিয়া আসা পুতুল ও ঘটি-বাটির কথা মনে করায় | তখন সে আপন কক্ষে গিয়া গোপনে অশ্রু বিসর্জন করে |

একদিন এই রূপে সে শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া নীরবে অশ্রু ঝরাইতেছে, এমন সময় কোথা হইতে এক মিহি আওয়াজ শোনা গেল, যেন কোন বিড়ালছানা সেই শব্দ করিয়াছে | মেনকা কখনও বিড়ালের সহিত একই কক্ষে অবস্থান করে নাই, সম্মুখীন হওয়া তো দূরের কথা | সাথে সাথে তাহার ক্রন্দন থামিল, ও অনতিবিলম্বে সে কাজল-মিশ্রিত অশ্রুধারা মুছিল | অধীর আগ্রহে একবার এদিক, একবার ওদিকে চাহিল | তারপর, কী ভাবিয়া উবু হইয়া শুইয়া সে পালঙ্কের নিম্নে তাকাইল | সঙ্গে সঙ্গে, সেথা হইতে নলিনের খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল | অতঃপর সে নিমেষে বাহির হইয়া দরজা খুলিয়া দ্রুত বাহিরে পলায়ন করিল | মেনকা শাড়ির আঁচল কোমরে বাঁধিয়া তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিল | কিছু পরে হলঘরে তাহাদের হুটোপুটির শব্দ, ও উত্তেজিত চিৎকার শুনিয়া কমলা দাসী গিয়া দেখিল নলিন ও মেনকা একে অপরকে ধরিয়া ধস্তাধস্তি করিতেছে | পাশেই এক বিড়ালছানা ভয়ভীতিতে  ইতস্তত করিতেছে, যে এ ক্ষেত্রে পলায়ন করা উচিত কি না | দাসী দুই জনের মধ্যে বচসার কারণ অনুমান করিয়া তাহাদের নিরস্ত করিবার পূর্বেই দেখিল নলিন দুই বাহুতে মেনকাকে বেষ্টিত করিয়া ফেলিয়াছে |

বাহুর নিষ্পেষণে মেনকা তাহার সমস্ত শক্তি হারাইয়া, হার মানিয়া, স্থির হইয়া আছে | মুখে কথা নাই | তাহার কাজলে কলঙ্কিত দুই কপোল আরক্তিম | তাহার অধরোষ্ঠ অজ্ঞাত এক উত্তেজনায় কি ত্রাসে কম্পিত |

দাসীর প্রতিবেদন শুনিয়া যামিনীরঞ্জন পরদিনই পশুহাটির বাজার হইতে একটি বিড়াল ছানা আনাইয়া মেনকার হস্তে সমর্পণ করিয়া কহিলেন, “কি ? আর ঝগড়া হবে না তো, নলিনের সাথে ?”
মেনকা মিশমিশে কালো বিড়ালছানাটি হাতে লইয়া কহিল, “এটা, মেনী, না হুলো ?”
বিস্ময়ে যামিনী প্রশ্ন করিলেন, “কেন ?”
মেনকা কিঞ্চিত তাচ্ছিল্যের সহিত কহিল, “এমনি ... আমার হুলো বিড়াল চাই | কী করে বুঝব, এটা হুলো বিড়াল কি না ?”
যামিনী কহিলেন, “ও ... তা, বড় হও | বুঝতে পারবে |”

কালক্রমে মেনকা বড় হইল, এবং রূপে, গুণে ও বিভিন্ন হস্ত কলার পারদর্শিতায় সে সম্পন্ন হইল | নলিনও ধীরে ধীরে তাহার অনুগত হইল, এই অর্থে যে মেনকার সহিত সে আর রেষারেষি করে না | তাহার আকর্ষণ বিড়াল ছানা, খেলনা ও খেলা ধুলা হইতে পড়াশোনায় স্থানান্তরিত হইয়াছে | বয়েসের পরিপক্বতার সহিত তাহার ভিতর মেনকার প্রতি এক প্রকার সম্ভ্রম বোধ জাগ্রত হইল | শৈশবে যে মেনকাকে ‘মা’ বলিয়া সম্বোধন করে নাই, সে এখনও করে না | কিন্তু, প্রায়ই সে  দিনে একবার মেনকার নিকট আসে,  জিজ্ঞাসা করে, “মেনী, তুমি কি করছ ?” উত্তরে মেনকা কী বলে তাহাতে নলিন বিশেষ কর্ণপাত করে না | বেশির ভাগই, সে চুপ করিয়া মেনকার পার্শ্বে বসিয়া তাহার আঁচলের খুঁট কিম্বা বিনুনির অন্ত লইয়া ব্যস্ত থাকে | কখনও বা সে মেনকার পায়ের অঙ্গুলির দিকে তর্জনী দেখাইয়া গম্ভীরতা পূর্ণ কপট ছলে, “একি, তোমার পায়ের একটা আঙ্গুল কোথায় গেল ?” বলিয়া তাহাদের সংখ্যা গণনা করিতে উদ্যত হয় | মেনকা, “আবার !” বলিয়া তাহাকে নিরস্ত করে | দুই জনের ক্বচিৎ কদাচিতের অন্য কথোপকথন মেনকার বিড়াল সম্বন্ধিত হয়, যেমন –

