বুধবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৫

লুব্ধক

|| লুব্ধক ||

আলোও ফোটেনি, ডাক এলো, “আপনি আসুন, উনি সিরিয়াস !”
তখনই, আকাশ ভরা জোছনালোকে উঠল জ্বলে তারা সিরিয়াস

শুনছো স্বাতী, এখন তুমি যাদবপুরের মাতৃসদন হাসপাতালে
একটু পরেই ঘুম ভাঙ্গবে, জাগিয়ে তোমায় উচিত পলে
তবে কেন মুঠো-ফোনে ভোর সকালে ডাক এলো ?
ক্রিং ক্রিং ক্রিং – গায়ের চাদর এলোমেলো
ফেলে ছুটি, ত্রস্ত জোড়া পায়জামা পায়
ঘুম চলে যায়, ঘুম চলে যায়
যখন তুমি অঘোর ঘুমে |
তোমার বোজা স্তন চুমে
ঘুময় শিশু তোমার পাশে
জানেনা, মা রেখেছে হিম পরশে |
কারোরই আর কারোর প্রতি নেইকো টান,
নাড়ির সাথে কেটে গেছে যাচ্ছেতাই সব রাগ-অভিমান |

শোন স্বাতী, এখন তুমি শুয়েই থাক হাসপাতালের ওই মর্গে
একটু পরে ঘুম ভাঙ্গবে, ওপারেতে চোখ খুলবে, এক স্বর্গে
মিছে তুমি মুঠো-ফোনে ভোর সকালে ডাক পাঠালে
ক্রিং ক্রিং ক্রিং – ঘাবড়ে গিয়ে, চোখের জলে
কাঁদি আমি নিজেই নিজের কর্মফলে
মন ভেঙ্গে যায়, বুক ভেঙ্গে যায়
যখন তুমি কুসুম বুকে
ঘুমাও শিশুর সঙ্গসুখে
যাবেই জানি – নাও, নিয়ে যাও
তোমার সাথে সদ্যজাতের হাসি কান্নাও
আমায় কেন কৃপণ হাতে কয়েক দিনের সুখ দেখালে ?
শিশুকে দিয়ে, না বলে কয়ে, কোথায় আমায় ফেলে পালালে ?

একি সকাল সকাল সূর্যডুবি অস্তাচলে ?
ও, বুঝেছি, বান ডেকেছ নীলনদে ওই থৈথৈ চোখের জলে ||

--------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২২ এপ্রিল ২০১৫

মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৫

বেপরোয়া

৷৷ বেপরোয়া ৷৷

কিছুদিন ধরে কলেজের বিবেকের খোঁজ হচ্ছিল ৷ ফেসবুকেতে তো নেইই, কেউ ওর হদিশ, ই-মেল, কি মোবাইল নম্বরও জানে না ৷ কিন্তু, যেমন হয়, একদিন না একদিন সময়ের সমুদ্র টেনে নিয়ে যাওয়া সম্পর্ক হটাত ফিরিয়ে দেয় ৷

সেদিন শৈবাল ভবানীকে ফোন করল, “শোন, বিবেকের খবর আছে ৷ ব্যাটা গুরগাঁওয়ে আছে ৷”
- “কী করে যোগাযোগ করলি ?”
- “আরে, কোন এক লাফটার ক্লাবে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর সাথে আলাপ করে তার কাছ থেকে ও আমার ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিল ৷ এতদিন ফোন করে নি, নাকি সময় হয় নি ৷ কাল ফোন করেছিল জানাতে যে ও কলকাতায় আসছে ৷ আসার কারণ, মেয়ের বিয়ে ৷ অনেক কথা হল ৷ আমাকে বলল, ‘শৈবাল, একবার সবাইকে কন্টাক্ট কর ... সেই কলেজে শেষ দেখা ৷ জেনে নে কে কে আমার মেয়ের বিয়েতে আসতে পারবে, আর জানা আমাকে ৷ আমি তাদের নেমন্তন্ন পাঠিয়ে দেব ৷ সবাই এলে বেশ জম্পেশ করে আড্ডা দেয়া যাবে’ ... তুই আসবি তো ?”
ভবানী একটু ইতস্তত করে বলল, “আমার কথা তো জানিস ৷ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া যাবে না, আর গুষ্টি নিয়ে গেলে কতটা আড্ডা দিতে পারব জানি না ৷”
শৈবাল – “দেখ না চেষ্টা করে ৷ আমাদের গ্রুপের প্রায় সবাই আসছে – বিমল, রথীন, স্যাম, বিরাট, গুড্ডু ৷ নীতিনও বলছে, ও সেই সময় কলকাতার বাইরে না গেলে অবশ্যই আসবে ৷ আর, সব্বাই জানতে চায়, তুই আসছিস কিনা ৷”
ভবানী – “দেখি রে ... এই মুহূর্তে ঠিক বলতে পারছি না ৷”
শৈবাল – “উত্তরটা তৈরি রাখিস ৷ বিবেক ফোন করবে ৷”

কিছুদিন পরেই ভবানী বিবেকের ফোন পেল, “শৈবালের কাছে শুনেছিস তো, আমার মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি কলকাতায় ?”
ভবানী – “হ্যাঁ, সে খবর পেয়েছি ৷ তুই ছিলি কোথায় এতদিন ?”
বিবেক – “বলব ... আমি তোকে এখুনি এসএমএস করে বিয়ের দিনক্ষণ, আর যে গেস্ট হাউসটা ভাড়া নিয়েছি তার ঠিকানা, সব পাঠিয়ে দিছি ৷ তোকে কিন্তু আসতেই হবে ৷”
ভবানী – “দেখি .. তবে প্রমিস করতে পারছি না ৷ কিছু অসুবিধা আছে ৷”
বিবেক – “এখন ছাড়ছি ৷ এসে বলিস কী অসুবিধা ৷ ঠিক আছে ?”

