সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪

টগরের ছবি

৷৷ টগরের ছবি ৷৷

ভৈরব বাবু ইদানীং ছবি তুলছেন ৷ ডিসেম্বরে বড় নাতি রথীন তার পুরানো হয়ে যাওয়া ক্যামেরা ফেলে গিয়ে ফোন করে বলেছে, “দাদু, আমি ওটা তোমার জন্য রেখে এসেছি ৷” তাই, শীত কমার মুখে, উনি রোজ সকাল দশটার পর বেরিয়ে দুটো ব্লক পার করে প্রত্যন্তভিহার উদ্যানে ঢুকে পড়েন ৷ তারপর ঝোলা-ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা সাবধানে বের করে ছবি তুলতে শুরু করেন ৷ পুরানো বড় বড় গাছে ভর্তি পার্কটায় এই সময় স্বাস্থ্যসচেতনদের ভিড় শেষ ৷ শুধু ত্যানা কুড়ানি, আর, কোনও কোনও বেঞ্চে স্কুল কলেজ পালানো জোড়া কিশোর কিশোরী বসে ৷ দেখলে এড়িয়ে যেতে হয় ৷

একদিন, দূরে একটা ঝোপের উপর অনেক হলুদ কিছু উড়ছে, কাছে গিয়ে দেখলেন ওগুলো প্রজাপতি ৷ ছবি নিতে শুরু করেছেন, এক দুটো শট ঝাপসা উঠেছে, হটাত তাঁর মনে হল কেউ যেন হালকা হাততালি দিল ৷ ক্যামেরা থেকে মুখ সরিয়ে দেখলেন এক পাশে রথীনের বয়েসের একটা ছেলে দুহাত আঁজলা করে প্রজাপতি ধরার চেষ্টা করছে ৷ বেশভূষা দেখে মনে হল ভিখিরি, কি ভবঘুরে ৷  একটু বিরক্ত হয়ে তিনি ক্যামেরা নামালেন ৷ ছেলেটা ঝুঁকে হাত দুটো প্রসারিত করে এক ঝাপটায় প্রজাপতির কাছে এনে হাতের পাতা আঁজলা করে ঘিরতে চাইছে ৷ কিন্তু তার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে প্রজাপতি উড়ে পালাচ্ছে ৷ হাস্যকর কাণ্ডটার মুভি করে রাখতে তিনি ক্যামেরা তাক করলেন ৷ ছেলেটা যেন টের পেয়ে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, “কী করছ ?” ভৈরব বাবু নেতিবাচক ভাবে মাথা নেড়ে ক্যামেরা নামিয়ে নিলেন ৷ ছেলেটা এবার বলল, “ওই, ওটা দিয়ে ?”
ভৈরব বাবু মুখ খুললেন, “ছবি তুলছিলাম ৷”
ছেলেটা – “ফটো ?”
ভৈরব – “হ্যাঁ | তুমি কী করছ, ওই ভাবে হাততালি দিয়ে দিয়ে ?”
ছেলেটা – “প্রজাপতি ধরছি ৷”
ভৈরব – “ও ! ... ধরে কী করবে ?”
ছেলেটা – “কাউকে দেব ৷”
ভৈরব বাবু একটু কৌতূহলী হলেন, “কাকে দেবে ?”
ছেলেটা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিক দেখে নিলো ৷
ভৈরব বাবু পরিস্থিতি লঘু করার জন্য জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কী ?”
ছেলেটা – “বাবলু”
ভৈরব – “বাহ ! বেশ ... তা বাবলু, প্রজাপতি ধরে কাকে দেবে ?”
বাবলু সন্দিগ্ধ হয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে একটা পড়ে থাকা বস্তা তুলে হাঁটা দিল ৷ তাড়াহুড়োর ঝটকায় কিছু ছেঁড়া প্লাস্টিকের প্যাকেট আর কাগজের ঠোঙ্গা তার থেকে উপচে পড়ল | ভৈরব বাবু বুঝলেন ছেলেটা ত্যানা কুড়ানি ৷

কিছু দিনেই তিনি বাবলুর পরিচয় পেলেন ৷ মা কে নিয়ে পার্কের পিছনে বস্তিতে থাকে ৷ ওর মদ্যপ বাবা লিলুয়ার দিকে এক কুয়াশা রাতে লেভেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে কাটা পড়ে ৷ ছেলেটা এখন তাঁকে দেখলে বস্তা নামিয়ে কাছে আসে ৷ সাথে সাথে ঘুরে এমন জায়গা দেখিয়ে দেয় যেখানে অচেনা সব পাখি আসে যায় ; উনি ছবি তোলেন ৷ বাবলু মাঝে মাঝে বলে, “কেমন ফটো তুললে আমায় দেখাও ৷” ভৈরব বাবু কখনও দেখান, আবার কখনও বলেন, “দেখাব ... আগে বল কার জন্য সেদিন তুই প্রজাপতি ধরছিলি ৷” তখন বাবলু নিরাশ হয়ে বলে, “তাহলে থাক ৷” তারপর ওর উৎসাহ কমে যায়, ইতস্তত করে বস্তাটা তুলে চলে যায় ৷ আবার এক দু দিন পরে দেখা দেয় ৷ এই রকম প্রস্থান হলে ভৈরব বাবু বিরক্ত হন | আবার যে দিন বাবলুর পুনরাবির্ভাব হয় সেদিন তিনি ভুরু না কুঁচকে বাড়ি ফেরেন ৷
 

আজ সকালে তিনি মন দিয়ে একটা গাছের নিচু ডালে বসা পাখির দিকে ক্যামেরা তাক করে জুম করেছেন কি পিছনে শুকনো পাতায় হালকা পা ফেলার শব্দ হল, আর পাখিটা উড়ে গেল ৷ মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন দু’হাত আঁজলা করে বাবলু দাঁড়িয়ে ৷ মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “আজ একটা ফটো তুলে দেবে ?”
ভৈরব – “কিসের ছবি ? তোর হাতে কী ?”
বাবলু – “প্রজাপতি ধরেছি | দেখবে ?”
ভৈরব – “প্রজাপতির ছবি নিতে বলছিস ?”
বাবলু – “না, না | আমি প্রজাপতিটা টগর কে দেব | তুমি ওর একটা ছবি তুলে দেবে ?”
নামটা প্রথম শুনলেও, ভৈরব বাবু কৌতূহল চেপে নিরস গলায় বললেন, “টগর ... বেশ তো ৷ যা ডেকে নিয়ে আয় ৷”
বাবলু ঘুরে জোর গলায় ডাকল, “রানী ...” ৷
দূরে ঘেউ ঘেউ করে উঠে একটা কুকুর দৌড়ে আসতে শুরু করল ৷ ওটা কাছে এলে দেখলেন একটা দো-আঁশলা ময়লা মাঝ-বয়সী মাদী কুকুর, যার ঘাড়ে, দাপনায় আর পিঠের কোথাও কোথাও চুল উঠে গেছে ৷ বাবলু ওকে বলল, “যা রানী, টগরকে নিয়ে আয় ৷”
কুকুরটা ছুটে চলে গেল ৷ পুনর্ধ্যানস্থ হয়ে ছবি তুলতে তুলতে ভৈরব বাবুর হটাত মনে হল, আরে এ তো ডিজিটাল ক্যামেরা – এর ছবি বাবলুকে কী করে দেবেন ? সমস্যাটা এড়াতে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ রে, তুই ছবি নিয়ে কী করবি ?”
বাবলু – “মা দেখতে চায় ৷”
ভৈরব – “টগরের ছবি ?”
বাবলু – “হ্যাঁ ... না, মানে ... টগর কে |”
ভৈরব – “তাহলে ছবি নিয়ে কী হবে ?”
বাবলু – “কিন্তু, টগর চায় ... ওহ ! সে তুমি বুঝবে না ... এখন চলো আমার সাথে ৷”
ভৈরব – “কেন, কোথায় নিয়ে যাবি ?”
বাবলু – “চলো, দেখি টগর আসছে না কেন, আর রানী কোথায় পালাল ৷”

বাবলু ভৈরব বাবু কে নিয়ে চলল ৷ পার্কটা এত বড় যে বেশ অনেকটা দূরে এসে ভৈরব বাবুর সন্দেহ হল ছেলেটার কোন মন্দ মতলব নেই তো ৷ কিন্তু এতদিন ছেলেটার মার্জিত, অকপট কথাবার্তা শুনে তাঁর কেমন যেন মনে হয়েছে একটু ছিটিয়াল হলেও ছেলেটা বোকাসোকা, সরল ৷ জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রে, কোথায় গেল তোর টগর ?” একটু দূরে একটা, যেন কোনও জলাশয়ের চারিপাশে জমায়েত, ঝাঁকড়া গাছের জটলা দেখিয়ে বাবলু বলল, “ওই ওখানে, হয়ত ৷” গাছগুলোর কাছে পৌঁছে একটা সরু পথে বাবলুর পিছন পিছন এগিয়ে দেখলেন, জমিটা একটু উঁচু হয়ে উঠে নেমেছে একটা পুকুরে ৷ পথটার শেষে তালগাছের গুঁড়ি ফেলা তিন ধাপের সিঁড়ি ৷ পাশে একটা গাছের গুঁড়ি জলে আগা ডুবিয়ে শুয়ে ৷ তার উপরে ছেঁড়া কাপড় পরা একটা মেয়ে, পাশে কুকুরটা – দুজনে নিশ্চল হয়ে বসে পানকৌড়ি দেখছে ৷  যেন এদের অস্তিত্ব টের পেয়েও ওরা দুজনে চুপ করে বসে রইল ৷ বাবলু ডাকল, “রানী, টগর কে নিয়ে আয় ৷” কুকুরটা উঠে মেয়েটার কাপড় মুখে ধরে টানল ৷ মেয়েটা তাও বসে রইল ৷ অধীর হয়ে বাবলু হড়বড় করে নিচে নেমে মেয়েটার পাশে ঝুঁকে তার কানে কানে কিছু বলল
মেয়েটা এক অদ্ভুত জড়তার সাথে আস্তে করে বাবলুর মুখ থেকে কান সরিয়ে, আঁজলা করে ধরা বাবলুর দুই হাতের পাতার কাছে কানটা নুইয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল | বাবলু ভৈরব বাবুর দিকে মুখ তুলে বলল, “এই হল টগর ... টগর, মুখ তোল ৷ বাবুকে এনেছি, তোর ফটো তুলিয়ে মাকে দেখাব বলে ৷”

মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে  “আর আমাকে ... ?” বলে কথার খেই হারিয়ে বিব্রত মুখ তুলে হাসল ৷


ভৈরব বাবু
দেখে চমকে উঠলেন, গড়নে কিশোরী টগরের পোড়া মুখে পলকহীন ঘোলাটে চোখ দুটোয় কোনও দৃষ্টি নেই ৷
----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪


শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪

লুপ লাইন

৷৷ লুপ লাইন ৷৷


ট্রেনটা লিপিং স্টেশন ছেড়ে ধীরে ধীরে বাঁক নিয়ে গতি বাড়াল ৷ প্রায় সবাই নেমে গেছে ৷ এখন এটা লুপ লাইনে চলবে, এক একটা স্টেশন ধরে ধরে ৷ মেন লাইনে একটাই স্টেশন – টুরিস্টদের গন্তব্য – ওখান থেকে পাহাড়ের নিচে বিম্বল লেক দেখা যায় ৷ ছুটির দিন ছাড়া শুধু প্রেমিক প্রেমিকাদের ভিড় – রঁদেভুর জায়গা ৷ দুই লাইনই শেষ হয়েছে হাফলং এ ৷

আমার একমাত্র সঙ্গী যাত্রী, বয়স্ক ভদ্রমহিলা উৎসুক হয়ে বাইরে দেখছেন ৷ মনে হল হয়ত বহুদিন পরে ফিরছেন ৷ চেহারা উদগ্রীব, তার সাথে একটু চিন্তার ছায়া ৷

ট্রেনটা লাপুস্কাতে ঢুকতেই উনি উঠে দাঁড়ালেন ৷ দ্রুত পায়ে দরজায় গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, শান্ত স্টেশনের নিস্তব্ধতায় শুনলাম, “এ কী, লাপুস্কা !” তারপর আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “বিম্বল লেক হল্ট কি পড়ে না এই লাইনে ?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “এটা লুপ লাইন দিয়ে যাচ্ছে ৷ ওখানে নামতে হলে মেন লাইন হয়ে যেতে হয় ৷”
উনি – “কিন্তু ওরা যে বলল হাফলং এর ট্রেন ধরতে !”
আমি – “ঠিকই বলেছে ৷ কিছু ট্রেন মেন লাইন দিয়েও যায় ৷”
ভদ্রমহিলা অসম্ভব হতাশ হয়ে স্বগতোক্তি করলেন, বাংলায়, “আবার সেই ভুল করলাম !”

এবার আমি ওনার মুখের দিকে তাকালাম ৷ বয়েসের সাথে নিঃসঙ্গতার ছাপ ৷ আবরণ ও আভরণে মনে হল অবিবাহিতা ৷ হাতের এখনো পেলব আঙ্গুল দেখে মনে হয় সংসারের ধকল বইতে হয় নি ৷ আমি বাংলায় বললাম, “কিছু যদি মনে না করেন, এর আগেও কি কখনো এই ভাবে লুপ লাইনে ভুলে চলে এসেছিলেন ?”

ভদ্রমহিলা আমার দৃষ্টি দেখে, মাথায় কাপড় তুলে সাদা সিঁথি ঢেকে বললেন, “হ্যাঁ ... অনেক দিন আগে ৷ ভুলেই গেছিলাম, সেই ভুলের কথা ৷”


------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২০ ডিসেম্বর ২০১৪

বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৪

শীতের রোদ, ক্যামেরায়

৷৷ শীতের রোদ, ক্যামেরায় ৷৷

দু’দিনের জন্য মেয়েটা বাড়ি এসে ফিরে গেল
একান্ত নিঃসঙ্গ নির্মোহ জীবনটা দুলিয়ে দিয়ে
খালি দোলনার মত, এক দমকা, শূণ্য দোলায়
ক্যামেরায় ধরে রাখতে ক্ষণজীবী শীতের রোদ
জমায়েত পালকের মত সির্র্যাস মেঘের মাঝে

জানালা দিয়ে বিছানায় আছড়ে পড়ে স্বর্ণ সমুদ্র
উচ্ছল, সফেন, লুটায় মোজায়েকের বেলাভূমে
জ্বলে, ডুরে চাদরে ফেলে যাওয়া কমলা স্কার্ফ
কাঁচের শার্সিতে ছায়া ফেলে উড়ে যায় টিয়ারা
রং ঈষদচ্ছ আমলকী – উচ্ছ্বসিত উল্লাসে ওরা
ধরা দেয় না মেয়ের দেয়া আনকোরা দূরবীনে
এক জোড়া কিন্ডল্ পড়ে থাকে বন্ধ, মূক মুখে
একই গল্প লেখা দুয়ে, একসাথে বসে এই রোদে
“বাপি, দেখে নাও কী করে ডাউনলোড করে”

জীবনটা ভরছে, খুলে রেখে না পড়া গল্পে গল্পে
রোদে জরানো লেবুর নিমকি, বয়ামে জমানো

যদিও জানি ক্যালিফোর্নিয়ায় ওই একই সূর্য ওঠে
মেয়ের গা ছুঁয়ে যায়, ছুঁয়ে যায় ওর প্যাটিওর ফুল
উপভোগ্য রোদ, শুধু বিভিন্ন নীল আকাশ ছেঁচা
তবুও এক বছর করতে হবে তার জন্য অপেক্ষা
আনবে ও মানা করা উপহার, খুলে দেখলেই শেষ
আর আকাঙ্ক্ষিত, ক্যালিফোর্নিয়ার রোদ ছোঁয়ান
“বাপি, দেখ কত লম্বা হয়েছে এবার আমার চুল !”
ওর হালকা, খুশি গলায়, জলতরঙ্গ সুরেলা সুরে ৷৷


-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪

মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪

শখের ছেলে

৷৷ শখের ছেলে ৷৷


শুভদিষ্টি হল মানবাজারে
মালাবদল হল বারাসতে
ঘর বাঁধলাম শখ করে
মৌলা আলীর ফুট-পথে

ঘর বলতে রেলিঙে বাঁধা
বাঁশের মাথায় সামিয়ানা
তার মধ্যেই অঢেল সুখ
ঘরকন্নার, ষোলআনা

স্বামী করে বেতের কাজ
কুড়াই আমি তারই কুটি
রাতে, দুপুরে, ছ্যাঁচা মাদুরে
ছাউনি তলায় কী খুনসুটি
...

