শুক্রবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৫

ভিনাস-দ্য-মিলো

|| ভিনাস-দ্য-মিলো ||


তোমাকে খুঁজে খুঁজে শেষে ফেসবুকে পেলাম
দেখতে কিছু তেমনই আছ যেমন দেখেছিলাম
অবসন্ন অপলক দৃষ্টিতে, শেষ বিদায়ের ক্ষণে
মুখটা শুধু আধো ছায়ে, যেন গোপনে গোপনে
মেখেছ বিষাদের প্রলেপ লুকিয়ে আঁধারে

চাইলাম তোমাকে পাঠাতে বন্ধুত্বের অনুরোধ
কিন্তু বাধা দিল অবচেতনে এক অপরাধ বোধ
জানি না তুমি এখনও আছ কি নিভৃতে একাকী
এখনও রেখেছ কি কিছু নাবালিকা সতীত্ব বাকি
নাকি সবই গেছে বয়ে মাতৃত্বের জোয়ারে

শুধু একটাই কথা, জানি না কী ভাবে বলব
ছবিতে দেখছি তোমার বাহু এখনও পেলব
তোমার অভিমানী গ্রীবাও তো এখনও পৃথুল
শুধু ঠোঁট থেকে ঝরে গেছে হাসির মুকুল
তবে কি তুমি হারিয়েছ কূল হীন পাথারে ?

যেন ভিনাস-দ্য-মিলো, খোদিত পাথরে ||


------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫

ইঁদুর


|| ইঁদুর ||


ভোর ভোর ঘুম ভেঙ্গে গেলেও, শৈলজার তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা একটু একটু করে কাটছে | হটাত মনটা তির তির করে সজাগ হয়ে উঠলো | আলতো গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “উঠে পড়েছ ?” পাশ থেকে শিবনাথ উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ | ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ... দেখি জানালায় একটা ইঁদুর এদিক ওদিক করছে |”
শৈলজা চমকে উঠলেন, “ইঁদুর ?”

বিস্মৃতিতে লুকিয়ে থাকা বর্জিত একটা শব্দ ...

তাঁদের বিয়ের পর দু’বছর কেটেছিল ২২/২ বনবিহারী মিস্ত্রী লেনে | পাড়াটা প্রায় বস্তি | বেশির ভাগ টালির কি টিনের ছাতের কুঁড়ে | তার মাঝে এক দু’টো পাকা বাড়ি | যেমন তাদের ভাড়া বাড়িটা | দোতলায় টালির ছাতের দু’খানা ঘর | সামনের উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি উঠে ঝুল বারান্দা হয়ে বসার ঘর, শোয়ার ঘর তারপর | তার নিচু জানালা দিয়ে পিছনের কুমোর বাড়ি দেখা যায় | নিধু কুমোর ভোরে উঠেই কাজে লেগে যায় | একটু বেলা হলে তার বউ মিনতি এসে ঘরের কাজ করে যায় | তার উপচানো সোমত্ত শরীর দেখে শৈলজার ভীষণ অস্বস্তি করে | তাই রবিবারে ডাকেন না | শিবনাথ এক দু’বার বলেছেন, “রোববারেও তো ডাকলে পারো | কেন মিছে ছুটির দিন খেটে মরো ?” তবুও, ওই অস্বস্তিটুকু বাদ দিলে নিটোল জীবন |

সেই জীবনে ইঁদুরের উৎপাত শুরু হয়েছিল | তার আগেই শৈলজার নিজস্ব অভিধানে ইঁদুর কথাটা জুড়ে বসেছে – কখনও নেংটি, কখনও ধেড়ে | তাই নিয়ে কৌতুক, অভিমান কি বিরক্তি - আবার বেশি উৎপাত হলে রাগ | কিন্তু, একদিন সত্যি ইঁদুর দেখা দিল | ভোরের আলো ফুটেছে কি গায়ে চাপায় হালকা টান পড়ায় শৈলজার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল | দেখলেন, শিবনাথ ঘাড় তুলে আধশোয়া হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন | শৈলজা জিজ্ঞাসা করলেন, “কী  দেখছ ?” শিবনাথ ধপ করে শুয়ে পড়ে বলেছিলেন, “ইঁদুর | জানালার চৌকাঠে এদিক ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে |” “ও,” বলে শৈলজা পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছিলেন | তারপর মাঝে মধ্যেই ভোরে গায়ে চাপায় টান পড়ত | শৈলজা বুঝতেন ইঁদুর এসেছে | শেষে ইঁদুরের ভয়ে শৈলজা মশারি খাটিয়ে শোয়া শুরু করলেন, যদিও পাড়াটায় মশা নেই বললেই হয় |

সেদিনের কথা আজও মনে দেগে আছে | ভোরে - বোধ হয় হাল্কা হাওয়ার চাপে - খুট করে জানালার পাল্লার ঠোকাঠুকির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল | উঠেই শুনলেন নিধু কুমোরের উঠোনে চাপা কলের শব্দ | তারপর বালতি থেকে জল ঢালার ক্রমাগত ছপছপ | একটু পরেই মিনতির গলায় আদুরে ডাক, “হ্যাঁ গা, গামছাটা একটু দেবে |” চুপিসারে শৈলজা উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন | তার দূর প্রান্ত থেকে নিধুর উঠোন একটু দেখা যায় | মিনতি এত ভোরে স্নান সেরে ভিজে শাড়ির প্রায় সবটাই তারে মেলে দাঁড়িয়ে | তার সিক্ত টানটান আবলুস শরীরে সূর্যের প্রথম রশ্মির আভা চিকচিক করে উঠে এক অদ্ভুত নম্রতার মায়াজাল বিছিয়েছে | শৈলজার শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল | পা টিপে ঘরে ফিরে শোয়ার ঘরের দরজার চিলতে ফাঁক দিয়ে দেখলেন শিবনাথ আধশোয়া ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছেন | 

তারপর কী ভাবে বিরামহীন চল্লিশটা বছর কেটে গেছে | নিরলস, নিরুপদ্রুত, কিন্তু বৈচিত্র্যহীন নিঃসন্তান সংসার | তবে গায়ে চাপা আলাদা হয়েছে | আস্তে আস্তে সব রকমের ইঁদুরের সাথে আপোষ হয়েছে | ইঁদুর শব্দটাও দূর হয়ে আর কারো মুখে ফিরে আসে নি | শিবনাথ একটু একটু করে জীবনে উন্নতি করেছেন | শৈলজাকে আদরে রেখেছেন | ক’বছর আগে অবসর নিয়ে এই সাত তলার ফ্ল্যাটে উঠে এসেছেন | এখন উপর থেকে অনেক উঠোন দেখা গেলেও তাদের এত দূর থেকে দেখা ক্ষুদ্র ছবি সব তুচ্ছ, অর্থহীন | জীবন তাই এখন নিশ্চিন্ত |

এক লহমার স্মৃতিচারণ থেকে বেরিয়ে এসে শৈলজা ধরে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ধেড়ে না নেংটি ?”
শিবনাথ বললেন, “বুঝলাম না | শুধু ওর পিঠটা একটু দেখতে পেলাম |”
শৈলজা নিজের গায়ে চাপা থেকে একটা হাত বের করে শিবনাথের গায়ে চাপার ভিতর ঢুকিয়ে তাঁর গায়ের উপর রাখলেন | বললেন, “না, না, এই সাত তলার স্বর্গে ইঁদুর আসবে কোথা থেকে ? অন্য কিছু হয়তো | তুমি ঘুমাও |”

--------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ জানুয়ারি ২০১৫

মঙ্গলবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১৫

গড়িয়াহাটে, গালিচাওয়ালা

|| গড়িয়াহাটে, গালিচাওয়ালা ||


ওই সান্ধ্য রমণীয় গড্ডালিকা প্রবাহে ...