কিছুক্ষণ পরেই বিবেকের এসএমএস পেয়ে ভবানী ভাবল, ‘না, একবার শৈবালকেই বলতে হবে, যে আমার পক্ষে হয়ত যাওয়া সম্ভব হবে না ৷’

তার আগেই – বিয়ের ঠিক দু’দিন আগে – শৈবাল ভবানীকে রাত্রি সাড়ে এগারটায় ফোন করল ৷
শৈবাল – “ভবানী ! কী করছিস ? কথা বলা যাবে ?”
ভবানী – “হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল ৷ কী খবর ? সব ভালো তো ?”
শৈবাল – “ভালই ৷ তুই কি আসছিস ?”
ভবানী – “না ৷ তোর মায়ের চোখ কেমন আছে ?”
শৈবাল – “ঠিকই আছে, কাল একবার দেখাতে যাব ... যদি, মা কথা শোনে ৷”
ভবানী – “আর সব খবর ?”
শৈবাল – “এই ... ছেলে শীতে আসছে, হপ্তা তিনেক থাকবে ৷আমি ভাবছি ওর ফেরার সময় ওর সাথে যাব ৷”
ভবানী – “বাহ ! বেশ ... আমরা ভেবেছিলাম এই গরমে যাব, কিন্তু ছেলে বাড়ি কেনা নিয়ে ব্যস্ত ৷”
শৈবাল – “সে তো ভালো খবর ! কোথায় কিনছে, বে এরিয়াতে ?”
ভবানী – “ওই, ওরা যেখানে থাকে, স্যান ব়্যমনে, অফিসের কাছাকাছি ৷”
শৈবাল – “দারুণ খবর ... জানিস, এই যে আমাদের ছেলেরা ইউএসএ তে থাকে ... আমি মাঝে মাঝে ভাবি, যদি বে এরিয়াতে আমাদের জন্য একটা বৃদ্ধাশ্রম হত, তাহলে কেমন হত ৷”
ভবানী – “ভালই হয়, তবে ভিসা কে দেবে ?”
শৈবাল – “ছেলের গ্রীন কার্ড কি সিটিজেনশিপ থাকলে, বাবা-মা পেয়েই যায় ৷ আমি অনেককেই দেখেছি – পাঞ্জাবি, গুজরাতি, এমন কি করাচীর এক ভদ্রলোক - কথাও বলেছি তাদের সাথে ৷ আমি বাড়ির কাছেই যে পার্কে হাঁটতে যাই, ওখানে আলাপ হয়েছিল এক ভদ্রলোকের সাথে ৷ উনি বললেন, একটা ইন্টার্ভিউ দিতে হয়, কোশ্চেন নাকি মোটামুটি একই ধাঁচের হয় ৷”
ভবানী – “তাহলে খোঁজ নিয়ে জানা ৷ তবে, জানি না বিদেশে কতদিন আমার ভালো লাগবে ৷ আমার যেন বয়েসের সাথে সাথে শিকড়ের টানটা বাড়ছে ৷”
শৈবাল – “দেখ, ওদেশে গিয়ে চিরকালের জন্য কেউ থাকে না ৷ আমার জানা এক পাঞ্জাবি স্বামী-স্ত্রী আছে ৷ ওরা বছরে একবার মাস দুয়েকের জন্য দেশে আসে ৷ বুড়ো-বুড়ি পেনসন পায়, তাই ...৷ আর এমনিতেও, আমি তো রিফিউজি হয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দিলাম ৷”
ভবানী – “রিফিউজি কেন?”
শৈবাল – “প্রথমত, বাবা-মা ইস্ট বেঙ্গল থেকে রায়টের ঠিক আগে চলে এসেছিল ৷”
ভবানী – “তাই বলে তুই কেন রিফিউজি হবি ?”
শৈবাল – “দ্বিতীয়ত, জন্ম ঘাটশিলায় ৷ পরে, নরেন্দ্রপুরে স্কুল করলাম ৷ বাবা-মা তারপরও সাত বছর ওখানেই ছিল ৷ বাবা কেন যে নরেন্দ্রপুরে একটা বাড়ি বানাল না জানি না ৷ তাই, যখন বাবার হার্ট-অ্যাটাক হল, দাদা বিদেশে, আমি বোকারোতে বাবা-মাকে নিয়ে এলাম আমার কাছে ৷ শেষে আমি না রইলাম ঘাটশিলার, না নরেন্দ্রপুরের, না বোকারোর ; আর কলকাতার তো নইই, কোনভাবেই ৷”
ভবানী –  “হ্যাঁ, তোর একটু যাযাবর অবস্থা হয়েছিল বটে ৷ তবে এখন তো কলকাতায় সেটল করেই গিয়েছিস ৷
শৈবাল – “না রে ৷ সেটল করতে আর পারলাম কই ?”
ভবানী – “তুই এই কথা বললি যখন ... জানিস, আজকাল আর আমার বেশিদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে না ৷ ভাবছি চলে যাই ৷”
শৈবাল – “এই ইচ্ছা-অনিচ্ছাটা তো আমার মধ্যেও প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে, কেন জানি না ৷ আমি কতদিন ধরে যে ভেবেছি কোন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাব – কী বলে, কী পরামর্শ দেয় দেখব ৷”
ভবানী – “সে কী রে !”
শৈবাল – “হ্যাঁ, একটুও বাড়িয়ে বলছি না ৷ আমার বউ অবশ্য এসব কিছু জানে না ৷”
ভবানী – “কেন ?”