বরটা আমার মনের ভালো
বুঝল যখন আমি বাঁজা
ধরে আনল কুকুর ছানা
বলে, “দিলেম সোনা রাজা”

রাজা আমার ভীষণ পাজি
হয়ে গেল কোলের ছেলে
মাঝখানেতে জায়গা নিয়ে
বরকে দিল ধারে ঠেলে

ওই আমাকে জড়িয়ে শুল
ভোরে উঠে চাটল গাল
শাশুড়ি-মা দেখে কাঁদল
“হায়রে, কী পোড়া কপাল !”
...

তাই তো আমি মানবাজারে
ফিরে এসেছি রাজার সাথে
না থাক বর, না থাক ঘর
শখের ছেলে হাজার পথে ৷৷


--------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৪

বনিতার শুভরাত্রি

|| বনিতার শুভরাত্রি ||

‘শুভরাত্রি’, বলেও তুমি দাঁড়িয়েছিলে দোরগোড়ায়
বুঝি নি তখন দু’জনের কে করবে দরজা নীরবে বন্ধ
মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা ছিল ম্রিয়মাণ হাওয়ার শীতলতায়
প্রদীপের অনির্বাণ স্থির শিখায় পুড়েছিল রাত্রির নির্বন্ধ

যে একরাশ সরল আকাশে সন্ধ্যা ঢলেছিল ইতিহাসে
তোমার চোখে ছেয়ে অমানিশার অপার অজানা লিপ্সা
জানালা হতে উধাও তার নীলিমা, অন্ধকারে ছদ্মবেশে
সময় হয় নি বিদায়ের বলে জানিয়েছিল অপ্রতিভ ঈপ্সা

উপায় ছিল না জানানোর, ঐ দ্বিধার অজানিত আকুলতা
ছিল না কত কিছুই জানা ; অজানাও ছিল যে যত জানা
আলাদা রাত্রি যাপন, বাধিয়ে অন্ধকারে বিদায়ের দূরতা
কী অজুহাতে এক হৃদয়ের দুই শরীরে আলাদা উপাসনা

অথচ আমার বাহু তখন আবিষ্ট তোমার উত্তাপ রেশে
তোমার পলকের আঁচড় আমার নিমীলিত আঁখি পাতায়
আবিল অনিদ্রায় অবশ আমার অস্তিত্ব, সম্মোহক বশে
জেনেছিল শুভরাত্রি, তোমার অনুচ্ছাস জোয়ার ভাঁটায়

ওই প্রদীপ তাই কি বুঝেছিল কিছু, হয়েছিল উজ্জ্বল
ফিরাতে চেয়েছিল ঢলে যাওয়া, পড়ে যাওয়া আলো
তবে ওই শীতল হাওয়া কেন করেও তোমায় বিহ্বল
তোমার ভর্ৎসনায় ঠোঁট উচ্ছল আগ্রহে কাঁপিয়েছিল

যখনই ক্রমশ প্রকাশ্য সম্ভাবনায় রাত্রি আসন্নপ্রসবা
তুমি খেলো লুকোচুরি আলোয় আঁধারের সমাগমে
আমি চাই তুমি থাক ওই প্রদীপ শিখার মতই সধবা
উষ্ণ বিচ্ছুরণ সঁপে আমার প্রতি রোমাঞ্চিত রোমে ||


-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১১ ডিসেম্বর ২০১৪

বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪

শোধ

|| শোধ ||


শুনেছি তুমি ঘর বেঁধেছ
স্ত্রী হয়েছ, বৌমা হয়েছ
মা-জননীর শতরূপেতে
দেহ সাজিয়ে মন নিয়েছ

কিছু ভালো পেয়েছ কি ?

কারো দুঃখে দুখী হয়েছ
ব্যথার ভার বুকে ভরেছ
বক্ষ সম্ভার মুখে যুগিয়ে
সুবাদে তুমি সুখী হয়েছ

সত্যিই সুখ দেখেছ কি ?

আমিও কিছু মলিন সুখে
মন্দ লোকের মুখে মুখে
শুনছি তুমি আছ অসুখে
দেবাদিদেব রেখে সমুখে

কভু ভেবে দেখেছ কি ?

ওই যে ঘর-সংসার খেলা
করকচি গত শৈশববেলা
বিছানাতে সাজিয়ে মেলা
শুধু আকাশকুসুম তোলা

সে সব ভুলে গিয়েছ কি ?

তবুও কেন তোমার ঘরে
যেই জানালার পর্দা সরে
দেখি বোবা আঁধার চিরে
কী নৈশব্দ কাঁদে শিহরে

তবে তুমি ভুল করেছ কি ?

কপাল লেপে সিঁদুর মাখো
তবুও তুমি উপোষ রাখো
ম্লান হাসিতে অশ্রু ঢাকো
ঘুমঘোরে ককিয়ে ডাকো

এভাবে তুমি ভ্রূণ হানছ কি ?
বলো, তুমি শোধ নিচ্ছ কি ?


--------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১১ ডিসেম্বর ২০১৪

বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৪

পত্রের অ্যালকমী

৷৷ পত্রের অ্যালকমী ৷৷


সব ফেলে দিয়েছি, শুধু ওই চিঠির বাক্সটি ছাড়া
কী হবেই বা কিছু রেখে, যখন জীবনটাই ছন্নছাড়া

বাক্সটাও খালি, রং চটা, খয়েরি, মলিন, অমসৃণ
তবু তার মধ্যে অন্তহীন সময় হয়েছে রয়ে লীন

লোকে খোলে ঝাঁপি, করতে রোজকার দিন শুরু
জীবন শুরু করতে গেলেই কোঁচকায় আমার ভুরু

শুরু হয়েছিল জীবন একদা চিঠি লেখালেখিতেই
কিন্তু কী ভাবে, কেন যে, হারিয়ে গেল সব খেই

‘ধুত্তোর’, বলে চিঠিপত্রের পাঠ তুলে দিয়েছি তাই
এখন আমার জীবনটা শুধু তাইরে নাইরে নাই

তবুও বাক্সটা খুললেই যেন জমা এক দীর্ঘশ্বাস
আটকে রেখে, খোলা বাক্সটা করে শুধু হাঁসফাঁস

বন্ধ করলে বাক্সটা শোনায় কত শব্দের ফিসফিস

বুঝি, বন্ধ আর খোলার ফারাকটা উনিশ আর বিশ

এবার ভাবছি বাক্সটাও দেবে ফেলে একটানে ছুঁড়ে
কিন্তু ওঠেনা হাত, বোধহয় নিজেকে বড্ড কুঁড়ে

তাই ভাবছি যদি খালি বাক্সেই ধরে এত আলসেমি
তবে কোন সাহসে পত্রালাপ, সম্পর্কের অ্যালকমী ৷৷


-------------------------------------
©ইন্দ্রনীর / ২৫ নভেম্বর ২০১৪

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪

অনাবিষ্কৃত পুরাতত্ব

|| অনাবিষ্কৃত পুরাতত্ব ||


পোস্টম্যান আজও এসে ফিরে চলে গেল
হল না দেখা, অবেলায় বেলা পড়ে এলো
হয়তো তোমার চিঠি সে এনে ফিরে গেল
কী যে লেখা ছিল, বলো না কী লেখা ছিল

হয়তো সে খাকি ঝুলিতে রেখেছে জমিয়ে
মুখশুদ্ধি তোমার চিঠি, থরে থরে সাজিয়ে
হয়তো সে সামলে আঁকড়ে রেখেছে ধরে
অনাবিষ্কৃত পুরাতত্ব, অজস্র চিঠির নজিরে

জানি সে করবে একদিন সময়ে অনুসরণ
তোমার অপরিণত হাতের বক্রিমা লেখন
প্রস্তরীভূত, সুমেরীয় সূক্ষ্ম কীলক আখরে
অবর্ণনীয় যার অর্থ ছিল আমার অগোচরে

যে চেষ্টায় আমি হেরেছি তোমার কাছে
আমার সে’ স্থান কি পোস্টম্যান নিয়েছে
কী দুখে ঠুকছ কীলক, বলো কোন দুখে
ক্ষতবিক্ষত করে ভালবাসা বুকের ফলকে ||

------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৩ নভেম্বর ২০১৪

বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪

ছড়া ছন্দ

|| ছড়া ছন্দ ||


লিখিতে বসিয়া ক’টি পদ্য
কহি, “মেলে না যে ছদ্ম !”
গিন্নী কহে, “ওটা হবে ছন্দ ?”
বুঝিলাম সর্দিতে নাক বন্ধ

যাই হোক, নানা কসরতে
ঘুরিয়া শব্দের পথে বিপথে
লেখা হইল এক ডজন পদ্য
এক সপ্তাহ কাটাইয়া, অদ্য

কহিলে ডজনে বারো পদ্য
শুনিতে লাগে বটে অনবদ্য
কিন্তু কী পোড়া মোর কপাল
গৃহিণী দেয় বড্ড গালাগাল

কেন না রবি হইতে শনিতে
গৃহিণীর সরল পাটিগণিতে
যোগ দিয়া কিছু ছলা-কলা
কি সিঙ্গাপুরি কী কাব্য কলা

ফাউ সমেত ডজনে চৌদ্দ
না হইলেই উপবাস বরাদ্দ
অতএব ভাবি লিখিব গদ্য
নতুবা অনিবার্য অকালশ্রাদ্ধ !


-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১২ নভেম্বর ২০১৪

বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৪

অন্ধকারে গন্ধ কার

|| অন্ধকারে গন্ধ কার  ||


“অন্ধকারে গন্ধ কার?” শুধাইল রাজা
মন্ত্রী কহে “উত্তর নাহি তার সোজা |”
“কত ঘন অন্ধকার তা জানা দরকার,
“গন্ধটি কি বিচ্ছিরি, নাকি কদাকার ?”
‘কদাকার’ শুনি কহে আহ্লাদী গদাধর
“কদাকার পছন্দসই, যদি হয় নধর”
‘পছন্দসই’ শুনি কহে দজ্জাল সুয়োরানী
“সত্বর ডাক মোর পছন্দের সই, মেথরানী”
মেথরানী আসিয়া কহে করিয়া কুর্নিশ
“কর্পোরেশনে ধাঙ্গড় আছে প্রায় উনিশ
“সাথে বিদ্যুৎ সরবরাহের যত কর্মচারী
“সকলে করিয়াছে ধর্মঘট রচিয়া আঁধারী
“অন্ধকারে বহে শত ভিন্ন দুর্গন্ধের হাওয়া
“কোনটি কাহার, কে কহিবে কী করিয়া ?”


----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩০ অক্টোবর ২০১৪

প্রণাম

|| প্রণাম ||


আশ্বিনের শেষ | দিন ক্রমে ক্রমে হ্রস্বতর হইতেছে | পূজা শেষ হইয়াছে | তাহারই অবসাদ যেন অস্তগামী সূর্যের দিনশেষ রশ্মিতে ঝরিতেছে | সুকোমল শয়নকক্ষে বসিয়া জানালা দিয়া আম্র কুঞ্জের পিছনে সূর্য বিলীন হইতে দেখিল  | দিন কয়েক যাবত তাহার যেন কিছুই ভালো লাগে না | অন্যান্য বারের মত এইবার সে গ্রামে আসিয়া বিশেষ আনন্দ উপভোগ করে নাই | কোন কিছুর সদ্য নূতন প্রয়োজন বোধ যেন তাহার বক্ষে একটি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার আকার লইয়াছে |

ঘরের ভিতর আসিয়া সৌদামিনী কহিল, “ঠাকুরপো, বাতি দিয়ে যাই |” সুকোমল কহিল, “না, থাক | এমনিই দিব্যি আছি |”
সৌদামিনী – “কেন ? কী হয়েছে ? মন খারাপ বুঝি, ফিরে যেতে হবে বলে ?”
সুকোমল – “না, তা হবে কেন | গেলেই তো স্কুল খুলে যাবে, আর সব বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে যাবে |”
সৌদামিনী নিকটে আসিয়া তাহার কপালে হাত রাখিয়া কহিল, “শরীর খারাপ নয় তো ?” সুকোমল মাথা নাড়িল, কিন্তু, বৌদির হাত সরাইল না | | বৌদির করস্পর্শ তাহার ভালো লাগে | কিছুক্ষণ এইভাবে সময় কাটিলে, কী ভাবিয়া সুকোমল কহিল, “আচ্ছা, ঠিক আছে বৌদি, যাও একটা বাতি নিয়ে এসো, আর, তেল আর নারকেল কুচো দিয়ে মাখা একটু মুড়ি |”