– “ বিড়ালটাকে সবসময় এত ঘাঁট কেন ?”
– “ভালো লাগে তাই” ...

কিম্বা,
– “বিড়ালটা কে যদি আমি তিনতলা থেকে ফেলে দিই ?”
– “কিচ্ছু হবে না | বিড়ালের ন’টা প্রাণ হয়, জানো না ?” ...

নতুবা,
– “এই বিড়ালটা মরে গেলে তুমি কি করবে ?”
– “গলায় দড়ি দেব ?”
– “কেন, মেনী ?”
– “আর, আমার কে আছে ?” ...
...
ইত্যাদি

ইত্যবসরে যামিনীরঞ্জন নিজস্ব সম্পদ, ব্যবসা ও আসন্ন স্থবিরতার নানান চিন্তায় ব্যস্ত থাকিয়া সংসারের সব সম্পর্কে ফাঁকি দেন | একেই তাঁহার একই শয্যায় স্ত্রী ও বিড়ালের সাহচর্য মনঃ পূত নহে, উপরন্তু তাঁহার রক্তচাপের রোগ ধরা পড়িয়াছে | অতএব তিনি একতলার বৈঠকখানায় একটি ক্যাম্প-খাটে শয়নের ব্যবস্থা করিয়াছেন | 
 

সময়ের সাথে সাথে মেনকার নিকট হুলো বিড়ালের গুরুত্ব হ্রাস পাইয়াছে | সে দোতলার শয়নকক্ষে নিজের মেনী বিড়ালটি লইয়াই ব্যস্ত থাকে | বিড়ালটি পাড়ার হুলো বিড়ালের সান্নিধ্যে প্রতি শীতে অন্তঃসত্ত্বা হয়, ও কয়েকটি শাবক প্রসব করে | ছানা গুলি মেনকার যত্নে, আদরে বড় হইয়াও, যথা সময়ে অকৃতজ্ঞের ন্যায় বহির্জগতে পাড়ি দেয় | বৎসরের বাকি সময় দেখা যায় মেনকা সদা নিত্যই বিড়ালটিকে লইয়া ব্যস্ত - সে বই পড়িতে পড়িতে, কি গান করিতে করিতে, বিড়ালটিকে বিছানায় চিত করিয়া রাখিয়া তাহার পেটে আদর করিতেছে, ও বিড়ালটি অর্ধ নিমীলিত চক্ষে সেই আদর উপভোগ করিতেছে | কয় বৎসর হইল বিড়ালটি আর প্রসব করে নাই | তাহাতে মেনকার বাৎসল্য রসে ভাঁটা পড়িয়া, মেনকার আর এক উপসর্গ দেখা দিয়াছে | বিবাহবার্ষিকীতে সে নিজ হস্তে যামিনীরঞ্জনের তরে পরমান্ন প্রস্তুত করিত | কিন্তু দেখা গেল যে বিড়ালটি তাঁহার মতোই সেই অন্নে বিমুখ | আজকাল মেনকা প্রায়শই মা ষষ্ঠীর পূজা দিয়া পরমান্ন প্রস্তুত করিয়া নলিনকে কহে, “মেনীর জন্য পায়েস রেঁধেছিলাম | খেলো না | এখন কী করি ? অতটা পায়েস |” নলিন কহে, “এঁটো না করে থাকলে আমায় দাও | আমার তো পায়েস ভালোই লাগে |” নলিন তাহা খাইয়া চলিয়া গেলে, মেনকার মনে এক অদ্ভুত বিজয়ের অনুভূতি হয় | সে দরজা বন্ধ করিয়া নলিনের আনা পূজার পুষ্প সমগ্রের পাপড়ি ছিঁড়িয়া বিছানায় ছড়ায় | তারপর, মেনীকে বিছানায় লইয়া সেই সব পাপড়ির ঘ্রাণ সমুদ্রে উভয়ে নিদ্রায় বিলীন হয় |