চোখের ঢেউ দেখেই মনে মনে ধিক্কার শুনি
অথচ ওদের চোরা চাউনিতে অপলক বিস্ময়
দাঁতে চেপে ধরা রুমালে মোছা অস্বস্তির হাসি
পর্যটনের অবসন্নতা ঝরানো চোখের কাজল

ওদের দেহের মিছিল দেখে, মনে ধিক্কার গুনি
অথচ ওদের শরীর এখনও ছুলে থর থর কাঁপে
আপনি হৃদয় ফুঁড়ে ওঠে উষ্ণতার জলোচ্ছ্বাস
যার স্রোতস্বিনী ধারায় ভেজে ঠোঁটের রংলিপি

ওদের মুখ পানে চাইলেও মনে ধিক্কার গুঞ্জে
যাদের চিরেছি ছুঁড়ে আমার দৃষ্টির শল্যকুশল
পাশ দিয়ে যেতে, ছুঁয়ে দেখেছি সুডৌল বাহু
একটুও প্রতিহত না হয়ে ওদের প্রত্যাখ্যানে

তুমিও যদি হতে ওদেরই মত - ভিড়ে ডুব দিয়ে
পানকৌড়ির মত, উঠতে ভেসে হটাত কাছাকাছি
ভিড়ে  চুবিয়ে ডুবুরী হাত, ধরতাম তোমার পাত
দেখতাম চোখ মুছে ভিজিয়েছ কোন অনামিকা

থেমে যেত চৌমাথায় সব যানবাহন, পদাতিক
লাল হত কালো থামে যত হলুদ, সবুজ সংকেত
নিস্তব্ধ হত হকারদের সব ছিনিমিনি, কোলাহল
তোমার পথে বিছতাম জেব্রা ক্রসিং এর গালিচা

চল্লিশ বছর অপেক্ষায় কাটিয়েছি এই চৌমাথায়
এখনও নাতির হার ধরে তুমি ঘড়িতে দেখ সময়
এর পর কার হাত ধরবে, করবে কিসের প্রতীক্ষা
তার থেকে পা ফেল জেব্রা ক্রসিঙে, আমি আছি ||


-------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২০ জানুয়ারি ২০১৫

রবিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৫

নীলবাতি

|| নীলবাতি ||

নিশীথে ভ্রামণিক নীলবাতি ছুটে যায়
সাইরেন বাজিয়ে, দিশাহীন ব্যস্ততায়
ঘুমঘোরে নড়বড়ে ফুটপাথে ভিখারি
সামলে ভিক্ষার বাটি, গোঁজে মশারি
ঝিমনো কুকুরগুলো চমকে তাকায়
ভাঙ্গে কুণ্ডলী, তোলে অনাগ্রহী কায়
পুত্রেরা হেঁটে যায় নিঃশব্দ মিছিলে
খালি পা তাদের ঘষটে পথের ধুলে
তবুও ঝরা পাতা ঝাঁট দিয়ে হাওয়া
গলিতে গলিতে তার আঁচল বিছায়

জানালায় দেখা দেয় চাঁদ ত্রয়োদশী
দেখি না মুখে তার আমার ষোড়শী
বিচল আঁখি দিদি, যার অবিচল হাসি
বুঝিয়েছিল আমরা মিছেই ভালবাসি
তার সব ভাই, আমার সৌম্য বন্ধুরা
আমারই মত, বুকের ভালবাসা হারা
ফিরে আসে না, কবেই নিয়েছে বিদায়
আমি একাকী স্মৃতিচারণের আড্ডায়
হয়তো করেছে তারা বার্ধক্য স্বীকার
ভুলে পাণ্ডবেয় এক যৌবন অঙ্গীকার

ফিরে আসে নীলবাতি নিশ্চুপ গতিতে
জেগে উঠে, যে ছিল বিলীন অতীতে
সহধর্মিণী ছড়িয়ে বিছায় গায়ের চাদর
শীতল শরীরে উষ্ণ উপেক্ষিত আদর
তার কাঁকনের রিমঝিমে, শীর্ণ মণিবন্ধে
অবশ শাড়ির খসখসে, চুলের সুগন্ধে
মাতোয়ারা হয় না আর ঘুম ঘুম চেতন
চোখ বুজি, কান পাতি,  সুতীক্ষ্ণ শ্রবণ
নীলবাতি নিঃশব্দে দাঁড়ায় দোরগোড়ায়

জানি হয়েছে সময়, এসেছে উঠে পড়ার
শমন, শেষবার নিদ্রায় তলিয়ে পালাবার
তবুও হয় না সাহস, পার হতে পারাবার
তার অঙ্ক থেকে উঠে পালঙ্কে শোবার ||


---------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৮ জানুয়ারি ২০১৫

শুক্রবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৫

উল বোনার ঝুরো গল্প

|| উল বোনার  ঝুরো গল্প ||


বাবা, মা মারা যাওয়ার পর অনেকদিন ফ্ল্যাটটা বন্ধ পড়েছিল | বাবা উইল করে যায়নি | মা আগেই মারা গেছে | উকিল ধরে জানা গেল অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, বেশ কিছু টাকাও খরচ হবে, কোর্ট থেকে উত্তরাধিকারের কাগজ বের করতে | তাও, বিদেশে থাকা ছোট ছেলে নাকি কোনও অংশ পাবে না | বড় ছেলে পরিতোষ বাকি ভাই বোনেদের বলে দিল, “আমি আমার অংশ ছেড়ে দিচ্ছি | তোরা যা করবি কর |” সবাই শুনে বলল, “তাই কি হয় | তুই না বড় ছেলে |” পরিতোষ অটল দেখে শেষে জামাই মুকুল কোমর বেঁধে নামল | কয়েক বছর আগে রিটায়ার করেছিল | কাজের মানুষ, লোক চেনে, আর লোক চরাতে পারে | মুচকি হেসে স্ত্রীকে বলল, “আমি আগেই জানতাম, আমার ওই ভাবুক, প্রেমিক শালার দ্বারা কিস্সু হবে না |”

কার্যত পরিতোষ হাত সম্পূর্ণ গুটিয়ে থাকতে পারল না | যদিও সে হলফনামা লিখে দিল যে সম্পত্তির কোনও দাবী করবে না, তবুও নানান কাগজে সই করতে হয় | মাঝে মধ্যে মুকুল আলগোছে বলে, “তুমি কী সত্যিই নেবে না ? আমি কিন্তু চাই তুমি তোমার অংশ পাও |” পরিতোষ শান্ত ভাবে মাথা নাড়ে | এই ভাবে বছর খানেক কেটে গেলে মুকুল একদিন ফোন করলো, “শোনো, বাড়িটার খরিদ্দার ঠিক হয়ে গেছে | হস্তান্তর হওয়ার আগে যা জিনিস আছে সব বিদায় করছি | তুমি কি কিছু নেবে ?” পরিতোষের মনে পড়ল তার ছোট বেলার কিছু বই ছিল বাবার আলমারির তলায় | একটা প্যাকিং কেসেও বাবার কিছু বইও ছিল | বলল, “আচ্ছা, মুকুলদা’ আমি একবার এসে দেখব | কিছু বই হয়তো নেব |”

প্যাকিং কেসের মধ্যে পাওয়া গেল পরিতোষের স্কুলের প্রাইজের আর বাবা মায়ের কিছু বই | বহু বছর বাক্সে বন্ধ থাকায় বইগুলোর গা ময় চিটচিটে ঝুল, এক-দুটো পোকার ডিম, আর অজস্র গুঁড়ো ময়লা, যা চট করে ছাড়তে চায় না | ওগুলো বাড়িতে এনে পরিতোষ কদিন পিছনের বারান্দায় রোদে ফেলে রেখে, একদিন ভালো করে ভ্যাকুয়াম ক্লিনর দিয়ে পরিষ্কার করে, ঘাঁটতে বসলো | কিছু বই স্কুলে পুরস্কারে পাওয়া – খুবই ছেলেমানুষি – হয়তো সেই বয়েসে উদগ্রীব হয়ে পড়েছে, কিন্তু ও এখন আর সেই উত্তেজনা অনুভব করল না | বাবার বইগুলো ব্রিটিশ আমলের কারিগরির বই | স্কুলে পড়াকালীন খুব দুরূহ অথচ চিত্তাকর্ষক লাগত, মনে হত কবে ও কলেজে উঠে ওই সব বই পড়বে | এ ছাড়া ছোটবেলার কিছু পুরনো পুজো সংখ্যা – আর পরবর্তী কালে মাকে কিনে দেয়া কিছু শারদীয়া আনন্দবাজার আর দেশ |