সৌদামিনী চলিয়া গেলে সুকোমল বসিয়া ভাবিবার চেষ্টা করিল তাহার কিসের অভাব বোধ হইতেছে | চিন্তায় মগ্ন রহিয়া সহসা তাহার জ্ঞান হইল যে কক্ষে কেহ আসিয়াছে | ভালো করিয়া ঠাহর করিয়া দেখিল প্রবেশ দ্বারের ভিতরে আসিয়া একটি বালিকা এক হাত বাড়াইয়া দাঁড়াইয়া আছে | সেই হাতে একটি কাঁসার বাটি | আশ্চর্য হইয়া সুকোমল শুধাইল, “তুমি কে ? কী করছ এখানে ?” বালিকাটি নিকটে আসিয়া কোন কথা না বলিয়া বাটিখানি তাহার দিকে বাড়াইয়া দিল | সুকোমল দেখিল তাহাতে কিছু মুড়ি ও দুইখানি বড় মোয়া | সে বাটিটি লইয়াছে কি, বালিকাটি কহিল, “আমি বকুল | ওই মোয়াগুলো আমার |” সুকোমলের বোধ হইল বালিকাটির বয়েস আট নয় বৎসর হইবে | সুকোমল হাসিয়া কহিল, “ঠিক আছে | তুমি তোমার মোয়াগুলো নিয়ে নাও, আর খাটে উঠে বসে খেয়ে নাও |”
উচ্চ পালঙ্কের দিকে চাহিয়া বকুল কহিল, “আমি অত উঁচুতে উঠতে পারব না ... আর, একটু পরেই তো চলে যাব |”
এমন সময় আলো দেখা গেল | একটি হ্যারিকেন লইয়া সৌদামিনী আসিয়া, হাসিয়া কহিল, “কি, আলাপ হল ?” বকুল সাথে সাথে উত্তর দিল, “আমার নাম তো আমি বলেছি | ও কে ?”
সৌদামিনী – “ও তোর দাদা হয় |”
বকুল – “দাদা ? কেমন দাদা ? নাম কী ?”
সৌদামিনী – “ওহ ! বড্ড প্রশ্ন করিস | তোর দূর সম্পর্কের দাদা হয় | ওর নাম সুকোমল, তুই কমলদা বলতে পারিস |” বকুল দ্বিধাভরে চাহিয়া সুকোমলের দিকে অগ্রসর হইয়া ঝুঁকিতেই, সে শশব্যস্ত হইয়া কেদারা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “থাক, থাক |” আজ অবধি কেহ তাহাকে প্রণাম করে নাই | সে সম্ভাবনার কথাও সে কখনও চিন্তা করে নাই | সৌদামিনী কহিল, “বকুলের মা হল তোমার দাদার দূর সম্পর্কের পিসিমা | পিসিমা বিকেলে মন্দিরে যাবে বলে গঙ্গায় গা ধুতে গিয়ে ফেরে নি দেখে পিসেমশায় খুঁজতে যাচ্ছিল | বকুল জেদ করল সাথে যাবে | কিন্তু অন্ধকার দেখে আমাদের বাড়ির কাছে এসে বলল, ‘আচ্ছা, আমাকে দিদির কাছে রেখে যাও’ |”
সৌদামিনী হ্যারিকেন খানি পালঙ্কের ছতরি হইতে ঝুলাইয়া, বকুলের হাতে দুইটি মোয়া দিয়া তাহাকে তুলিয়া পালঙ্কে বসাইয়া কহিল, “তুই বসে এগুলো খা, আর দাদার সাথে কথা বল | আমি একটু সন্ধ্যা দিয়ে আসি |”

কথা কিছুই হইল না | সুকোমল  মুড়ি খাইতে খাইতে পুতুলের মুখশ্রী নিরীক্ষণ করিল  | হ্যারিকেন খানি পুতুলের মাথার পিছনে হওয়ার জন্য তাহার মুখ ঠিক ভাবে দেখা না গেলেও, বুঝিতে পারিল যে তাহাকে দেখিতে মন্দ নহে | তবে মাথায় উচ্ছৃঙ্খল চুল | কী দেখিতে চাহিল, আর কী দেখিতে পাইল, সুকোমল তাহা তৎক্ষণাৎ জানিতে পারিল না | বকুল মন দিয়া মোয়া ভক্ষণ করিয়া সুকোমলকে প্রশ্ন করিল, “তুমি পড়াশুনা করো ?” সুকোমল হাসিয়া কহিল, “হ্যাঁ, আমি ক্লাস টেন এ পড়ি | তুমি ও বুঝি পড়াশুনা করো ?” বকুল কহিল, “হ্যাঁ ... না, আগে বলো, মোয়াগুলো খাচ্ছ না কেন ?” সুকোমল কহিল, “খাব না কেন ? তবে, তুমি খাবে তো নাও ?” সে দেখিল, বকুলকে ইহার বেশি বলার প্রয়োজন হইল না |

তুলসী তলা হইতে শঙ্খধ্বনি শোনা গেল | বকুল কপালে হাত তুলিয়া প্রণাম করিল | তখনই বাহির হইতে কেহ ডাকিল, “সৌদামিনী, ও সৌদামিনী, কই পারু কই ?” সৌদামিনীর সাড়া দিল, “আসি পিসেমশায় |” সদর দরজার অর্গল খোলার আওয়াজ হইল | কিঞ্চিত পরেই, “আয় বকুল, তোর বাবা এসেছে তোকে নিতে”, কহিয়া সৌদামিনী কক্ষে প্রবেশ করিল | বকুল পালঙ্ক হইতে লাফ দিয়া নামিয়া, হাতের মোয়া সুকোমলের বাটিতে ফেলিয়া, দৌড়াইয়া বাহিরে যাইতে যাইতে থামিয়া, পিছনে ফিরিয়া কহিল, “ওই যাহ্‌ ! প্রণাম ?” সুকোমল হাসিয়া কহিল, “এখন থাক | পরে কখনও কোরো |”
বকুল কহিল, “ঠিক আছে তাহলে, প্রণামটা বাকি রইল | তুমি কিন্তু ভুলবে না |”

কিছু পরে সৌদামিনী ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “কী কমল, কেমন দেখলে ? মিষ্টি না, মেয়েটা ?”
সুকোমল – “তেমন তো কিছু দেখলাম না | ওই তো ছোট্ট একটু মেয়ে – তার আবার সুন্দরী অসুন্দরী কী ?”
সৌদামিনী – “কই, আমি তো বলি নি ও সুন্দর দেখতে | সবাই অবশ্য বলে বড় হলে সুন্দরী হবে | ওর মা, সম্পর্কে যিনি তোমার মাসি হবেন, তিনি খুব সুন্দরী |”

সৌদামিনী সুকোমলের মামাতুত দাদার স্ত্রী | বয়েসে সুকোমল হইতে মাত্র ছয় বৎসরের বড় হইলেও মাতৃহীন বালকটিকে সে মাতৃস্নেহে আবৃত করিয়া রাখে | একই মাতৃস্নেহের দাবীতে সে প্রায়ই গ্রামের সুন্দরী বালিকাদিগের প্রতি সুকোমলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার চেষ্টা করে | কিন্তু সুকোমলের সদ্য শ্মশ্রু-গুম্ফের আভাস দেখা দিয়াছে – সে এই ব্যাপারে কপট গাম্ভীর্যে চরম উদাসীনতা প্রকাশ করিবার চেষ্টা করে | সৌদামিনী অন্তরে আমোদিত হইয়া নিশ্চিন্ত হয় |

সেই রাত্রে নৈশভোজ শেষ হইলে, পালঙ্কে শয়ন করিয়া হ্যারিকেনের শিখা স্তিমিত করিয়া সুকোমল চিন্তা করিল স্কুলে ফিরিয়া সে বন্ধুদের কাছে এই অদ্ভুত বালিকাটির কথা কহিবে কিনা | সহসা কিছু মনে পড়ায় সে সৌদামিনীকে ডাকিল, “বৌদি, শিগগির এসো |” সৌদামিনী আসিয়া কহিল, “কী হয়েছে ?”
সুকোমল – “আচ্ছা, ওই মেয়েটা কেন মুড়ির বাটি এনে বলল ওই মোয়াগুলো ওর ?”
সৌদামিনী – “আহা রে ! কী চিন্তায় ঘুম আসছে না, দেখো | ঠাকুরপো মশাই, ওই মোয়াগুলো পিসিমা দিন কয়েক আগে পাঠিয়ে দিয়েছিল | আমি যখন পারুকে বললাম, ‘যা, দাদার জন্য এই মুড়ির বাটিটা নিয়ে যা’, তখন ও বলল, ‘দাদাকে দুটো আমার মোয়াও দাও |’ জানো, ও সব কিছু নিয়ে ঐরকম করে | সবাই কে, সব জিনিস কে, নিজের মনে করে | কাল দেখব তোমায় দখল করতে ও সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, ‘আমার একটা নতুন দাদা হয়েছে’ |”
সুকোমল – “পারু ?”
সৌদামিনী – “হ্যাঁ, ওর নাম পারুল, বকুল ওর দিদির নাম | কিন্তু, ওই নাম নিয়েও ছোট থেকে পারু ঝগড়া করে, ‘আমার নাম বকুল | আমি বড়’ |”
সুকোমল – “আসল বকুল কত বড় ?”
সৌদামিনী – “সে তোমার থেকে ক’বছরের বড়ই হবে | কেন ?”
সুকোমল – “না, এমনি ... আমি কি তাকে দেখেছি ?”
সৌদামিনী সহসা সুকোমলের গাল টিপিয়া রহস্যের গলায় কহিল, “দেখে থাকলে ভুলতে না | ... নাও, এখন শুয়ে পড় তো |” সৌদামিনী বাতিটি লইয়া চলিয়া গেলেও অনেকক্ষণ তাহার ঘুম আসিল না | তাহার মানসে ওই চপলা বালিকার বিশৃঙ্খল কেশপুঞ্জ হ্যারিকেনের আলোক বিচ্ছুরিত করিয়া ভাসিতে থাকিল |

কিছুদিন পরে সৌদামিনী সুকোমলকে ডাকিয়া কহিল, “আসল বকুল এসেছে | তোমায় আলাপ করতে ডাকছে |” সুকোমল দাদার শয়ন কক্ষে যাইয়া দেখিল এক অপরূপ সুন্দরী বসিয়া | তাহার পরিধানের কাপড় সাদামাটা হইলেও, রূপসী মুখখানি দেখিলে বারম্বার দেখিতে ইচ্ছা করে | সলজ্জে সে যাইয়া প্রণাম করিলে,  বকুল কহিল, “সেদিন পারু এসে তোমার কথা বলছিল খুব |”
সৌদামিনী – “কী বলছিল ?”
বকুল – “বলছিল, নতুন দাদা না কিছুতেই আমার মোয়া খাচ্ছিল না | শুধু ড্যাবড্যাব করে আমাকে দেখছিল, আর ভাবছিল আমি কখন ওকে প্রণাম করব |”
সুকোমল সংকুচিত হইয়া কহিল, “বকুল দিদি, আমি একটু বেরুবো |”
বকুল – “আচ্ছা, তুমি এসো এখন | পারলে, বাড়িতে এসো |”

বাহিরে আসিয়া তাহার মাথায় এক অদ্ভুত ভাবনা দেখা দিল | যদি সে দুই ভগিনীকে একত্রে দেখিতে পাইত, তাহা হইলে কি জানিতে পারিত যে পারুল বড় হইয়া প্রকৃত সুন্দরী হইবে কিনা ?

দুই জন কে একত্রে দেখিবার সুযোগ এক দিন হইল, যখন সে ভবাই এর সহিত বাতাবী লেবু দিয়া ফুটবল খেলিয়া পায়ে চোট লাগাইয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে বাড়ি ফিরিতেছে | সহসা কেহ পিছন হইতে কহিল, “কী হয়েছে ? পায়ে লেগেছে বুঝি ?” সে পিছনে ফিরিয়া দেখিল, বকুল দিদি ও পারুল | ঠিক তখনই পারুল আমুদে গলায় কহিল, “আজ তো তাহলে তোমাকে আর প্রণাম করা যাবে না |”

ইহার পর প্রায় আট বৎসর সুকোমলের আর মাতুলালয়ে আসা হইল না | একেবারে কলেজ হইতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সম্পন্ন করিয়া সে আবার গ্রামে আসিল | যথারীতি তাহার পিতা আসেন নাই, কারণ শ্যালকের সহিত তাঁহার বিশেষ বনিবনা নাই | তবে তিনি মাতৃহীন পুত্রের উপর মামার অধিকার স্বীকার করেন | সুতরাং মামার পত্র অনুযায়ী, যে সুকোমল যেন চাকুরীরত হইবার পূর্বে একবার দেশ গ্রাম ঘুরিয়া যায়, তিনি সুকোমলকে গ্রামে পাঠাইয়া দিলেন |

সুকোমলের মামা, প্রতুল চন্দ্র মহাশয়, অবশ্য ভাগিনার মুখ দেখিয়া ভগিনীর মুখ স্মরণ করিয়াই খুশি থাকেন – আসিতে যাইতে স্নেহের অভিবাদন ব্যতীত আর বিশেষ কথাবার্তা করেন না | সুকোমলের দাদা, নবীন চন্দ্র, স্থানীয় বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার – নিজের কাজ কর্ম লইয়া ব্যস্ত থাকেন | সৌভাগ্যবশত, ইতিমধ্যে সৌদামিনীর এক কন্যা হইয়াছে | তাহার নাম সুরভি | পাঁচ বৎসরের সুরভি সহজেই কাকুর উপর আধিপত্য স্থাপন করিল | সুকোমল শৈশবের বন্ধুদের সন্ধান না পাইয়া অগত্যা সুরভির সহিত দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনে মন দিল | সে তাহাকে প্রত্যুষে গঙ্গার তীরে বেড়াইতে লইয়া যায় | বেলা হইলে বারান্দায় বসিয়া তাহাকে নিজের শৈশবের গল্প শোনায় | দ্বিপ্রহরে তাহার সহিত কথা কহিতে কহিতে সুরভি ঘুমায়, ও বৈকালে জাগিয়া তাহার সহিত মন্দিরে যায় | আবার নৈশভোজের পর সুরভি ঢুলু ঢুলু চক্ষে কাকুর কাছে শুইয়া রূপকথা শুনিতে শুনিতে ঘুমায় |

একদিন সুকোমল মন্দির হইতে ফিরিয়া দেখে বাড়ির খিড়কি দরজায়, পথের দিকে মুখ করিয়া সৌদামিনী দাঁড়াইয়া | তাহার সম্মুখে দুই তরুণী পথের দিকে পিঠ করিয়া কথাবার্তা করিতেছে | সুকোমল নিকটে আসিলে সৌদামিনী তাহাকে দেখিয়াই কিঞ্চিত উত্তেজিত কণ্ঠে কহিল, “ঠাকুরপো, দেখো তো, চিনতে পারো কিনা ?” সেই সাথে সে একটি তরুণীর চিবুকে হাত দিয়া তাহার মুখ ঘুরাইয়া দিল | তাহার পরিধান সবুজ পাড়ের গেরুয়া রঙের শাড়ি, যাহার অর্ধনমিত অবগুণ্ঠনের নিচে লহরিত কেশ বেষ্টিত, সিঁদুর মণ্ডিত, সিঁথি ও কপাল | তাহার গ্রীবায় স্বর্ণচম্পক দ্যুতি, কপোলে লালিমা,ও কমলা বর্ণের সুপক্ব ওষ্ঠাধরে সহসা লজ্জার অপ্রস্তুত মৃদু হাসি | এ হেন বর্ণাঢ্য সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য এত সন্নিকট হইতে সুকোমল পূর্বে দেখে নাই | তাহার অন্তরে যেন কোন সংযমের বন্ধন টুটিল | তাহার দৃষ্টি অপলক হইল | অবশ হাত হইতে সুরভির হাত স্খলিত হইল |

ঠিক এক মুহূর্তের অন্তরে অন্য তরুণীটি মুখ ঘুরাইলে সুকোমল তাহাকে দেখিয়া স্তম্ভিত হইল | দুই তরুণীর চেহারায় কিছু মিল হইলেও দ্বিতীয় জন লালিত্য হীন, বয়েসে মলিন | সুকোমল তাহাকে চিনিতে পারিয়া, অগ্রসর হইয়া, প্রণাম করিতে উদ্যত হইয়া কহিল, “কেমন আছ বকুল দিদি ?”