শৈবাল – “দেখ, এইরকম কিছু কথা না সবার সঙ্গে শেয়ার করা যায় না – এই উপলব্ধিটা সম্প্রতি আমার মধ্যে এসেছে ৷”
ভবানী – “যা বলেছিস ... আমারও আজকাল কেমন যেন মনে হয় যে একদম খুউব আপনজন বলতে কেউ নেই ৷ এটা কোন অভিযোগ নয়, স্রেফ একটা চরম সত্য ৷”
শৈবাল – “আমার তো মনে হয় আমার প্রয়োজন মিটে গেছে ৷”
ভবানী – “আমারও ৷ তবে, আমি আজকাল একটু আধটু, মাঝে মধ্যে, পুনর্জন্ম কামনা করছি ৷”
শৈবাল – “পুনর্জন্ম ? পুনর্জন্মে তুই যে আবার তুই হয়েই আসবি কী করে জানলি ?”
ভবানী – “না, তা নয় – এটা জাস্ট একটা চান্স নেয়া মাত্র, যে যদি যাদের আমি জানতাম তাদের আমার পুনর্জন্মে পাই ৷ আমি শুধু জানতে চাই ওদের মধ্যে কে কে আমাকে কামনা করেছিল, কিন্তু মুখ ফুটে বলে নি ৷”
শৈবাল – “তার আগে, তুই কিন্তু তোর দ্বিতীয় প্রজন্ম দেখে যাস ৷ ওর টান খুব সাংঘাতিক ৷ আমার নাতি ওর ছোট মুঠি দিয়ে আমার হাত ধরে যখন হাটতে শিখত আমার কী অদ্ভুত আনন্দ যে হত ৷ অপার্থিবও বলতে পারিস ৷”
ভবানী – “আচ্ছা ?”
শৈবাল – “হ্যাঁ ... তোর ওই দ্বিতীয় কথাটা কিন্তু খুব ভয়ানক, খুব ছোঁয়াচে ৷ খুব বেপরোয়া চিন্তা ৷”
ভবানী – “কেন ?”
শৈবাল – “আমিও যে ভাবি, যাদের চেয়েছিলাম, এবং যারা আমাকেও চেয়েছিল, তারা কি এখনও আমার কথা ভাবে ?”
ভবানী – “এই শোন, আমি কিন্তু এই কথাগুলো মনে মনে নথিবদ্ধ করছি ৷ হয়ত কোথাও এই নিয়ে লিখব ৷”
শৈবাল – “লেখ না ৷ আমার কোনও আপত্তি নেই, সমস্যাও নেই ৷”
ভবানী – “ফাস-ক্লাস ! তা, যেমন তুই বললি, আমিও চিন্তা করি – বিশেষ করে, জীবনের কোন মুহূর্তের ভালো লাগাটা ক্ষণস্থায়ী, আর কোনটা দীর্ঘস্থায়ী সেটা কেন অজানা রয়ে গেল ৷”
শৈবাল – “তাই বলছি – তুই বিবেকের মেয়ের বিয়েতে এখানে আয় ৷ তুই এলে বেশ গুছিয়ে মনের কথা শেয়ার করে হালকা হওয়া যেত ৷”
ভবানী – “দেখা, এবার নয় তো, আরবার হবেই ৷ এই সুযোগটা অবশ্য আইডিয়াল ছিল, নিঃসন্দেহে ৷
শৈবাল – “আসলে কী জানিস, প্রথম প্রেম ভোলা যায় না – এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ৷”
ভবানী – “কিন্তু প্রথম প্রেম চেনা যায় কী করে ? ইন ফ্যাক্ট, আমি ভাবি প্রথম প্রেমের পর, পরপর অন্য প্রেম - প্রতি পরবর্তীটা পূর্ববর্তী সব কটার চেয়ে বেশি মোহময়, আচ্ছন্ন করা, পাগল করা – এমন হল কেন ?”
শৈবাল – “প্রথম প্রেমের ব্যাপারটা কিন্তু অন্যরকম ৷ খুব ভালো বোঝাবুঝি হয় ৷ পরে, বড় হয়ে গেলে, আমরা স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রয়োজনের বেশি ব্যবহারিক হয়ে পড়ি ৷ আর সেটাই সুসংগতির পথটা গড়তে দেয় না ৷ পরের প্রেমগুলো ঠিক নিষ্পাপ, পরিচ্ছন্ন প্রেমও হয় না ৷ ওগুলোতে স্বার্থ মিশে থাকে ৷”
ভবানী – “সেটা ঠিক – কিন্তু, আমি শুধু জানতে চাই একটার পর একটা আকর্ষণ কেন হয়েছিল - স্রেফ ডারউইনিয়ান সিলেকশন ? তাই যদি হয়, তাহলে মানুষের আবেগ আছে কেন ?”
শৈবাল – “হতেই পারে ... ছাড় এখন এ’সব কথা ... তুই কিন্তু চেষ্টা কর বিবেকের ওখানে আসতে ৷ এইরকম সুযোগ আর আসবে না ৷”
ভবানী – “দেখি ... তবে সম্ভাবনা খুব কম ৷”
শৈবাল – “চল, আমি এবার শুতে যাই ৷ চোখ বুজে আসছে ৷ সারাদিন হাওড়া স্টেশনে কিছু কাজে একরকম টোটো কোম্পানি করেছি, এই ভ্যাপসা গরমে ৷”
ভবানী – “কেন ? কী হয়েছিল ৷ কাউকে সী-অফ না রিসিভ ? কাকে ? গাড়ি লেট ?”
শৈবাল – “বললাম তো ... আয় না, সব খুলে বলা যাবে ৷ তোর গল্পও শুনব ৷”
ভবানী – “ঠিক আছে, যা তাহলে শুতে ৷ গুড নাইট ৷”
শৈবাল – “গুড নাইট ৷”


