বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৩

এলেশ্বরী কান্ড

|| এলেশ্বরী কান্ড ||


সেই কালের কথা যখন যোগানন্দ বাবুর বয়স পঞ্চাশ | অকাল-বার্ধক্যের ফলে বাহিরে ক্বচিৎ পদার্পণ করেন | চলাফেরা করেন সাবধানে |  হটাত এক শনিবার জরুরী তলব আসিল তাঁহাকে বাঁশবেড়ে যাইতে হইবে | বাঁশবেড়ে তাঁহার শ্বশুর বাড়ি | শ্বশুর মহাশয়, ত্রিলোক চৌধুরী, কিছু দিন পূর্বে পঁচাত্তর বৎসরে পদার্পণ করিয়াছেন | তলবের কারণ তিনি তাঁহার উইল প্রস্তুত করিয়াছেন, যাহা তিনি সর্বসমক্ষে পড়িয়া সবাই কে অবগত করাইবেন |

বাঁশবেড়ে কলিকাতা হইতে এগারো কিমি | যখন যোগানন্দর সহিত ত্রিলোক বাবুর কন্যা যোগমায়ার বিবাহ স্থির হইল তখন গুরুজনেরা কহিলেন, “একেই বলে যোগা-যোগ |” কিন্তু যোগানন্দর বন্ধুরা মস্করা করিল, “জেনে শুনে বাঁশ নিতে কেন গেলে ভাই, তাও বেঁড়ে ?” বিবাহের দিন যোগানন্দ দেখিলেন জায়গাটি গ্রাম্য - আশেপাশে ধানক্ষেত; বাঁশ কোথাও দেখা গেল না | যোগানন্দ যখন আশ্বস্ত বোধ করিতেছেন, তখন প্রবাল, তাঁহার শ্যালক, কলেজ হইতে আসিয়া প্রণাম করিল | প্রবালের চেহারা খর্ব এবং সর্ব শরীর গাঁটে ভরা, কণ্ঠনালী হইতে গোড়ালি অবধি | যোগানন্দর সন্দেহ হইল এই গ্রামে সেই একমাত্র বেঁড়ে বাঁশ কি ?

বিবাহের পর যোগানন্দ দেখিলেন যোগমায়া অভিমানিনী হইলেও ত্রিলোক বাবুর ন্যায় বিচক্ষণ, কিন্তু প্রবাল তাঁহার মতো ধুরন্ধর | উপরন্তু সে নির্লজ্জ ও মহা কঞ্জুস | এই দ্বিতীয় কারণে সে এমন কি যোগানন্দকে জামাইবাবুর বদলে সংক্ষেপে দাদা বলিয়া ডাকে |

বাঁশবেড়ে যাইতে শিয়ালদহ হইতে লোকাল আছে, আর আছে বাস | উভয়েই যোগানন্দর আপত্তি, একেতে বড় ভিড়, অন্যেতে বড় ঝাঁকুনি | নিরুপায় হইয়া তিনি শ্যালকের শরণাপন্ন হইলেন | তাহার একটি মোটর গাড়ি আছে, কখনো কখনো কলিকাতা আসে কাজে | যোগানন্দ তাহাকে ফোন করিয়া সমস্যা জানাইলে সে কহিল, “কিছু চিন্তা নেই, দাদা | যায় যায় অবস্থা, এটুকু তো করতেই হবে |“ কী যায় যায় তাহা জানিবার পূর্বে লাইন কাটিয়া গেল | সন্দেহ হইল শ্বশুর মহাশয় কি যায় যায় | কিন্তু যোগমায়া সে কথা আমল দিলেন না | তাঁহার তাম্বূল পূর্ণ মুখ হইতে শোনা গেল, “ম্ এত ম্ চট করে ম্বাবা যাচ্ছে ম্না |” এই বলিয়া তিনি ফেলিলেন ‘সজোরে তাম্বূলের পিক, দিতে শত্রুর মুখে ধিক |’

প্রবাল আসিল মধ্যাহ্ন ভোজের সময়, এবং যোগানন্দর ভাত সে প্রায় সমস্তই গ্রাস করিয়া দিদির সহিত গল্প করিবার ছলে খাটে যোগানন্দের স্থানে দিব্যি দিবানিদ্রা করিল | বেলা তিনটার সময় প্রবাল যোগানন্দ কে লইয়া বাঁশবেড়ের জন্য রওয়ানা হইল | যোগমায়া সঙ্গ দিতে রাজী হইলেন না, কারণ তাঁহার উপবাস (পান / চা ইত্যাদি খাওয়া বাদে), কাজেই যাত্রার ধকল সহিবে না |

মোটর গাড়িতে প্রায় দু ঘণ্টা লাগিল, ঝাঁকুনি বিশেষ বোধ হইল না, কেননা প্রতি সিকি কি আধ কিমি অন্তর গাড়ি থামে, তাহাকে মুখে জল, বনেট খুলিয়া বুকে হাওয়া ও পশ্চাতে ধাক্কা প্রদান করিলে তবে সে আবার নড়ে | এই লম্বা অবসরে প্রবালের সহিত কথোপকথনে যোগানন্দ দুইটি ব্যাপার সম্বন্ধে জানিতে পারিলেন | এক – যায় যায় অবস্থা শ্বশুরের নহে, সম্পত্তির | দুই - তাঁহার নিজের হয়ত যায় যায় অবস্থা হইতে চলিয়াছে | কারণ, প্রবাল জানাইল যে রাত্রে গাড়িতে তাঁহাকে লইয়া কলিকাতা ফেরা অসম্ভব | এবং, যোগমায়াকে ছাড়িয়া শ্বশুরালয়ে রাত্রি বাস করা যোগানন্দর অনুচিত হইবে | অতএব, প্রবাল প্রস্তাব করিল যে রাত্রে সে তাঁহাকে লোকালে চড়াইয়া দিবে |

এই অবসরে যোগানন্দর জ্ঞান আরও বাড়িল যে বাংলার চাষার সাধারণ-বুদ্ধি অসাধারণ | পাকা-পথে মোটর গাড়ি দাঁড়াইতে দেখিলে সে কাছে আসে কৌতূহল চরিতার্থ করিতে | কিন্তু কাঁচা-পথে দাঁড়ান মোটর গাড়ি দেখিলেই সে পলায়ন করে | সে জানে যে এমন গাড়ি ঠেলিতে হইবে, এবং মালিক পয়সা দিবার আশা দিয়া, পরে গাড়ি চলিতে লাগিলে আর প্রতিশ্রুতি রক্ষণের জন্য গাড়ি থামাইবে না, পাছে থামিলে গাড়ি আবার বন্ধ হয় | অতএব, একাধিক জায়গায় তিনি গাড়ির পিছনে থাকিয়া চাষা বন্ধুদের পয়সা চুকাইয়া ধুলা খাইতে খাইতে দৌড়াইয়া গাড়ি ধরিলেন - যদিও, প্রবালের চলতি গাড়ি হাঁটিয়াই ধরা যায় |

পাঁচটা নাগাদ দুই জনে ত্রিলোকালয়ে উপনীত হইল | চা ও চাল-ভাজা খাইতে, খাওয়াইতে শ্বশুর মহাশয় খবরাখবর লইলেন | তাহার পর পুরোহিত মহাশয় ভগবানের উইল, ও অতঃপর শ্বশুর মহাশয় নিজস্ব উইল পাঠ করিলেন | প্রকারান্তরে যোগানন্দ বুঝিলেন যে, যে বিছা-হার ও সর্প-মুখী কঙ্কণ লইয়া যোগমায়া তাঁহার সংসারে প্রবেশ করিয়াছিলেন, তাহার পর আর বিশেষ কিছুর ব্যবস্থা শ্বশুর মহাশয় বিবেচনা করেন নাই | তাঁহার চিন্তা হইল ফিরিবার ভাঁড়া অন্তত পাওয়া যাইবে কিনা | পরে দেখিলেন সে গুড়ে বালি |

রাত্রের ভোজন অল্পেই সমাপন হইল – ভাত, ডাল, বড়ি ভাজা ও পুঁটি মাছ দিয়া লাউ-ডাঁটার চচ্চড়ি | এত ঝাল যে অল্পেই পেট ভরিল, অন্তত যোগানন্দর পেট বারম্বার ঢেকুর-ধ্বনির ধিক্কারে সেইরূপ ঘোষণা করিল | 

ভোজন শেষ হইল কি প্রবাল কহিল, “এবার চট করে চলো দাদা | তোমাকে নটা এগারোর এলেশ্বরী ফাস্ট লোকাল ধরিয়ে দেব |”
যোগানন্দ – “এলেশ্বরী ? নতুন গাড়ি বুঝি ?”
প্রবাল – “চলো, দেখতেই পাবে |”

স্টেশনে আসিয়া প্রবাল তাঁহাকে সোজা ওভারব্রিজের উপর দিয়া দুই নম্বরে লইয়া গেল | “টিকিট টা আগে নিয়ে নিলে ভালো হত না ?” যোগানন্দর এ প্রশ্নের উত্তরে প্রবাল কহিল, “চিন্তা নেই, এ গাড়িতে চেকিং হয়না | মনে করে শিয়ালদহের আগে আউটার সিগন্যালে নেমে পোড়ো, দেখবে ওখানেই সবাই নামবে | আর, বাথরুম পেলে ভেবো না | টয়লেট আছে | এই গাড়ির এটাই এক সুবিধা |”

ব্রিজ হইতে নামিয়া যোগানন্দ দেখিলেন সম্মুখেই এক জীর্ণ দীর্ণ নাইনটীন-অস্টিনের পুরাতন কামরা | তাহার পিছনে পার্সেল ভ্যান, তারপর কেবল খোলা মালের ওয়াগন, তাহাতে বোঝাই শত সহস্র বাঁশ | তবে কামরার অগ্রে লাগা বিদ্যুৎ চালিত আধুনিক ইঞ্জিন | ইহা দেখিয়া তাঁহার কিঞ্চিত ভরসা হইল | কামরার নিকটবর্তী দরজার দিকে অগ্রসর হইয়া তিনি দেখিলেন তাহার উপর ফিকা পড়া এক মহিলার চিত্র ও তাহার নীচে ইংরেজির দুই অক্ষর - এল. এস. | ভিতরে টিম টিম বাতিতে কতিপয় মহিলা দেখিতে পাইলেন, কোনও পুরুষ দেখা গেল না | তাঁহার দ্বিধা হইল এই প্রমীলাকুলে তিনি কি কোনও মুশকিলে পড়িতে চলিয়াছেন | কিন্তু সেই মুহূর্তে গার্ডের বাঁশি ও ইঞ্জিনের হর্ন বাজিল, একাদিক্রমে | প্রবাল যোগানন্দর ধুতির কোঁচা তাঁহার হাত হইতে ছাড়াইয়া তাহা দিয়া তাঁহার মাথা ঢাকিল ও পৃষ্ঠে  ধাক্কা দিয়া কহিল, “মাথায় কাপড়টা ধরে তাড়াতাড়ি  ওঠো, গাড়ি ছাড়ছে |”

এইরূপে ঘোমটাবৃত অবস্থায় যোগানন্দ আর কোনোদিক দৃকপাত না করিয়া গাড়িতে উঠিলেন, গাড়ি ছাড়িয়া দিল |

ধাতস্থ হইয়া যোগানন্দ প্রথমে একবার চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন পরিস্থিতি যাচাই করিতে | দেখিলেন দরজার বাম পার্শে কামরায় দৈর্ঘ্য বরাবর বেঞ্চ, দুইটি জানালার ধারে ধারে ও দুইটি পিঠো-পিঠি কামরার কেন্দ্ররেখার দুই পার্শে | বেঞ্চ গুলি বেশ চওড়া, কিন্তু হেলান দিবার ব্যবস্থা নাই | কিছু মহিলা জানালার দিকে বসিয়া আছে | কিন্তু বেশির ভাগ মহিলাই মধ্যবর্তী বেঞ্চের এপাশে কি ওপাশে বসিয়া | জিনিষ পত্র কাহারো তেমন নাই | কেহ কেহ একটি চামড়া কি রেক্সিনের ব্যাগ হাতে রাখিয়াছে |  দরজার দক্ষিণ পার্শে আসা যাওয়ার রাস্তা ছাড়িয়া মুখোমুখি দুইটি টয়লেট | একটির বাহিরের দেয়ালে একটি আয়না ও তাহার নীচে বেসিন | অপর টয়লেটের দেয়ালে হেলান দিয়া এক মেয়েছেলে উবু হইয়া  বসিয়া আছে, পরিধানে খাটো শাড়ি, পাশে এক প্যাঁটরা | তাহার হাবভাব হইতে বোধ হইল যে সে মেথরানী | এতটা নিরীক্ষণ করিতে করিতে যোগানন্দ দেখিলেন গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়াছে ও জীর্ণ কামরা ভয়ঙ্কর ঠোকাঠুকির শব্দ করিয়া ভাল রকম দুলিতেছে | সুতরাং তিনি দরজা হইতে অগ্রসর হইয়া নিকটের মধ্যবর্তী বেঞ্চে সীট গ্রহণ করিলেন | বসিবামাত্র মেথরানী তাঁহাকে প্রশ্ন করিল, “বাবু, বাথরুম না যইবো কি ?”