বকুল তড়িৎ বেগে পিছনে সরিয়া কহিল, “থাক, থাক !” তারপর সে কিঞ্চিত রুষ্ট কণ্ঠে প্রথম তরুণীটি কে কহিল, “তোর উচিত, সুকোমল কে প্রণাম করা |”

সে তাহার চপল মুখখানি সুকোমলের দিকে ঝুঁকাইয়া কৌতুকের সহিত কহিল,  “হ্যাঁ, ওনার একটা প্রণাম অনেক দিন ধরে তোলা আছে | তাই না, সুকোমলদা ?” সুকোমল অপ্রস্তুত হইয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আমি ... আমি তো ঠিক চিনতে পারলাম না |” সে কহিল, “ইস | বললেই হল ?” সৌদামিনী হাসিতে গদগদ হইয়া তাহাকে কহিল, “দেখলি, আমি জানতাম, ও তোকে চিনতে পারবে না |” তারপর সৌদামিনী সুরভি কে কহিল, “যা, তুই কাকু কে নিয়ে ভিতরে যা | আমি আসছি |”

কিছু পরে সৌদামিনী চা লইয়া আসিলে, সুকোমল কহিল, “ও কে ছিল, বৌদি | আমি তো চিনতে পারলাম না |”
সৌদামিনী – “তা তো হবেই | সেই কবে আট বছর আগে দেখেছিলে, তখন ওর বয়েস ছিল নয় |”
সুকোমল পালঙ্কে অর্ধ শায়িত অবস্থা হইতে সটান উঠিয়া কহিল, “বল কী বৌদি ? ও বকুলদি’র ছোট বোন পারু ?”
সৌদামিনী – “আজ্ঞে হ্যাঁ, মশাই | ও পারু | এক বছরের উপর হয়ে গেল, বিয়ে হয়ে গেছে |”
সুকোমল – “ও ! ... এই গ্রামেই ?”
সৌদামিনী – “হ্যাঁ, গ্রামেরই ছেলে |”
সুকোমল – “আর বকুল দিদি ?”
সৌদামিনী – “ওর বর শহরে থাকে | অবস্থা খুব একটা ভালো নয় | মাসে দুমাসে একবার আসে | ছেলেপুলে নেই | পিসিমা তো আগেই মারা গেছে | পিসেমশায়ও আজ যায়, তো কাল যায় | বকুলই পারুকে রেখেছে |”
সুকোমল – “রেখেছে মানে ? পারু কী শ্বশুরবাড়িতে থাকে না |”
সৌদামিনী – “না | বরটা জাহাজে কাজ করে | পারুলকে গ্রামে ফেলে রেখে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায় | আগে ছুটিতে বাড়ি এলে ওকে নিয়ে যেত | বর চলে গেলেই পারু বকুলের কাছে চলে আসত | এখন তো ছ’মাসের উপর বরটা বাড়ি আসে নি | শুনেছি পারুকে কোনও টাকা কড়িও পাঠায় না | তাই, শ্বশুর-শাশুড়ি মুখে কিছু বলে না, কিন্তু ছেলের বউকে রাখতেও চায় না |”
সুকোমল – “আর পারু ?”
সৌদামিনী – “পারুও ... মুখে কিছু বলে না | দেখলে তো, কেমন মুখে হাসি মাখিয়ে থাকে | যাকগে, তুমি এই সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী করবে ? যার ভাগ্যে যা জোটে ... এখন তো তুমিও কিছু করতে পারবে না |”
সুকোমল, “আমি ?” কহিতে গিয়া বৌদির কথার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত অনুমান করিয়া নিরস্ত হইল |

সেই রাত্রে সুকোমলের মনে একটি চিন্তা দেখা দিয়া তাহাকে বিমর্ষ করিল | সে যে এক মুহূর্ত পারুলকে অপলক দৃষ্টিতে দেখিয়াছিল, তাহাতে কি কোনও অবাঞ্ছিত আকর্ষণ কিম্বা কামনা ছিল ? নতুবা, বকুল দিদি কেন এত দূরত্ব বজায় রাখিয়া কথা কহিল ? সে তো গতবারের মত তাহাকে বাড়িতে আসিতে আমন্ত্রণ জানাইল না |

গ্রামে আরও দিন কয়েক কাটাইয়া সুকোমল এক প্রভাতে সুরভি ঘুম হইতে উঠিবার পূর্বে বাড়ি ফিরিয়া গেল | বড় রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষা করিতে করিতে সহসা তাহার মনে হইল বিগত আট বৎসরে তাহার মাঝে মধ্যে গ্রামে আসা উচিত ছিল | কত কী বেদনাদায়ক পরিবর্তন হইয়াছে, যাহার যাতনা গ্রামের সহিত সম্পর্ক রাখিলে এতটা দুঃসহ হয়ত হইত না |

পঁয়ত্রিশ বৎসর জামালপুরে রেলের ওয়ার্কশপে কাজ করিয়া, একদিন সুকোমল কর্মজীবন হইতে অবসর লইল | বিবাহের কয় বৎসরের মধ্যেই তাহার পত্নী বিয়োগ হইয়াছিল | একমাত্র পুত্র বোর্ডিং স্কুল হইতে পড়াশুনা করিয়া কলেজের পাঠ শেষ করিয়া কর্মে যোগ দিয়াছে | সে কিঞ্চিত বাউণ্ডুলে প্রকৃতির | ছুটিতে বাড়িতে না আসিয়া এদিক ওদিক ঘুরিয়া বেড়ায় | পত্র লিখিবার অভ্যাস সে কখনই করে নাই | মাঝে মধ্যে টেলিফোনের মাধ্যমে পিতার খবর নেয় | চাকুরীরত অবস্থায় সুকোমল স্টেশনের নিকটে একটি বাড়ি নির্মাণ করাইয়াছিল | কাজেই ঠাঁইয়ের অভাব তাহার হইল না | বাকি রহিল জন সম্পর্ক | তাহার জন্য সে রোজ ‘মর্নিং-ওয়াক’ এ যাইয়া স্টেশনে পৌঁছায় | সেখানে চা ও কাগজ লইয়া একটি বেঞ্চিতে বসিয়া কাগজ পড়ে, রেলগাড়ি ও যাত্রীর গমনাগমন দেখে | অপেক্ষা করে যে, কোনও পরিচিত অধস্তন কর্মচারীর সহিত দেখা হইলে, যদি কিছু পুরানো কথাবার্তা হয় | কিন্তু সে বোঝে যে তাহার কর্মব্যস্ত জীবনের নেপথ্যে তাহার অজান্তে সমাজে বহু পরিবর্তন হইয়াছে | মানুষ আর আগের মত নাই | দু’টি কথা হইতে না হইতেই যেন লোকে পলায়িত সময়ের পিছনে ছুটিবার জন্য উদ্যত হয় | অবশ্য, প্রতি বৎসর এক বার সুরভি স্বামী, পুত্র, কন্যা লইয়া আসে কয় দিনের জন্য | সেই কয় দিন আর সুকোমল স্টেশনে যায় না |

একদিন তাহার এক প্রাক্তন অধস্তনের সহিত এক হ্রস্ব বার্তালাপের পর সুকোমল তাহার দ্রুত প্রস্থানের দিকে তাকাইয়া অন্যমনস্ক হইলে, সহসা কেহ তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, “আরে, সুকোমল না |” সুকোমল চাহিয়া দেখিল তাহারই মত বয়েসের এক ভদ্রলোক,  পরিধানে ধুতি, জামা ও কোট | সুকোমল উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আমি তো ঠিক চিনতে পারলাম না |” ভদ্রলোক সহাস্যে কহিল, “আরে বসো, বসো | আমিও বসি | ক’দিন ধরে তোমাকে দেখছি, আজ ঠিক চিনতে পারলাম | আমি জযপুরের ভবতোষ |” ‘ভবতোষ, ভবতোষ ...’, চিন্তা করিয়াও সুকোমল মনে করিতে পারিল না | “আরে, সেই বাতাবি লেবু নিয়ে ফুটবল খেলা, ভুলে গেছ ?”, ভদ্রলোক মনে করাইবার চেষ্টা করিলেন | সাথে, সাথে সুকোমলের মনে পড়িল, গ্রামের ভবাইয়ের কথা – যাহাদের বাড়িতে একটি খর্ব ঝাঁকড়া বাতাবী লেবুর গাছ ছিল | তাহাতে অবিশ্বাস্য রকম বৃহৎ ও বিস্বাদ অজস্র ফল হইত | পাকিলে তাহার বাহিরে হালকা হলুদ রং ধরিত, কাটিলে দেখা যাইত ভিতরের রং  হালকা গোলাপি | ভবাই ফুটবল খেলায় জেদাজেদি করিত বলিয়া তাহাকে কেহ খেলায় লইত না | সে একাই একটি বাতাবী লেবু লইয়া সামনের মাঠে খেলিত | 

সুকোমল কহিল, “ভবতোষ মানে, তুমি ভবাই ? হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে |” তৎক্ষণাৎ তাহার মনে পড়িল সেই স্কুলের কালে শেষ বার যখন সে গ্রামে যায়, একদিন ভবাইয়ের সহিত খেলিয়া পায়ে লাগিয়াছে, খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে বাড়ি ফিরিতেছে, সহসা কেহ পিছন হইতে তাহাকে ডাকিলে সে পিছনে ফিরিয়া দেখিয়াছিল বকুল দিদি ও পারুল কে | সেই তাহার শেষ দেখা বালিকা পারুলের সহিত, যাহার মুখচ্ছবি তাহার আর মনে পড়ে না |

তাহার চিন্তা স্রোত থামাইয়া ভবতোষ কহিল, “তা, তোমার খবর কী ? মনে হয়, অবসর নিয়ে জামালপুরেই বাস করছ | বাড়িতে কে কে আছে ?” সুকোমল সংক্ষেপে তাহার পারিবারিক ইতিহাস অবগত করাইয়া কহিল, “তোমার কথা বলো |”
ভবতোষ জানাইল যে সেও বিপত্নীক | পুত্র জামালপুরে রেলের কন্ট্রাক্টর | এখনও বিবাহ হয় নাই | কথাবার্তা চলিতেছে | পিতা ও পুত্র স্টেশন হইতে কিছু দূরে রামপুর কলোনিতে থাকে | কোন কোন দিন কাজে আসিবার পথে পুত্র তাহাকে মোটরসাইকেলে স্টেশনে ছাড়িয়া দেয় | সে স্টেশনে প্রাতরাশ করিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে বাড়ি ফেরে | পথে দৈনিক বাজার  সারিয়া লয় |

কিছু পরে ভবতোষ উঠিয়া কহিল, “আজ তাহলে আসি | আশা করি মাঝে মধ্যে এই ভাবে দেখা হবে, গল্প করা যাবে |”

কয় মাসের ভিতর সুকোমল ভবতোষের সহিত গল্প-গুজবে গ্রামের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানিতে পারিল না | কিম্বা, যাহা জানিল তাহা বিশেষ কিছু নহে | সে জানিত যে গত দুই পুরুষে গ্রামের প্রায় সকল চেনা জানা লোকই গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিল | সুরভির বিবাহ হইলে তাহার দাদা ও বৌদি বেশি দিন বাঁচে নাই | তখন সুরভি গ্রামের বাড়িটি বিক্রি করিয়া দেয় |
ভবতোষ বাকি যাহাদের কথা কহিল তাহাদের কাহাকেও সুকোমল চিনিতে পারিল না | কিছুদিন তাহার ইচ্ছা করিল বকুল ও পারুলের কথা জিজ্ঞাসা করে | কিন্তু দ্বিধা বোধ করিয়া সে প্রশ্ন করা হইল না |

প্রায় এক বৎসর কাটিলে, একদিন ভবতোষ জানাইল তাহার পুত্রের বিবাহ স্থির হইয়াছে | কন্যার পিতা গ্রামেরই ছেলে, অধুনা মিহিজামে রেলে ‘সার্ভিস’ করে | ভবতোষ আগ্রহ প্রকাশ করিল যে সুকোমলকে বর যাত্রীতে যাইতে হইবে | সুকোমল কহিল, “না না | আমাকে আর ওই কচি কাঁচাদের দলে নিও না | রবি (ভবতোষের পুত্রের নাম) যাক না ওর বন্ধু বান্ধব নিয়ে |” ভবতোষ অনেক অনুরোধ করিয়াও তাহাকে রাজী করাইতে পারিল না | শেষে ভবতোষ কহিল, “এত যে গ্রামের এর ওর খোঁজ খবর নাও, বিয়েতে গেলে গ্রামের কিছু না কিছু চেনা মুখ দেখতে পেতে | এক রাতের তো ব্যাপার | মেয়ের বাবা স্টেশনে থাকার ব্যবস্থা করছে | কী ভাবে জানি না | তবে যা শুনছি, যোগাড় যন্তর করে একটা রিটায়ারিং রুম আর একটা ডরমিটরি পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে | চলো চলো, আর আপত্তি কোরো না |” সুকোমল কহিল, “দেখি, ভেবে দেখি |” সে কহিতে পারিল না যে তাহার পত্নী বিয়োগের পর সচরাচর সে বিবাহের নিমন্ত্রণে যাইতে পছন্দ করে না |

সেইদিন সুকোমল স্টেশনে বসিয়া ভাবিয়া কুল পাইল না যে সে কাহাকে দেখিতে চায় | ভবতোষের কথা হইতে সে জানিয়াছিল যে তাহার সমসাময়িক গ্রামের চেনা জানা প্রায় সকলেই প্রবাসী হইয়াছে, কেহ কেহ পরলোকেও গমন করিয়াছে | কেবল বকুল দিদি ও পারুলের কথা সে জানে না | বকুল দিদির বয়েস নিশ্চয় চৌষট্টি পঁয়ষট্টি হইবে | সে কি আর বাঁচিয়া আছে ? আর পারুল – সে নিশ্চয় এতদিনে স্বামীর সহিত অন্য কোথাও সুখে ঘর করিতেছে |

বিবাহের দুই দিনে পূর্বে এই অসহ্য অধীরতা হইতে মুক্তি পাইতে সে ভবতোষ কে জানাইল যে সে বিবাহে যাইবে না, তবে বৌভাতে অবশ্যই যাইবে |

বৌভাতের দিন এই কার্যে ওই কার্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখিয়া সে যখন ভবতোষের বাড়ির নিকট ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব’ এ পৌঁছাইল তখন রাত প্রায় সাড়ে নয়টা | রাস্তার ধরে উচ্ছিষ্টের ঢিপি দেখিয়া বোধ হইল বেশ কিছু অতিথি আসিয়া চলিয়া গিয়াছে | তথাপি লোক প্রচুর, যাহাদের পোশাক ও ইতস্তত হাবভাব হইতে আন্দাজ করা যায় যে তাহারা গ্রাম্য | সে ভবতোষ কে খুঁজিয়া পাইয়া কহিল, “কই, কোথায় ছেলে, আর ছেলের বউ |” ক্লাবের হলঘরে খাওয়ার আয়োজন ছিল | তাহার পার্শ্বে একটি ছোট কামরায় এক মঞ্চে বসানোর ব্যবস্থায় বর-বধূ আসীন | সুকোমল মঞ্চে যাইয়া বর-বধূ কে আশীর্বাদ করিয়া নববধূর হাতে উপহার দিয়া রবির সহিত কিছু কথা কহিয়া নামিয়া আসিল | তারপর সে কোনদিকে যাইবে, কী করিবে, ভাবিতেছে, এমন সময় ভবতোষ তাহাকে পিছন হইতে কহিল, “দেখ তো, সুকোমল, একে চিনতে পার কিনা ?” কে ঘুরিয়া দেখিবার পূর্বেই পিছন হইতে তাহার সামনে আসিয়া দাঁড়াইল এক প্রৌঢ়া, পরিধানে সরু নীল পাড়ের সাদা সুতি শাড়ি, ও সাদা ব্লাউজ | ফেস পাউডারের আতিশয্যে রুক্ষ তাহার চেহারায় যায়-যায় সৌন্দর্যের যে ছটা এখনও অবশিষ্ট তাহাতে এক নজরে বেশিক্ষণ তাকানো সম্ভব নহে |

চেহারাটি চেনা চেনা মনে হইলে সুকোমল প্রণাম করিতে যেই নত হইল, মহিলাটি কহিল, “ছি ছি, এ কী করছেন | আমি যে আপনার চেয়ে ছোট |” সুকোমল বিস্মিত হইয়া কহিল, “পারুল ?” সে ম্লান হাসিয়া কহিল, “যাক ! আপনি ভেবেছিলেন বকুল দিদি, তাই না ?” সুকোমল বিব্রত মুখে কহিল, “না মানে, ... তা, বকুলদি কই ?” |
পারুল – “দিদি তো আর নেই ?”
সুকোমল – “সে কী ?”
পারুল  – “হ্যাঁ, দিদি, জামাইবাবু অনেক বছর হল মারা গেছে | আপনি জানতেন না ?”
সুকোমল – “ও, ... না, আমি জানতাম না, ... আর তুমি, তুমি কেমন আছ ? কোথায় আছ তোমরা ?”
পারুল  – “বর্দ্ধমানে থাকি | একটা স্কুলে পড়াই |”
সুকোমল – “তোমার বর ? সে কই ? ডাকো তাকে, আলাপ করি |”

পারুল তাহার দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে চাহিয়া কহিল, “আমার বর ? দাঁড়ান, আগে আমি আপনাকে প্রণাম তো করি |” সুকোমল দেখিল পারুলের কপালে সেই বড় সিঁদুরের ফোঁটা জ্বলজ্বল করিতেছে | সিঁথিতেও দু’কুল ছাপাইয়া চওড়া সিঁদুরের রেখা | সে দ্রুত পিছনে সরিয়া কহিল, “থাক, থাক | পায়ে হাত দিতে হবে না | তুমি খেয়েছ ?”