সব শেষে, উচ্চতায় কম, প্রস্থে লম্বাটে মায়ের উল বোনার বইটা - শ্রীমতী মীরা দেবীর লেখা উলশিল্প – প্রথম ভাগ | বহু ব্যবহারে বাঁধাই ছিঁড়ে এলেও, পাতাগুলো প্রায় সবই আছে | প্রথম পাতায় মায়ের অপরিণত হাতে লেখা নাম | সাড়ে তিন টাকা দামের, আশ্বিন ১৩৪৩ এ প্রথম প্রকাশিত, বইটার বর্তমান সংস্করণ আশ্বিন ১৩৫৬ | পরিতোষ হিসেব করে দেখল বইটা তার জন্মের কাছাকাছি সময়ে কেনা | ভিতরে কয়েক পাতা অন্তর সাদা-কালোয় উল বুনুনির বিভিন্ন নকশার ছবি | কিছু তার খুব চেনা, যেন এখনও চোখ বুজলেই সেই সব সোয়েটার দেখতে পাবে, যদিও বিশেষ সময়টা মনে পড়বে না | যেমন এই তো সেই নকশাটা, যেটা মা ওর মেরুন রঙের সোয়েটারে বুনেছিল |

বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেলা হলে, নন্দিনী এসে ডাকল, “এই যে মিস্টার লস্ট ! কত বেলা হল | স্নান করবে, খাবে কখন ?”

সেদিন রাত্রে শুয়ে নন্দিনী জিজ্ঞাসা করল, “তুমি যে বইটা দেখছিলে ওটা কিসের ?” পরিতোষ উত্তর দিল, “মায়ের উল বোনার বই |”
নন্দিনী – “মা বুঝি খুব বুনতেন ?”
পরিতোষ – “হ্যাঁ | ছোটবেলায় আমরা ভাই বোনেরা মায়ের হাতের বোনা সোয়েটার পরেই বড় হয়েছি | বাবাও মায়ের হাতের বোনা সোয়েটার পরত | তবে বাবার খুঁতখুঁতানির জন্য মাকে দেখেছি একই সোয়েটার বার বার বুনে, খুলে আবার বুনতে | এমন ও হয়েছে যে বাবা একই সোয়েটার এক শীতে পরে পরের শীতে মাকে দিয়ে খুলিয়ে আবার বানিয়েছে |”
নন্দিনী – “তাই বুঝি এত সময় ধরে লস্ট হয়ে গিয়েছিলে ?”
পরিতোষ – “আসলে, উল বোনা ঘিরে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছিল | সব কেমন গল্পের মত ... “
নন্দিনী – “কী গল্প ? আমি কি আগে শুনেছি ?”
পরিতোষ – “হয়তো, হয়তো নয় | আমার অনেক কথাই তুমি জানো, আবার কিছু কিছু হয়তো কোনদিন বলিনি |”
নন্দিনী – “তাহলে বলো সব, শুনি |”
পরিতোষ – “ওহ, সে সব কথা শোনাতে, শুনতে রাত কেটে যাবে | তোমার ঘুম পায় নি ?”
নন্দিনী – “পাক গে | তুমি বলো |”

<<
বেশ, শোনো তাহলে ...
আমাদের ছোটবেলায় সব বয়েসের মেয়েরাই উল বুনত | শীতকালে দুপরে ঘুমনোর চল ছিল না | পাড়ার বউরা একসাথে বসে উল বুনত | আর সেই সাথে নানান গল্প গুজব, আর পরচর্চা হত | মান অভিমানও হত, আবার মিটেও যেত | পাড়ার বউদের মধ্যে মা খুব ভালো বুনতে পারত বলে বোনার আসর আমাদের বাড়িতেই বেশি বসত | সামনের উঠোনে দুপুরের রোদ এসে পড়ত | সেই রোদে সবাই উঠোনে নামার সিঁড়িতে, কেউ উপরে, কেউ নিচে বসে বুনত | তাদের কারো কারো মেয়েও এসে বসত, বোনা শিখত, কিম্বা শুধু গল্প শুনত | কখনও তারা বকুনিও খেত, “এই যা, গিয়ে খেল | বড়দের সব কথা তোদের শোনার মত নয় |” বুঝতাম কিছু এমন গল্পও হয়, যা অল্পবয়সী মেয়েদের শোনার কথা নয় | কিন্তু কান দিয়ে শুনেও কোনও দিন কিছু বুঝতে পারিনি, কেন না তখন তেমন কিছু কথা যেই বলত, সে গলা খাদে নামিয়ে বলত |

যতদূর মনে পড়ে, আমার প্রথম সোয়েটারটা ছিল মেরুন রঙের, যেটা আমার বাড়ন্ত বয়েসের সাথে সাথে এক আধ-বার খুলে, আরও উল যোগ করে প্যাটার্ন বদলে বোনা হয়েছিল | মেরুন রংটা আমি ওই উলের রং দেখেই চিনি | তখনকার দিনের পিওর উল | খুব গরম হত | ওর একটা প্যাটার্ন আমার এখনো মনে আছে – খাড়া খাড়া ডিমের ছড়া, প্রত্যেকটার মাথায় শুঁড় আর লেজে ফুটো | মা বলত ওগুলো পশমের গুটি, কিন্তু দেখে আমার আরশোলা মনে হত |
>>

নন্দিনী পরিতোষকে থামিয়ে বলল, “ঘটনার কথা কী বলছিলে ?”

<<
বলছি তো ...
আমার বছর পাঁচেক বয়েসে প্রথম ঘটনা – শীতকালে মাসি এসেছে, সাথে পিয়াদি’, আমার থেকে দু’বছরের বড়, আর পাপুন, আমার থেকে বছর খানেকের ছোট | দুপুর বেলায় মায়েরা উল বুনছে, আর আমরা কাছে কাছেই ঘুরঘুর করছি, মা মাসির গল্প শুনছি | উজ্জ্বল রোদে শীতটা তেমন গায়ে লাগছে না | হটাত পাপুন বলল ওর খুব শীত করছে,  কোট পরবে | কোটটা ভিতর ঘরে দেয়ালে ওর নাগালের ঊর্ধ্বে টাঙানো ছিল | মাসি বলল, “শীত কই ? কোট পরবি যে, গরম লাগবে না ?” কিন্তু পাপুন একগুঁয়ে, মানল না, নাছোড়বান্দা জেদ ধরে বসল | শেষে পিয়াদি’কে উঠে কোটটা এনে দিতে হল | একটু পরে মাসি দেখে পাপুন কোটের পকেট থেকে কিছু বের করে মুখে পুরছে | “এই, দেখি দেখি, কী মুখে দিচ্ছিস |” পাপুন ধরা পড়ে গেল | লুকিয়ে কুল কিনে কোটের পকেটে রেখেছিল, পরে খাবে বলে | তখন আমাদের কুল খেতে মানা, বেশি খেয়ে কাশি হওয়ার ভয়ে | তাই পাপুন মাসিকে বলতে পারছিল না, অথচ কুলের লোভ সামলাতেও পারছিল না | ওর কাণ্ড দেখে পাড়ার মাসীমারা খুব হাসলেন, মাসিকে বললেন, “আহা, দাও দাও, বেচারাকে ক’টা কুল খেতে দাও | কিছু হবে না |” তাও মাসির রাগ কমে না, “কুল খাবে, খাক | আমি জানতে চাই, ও পয়সা পেল কোথায় ?” শেষে আমি বললাম, গুলু মাসি কিনে দিয়েছিল | গুলু মাসি পাড়ার বাগচি মাসিমার আইবুড়ো বোন | আমি জানতাম গুলু মাসিকে কেউ কিছু বলবে না | ও উল বোনার আসরে আসত না | কিন্তু প্রায়ই পাড়ার ছেলেদের স্কুলের সোয়েটার বুনে দিত | আমায় ধরে গায়ে যার তার সোয়েটার পেতে বলত, “দেখি, বোনাটা ঠিক হচ্ছে কি না |” আমার কেন জানি না মনে হত, আমাকে ও ওই অছিলায় ডাকত | তারপর কাছে টেনে বলত, “শোন, উল বোনার ওখানে আমাকে নিয়ে কী গল্প হয়, বলবি ?”