এইরূপ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে যোগানন্দর সন্দেহ হইল সে প্রশ্নটি অন্য কাহাকে তো করে নাই | কিন্তু ততক্ষণ যাবত তাঁহার সমীক্ষা অনুযায়ী কামরায় তিনিই একমাত্র ‘বাবু’ | অতএব না শোনার ভান করিয়া তিনি কামরা নিরীক্ষণে গম্ভীর মনোযোগ দিলেন | দেখিলেন, যে দরজা দিয়া তিনি প্রবেশ করিয়াছিলেন তাহার উপর লেখা “মহিলা কামরা | কেবল মহিলা ও অশীতিপর পুরুষ মাত্রর জন্য | পুরুষ যাত্রীর জন্ম-তিথি প্রমাণ-পত্র লাগিবে | অন্যথায় সাজা - দুই বৎসর (মহিলা) / যাবজ্জীবন (পুরুষ) কারাদণ্ড ও ২.৫০ টাকা জরিমানা |”

তাহার নীচে আরও কিছু লেখা, কিন্তু কেহ তাহার উপর বিজ্ঞাপন সাঁটিয়া ছিল | পরে তাহা ছেঁড়া হইলেও কিছু অক্ষর দেখা যাইতেছে না | তিনি কাছে গিয়া অধ্যয়ন করিবেন ভাবিয়া উঠিয়াছেন কি, সে মেথরানী উঠিয়া আসিল | তাঁহার কানে নিম্নস্বরে কহিল, “বাবু, এলোশাড়ি লগবো না ? দিখাবো কি একটা ?”

যোগানন্দ স্তম্ভিত হইয়া নির্বাক রহিলেন | মেথরানী ছাড়িবার পাত্রী নহে | কহিল, “বাবু, কী বোলছো ? চিরা-সায়া, বাটম্ সিটেম্ | একদম বড়িয়া জীনীস্ আছে আমার কাছে |”

যোগানন্দ ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাহার দিকে তাকাইতে, তাঁহার মুখ দেখিয়া মেথরানী পিছু হটিল | তিক্ত স্বরে কহিল, “আরে ! ই তো ঘাটের মরা আছে | জয় সিয়ারাম |” তারপরে নিজ স্থানে ফিরিয়া উচ্চৈঃস্বরে স্বগতোক্তি করিল, “চেকিং আসলে ঠেলা বুঝবে আপ্নে আপ্ |”

যোগানন্দর মনে মনে প্রবালের উপর খুব রাগ হইল | একে বিনা টিকিটে মহিলা-কামরায় যাত্রা, তায় বিক্ষুব্ধ এক বদ-মতলবি মেথরানীর ঘন ঘন দুর্বোধ্য প্রশ্ন, প্রস্তাব, কিম্বা মন্তব্য | বিপদ গুনিলেন যে সমস্ত রাস্তা কাটিবে কী করিয়া | কিন্তু এও বুঝিলেন যে অবস্থা নিরুপায় - মাঝপথে আর কোথা যাইবেন |

কিছুক্ষণে গাড়ির গতি কমিল | বাঘরিয়া স্টেশন আসিল | এক প্রৌঢ়া উঠিলেন | গাড়ি ছাড়িতেই দৌড়াইয়া এক যুবক প্রবেশ করিল | উঠিয়াই (বোধহয় লক্ষ্য করিয়া যে কামরা ভর্তি মহিলা) সে ফিরিয়া নামিতে উদ্যত হইল | মেথরানী তৎক্ষণাৎ তাহাকে চক্ষের এক ইঙ্গিতে টয়লেটের দিকে কী ইশারা করিল | সে নামিতে গিয়াও নামিল না |  এদিকে প্রৌঢ়া যোগানন্দর কাছে আসিয়া তাঁহার দিকে চাহিলেন | তারপর পার্শে আসন গ্রহণ করিয়া ব্যাগ হইতে চশমা বাহির করিয়া চোখে লাগাইলেন | যোগানন্দকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া প্রৌঢ়া এক গাল হাসিয়া কহিলেন, “নূতন বুঝি, দাদা ?” যোগানন্দ নিরুত্তর থাকিলেও তিনি বার্তালাপ বজায় রাখিলেন, “এলোশাড়ি নেই যে ?” যোগানন্দর নীরব মাথা নাড়া দেখিয়া মন্তব্য করিলেন, “তা যা গরম | সবাই একদম পসীনা পসীনা হচ্ছে |”

যোগানন্দ সম্মতির হাসি হাসিয়া, ও মাথা নাড়িয়া, মুখ ঘুরাইলেন | দেখিলেন টয়লেট হইতে এক তন্বী যুবতী বাহির হইল | শাড়ির কোঁচা ঝাড়িতে ঝাড়িতে সে আসিয়া প্রৌঢ়ার পাশে বসিল | প্রৌঢ়ার ধ্যান যুবতী আকর্ষণ করিলে যোগানন্দ মুক্তির আনন্দ অনুভব করিলেন |

এই শুভ মুহূর্তে যোগানন্দর স্মরণে আসিল তাঁহার ডাক্তারের এক বক্তব্য – ‘চিন্তা-বিশ্লেষণ ও মানসিক অনুশীলন দ্বারা মস্তিষ্কে জরার অগ্রগতি রোধ করা যায় |’ বাড়িতে যাহার বিশেষ সুযোগ মেলেনা, তাহারই পরিমিত অবসর ও অপরিমিত সুযোগ তিনি তাঁহার বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখিতে পাইলেন | যদিও কামরায় দেখিবার বিশেষ কিছু নাই, তবু অনুজ্জ্বল আলোতে যাহা দেখা গেল তিনি তাহারই বিশ্লেষণ করিতে মনোযোগ দিলেন |

যোগানন্দ লক্ষ্য করিলেন যে কামরায় দুই প্রকারের মহিলা যাত্রী আছে | যাহারা জানালার ধারে বেঞ্চে বসিয়া, তাহারা কিঞ্চিত বেপরোয়া ও চটুল | মাথায় ঘোমটা নাই, হওয়ায় চুল উড়িতেছে, শরীরের বস্ত্র শিথিল ও এলোমেলো | একে অপরের সহিত হালকা গল্প গুজব ও হাসি মস্করা করিতেছে | কিন্তু যে মহিলারা কামরার মধ্যবর্তী বেঞ্চে বসিয়া, তাহারা অপেক্ষাকৃত গম্ভীর ও পর্দানশীন | পরনে ফুল-হাত ব্লাউজ | সকলেরই মাথায় ঘোমটা | ঘোমটা কাহারো আলগা আবার কাহারো তাহার ভিতর মুখ প্রায় সম্পূর্ণ ঢাকা, খালি নাক দেখা যাইতেছে | যাহাদের ঘোমটা আলগা তাহারা অবিবাহিতা | অন্যদের কখনো ঘাম মুছিতে ঘোমটা সরাইলে দেখা যাইতেছে সিঁথি বিহীন কেশ সজ্জা | জানালা দিয়া পবন-দেব হানা দিলেও জুনের সেই গরম হাওয়ায় প্রচুর পরিমাণে তাঁহার ঘামের আর্দ্রতা | তাহার প্রভাবে প্রায় সকলেরই নাকের উপর বিন্দু বিন্দু জল টসটস করিতেছে | তবু শান্ত অবিচলিত ভাবে সকলেই কোলের উপর হাত জোড়া করিয়া যেন ধ্যান করিতেছে | কাহারো কথা বলিবার প্রবৃত্তি দেখিলেন না | আর লক্ষণীয় যে সকলেরই পা পাদুকা-হীন | চিনিতে মুস্কিল হয়না সে এই সব কুমারীরা এলেশ্বরী-ভক্ত, দিনভর পূজা দিয়া ফিরিতেছে | যোগানন্দ স্থির করিলেন পুনরায় বাঁশবেড়ে আসিলে তিনি যোগমায়াকে সাথে লইয়া এলেশ্বরী দর্শনে যাইবেন (যদি এ যাত্রা বাকী পথ নির্বিঘ্নে কাটে) |

পরের স্টেশন জামবাটি আসিলে এক পসারিণী উঠিল | তাহার চক্ষে কালো চশমা | গলায় ঝুলানো ঝুড়ি, তাহার উপর এক নামের ফলক, যাহাতে লেখা “শশী খান” | সে উঠিয়া বার বার উচ্চস্বরে নিজের নাম ঘোষণা করিতে লাগিল | এক দুজন করিয়া মহিলারা, ও যোগানন্দর প্রতিবেশী প্রৌঢ়া তাহার কাছ হইতে শসার মতো দেখিতে এক ফল কিনিয়া খোসা সমেত খাইতে লাগিলেন | কেন যেন অদ্ভুত এক প্রশ্ন যোগানন্দর মনে আসিল, ‘শশী কি শসার স্ত্রীলিঙ্গ ? বাড়িতে গিয়ে অভিধান দেখতে হবে |’ সে প্রৌঢ়া যেন তাঁহার মনের কথা বুঝিয়া তাঁহাকে কহিলেন, “দাদা খাবেন না শশী ? খান | একদম কচি আছে | এ শুধু এলেশ্বরী তে পাবেন |”

দেনাবাটি আসিলে শশী খান নামিয়া গেল | কোনও যাত্রীর আগমন কি নির্গমন হইল না | উঠিল এক ঝাল-মুড়ি ওয়ালী | সে উঠিয়াই ঝাল-মুড়ির কৌটা ঘাঁটিতে লাগিলে তাহা হইতে এক ভয়ঙ্কর খর-খর শব্দ শোনা গেল | মুড়ি তাজা ভাবিয়া উৎসুক হইয়া যোগানন্দ তাহাকে ডাকিয়া ঝাল-মুড়ি লইলেন | কিন্তু তাহা মুখে দিতেই ফেলিবার উপক্রম হইল | একে ভীষণ ঝাল – সে ঠিক আছে | কিন্তু মুড়ি তো নয় যেন কঙ্কর | তিনি থু থু করিয়া ফেলিয়া মুড়ি ওয়ালীকে প্রশ্ন করিলেন, “এ কী ?”
মুড়ি-ওয়ালী – “কেন, ঝাল চাল-ভাজা |”
যোগানন্দ – “মুড়ির বদলে চাল-ভাজা ?”
মুড়ি-ওয়ালী – “হ্যাঁ গো | এ মেয়ে-গাড়িতে তো তাই চলে | একটু আঁচার দেবো ?”
যোগানন্দর কাছে একটি সিকি ছিল | তাহা গেল |

ততক্ষণে যোগানন্দর বাথরুম পাইয়াছে | তিনি উঠিতেই মেথরানী নড়িয়া বসিল, যেন তাঁহার টয়লেট যাত্রার প্রতীক্ষায় ছিল | যোগানন্দর এমন মনে হইল যেন সে পা বিছাইল, তাঁহার পথ আটকাইতে | তাহার পাশ কাটাইয়া যাইতে যাইতে যোগানন্দ দেখিলেন মেথরানীর প্রসারিত পা খুবই লোমশ ও শক্তপোক্ত পুরুষ মানুষের মতো |  সে নিম্নস্বরে কহিল, “বাবু আমিও আসি ? ধরে পরিয়ে দিব |” তিনি এ অসভ্য প্রস্তাব শুনিতে না পাওয়ার ভান করিয়া ত্রস্ত গতিতে টয়লেটে ঢুকিয়া ছিটকিনি লাগাইলেন |

কিন্তু বাথরুম করা মাথায় উঠিল | ভিতরের দৃশ্যে তিনি হতভম্ব | বন্ধ দরজার উপর দড়ি দিয়া ঝোলান ক্ষতবিক্ষত এক আপাদমস্তক দেখিবার আয়না | তাহার দুই পার্শে দুই প্লাস্টিকের থলি ঝুলানো | একটিতে বেশ কিছু নানান সাইজের নারিকেলের মালা | অন্যটিতে কিছু জীর্ণ বিবর্ণ স্ত্রীলোকের অন্তর্বাস - নানান রঙের | সাবান রাখার তাকের উপর এক নিষ্প্রভ লাল লিপস্টিক | ছিপি খোলা এক ‘অগুরু’ সেন্টের শিশি গন্ধ ছড়াইতেছে, যাহার সহিত আর এক তীব্র গন্ধ মিশিয়া নরকের কুণ্ডের পরিবেশ সৃষ্টি করিয়াছে | গভীর এক ঘ্রাণ লইয়াই যোগানন্দ চিনিতে পারিলেন যে তাহা কারণের গন্ধ | মনে পড়িল মেথরানী যখন তাঁহার কানে কানে কথা বলিয়াছিল সেই একই গন্ধ পাইয়াছিলেন |  কোনোমতে কাজ সারিয়া ধুতির কোঁচায় ঘোমটা দিয়া তিনি বাহির হইলেন, ও মেথরানী আক্রমণ করিবার পূর্বে দ্রুত গতিতে নিজের আসনে ফিরিলেন | শঙ্কা হইল তাঁহার লাল কর্ণমূল দেখিয়া যদি কেহ ভাবে যে তিনি কানে  লিপস্টিক লাগাইয়াছেন |