বিড়ালটির প্রতি যামিনীরঞ্জনের প্রকৃত মনোভাব প্রকাশ পাইল যখন মেনকার বয়স একুশ. নলিনের চব্বিশ ও বিড়ালটির বৃদ্ধাবস্থা | যামিনীরঞ্জন হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া পরলোক গমন করিলেন |

তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইলে জানা গেল, তিনি ইষ্টিপত্রে প্রায় সমস্ত ধন সম্পত্তি নলিনের নামে লিখিয়া দিয়াছেন, পরিবর্তে তাহাকে মেনকার রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইবে | মেনকার নামে শুধু বসতবাটিখানি রাখিয়াছেন, এই সর্ততে যে যতদিন তাহার বিড়ালটি জীবিত থাকিবে, মেনকার বসতবাটির উপর অধিকার থাকিবে | তাহার পর বাটিকাটি পরিবারের পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে, সন্তানের রক্ষাকারিণী ষষ্ঠীদেবীর, ও তাঁহার বাহন বিড়ালের পূজার জন্য দেবোত্তর করা হইবে |

উকিলের কণ্ঠে যামিনীরঞ্জনের ইস্টপত্র পাঠ শুনিতে শুনিতে মেনকার মনে হইল, তবে কি সে বিড়ালটির সুবাদে মাত্র নলিনের রক্ষাকারিণী ষষ্ঠীদেবী ? পাঠ সম্পন্ন হইলে, মেনকা ম্লান দৃষ্টিতে নলিনের দিকে চাহিয়া, উঠিয়া কক্ষ হইতে প্রস্থান করিল | নলিন কিছু কহিতে উদ্যত হইয়া নিজেকে নিরস্ত করিল | পরে সে মেনকার কক্ষে যাইয়া তাহার সাক্ষাত পাইল না | সে রাত্রে মেনকা শয়নকক্ষে দ্বার রুদ্ধ করিয়া রহিল, রাত্রির আহারের জন্য নীচে নামিল না | নলিন আসিয়া, “মেনী, দরজা খোল ! চল, খেয়ে নেবে |” কহিয়া কত ডাকিল | রুদ্ধ দ্বারের পিছন হইতে মেনকা কোনও উত্তর দিল না |

পরদিন অতি প্রত্যুষে বৃদ্ধা কমলা দাসী আসিয়া উত্তেজিত ভাবে নলিনের দরজায় ঘন ঘন করাঘাত করিল | নলিন দরজা খুলিলে, দাসী রুদ্ধশ্বাসে কহিল, “দাদা বাবু, দাদা বাবু, শিগগির চল | মেনী উপর থেকে পড়ে দালানে মরে পড়ে আছে |”

নলিন হতভম্বের মত তাহার দিকে তাকাইয়া অস্ফুট স্বরে কহিল, “আর, মা ?”
কমলা দাসী বিস্মিত হইয়া, তাহার দিকে নির্বোধের দৃষ্টিতে তাকাইয়া, প্রশ্ন করিল, “মা আবার কে ?”


----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৭ জুলাই ২০১৪



বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০১৪

সিল্ভ্যর লাইন

|| সিল্ভ্যর লাইন ||


জানার কোনও উপায় ছিল না সে কোন স্টেশনে নামবে | একটা অস্থিরতার অনুভূতি চেপে ছিলাম | যদি হটাত নেমে যায় | আর কিছুতেই মন ভরছিল না, কেন না তার মুখটা মনে রাখার মত করে দেখা হয়নি |

ট্রেন ছাড়ার শেষ মুহূর্তে আমি এই টু-টায়ারে উঠে ছোটার হাঁপটা একটু ছাড়িয়ে নিয়ে উপরের বার্থে ব্যাগটা রাখতে গিয়ে দেখেছিলাম মহিলা বসে আছে, পা ছড়িয়ে | অবাক হয়েছিলাম, কেউ গাড়িতে চেপেই উপরের বার্থে উঠে বসে না | ব্যাগটা আধ-তোলা অবস্থায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম যে চিন্তা মাথায় এসেছিলো, “কী করি ?” একটা দ্বন্দ্ব, হাতটা নামিয়ে ব্যাগটা নীচে রাখি, আর যোগাযোগ এড়িয়ে যাই, না, ব্যাগটা রাখতে গিয়ে যোগাযোগ হয়, আর মুখটা দেখতে পাই | মহিলা দুহাতে মাথার খোঁপা ঠিক করতে করতে পা দুটো টেনে নিয়ে জড়ো করে বলেছিল, “রেখে দিন ... শোয়ার সময় সরিয়ে নেবেন |” আমি, “না, থাক”, বলে হাতটা নামিয়ে নিয়েছিলাম | আর কথা হয়নি | মুখটা কিছুটা অদেখা রয়ে গিয়েছিল |