একটু বড় হয়ে, বোধহয় ক্লাস নাইন কী টেনে পড়ি – রাইগাংপুরে তখন মেসোমশাই বদলি হয়ে এসেছেন | মাসির কাছে  বেড়াতে গেলাম শীতে | ভীষণ ঠাণ্ডা, ঠিক এখানকার মতই, তবে আকাশ অনেক বেশি ঝকঝকে, রোদ অনেক বেশি ঝলমলে, সাথের ঠাণ্ডা হাওয়া কী হালকা | দুপুরে মেসোমশাই খেয়ে অফিসে ফিরে গেলে মাকে নিয়ে মাসি কোন বান্ধবীর বাড়ি যায় | সেখানে উল বোনার ফাঁকে গল্প গুজব হয় | আমি বাড়িতে থেকে পাপুনের সাথে খেলি, নয় পিয়াদি’র সাথে গল্প করি | মাঝে মাঝে দিদির বান্ধবীরা আসে | আবার কখনও দিদিও মা, মাসির সাথে চলে যায় | একদিন দুপুরে ফোন বাজলে পিয়াদি’ ধরল, আর বলল, “মা ডাকছে | উল নিয়ে যেতে হবে |” আমিও গেলাম পিয়াদি’র সাথে মাসির বান্ধবীর বাড়ি | সেখানে বাগানের ঘাসে চেয়ার পেতে বসে অনেকে উল বুনছে | আর ঘাসে বসে মাসির সেই বন্ধুর মেয়েও উল বুনছে | ও ছিল পিয়াদি’র থেকে বছর কয়েকের বড় | শান্ত, মিষ্টি মুখটা দেখতে ভারি করুণ | ওর একটা পা ছোট হওয়ায় একটু খুঁড়িয়ে হাঁটত | পিয়াদি’ বলত ওর নাকি ওই কারণে বিয়ে হচ্ছে না | বলত, “আরও কারণ আছে, কিন্তু তোকে বলা যাবে না” | পিয়াদি’ মাসি কে উল দিতে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় কেউ একটা কিছু বলল, আর সবাই ওই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে উঠল | আমি দেখলাম মেয়েটা ঝট করে উঠে, ওর বুকের সামনে ঝোলা উড়নির ভাঁজে রাখা একটা উলের বল আর হাতের বোনা ঘাসে ফেলে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ির ভিতরে পালিয়ে গেল | ফেরার পথে আমি  পিয়াদি’ কে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী কথা শুনে ওই দিদি এমন লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল |” দিদি বলল, “ওর মা বলল, সবার মেয়ের দুটো মানা, আমার মেয়ের শুধু একটা |” আমি বললাম, “মানা মানে ?” দিদি একটু থমকে গিয়ে বলল, “উলের বল ... ওই যেটা উড়নির ভিতরে ঝুলিয়ে বুনছিল, সেটাই |” আমি বললাম, “উলের বল কে মানা বলে ?” দিদি বলল, “ধর, তাই |” আমি বললাম, “কিন্তু সবাই তো একটাই উলের বল নিয়ে বুনছিল |” দিদি ভীষণ চটে গিয়ে বলল, “আচ্ছা, সব মেয়েলি কথা কি তোর না বুঝলেই নয় ?” বড় হয়ে জেনেছিলাম, কার মুখে মনে নেই, শরীরের গড়নের ওই অভাবের জন্যই ওই মেয়েটার ছেলে জুটছিল না |

আমার মনে নেই স্কুলের শেষের দিকে কী সোয়েটার পরতাম | কিন্তু যেবার কলেজে ভর্তি হলাম, পুজোর ছুটিতে বাড়ি এলে আমার একটা কট্সউলের জামা, আর একটা গাড় খয়েরী রঙের বুক খোলা ফুলহাতা সোয়েটার হল | ছুটির পরে যেদিন ফিরছি, সন্ধ্যের ট্রেন ধরিয়ে দিতে বাবা স্কুটারে আমায় স্টেশন পৌঁছিয়ে দিয়েছিল | সদ্য ঠাণ্ডায় আমি ওই নতুন সোয়েটারটা পরেছিলাম | পরে, বাবার চিঠিতে জানলাম স্টেশন যাওয়ার পথে, কি বাড়ি ফেরার সময়, স্কুটারের স্টেপনিটা ব্র্যাকেট সমেত ভেঙ্গে পড়ে যায় | বাবা বাড়ি ফিরে স্কুটারটা দাঁড় করাতে গিয়ে দেখে | সাথে সাথে আবার স্কুটার নিয়ে ছোটে, অনেক রাত্রি অব্দি সারা রাস্তা তন্ন তন্ন করে খোঁজে, কিন্তু পায় না | নতুন স্টেপনি কিনতে অনেক টাকা লাগে | বাবা আমাকে সব সময় বলত স্টেপনিটা ধরে বসতে | কিন্তু, পিছনে হাত ঘুরিয়ে ধরতে আমার আঁতে লাগত | এর পর, আমি ওই সোয়েটারটা পরলেই আমার কেমন অনুশোচনা হত | আমি সেকেন্ড  ইয়ারে উঠে আমার স্কলারশিপের টাকায় আসানসোল থেকে ইয়র্কের একটা চারকোল গ্রে সোয়েটার কিনলাম, তখনকার দিনে তেষট্টি টাকা দিয়ে | সেটাই আমার প্রিয় সোয়েটার হয়ে দাঁড়াল | আমি মায়ের বোনা সোয়েটারটা পরতাম ক্লাস করতে |

ফাইনাল-ইয়ারে কোন এক ইংরেজি সিনেমায় নিটেড টাই দেখে মাকে ধরে ওই সোয়েটারের বেঁচে যাওয়া উল দিয়ে একটা টাই বুনিয়েছিলাম, | দু’মাথা চৌকো, সাবুদানা প্যাটার্নে বোনা, ওই টাইটাই আমার সম্বল ছিল অনেকদিন |
>>

পরিতোষ থামল | ওর প্রথম চাকরির ট্রেনিংয়ে কানপুরে থাকতে হয়েছিল এক বছর | তার আগে ও উত্তর ভারতের ভয়ঙ্কর শীত দেখে নি | ওর রুমমেট ছিল আর এক ট্রেনি নরেশ | ল্যখন্যউ এর ছেলে | দেখতে অনেকটা হিন্দি সিনেমায় বাবার ভূমিকার অভিনেতা নাসির হুসেনের মত | আধ-বোজা চোখ, আর ঝোলা গোঁফ সমেত | আর, সেই সিনেমার বাবাদের মতই দিলদরিয়া মেজাজ | সে প্রথমে পরিতোষকে নিজের একটা কম্বল দিয়ে বসল | তারপরে ওকে বলল বাড়ি গেলে ওর জন্য একটা সোয়েটার বানিয়ে এনে দেবে | সত্যিই সংক্রান্তিতে বাড়ি গেল দু’দিনের জন্য, আর ফিরে এলো একটা লাল-ইমলির খয়েরি রঙের উলের ভারি সুন্দর সোয়েটার নিয়ে | ওর নিজের বোন নাকি এক দিনে সমস্ত সোয়েটারটা বুনেছিল | কী গরমই ছিল সেই সোয়েটারটা | সেটা গায়ে দিলেই তার ওমের সাথে সাথে পরিতোষ অনুভব করত একটা অচেনা মেয়ের দয়া, আর জানতে ইচ্ছে করত, কেন, কী জন্য মেয়েটা ওকে এত বড় একটা কষ্টের উপহার দিয়েছিল |

নন্দিনী – “কি হল ? কী ভাবছ এত |”
পরিতোষ – “হ্যাঁ ? ... ওই, কানপুরে থাকার সময়ের কথা ... ”
নন্দিনী – “সব শুনেছি, সব জানি | তারপরের গল্প বলো |”