তৎক্ষণাৎ পিছন হইতে ভবতোষ কহিল, “সুকোমল, চলো খেয়ে নেবে | অনেক রাত হয়েছে | আমি বলি কী,  আজ রাতটা এখানে থেকে যাও | এইরকমই চেনা জানা লোকের সাথে গল্প স্বল্প করে সকালে চলে যেও, না হয় | শোয়ারও ঢালাও ব্যবস্থা আছে | চাইলে চোখ বুজে একটু গড়িয়ে নেবে |”

সত্যই, খাইতে খাইতে রাত বারোটা হইয়া গেল | এত রাত্রে গাড়ি-ঘোড়া কম, আর নির্জন মধ্যরাত্রে যাতায়াত ও সমীচীন নহে | তদুপরি, সুকোমলের মনে হইল, পারুলের বরের সহিতও আলাপ করা হয় নাই | সে পান খাইতে খাইতে বাহিরে রাস্তায় পায়চারী করিতেছে, এমন সময় ভিতরের মৃদু গুঞ্জন ছাপাইয়া হারমোনিয়ামের আওয়াজ শোনা গেল, কেহ গাহিতে লাগিল, “ভাঙা দেউলে মোর কে আইলে আলো হাতে / বলে দিল কে পথ, এ কালো রাতে” | সহসা কিসের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হইয়া সুকোমল দ্রুত পায়ে ভিতরে আসিল | দেখিল, সেই মঞ্চে বসিয়া পারুল গান গাহিতেছে | সাথে একজন অলস ভাবে হারমোনিয়াম বাজাইতেছে | তবলচি যে সে চুপ করিয়া বসিয়া আছে | সম্মুখে মেঝেতে শতরঞ্জি পাতিয়া শ্রোতারা বসিয়া শুনিতেছে | সে ও পিছনের সারিতে দেয়ালে হেলান দিয়া বসিয়া পড়িল |

আরও এক দুইটি গান গাহিয়া পারুল উঠিয়া চলিয়া গেল | তাহাকে আর দেখা গেল না | গান বাজনা চলিতে থাকিল | রাত্রির সাথে সাথে শ্রোতারা ক্রমে ক্রমে নিঝুম হইল | কেহ কেহ শুইতে চলিয়া গেল | কখন তাহারও চক্ষু নিমীলিত হইল, নিদ্রা তাহাকে গ্রাস করিল, সুকোমল টের পাইল না | ঘুমে কাতর হইয়া সে ঢলিয়া পড়িল, সেই ভাবেই রহিল, যতক্ষণ না কেহ আসিয়া তাহাকে ডাকিল | সে দেখিল মঞ্চ খালি, মেঝেতে এক আধ জন তাহারই মত নিদ্রামগ্ন | যে চাকর ধরনের ব্যক্তিটি তাহাকে ডাকিয়াছিল সে কহিল, “বাবু, এক দিদি আপনাকে ডেকে দিতে বললেন |” সুকোমল কহিল, “কে ?” চাকরটি কহিল, “তা তো জানি না | দিদিমণি খালি বললেন আপনাকে ডেকে খবর দিতে যে উনি চলে যাচ্ছেন |”

সুকোমল দ্রুত হাতে মুখে চোখে জল দিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল ভোরের আলো সবে ফুটিতেছে | প্রকৃতি তখনও নিস্তব্ধ, কাক পক্ষীর কোলাহল শুরু হয় নাই | রাস্তায় একটি রিক্সা ডাকিয়া তাহার উপর একটি স্যুটকেস রাখিয়া সেই চাকরটিই পাশে দাঁড়াইয়া আছে | ক্লাবের গেটের নুড়ি ঢাকা পথে অবগুণ্ঠিতা এক মহিলা, পরিধানে সেই সরু নীল পাড় সাদা তাঁতের শাড়ি | সুকোমলের ক্ষিপ্র পদক্ষেপে নুড়ির কর্কশ শব্দ শুনিয়া পারুল তাহার দিকে মুখ ফিরাইল | ভোরের মৃদু হওয়ায় হিল্লোলিত তাহার চূর্ণকুন্তল  দেখিলেও, সুকোমল লক্ষ্য করিল তাহার দুই চক্ষু নিদ্রার অভাবে ফোলা, ও লাল | তাহার নিকট পৌঁছাইলে, পারুল নিম্ন স্বরে কহিল, “সুকোমলদা, আমি আসি | কত দিন পরে আপনার দেখা পেলাম, আর, আবার কবে দেখা হবে জানি না | তাই ডেকে পাঠালাম | এই হয়ত শেষ দেখা |”
সুকোমল – “না, না | তা হবে কেন ?”
পারুল – “কে জানে, ... তাই, একটা শেষ কথা ... ”
সুকোমল – “কী ? ... কী শেষ কথা ?”
পারুল – “সেই  ... সেই অনেক দিনের তুলে রাখা প্রণামটা যদি আজ আপনি গ্রহণ করেন |” তাহার কণ্ঠে দ্বিধা | তবুও, সে সুকোমলের উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া চট করিয়া নত হইয়া তাহার পা স্পর্শ করিয়া অবগুণ্ঠন সরাইয়া মাথায় হাতখানি  ঠেকাইল | সুকোমল দেখিল সেই হাতের মণিবন্ধ আভরণ হীন | সে হেঁট মাথা উঠাইলে সুকোমল তাহার মাথায় হাত রাখিতে গিয়া যে শূন্যতা দেখিল, তাহাতে স্তম্ভিত হইয়া কহিল, “এ কী করেছ, তুমি ?”

পারুলের সিঁথি শূন্য, কপালে সিঁদুরের টিপটি ও নাই | সে অবগুণ্ঠনের কাপড়  গলবস্ত্রের মত টান করিয়া গলায় জড়াইয়া আঁচলের প্রান্ত দিয়া যেন বুকের ওঠাপড়া ঢাকিল | কহিল, “কাল রাত্রে আমার মনে হয়েছিল, কি জানি হয়তো সেটা ভুল চিন্তা, যে সধবার চিহ্ন নিয়ে আপনাকে প্রণাম করার যোগ্য আমি নই | তাই ... আচ্ছা, এবার আমি আসি ?”

তারপর ধীর পায়ে রাস্তা পার হইয়া রিক্সায় উঠিয়া সে কহিল, “আপনি ভালোয় ভালোয় থাকবেন |”
রিক্সা রওয়ানা দিল |


------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩০ অক্টোবর ২০১৪




বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৪

আঙ্গুলে আঙ্গুলে

|| আঙ্গুলে আঙ্গুলে ||


তোমার ছিটে লাল জাফরানি
হাতের পাতায়, আঙ্গুলে পাই
স্নেহে ঘেরা আলগোছ মিষ্টত্ব
চেঁছে নেয়া ঘি মাখা শিরার ;
আর কর্পূর, নাকি এলাচের
ফিরে আসা ভবঘুরে সুরভি

এ সবের খুব গভীরে সেঁচলে
নোঙ্গরের নোনা নোনা স্বাদ ;
বিষুবরেখায়, সমুদ্রের বুকের
উস্কানো ধিমে আঁচের উত্তাপ

সুগন্ধি সিনামন স্টিকের ঝাড়
কোথায় লাগে তার কাছে ?

যে করকমলে তুমি গড়েছ
আমার প্রিয় মতিচুর লাড্ডু
মুছতে, মুছতে চোখের ধারা
খুঁটিয়ে খতিয়ে দেখি তাতে
ঘি, শিরা, স্বেদের মাখামাখির
সহবাসে, এক মূক ভালবাসা ||


---------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৯ অক্টোবর ২০১৪

মনের মানুষ

|| মনের মানুষ ||


মনের মানুষ, সেরের দরে
বিক্রি হয় সব হাট বাজারে

তাও তো ফুটো বাটখারায়
বাকিটা যায় ডান্ডি মারায়

মনের মানুষ খুঁজতে হলে
না বসে, যাও দৌড়ে চলে

যাও গে বাটখারার দোকানে
দেখবে তারই একটি কোনে

ঘাপটি মেরে বসে গোপনে
লোকটা শুধু টাকাই গোনে

তার যে আছে ঢাকাই বোন
পেল্লায় শরীর, কয়েক মোন

চেহারা যদিও ফানুস, ফানুস
সত্যি সে বেশ মোনের মানুষ ||


---------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৯ অক্টোবর ২০১৪

মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৪

পেন্থেসিলিয়া

|| পেন্থেসিলিয়া ||


মাদলের তালে নাচে নারীরা, সাঁওতাল
করে করে গেঁথে তাদের দেহ একতাল

শিকারি পুরুষ খোঁজে এক গজগামিনী
সেই অভেদ্য ব্যূহে, যে তত বশ হয়নি

ভাবে, ঐ শৃঙ্খলের মধ্যমণি রণোন্মত্তা
পেন্থেসিলিয়া হতে, হবে কি সংক্রমিত
পোক্ত আমাজন যোদ্ধা নারীর মাদকতা
ধমনীতে, তার স্ত্রীর, নিরাসক্ত প্রান্তিকা

নিশীথে কার নেশায় হবে আত্মসমর্পণ
অম্ল মহুয়ার রস, না কি গজানীক রমণ

থামে না মাদল, না উন্মত্তা
পেন্থেসিলিয়া
নৃত্যের তালে উত্তাল নারী দেহ একতাল
করে শিকার, চক্ষুহীন এক পুরুষ মাতাল ||


--------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৮ অক্টোবর  ২০১৪

সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৪

প্রত্যাবর্তন

|| প্রত্যাবর্তন ||


তোমার রূপ কাল দেখি নাই,
আজ হয়ে গেছে বড় দেরী
যাবার সময় নিকটে এসেছে
ঘাটে লেগেছে ফেরার ফেরী

কেন এসেছিনু ফিরতি টিকিট
আগে ভাগেই কেটে নিয়ে
সারাটা প্রমোদ-ভ্রমণ মাটি,
ফেরার চিন্তা রহিল ঘনিয়ে

এবার বলো আবার কবে সব
সাজ ছেড়ে হবে নিরাভরণ
কাটিব এপারে ফিরতি টিকিট
ফিরিব, ভরে নিতে দু’নয়ন ||


--------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৭ অক্টোবর ২০১৪

রবিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৪

পিঠোপিঠি

|| পিঠোপিঠি ||


আয় না, বসে, পিঠে পিঠ ঠেসে, আজ হয়ে যাই পিঠোপিঠি
আয়নায় মুখ ভেংচে, আয় না, হেসে হেসে করি হুটোপুটি

সেই কোন কালে, হেঁটে মাঠে আলে, গিয়েছিনু পাঠশালে
আজ নেই আর, পাততাড়ি তার, সব পাঠও গিয়েছি ভুলে

শুধু মনে পড়ে ...
শুয়ে ঘাসফুলে, খোলা তোর চুলে, ভেলভেটি পোকা ধরা
হাত দিয়ে তোর, শিহর-বিভোর, গা’টা ছোঁয়া আগাগোড়া
আলপনা দেয়া তোর হাত শুঁকে, বুকে ভরা পিটুলির গন্ধ
অচিন্ত্য তোর আঁখি টিপে ধরে ভাবা আমি নিজে কত অন্ধ
শিশিতে বন্দী জোনাকি পোকার আলো দেখে করা বিশ্বাস
চোখে কি কাঁপে, পলকের ঝাঁপে বন্দী দীপালী ভিসুভিয়াস
খেলবার ছলে জোচ্চুরি বলে জোর গলায় তোকে হারিয়ে
জেতা কড়ি সব, তোর পদ পল্লবে আমিই দিয়েছি সাজিয়ে
বিজিতা অসহায়, লক্ষ্মীটি পায়, তুই তখন গুটি গুটি হেঁটে
কেঁদেছিস রুখে, আমার বুকে অলক্ষুণে এক আঁচড় কেটে

এত গায়ে লেগে, কণ্ঠনালীতে আবেগে,  ঘনাত অচিন ভয়
কখন নিভৃতে, যদি যাস জিতে – আর, হয় আমার পরাজয়
তখন রাশি বসন্ত-হলুদ উড়ন্ত অশ্বত্থ পাতার পিছু পিছু ছুটে
মনে হত কেন, কী কথা যেন, বলি নি যে তোকে মুখ ফুটে
সে’সব কথার স্মৃতি আজ আবার পাক দেয় মনে ঘুরে ফিরে
আয় ভাই তাই, পিঠোপিঠি হই, বসে এই হেমন্তের রোদ্দুরে

মুখোমুখি বসে, চোখে চোখ রেখে, যদি আড় ভেঙ্গে যায়
তার চেয়ে চল, আড়াআড়ি হয়ে, মুখ চুরাই হাত আয়নায় ||


------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৯ অক্টোবর ২০১৪

বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৪

প্রার্থনা

|| প্রার্থনা ||

তোমার কপালে সিঁদুর দেখে ভরসা পেয়েছিলাম
যে, এবার নিবিড় করে পরকীয়ার প্রেম করা যাবে
সে জানবে না, অগোচরে তুমি আমার এঁটো হবে
তোমার সারা গায়ে, ঠোঁটে, কপালে, গ্রীবা তলে
আমার স্বেদে তোমার সধবা সুস্বাদ হবে লবণাক্ত
তোমার ফুলশয্যার রাতের তৃপ্ত কামনার সব ছবি
মুছে গিয়ে বিবশ চোখের তারার আয়না হবে রিক্ত
বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝরে এই শরীরের রোমকূপে ঢুকে
তুমি আমার হবে, আর কেউই পাবে না তোমাকে