যে টুকু দেখছিলাম, খুব কোঁকড়ানো তামাটে চুলগুলো নিপুণ হাতে বিনুনি করা | রং ফ্যাকাসে, আর পরিপূর্ণ প্রসাধন হীন ঠোঁট দুটো স্বাভাবিক গোলাপি | হাতের মেদে মনে হয়েছিল মাঝবয়সী |

শোয়ার সময় হলে মহিলা খুব সাবলীল ভাবে বার্থ থেকে নেমে, ঘুরে এসে, আবার উঠে পড়ল | উঠে আলো নিভিয়ে বসে আমার দৃষ্টি দেখে একটু মিষ্টি হাসল, প্রশ্রয় দেয়ার ভঙ্গীতে, যাতে এ’টুকুই বুঝলাম যে আমি তাকালে আপত্তি নেই | তবে অনুজ্জ্বল আলোয় ওই মুখ দেখতে যে অনেক অনেক সময় লাগবে ; ততোটা সময় সে দেবে কি ?

রাত্রে ঘুমের মধ্যে অনেক বার জেগে, মাথা একটু উঁচু করে দেখার চেষ্টা করেছি, সে আছে তো | একবার এমনই, পাশ ফিরে দেখি মহিলা আমার দিকে পাশ ফিরে বার্থের ধারে মাথা টেনে এনে নীচের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে, চোখ দুটো খোলা, অদ্ভুত ঘন তাল তমালের বেষ্টনী ঘেরা মরূদ্যান | আমি কি সত্যি দেখলাম, না কি অনুমান করলাম ? নিজের চোখ বন্ধ করে ঘুমতে চাইলাম | ঘুম এলো ভাবতে ভাবতে. ‘খোঁপায় যদি ঠোঁটের সাথে রঙ মিলিয়ে দুটো গোলাপ গোঁজা হত !’

সকালে উঠে মুখ ধুয়ে জানালা দিয়ে আসা হুহু হাওয়ায় বসে রাত্রের কথা মনে পড়ল | একজন মাঝবয়সী মহিলা, যার খুব সম্ভবত স্বামী আছে, পরিবার আছে – সেই মহিলা কেন ওভাবে তাকিয়ে ছিল এক ঘুমন্ত পরপুরুষের দিকে ?

সারাদিনে মহিলা এক দু’ বার নামল আর উঠল | খাবার এলে উপরেই বসে খেল | একবারও নীচে নেমে সিটে বসল না | সন্ধ্যা হয়ে এলে বুঝলাম একটু পরে আমার নামার সময় এসে যাবে, আর মুখটা ঠিক করে দেখা হবে না | একবার উপরে তাকাতেই দেখলাম মহিলা উঠে বসে আছে | আমার দৃষ্টি দেখে অস্ফুট স্বরে বলল, “কিছু বলছেন ?” আমি তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে চোখ সরালাম |

একটু আগে শুনলাম, মহিলা বলছে, “শুনুন !”
উপরে তাকাতে সে বলল, “এর পর আমার স্টেশন আসছে | আমার ব্যাগটা স্টেশন এলে একটু নামিয়ে দেবেন ?”
আমি বলতে গেলাম, “আমিও নামব”, কিন্তু একটা ব্রিজের গমগম শব্দে  কথাটা চাপা পড়ে গেল | মহিলা বিব্রত হাসি হেসে বলল, “কী ?” তারপর আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সে বলল, “আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না |”
কথায় একটা অদ্ভুত টান |
ব্রিজটা শেষ হলে আমি বললাম, “আপনি চক্রধরপুরে নামবেন ?”
“হ্যাঁ | আপনি ?”
“আমি তারপর, জামশেদপুরে |”

চক্রধরপুর এলে মহিলা নেমে সিটের তলায় ব্যাগটা দেখিয়ে দিল | তুলতে গিয়ে দেখি বেশ ভারী | তার পিছন পিছন ব্যাগটা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামলাম | মহিলা হাতব্যাগ খুলল | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কুলি ডেকে দেব ?”
“না থাক | আমার স্বামী এসে পড়বে | অনেক ধন্যবাদ |”
আমি মুখ তুলে তাকালাম, পরিষ্কার দৃষ্টিতে | আর আমার দ্বিধা নেই, সহযাত্রা শেষ | আর দেখা হবে না – তাই চক্ষুলজ্জার প্রশ্ন নেই আর |

দেখলাম, বার্তালাপে নিকট হয়েও এই মহিলার অসম্ভব রূপ আমার কল্পনার আওতার বাইরে | অথচ বুঝবার উপায় নেই |

হাতব্যাগ থেকে মুখ তুলে, একটু শুকনো গলায় সে বলল, “টিকিটটা পাচ্ছি না কেন ?”
আমি কিছু বলার আগেই শুনলাম কেউ ডাকল, “রেখা !”
তার মুখে হাসি ফুটল | ঘুরে তাকাতে তাকাতে বলল, “ওই তো, আমার স্বামী এসে গেছে | যাকগে টিকিটটা !”