<<
কানপুরের ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি ফিরলাম শীতে | সেবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা | তখন মডেলার উল খুব চলত | আমি আমার টাকায় কালো সিক্স-প্লাই উল কিনে মাকে দিয়ে একটা হাই-নেক ফুলহাতা সোয়েটার বানালাম | সেটা হয়েছিল শীতের যম | ওটা পরে রাত্রি দশটা পর্যন্ত প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রকে বসে আড্ডা দিয়েছি, ঠাণ্ডা লাগে নি | কিন্তু তার জারিজুরিও খাটল না একবার | হ্যালের কাজে শ্রীনগর যেতে হয়েছিল | দিল্লি অব্দি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেনে | তারপর ওখান থেকে এয়ারফোর্সের একটা বিশেষ প্লেনে, দু’জন যাত্রী | ভোরে উঠে দিল্লি থেকে প্লেন ধরেছি | পরেছি সেই মডেলার সোয়েটার, আর তার উপর একটা টেরিউলের জ্যাকেট | পথে প্লেনটা লেহ তে নামল | ট্যাক্সিওয়ের বাইরে চারিদিকে বুক উঁচু বরফ | পাইলট জানালো, বাইরে তাপমান মাইনাস সতেরো | তাই কেবিনে ইঞ্জিনের গরম হাওয়া দেয়া হচ্ছে | আমার যেন বাইরে না যাই | আমার সহযাত্রী, সে লেহ তে আগে এসেছে, আমায় ঠাট্টা করল, “সে কী ? লেহ এর মাটিতে পা ছোঁয়াবেন না ?” ব্যাস, আমিও নেমে পড়লাম | একটা হ্যালের লোক পেয়ে তার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম | একটু পরে দেখি হালকা হালকা ঠাণ্ডা লাগছে | তাড়াতাড়ি কেবিনে ফিরে এলাম | কিন্তু ততক্ষণে জ্যাকেট, সোয়েটার সব মাইনাস সতেরোয় | যে হাড়কাঁপুনি ধরল, সে আর ছাড়ে না | প্লেনের দরজা বন্ধ হল, প্লেন উড়ল – আমি কতক্ষণ ধরে শুধু কাঁপতে থাকলাম | শেষে শ্রীনগর এ পৌঁছে এয়ারফোর্সের থেকে একটা কোট-পার্খা পেয়ে সে যাত্রায় ওখানকার শীতে টিকেছিলাম |

তাহলেও, বাড়িতে শীত কাটাতে এলে ওই মডেলার সোয়েটারটাই পরতাম সন্ধেবেলায়, আর সকালে সেই কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে কেনা ইয়র্কের সোয়েটারটা | তারপর বুনটির বিয়ে হল | মুকুলদা’র বাড়িতে প্রায় রোজ সন্ধ্যায়  চা, পকুড়ি খেতে খেতে আড্ডা দেয়া, আর কখনো রাত্রিভোজ ও করে বাড়ি ফেরা | জয়ন্তী সরোবরের পাশ দিয়ে আসতে, অত ঠাণ্ডায়ও ওই মডেলার সোয়েটার গায়ে থাকলে স্কুটারের হাওয়া গায়ে লাগত না | কিন্তু তাতে কুনজর লাগলো | একদিন মুকুলদা’র পাড়ার এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী কে নিয়ে বেড়াতে এল | ভদ্রলোক এদিকের, স্ত্রী বাঙালি | মহিলার রং শ্যামলা, মাথায় কোঁকড়ান চুল টান করে বাঁধা তবু বিশৃঙ্খল, সিঁথিতে সিঁদুর নেই, আর একটু বুনো মুখশ্রীতে অসতর্ক চঞ্চল দৃষ্টি | পরে মুকুলদা'র কাছে শুনেছিলাম মহিলাটি নিজের বাঙালি বর কে ছেড়ে প্রতিবেশী এই লোকটার সাথে বাস করতে শুরু করে | সে যতক্ষণ থাকলো, মাঝে মাঝেই ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখতে থাকলো, চোখাচোখি এড়িয়ে | ক’দিন পরে একই ব্যাপার | কিছুদিন এইরকম গেলে আমি মুকুলদা’ কে ব্যাপারটা বললাম | বুনটি বলল, “হ্যাঁ, দাদা, ওই বৌদির কৌতূহলটা একটু বেশিই | তবে তোকে নিয়ে হয়ত নয় |” তার ক’দিন পরেই মুকুলদা’ হাসতে হাসতে বলল, “পরিতোষ, ব্যাপারটা পরিষ্কার হল | মঞ্জুলা (সেই মহিলা) কাল আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার শালার বুঝি আপনার কালো সোয়েটারটা খুব পছন্দ ?” আসলে কী হয়েছিল, অন্য উল কাচলে ছোট হয়, আর মডেলার উলটার ব্যাপারটা ছিল উল্টো | সোয়েটারটা কেচে কেচে বড় হয়ে গিয়েছিল | আমার গায়ে বেশ ঢিলে হয়ে গিয়েছিল | আমি বললাম, “কই মুকুলদা’, তুমি এটা পর তো, দেখি তোমার গায়ে ওঠে কি না |” সত্যি ওটা মুকুলদা’র গায়ে ঠিক হল | একদিন খুব রাত্রে মুকুলদা’ আমাদের বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরবে | গায়ে হাফ হাত সোয়েটার শুধু দেখে মা বলল, “মুকুল, তুমি পরিতোষের সোয়েটারটা গায়ে দিয়ে যাও |” তারপর আমি আর সোয়েটারটা ফিরত নিলাম না | বদলে বুনটি ওর কলেজে থাকতে আর্ট ক্লাসে বোনা একটা সোয়েটার আমায় দিয়ে দিল | আকাশী নীল রঙের সিনথেটিক উলটা পাপুন সিমলা থেকে এনে দিয়েছিল | এর পর আমি গলাবন্ধ চেন দেয়া জ্যাকেট পরতে শুরু করি | সেই ছিল আমার শেষ সোয়েটার, বিয়ের আগেকার |
>>

কথা থামিয়ে, নন্দিনী চুপ করে আছে দেখে পরিতোষ জিজ্ঞাসা করল, “ঘুমিয়ে পড়েছ ?”
নন্দিনী ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “না, না ... হ্যাঁ, ঘুম তো একটু পাচ্ছে ... |”
পরিতোষ – “তাহলে ঘুমাও এবার |”
নন্দিনী – “ঘুমবো, ঘুমবো | তার আগে তোমার সব গল্পের নায়িকাদের শেষ কথা বলো | তোমার সেই পাড়াতুতো গুলু মাসির কি হল ?”
পরিতোষ – “গুলু মাসিকে দেখতে তো খুব সুন্দর ছিল | তাই বদনাম | তাই ছেলে খুঁজতে খুঁজতে বয়েস বেড়ে গিয়েছিল | শেষে ওই রূপের জোরেই এক খুব বড় ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হয় | আমাদের পাড়ায় প্রথম দ্বিরাগমনে কেউ গাড়ি চড়ে আসে | জানো, তারপরে কিন্তু গুলু মাসি আর আমাকে দেখলে ডাকত না !”
নন্দিনী – “ভালো তো | আর, সেই খোঁড়া মেয়েটা ?
পরিতোষ – “পিয়াদি’র কাছে বহুকাল পরে জেনেছিলাম, ওর আর বিয়ে হয় নি | রাইগাংপুরে একটা স্কুলে চাকরি করত | ওর উল বোনার হাত ভালো ছিল বলে কাকাবাবু, ওর বাবা, ওকে একটা উল বোনার মেশিন কিনে দেয় |”
নন্দিনী – “আর, মঞ্জুলা বৌদি, না কী, সেই মুকুলদা’র পাড়ার বউটার |”
পরিতোষ – “বুনটি বলত,ও নাকি মাঝে মাঝে কাঁদত, ‘কী ভুল করেছি’ বলে | এক-দেড় বছর পরে নিজের বাবার কাছে ফিরে যায় | বর ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল, যায়নি |”
 

নন্দিনী পরিতোষের কাছ ঘেঁষে বলল, “আশ্চর্য ! আর, তোমার সেই কানপুরের বন্ধুর বোন ? ওর মনে কী ছিল, যে একদিনের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে সোয়েটার বুনে দিয়েছিল ?”
পরিতোষ – “ও হ্যাঁ ! সেই ঘটনাটার শেষটা তো ভুলেই গিয়েছিলাম | মায়ের উল বুনে পাকা চোখ তো | অনেক দিন পরে বলেছিল সোয়েটারটার সামনের আর পিঠের দিকের বোনা নাকি আলাদা দু’হাতের ছিল, একটা যেমন নতুন বুনতে শিখলে হয়, অন্যটা পাকা হাতের টানটান | বলল, হয়তো, মায়ে মেয়েতে মিলে বুনেছিল | মা আমায় আগে বলে নি |”

নন্দিনী একটু চুপ করে থেকে বলল, “সত্যি ? মা ধরে ফেলেছিল ? কই, এতদিন তো তুমি আমায় বল নি !”