তাই বলেছিলাম বড় করে সিঁদুরের ফোঁটা পরতে
আঁকতে রক্তিম পায়ে গাড় অলক্তকের আলপনা
বাহুতে, গ্রীবায় করতে ধারণ, আছে যত স্বর্ণাভরণ
আঁখিতে উদ্দীপ্ত প্রদীপ শিখার  আলোর প্রতিবিম্ব
ঘিরে মোহিনী মায়াজালের মত কাজল, সদ্য গরম,
লেপে, লুকাতে ফিনফিনে মলমলের স্বচ্ছ মোড়কে
কামনায় জর্জরিত, আরোহণ আকাঙ্ক্ষিণী দেহলতা

শুধু সূর্যমুখী ঠোঁট  রেখে ওদেরই মতন, আর্দ্র নরম
নিষিক্ত হতে উৎসুক তৃষিত চাতকের মত ঊর্ধ্বমুখী

কিন্তু কী হল, আমি থেকে থেকে তোমার অপেক্ষায়
জানলাম সিঁদুরে যাকে দেখেছি, সে তোমার আত্মজা
তবে কি সাজবে না, তুমি, আসবে না আমার কাছে ?
প্রেপ্সু আমি যে যোজনা করেছি আমার হিমানী ননী
তোমার ক্ষমায়, তোমার শরীরের উত্তাপে গলাতে ||


--------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৫ অক্টোবর ২০১৪

মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪

স্বৈরিনী

|| স্বৈরিনী ||

পিতার গ্রামবাসী বাল্যবন্ধু রঘুনাথের সহিত বৎসরে একবার, অধিকতর গ্রীষ্মকালে, গ্রাম-দেশে ছুটি কাটাইতে গেলে সাক্ষাত হইত । পিতা গ্রামের স্কুলে বেশিদিন পড়াশুনা করেন নাই । নিম্ন শ্রেণীতেই পিতামহ তাঁহাকে সদরে এক ধর্মীয় মহারাজের আবাসিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়াছিলেন । সেথা হইতে ম্যাট্রিকে উত্তীর্ণ হইয়া পিতা কলিকাতার এক কলেজে যোগ দেন । পরবর্তী কালে তিনি বিহার প্রদেশে চাকুরীরত হন । এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার আন্দাজ যে, রঘুকাকা পিতার অতি শৈশবের বন্ধু  ছিলেন ।

প্রায়শই আমাদের যাত্রা এইরূপ হইত যে আমরা গ্রামে রাত্রিকালে পৌঁছাইতাম । পরবর্তী এক দুই দিনে পিতামহের সহিত যত প্রয়োজনীয় (ও কিছু অপ্রয়োজনীয়) কথাবার্তা সম্পন্ন হইলে, এক সকালে প্রাতরাশ সমাধা করিয়া, পিতা রঘুকাকার সহিত সাক্ষাতের জন্য রওয়ানা হইতেন । পিতার নিষ্ক্রমণের পর আমি ইচ্ছামত আচরণ-বিচরণের স্বাধীনতা পাইতাম । পিতামহের বাটীতেই বড় জেঠা বাস করিতেন । তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র জগবন্ধু, ডাকনাম জগা, বয়েসে আমার অপেক্ষা কয়েক বৎসরের বড় হইলেও আমার বন্ধু ন্যায় ছিল । আমার মেজ জ্যাঠা, যিনি কৈশোরেই পিতামহের সহিত নিত্য বাদ-বিতণ্ডার ফলে এই বাটী ত্যাগ করেন, নিকটেই নিজস্ব বাটীতে বাস করিতেন । আমার প্রায় সমবয়সী তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র মহারাজ, ডাকনাম মহা, সে ও আমার বন্ধু ছিল । এই দুইজনের সহিত আমার খেলাধুলা চলিত, যতক্ষণ না পিতা বাটীতে প্রত্যাবর্তন করিতেন । অতঃপর তিনি আমাকে গ্রামের নদীতে স্নান করিতে লইয়া যাইতেন । কদাচ, অত্যধিক রৌদ্র, অথবা সময়ের অভাব হইলে বাটীতেই কূপের জলে স্নান হইত । তাহা আমার বিশেষ পছন্দ ছিল না ।

রঘুকাকা ছিলেন কৃশকায়, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ । তাঁহার সর্বদা সংকুচিত আননে লক্ষ্য করিবার মত ছিল ক্ষুদ্র তীক্ষ্ণ নাসিকা, ও তাহার নিচে চার্লি চ্যাপলিন ঢঙে ছাঁটা গুম্ফ, যাহা দেখিয়া বোধ হইত নাসিকা হইতে কিছু নির্গত হইয়া জমিয়া গিয়াছে । তাঁহার কুঞ্চিত ললাটের উপর অত্যন্ত তৈলাক্ত কোঁকড়ান কিছু কেশদাম সর্বদাই অবিন্যস্ত ভাবে পড়িয়া থাকিত । গভীর কোটরে অবস্থিত তাঁহার চক্ষু দুইটি ছিল লম্বা কৃষ্ণ পলকে আচ্ছাদিত । তাঁহার চোখ পিটপিট করার মুদ্রাদোষে পলকগুলি অসহায় ভাবে অনবরত উঠানামা করিত । এই সব কারণে তাঁহার চেহারা, অন্তত আমার মনে, এক অদ্ভুত করুণার উদ্রেক করিত । তিনি গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করিতেন । শুনিয়াছি, তাঁহার প্রচুর চাষের জমিজমাও ছিল । কিন্তু এই দুইয়ের উপার্জন সত্যেও কোন কালেই তাঁহার অবস্থায় সচ্ছলতা আমি দেখি নাই । তিনি সর্বদা পরিধান করিতেন ফিতা বাঁধা সাদা ফতুয়া, ও আজানু ধুতি, যাহারা কখনই সাবানের মুখ দেখে নাই । তাঁহার পায়ে খয়েরি রঙের ক্যাম্বিসের জুতা, ও বগলে একটি অতি পুরাতন ছাতা থাকিত । এই বিবর্ণ, প্রায় ক্যাম্বিসের জুতার রঙের ছাতাটি তাঁহাকে প্রখর রৌদ্রেও কখনও ব্যবহার করিতে দেখি নাই ।

রঘুকাকার ভিটা পিতামহের বাটীর অতি সন্নিকটে ছিল । সেই ভিটাতে একটি স্খলিত-প্লাস্টার ইটের বিকশিত-দন্ত শোভিত কয় কামরার বড় গৃহ, তাহার পার্শ্বে একটি মাটির বড় কুটির, ও কয়েকটি ধানের গোলা ছিল । আমি অত্যন্ত শৈশবে হয়তো পিতার সহিত রঘুকাকার ভিটাতে এক-আধ বার পদার্পণ করিয়াছি । কিন্তু, ক্ষীণ স্মৃতি হইতে মনে পড়ে না যা তাঁহার বাটীতে কখনও প্রবেশ করিয়াছি । পিতামহের বাটীর সদরের রাস্তা দিয়া বাম দিকে কিছু দূর যাইলে, রঘুকাকার বাটী ও তৎসংলগ্ন আম বাগানের পরেই আসিত ‘তেঁতুলতলা’ নামক এক চৌমাথা, যেখানে এক বিশাল তেঁতুল বৃক্ষ তলে এক উচ্চ মাচান ছিল । চৌমাথা হইতে কিঞ্চিত অগ্রসর হইলে কিছু আনাজ, মুদি ও কাপড়ের দোকানের বাজার ছিল, এবং তাহার পর আমার দুই পিসা-মহাশয়ের বাটী, একের পর এক । পিতা বাটীর বাহিরে গেলে কোন কারণে তাঁহাকে ডাকিতে আমাকে ওই চৌমাথা কি বাজার অব্দি যাইতে হইত । তেঁতুলতলার মাচানে উপবিষ্ট এক বা একাধিক গ্রামের প্রবীণ ও অশীতিপর বৃদ্ধ তামাকু সেবন ও পরচর্চায় রত থাকিতেন । সর্বদাই তাঁহাদের কাছে পিতার গতিবিধির খবর পাওয়া যাইত । ইহা মনে পড়ে না যে তাঁহাকে পাইতে কোনদিনই রঘুকাকার বাটী গিয়াছিলাম ।

পিতা কোন কালেই রঘুকাকা সম্বন্ধে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন নাই । উভয়েই সর্বদা অত্যন্ত মৃদু স্বরে কথাবার্তা করিতেন,  রঘুকাকা কেবল পিতার প্রশ্নের উত্তরে । সর্বপ্রকারে অত্যন্ত শহুরে আমার পিতা ও নিতান্ত গ্রাম্য রঘুকাকা, উভয়েই মিতভাষী – এই দুইজনের মধ্যে কী ভাবে এত অন্তরঙ্গতা সম্ভব হইয়াছিল তাহা কোনদিন জানিতে পারি নাই । কদাচিৎ রঘুকাকা পিতার সহিত দেখা করিতে পিতামহের বাটীতে আসিলে মাতাকে ‘বৌদি’ সম্বোধন করিতেন । বোধ হয় সেই কারণেই আমি তাঁহাকে কাকা ডাকিতাম । রঘুকাকাকে অভ্যর্থনা করিলেও, রঘুকাকার পরিবার সম্বন্ধে মাতাকে কোনও প্রশ্ন করিতে শুনি নাই । এক কথায় বলা যায় যে রঘুকাকা সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানিতাম না । অতএব, জানিবার আগ্রহ দিনে দিনে প্রবলতর হওয়াই স্বাভাবিক ছিল ।

জগা ও মহার দৌলতে রঘুকাকা সম্বন্ধে যে টুকু জানিতে পারিয়াছিলাম তাহা বিশেষ কিছু নহে । ক্রমে ক্রমে আমার ধারণা হয় যে রঘুকাকা দৃশ্যত লাজুক প্রকৃতির হইলেও, আসলে তিনি নিতান্ত অসামাজিক ছিলেন । কী কারণে অসামাজিক তাহা না জানিতে পারিলেও, এক সময় কোন সূত্র হইতে অবগত হই যে রঘুকাকার স্ত্রী বহু বৎসর পূর্বে অগ্নিদগ্ধ হইয়া মারা যান । অতঃপর রঘুকাকা আর বিবাহ করেন নাই, ও তাঁহার পরিবার বলিতে কিছুই ছিল না । আসা যাওয়ার পথে তাঁহার বাড়িতে সচরাচর অন্যজন কাহাকে না দেখিলেও, একাধিক বার এক সুঠাম দেহের মহিলাকে দেখিয়াছি, যে সর্বদা এক লাল-পেড়ে সাদা শাড়ি পরিয়া গেরস্থালীর কার্য করিত । ঘোমটা সত্যেও তাহার সাবলীল সুনিপুণ অঙ্গ সঞ্চালনে ঢেঁকিতে ধান কোটা কি প্রাঙ্গণের নানাবিধ কাজ দেখিয়া বোধ হইত যে সে দৃঢ় অথচ কুশলী হস্তে রঘুকাকার সংসারের রক্ষণাবেক্ষণ করে । শিক্ষক হিসাবেও রঘুকাকার বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল বলিয়া জানা নাই । নিঃসন্দেহে ছাত্রদের মধ্যেও তিনি বিশেষ প্রিয় ছিলেন না । পথে ঘাটে, কখনও দেখা হইলে দেখিতাম তিনি মাটিতে চক্ষু রাখিয়া পথ চলিতেছেন । বোঝা যাইত যে অন্য জনের সহিত, সে ছাত্রই হউক না কেন, কোন প্রকার অভিনন্দনের কিম্বা দৃষ্টির আদান প্রদান তাঁহার পছন্দ ছিল না ।

রঘুকাকার সহিত পিতার কথোপকথনের দুইটি বিশেষ বিষয়বস্তু ছিল । প্রথমটি ফুটবল সম্বন্ধিত – গ্রীষ্মকালে যথেষ্ট সংখ্যক প্রবাসী বন্ধুর গ্রামে সমাগম হইলে একটি প্রবাসী বনাম স্বদেশী (অর্থাৎ গ্রামবাসী) ফুটবল প্রতিযোগিতা হইত – রঘুকাকা ইহার জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও আয়োজন করিতেন । দ্বিতীয়টি চাষবাস সংক্রান্ত – পিতা চাকুরীর আয় হইতে সঞ্চিত অর্থে গ্রামের আশেপাশে কিছু চাষের জমি খরিদ করিয়াছিলেন – যাহার তদারকির ভার তিনি রঘুকাকার উপর সঁপিয়াছিলেন । এই দুই কারণে, পিতার সহিত রঘুকাকার কথোপকথন হইতে প্রায়শই ‘ফুটবল’, ‘ম্যাচ’, ‘ভাগচাষী’, ‘ফসল’ ইত্যাদি শব্দ কানে আসিত । বলা-বাহুল্য, ইহাতে আমার তীব্র কৌতূহল প্রশমিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না ।

‘তেঁতুলতলা’ যাইবার পথে, ঠিক চৌমাথার পূর্বে, বাম দিকে রঘুকাকার বাটী ও তৎসংলগ্ন আম বাগানটি ছিল । চৌমাথা পৌঁছাইলে, দক্ষিণ দিকে ঘাটে যাইবার পথের কোনে ওই বাগানের ঠিক বিপরীতে একটি টিনের চালার পাকা বাটী ছিল । উভয় রাস্তা হইতে দৃশ্য তাহার একটি মাত্র জানালা সর্বদা বন্ধ দেখা যাইত । তাহার প্রবেশ-দ্বার পিছন দিকে চক্ষুর আড়ালে ছিল । ওই বাটীতে সচরাচর কোনও প্রাণের লক্ষণ দেখিতে না পাইলেও, তাহার বেড়া হীন, কিছু পুষ্পিত মাধবীলতা ব্যতীত রিক্ত, পরিষ্কার আঙ্গিনা দেখিয়া বোধ হইত যে অবশ্যই কেহ বাস করে । ওই জনহীন বাটীর পরিবেশে এক অদ্ভুত পয়মন্ত আবহাওয়া ছিল যাহা আমাকে চরম ভাবে আকর্ষিত করিত । যেন স্বয়ং লক্ষ্মী দেবী আসিয়া সংসারের কাজ গুছাইয়া ফিরিয়া গিয়েছেন । কে সেই বাটীতে বাস করিত জানিতে চাহিলে জগা ও মহা উভয়েই একে অপরের মুখে চাহিয়া, মৃদু হাসিয়া, সে প্রশ্ন এড়াইয়া যাইত । পরবর্তী কালে, জগার নিকট জানিতে পারি যে ওই বাটীতে গ্রামের এক ‘সঈর্নি’ (গ্রাম্য ভাষায় কুশীলা স্ত্রী, সম্ভবত স্বৈরিণী শব্দের অপভ্রংশ) বাস করিত, যাহাকে দিনের আলোকে কেহ কখনও দেখে নাই । কোনও স্ত্রীলোক এই ভাবে অসূর্যস্পশ্যা হইয়া কী প্রকারে একাকী বাস করিতে পারে তাহা আর জানা হয় নাই, কেন না এই জ্ঞান আহরণের কিছু পরেই কলেজে যোগদান করিলে, গ্রীষ্মের অবকাশে আমি বাড়ি আসিয়া আর কোথাও যাইতাম না । পিতা মাতা বৎসরের অন্য অনুকূল সময়ে গ্রামে যাইতে শুরু করেন । ইহার পর আমি দূর দেশে চাকুরীরত হইলে চিরকালের মত আমার গ্রামে যাওয়া ঘুচিয়া গেল ।