---------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২১ এপ্রিল ২০১৫

রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫

কার্পেট-ব্যাগার

|| কার্পেট-ব্যাগার ||


শৈবাল ঘটনাটা বলেছিল, খানিকটা এই বয়ানে –

বুঝলি, আমার তখন প্রথম চাকরির প্রথম পদোন্নতি হয়েছে | একটু সচ্ছল অবস্থা – একনাগাড়ে ছ’মাস কেনাকাটা করে সংসারের খুঁটিনাটি মোটামুটি কুক্ষিগত করে একটু হাঁফ ছেড়েছি, কি, সীমা বলল ও জন্মদিনে একটা গালিচা নেবে | নতুন সোফার সামনে মেঝে নাকি ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে | অনেক বুঝিয়েও বোঝাতে পারলাম না যে জায়গাটা তত বড় নয়, গালিচা পাতলে আর খালি জায়গা থাকবে না | সব সময় গালিচায় মাড়িয়ে হাঁটতে হবে; আর আমদের দেশে জুতো চটিতে সবসময় ধুলো বালি থাকে | কিন্তু সীমা কিছুতেই শুনল না | তখন বললাম, 'আচ্ছা এই মাসটা যাক |' সীমা জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্রেডিট কার্ডে কেনা যায় কিনা ?’ সত্যিই, সদ্য সদ্য ক্রেডিট কার্ড নিয়েছি, বেশির ভাগ ভারী দামের জিনিস তাতেই কেনা হয়েছে |

অগত্যা, একদিন ওকে দোকানে, দোকানে নিয়ে গিয়ে, অনেক দেখে রেখে একটা গালিচা কিনে দিলাম | সাগর-সবুজ রঙের জমিতে পার্সি কারুকাজ করা সুন্দর গালিচাটা বেলজিয়াম এ তৈরি | সাইজ চার ফুট বাই ছ’ ফুট – কিন্তু দাম প্রচণ্ড | তারপর বিভ্রাট – কার্ড মেশিনের কী গণ্ডগোলে দোকানদার দামটা দু’বার চার্জ করে ফেললো | তাই নিয়ে কথা কাটাকাটি, ক্ষমা প্রার্থনা | শেষে. দোকানদার আবার আমাকে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য একটা চেক লিখে দিল | দোকান থেকে যখন বেরলাম রাত সাড়ে ন’টা | অতি কষ্টে একটা রিক্সা ধরে গালিচা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম |

প্রথমে ক’দিন ওই সুন্দর গালিচা পেতে ঘর আলো | সোফা দেয়ালের সাথে ঠেসে গালিচার চারপাশে একটু খোলা মেঝেয় পায়ে হাঁটার জায়গাও হল | সীমা গালিচায় বসে স্কুলের খাতা দেখে, বাতাবি ওতেই বসে খেলে, নয় পড়ে | আমিও মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফিরে ওতে বসে চা খাই | কিন্তু সে ক’দিন ? সীমা নিজেই একদিন বলে, পুঁটি মাসি নাকি ওর উপরেও ঝাড় দিচ্ছে | সর্বনাশ ! তাহলে তো গালিচা ধুলোয় ভরে যাবে | তখন ঠিক হল, অফিস যাওয়ার আগে আমি গালিচাটা ভাঁজ করে একপাশে করে যাব | পুঁটি মাসি দুপুরে এসে ঘর ঝাড় দিয়ে, মুছে দেবে | বিকেলে অফিস থেকে ফিরে আমি আবার গালিচাটা পেতে দেব | এই ভাবে চলল ক’মাস | তারপর সীমা বলল, ভাঁজ করে করে গালিচাটা নাকি খারাপ হয়ে যাচ্ছে, ‘তার চেয়ে বরঞ্চ যদি গালিচাটা রোল করে রাখা যায়, তাহলে কেমন হয় ?’ আমি বললাম, ‘তোমার পাঁঠা, তুমি যেদিকে কাটবে ... থুড়ি, ওটাকে যে ভাবে রাখবে ...’

আরও ক’মাস এই ভাবে কেটে গেল | এখন প্রায়ই গালিচাটা রোল করে ফেলে রাখা হয় | পড়ে থাকতে থাকতে ওটা একটু একটু করে খুলে যায়, তখন আবার রোল করতে হয় | সীমা বলল, ‘এতসব ঝামেলায় কাজ নেই, ওটাকে রোল করে দাঁড় করিয়ে রেখে দাও |’ বেশ, ওটাকে গুটিয়ে বসার ঘরের কোনে দাঁড় করিয়ে রেখে দিলাম | এর পর বাড়িতে কাউকে চা-জলখাবারে ডাকলেই ওটা পাতা হত | নইলে, ওটা দাঁড়িয়ে থাকত | শুধু শীত পড়লে ওটাকে খুলে, ভ্যাকুয়াম করে রোদে দিয়ে, সীমার স্কুলের ছুটির দিন ক’টা পেতে রাখতাম | সে’ ক’দিন পুঁটি মাসি বসার ঘরের ঝাড়া-মোছা বাদ দিত | আবার, সীমার স্কুল খুললে গালিচাটা কে গুটিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দেয়া হত |

একবার গরম পড়ছে কি টিকটিকির খুব উৎপাত | সীমা আবার টিকটিকি একদম সহ্য করতে পারে না | আমাকে বলল, গোল করে দাঁড় করানো গালিচার ভিতর নাকি টিকটিকি বাসা বেঁধেছে | টিকটিকি যে বাসা বাঁধে জানতাম না | কিন্তু, সীমা বলল, ‘ওরাও নিশ্চয় বাসা বাঁধে | নইলে ডিম পাড়বে কোথায় ?’ অগত্যা, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমাকে কী করতে হবে ?’ সীমা বলল, ‘একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট দিচ্ছি, ওটা কার্পেটের রোলের মাথায় টুপির মত পরিয়ে বেঁধে দাও, তাহলে ওর ভিতরে আর টিকটিকি ঢুকতে পারবে না | আর ওর ভিতরে ধুলোও ঢুকবে না |’

তাই করলাম | এই করতে গিয়ে গালিচাটা পড়ে গেলে ভিতর থেকে কিছু ভাঙ্গা টিকটিকির ডিমের খোলা বেরল | সীমা বলল, ‘দেখলে, টিকটিকি বাসা বাঁধে কিনা ?’ তাই তো, ডিম পাড়তে নিশ্চয় বাসা বাঁধতে হয় !