--------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৬ জানুয়ারি ২০১৫

মঙ্গলবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৫

নুনছাল



|| নুনছাল ||


আয়নার আবরণ সরিও না
থাক না, ওই অস্বচ্ছতা
জাল বোনা অতীতের ছল
যার ফাঁক দিয়ে ষোলকলা
সাজিয়েছিল রূপের ডালি
কে জানতো তার নুনছাল
লেগে রবে আয়নার কাঁচে
থাক, থাক লেগে থাক
অপাপবিদ্ধ রূপ থাক
চরিত্র গিয়েছে বিপথে
অনুরাগে সুখের খোঁজে
কিন্তু সে আসবে ফিরে

একদিন, নিতে জুড়ে 
লোলচর্মে ওই নুনছাল
সেইদিন জুড়বে জ্বালা
ততদিন আবরণ সরিও না ||


------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৩ জানুয়ারি ২০১৫

রবিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৫

গুড়-বাদাম ও দাঁতপরী

|| গুড়-বাদাম ও দাঁতপরী ||


নাতি নাতনি আসছে, বিদেশ থেকে | সুদাম বাবু লুকিয়ে লুকিয়ে গুড়-বাদাম কিনে আনলেন | ছেলে ছোটবেলায় খেতে ভালবাসত | কিন্তু বিদেশ গিয়ে তার রুচি বদলে গেছে | জানলে বাচ্চাদের খেতে দেবে না, বলবে, “বাবা, ওদের ওই সব ফেরিওয়ালাদের অস্বাস্থ্যকর খাবার দিও না | পেটে সইবে না |”

সুদাম বাবু ভালোই জানেন, টিনটিন আর তুলতুল খুব পছন্দ করবে | তবুও ওদের হাতে তুলে দিয়ে সাবধান করে দিলেন, “বাবা কে বলবি না |” দু’জনে সন্দিগ্ধ হয়ে তাকাল | হেসে বললেন, “যা, চিলেকোঠায় গিয়ে বসে খা | ভালো লাগলে বলিস, বিকেলে আবার দেব |” দু’জনে মাথা নেড়ে চলে গেল | একটু পরে সিঁড়ির অর্ধেক উঠে উঁকি মেরে দেখলেন, দুজনে ঘুপটি মেরে বসে চুষে চুষে খাচ্ছে | ‘তাহলে কি  ...?’ অমূলক সন্দেহ দৃঢ় হাতে সরিয়ে বললেন, “চুষে না রে বোকা, কামড়ে কামড়ে খেতে হয় |” দু’জনেই চারিদিকে গুড় আর লালঝোল মাখা মুখ থেকে গুড়-বাদাম বের করে হাসল | তারপর খেতে মন দিল |

দু’জনেই বিকেলে এসে হাত পাতলে সুদাম বাবু নিশ্চিন্ত হলেন | বললেন, “চিবিয়ে চিবিয়ে খাবি, বুঝলি ?”

রাত্রে শুয়ে ঘুম এসেছে এসেছে, কি সৌদামিনী দেবী ঘরে ঢুকে বললেন, “জানো তুমি কী কাণ্ড করেছ ? ... ও ঘুমিয়ে পড়েছ বুঝি ?”  সুদাম বাবু ঘুম জড়ানো গলায় বললেন, “না, কী বলছ, বলো |” “দাঁড়াও” বলে সৌদামিনী দেবী বাতি নিবিয়ে পাশে শুয়ে পড়ে বললেন, “একটা জিনিস দেখাতে চাইছিলাম, আচ্ছা ঘুম থেকে উঠে দেখো |”
-    “না, ঘুম আসতে দেরী আছে | কী দেখাবে, দেখাও |”
-    “আসলে ... বলছিলাম কী, বাচ্চাদের ওই গুড়-বাদাম না দিলেও পারতে |”
-    “কেন ? কী হয়েছে ?”
-    “যত সব আজে বাজে জিনিস | গুড় আর বাদামের নামে কী না কী দেয় |”
-    “কী হয়েছে বলবে ?”
-    “কী আবার | বিকেলে তুলতুল কাঁদতে কাঁদতে এলো | গুড়-বাদাম খেতে গিয়ে মুখে পাথর পড়েছে | লালঝোল শুদ্ধু মুখ থেকে বার করে আমার হাতে দিল | বাব্বা কী রঙ দেয়া সব |”
-    “তুমি ঠিক দেখেছ পাথর ছিল ?”
-    “দেখেছি বই কি ! তোমায় দেখাবো বলে ধুয়ে রেখে দিয়েছি | দাঁড়াও |”
সৌদামিনী দেবী মাথা তুলে উবু হয়ে বালিশের তলায় হাতড়ে কিছু বের করে বললেন, “নাও, হাত পাতো |” সুদাম বাবু হাতে নিয়ে উঠে বসলেন | অন্ধকারে দেখা না গেলেও পাথরই মনে হচ্ছে | মাথার পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে বোতাম টিপলেন | তার ক্ষীণ আলোয় পাথরটা ভালো করে দেখে মোবাইলটার আলো ফেললেন সৌদামিনীর মুখে | সৌদামিনী বিরক্ত হয়ে বললেন, “আরে, কী করছ ? আমার মুখে আলো ফেলছে কেন ?”
সুদাম বাবু বললেন, “তোমাকে দেখছি |”
-    “আ মরণ ! আমাকে আবার দেখার কী হলো |”
-    “দেখছি ... আগে তো কখনও দাঁতপরী দেখিনি, তাই | বড় সুন্দর লাগছ !”


------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১১ জান্যুয়ারী ২০১৫

বৃহস্পতিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০১৫

প্রসূনের জন্মদিন

|| প্রসূনের জন্মদিন ||


আজ প্রসূনের জন্মদিন | এগারয় পা দিয়েছে | খুব ভয় পাচ্ছি | একটু পরেই সান্ধ্য অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে সবাই চলে গেলে, খেয়ে, অন্য সব ঘরের বাতি নিভিয়ে টিভি চালিয়ে বসব, শোয়ার আগে একটু খবর শুনতে | ঠিক তখন ও এসে রিমোট কেড়ে নিয়ে টিভি ম্যুট করে বলবে, “বাবু, এবার বলো |”

কী বলতে হবে জানি | তবু, জিজ্ঞাসা করব, “কিসের কথা বলছ ?” প্রসূন বলবে, “ওই যে, আমি কোথা থেকে এসেছিলাম ?” আমি বলব, “ঠিক আছে | বলেছি তো, একদিন বলব | আর একটু বড় হও |” ও বলবে, “আর কত বড় হব ? সেই কবে থেকে তুমি একই কথা বলে আসছে | না, না, আমি এখন বড় হয়ে গিয়েছি | এবার তোমাকে বলতেই হবে |”

প্রসূন আমার দত্তক নেয়া ছেলে | সুপ্রভার বাচ্চা হচ্ছিল না | কারণ জানা যায় নি, কেননা সুপ্রভা অজ্ঞাত অন্ধ বিশ্বাসে কোনও পরীক্ষা করাতে রাজী হয় নি | অনেক বুঝিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম | তাই আমিও নিজের কোনও পরীক্ষার ধারে কাছে যাই নি | কয়েক বছর অনেক দোনোমনা করে দু’বছরের কচি প্রসূন কে শিশু সদন থেকে নিয়ে এসেছিলাম | যেদিন ওকে নিয়ে আসি, একবছর পরে সেইদিন ওর জন্মদিন হিসাবে পালন করতে শুরু করেছিলাম | তারপর স্কুলে যখন গেল, জন্মদিনে ওর সাথে অনেক লজেন্স, টফি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে | সেদিন ফিরে এসে প্রথম জানতে চেয়েছিল, “বাবু, আমি কোথা থেকে এসেছিলাম ?” পাঁচ বছর এড়িয়ে গিয়েছি |