খাড়াজুরি আসিলে এক পসারিণী উঠিয়া তাহার পসরা সাজাইয়া বসিল | হরেক রকমের পুতুল, ছোট ছোট হাঁড়ি, কড়াই, ঘটি, বাটি ও অন্যান্য মেয়েলি খেলনা | খেলনায় যোগানন্দর বিশেষ কৌতূহল | তিনি পসরা দেখিতেছেন কি পসারিণী এক বার্বি ডল দেখাইয়া তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল | কহিল, “দিদি, নেবে নাকি ? হাওড়ায় তৈরি | দাম মাত্র সাত টাকা | এত সস্তা এই এলেশ্বরীতেই পাবে | সাথে একে জোড়া ম্যাচিং এলোশাড়ি আছে |” পাশের প্রৌঢ়া কহিলেন, “ছ’টাকায় দেবে ?” শেষে অনেক দরাদরির পর সাড়ে ছ’টাকায় কথা পাকা হইল | ততক্ষণে যোগানন্দ বুঝিয়াছেন যে পসারিণী ট্যারা | পুতুল বেচা কেনার লজ্জা ও দরদাম হইতে তিনি নিস্তার পাইলেন | পুত্রের জন্য তাহার মামার মোটর গাড়ির মতো খেলনা পাইবার ইচ্ছা দমন করিতে হইল |

খাড়াজুরির পর আসিল মেদপুর |  সেখানে উঠিল আর এক পসারিণী, সাথে বিস্তর পুস্তক | এক মহিলা তাহাকে শুধাইল, “আমার বউয়ের জন্য সেলাই এর বই চাই | সেরকম কিছু আছে ?” বিক্রেতা মাথা হেলাইয়া বেঞ্চের উপর বইয়ের বোঝা নামাইল |

“আমার বউ” শুনিয়া যোগানন্দ আশ্চর্য হইয়াছেন কি মহিলা তাঁহার সন্দেহ অনুমান করিয়া মূক দর্শক প্রতিবেশীদের ব্যাখ্যা দিল, “মানে আমার ছেলের বউ, বাড়ির সব সেলাই ওই করে |” তাহাকে বিক্রেতা ‘পারিবারিক সেলাই-ফোঁড়াই’ নামক এক বই দিল | যোগানন্দ তাহাকে ডাকিয়া বই দেখাইতে কহিলেন | সে দেখাইল ‘আমের আচার-বিচার’, ‘স্ত্রী-ভাগ্য কী দুর্ভাগ্য’, ‘প্রেম-রাগ বনাম গলায় দড়ি’, ‘ধাত্রী বিদ্যায় হাতে-খড়ি’, ‘উল বোনার বর্ণ পরিচয়’, ‘সংসার রণ - টুকিটাকি নিয়ে ঠোকাঠুকি’, ইত্যাদি | যোগানন্দ তাহাকে প্রশ্ন করিলেন কোনও ম্যাগাজিন আছে কিনা | সে দেখাইল ‘মিস ইন্ডিয়া’, ‘নারীর প্রসাধন’, ‘মেয়েদের আসর’, ‘প্রেম-শৃঙ্গার’ ইত্যাদি | যোগানন্দর নিরাশ চেহারা দেখিয়া সে বিব্রত হইয়া কহিল, “বাবু, এলেশ্বরীতে এই সবই চলে, তাই আর কিছু রাখি না |”

মেদপুর ছাড়িয়া গাড়ি একটু গতি লইয়াছে কি হটাত কামরার বাতি নিভিয়া গেল | আতঙ্কিত হইয়া যোগানন্দর মুখ হইতে শব্দ বাহির হইল, “সর্বনাশ |” পার্শ্ববর্তী প্রৌঢ়া কহিলেন, “চিন্তা নেই, চেঞ্জ-ওভার হচ্ছে | এখুনি বাতি এসে যাবে |” সত্যই তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে কামরার বাতি জ্বলিল | অনিচ্ছাসত্ত্বেও অজ্ঞতা দূর করিতে যোগানন্দ জানিতে চাহিলেন ঘটনা টা কী | প্রৌঢ়া ব্যাখ্যা দিলেন যে সেখানে ডিভিসি’র বিদ্যুৎ সরবরাহ শেষ হইল ও সিএসসি’র শুরু | যেখানেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ঐরূপ এক হইতে অপরে পরিবর্তিত হয়, মাঝখানে কিছু দূর ওভারহেডে বিদ্যুৎ থাকে না | ইঞ্জিন বিদ্যুৎ না পাওয়ায় কামরার বাতি যায়, কেননা কামরার ব্যাটারি মরিয়া গিয়াছে | যোগানন্দ মনে মনে প্রমাদ গুনিলেন যে সেই সময় যদি মেথরানী অন্তরঙ্গ হইবার প্রয়াসে আক্রমণ করে তো ... প্রৌঢ়ার ভরসায় শক্ত হস্তে সে চিন্তা দূর করিলেন | তাঁহার মনে প্রৌঢ়ার অসীম জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা হইল | অদম্য করমর্দনের ইচ্ছায় তিনি প্রৌঢ়ার হাতের দিকে হাত বাড়াইলেন | নজরে পড়িল প্রৌঢ়ার কোলে রাখা হাতের নীচে এক ব্যাগ, যাহাতে লেখা ‘শঙ্কর কে প্রসাদ’ | প্রৌঢ়া যোগানন্দর দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া ব্যাগ উঠাইয়া মাথায় ঠেকাইলেন ও কহিলেন, “শঙ্কর জী আমার ইষ্ট দেওতা আছেন, ব্যাগে তাহার প্রসাদ আছে |”

তখনি যোগানন্দ লক্ষ্য করিলেন প্রৌঢ়ার পার্শ্ববর্তী যুবতী নাই | সে তো এইমাত্র ছিল | গেল সে কোথায় - অন্ধকারের অন্তরালে অদৃশ্য হইল কি ?  আচমকা লজ্জা অনুভব করিয়া – তন্বী যুবতীর আকর্ষণ ... যোগমায়া জানিলে কী ভাবিবে – তিনি এই চিন্তাধারায় লাগাম লাগাইলেন |

মাঠপাড়া আসিল, শিয়ালদহের পূর্বে শেষ স্টেশন | ট্রেন থামিলে বাঘরিয়ার সেই দ্বিধাগ্রস্ত যুবক রুমালে রক্তাভ লাল ঠোঁট মুছিতে মুছিতে টয়লেটে হইতে সট করিয়া বাহির হইল | বিদ্যুৎ বেগে প্ল্যাটফর্মের বিপরীত দিকের দরজা দিয়া ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করিয়া অন্ধকারে নামিয়া অদৃশ্য হইল | তখন যোগানন্দ লক্ষ্য করিলেন যে সে দরজার পাল্লা নাই | দরজার ফোকরের উপরে কাঁচা হাতে কেহ লিখিয়াছে:- “সংকট-কালীন দ্বার | ঝাঁপানর পূর্বে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি করুন |”

ইতিমধ্যে প্ল্যাটফর্ম হইতে এক অতি খর্বকায় নাদুস-নুদুস কালো কোট পরিহিতা মহিলা প্রবেশ করিল | তাহার মাথায় বব-কাট চুল, সিঁথি সিন্দুরবিহীন | সে টিকিট চেকিং করিতে লাগিলে যোগানন্দ যথাসম্ভব নিম্ন কণ্ঠে প্রৌঢ়াকে কহিলাম, “আমার যে টিকিট নেই, কী করি ?”
প্রৌঢ়া – “এজ-প্রুফ ?”
যোগানন্দ – “না তাও নেই |”
প্রৌঢ়া - “ইমার্জেন্সি নোট আছে ? বের করিয়ে রাখুন দু-পাঁচ টাকা |”
যোগানন্দ – “ইমার্জেন্সি নোট আবার কী ? আমার কাছে দুটো দশ টাকার নোট আছে মাত্র |”
প্রৌঢ়া – “দিন দেখি সেগুলো আমাকে |”
যোগানন্দ তাহাকে নোট দুইটি দিলে তিনি তাহার পরিবর্তে প্রসাদের ব্যাগ হইতে কড়কড়ে দশটি লাল দুই টাকার নোট বাহির করিলেন | বাতির দিকে একটি ধরিয়া যোগানন্দ কে দেখাইলেন যে তাহার জলছাপে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ছবি | কহিলেন, “ইমার্জেন্সিতে এলেশ্বরীতে এটাই চলে – টিটি থেকে হকার সবাই নেয় | রেখে দিন, কাজে আসবে |”

টিটিই আসিলে যোগানন্দ চুপচাপ দুইটি ইমার্জেন্সি নোট দিলেন – বিনা-টিকিট ও বিনা এজ-প্রুফ  যাত্রার ডবল ইমার্জেন্সির জন্য | টিটিই তাহা হাতে লইয়া ভাঁজ করিয়াছে কি, এক কৌতূহলী ঝিঁঝিঁ পোকা সবার অলক্ষ্যে আসিয়া টাকার উপর বসিল | টাকা সমেত সে ব্লাউজের ভিতর পাচার হইতেই  “এই মরেছে | পোকা ঢুকেছে রে” বলিয়া টিটিই চিৎকার করিয়া আঁচল ফেলিয়া পটাপট ব্লাউজের বোতাম খুলিয়া ফেলিল | সংকোচিত যোগানন্দ মুখ ঘুরাইলেও, তাঁহার নিঃসংকোচ চোখ (তাঁহার অজ্ঞাতে) আড়চোখে কী পোকা তাহা দেখিতে চাহিল | এক মুহূর্তের জন্য তিনি দেখিতে পাইলেন যে টিটিই’র ভিতরের পরিধান এক অতি ম্লান গেঞ্জি | তাহার উপর ডাক্তারের স্থেথস্কোপের মতো আলগা ভাবে ঝুলিতেছে এক কাল অন্তর্বাস | কাঁধে পৈতা দেখা যাইতেছে | আর গেঞ্জির উপর দিয়া উঁকি মারিতেছে বুকের পাক ধরা চুল | সেই চুলে আটকা পড়িয়াছে অনভিজ্ঞ এক ঝিঁঝিঁ পোকা | অকস্মাৎ আবিষ্কৃত এই পোকাটি অপ্রত্যাশিত ভাবে পলায়ন-পথ খোলা পাইয়া ফরা‍‌ৎ করিয়া লম্ফ দিল | টিটিই বুক আঁচলে ঢাকিয়া তীর বেগে টয়লেটের দিকে অগ্রসর হইলে মেথরানী তটস্থ হইয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে স্যালুট করিয়া টয়লেটের দরজা খুলিয়া দিল | যোগানন্দ যুগপৎ এতগুলি ইমার্জেন্সি কখনো দেখেন নাই |

কিছুক্ষণ পরে গাড়ির গতি কমিতে লাগিল | মেথরানী  উঠিল, ও মধ্যবর্তী বেঞ্চগুলিতে বসা সব মহিলাদের সামনে হাত পাতিল | দেখা গেল কেহ তাহাতে এক সিকি রাখিল, কেহ বা আট আনা কি টাকা রাখিয়া কিছু সিকি উঠাইয়া লইল | মেথরানী সিক্কা-চয়ন শেষ করিয়া নিজের জায়গায় ফিরিয়া পয়সা গুনিল | গোনা শেষ হইলে সে শাড়ি উঠাইয়া ভিতরে এক ডোরাকাটা খাটো পাজামার পকেটে পয়সা রাখিয়া বসিয়া পড়িল | তারপর হাতে খৈনি লইয়া মর্দন করিতে লাগিল |

আবার হটাত গাড়ির বাতি চলিয়া গেল ও ঘ্যাঁচ করিয়া গাড়ি দাঁড়াইল | সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার কামরায় কোলাহল শুরু হইল | যোগানন্দ অন্ধকারে তীব্রতর শ্রবণশক্তির বলে শুনিলেন  অদ্ভুত সব কথা বার্তা |
-    “ধুত্তোর জুতো জোড়া গেল কোথায় ?”
-    “আরে সায়ার দড়িতে যে গিঁট লেগে গেছে | ডালিম একটু টর্চের বাতিটা ধর না |”
-    “কী করে ধরব ? টর্চের তো ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে |”
-    “আ মোলো | এ কী, ব্লাউজের বোতাম কোথায় আঁটকে ? একটু দেখ না বুলু |”
-    “দাঁড়া দাঁড়া | আমার জামার বোতাম এলোশাড়ির ঘাটে আঁটকে গেছে মনে হচ্ছে |”
-    “আরে আরে | আমার হাতায় কে হাত ঢোকাচ্ছে ?”
-    “ও হো | শাড়ির উপর কে দাঁড়ালো রে বাবা ?”