কিছু দিন পরে দু’জনের স্কুলে গরমের ছুটি হলে আমরা দার্জিলিং চলে গেলাম বেড়াতে | ফিরে এসে বাড়ি খুলে দেখি বদ্ধ ঘরে সে কি চিমসে দুর্গন্ধ | বুঝলাম, নির্ঘাত টিকটিকি মরেছে কোথাও | কিন্তু বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও মরা টিকটিকি পাওয়া গেল না | পুঁটি মাসিও পরদিন এসে কোথাও কিছু তেমন পেল না | তখন ও বলল, ‘তাহলে নির্ঘাত ওই কার্পেটের ভিতরে কোনও টিকটিকি আটকা পড়ে মরেছে |’ ‘ও মা’, সীমা শিউরে উঠে বলল, ‘মাসি তুমি তাহলে ওটা বাইরে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে এস না |’ পুঁটি মাসি বলল, ‘আমি কি করে অত ভারীটা তুলব ? আর ওই মরা টিকটিকির রসে হয়ত ওটা মাখামাখি হয়ে আছে, সেটা কী করে পরিষ্কার হবে ? ও তো ফিনাইল দিয়ে ধুতে হবে |’ সীমা গা ঘিন ঘিন করে বলল, ‘তাহলে মাসি কাউকে ডেকে নিয়ে এসো, কার্পেটটা নিয়ে যাক |’ আমি বললাম, ‘নিয়ে যাক মানে ?’ সীমা বলল, ‘নিয়ে যাক মানে নিয়ে যাক ! আমি আর ওই কার্পেটে হাঁটতে বসতে পারব না |’ আমি সীমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম | সীমা বলল, ‘কার্পেটটা কার, তোমার না আমার ?’ আমি বললাম, ‘তাহলে কাউকে দিয়ে দাও |’ সীমা বলল ‘কে নেবে মরা টিকটিকির রস মাখা কার্পেট ?’ পুঁটি মাসি সায় দিয়ে বলল, ‘যে নেবে সে কি আর গন্ধে টিকতে পারবে ? দিদি ঠিকই বলছে, ওটা ফেলে দেয়াই ভালো |’ শেষে রাজি হতেই হল | পুঁটি মাসি পাড়ার জমাদার বিশুকে ডেকে নিয়ে এলে | বিশু পনের টাকায় রাজি হল গালিচাটা নিয়ে ফেলে দিয়ে আসতে |

ক’দিন পরে বিশু বাথরুম, পায়খানা পরিষ্কার করতে এলে সীমা জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁ রে বিশু, সেদিন কার্পেটটা কত দূরে নিয়ে গিয়ে ফেললি ?’

বিশু বলল, ‘ফেলব কেন, দিদি ? একটু দূর যেতেই দেখলাম পুঁটির ছেলে দাঁড়িয়ে | ওকে দেখতেই  পুঁটি বলল, ‘দে, কার্পেটটা এখানেই নামিয়ে দে |’