সুপ্রভা থাকলে হয়ত বুঝিয়ে বলতে পারত | কিন্তু সুপ্রভা তো প্রসূন কে আনার বছর দুয়েক পরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল একদিন, হটাত | একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি রেখে গেল, “আমি নিজের ধনে সুখী হতে চাই | আশা করি তুমিও এই ভাবে সুখী হবে | প্রসূন কে বোলো, ও বড় হলে বুঝবে |” আমি অতি কষ্টে প্রসূনকে আগলে ছিলাম | হয়ত ছোট বলে সম্ভব হয়েছিল |

আজ আমি বিশেষ করে ভয় পাচ্ছি | স্কুল থেকে প্রসূনকে আনার সময় সুপ্রভাকে দেখেছি | একটা বছর তিন চারের ছোট ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে প্রসূনকে খুব কাছ থেকে দেখছিল | খুব ভয় হল, হয়ত চিনতে পেরেছে | হয়ত আলাপ করেছে, হয়ত কিছু বলেছে |

গাড়িতে উঠেই প্রসূন বলেছিল, “বাবু, তুমি মা কে দেখেছ ? দাঁড়িয়েছিল |”
আমি বললাম, “মা ! কার মা ?”
প্রসূন বলল, “আমার ! এসে যে আমায় বলল, আমি তোমার মা | তুমি তাকে দেখেছ ?”


-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৮ জানুয়ারি ২০১৫

বুধবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৫

নিছক গল্প

|| নিছক গল্প ||


ক্লাবের রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখি সব টেবিল ভর্তি | তার মাঝে জোড়া দেয়া দুটো টেবিলে পিকুদা বসে আছে বৌদির সাথে | বিপরীতে, আমার দিকে পিঠ করে, এক ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা, দুজনেরই চুল সাদা | টেবিল জোড়া করে ছ’জন বসার জায়গায় বাকি দু’খানা খালি | পিকুদা আমায় দেখে হেসে হাত নাড়ল | আমিও “কেমন আছো ?” বলে এগিয়ে গেলাম |

পিকুদা বহুকালের | আমি যখন কলেজ শেষ করলাম, বাবা-মা নতুন পাড়ায় বাড়ি নিয়েছে মাস কয়েক আগে | আমাদের কোনাকুনি উল্টো দিকে পিকুদা থাকত | কলকাতার ছেলে, বছর কয়েক আগে পাশ করে কোম্পানিতে কভেন্যান্টেড অফিস্যর হয়ে ঢুকেছে | বিকেলে কারখানা থেকে ফিরে বাগানে বসে চা খেত | একদিন আমায় দেখে ডাকল, বলল, “তুমি রুদ্র বাবুর ছেলে না ?” আমি মাথা নাড়লে বলল, “এসো, চা খাবে আমার সাথে |” সেই ভাবে আলাপ | আলাপের কিছুদিন পরে  আমায় কলকাতা যেতে হল একটা চাকরির জন্য নানান পরীক্ষা দিতে | আমাদের কলকাতায় কোনও আত্মীয় নেই শুনে পিকুদা একটুও আশ্চর্য না হয়ে বলেছিল, “চিন্তা কী ? আমাদের বাড়িতে উঠো | কোনও অসুবিধা হবে না |” আমি গিয়ে তিনদিন ছিলাম | ঠাকুরপুকুর লেনে লম্বাটে তেতালা বাড়ি, যার নিচতলাটা ফাঁকা পড়ে থাকত | পিকুদার বাবা, মা এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে দোতলায় থাকতেন | তিনতলায় ঠাকুর, চাকর আর ঝি | বোধহয়, শুধু প্রথম দিন মাসিমার সাথে কথা হয় | উনি চাকর পাঠিয়ে আমার জন্য নিচের একটা ঘর খুলিয়ে দিলেন | একটু পরে তিতুম, আমার সমবয়সী পিকুদার ভাই, এসে আলাপ করল | যে ক’দিন ছিলাম ওই আমার খোঁজ রাখল, বিকেলে আমায় নিয়ে গেল ওর সাথে আড্ডা দিতে | সকালে দোতলায় খাওয়ার টেবিলে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে যেতাম পরীক্ষা দিতে | বিকেলে ফিরে নিজের ঘরেই ঠাকুরের পাঠানো চায়ের সাথে কিছু খেয়ে তিতুমের জন্য অপেক্ষা করতাম | রাত্রে খাওয়ার সময়ের আগেই রাঁধুনি এসে ডেকে নিয়ে যেত তেতালায় রান্নাঘরে লাগোয়া একটা ঘরে | আমি একা, একাই খেতাম, কেন মনে নেই | শুধু একদিনের একটা ছোট্ট ঘটনা বাদ দিলে, খুব স্বচ্ছন্দে ক’টা দিন কাটিয়েছিলাম | বাড়ি ফিরে কৃতজ্ঞতা জানালে অকপট মানুষ পিকুদা ভারি বিব্রত হয়েছিল |

পিকুদা’র টেবিলের কাছ ঘেঁসতেই পিকুদা বলল, “এসো, এসো ... তিতুমকে তো চিনবেই ... কিন্তু, একে মনে আছে কিনা দেখো |” পিকুদার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম মালার চোখে পড়েছে একটা টেবিল থেকে লোক উঠছে | আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “পিকুদা একটু দাঁড়াও, একটা টেবিল খালি হয়েছে |” পিকুদা মাথা ঘুরিয়ে দেখে বলল, “এখানেই বসো না, দু’টো জায়গা তো খালিই পড়ে আছে |” আমি দেখলাম মালার মুখ বিব্রত | ও তাও হেসে বলল, “আপনাদের অসুবিধা হবে না ?” পিকুদা বলল, “না, না, অসুবিধার কী আছে | তাছাড়া, তোমাদের দেখা তো চট করে পাওয়াও যায় না |”

কথাটা সত্যি | ক্লাবে খুব কম আসি | কখনও দেখা হলেও দু’ পক্ষের এক পক্ষ ঢুকছে, তো অন্য পক্ষ বেরোচ্ছে | পিকুদা কয়েক বছর আগে অবসর নিয়েছে, আমি গত বছর | দু’জনেরই ছেলে মেয়ে বিদেশে | প্রথম আলাপের কালে পিকুদার সাথে আড্ডার একটা বিষয় ছিল আমার আকাশকুসুম গল্প | প্লট সাজিয়ে নিয়ে খুব আলোচনা করতাম, কিন্তু লেখা আর হয়ে উঠত না চাকরি খোঁজার ঝক্কির মাঝে | তারপর আমি চাকরি পেয়ে অন্য শহরে চলে গেলে আর যোগাযোগ থাকে নি | বছর দশেক পরে ফিরে এসে জেনেছিলাম পিকুদা বাড়ি পাল্টেছে |

অতএব, এই শেষ বয়েসে বলার কথা কম | তবুও ক্লাবে দেখা হলে দাঁড়াই, দুটো কথা বলি | এখন মালার মুখে মৌন সম্মতি দেখে টেবিলের মাথায় তিতুমের পাশে বসে পড়লাম | মালা বসল পায়ের দিকে | বেয়ারা ডেকে খাবার বলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “পিকুদা, এমন টেবিল জোড়া করে বসেছিলে কেন ?” পিকুদা বলল, “ভাবতে পারো তোমাদের জন্য ... হা, হা ... না, আসলে আমরা যখন ঢুকলাম শুধু এই জোড়া করা টেবিলটাই খালি ছিল |”