আমি হেসে ফিরে গাড়িতে উঠে পড়লাম | গাড়ি ছেড়ে দিল | দরজায় দাঁড়িয়ে দেখার ইচ্ছে দমন করে সিটের কাছে এসে দেখলাম মাটিতে কী একটা খাম পড়ে আছে | তুলে দেখি নাম ঠিকানা ছাপান খাম, যাতে রেলের টিকিট আসে | উল্টো পিঠে অমার্জিত হাতে লেখা একটা মোবাইল নম্বর | কেন ?

কিছুক্ষণ ভেবে, নম্বরটা ডায়াল করলাম | উত্তর শুনলাম, “হেলো !”
“রুপালী রেখা ?”
“হ্যাঁ ! আপনি কে ?”
“আমি ... আপনার টিকিটটা পেয়েছি | গাড়ির মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল |”
“ও, আপনি ! না, থাক চিন্তা করবেন না | আমার স্টেশন থেকে বেরোতে কোনও অসুবিধা হয়নি ... ফোন করার জন্য ধন্যবাদ |”
আমি চুপ করে থাকলাম |
“হেলো”
সম্বিত ফিরে বললাম, “হ্যাঁ, বলুন |”
“রাখতে পারি ?”
“হ্যাঁ |”

জিজ্ঞাসা করা হল না, “আমি কি টিকিটটা রাখতে পারি ?”
না, টিকিটটা রাখিনি | ঠিকানা তো ছিল মুম্বাইয়ের |
মোবাইল নাম্বারটা বাঁচিয়ে রেখেছি -
নাম দিয়ে, সিল্ভ্যর লাইন ||


-----------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ১৬ জুলাই ২০১৪


মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০১৪

কোকিলার বৃষ্টি

|| কোকিলার বৃষ্টি ||


আলগোছে তুমি যে বলেছিলে, “এই শোন না, লক্ষ্মীটি !
এত অঝোর বৃষ্টির দিনে, নিলে কেমন হয়, ফরাসী-ছুটি ?”

তুমি, বলেছিলে ...
না জেনেই আমার পরিকল্পনা ছিল অন্য - আমি দেখব যে
বৃষ্টির দিনে, চোখ ছাড়া, দৃষ্টিতে আরও কী দেখায় ভিজে

সকালে থেকে ভিজছে তারই সব প্রশ্ন গুলো ঠায় বর্ষাতে
আমি চাই তুমিও ভেজো | আজ ভিজবে কি আমার সাথে ?

তুমি তো দেখনি ...
রাস্তার জল-সমুদ্রে মুকুট-হীন শত ঢেউয়ের ছলছল রঙ্গ
তাতে বিলীন হয়ে, প্রতিবিম্বিত রঙিন জনপথ আজ অনঙ্গ
যে দিকেই এগোই, এগিয়ে যায় আমার অভিমুখিনী তরঙ্গ
আমি পথ হারাই, কাদা পায়ে, কাদাখোঁচার মতই নিঃসঙ্গ

জানো কি আমার ...
কাম্য, ধুসর ঢেউয়ে ভেসে আসা এক মদালসা রাজহাঁস
চোখে পিঙ্গল মদিরা নিয়ে মন্থরগামিনী লাল দোতলা বাস
থামবে ঘণ্টি বাজিয়ে, নামাবে কিছু ঢেউ তোলা ফর্সা পা
আমায় তুলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে এগুবে - ‘যা, যেথা যাবি যা’
দেখব সবুজ আসন উপচে রঙিন বর্ষাতিতে ভিজে মুখ
ভাঙ্গা জানালার সিট খুঁজব, এড়াতে পড়শির সুখ-অসুখ

আজ অফিসটা হবে ফাঁকা, খুলে রাখা যাবে জানালাটা
দেখে নিতে সরু গোবরাঠে, বেপরোয়া গাংশালিক কটা
পূবে হাওয়ায় নাচবে পর্দা, গুটিয়ে আস্তরের সাদা সায়া
ভিজে ডানা থেকে ঝাড়বে শালিক বৃষ্টির গা লাগা মায়া