আমার বিদ্যালয়ে পাঠকালীন পিতামহ প্রয়াত হইয়াছিলেন । ক্রমে ক্রমে পিতামহী, বড় জেঠা ও জেঠিমা পরলোক গমন করিলেন । জেঠতুত ভাইয়েরাও একে একে গ্রাম ত্যাগ করিল । জমির ফসল বিক্রয়ের পয়সা সংগ্রহ করিতে পিতা অবশ্য মাঝে মাঝে গ্রামে যাইতেন, এবং বহুকাল যাবত রঘুকাকার সহিত তাঁহার পত্রালাপ চালু ছিল । সেই পত্র গুলিতে – সবই সংক্ষিপ্ত পোস্টকার্ড – দেখিতাম রঘুকাকা জমির ফসল বিক্রয়ের হিসাব ব্যতীত বিশেষ কোন কথা লিখিতেন না । শেষে, পিতা তাঁহার মৃত্যুর কয় বৎসর পূর্বে তাঁহার গ্রামের সকল জমি ও পিতামহের বাটীর অংশ মুসলমান ভাগচাষীদের কাছে বিক্রয় করিয়া দেন ।

গত বৎসর আমি চাকুরী হইতে অবসৃত হইলে, প্রাপ্ত পর্যাপ্ত অবসর লইয়া যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম, যে কী এমন কাজ আছে যাহা চাকুরীরত হইয়া করি নাই । তখন মনে হইল একবার গ্রাম দেশ হইতে ঘুরিয়া আসিলে কেমন হয় । আমার শেষ গ্রাম যাত্রা হইয়াছিল প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর পূর্বে । কিন্তু, প্রশ্ন – কয় দিনের জন্য যাইব, ও কোথায় থাকিব ? সৌভাগ্যক্রমে জানিতে পারিলাম যে পিতামহের বাটীর বড় জেঠার অংশ এখনও বর্তমান, এবং তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র দীনবন্ধু তাহা বিক্রয় করিবার জন্য সেই বাটীতেই বসবাস করিতেছেন । আমার এই ‘দীনুদা’ আমার অপেক্ষা প্রায় দশ বৎসরের বড় ছিলেন । যে কালে আমি গ্রামে যাইতাম তিনি সদরে থাকিয়া কলেজে পড়াশুনা করিতেন । কাজেই তাঁহার সহিত কোন কালেই বিশেষ সাক্ষাত হয় নাই । তথাপি, অতি সুশীল, সুভাষ ও স্নেহময় এই দাদা আমাকে সর্বদা বড় স্নেহে স্বাগত করিতেন ।

শীত পড়িলে আমি সস্ত্রীক মোহারামপুর যাইয়া হোটেলে ঠাঁই লইয়া, পরদিন সকালে একটি গাড়িভাড়া করিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম । যে যাত্রা শৈশবে বাসে মেঠো পথে কয় ঘণ্টা, ও পরে নৌকায় নদীপথে আরও দুই ঘণ্টায় সম্পন্ন হইত, তাহা ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সমাধা হইল । গ্রামে পৌঁছাইয়া দেখি আমূল পরিবর্তন হইয়াছে । পথঘাট পাকা, বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা হইয়াছে । বেশির ভাগ বাটীই পাকা ও তাহাদের উপর টিভির ডিশ দেখা যাইতেছে । পিতামহের বাটী খুঁজিতে বেগ পাইতে হইল, কেননা তাহা একতল হইতে দ্বিতল হইয়াছে, এবং তাহার গাত্রে রং ও প্রবেশ পথে লোহার জালের ভারি দরজা লাগিয়াছে । সেই দরজা ঠেলিয়া প্রবেশ করিয়া দেখি দীনুদা সান বাঁধানো জমিতে বসিয়া রৌদ্রতাপ উপভোগ করিতেছেন । আমাকে দেখিয়া মুহূর্তের জন্য চমকিত হইয়াই, সত্বর পরম আহ্লাদে আটখানা হইলেন, ও বৌদিকে ডাকিতে চেঁচামেচি করিতে লাগিলেন । বৌদি দ্বিতল হইতে সবেগে অবতরণ করিয়া এই দম্পতির যুগল চেহারা দেখিয়াই চমকিয়া একেবারে থ । তাঁহাদের সহিত, মনে হয়, শেষ দেখা হইয়াছিল প্রায় পঁচিশ বৎসর পূর্বে । সমাদরে আমাদের দোতলায় লইয়া গিয়া বসান হইলে, বেশ কিছুক্ষণ চারি জন একই সাথে সমস্বরে নানান প্রশ্নোত্তরে জরাজীর্ণ হইয়া ক্রমে ক্রমে ক্লান্ত হইয়া ক্ষান্ত হইলাম । এতদিন পরে মিলনের উদ্দীপনা শান্তিতে সমাহিত হইলে বৌদি চায়ের আয়োজন করিতে চাহিলেন । আমি আপত্তি করিলাম, কেননা দ্বিপ্রহরের ভোজনের সময় প্রায় হইয়াছিল । আর, শীতের বেলা পড়িতে বিশেষ সময় লাগে না, তাহার পূর্বে আমরা মোহারামপুর ফিরিতে চাহিলাম । তখন দীনুদা কহিলেন, “সে কী ? এতদিন পরে গ্রামে এলি । একটু ঘুরে ফিরে দেখবি না ?”
আমি কহিলাম, “কী আর দেখব ? সবই তো দেখছি বদলে গিয়েছে ।”
দাদা – “না না, সে কী করে হয় । তোর গাড়ি আছে, গ্রামের সব রাস্তা প্রায় পাকা ... চল না, ফিরে যাওয়ার আগে না হয় গাড়িতে করেই একটু ঘুরে দেখে নে । আবার কবে আসবি, না আসবি ...”

স্ত্রী দেখিলাম এই প্রস্তাবে রাজী । অগত্যা তাহাই হইল ।

প্রথমে আমরা নদীতীরে গিয়া তাহার পাড় বরাবর রাস্তায় গ্রামের অপর প্রান্তে গেলাম, যেথা শৈশবে নদীপথে নৌকায় আসিয়া ঘাটে নামিতাম । এই ঘাটের নাম বড় মনোহারী – ‘কিশোরীতলা’ । তাহার নিকটেই স্থিত গ্রামের স্কুল, যাহা শৈশবে একতল দেখিয়াছিলাম । এখন তাহা দ্বিতল হইয়াছে, ও রাস্তার বিপরীত দিকেও তাহার বিস্তার হইয়াছে । স্কুল দেখিয়া রঘুকাকার কথা মনে পড়ায় প্রশ্ন করিলাম, “দীনুদা, রঘুকাকা কি এখনও বেঁচে আছেন ?”
দাদা – “না রে । সে তো কবেই মারা গেছে ... কাকাবাবুর, মানে তোর বাবার, আগেই ।”

স্কুল হইতে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া গ্রাম শীঘ্রই সমাপ্ত হইল, পরিচিত বিশেষ কিছু দেখিতে পাইলাম না । সর্বত্র অতীতের বিস্তৃত খোলা জায়গা, বাঁশঝাড়, পুষ্করিণী ও আম বাগান লোপ পাইয়া পাকা বাড়ি হইয়াছে । ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া নানান বিকট রঙের সেই সব বাড়ি নির্বিবাদ সহবাসে লিপ্ত । দ্বিপ্রহর হেতু পথে ঘাটে বিশেষ লোকজন দেখা গেল না । গ্রামের পর্যবেক্ষণ শেষ হইলে দীনুদার আজ্ঞায় ড্রাইভার গাড়ি লইয়া গ্রামের বাহিরে ছুটিল । কোথায় ? সেই মাঠ, যেথা শৈশবে পিতার সহিত প্রবাসী বনাম স্বদেশী ফুটবল খেলা দেখিতে আসিতাম । তাহার পার্শ্ববর্তী স্বাস্থ্য-কেন্দ্রটি  দেখিলাম সেইরূপই আছে, যদিও মেরামতের প্রয়োজন সুস্পষ্ট । আমি শৈশবের সেই ময়দানটি চিনিতে পারিয়া উৎফুল্ল হইলেও দেখিলাম দীনুদা কিঞ্চিত অধীর । বুঝিলাম তাঁহার অভিপ্রেত গন্তব্য অন্য । তাঁহার কথা মত গাড়ি আরও কিছুদূর অগ্রসর হইলে রাস্তার এক বাঁকে এক বিশাল প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষ দেখাইয়া দীনুদা জানাইলেন যে তাঁহার একমাত্র কন্যার বিবাহে এই বৃক্ষতলে পূজা দিয়া তিনি বিশেষ ভোজের আয়োজন করিয়াছিলেন, ও গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা তাহাতে নিমন্ত্রিত ছিল । বুঝিলাম এই অশ্বত্থ-তলা দাদার বিশেষ প্রিয় । আজ গাড়ির সৌভাগ্যে তাঁহার এই স্মৃতি-তীর্থ দর্শন লাভ হইল ।

ফিরিবার পথে বাটীর নিকট পৌঁছাইয়া স্মরণে আসিলে দীনুদাকে প্রশ্ন করিলাম, “কই, সেই তেঁতুলতলা তো দেখলাম না ।” দীনুদা তৎক্ষণাৎ পশ্চাতে মাথা ঘুরাইয়া কহিলেন, “ওই তো ! এইমাত্র পিছনে রেখে এলাম । অবশ্য মোড়টাই আছে, আর নামটা । সে’ তেঁতুলগাছ কবেই কেটে ফেলে বাড়ি হয়েছে । সে’ মাচানটাও নেই । দেখলি না সেখানে একটা ছোট মন্দির হয়েছে ।” ইহা সত্য, যাহা দেখিলাম, গ্রামে মন্দিরের প্রচুর প্রাদুর্ভাব হইয়াছে ।

বাটীতে ফিরিয়া বৌদি কহিলেন, “বেলা হয়েছে । তোমরা না খেয়ে এতটা পথ ফিরবে, আর আমরা বুড়ো বুড়ি নিশ্চিন্তে খেয়ে দেয়ে ঘুমব । সে কি হয় ?”
অগত্যা কহিলাম, “ঠিক আছে । তাহলে শুধু ভাতে ভাত খাব । বিশেষ আয়োজন কিছু কোর না ।”
“না, না । দাদা-ভাইয়ে গল্প করো । আমি চট করে ভাত চড়িয়ে দিই”, কহিয়া বৌদি স্ত্রীকে লইয়া রান্নাঘরে গেলেন ।

উদ্দ্যেশ্যহীন কিছু কথাবার্তার পর দীনুদা সহসা কহিলেন, “আশ্চর্য ! তোর কী ভাবে রঘু মাস্টারের কথা মনে পড়ল ?”
আমি – “রঘুকাকা তো বাবার বিশেষ বন্ধু ছিল ... বাবার জমিজমা দেখত । আমি ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামে এলে বাবা রঘুকাকার সাথে প্রায় রোজই দেখা করত ।”
দাদা – “হুম !”
কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভঙ্গ করিয়া কহিলাম, “জানো দীনুদা, ছোটবেলায় রঘুকাকাকে আমার খুব রহস্যময় লাগত ।”
দাদা – “তাই ? কী রকম ? অপরাধী, অপরাধী ...”
আমি – “না ... মানে, ওনার সম্বন্ধে তো কিছুই জানতাম না ... শুধু এই যে ওনার স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা যায় ।”
দাদা – “ওহ ! ... সে কথা কী করে জেনেছিলি ?”
জগন্নাথ ও মহারাজের নাম জিহ্বাগ্রে আসিলেও নিজেকে নিরস্ত করিয়া কহিলাম, “ঠিক মনে নেই ।”
দাদা পুনরায় নীরব হইলেন । আমি পুনরুদ্দীপিত কৌতূহলে দগ্ধ হইলেও, কী প্রকারে তাহা নির্বাপিত করা যায় ভাবিয়া পাইলাম না । কিছু পরে দেখিলাম দাদা দুই চক্ষু নিমীলিত করিয়াছেন । মনে হইল, বয়েস হইয়াছে, ক্ষণে ক্ষণে ক্লান্তি ও নিদ্রা অনিবার্য । এই সময় কী কাজে বৌদি আসিয়া কহিলেন, “সে কী ? তুমি কি ভাই কে বসিয়ে রেখে ঘুমচ্ছ ?” দাদা দুই নয়ন অর্ধনিমীলিত করিয়া কহিলেন, “না, কিছু পুরানো কথা ভাবছিলাম চোখ বুজে ।”
বৌদি প্রস্থান করিলে কিছু আশ্বস্ত বোধ করিয়া প্রশ্ন করিলাম, “দাদা, কিছু বলছ না যে ।”
দাদা – “কী বলব ? কী জানতে চাস তুই ? রঘুকাকার কথা ?”
আমি – “হ্যাঁ ।”
দাদা – “ও ... আর কিছু ?”
আমি – “আর ... জানি না, আরও একটা কৌতূহল ছোটবেলা থেকে রয়ে গেছে । কিছুতেই কাটাতে পারি নি । ওই রঘু কাকার বাড়ির উল্টোদিকে চৌমাথার কোনে একটা বাড়ি ছিল ... সব সময় বন্ধ থাকত । শুনতাম কোন কোন রাত্রে তার আঙ্গিনার দিকে দরজা খোলা থাকত । দরজা জানালা দিয়ে গভীর রাতেও বাতির আলো দেখা যেত । কে থাকত ওই বাড়িতে ?”
দাদা উঠিয়া বসিয়া দুই চক্ষু সম্পূর্ণ উন্মীলিত করিয়া হাসিয়া কহিলেন, “বাব্বা ! সে তো অনেক কথা । দাঁড়া ...”