তিতুমের সাথে বোধহয় তিরিশ বছর পরে দেখা | পুরু চশমা ঢাকা কৌতুকমাখা মুখে গড়গড় করে অনেক কথা বলে গেল, আর কিছু ঠাট্টা করা প্রশ্ন করল আগের মত | দেখলাম ওর ওপাশে বসা ভদ্রমহিলা ওর অনুপাতে চুপচাপ | একবার শুধু মুখ তুলে আমায় দেখে একটু হাসলেন | দোহারা শরীরে চঞ্চল লক্ষ্মী ট্যারা চোখের নিচে বেমানান চাপা বিব্রত হাসি | আদলে তিতুমের সাথে কোথাও একটা মিল | তবু চিনলাম না ওনাকে | মালার সাথে কথা বলতে দেখে ভাবলাম পরে মালার কাছ থেকে জেনে নেয়া যাবে |

খাওয়া প্রায় একসাথেই শেষ হলে সবাই বসে রইল কফির জন্য | উঠে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে | কিন্তু কফি বোধহয় শেষ, তাই তার জন্য অপেক্ষমাণ লাইন লম্বা | হটাত মালা বলল, “কফি এসেছে !” আমি ছাড়া সবাই উঠে গেল | আমি কফি খাই না রাতের খাওয়ার পরে | ভদ্রমহিলা উঠেও বসে পড়লেন | আমি বললাম, “আপনি কফি নেবেন না ?”  উনি মাথা নেড়ে বললেন, “না, বেশি খাওয়া হয়ে গেছে  ... আপনি আমায় ‘আপনি’ বলছেন কেন ?”

আমি একটু অস্বস্তি বোধ করলাম | কী করে বলি, আমি আপনাকে চিনি না | ‘পিকুদা তো আলাপ করাতেই গিয়েছিল | আমিই টেবিল ধরার তাড়ায় ...’ | চিন্তা থামিয়ে হেসে বললাম, “আপনাকে ঠিক চিনতে পারি নি | কিছু মনে করবেন না |” উনি বললেন, “আমি শ্রীমতী | নামটা শুনেছেন নিশ্চয়ই |” এবার শরীরে, মুখে একটু সহজ হওয়ার ভঙ্গি |

মনে করার চেষ্টা করলাম | আবছা মনে পড়ল, তিতুম ওর বান্ধবীর কথা বলত | কোন এক শ্রীমতীর কথা | আমি ভাবতাম ওটা নাম নয়, বিশেষণের বিভূষণ | কিন্তু এনার তো সিঁথি খালি | বললাম, “আপনার, মানে তোমার, নাম শুনেছিলাম মনে হচ্ছে | কিন্তু সে তো অনেক দিনে কথা |”

কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি নয় | অনেক কথাই মনে আছে, আর কিছু জিজ্ঞাসা | বিশেষ করে সে দিনের কথা, যে দিন শেষ পরীক্ষা দিয়ে ফিরে চা খেয়ে অপেক্ষা করছিলাম তিতুমের জন্য, বাড়ির বাইরে রোয়াকে একা বসে | হেমন্তের বিকেলের রোদ কোন কোন বাড়ির দেয়ালে ঠিকরে নির্জন এঁদো গলিটা উদ্ভাসিত করেছিল | হটাত রিক্সার টুংটাং শুনে, দুটো মেয়েকে গলির মুখে ঢুকতে দেখে নিজের ঘরে ফিরে এলাম | বসলাম জানালার দিকে মুখ করে, শেষ আলোটুকু উপভোগ করার জন্য | একটু পরেই কেউ সিঁড়ি দিয়ে চটির শব্দ করে উঠে গেল, আর একই সাথে আমার ঘরের দিকে কেউ যেন পা টিপে টিপে এগিয়ে এলো | তিতুম কিনা ভেবে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম মুহূর্তের জন্য দরজার চৌকাঠ থেকে উঁকি মারা একটা চুলের গোছায় ঘেরা মেয়ের মুখ এক ঝলকের দেখা দিয়েই সরে গেল | তারপর তার ছুটে পালিয়ে যাওয়ার শব্দটা, যাতে বিন্দু মাত্র লুকোনোর চেষ্টা নেই, ক্রমে জোরালো হয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল | আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে শুধু শুনতে পেলাম উপর থেকে দুই চপল গলায় খিলখিল হাসি চাপার বিফল চেষ্টা | পরে তিতুমকে ঘটনাটা বলতে ও আমুদে হাসি হেসে বলেছিল, মেয়েটি ওর বোনের বন্ধু হবে হয়ত | কিন্তু তার এই কৌতূহলের কারণটা ? সেই কি ছিল তবে তিতুমের শ্রীমতী ?

কফির লাইনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মালা তাকিয়ে দেখছে | হতাশার মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে জানালো, শিগগির কফি পাওয়ার আশা নেই | দেখলাম যারা কফির অপেক্ষায় ছিল, এক সাথে কয়েক কাপ ঢেলে নিয়ে যাচ্ছে, টেবিলের সব সঙ্গীদের জন্য |

অবসর ও অবকাশ আছে দেখে বললাম, “আচ্ছা, সেদিন কি তুমিই উঁকি দিয়েছিলে ?”
শ্রীমতী বলল, “সেদিন ? কবেকার কথা বলছেন ?”
আমি বললাম, “ওহো ! ভূমিকা ছাড়া প্রশ্ন করে ফেললাম বুঝি | আসলে, আমি কলেজ পাশ করে একবার তিতুমদের বাড়িতে গিয়ে ক’দিন ছিলাম, একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে ...”
শ্রীমতী – “জানি সে কথা |”
আমি – “তখন একদিন একটা মেয়ে আমার ঘরে এসে উঁকি মেরে পালিয়ে যায় | আমি জানতে পারি নি সে কে ছিল | তুমি কি ...”
শ্রীমতী – “না, আমি না |”
আমি – “কিন্তু তুমি জানো, নয় কি ?”
শ্রীমতী ইতস্তত করে বলল, “ও ছিল আমার কলেজের এক বন্ধু | আমার কাছে আপনার কথা শুনে দেখতে গিয়েছিল |”
আমি – “কেন ?”
শ্রীমতী মাথা ঘুরিয়ে কফির লাইনের দিকে তাকাল | তারপর আড়ষ্ট গলায় বলল, “এতদিন পরে জেনে কী করবেন ?”
আমি – “কিছু না | নিছক একটা কৌতূহল বলতে পার |”
শ্রীমতী – “দাদার কাছে আপনার কথা শুনে আমার বন্ধু বলেছিল আপনি নাকি ওর দাদার কলেজের ছেলে | তাই ওর খুব কৌতূহল হয়েছিল আপনাকে দেখার |”
আমি – “দাদা মানে পিকুদা ?”
শ্রীমতী – “না, না, ছোড়দা | রোজ আপনার সাথে বেড়িয়ে ফিরে রাত্রে খাওয়ার টেবিলে আপনার কথা বলত | শুনে আমারও খুব কেমন একটা কৌতূহল হত |”
আমি – “তাহলে তো দু’জনে এসে আলাপ করলেই পারতে |”
শ্রীমতী উত্তর না দিয়ে তাকাল | ওর লক্ষ্মী ট্যারা চোখ দেখে দ্বিধার কারণটা অনুমান করে আমি আর কিছু বললাম না |

ফেরার পথে গাড়িতে উঠেই মালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা ওই মহিলাটি কে ? দেখে তো মনে হল না তিতুমের বউ |”
মালা বলল, “কী যে আজগুবি প্রশ্ন করো ! ও পিকুদার বোন |”
আমি – “কী করে বুঝলে ?”
মালা – “আমায় বলল |”
আমি – “কিন্তু আমি জানতাম শ্রীমতী তিতুমের বান্ধবীর নাম ছিল |”
মালা – “সে হতেই পারে, দুজনের এক নাম | কিম্বা, হয়ত বান্ধবীর নাম ছিল রাধিকা | ... এটা বলো, এত অল্প আলাপে উনি এত কী কথা বলছিলেন |”
আমি – “তেমন কিছু না | ভদ্রমহিলা খুব চাপা | আমিই বকবক করছিলাম ...”
মালা – “উনি যে চাপা সে কী করে বুঝলে ?”
আমি হেসে বললাম, “কেন, শুধু তোমরা মেয়েরাই সব কথা বুঝতে পার কি ?”


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৭ জানুয়ারি ২০১৫