তুমি আজ থাকবে না, কোকিলা, হাসবেও না অকারণে
বলবে না, “চুপচাপ বসে কেন, কোনও কাজ নেই বুঝি ?”
টেলিফোনটা হবে আজ আমারই, একান্ত এই কোনে,
তোমার সাথে জরুরি কথা বলা যাবে ঢালা, সোজাসুজি

কিন্তু বলব কী ভাবে নিভৃতে, চেয়ে বৃষ্টিতে একনাগাড়ে
দেখেছি আসতে পথের ধারে টেলিফোনের টানা তারে
সারি সারি বৃষ্টির স্বচ্ছ বিন্দুর হিল্লোল ; হাওয়ায় নড়বড়ে
ভিজে চড়ুই তাতে দেয় চুমুক, বসে উচ্ছৃঙ্খল কাতারে

কিন্তু এমনই হয় যদি, আমাদের শব্দের প্রবাহিত তরঙ্গ
কাঁপিয়ে টেলিফোনের তার, ঝরিয়ে দেয় বৃষ্টির ফোঁটা
উড়িয়ে দেয় চড়ুই এর দল, করে দেয় তাদের ছত্রভঙ্গ
আর, তাদের প্রত্যাখ্যানে ছিঁড়ে যায় ভিজে নরম তারটা

তাহলে কি ভাবে গড়ব এই ভিজে দিনের নিবিড় সম্পর্ক
হাতে ধরা টেলিফোনের ছোঁয়ায়, থামিয়ে অসার বিতর্ক

তাই তো বলছি ...
“শোন, কথা শোন, বাড়িতে থেকো না, কোকিলা, লক্ষ্মীটি !
এসে অফিসে দ্যাখো আমি এসেছি, শুধু তোমায় দেখাতে বৃষ্টি |”


-----------------------------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৫ জুলাই ২০১৪

শনিবার, ১২ জুলাই, ২০১৪

বরষার আয়োজন

|| বরষার আয়োজন ||


এখনি আসিয়া  কহিবে সে, “চল, নিয়ে চল
দেখাও কোথায় হইয়াছে মেঘ সমুদ্র উদ্বেল |”

আমি দেখিব শুধু তাহার অবিন্যস্ত চূর্ণকুন্তল
যাহাতে পুঞ্জিভূত ছায়া কালো মেঘ-মখমল
তাহার বিস্ফারিত দুই আঁখির কমল কোরকে
নিনাদ-বিহীন সুতীব্র শত সহস্র বিজলি ঝলকে
তাহার নাসিকা রন্ধ্রের উষ্ণ আর্দ্রতায় মরীচিকা
সম দেখা দেয় আরশিতে মায়াময় কুহেলিকা
সুপক্ব কমলা ওষ্ঠ অধরে শেষ গোধূলির স্বর্ণ
যেন মেঘ সম্ভারে সূর্য ছড়ায় তাহার শেষ বর্ণ
কপোলে, চিবুকে ছড়ানো কী তাহারই লালিমা
ব্রীড়া তাহে ঢাকিতে পারে না, সে উজ্জ্বল গরিমা

কেমনে বুঝাব অভিমানীরে বাহিরে আসে নাই বরষা
ক্ষীণ পূবে বায়ে পায় নাই মেঘেরা কোনও ভরসা
উতলা হইয়া আছে বর্ষা শুধু তাহারই অভ্যন্তরে
সিঞ্চিতে ধরা আনিব তাহারে বাহিরে কি মন্তরে ?
উপায় একটি, করিতে বাহ্যিক বর্ষার আয়োজন
যদি সে পাঠায়, অশ্রু ধারায়, মেঘদের নিমন্ত্রণ ||


--------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১২ জুলাই ২০১৪

বুধবার, ৯ জুলাই, ২০১৪

শৈশবস্মৃতি

|| শৈশবস্মৃতি ||


মা, তোমায় কতদিন বল তো দেখিনি
তুমি কি এখনও রয়েছ ঠিক তেমনই ?

না বোধহয় !