কিন্তু ক্রমে ক্রমে কোলাহল শান্ত হইল | কিছু ঘুঙুরের আলগা ঝংকার শোনা গেল | কিছু জিনিস প্রচুর সংখ্যায় খট খট শব্দে মাটিতে পড়িয়া গড়াইতে গড়াইতে থামিল | শেষে ধুপধাপ শব্দ করিয়া বেশ কিছু যাত্রী অন্ধকারে নামিয়া গেল | প্রৌঢ়া যোগানন্দর হাতে হাত রাখিয়া কহিলেন, “দাদা, আপনি নামবেন না ?” বেশ কর্কশ সে হাতের স্পর্শে তাঁহার এক শিহরণ হইল; সন্দেহ হইল, এ কি স্ত্রীলোকের হাত ?

বাহির হইতে এক আরপিএফ জওয়ান গাড়ির ভিতর টর্চের আলো ফেলিয়া কহিল, “এ বুধবারী , আজ শিয়ালদা মে চেকিং ভইল |”
মেথরানী কহিল, “ক্যা করি | এক বাবু হ্যাঁয় | কছু বাত সুনত্ নহি |”

তারপর বাহিরে এক বাঁশি বাজিল ও গাড়ি ছড়িয়া দিল | বাতিও জ্বলিল | যোগানন্দ দেখিলেন মাঝের বেঞ্চি দুইটি খালি | যেখানে যেখানে যাত্রী বসিয়া ছিল সেখানে সেখানে অবিন্যস্ত এক এক শাড়ি আলগোছে রাখা | কাহারো নীচ হইতে অন্তর্বাস উঁকি মারিতেছে | আর মেঝেতে প্রচুর নারিকেলের মালা গড়াগড়ি দিতেছে | মেথরানী ঘুরিয়া ঘুরিয়া সব সংগ্রহ করিয়া শাড়ি গুলি তাহার প্যাঁটরা খুলিয়া সযত্নে ভাঁজ করিয়া রাখিল | বাকী জিনিস সে টয়লেটে লইয়া গেল |

তারপর মেথরানী যোগানন্দর সামনে আসিয়া অতি নম্র ভাবে কহিল, “বাবু ইমার্জেন্সি আছে, সো এলোশাড়ি একটা লিয়ে লাও | সির্ফ ছ রূপিয়া |  দেখো এ দিদিও তো পিনিয়েছেন | খরাব আছে কি ?“

অগত্যা যোগানন্দ মেথরানীকে তিনটি ইমার্জেন্সি নোট দিলেন | প্রৌঢ়া তাহাকে কহিলেন, “বুধবারী, নারিয়াল, বডিস্ বগৈরা ন ডালো | বাবু বুড়া ছে | উপর সে মাস্ নইখে |”

বুধবারী এলোশাড়ি লইয়া আসিলে যোগানন্দ দেখিলেন তাহা এক মুখ-খোলা লুঙ্গির মতো | প্রথম প্রান্তে বোতাম লাগানো ও দ্বিতীয় প্রান্তে বোতাম-ঘাট | সেই বোতাম-ঘাট ঢাকিয়া শাড়ির কুঁচি | আর পিছন হইতে আলাদা সেলাই করা আঁচল উঠিয়া আসিয়াছে | আঁচলের মাঝে এক ব্লাউজ লাগানো আছে, যাহার পিঠে বোতামের ব্যবস্থা |  এই অদ্ভুত পরিধানের ভিতর আলাদা কাপড়ের আস্তর, যাহা সায়ার কাজ করিবে | কোমরের ভিতর বাঁধার জন্য দড়ি আছে ও তাহার দুই প্রান্তে দুই ঘুঙুর | যোগানন্দ বুঝিতে পারিলেন “চিরা-সায়া, বাটম্ সিটেম্ ” ইত্যাদি ব্যবস্থার যথার্থতা | ইহাও আন্দাজ করিলেন যে ঘুঙুর দ্বারা অন্ধকারে দড়ির প্রান্ত খুঁজিতে সুবিধা হইবে |

বুধবারী বড়ই যত্নে তাঁহাকে এলোশাড়ি পরাইয়া দিল | প্রথমে ব্লাউজের হাতা গলাইয়া পিঠের বোতাম লাগাইল | তারপরে কোমরের দড়ি দিয়া এলোশাড়ি বাঁধিয়া আঁচল সামলাইয়া দিল | শেষে যোগানন্দকে সিটে বসাইয়া তাঁহার মাথায় ঘোমটা দিয়া দিল | প্রৌঢ়া হাসিয়া কহিলেন, “দেখ্ বুধবারী, নজর না লগ্ যায় |”

নজর লাগিল শিয়ালদহে পৌঁছাইয়া | গাড়ি থামিলেই প্ল্যাটফর্মে মাতামাতি | কামরার সম্মুখ ঘিরিয়া খাকি-বাহন | তাহাদের সর্দার দুই সেনা লইয়া কামরায় প্রবেশ করিল | এক সেনা প্ল্যাটফর্মের দিকের দরজা আগলাইয়া দাঁড়াইল | অন্যটি  সংকট-কালীন দ্বার আটকাইবার পূর্বেই বুধবারী বগলে আয়না, এক হাতে প্যাঁটরা ও অন্য হাতে দুই প্লাস্টিকের ঝোলা লইয়া সেই দরজা দিয়া ‘জয় বাংলা’ কহিয়া ঝাঁপ দিল | সর্দার মাঝের বেঞ্চের দুই যাত্রীর সামনে আসিয়া বেটন দিয়া এক এক করিয়া অবগুণ্ঠন উঠাইয়া মুখ দেখিল | প্রৌঢ়া “আমার মাসিক আছে” কহিয়া এক কাগজ দেখাইলেন | তাহাকে ছাড়িয়া সর্দার যোগানন্দর সামনে নিঃশব্দে হাত পাতিল | প্রৌঢ়ার ইশারায় যোগানন্দ তাহার হস্তে দুইটি ইমার্জেন্সি নোট দিলেন | ‘বাকী থাকল তিনটে’, যোগানন্দ মনে মনে হিসাব করিলেন |

সর্দার সেনা লইয়া প্রস্থান করিলে সব যাত্রী গাড়ি হইতে নামিল | প্রৌঢ়া তাঁহাকে লইয়া ওয়েটিং রুমে গেলেন | সেখানে এক ইমার্জেন্সি নোট গেল বাথরুম ব্যবহার করিয়া এলোশাড়ি ছাড়িতে | তারপর আলাপ পরিচয় সম্পন্ন করিয়া শঙ্কর কুমার প্রসাদ বিদায় লইলেন - তিনি যাইবেন রেলের বিদ্যুৎ বিভাগে কিছু কাজের বিল দিতে | যোগানন্দ বাবু স্ট্যান্ড হইতে ট্যাক্সি লইয়া বাড়ি গেলেন | শেষ দুইটি ইমার্জেন্সি নোট গেল ট্যাক্সি-ভাড়ায় |

যোগমায়া এলোশাড়ি পাইয়া যারপরনাই খুশি হইলেন | তাহা বুকের সহিত সংলগ্ন করিয়া গদগদ কণ্ঠে কিছু বলিবেন কি হটাত তাঁহার মুখ কালো হইয়া গেল | শাড়ি মাটিতে ফেলিয়া দাপটের সহিত কামরা হইতে প্রস্থান করিলেন | যোগানন্দ ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া শাড়িটি উঠাইয়া যত্নের সহিত আলমারিতে রাখিয়া দিলেন ভবিষ্যতের জন্য |


উপসংহার

মাস কয় পর ত্রিলোক বাবু আসিলেন জামাতা দর্শনে, গোপনে এক বগলা-মুখী বশীকরণ কবচ সাথে লইয়া | যোগমায়া তাঁহাকে গুপ্ত চিঠি মারফৎ জানাইয়াছিলেন যে তাঁহার জামাতা বোধহয় অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হইয়াছেন | কারণ তিনি বাঁশবেড়ে ফেরত এক ব্যবহৃত শাড়ি যোগমায়াকে আনিয়া দিয়াছেন, যাহাতে অগুরু সেন্টের গন্ধ ছিল |

ত্রিলোক বাবু আসিলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্ধি হইল, ও এক দুই দিন ভালই কাটিল | তাঁহার ফিরিবার দিন, সকাল বেলায় শ্বশুর ও জামাতা দোতলার বারান্দায় চা পান করিতেছে | শরতের বাতাসে আসন্ন পূজার আভাস, ও নীচে হইতে আসা মাছ ভাজার গন্ধ |  কিঞ্চিত উসখুস করিয়া যোগানন্দ নিজেকে শ্বশুরালয়ে নিমন্ত্রণ করিলেন, “বাবা অনেক দিনে থেকে ভাবছি যোগমায়াকে নিয়ে আপনার ওখানে আসবো, একটু এলেশ্বরীর মন্দিরে যাব |
ত্রিলোক – “এলেশ্বরী মন্দির ? সে আবার কোথায় ?”
যোগানন্দ - “ওই যে, যেখান থেকে এলেশ্বরী ফাস্ট লোকাল ছাড়ে |”

ত্রিলোক বাবু হটাত হোহো করিয়া এমন হাসিলেন যে তাহার বিস্কুট চায়ে পড়িয়া গেল | হাসি থামিলে কহিলেন, “ও তুমি এলেশ্বরীর ব্যাপারটা জানো না বুঝি |”

মনোযোগ সহকারে ত্রিলোক বাবু একটি বিড়ি জ্বালাইয়া খান দুই গভীর টান দিলেন | তারপর এই বৃত্তান্ত শুনাইলেন:

“তাহলে শোনো |”
“এলেশ্বরী কোনও দেব-দেবী নয় |
“বাঁশবেড়ে থেকে শিয়ালদা’র উল্টো দিকে গেলে এক কিমি মতো দূরে এক রেলওয়ে হল্ট আছে, যেখান থেকে এলেশ্বরী ফাস্ট লোকালটা ছাড়ে | এক কালে হল্টটার নাম ছিল বাঁশতোলা হল্ট | একটা সাইডিং ছিল বাঁশ লোড্ করার জন্য |
“সেখানে যে মেয়ে লোডাররা কাজ করতো তাদের লেখাপড়া শেখাতে এক পাদ্রি আসতেন কিছু নান্ নিয়ে | নানেদের সুবিধার জন্য লেডিজ স্পেশাল গাড়ি চেয়ে তিনি রেলে কর্তৃপক্ষকে এক আবেদন-পত্র দিলেন | তা, ওই কটা নানের জন্য লেডিজ স্পেশাল হবে কোথা থেকে ? খুঁজেপেতে পাদ্রি আমাদের বাঁশবেড়ের তখনকার স্টেশন-মাস্টার টমাস সাহেব কে ধরলেন | বাঁশতোলার সাইডিঙে একটা পুরানো মেডিকেল ভ্যান পড়ে ছিল | টমাস সাহেব ওটাকে ঝাড়ামোছা করে জুড়ে দিলে এক মাল গাড়িতে | সকালে শিয়ালদহ থেকে আসত, আর বিকেলে ফিরে যেত | একটাই স্টপ ছিল, আমাদের বাঁশবেড়েতে |
“কিন্তু  কিছু অবাধ্য পুরুষ মানুষ উঠতে লাগলে সেই কামরায় | টমাস সাহেবের এক কাজ হয়ে দাঁড়ালো গাড়ি থেকে লোক খেদানো | পুরুষ যাত্রী দেখলেই তাকে আটকাতে টমাস সাহেব হাতজোড় করে বলত, “লেডিজ স্পেশাল, সরি |” সে কামরার দরজার উপর ইংরেজিতে লেখাল এল. এস.  ...  মানে লেডিজ স্পেশাল আর কি | পরে টমাস সাহেব রিটায়ার করলে সমস্যা আবার যে কে সেই | তখন সমাধান করতে এলো এক এংলো টিটিই | ডেসমন্ড নাম তার, বদমেজাজি, কম কথার মানুষ |  সে শিয়ালদা’র আগে আউটারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে পুরুষ যাত্রীদের ধরে ধরে ফাইন করতে লাগল | কেউ কিছু আপত্তি করলে শুধু বলত, “এল এস | সরি !” সুতরাং আউটারে গাড়ি দাঁড়ালে লোকে নেমে পড়ে পালাত | সেই থেকে লোকমুখে সেটা হয়ে দাঁড়ালো এলেশ্বরী স্টপ | গাড়ির ডাকনাম হল এলেশ্বরী ফাস্ট লোকাল | তখন একটাই স্টপ ছিল বাঁশবেড়েতে | এখন তো গাড়িটা সব স্টেশনই ধরে | পরে ওই ঘনি খান চৌধুরী ব্যাটা এসে বাঁশতোলার নাম বদলে করলো এলেশ্বরী |”
“এবার বুঝেছ. এলেশ্বরীর মর্ম ?”