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৮ এপ্রিল ২০১৫

শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৫

চায়ের এঁটো

|| চায়ের এঁটো ||

-“হ্যালো ... তনিমা !”
-“কে ? শিপ্রা ? আরে, কী খবর তোর ... এ’ ক’দিন ফোন করিস নি কেন ?”
-“বলছি, বলছি | সেই কথাই তোকে বলার জন্য তো ফোন করলাম | তোর সময় আছে ?”
-“হ্যাঁ, বল না ... যা বলতে চাস |”
-“তোর টম কে মনে আছে ?”
-“কে টম ?”
-“আরে টমেটো – টম-এঁটো ... কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের |”
-“ও ... তম এঁটো, মম এঁটো, যার-তার এঁটো, তুই যাকে ...”
-“থাক, আর বলিস না ...
  “আচ্ছা, তনিমা, একটা কথা বল ... মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে, অথচ, পাগল কেন হতে পারে না রে, স্বেচ্ছায় ?”
-“ও মা, তুই পাগল হয়ে কী করবি ? কী হয়েছে তোর ?”
-“জানি না | কিন্তু কিছুদিন আগে হটাত ওর কথা মনে হল, ফোন করলাম ওকে |”
-“নম্বর পেলি কোথায়, এতদিন পরে ? তোর বিয়ে হয়েই তো তের বছর হয়ে গেল, তার তিন বছর আগে ছাড়াছাড়ি | কী, ঠিক বললাম তো ?”
-“ঠিকই বলেছিস, প্রায় ষোল বছর হয়ে গেল | এতদিনে নিশ্চয় ওর টাক, ভুঁড়ি, চশমা, সিরিয়্যাল দেখা বউ, বাচ্চা-কাচ্চা সব হয়ে গেছে | হ্যাঁ, ইয়ে ... যা বলছিলাম ... ও তো আমার মাসতুত দাদা সমীরের বন্ধু ছিল | সমীরদা’ই দিল নম্বরটা |”
-“কিছু জিজ্ঞাসা করল না ?”
-“না রে, সমীরদা খুব ভিন্ন রকমের মানুষ | শুধু বলল, ‘বাহ, এখনও প্রেম করছিস !? করে যা, মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব ভালো’ ... আর কিছু না |”
-“তুই কী বললি ?”
-“ধুর, সব কথার জবাব দিতে নেই | যাকগে, টমকে ফোন করলাম | বেশ ভারিক্কি, চিন্তা করা গলায় ফোন তুলল | মনে হল যেন টাক মাথায় হাত রেখে, বাই-ফোকাল চোখে উদাস হয়ে চেয়ে, ফোলা পেটের নাভির কাছ থেকে আওয়াজটা বের করল | তারপরই, আমার নাম শুনেই, টাক থেকে হাত নামিয়ে, বাই-ফোকাল খুলে রেখে, ভুঁড়ি টেনে ধরে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আরে, এতদিন কোথায় ছিলে ?’”
-“উফ, এমন ভাবে বলছিস যেন মুখোমুখি কথা বলেছিস | তারপর ?”
-“তারপর অনেকক্ষণ নিছক কথা বার্তা – কে কোথায় আছে, কী করছে, বউ, বা বর - যার যেমন কেস - কী করে, ছেলে মেয়েরা সায়েন্স নিয়েছে না আর্টস | শেষে, বিশেষ বলার কিছু যখন থাকল না, তখন দুজনেই চুপ |”
-“ব্যাস ?”
-“না, ব্যাস ওখানেই নয় | আমি শেষে বললাম, ‘শোনো টম, যে কথাটা জিজ্ঞাসা করতে, তোমাকে ফোন করেছিলাম |’ ও বলল, ‘হ্যাঁ, বলো |’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, আমাদের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতাটা হয়েছিল, তাতে কী একটুও ভালবাসা ছিল না ?’ ও জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘনিষ্ঠতা ? সেকালের কম বাজেটের পকেট খরচে এঁটো চা শেয়ার করে দুজনের ঠোঁট এঁটো করা ছাড়া আর তো কিছু হয় নি |’ আমি বললাম, ‘যাই হোক, তার মধ্যে কি একটুও ভালবাসা ছিল না ?’ জানিস, তনিমা, ও না কিচ্ছু উত্তর না দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখল |”
-“এই ব্যাপার ? এইটুকু ব্যাপার, আর তুই জানতে চাস মানুষ আত্মহত্যা করতে পারে, অথচ, পাগল কেন হতে পারে না স্বেচ্ছায় ?”
-“তুইই বল |”
-“কী বলব ? তুই এইরকম পাগলামি করলি, এর পরে তোর মুখে আর ওই প্রশ্ন সাজে ?”
-“তুই বুঝলি না | আমি অন্যের জন্য পাগল হওয়ার কথা বলছি না | সে অভিজ্ঞতা আমার আছে ... আমি জানতে চাই, মানুষ কেন নিজের জন্য পাগল কেন হতে পারে না স্বেচ্ছায় ?”
-“জেনে কী করবি ?”
-“কেন ? দিব্যি নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে বেঁচে থাকব, শাশুড়ি, বর, মেয়ে দুটো, কেউই ডিস্টার্ব করতে পারবে না  ... এই তোর ফোন বাজছে বোধ হয় |”
-“হ্যাঁ, ল্যান্ড লাইনে কেউ ফোন করছে | দাঁড়া দেখি ...
 “... শিপ্রা, আন্দাজ কর দেখি কার ফোন ছিল |”
-“কার তা আমি কি করে জানব ... ওহ! লেট মি গেস ...”
-“থাক, থাক | জিজ্ঞাসা করল, তুই কেমন আছিস |”
-“কী বললি ?”
-“বললাম যে তোর সাথেই ফোনে কথা বলছি | শুনে, ‘যাও, তাহলে পরে কথা হবে’ বলে ফোন রেখে দিল |”
-“ওহ ! আমি তো জানতাম না যে তোর সাথে ওর কথা আছে, তাহলে ওর নম্বরটা ...”
-“কেন ? তুই কি ভেবেছিলি ও শুধু তোর সাথেই চা শেয়ার করে খেয়েছিল ?”


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৮ এপ্রিল ২০১৫

বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

শেষ শোকযাত্রা

|| শেষ শোকযাত্রা ||

এই আত্মনিমগ্ন শহরে, আমার শেষ শোকযাত্রার রাসে
তুমি গিয়েছিলে শেষ অব্দি, পায়ে হেঁটে আমার পাশে
যে চলে গিয়েছে তারই স্মৃতিতে ছিলেম আমি বিমর্ষ
চিনি নি তো তোমার মুখ, শুধু ছুঁয়েছিল তোমার স্পর্শ

হাওয়ায় ছিল উদগ্র ধুপ ধুনো, ছিটানো মৃদুগন্ধি ফুল
শুধু অনুভবে বুঝেছিলাম যে তুমি স্থবিরা, তুমি বিপুল
স্নেহবৎসলা পৃথুলা তুমি, তোমার বাহ্য স্নেহের গন্ধ
যেন হাতড়ে খুঁজেছিল আমায়, যেমন খোঁজে অন্ধ

আড় চোখে চেয়ে দেখছিলাম তোমার ঊর্ধ্ববাহুর মেদ
দেখেছিলাম তোমার আর্দ্র চিবুকে জমা বিন্দু বিন্দু স্বেদ
সহসা রাস্তার কোলাহল যেন থেমেছিল কোন ইঙ্গিতে
শুনেছিলাম তোমার হাঁপানির শ্বাস, স্তব্ধশব্দ পৃথিবীতে

তবুও তুমি হেঁটেছিলে শেষ পর্যন্ত আমার পাশে পাশে
এই আত্মনিমগ্ন শহরে, আমার শেষ শোকযাত্রার রাসে
যাত্রার শেষে আমার শ্রীমতীর সিঁদুর উজাড় করা পা’য়
প্রণাম করে হাত মুছেছিলে তোমার রজতশুভ্র মাথায়