কি করে বোঝাব আমি কত যে কাতর
দেখতে তোমার নত মুখ আমার মুখ পর
নামিয়ে ঝুপসি চুল - খোলাচুল, সুগন্ধি |
তুমিই জাগিয়েছিলে আমার দুরভিসন্ধি
চুল ধরে টানি আমি, চাই তোমার চুমো
তুমি বল, “ওরে দস্যু, এবার তুই ঘুমো |”

ঘুমিয়েছি আমি শেষে তোমারই কোলে
শেষনিদ্রায় অনাগত কৈশোরের প্রাক্কালে
ছাড়িয়ে মুঠোর চুল তুমি উঠে চলে গিয়ে
দিলে খাটের কাঠে আমার শয্যা সাজিয়ে
বিছানা, কোল-বালিশ, প্রিয় খেলার ঘোড়া
আর দু’চোখ বুজে ফুল বেল-পাতা জোড়া
ঠোঁটে বাতাসা রেখে, দেখে সারি পিপীলিকা
সে মুখে ছোঁয়ালে প্রজ্বলিত কুশ পুত্তলিকা

সেই থেকে খোলাচুল আর মুঠোয় ধরিনি
তুমিও আর কখনও সেই মুঠো ছাড়াওনি
আমার হাত দেখ তাই মুঠোই হয়ে আছে
শুধু আমি নই আর তোমার বুকের কাছে
না শিখেই হাঁটা, পথ কত বাঁকা, কত দূর
পার হয়েছি আলোকবর্ষে আকাশ-সিন্ধুর
বিশাল শূন্যতা | ওই চাঁদের বিপরীত পিঠে
যেখানে তারারা দেখ জ্বলে আর মিটে
স্বচ্ছ স্ফটিকে গড়া এই নির্জন স্বর্গ পুরী
তোমার অভাবে হিমেল-শীতল বিভাবরী

তুমি আছ আজও কি তেলে, জলে, সিঁদুরে
সেজে, চির একাকিনী শূন্য ঘরের দুয়ারে
জড়িয়ে জল-কাচা কোরা আটপৌরে শাড়ি
চেয়ে সে পথ যাতে আমি দিয়েছি দূর পাড়ি

বাবা গেল চলে, তুমি মোছনি সিঁথি-সিঁদুর
কাঁপেনি তোমার গলায় কোন কান্নার সুর
শুধু খুলেছ বিবাহের কেয়ূর, কঙ্কণ, বালা
রেখেছ হাতের নোয়া, শাঁখা, আর পলা
আমায় বুকে নিয়ে বলেছ, “শোন, সবাই
পুত্র কোলে সধবা আমি, অভাব কিছু নাই |”

প্রশ্ন ছিল একটাই, দিও উত্তর কাছে এসে
মুখ দেখে বলেছিলে কেমন ভালোবেসে,
“ওই দেখ এসেছে মুখপোড়া হনুমান”
করবে আমার মুখাগ্নি না করে অনুমান ?

আজ এই নির্জন স্বর্গ পুরীর হিমেল-শীতে
বড় ইচ্ছে তোমার ওই কোলে ফিরে যেতে
তাই মুখাগ্নির উষ্ণতা রোমে রোমে নিয়ে
আমি আছি, তুমি এস, খোলা চুলে, নেয়ে
খুলে দিও আমার সঞ্চিত আঁট করা দুই মুঠি
ধরব ভিজে চুল – ছাড়াতে, দিও আর্দ্র চুমোটি
এই ভাবে যদি হয় এই শরীরে প্রাণ-সঞ্চার
আসবো তোমার জঠরে ফিরে পুনঃ পুনর্বার ||

-----------------------------------------------------

ইন্দ্রনীর / ০৯ জুলাই ২০১৪

মঙ্গলবার, ৮ জুলাই, ২০১৪

পরস্ত্রী

|| পরস্ত্রী ||


হে কমনীয়া যৌবনবতী, রতি
জানিয়াও তুমি পরস্ত্রী, কুমতি
করিয়াছি আলিঙ্গন কি আগ্রহে
ভাবিয়া, একদা লভিয়া বিরহে,
যা হারায়েছি, তা পাইব প্রেমে
বাহুতে অনন্বিত অঙ্গের হেমে

তাই নাটকের দৈনিক মহড়ায়
যেথা তুমি নারী, আর আমি নর
যাচিতে নিষিদ্ধ প্রেম অবিনশ্বর
অনালোকিত সেই পার্শ্ব দৃশ্যে
যেথা লইয়া তোমারে মম বক্ষে
(নেপথ্যে, নহেক সর্বসমক্ষে)
চাহিয়াছি মোর বুকে ভরিতে
তোমার কোমল বক্ষের স্পন্দন
অনুচ্চারিত প্রেমের অভিনন্দন

সন্ধ্যা কাটে, পূর্ণিমা হতে অমানিশি
মহড়া হয় না সমাপ্ত, মোরা আসি
তুমি আস জ্বালিয়া প্রদীপ অন্তরে
আলিঙ্গনে করিতে নির্বাপিত তারে |
এ নহে যে তুমি আমারে ভালবাস
তুমি জান, এ শুধু মোহ, সর্বনাশ
জানিয়াও, তুমি আস কোন আশে
নীহারিকা চ্যুত  নক্ষত্রের আকাশে ?