গল্প শেষ করিয়া ত্রিলোক বাবু সন্তর্পণে কাপ হইতে বিগলিত বিস্কুটটি জিভ দিয়া টানিয়া সেবন করিলেন | চায়ে চুমুক দিয়া তৃপ্তিসূচক শব্দ করিয়া প্রশ্ন করিলেন, “তোমাকে বুঝি গাড়িতে এলোশাড়ি কিনতে হয়েছিল ?”
যোগানন্দ – “হ্যাঁ বাবা |”

কিছুক্ষণ চুপ থাকিয়া যোগানন্দ পাল্টা শুধাইলেন, “বাবা, এলোশাড়ি নামটার ব্যুৎপত্তি কী ?”
ত্রিলোক বাবু মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “ঠিক জানিনা | তবে শুনেছি, বাঁশবেড়ে স্টেশনে এক মেথর ছিল বুধুয়া নামে | সে ছাপরা গেলে কোনও মন্দির থেকে দানে দেয়া বিহারিদের পুজোর হলুদ শাড়ি সস্তায় কিনে এনে স্টেশনে বেচত | ইমার্জেন্সি তে কাউকে এলেশ্বরী ধরতে হলে সে সেই শাড়ি পড়ে এলেশ্বরীতে উঠে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকত | ধর্মের ব্যাপার বলে কথা | কিন্তু ডেসমন্ড সেটা ধরে ফেললে একদিন | তারপর হলুদ শাড়ি দেখলেই চ্যাঁচাত “ইয়েলো শাড়ি !” সেই থেকে বোধ হয় এলোশাড়ি কথাটা এসেছে | শুনেছি এলোশাড়ি পরা যাত্রীরা গাড়ির মাঝের বেঞ্চে বসতো যাতে জানালা দিয়ে ডেসমন্ড আসছে দেখে সময়ে পালাতে পারে |”
যোগানন্দ – “বাবা, বুধুয়া কি এখনো আছে ?”
ত্রিলোক বাবু – “শুনেছি ডেসমন্ড এর দাপটে তার শাড়ির ব্যবসা চুলোয় উঠলে সে বাঁশবেড়ে স্টেশনের কাজ ছেড়ে দিয়েছিল  | তারপর তো এক মেথরানী এলেশ্বরী তে শাড়ি ভাড়া খাটাতে লাগলো | বুধুয়া কোথায় গেল  কে জানে |”

দ্বিপ্রহরের ভোজনের সময় যোগমায়া নিজেই পরিবেশন করিলেন | তাহার চিত্ত বড়ই প্রফুল্ল | ত্রিলোক বাবু তাহাকে কহিলেন, “তোর ধনে-পাতা দিয়ে মাছের ঝোলটা খুব ভালো হয়েছে |”
যোগমায়া – “বাপরে, সে কী কাণ্ড | ঝোল বসিয়ে দেখি ধনে-পাতা নেই | অমনি গাউন খুলে চট করে তোমার আনা এলোশাড়িটা জড়িয়ে ছুটলাম | ধনে-পাতা কিনে শাড়ি ছেড়ে গাউন পরে রান্নাঘরে গিয়ে মাছে দিয়ে নামালাম – কত সময় লাগল জানো ?”
ত্রিলোক বাবু – “কতক্ষণ ?”
যোগমায়া – “স্রেফ পাঁচ মিনিট | বাবা, তোমার আনা এলোশাড়িটা খুব ভালো | খুব কাজের হয়েছে |”
ত্রিলোক – “বেশ বেশ | তোর ভালো লাগলেই ভালো |
“তা, তোকে বলিনি, আসলে আমার উইলে তো লিখি নি, তাই কথাটা গোপন রেখেছিলাম | যোগানন্দ যে এলোশাড়িটা তোকে এনে দিয়েছিল, সেটা তোর মায়ের জন্য কিনেছিলাম রে | ফুল-হাতায় গরম লাগত বলে সে কোনোদিন শাড়িটা পরলও না | তারপর তো সে চলেই গেল সব ছেড়ে |”

ত্রিলোক বাবু কপটশ্রু মোচন করিলেন | যোগমায়া তাঁহার কাঁধে হাত দিয়া কহিলেন, “বাবা কেঁদো না |”
ত্রিলোক বাবু - “প্রবাল জেদ ধরে ছিল ওই শাড়ি ও নেবে ওর বউ এর জন্য | আমি তাই চুপি চুপি যোগানন্দর হাতে পাঠিয়ে দিলেম | তোরঙ্গে রেখে কেমন ছাতা-পড়া গন্ধ হয়েছিল তাই একটু অগুরু সেন্ট লাগিয়ে দিয়েছিলাম, নইলে তোর আবার হাঁচি হবে বলে |”

যোগানন্দ চমকাইয়া বিষম খাইলেন | তাঁহার বিষমের ধাক্কায় টেবিলের থালা, বাটি, গেলাস নড়িয়া গেল | ত্রিলোক বাবু সেসব অগ্রাহ্য করিয়া, ও অশ্রু সম্বরণ করিয়া চার আঙ্গুলে চাটনি চুষিতে লাগিলেন |

পূর্বেই বলিয়াছি, ত্রিলোক বাবু বিচক্ষণ ও ধুরন্ধর - উভয়ই |


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৯ অগাস্ট ২০১৩                                                

বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৩

অশ্বান্ড কান্ড


জীবন যুদ্ধে পরাস্ত, সংসার রোগে আক্রান্ত বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে যে কতিপয় কথা ঘন ঘন শোনা যায়, পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাহাতে প্রথম ইষ্টদেবতার নাম, দ্বিতীয় ‘ধুর ছাই’ ও তৃতীয় হইল ‘ঘোড়ার ডিম’ |

শৈশব হইতে শুনিতে অভ্যস্ত, কোনও দিন ইহার গভীরে যাই নাই যে ‘ঘোড়ার ডিম’ প্রকৃত কি বস্তু | আমাদের যুগে ছিল কৌতুক বেশী কৌতূহল কম, কিন্তু বর্তমান যুগের ধারা যে বিপরীত | আমার সংযমহীন কথাবার্তার ফল হইল এই যে একদিন শ্রীমতী আসিয়া কহিলেন, “তোমার সেয়ানা ছোট-ছেলে ঘোড়ার ডিম খেতে চায়” | বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করিয়া পাল্টা প্রশ্ন করিলাম, “হাফ-বয়েল না মামলেট না ঝোল?” তিনি কহিলেন, “ইয়ার্কি ছাড়, ছেলেকে সামলাও তুমি” | আমি প্রসঙ্গ বদল করিতে প্রয়াস করিলাম, “আচ্ছা আমি ওকে বলে দেব ঘোড়ার ডাক্তার হতে | বিনে পয়সায় যত চায় ঘোড়ার ডিম - পাবে আর প্রাণ ভরে খাবে” | স্ত্রী হুঙ্কার সহ বিদ্রূপ করিলেন, “তুমি পারলে না ফোঁড়ার ডাক্তার হতে, আর ছেলে হবে কিনা ঘোড়ার ডাক্তার !” এই খোঁটার কারণ বহুকাল যাবত তিনি ‘বাতের ওপর বিষ ফোঁড়া’ হইতে ভুগিতেছেন | কোনও প্রলেপ কাজ করেনা | আমার প্রেমের উষ্ণ-আর্দ্র প্রলাপেও তাহার কোনও উপশম হয় নাই | ইদানীং আফিমের আশ্রয় লইয়াছেন |

অগত্যা ঘোড়ার ডিম সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা সমীচীন বোধ করিলাম | কিন্তু দেখা গেল যে বিষয়টি প্রশ্ন-সার -

কি করে যে লোকে চেনে, কি অশ্বডিম্ব,
ছাপার জগতে যার নেই কোনও বিম্ব ?
বিজ্ঞাপন খুঁজে খুঁজে হলাম যে হিমসিম,
কোথায় কি ভাবে পাব আস্ত ঘোড়ার ডিম ?
গোল নাকি লম্বা, নাকি সেটা চৌকস ?
কততে ডজন দেয়, ক’ টাকায় ওয়ান বক্স ?
হাতে গুনে বিক্রি, নাকি দাঁড়িপাল্লায় ?
ঝুড়ি ভরে আনে, নাকি রাখে ডিম গামলায় ?
কখনই বা বেচে, কোন দিন, ক্ষণ, বেলাতে ?
দিনের বাজারে, নাকি নিশুতি বে-রাতে ?

“ঠিক হ্যাঁয়, কোই বাত নেহি” এই ভাবে হিন্দিতে নিজেকে আশ্বস্ত করিয়া বাজারে রওয়ানা হইলাম |

কিন্তু সে সফর বৃথায় গেল | কেহ কহিল কোলকাতায় যান - বাঘের চর্বি, শুয়ারের দাঁত, সাপের চামড়া সবই পাইবেন | কেহ কহিল আস্তাবলে খোঁজ নিতে | শেষে প্রশ্নটি ডিম্ব-জড়িত বুঝিয়া ব্যাঙের ছাতা বিক্রেতা উপদেশ দিল ডিম ওয়ালী কে জিজ্ঞাসা করিতে | ডিম ওয়ালী সামনে ডিম পাড়িয়া বসিয়া আছে, এবং তাহার পিছনে বাঁধা এক মুরগী ক্ষুব্ধ-স্বরে জানাইতেছে যে  ডিম গুলি আসলে তাহার কৃত ফল | সে (মহিলা, মুরগী নহে) দুঃখিত স্বরে কহিল, “বাবা মুরগীর দানা যোগাতে পারিনা, ঘোড়ার খোরাক কোথা থেকে যোগাবো ?”

ফিরিলাম ভাবিতে ভাবিতে –
কে কেনে, কে ব্যাচে, কে দ্যায় সাপ্লাই ?
এই সব প্রশ্নের কোথা পাই রিপ্লাই ?

ফিরিবার পথে পাড়ার মুখে দর্পণ বাবুর সাথে দেখা | তিনি যথারীতি নখ খুঁটিতে খুঁটিতে হাসিলেন, এবং শুধাইলেন, “কি খবর? বাজার থেকে, ব্যাজার মুখে, হাতে থলি, খালি খালি | বলি ব্যাপারটা কি ?”

ভদ্রলোকের পরিচয় -
বাবুর নাম দর্পণ, নখের বড় শৌখিন
বড় বড় নখ তার, নানান রঙে রঙ্গিন   
জীবন উৎসর্গিত তার অজ্ঞানতা বর্জনে
দুনিয়ার সব জ্ঞান তিনি রাখেন নখদর্পণে

তাঁহারএক এক রঙের নখে এক এক বিষয়ের জ্ঞান | সাদা – অর্থ ও ধন-সম্পদ; হলুদ – রন্ধনপ্রণালী ও কুশলতা; সবুজ – গ্রাম্য জীবন ও কৃষি পদ্ধতি ; গোলাপি – প্রেম ও বিরহ ; লাল – বিবাহ, প্রজনন ও সংসার পালন ; নীল – ভৌতিক, রাসায়নিক ইত্যাদি বিজ্ঞান ; মেটে - জীব বিজ্ঞান ; কালো – মৃত্যু, নরক ও পরকাল, ইত্যাদি, ইত্যাদি | ইদানীং তাঁহার পায়ের নখেও ও রং ধরিতে শুরু হইয়াছে, যেমন যেমন জ্ঞান জগতে বিস্তার হইতেছে তেমন তেমন তিনি নিজেকে প্রস্তুত করিতেছেন |

বিপদে দর্পণ বাবুর শরণাপন্ন হয়নাই এমন ব্যক্তি বিরল – অন্তত আমাদের পাড়ায় | তাহাকে সংক্ষেপে আমার সমস্যা অবগত করাইলাম | তিনি আমার কথা শোনেন আর বিস্মিত মুখে মেটে রঙের নখ খুঁটিতে খুঁটিয়ে মাথা নাড়েন - কিন্তু মুখে কোনও কথা নাই | তাঁহার মৌনতায় সন্দেহ জাগে:

প্রশ্ন কি ডিম্বের, নাকি তাহা অশ্বের ?
পরিধি স্থানীয় কি, নাকি তাহা বিশ্বের ?
কি সব জানিলে তবে হবে নিষ্পত্তি,
অশ্বডিম্ব পিছে লুকান যে সত্যি ?