অতর্কিতে ছুঁয়েছিল আমার পাতায় তোমার সে আঙ্গুল
ঠেকেছিল এই হাতে যেন এক সজল রক্তকরবী ফুল
দেখো, এখনও লেগে আছে সেই সিঁদুরের লাল আভা
উষ্ণ, উজ্জ্বল, তোমার সচকিত লজ্জিত চোখের লাভা

চলে গেল যে প্রিয়জন, সে তো আর ফিরেও তাকাল না
তার ঠাঁই দিয়ে গেল কার জন্য ছেড়ে, না শুনে সব মানা
এখন, আত্মনিমগ্ন শহরে, আমার শেষ শোকযাত্রার রাসে
বলো কেন এসেছিলে এক সদ্য-বিপত্নীকের প্রতিবেশে ||


---------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৬ এপ্রিল ২০১৫






বুধবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৫

চোখের দেউলে

|| চোখের দেউলে ||


সদ্য ভাঙ্গা ঘুমের শেষ স্বেদে ভিজে ছিল তোর গাল
চুলগুলো টেনে মাথার পিছনে, নিভাঁজ করে কপাল
দু’হাতে চুল মুঠো করে বেঁধেছিলি চুড়োখোঁপা উচল
শক্ত হাতে গুঁজেছিলি তোর কোমরে শাড়ির আঁচল
কটির কাছে কাঁচল নিচে মেলে তোর এক ফালি গা
খালি পায়ে তুই যাচ্ছিলি, টিপে ফুলকো ফুলকো পা

তুই হাঁটছিলি রাজহংসীর মতন, উদ্ধত বুক এগিয়ে
পিছনে তোর উর্বরা-জননী অভিমানী পেখম নাচিয়ে
চেয়েছিলাম আমি বলতে, ‘বড় লাগছিস মনকাড়া’
আমায় বিমনা করল তখন তোর চোখের শূন্য তারা
ঠোঁটে ঠোঁট চিপে, তর্জনী রেখে, ক্ষুব্ধ এক কটাক্ষে
ইঙ্গিত কী যে করেছিলি, তা পড়েনি আমার লক্ষ্যে

তুই চলে গেলি ঠাকুরঘরে, আমি রয়ে গেলাম দালানে
সামলাতে অদম্য ব্যাকুলতা, বেসামাল হয়ে আনমনে
কিছু পরে তুই ফিরে এলি, সেরে নিয়ে তোর অবগান
কপালে, চিবুকে চন্দনের ফোঁটা, গলায় গুনগুন গান
বুঝলাম, তোর হয়ে গেছে রোজকার প্রত্যুষী অভিসার
জানলাম না বাকি দিনটা তুই কি হবি শুধু এক আমার

বুঝি, তোর বুকের দেউলে বসানো অন্য কারো বিগ্রহ
দর্শায় শূন্য চোখের
দেউলে আমার ব্যাকুলতার নিগ্রহ  ||

-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৫ এপ্রিল ২০১৫

সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৫

বৈশাখী আম

|| বৈশাখী আম ||

এখন আঙ্গিনা ভরে
ছড়ায়ে পড়ে আছে
কাল বৈশাখীর অভিমানী আহত আম
ঝড় থেমে গেছে, মেঘও হয়েছে উধাও
তবুও কোথা যেন বরিষণে নাহি বিরাম

ভাবি বসে বসে, দাওয়ার এক পাশে
কোথায় সেই সখী, বড় প্রিয় বালিকা
আম্র মঞ্জরীর সুবাসের সাথে সাথে যে
পেশ করিত তাহার বায়নার তালিকা

কিছু কুশি, কিছু গাছপাকা, সে বায়না
তাহার দিয়াছে বুকে দাগ কাটা ব্যথা
কত শত বার পারি নাই যে রাখিতে
তাহাকে প্রদত্ত সব মিছে স্তুতি কথা ||


---------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৩ এপ্রিল ২০১৫

রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৫

মহুদার খোঁজে

|| মহুদার খোঁজে ||


এক অধুনালুপ্ত বালিকা বেলার স্মৃতি টেনে টেনে বয়ে
আজও দূরদূরান্তে ঘুরে বেড়াই, নানান পথে ক্ষয়ে ক্ষয়ে

শহর ছাড়ালে এখনও উদ্ভিন্নযৌবনা ওই যে পৃথিবীর দেহ
তেমনই শ্যামা সব তৃষিতের চোখে, যার হারিয়েছে গেহ
তেমনই তার আদিগন্ত আলুলায়িত সবুজ চুলের নামা ঢল
সুজলা নীল চোখ, খোয়াইয়ের সিঁথি উপচে সিঁদুরে-অনল
এখনও হটাত হাওয়ার দমকে সে সলজ্জ হাসিতে খসায়
পলক, শিহরিত ইউক্যালিপটাসের লেবুগন্ধি জীর্ণ পাতায়
তার বুক চিরে এখনও রেলপথে একসাথে পাশাপাশি ধায়
সমান্তরাল জুড়ি, কোথা সাতনরি, ধুসর উপলের বিছানায়
নারঙ্গি সন্ধ্যায় এখনও সবুজ, লাল সিগন্যাল ওঠে জ্বলে
বিকেলের রোদ ঝরায় হেমরেণু, যাত্রিণীর নিটোল কপোলে
ছুটে যায় গাছালি ফেলে আসা অতীতের হদিশের সন্ধানে
দুর্নিবার ঘূর্ণির পাক খেয়ে আকাশ দিশা হারায় অকারণে
বিগতের মোহে মুহ্যমান সব নির্জন স্টেশন আসে যায়
শান্ত সমাহিত উদার প্ল্যাটফর্ম চিত হয়ে শুয়ে ঘুমায়
কবেকার পেয় জলের নল, এক কোনে সবার অলখে
টিপ টিপ করে একা কেঁদে যায় নিস্তব্ধতায় চাপা দুখে
প্রতীক্ষালয়ে অকাতরে সুপ্ত জড়সড় অচিন বালিকারা
অজানা ট্রেনের বাঁশির টানে ঘরছাড়া হয়েছে যাহারা