তুমি তো জানো (আমার দৃঢ় বিশ্বাস)
আমার বক্ষ করিবে তোমারে রুদ্ধশ্বাস
আমার বাহু বেষ্টনীর নাগপাশ
তোমার নম্রস্নেহ পৃষ্ঠে
খুঁজিবে কর স্পর্শে
উর্বর মৃত্তিকা
নখতলে
করিতে কর্ষণ
তুমি করিয়া অশ্রু বর্ষণ
সিঞ্চনে করিবে মম অঙ্কুর আকর্ষণ

যুগপৎ - রাখিয়া তোমার জোড়া বাহু
আমাদের দুই প্রাপ্তবয়স্ক বক্ষের মাঝ
রুখিতে নিষ্পেষিত কোমলতায় ভাঁজ
চাহিবে রচিতে কপট দুর্বার ব্যবধান
কহিবে আমারে, “ছাড়, যায় যে প্রাণ”
আমি কহিব না, “দেখ, আমি নিরুপায়,
জানিয়া, কী তোমার প্রকৃত অভিপ্রায় |”

কেন না দুই জনেই মানি, নিঃসঙ্গতায়
তুমি মোর, মাত্র এই অলীক মহড়ায়

বহুবল্লভা,
প্রকৃত জীবনে তুমি এক দুর্লভ পরস্ত্রী
এই প্রেম, সব প্রেম-অভিনয়ের মাতৃ
জানি কেহই কাহারও নয় | আসলে
বিশ্বাসী দর্শকের অভাবের দিনকালে
নাটক শুধু মহড়ার তরে এক অছিলা
সময়ের সাথে রচিত সমসাময়িক
জনান্তিক ঘনিষ্ঠতার এক ধারাবাহিক
যাহা কখনই হইবেনা প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত

অতএব, আমাদের এই আলিঙ্গন
বন্ধ্যা, কিন্তু নহে অবৈধ আচরণ ||


-------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ০৮ জুলাই ২০১৪

শনিবার, ৫ জুলাই, ২০১৪

খেলার নেশা


|| খেলার নেশা ||


রাত্রির ক্রীড়া বিলম্বে সাঙ্গ করে
জেগে থেকেছে নিশাচরেরা,
আরও রাত্রির তামসী গভীরে
পেতেছে কান, শুনতে পদধ্বনি
দেখেও শিকারের অঙ্গন ফাঁকা,
আকাশে নেই কোন প্রতিধ্বনি
শুধু যুদ্ধক্ষেত্র আলোয় উজ্জ্বল
এক তৃণ-হরিত অর্ণব, পোত-হীন
আর তাতে ভাসমান নিশ্চল
রামধনুর রেখা চিত্রিত এক বর্তুল |

তখন স্বস্তিতে এপাশ ওপাশ দেখে
তাকিয়ে আকাশে, তারা ঘুমিয়েছে
অনেক অনেক রাতের গভীরে
মুখে লাল-হলুদ রক্তের স্বাদ নিয়ে
মাখিয়ে দেহে ক্রীড়ার আলস্য
জড়িয়ে চোখে এক রমণীয় লাস্য

আমি প্রবেশ করেছি তাদের মনে
দেখেছি তাদের মন তখনও গুঞ্জিত
সবল দেহের পায়ের অস্থিরতায়,
ঘর্মাক্ত শরীরে উষ্ণ শরীরের ধাক্কায়
শান্ত করতে সেই চপল চাঞ্চল্য
স্বপ্নের মাধ্যমে ধরেছি তাদের হাত
যে হাত তখনও আর্দ্র, স্নায়ু-বিকল
সেই হাতে ধরিয়েছি পতাকা,
ও বাঁশি, কাল বাজাতে ক্রীড়াঙ্গনে
করতে শুরু সেই, আবার যা হবে
একদিন না একদিন নিশ্চয় শেষ

ততক্ষণ ঘুমাও বন্ধু, ওই জগতে
যেখানে নেই কোনও ফুটবল
আর নেই লাখো উৎসাহী দর্শক
যার শতকরা পঞ্চাশ, ভ্রুভঙ্গিতে
আমন্ত্রণের সাঙ্কেতিক ইঙ্গিতে বলে,
“কাল আবার এসে, বসে ওপারে,
নেড় হাত সেম্যাফ্যর সংকেতে |”

Semaphore: a system of signaling, especially a 
system by which a special flag is held in each 
hand and various positions of the arms indicate 
specific letters, numbers, etc.

-------------------------------------------------------------------------

ইন্দ্রনীর / ০৫ জুলাই ২০১৪