শেষে দর্পণ বাবু বিব্রত মুখে কহিলেন, “বিষয়টা ভাবিয়ে তুলেছে | একটু গবেষণা করা দরকার | কোনভাবে দুটো দিন ম্যানেজ করে এসে দেখা করুন |”

আমার কনিষ্ঠ সন্তান চেহারায় বড় সড় হইলেও দুগ্ধ পানে আসক্ত | তাহার দুগ্ধে সামান্য আফিম দিয়া তাহার মা তাহাকে সামলাইল | ঘোড়ার ডিম লইয়া তাহার যে প্রবল বেগ তাহা দু’দিন শান্ত থাকিল |
তৃতীয় দিন  সকালেই দর্পণ বাবুর বাটিকায় পদার্পণ করিলাম | তিনি হাস্য মুখে সম্বর্ধনা করিলেন | চা পান অন্তে আমাকে পার্শ্ববর্তী তাঁহার অধ্যয়ন কক্ষে লইয়া গেলেন | এক কেদারায় বসাইয়া কহিলেন, “একটা কথা বোঝা গেল যে ঘোড়া ডিম পাড়ে না, বা বলা যায়, ডিম পাড়ার উপযুক্ত নয় |”

আমার বিস্মিত বিমর্ষ মুখ দেখিয়া তিনি আমাকে আশ্বস্ত করিতে চাহিলেন | “এই রকম ভাবার স্বপক্ষে আমার যুক্তি গুলো একে একে দেখুন”, এই কথা কহিয়া সামনে রাখা এক ত্রিপদের ঘোমটা উন্মোচন করিলেন | দেখিলাম তাহাতে বড় বড় সাদা কাগজে তাঁহার হস্তাক্ষরে কি সব কথা লেখা | প্রথম পাতায় লেখা :

প্রধান কথা ডিম পাড়া প্রাণী যেমন মুরগী, হাঁস, ইত্যাদির কিছু জৈবিক বিশিষ্টতা আছে যা ঘোড়ার নেই |


অতঃপর তিনি একে একে দেখাইলেন, পাতার পর পাতায় লেখা:

এক

হাঁস, মুরগীর আছে উঁচানো পেখম, ডিম পাড়তে যাতে ব্যাঘাত না হয় | ঘোড়ার লেজ ঠিক উল্টো, ডিমের রাস্তার মুখ ঢেকে ঝোলে | ঘোড়া যদি ডিম পাড়ে তবে তার লেজে ডিম আটকাবে | সে অবস্থায় ঘোড়া কি করবে ? ঘোড়া কি লেজে-ডিমে হয়ে ছটফট করবে না ?

দুই

এটা তো জানা কথা যে ঘোড়া বসে না, দাঁড়িয়ে জীবন কাটায় | তাহলে সে মাটিতে ডিম পাড়বে কি করে ? দাঁড়িয়ে ডিম পাড়লে তো অত ওপর থেকে পড়ে ফটাস করে সব শেষ হবে |

তিন

ডিমে তা দিতে ঘোড়াকে তো মাটিতে বসতে হবে | সদা দণ্ডায়মান ঘোড়ার পক্ষে সেটা কি করে সম্ভব ?

চার

গরম কালে ডিমের গরম লাগলে হাঁস, মুরগী পেখম দিয়ে ডিম কে হাওয়া করে ঠাণ্ডা করে | ঘোড়া লেজ দিয়ে ডিম সামলাবে কি করে ? তা-খাওয়া ঘোড়ার ডিম তো হাফ-বয়েল হয়ে যাবে |

পাঁচ

ডিম ভেঙ্গে বেরুতে চঞ্চু লাগে |  বাচ্চা ঘোড়া তা পাবে কোথায় ? সে তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে স্রেফ |

এই প্রদর্শন শেষ হইলে তিনি কহিলেন, “অর্থাৎ ভেবে দেখুন ঘোড়া কি ডিম দিতে উপযুক্ত ? না | একদম ই নয় |
"এত গেল যুক্তি | এবার তথ্যে আসা যাক | আমি আশে পাশের সব আস্তাবলে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কেউ কোথাও ডিম্ব-জাত ঘোড়ার বাচ্চা দেখেনি | উপরন্তু সবাই বললে ঘোড়া যা ছটফটে,  তার নালের লাথে আস্তাবলে কোনও ডিম আদৌ আস্ত থাকবে না | সবারই এক কথা - ঘোড়া মাত্রই জঠর-প্রসূত | হাঁ, তবে এ কথা জানা গিয়েছে পাড়ার ভেট্রীনারি ডাক্তার থেকে যে কিছু জন্তু জঠরে-ডিম্ব-প্রসূত হয় – যাকে বলে ওভোভিভিপ্যারস – কিন্তু সেটা মাছদের মাঝে হয় – যেমন হাঙ্গর মাছ | তা ডাক্তার বললেন ঘোড়া মাছ গোত্রের প্রাণী নয় |

“শেষমেশ, ভেবে দেখুন ঘোড়া শুধু কেন, গাধা, খচ্চর কেউই ডিম পাড়ে না | যেমন নেই গাধার ডিম, যেমন নেই খচ্চরের ডিম, তেমনি হয়না ঘোড়ার ডিম |”

যুক্তি তো অকাট্য, তথ্য ও যে সত্যি
বুক থেকে নড়ে যায় বিশ্বাসের ভিত্তি   
কিন্তু থেকেই যায় মূল আমার সমস্যা
ছেলেকে কি বোঝাব? পাই না ভরসা |

আমার মনের কথা অনুমান করিয়া দর্পণ বাবু কহিলেন, “আপনি এক কাজ করুন | কিছুদিন বাজার থেকে এমনি কোনও ডিম কিনে ঘোড়ার ডিম বলে ছেলেকে খাওয়ান | ততদিনে আমি সমস্যার একটা হল বের করছি |”

কিন্তু ছেলে আমার ততই সেয়ানা | ডিম দেখিয়াই সে সন্দেহ প্রকাশ করিল, “বাবা, অত বড় ঘোড়ার এতটুকু ডিম ? ডিম ওয়ালী তোমাকে ঠকিয়েছে |”

দ্বিতীয়া দফায় ডিম ওয়ালী কে অনুরোধ করিলাম, বড় মুরগীর ডিম দিতে | সে তো হাসিয়াই মরে | কহিল, “বড় মুরগীর ডিম, না মুরগীর বড় ডিম ? মুরগী বড় হলেও ডিম তো একই মাপের দেয় |” সে যাত্রা হাঁসের ডিম লইয়া ফিরিলাম, কিন্তু কিঞ্চিত বড় সে ডিমও অধমের ভোগে লাগিল, খোকার পছন্দ হইল না তাহার সাইজ | অন্যদিকে দর্পণ বাবু উপদেশ দিতে কার্পণ্য করেন না | প্রত্যহ তিনি খবর নেন সন্তান সন্তুষ্টি সম্বন্ধে | মাঝে মাঝে এমত আভাস দেন যে তাঁহার গবেষণা অব্যাহত আছে |

একদিন তিনি প্রচুর উত্তেজিত | আমাকে দেখিয়া জোর করমর্দন সহ কহিলেন, “পেয়েছি এক মহা ডিমের সন্ধান | অস্ট্রিচের ডিম, সব থেকে বড় ডিম | সেটা নির্ঘাত ঘোড়ার ডিম বলে চালানো যাবে, আপনার খোকা ধরতে পারবেনা |”

আমার জ্ঞানগম্যি কম | এই দুর্বোধ্য নাম শুনি নাই কখনো | সেকথায় দর্পণ বাবু যারপরনাই বিস্মিত হইলেন, “সে কি ? পক্ষীর রাজা অস্ট্রিচ | আপনি তার নাম শোনেন নি ?”

আমি কহিলাম, “আমি তো এক পক্ষীরাজ জানি, যে হয় উড়ন্ত ঘোড়া, যদিও এটা জানিনা ঘোড়া ওড়ে কিনা, এবং কি করে |”
দর্পণ বাবুর আমার কথা লুফিয়া লইয়া কহিলেন, “সেটাও দেখে নেব আমার গবেষণার মাঝে |”

কিছুদিন পর দর্পণ বাবু ডাকিয়া পাঠাইলেন | ভয়ঙ্কর উত্তেজিত তিনি | উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে কহিলেন, “পেয়েছি, পেয়েছি | সব রহস্য পরিষ্কার এবার | “ তারপর আমাকে বসাইয়া দ্রুতপদে পায়চারী করিতে লাগিলেন | মনে হইল তিনি চিন্তাধারা কে পঙক্তি-বদ্ধ করিতে ব্যস্ত | কিছুক্ষণ বাদে কহিলেন, “মনে আছে আপনি সেদিন পক্ষীরাজের কথা বললেন ? “

আমি কহিলাম, “আছে |”

তিনি আমার পিঠ চাপড়াইয়া কহিলেন, “ধারণা করতে পারেন কি ওই এক কথায় আমি এক মস্ত ক্লু পেলাম | সেদিন থেকে মাথায় ঘুরতে লাগলো একসাথে তিন রহস্য | এক - ঘোড়ার সাথে ডিমের কি সম্পর্ক হতে পারে, যদি ঘোড়া ডিমই দিতে অক্ষম ?  দুই – পক্ষীরাজের ওড়ার রাজ কি ? আর তিন – এই দুই রহস্যের মাঝে কোনও যোগাযোগ আছে কিনা ?“

এই সব ভাবছি তখন আমার চাকর নিয়ে এলো সকালের জলখাবার আর বলল, “বাবু, আপনার ডিমটা রেখে যাব কি ঢেকে ?” “আমার ডিম না মুরগীর ডিম, আহাম্মুক ?” জিজ্ঞাসা করব চাকর টাকে, কি অমনি প্রথম রহস্য জলবৎ তরল ! বুঝেছেন ? অশ্বডিম্ব তস্য ডিম্ব নয়, তস্য ভোজ্য !! অর্থাৎ ‘ঘোড়ার ডিম’ মানে, যে ডিম ঘোড়া খায় | সে সম্ভাবনা আমি যে একবারও ভেবে দেখিনি, মাথায়ই আসেনি |

“তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন জাগল মনে, ঘোড়া যদি ডিম খায় তাহলে তার কি হবে ? পেটে সইবে কি ? নাকি তার প্রভাবে  ঘোড়ার মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া হতে পারে ? ভাবুন দেখি মাথা খাটিয়ে |”

আমি হতাশ ভাবে মাথা নাড়িলাম | এ মাথা নড়ে মাত্র, খাটে না | খাটে শয়ন করিলে নড়েও না |

উত্তেজিত দর্পণ বাবু কহিলেন সফলতার উল্লাসে, “অবিলম্বে আমি করলাম থট-এক্সপেরিমেন্ট – অর্থাৎ চিন্তন-প্রয়োগ | অমনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলাম পরিণতি – ঘোড়া ডিম খেলে ঘোড়ার ডানা গজাবে পাখির মতো – আর ঘোড়া উড়বে, উড়ে বেড়াবে | ঘোড়া ঘোড়া থেকে পক্ষীরাজ হয়ে যাবে |
“হ্যাঁ ... অতএব, একেবারে সাবধান | ছেলেকে ঘোড়ার কেন, কোনও ডিমই খাওয়ানো চলবে না |  এ ব্যাপারে অসতর্ক হলে, ছেলেকে ডিম খাওয়ালে, নিশ্চিত জানুন যে ছেলের ও ডানা গজাবে |”

ভগ্নহৃদয়ে বাড়ি ফিরিলাম |

গৃহিণী সব কথা শুনিয়া কহিলেন, “ তাহলে বাপু কাজ নেই | তুমি ঘোড়ার ডিম খোঁজা বন্ধ কর |“
আমি শুধাইলাম, “ছেলে কি মানবে ?”
গিন্নি কহিলেন, “ সে চিন্তা আমার | দুধ দিচ্ছি আফিম দিয়ে, ছেলে দিব্বি খাচ্ছে | খেয়ে ভোঁসভোঁস করে ঘুমাচ্ছে | কি জানি, মুখে তো কিছু বলেনা, হয়ত স্বপ্নেই ঘোড়ার ডিম খাচ্ছে |”
...

সারাংশ:-

ছোট এক খামারেতে ছিল শিশু ঘোড়া
ছুটতে তো জানতো সে, জানত না ওড়া
সবুজ ঘাসের শেষে, দেখে নীলাকাশ
লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তার মিটত না আশ
হওয়ায় পাখির দল উড়ে যেতে দেখে
ভাবত কি করে ওরা উড়তে বা শেখে

ক্রমে শিশু ঘোড়া হল এতই হতাশ
কেঁদে কেটে একসা, যায় যায় শ্বাস
চাষা গিয়ে ভড়কে, ডাকে ডাক্তার
ডাক্তার এসে, দেখে, দ্যায় মত তার
শিশু ঘোড়া দুর্বল, না খেয়ে পাতা, ঘাস
দেহ খানা জিরজিরে, হাড়ে নেই মাস
ঘোড়ার হয়েছে জেদ উড়তে সে চায়
শিশুকে বাঁচাতে হলে করো কিছু ব্যয়
দুধ খাওয়াও তাকে মিশিয়ে আফিম
সেই সাথে দাও জোড়া মুরগীর ডিম
ডিম খেয়ে জোর হবে, ছুটবে আবার
আফিমের নেশায় হবে বাকি কারবার
ভাববে সে, “ছুটছি না, উড়ছি আকাশে
মাটির উপরে নই, ভাসছি বাতাসে”

ওষুধে তো কাজ হল, বাঁচল ঘোড়া
কিন্তু চাষার  ছিল কপালটাই পোড়া
ডিম খেয়ে খেয়ে দুটো ডানা গজাল
অন্তে সে পক্ষীরাজ হয়ে, উড়ে পালাল
---

তাই বলি –

যদি, প্রিয় পুত্র খেতে চায় ঘোড়ার-ডিম
দেবে কি দেবেনা ভেবে হইও না মলিন
কপটে আনিয়ে, দিও অস্ট্রিচের আণ্ডা
যতই খাক না ডিম,  উড্ডয়নের ফান্ডা
বাগে পাবেনা ছেলে, এ চালাকির প্যাঁচে |
ছেলে হবে বুদ্ধি-মন্দ, ঠিক বাপের ধাঁচে

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ২১ অগাস্ট ২০১৩

শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৩

ডাবল মশারি


|| ডবোল মশারি ||

গুজব ছড়ায় পাড়ার ঝিয়ে, হাবুর নাকি মেয়ের বিয়ে
পুজোর নামে চাঁদা করে, বর পেয়েছে ওজন দরে

গায়ের রং - বেগুন ভাজার ; হাত পা যেন লোমশ রাজার
গোঁপের উপর থ্যাবড়া নাক ; নাকের ডগায় তিলের চাক
কুটিল চোখের জটিল ভুরু ; ঠোঁট গুলো বেশ লালচে, পুরু
গাল দুটোতে ব্রণের চাষ ; কানের লতি ক’ সের মাস
নিটোল পেটটা প্রকাণ্ড বেশ ; তার উপরে কাঁচাপাকা কেশ
মাঝখানে এক টোপা কুল, নাভি নাকি, পাকা জামরুল ?