এত সবে মনে হয় কিছুই হারায় নি, কেবল তুমি ছাড়া
কিম্বা হয়ত তুমিও আছ, নেই শুধু সে, ছেলেটা বেয়াড়া
যে কবে একদিন নেমেছিল মহুদা স্টেশনে বৈশাখ বিকালে
দেখে তোমাকে প্রতীক্ষালয়ে উদগ্রীব অপেক্ষায় লুপ্ত, বিরলে
টেনে ঠিক করে সামলে তোমার শাড়ির সীমানা, বালিকা
আভাসে জানিয়েছিলে তুমি অপ্রস্তুত, লুকিয়ে চোখের শিখা

সেই অসম্পূর্ণ বালিকা বেলার স্মৃতি টেনে টেনে বয়ে
আজও আমি বহু দূরদূরান্ত ঘুরি, মহুদার পথ হারিয়ে ||


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১২ এপ্রিল ২০১৫




শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

কিশোরীতলা

|| কিশোরীতলা ||


তুতোদি,
তুমি আজ আমার কৈশোরের শেষ শিকড় নিড়িয়ে দিলে
যখন, বিভ্রম থেকে কুড়ন এক ঝাপসা দ্বিধায় তুমি শুধলে,
“তুমি কি আমাকে, এর আগে, কখনও দেখেছ আমায় ?”

তুতোদি, তুতোদি, তুতোদি ...
আমার শৈশব বেলার তুতোদি তুমি, তুমি হারালে কোথায়
ভুলে গেলে কি এত সব কিছু, শেষ বয়েসের উজানভাটায়
বলো কেন তুমি কথার খেই হারিয়ে দৃষ্টিতে ঝাপসা হলে ?

মনে পড়ে ?
সেই যে ... শৈশবে কিশোরীতলার ঘাটে, নাইবার ছল নামে
বাজি ফেলে ডুব দিয়েছি, তোমাদের কিশোরীদের সমাগমে
দেখছি ঊরু-জঙ্ঘার যুগল ঋজু স্তম্ভ, আজানু সর্পিল কেশ
পটভূমিতে অতলান্ত, অপরিচিত, আসক্তির বিভূঁই-বিদেশ
...
টলমল তুষার শীতল জলে ডুব দিয়ে শিউরে ওঠার উচ্ছ্বাসে
তুমি দেখছ আমায়, বলেছ আসিক্ত আরক্ত মুখে, “কে তুই ?”
অভিনয় যেন, ‘চুরিয়েছিস সব, এখন লাজ মোর কোথা থুই’

সেই যে ...
সেই যে দুরূহ আবিষ্কার শুরু, কখনও যার কাল হয় নি শেষ
আমার চোখে তুমি যতই চেয়েছ, দেখেছ কুতূহল নির্নিমেষ
বলেছ, বার বার, “কী দেখিস ? আচ্ছা, দেখবি তবে আয় |”
লুকিয়ে নিয়ে আমাকে তোমাদের ছাত-হীন চিলেকোঠায়
আদুড় তোমার কষ্টিপাথরের অঙ্গে রেখে শুধু কাঁকন, দুল
হাওয়ায় শুকিয়েছ গায়ের শাড়ি, নিংড়ে মুছেছ জটিল চুল
মৌন সাক্ষী দূর তালগাছ, আবছায়া মেঘলা আকাশ, চিল
দেখিয়ে কায়ার ভাস্কর্য, শিখিয়েছ রহস্যের রোমাঞ্চ আবিল 

কিন্তু সে তো কিছু দিন, কিছু দিনই, তারপর ...
কিশোরী হতে যৌবনবতী হয়ে তুমি ভরেছ কানায় কানায়
একদিন যাও নি স্নানে ওই টলমল জলের কিশোরীতলায়
গুটিয়ে গিয়ে পাটভাঙা তসরে, রেশমের ঘটি-হাতা জামায়
কলাবৌয়ের মত, কাউকে সাত পাকে বেঁধেছ ছাদনাতলায়
না বলে চলে গেছ - রেখে আমাকে আটক কিশোর বেলায়

তারপর ...
এতদিন দেখেছি তোমায়, শুধু তোমায়, বেঘোরে নির্বাক স্বপ্নে
ব্যথাটা তুমি জান নি; কথাটা বলতে পারি নি সঙ্গিনীকে জাগরণে
কী ভাবে কাটিয়েছি সাল দু’কুড়ি-পাঁচ, চিরকিশোরের অবেলায়
ফিরতে হল একদিন যখন অবশেষে এই গ্রামের কিশোরীতলায়
শুনে যে তুমি ফিরেছ, সিঁদুর হীন, পরনের সাদা থানের সম্ভ্রমে
খুঁজে ফিরে পেতে তোমার আমার কিশোর-কিশোরী কালবেলা
বলো, শেষ ক্ষণে কেন তোমার স্মৃতি করল এই ছলা, অবহেলা

তুতোদি,
এ’ভাবে, তুমি আজ এক কিশোরের শেষ বিশ্বাস কেড়ে নিলে
যখন সব শুনে আনমনে এক কুড়ন ঝাপসা দ্বিধায় তুমি শুধলে,
“তুমি কি আমাকে, এর আগে, আরও কখনও দেখেছ আমায় ?”
দেখেছি কি তোমাকে ? তুমি নইলে, বলো কে বলবে আমায় ?


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১০ এপ্রিল ২০১৫