পায়ের নখে কামড়ে মাটি, হাফ-ধুতি পরে যায় সে হাঁটি
দেখে জোড়া পায়ের গোছা, “নিম্নে কেন তাহার পাছা ?”
প্রশ্ন করে ছেলে ও বুড়ো | উত্তর যোগায় নকুল খুড়ো
“ও' দুই ব্যাটা, উপরে মা-বাপ, তাই গতরে তাদেরই ছাপ”

যাই হোক, তার ভালই মন, বিয়ে করবে না নিয়ে পণ
চাই না কিছুই, বাড়ি গাড়ি, চায় শুধু এক জোড়া মশারি

গায়ের চুলের ম্যালাই হ্যাপা | পাড়ার মশা বিলকুল খ্যাপা
রাতের বেলায় ঘুরে ফিরে, সকাল সকাল ফেরে নীড়ে
চুলের মধ্যে ঢুকে পড়ে, কামড়ায় না, বেড়ায় চরে
পাশ ফিরলে সুড়সুড় করে এপাশ থেকে ওপাশ সরে
বউটি নতুন, আশে পাশে, ফিকফিকয়ে যদি হাসে
যদি মশায় দ্যায় খেপিয়ে, মাথায় উঠবে নতুন বিয়ে
খাস্তা করে বরের দশা, কামড় দেবে পুষ্যি মশা
ফুলে গেলে লাশ দশাসই, পালিয়ে যাবে বিয়ে করা সই

কিন্তু ভায়া জোড়া মশারি ? মামলাটা কি জানতে পারি ?
বলছি তবে গোপন কথা – তাজ্জব এই বরের মাথা !

ধরবে মশা আজব প্ল্যানে, ঘুম পাড়িয়ে নতুন কনে
ওত পেতে সে রইবে বসে, মাতবে মশা বৌয়ের রসে
নতুন বৌয়ের গতর ঘিরি, বাঁধবে তখন এক মশারি
এই টোপে সে ধরবে মশা, বুদ্ধি তাহার এতই খাসা
(ইয়ং ব্লাডের কাজ কিবা, যদি না হয় পতির সেবা ?)

এর পরে মক্কেল ক্ষুরধার, খাটাবে আরেক মশারি তার
তার ভিতরে ফুলিয়ে ভুঁড়ি, নাক ডাকিয়ে ভুরি ভুরি
জমাবে ঘন ঘুমের পালা, চুকিয়ে যত মশার জ্বালা

তাই বলছি বন্ধু, শোনো | বউ থাকলে বিপদ কোনও
গছিয়ে দিয়ে তার ওপরে, ঘুমাও তুমি আলস ভরে

আজই গিয়ে শ্বশুর-বাড়ি, অর্ডার করো ডবোল মশারি
কদিন শুয়ে ট্রায়াল দিয়ে, না হয় কোরো ডবোল বিয়ে ||

--------------------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৭ অগাস্ট ২০১৩



শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৩

এক অম্লান সত্য

সবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এ দাখিল হইয়াছি |  পিতা মাতার শাসন হইতে মুক্তি এবং সদ্য-প্রাপ্ত স্বাধীনতার আনন্দে চিত্ত সদাই উৎফুল্ল. আমোদ আহ্লাদ এর অন্ত নাই | নিত্য নতুন বন্ধু সংগ্রহ হইতেছে |  কথায় কথায় হাসি মস্করা, গান, বাজনা | কিছু নাই তো সদ্যজাত বাছুরের ন্যায় হাত, পা ও কল্পিত লেজ নাড়াইয়া লম্ফ ঝম্প - কে কাহাকে দেখে সে প্রশ্ন অবান্তর |

এমন সময় একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে  - ঘটনা অথবা নাটক | তাহার কথাই এখনকার বক্তব্য | তবে, সেই প্রসঙ্গের চর্চা করিবার পূর্বে সেই নাটকের চরিত্রগুলির পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করি |

প্রথম চরিত্র – প্রথম বর্ষের ছাত্র বর্ধন – নাম হইতে অনুমান করা যায় তাহার কলেবর | জন্মাবধি পিতামাতার স্নেহ যেন তাহার শরীরে পুঞ্জিভূত মেদ রূপে ব্যাপ্ত | কিন্তু দেহ অনুযায়ী চিত্ত তাহার বড়ই সরল ও শান্ত | ভদ্র ব্যবহারে সে সকলের চিত্ত অল্প সময়েই জয় করিয়াছিল | তাহার আর এক বৈশিষ্ট্য ছিল উদার-হৃদয় | কখনো কেহ কিছু ধার লইলে সে তাহা ফেরত লইবার কোনও প্রচেষ্টার ধারে কাছেও যাইত না |

দ্বিতীয় চরিত্র – সেও প্রথম বর্ষের ছাত্র, কিন্তু প্রকৃতিতে সম্পূর্ণ বিপরীত | নাম তাহার অম্লান, এবং বৈশিষ্ট্য তাহার, অম্লানবদনে দুষ্টামি করা | তাহার দুষ্টামি হইতে কেহ ছাড় পাইত না | আর তাহার সুদীর্ঘ কদ ছিল সম্পূর্ণ কলেবর-হীন – অর্থাৎ ভগবান তাহাকে লম্বা অস্থির কাঠামো দিয়া, তাহার উপর মাংসের আচ্ছাদন প্রদান করিতে প্রচুর কার্পণ্য করিয়াছিলেন, কোনও অজ্ঞাত কারণে | কাজেই তাহার দুষ্টামির ভুক্তভোগী তাহাকে প্রহার করিতে চাহিলেও তাহার রুগ্ন শরীরে লক্ষ্যভেদ ব্যর্থ হইত | তদুপরি অম্লান অল্প বয়েসেই পুনঃপুন পিতৃ-হস্তে প্রহৃত হইয়া শেখে যে, “য পলায়তি স জীবতি” |

তৃতীয় চরিত্র – রসায়নের শিক্ষক জটায়ু বাবু | তাঁহার আয়ুতে জট লাগায় তাঁহার বয়েস বোঝা কিঞ্চিত দুষ্কর হইলেও, হাবভাবে ও চাল চলনে তিনি ছিলেন চির-ক্ষুব্ধ তরুণ | ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, খড়গনাসা, উন্নত ললাট এবং সদা উজ্জ্বল লাল চক্ষু | এক কালে ব্যায়াম করিতেন, ফলে শরীরের ঊর্ধ্বদেশ ও অধোদেশ ঋজু, কিন্তু ব্যায়াম ছাড়িয়া দেয়ার ফলে মধ্যদেশ ছিল বর্ধনের মতো প্রকাণ্ড | তাঁহার প্রিয় পরিধান ছিল শ্বেতশুভ্র জামা ও পাতলুন – কিবা গ্রীষ্ম কিবা শীত | কেহ তাহাকে সোয়েটার বা কোট পারিতে দেখে নাই | তিনি রসায়নে প্রকৃতই অনুরক্ত ছিলেন এবং তাহার প্রমাণ দিতে প্রায়শ ক্লাসে ল্যাব বয় দ্বারা বীকারে জল আনাইয়া পান করিতেন | কখনো বয় চা লইয়া আসিলে পিছন-পকেট হইতে স্প্যাটুলা (নাকি চিরুনি) বাহির করিয়া চা টি নাড়িয়া পান করিতেন | শোনা কথা, সেই চা তাঁহার কক্ষে বুণ্সেন বার্নরে তৈরি করা হইত |

এই ঘটনাটির বর্ণন করার পূর্বে ইহা বলিয়া রাখা প্রয়োজন যে সময়ের সাথে স্মৃতি দুর্বল হইয়াছে, কাজেই পাঠক হয়ত বিস্তারিত বিবরণের অভাব বোধ করিবেন |

...

সেদিন শীতের সকল | দ্বিতীয় ক্লাস জটায়ু বাবুর | তিনি আসিলে ল্যাব বয় যথাক্রমে জল ও চা আনিয়া রাখিয়া গেল |  জটায়ু বাবু পাতলুনের কটিবন্ধ ঘনঘন আঁটিতে আঁটিতে, কিছু অন্যমনস্ক ভাবে পিছন-পকেট হইতে স্প্যাটুলা / চিরুনি টানিলেন, কিন্তু না পাইয়া চা এমনিই পান করিলেন |

এদিকে ক্লাসের বাহিরে উজ্জ্বল রৌদ্রের চাঞ্চল্য | জানালা হইতে আসা শীতল হাওয়ার স্পর্শে মন উড়ুউড়ু | কিন্তু ক্লাসের ভিতরের আবহাওয়া রসায়ন মাস্টার জটায়ু বাবুর জমকাল কণ্ঠের এক্সথার্মিক প্রক্রিয়ায় একেবারেই নাতিশীতোষ্ণ | এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে ছাত্রদের ধ্যান বিক্ষিপ্ত | এইরূপ অবস্থায় জটায়ু বাবু ক্বচিৎ কদাচিৎ পরীক্ষা দিয়া গ্যালারি তে উঠিয়া আসিয়া ছাত্রদের উত্তর লইয়া তর্ক বিতর্ক করিতেন | সে দিন তাহাই হইল | তিনি ছাত্রদের মধ্যে আসিলে কিছু ভালো ছাত্র তাঁহাকে ঘিরিয়া তাঁহার ধ্যান আকর্ষণে করিতে বড়ই ব্যস্ত হইল | কিন্তু যেখানে একাধিক ভালো ছাত্র, সেখানে মন্দ কিছু ঘটা অবশ্যম্ভাবী | আর যাহার আশংকা হয় তাহা ঘটেও | আমরা মধ্যবর্গের ছাত্ররা শেষ পঙক্তিতে বসিয়া যে যার ঘড়ি কখনো দেখিতেছি, কখনো বা থামিয়া গিয়াছে ভাবিয়া তাহা ঝাঁকাইতেছি কিম্বা ডেস্কে ঠুকিতেছি | হটাত দেখি মাস্টারমশাই এর চারিপাশ হইতে ছাত্ররা ছত্রখান | এবং মাস্টারমশাই অম্লানের কান ধরিয়া চিৎকার ও চড়চাপড় করিতেছেন |  তবে আওয়াজ বেশি, আঘাত কম – কারণ পূর্বেই বলিয়াছি অম্লান কে মারধোর করা দুষ্কর ছিল | সে এই পাশ ওই পাশ করিয়া মাস্টারমশাই এর উদ্ধত হাত পা এড়াইবার প্রয়াস করিতেছে, ও মাস্টারমশাই কে কিছু বলিতেছে, বুঝাইতেছে | হটাত জমিতে পড়িয়া সে মাস্টারমশাইয়ের পাতলুন ধরিল, ও মাস্টারমশাই হুঙ্কার দিয়া পাতলুনের নিম্নগামী স্খলন থামাইতে ব্যস্ত হইলেন | সেই সুযোগে অম্লান মাস্টারমশাই হইতে গ্যালারির এক ধাপ উপরে উঠিয়া দাঁড়াইল | তাহার কান মাস্টার মশাইয়ের নাগালের বাহির হইল বটে, তবে তিনি তৎক্ষণাৎ অম্লানের ক্ষীণ কটি জড়াইয়া তাহাকে হ্যাঁচকা টানে নামাইলেন, এবং তাহাকে পাঁজাকোলা করিয়া ক্লাস হইতে বাহির হইয়া হনহন করিয়া প্রস্থান করিলেন | অম্লানের হাত পা মুক্ত হাওয়াতে নিষ্ফল আস্ফালন করিতে করিতে নেপথ্যে অদৃশ্য হইল |

এই রূপে যবনিকাপাত হইলে মুহূর্তেই নির্বাক দর্শক ছাত্র সব একেবারে সবাক | সমস্বরে শত প্রশ্ন - সহস্র উত্তর | গণ্ডগোল কমিলে, এবং উত্তেজনার কিঞ্চিত উপশম হইলে, জানিলাম যে অম্লান নাকি জটায়ু বাবুর পশ্চাৎ দেশে কলম দিয়া খোঁচা দেয় | কী কারণে, কাহার কলম দিয়া, তাহা কোথায় গেল, ইত্যাদি প্রশ্নের নির্ভরযোগ্য উত্তর পাওয়া যাইল না | দিনের বাকি ক্লাস পরম অস্বস্তিতে কাটিল |

সে দিন সন্ধ্যা নাগাদ জানা গেল যে জটায়ু বাবু অম্লান কে লইয়া প্রিন্সিপালের নিকট যান, এবং অম্লান কে সোপরদ্দ করিয়া সুবিচার দাবি করেন | অম্লান নাকি দোষ কবুল করে | স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে সে জানায় যে, পূর্বদিন সে বর্ধনের কলম ধার নেয়, এবং ফিরত দিতে ভুলিয়া যায় | সকালবেলায় মেসে বর্ধন তাহার কলম দেখিয়া ফেলে, কিন্তু ভদ্রতা-বশত ফিরত চায়না | তখন অম্লান ঠিক করে যে, সে বর্ধনের অজান্তে তাহার পকেটে কলমটি রাখিয়া দিবে | উপযুক্ত সুযোগ সে পায় যখন জটায়ু বাবু ছাত্রদের একজোট করিয়া কিছু বুঝাইতে লাগেন | তখন সে ভিড়ের মধ্যে বর্ধনের সাদা পাতলুন দেখিয়া তাহার পিছন-পকেটে সন্তর্পণে কলম টি রাখিতে যায় | কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হোঁচট লাগিয়া সে হুমড়ি খাইয়া পড়ে, ও তাহার হাতের কলম পাতলুনের পশ্চাৎ দেশে আঘাত করে | জটায়ু বাবুর হাতে আচমকা গ্রেপ্তার হইয়া, তাঁহার প্রহারে সে বুঝিতে পারে, যে সাদা পাতলুনটিতে সে লক্ষ্যভেদের প্রয়াস করিয়াছিল তাহার ভিতর বর্ধন নহে, জটায়ু বাবু বর্তমান ছিলেন | একথা বলা বাহুল্য যে, জটায়ু বাবু তাহাকে হাতে-কলমে ধরিয়া ফেলেন |

কিন্তু, এই ব্যাখ্যা জটায়ু বাবু মানিতে অস্বীকার করিয়া প্রিন্সিপাল কে প্রকৃত কারণ তদন্ত করিতে অনুরোধ করেন | তদন্ত-কালীন জটায়ু বাবু ক্লাস লইতে অসম্মত হন | প্রিন্সিপাল পড়েন মহা ফাঁপরে | ছাত্রদের ব্যাপারে অন্যরা কী অনুসন্ধান করিবে ? অতএব তিনি ছাত্র জিমখানা’র শরণাপন্ন হন |

এইখানে এই নাটকের দ্বিতীয় অংশ -  প্রবেশ এই লেখকের, জিমখানা’র সদস্য ভূমিকায় | অবশ্য, তদন্তে আমি একমাত্র সদস্য নহি | তবে আমার উপর বিশাল চাপের সৃষ্টি হয়, কারণটি নিম্নে দেয়া |

তদন্তের প্রথম অধিবেশনে এই তথ্য সামনে আসে যে বর্ধন ঘটনার সময় অকুস্থলে উপস্থিত ছিল না | জটায়ু বাবুর হাজিরা-খাতা অনুযায়ী বর্ধন ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল | কিন্তু, বারম্বার জেরায় অম্লান  অবিচল থাকে যে সে পিছন হইতে বর্ধনের সাদা পাতলুন স্পষ্ট দেখিয়াছিল | কমিটির পরবর্তী অধিবেশনে স্থির হয় – প্রশ্ন একই – অম্লান কি সত্যই ভ্রমবশত: সাদা পাতলুনে জটায়ু বাবু কে বর্ধন মনে করে ?

সব কমিটিতেই কিছু পরোপকারী লোক হয়, যাহারা কার্যভার অপরের ঘাড়ে চাপাইয়া পরস্মৈপদী অবসর উপভোগ করে | তাহারা রায় দেয় যে মিলন নাকি জামা কাপড়ের সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান রাখে, অতএব এই ব্যাপারে আলোকপাত করিতে মিলনই সর্বাপেক্ষা সক্ষম সদস্য | বিচক্ষণ পাঠক নিশ্চয় অনুধাবন করিতে সক্ষম যে এই অধমেরই নাম মিলন |

অগত্যা আমি সাক্ষ্য প্রমাণ জুটাইতে ব্যস্ত হই, ও জটায়ু বাবু এবং বর্ধন দুইজনেরই পাতলুন আনাই | ততদিনে উভয় পাতলুনের এক দুই ধোলাই বোধহয় হইয়াছে | পাতলুন আসিলে দেখা গেল দুই পাতলুনের মাপ প্রায় সমান | তখন স্বাভাবিক রূপে সন্দেহ জাগে কোন পাতলুনের উপর আক্রমণ হইয়াছিল | অম্লান কে জিজ্ঞাসা করিলে সে নির্দ্বিধায় বর্ধনের পাতলুন সনাক্ত করে | তাহার সনাক্তকরণের ভিত্তি কী ? সে দেখায় যে পাতলুনের পিছনে সেলাই খুলিয়া মাপ বাড়াইবার স্পষ্ট চিহ্ন আছে | মাপ কবে, কী কারণে বাড়ানো হইয়াছিল এই সব তথ্যের অনুসন্ধানে কিছু অতিরিক্ত তথ্য জানা যায় | বর্ধনের দর্জি নাকি তাহাকে উবু হইয়া বসাইয়া মাপ লইত – পাছে দাঁড়ান অবস্থার মাপে বানান পাতলুনের পিছনের সেলাই, বসিলে ছিঁড়িয়া যায় | কিন্তু, এই পাতলুনের মাপ বর্ধন যেদিন দেয়, সেদিন সে – তখনো তাহার প্রাতঃকৃত্য হয় নাই বলিয়া – দাঁড়াইয়া মাপ দায় | কিছুদিন পূর্বে, ব্যবহার-কালে পাতলুন পশ্চাৎ দেশে ছিঁড়িয়া গেলে, সে দর্জিকে পাতলুনটি দিয়া সেখানের বাড়তি কাপড়ে কিছুটা মাপ বাড়াইয়া দ্বিতীয় সেলাই করিতে বলে | ‘মে-ফেয়ার’ দোকানের দর্জি সাক্ষ্য দেয় যে সে এই সেলাই করে ঘটনার কিছুদিন পূর্বে | তাহার বকবকানি তে জানিতে পারি যে সে একই সাথে বর্ধনের সেই পাতলুনের কোমর বড়, ও অম্লানের কোনও এক পাতলুনের কোমর খাটো করে |

এদিকে স্পষ্ট দেখিলাম বর্ধনের পাতলুনের দ্বিতীয় সেলাই এক জায়গায় ছেঁড়া | সেখানে একটি ছিদ্র – যে পথে, সম্ভবত, অম্লানের হাতের কলম অন্দরে (এবং বলা যায়, জটায়ু বাবুর অন্তরে) প্রবেশ করিয়াছিল |

আশ্চর্যজনক কথা, দেখা গেল জটায়ু বাবুর পাতলুনের পশ্চাৎ সম্পূর্ণ নিশ্ছিদ্র, এমন কি কলঙ্কহীন – কোনই কলম প্রসূত দাগ নাই |

ইতিমধ্যে আমার লক্ষ্যে আরও কিছু ধরা পড়ে | সেই মতো বর্ধনকে জিজ্ঞাসা করিয়া নিশ্চিন্ত হই যে আমার এক অনুমান সত্য | সে কথা পরে |

এতদ্বারা স্পষ্ট হইল যে, অপরাধের দিন জটায়ু বাবুর পরিধানে বর্ধনের পাতলুন ছিল | ছিল কি, সত্যই ? এই ভাবে বর্ধনের পাতলুনে জটায়ু বাবুর আবির্ভাব ভাবিতে বাধ্য করে কাহার বা কিসের মাধ্যমে বর্ধনের পাতলুন জটায়ু বাবুর পরিধানে আসে | দুর্ধর্ষ বুদ্ধিমান পাঠক অনুমান করিতে পারেন কি, কে বর্ধনের পাতলুন লইয়া তাহা জটায়ু বাবুকে দিতে পারে ? ঠিক কথা – ইহা একমাত্র ধোপার দ্বারাই সম্ভব |

ধোপাকে জিজ্ঞাসাবাদের পরে মূল সত্য প্রকাশ পায়, ও রহস্যের সম্পূর্ণ সমাধান হয় | অপরাধের দিন, ধোপা প্রথম জটায়ু বাবুর বাড়িতে যায় | সেখানে, সাইকেল হইতে চুরি হইবে সেই ভয়ে, সে সমস্ত ধৌত কাপড়ের গাঁট বাড়ির ভিতরে লইয়া যায়, যেখানে জটায়ু বাবুর ভৃত্য গাঁট  এর উপরে রক্ষিত সাদা পাতলুন লইয়া লয় | বর্ধনের কাছে আসিয়া  ধোপা লক্ষ্য করে যে তাহার পাতলুনের পরিবর্তে জটায়ু বাবুর পাতলুন তাহার গাঁটে | সে কিছু না বলিয়া চুপচাপ জটায়ু বাবুর পাতলুন বর্ধনকে দিয়া পয়সা লইয়া চলিয়া যায় | বর্ধন প্রাতরাশের পর এক অদ্ভুত হাঁসফাঁস অনুভব করে | তাহার কারণ যে তাহার পরিধানে জটায়ু বাবুর পাতলুনের চাপ, তাহা সে না বুঝিয়া শরীর খারাপ ভাবিয়া ক্লাসে যায় না |

এইভাবে অবশেষে প্রমাণিত হয় যে অম্লানের ভ্রান্তির কারণ পাতলুনের অদল বদল |

অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট পাইয়া প্রিন্সিপাল রায় মহাশয় রায় দেন যে, যেহেতু অম্লান বিচারের পূর্বেই সাজা পাইয়াছে, তাহাকে সাজা দিবার অবকাশ আর নাই |

এই কথা প্রকাশ পাইলে জটায়ু বাবু যারপরনাই লজ্জিত হন | তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করিলে অনুসন্ধান কমিটি তাহাকে অনুরোধ করে যে তিনি যেন অম্লান কে চা (ক্যান্টিনের চা, বুণ্সেন বার্নরের নহে) খাওয়াইয়া ভুল বুঝাবুঝি দূর করেন |

...

পরদিন জটায়ু বাবু অম্লানকে ক্লাসের পর সাথে লইয়া গেলেন চা খাওয়াইতে | অম্লান ফিরিল ম্লান মুখে, এবং জানাইল মাস্টারমশাই তাহাকে লইয়া ক্যান্টিনে যান | চা আসে ভাঁড়ে | তখন তিনি বুক-পকেট হইতে সন্তর্পণে দুইটি পিপেট বাহির করেন | একটি অম্লানকে দিয়া কহেন, “ভাঁড় এর কোনও ভরসা নেই | কার না কার এঁটো | পিপেটটা দিয়ে খাও বরঞ্চ |”  তারপরে কিঞ্চিত নিম্নস্বরে, “পিপেটের সুবিধা কী, চা কম দিল কিনা বোঝা যায় |”

চা খাওয়া হইলে তিনি পয়সা দিতে চাহেন, কিন্তু অম্লান তাহাতে বাধা দেয় | তখন তিনি বলেন, “ঠিক আছে | আমি আর এক দিন তোমাকে চা খাওয়াব | তবে ভেবে দেখ, কম চায়ের জন্য পুরো দাম দেয়া উচিত কি?”

ফিরিবার পথে তিনি অম্লানকে বর্ধনের কলম ফিরত দিয়া কহেন, “অদ্ভুত ব্যাপার | যেদিন তুমি আমার ব্যাক-পকেটে কলম রাখতে গেছিলে সেদিন বাড়িতে প্যান্টটা পরে চিরুনি রাখতে গিয়ে দেখি ব্যাক-পকেটটাই নেই | তুমি কি ঠিক দেখেছিলে আমার প্যান্টে ব্যাক-পকেটটা?”

আমরা সবাই সমস্বরে কহিলাম, “সে কী ? স্যারের পরনের প্যান্টে ব্যাক-পকেট ছিল না ? তাহলে, তুই কলম রাখতে গিয়েছিলি কোথায় ?”

বর্ধন আমার দিকে ইঙ্গিত-পূর্ণ চক্ষে তাকাইল, এবং কাহাকেও উদ্দেশ্য না করিয়া বলিল, “মিলন অম্লান কে খুব বাঁচিয়েছে | অম্লান এখন বলুক সেদিন ‘মে ফেয়ার’ এ আমার প্যান্টটা দেখে ও কী বলেছিল |”

অম্লান হাসিয়া বলিল, “আমি বলেছিলাম তোর এত ঢাউস পাছায় কোনও ব্যাক-পকেট নেই, আমি হলে তো প্রত্যেক পাছায় এক জোড়া করে পকেট রাখতাম |”

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৯ অগাস্ট ২০১৩