ধীরে ধীরে দীনুদা আমাকে যাহা শুনাইলেন তাহা প্রায় এক কাহিনীর মত । কাহিনীটি শেষ হইলে দেখিলাম বৌদি ও বুনুও কখন নিঃশব্দে দরজায় আসিয়া শ্রোতা হইয়াছে । বুনু প্রশ্ন করিল, “আমি তো শুনতে পেলাম না সব কথা । নিলোর কী হল শেষমেশ ?”
দীনুদা – “নিলো আর ফিরে যায় নি । সে রঘুকাকার কাছেই থেকে গিয়েছিল ।”
বৌদি – “চলো বুনু, এই বেলা আমরা ভাত বেড়ে নিই । নইলে তোমাদের ফিরতে দেরী হবে । তুমি বরঞ্চ ফেরার সময় গাড়িতে সব শুনে নিও ।”

খাওয়া দাওয়া শেষ হইতে হইতে সূর্য অস্তাচলগামী । ত্বরায় দাদা বৌদিকে প্রণাম করিয়া গাড়িতে বসিলাম । গাড়ি চলিতে লাগিলে কিছু দূর যাইয়া বুনু পিছনে ফিরিয়া হাত নাড়িয়া, নড়িয়া চড়িয়া বসিয়া কহিল, “হ্যাঁ, এবার বল ।” আমি সামনে ঝুঁকিয়া ড্রাইভারকে কহিলাম, “গাড়ি ঘুরিয়ে তেঁতুলতলা হয়ে ঘুরে চল ।” তেঁতুলতলায় আসিয়া গাড়ি হইতে নামিয়া কিছুই চিনিতে পারিলাম না । শুধু দক্ষিণ দিকে কিশোরীতলা ঘাটে যাইবার পথের কোনে দেখিলাম একটি পাকা বাড়ি, যাহার একদা টিনের ছাত আর নাই । তাহাতে একটি ফলকে লেখা “প্রবাসী-স্বদেশী সংঘ” । শৈশবের এক দৃশ্য মানসে উঁকি দিলে এক মুহূর্তের জন্য আমি চক্ষু মুদিলাম । আমার প্রথম গ্রীষ্মের ছুটি । এক বৈকালে পিতার খোঁজ লইতে গিয়া না পাইয়া আমি একা একা ফিরিতেছি । এই বাটী হইতে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরিধানে এক স্ত্রীলোক বাহির হইল । তাহাকে পূর্বে কখনও দেখি নাই । কাছে আসিলে দেখিলাম তাহার মাথায় ঘোমটা হইলেও সিঁথিতে সিঁদুর নাই । সে আমার কাছে আসিয়া হাসিয়া কহিল, “তুই অরুদার ছেলে নীরেন না ?” আমি মাথা হেলাইয়া হ্যাঁ কহিলাম । সে কহিল, “তুই একা কেন ? অরুদা কই ?” আমি নেতিসূচক মাথা নাড়িলাম । সে কহিল, “চল, তোকে বাড়ি দিয়ে আসি ।” আমি পলায়ন করিতে উদ্যত হইতেই সে আমার হাত ধরিয়া কহিল, “আচ্ছা, থাক, তুই আয় আমার সাথে, নারকেলের নাড়ু খাবি । অরুদার প্রিয়, তোরও ভালো লাগবে । ক’টা খাবি, ক’টা নিয়ে যাবি ।” আমি সহসা প্রমাদ গণিয়া তাহার কোমল হাত ছাড়াইয়া পিছনে হটিয়া পিতামহের বাটীর দিকে ধাবিত হইয়া শুনিলাম সে ডাকিতেছে,  “কেন দৌড়চ্ছিস ? পড়ে যাবি যে ।” আজ সহসা বড়ই বিমর্ষ বোধ করিলাম সেই দৃশ্য মনে পড়িয়া, ও সেই ডাক মনে গুঞ্জিত হইয়া, “কেন দৌড়চ্ছিস ? পড়ে যাবি যে ।”

গাড়ি হইতে স্ত্রী ডাকিল, “এসো, দেরী হচ্ছে ।” গাড়িতে উঠিয়া কিশোরীতলার ঘাট পার হইলে আমি তাহাকে এই কাহিনী শুনাইলাম, কিছু কিছু আমার অনুমান যুক্ত করিয়া । ইহাতে অরিন্দম আর কেহ নহেন, আমার পিতা ।

***

রঘুনাথ রায়ের পরিবার অত্যন্ত সংরক্ষণশীল, এক প্রকার গোঁড়া, ছিল । রঘুনাথের পিতা শম্ভুনাথ রায় মহাশয় পত্নী বিয়োগের পর তাঁহার বিস্তর জমিজমা ভাগচাষীদিগের হাতে সম্পূর্ণ সঁপিয়া দিয়া শাস্ত্রচর্চা করিয়া দিনপাত করিতেন । ক্রমে ক্রমে সুযোগসন্ধানী চাষীদের হাতে ফসল হইতে প্রাপ্ত আয় হ্রাস পাইতে লাগিলে, তখন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র রঘুনাথ, জমিজমা দেখাশুনার কাজ শুরু করেন । এই সূত্রে তাঁহার দয়ালু এবং সহানুভূতিশীল চরিত্র হেতু তিনি লক্ষ্য করেন যে গরিব মুসলমান চাষীদের মধ্যে পড়াশুনার বিশেষ চল নাই, বিশেষত তাহাদের পর্দানশীন মহিলা মহলে । তাঁহার বাটীর সন্নিকটে চাষীপাড়া বাসী তাঁহার এক ভাগীদার চাষী সুলেমানের কন্যা নিলুফার, ডাক নাম নিলো, তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । যখনই রঘুনাথ সুলেমানের সহিত আবহাওয়া, বীজ, সার ইত্যাদি লইয়া আলোচনা, কিম্বা ফসলের পরিমাণ, মূল্য ইত্যাদির হিসাবনিকাশ করিতেন, মেয়েটি জল ও রঘুনাথের প্রিয় নারিকেলের নাড়ু লইয়া আসিবার ছলে নিকটবর্তী হইয়া মনোযোগ সহকারে সেই সব কথা শুনিত । ক্রমে নিলোর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখিয়া উৎসাহিত হইয়া রঘুনাথ বালিকাটির প্রাথমিক শিক্ষাদান শুরু করেন । কিছু আরও উৎসুক মুসলমান চাষীর শিশু যোগ দেয় । প্রায় এক দুই দিন বাদ রঘুনাথ সেই সকল শিশুদের বাটীতে ডাকিয়া তাহাদের প্রথমপাঠ, সহজ গণিত ইত্যাদির সহিত পরিচয় শুরু করেন । ইহা দেখিয়া শম্ভুনাথ রায় মহাশয় খুব খুশি হইয়া তাহাদের কিছু জলখাবারে ব্যবস্থা করেন । কিন্তু, ক্রমে ক্রমে এক এক করিয়া নিলো বাদে বাকি শিশুরা এই পাঠশালা হইতে পাততাড়ি গুটায় । নিলোর বয়েস বারো তের হইলে তাহার আসা যাওয়া লইয়া গ্রামে কুৎসা রটনা শুরু হইল । রঘুনাথ জেদি চরিত্রের মানুষ ছিলেন । তিনি সুলেমানের বাড়িতে কার্যে যাইয়া তাহারি মাঝে বালিকাটির শিক্ষা বজায় রাখিলেন । তিনি মোহারামপুর কলেজে যোগদান করিলে এই শিক্ষাদানে ব্যাঘাত ঘটিল । ছুটিতে বাটীতে আসিলে তিনি অবশ্যই সুলেমানের বাড়ি গিয়া খোঁজখবর লইতেন । কখনও কোন পছন্দসই বই নিলোকে পড়িবার জন্য ধার দিতেন । এক গ্রীষ্মে রঘুনাথ বিএ পাস করিয়া গ্রামে ফিরিলেন, ও স্থানীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করিলেন । তাঁহার আর্থিক সাহায্যে ষোড়শী নিলো পরীক্ষা দিয়া গ্রামের বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হইল । ইতিমধ্যে তাঁহার বাল্যবন্ধু অরিন্দম বিহার প্রদেশে কর্মে যোগ দিয়াছেন । দুই বন্ধুর সম্পর্ক পত্রালাপে সুরক্ষিত থাকিল ।

শরতে, দেবীর বিসর্জনের কিছুদিন পর,  এক প্রভাতে হটাত খবর আসিল গত রাত্রে সুলেমান ও তাহার স্ত্রী এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর রূপে আহত হইয়াছে । অবিলম্বে রঘুনাথ তাহার কুটিরে যাইয়া জানিতে পারিলেন, পূর্ব দিন সাইকেলে অসুস্থ স্ত্রীকে লইয়া সুলেমান সদরে গিয়াছিল । অধিক রাত্রে ফিরিবার সময় পশ্চাৎ হইতে আসা এক লরি ধাক্কা দেয় । দুইজন গুরুতর রূপে আহত হয় । সহায়তার অভাবে দুইজন দুর্ঘটনা স্থলে সারা রাত্রি পড়িয়া থাকে । প্রত্যুষে খবর পাইয়া গ্রামের অনুকূল ডাক্তার পৌঁছাইয়া দেখেন দুইজনেরই মৃত্যু হইয়াছে । বেলায় চাষীরা মরদেহ লইয়া আসিলে রঘুনাথ অন্তিম সৎকারের ব্যবস্থা করিলেন । কবরস্থান হইতে ফিরিয়া দেখিলেন কিছু পরিচিত ভাগচাষী কুটিরের সম্মুখে জড়ো হইয়াছে । তাঁহাকে দেখিয়া তাহাদের একজন কহিল, “কত্তা, এবার বাপ-মা মরা মেয়েটাকে কে দেখবে ?” দাওয়ায় উপবিষ্ট নিলোর ক্ষীণ ক্রন্দনের হৃদয়বিদারক শব্দে মরমে বিঁধিল । তিনি নিলোর নিকটে গিয়া কহিলেন, “তোমার কি আর কেউ নেই ?” নিলো উঠিয়া দাঁড়াইয়া আঁচলের খুঁট ধরিয়া মস্তক নত করিয়া রহিল । তাহার এই অসহায় ভঙ্গি দেখিয়া রঘুনাথের মনে কী করুণার উদ্রেক হইল, তিনি নিলোকে কহিলেন, “তুমি মুখ তোল, আমার দিকে তাকাও ।” নিলো মুখ তুলিয়া চাহিয়া তাঁহার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখিয়া রুদ্ধশ্বাসে কহিল, “আমার তো তেমন আর কেউ নেই । আমি কোথায় যাব ?” দেখিতে দেখিতে তাহার অশ্রুসিক্ত রক্তিম চেহারায় এক ফ্যাকাসে ছায়া ছাহিয়া গেল । রঘুনাথ কিঞ্চিত বিচলিত হইয়া কহিলেন, “ও ... আচ্ছা, দেখি কী করতে পারি ।”

বাড়ি ফিরিয়া অনেক চিন্তা করিয়াও রঘুনাথ কুল কিনারা পাইলেন না । নিলোর অসহায় অশ্রুসিক্ত নয়ন, ও ক্রন্দনের আবেগে  কম্পিত নত পৃষ্ঠ বারম্বার তাঁহার মানসে ফুটিয়া উঠিল । তাঁহার দয়ার এই পাত্রীর হৃদয়ে তাঁহার প্রতি একদা অস্ফুট কৃতজ্ঞতা যে অচিরে ক্রমে ক্রমে এক অপরূপ অনুরাগে প্রস্ফুটিত হইয়াছিল তাহা তিনি আজও অনুমান করিতে পারিলেন না । কেবল, আজ যেন তাঁহার বক্ষে এই অসহায় ক্রন্দসী ভাগচাষীর কন্যা করাঘাত করিয়া শুধাইল, “আমার ঠাঁই কই ?”

কিছু খোঁজ খবর করিয়া জানা গেল এক বিধবা, সুবাদে নিলোর মাসি, নিকটবর্তী এক গ্রামে পুত্রের সহিত থাকে । রঘুনাথ তাহাকে পথ খরচ দিয়া আনাইয়া নিলোর সাথে থাকিবার ব্যবস্থা করিলেন, যতদিন না নিলোর বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন হয় ।

হেমন্ত ও শীত পার হইল । বসন্ত আসিলে শম্ভুনাথ রায় মহাশয় ঘটক ডাকিয়া রঘুনাথের বিবাহের জন্য পাত্রীর অনুসন্ধান করিতে আগ্রহ প্রকট করিয়া কহিলেন, “সুবল, আমার আর বেশি দিন নেই । রঘুর শেষ কাজটা করে আমি এই জীবন থেকে নিস্তার পেতে চাই ।” সুবল কিছু অগ্রিম লইয়া যাইতে যাইতে কহিল, “ঠিক সময় কাজটা শুরু করছেন কর্তা । এমনিতেও তো গ্রামে রঘু আর ওই মেয়েটাকে নিয়ে কেচ্ছার অন্ত নেই । যত্তো সব ... এইবার সব ব্যাটাদের মুখ বন্ধ করিয়ে ছাড়ব ।”

শম্ভুনাথ হতভম্ব হইয়া বসিয়া থাকিয়া রঘুনাথকে ডাক দিলেন । সে আসিলে প্রশ্ন করিলেন, “তুমি কি ওই মুসলমান ভাগচাষী সুলেমানের মেয়েটার সাথে ... মানে, আমি কি জানতে পারি, কী তোমাদের সম্পর্ক ?”
রঘুনাথ – “দুস্থ একটা মেয়েকে নিয়ে গ্রামের লোক কুৎসা রটাচ্ছে । আপনি তাতে কান দেবেন না ।”
শম্ভুনাথ – “কিন্তু যা রটে, তার কিছুটা তো বটে ?”
রঘুনাথ নিরুত্তর থাকিলে শম্ভুনাথ কহিলেন, “যাক গে । আজ আমি ঘটক ডেকে তোমার জন্য মেয়ে খুঁজতে বলেছি । তুমি বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত হও ।”

বৈশাখ মাসে গ্রামে প্রবাসী যুবাদিগের সমাগম হইলে যথারীতি ফুটবল খেলার আয়োজন করা হইল । স্বদেশী পক্ষে রঘুনাথ গোল রক্ষক । দেখা গেল খেলায় তাঁহার বিশেষ আগ্রহ নাই । তাঁহার অমনোযোগের ফলে স্বদেশী পক্ষ দুই গোল খাইয়া প্রথম খেলাটি হারিল । খেলার পর দুই পক্ষ একত্রে হুল্লোড়ে মত্ত হইলে কেহ কেহ লক্ষ্য করিল যে রঘুনাথ উদাসীন হইয়া আছেন । একজন কহিল, “কী রে ? দু’ দুটো গোল ছেড়ে দিলি যে ! কী হয়েছে তোর ? কী রকম মরা মরা লাগছিস ।”
অরিন্দম প্রশ্ন করিলেন, “বাড়িতে কিছু হয়েছে নাকি ? তোমার বাবা কেমন আছেন ?”
রঘুনাথ কিঞ্চিত ইতস্তত করিয়া কহিলেন, “বাবা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন । আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না ।”
চিঠি পত্রের মাধ্যমে অরিন্দম সমস্ত ব্যাপারে অবগত ছিলেন । তিনি চুপ করিয়া রহিলেও, অন্যেরা নানা প্রশ্নে রঘুনাথকে জর্জরিত করিল । শেষে অরিন্দম প্রস্তাব করিলেন, “রঘু, আমি বলি ?”
রঘুনাথ মাথা নাড়িয়া অনুমতি দিলে অরিন্দম জানাইলেন যে রঘুনাথের ধারণা, অসহায় নিলো সম্পূর্ণ ভাবে তাঁহার উপর নির্ভর করিয়া বসিয়া আছে । এই পরিস্থিতিতে রঘুনাথের কী করা উচিত ? নিলোরই বা কী ব্যবস্থা করা যায় ?
বিস্তর আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে কোনও সমীচীন পথের খোঁজ পাওয়া গেল না । পরিশেষে অরিন্দম কহিলেন, “রঘু, তুমি তো শিক্ষক । রোজ ছাত্রদের নানান নৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করো । আজ এই ক্ষেত্রে তোমার কী উচিত মনে হয় ?”
রঘুনাথ – “আমি তো কোনই সিদ্ধান্ত করে উঠতে পারছি না “
অরিন্দম – “যা ঠিক মনে হয় তাই করো ... আমার সমর্থন পাবে ।”
প্রবাসী সকলে সমস্বরে কহিল, “হ্যাঁ, রঘু, তুমি যা ঠিক মনে কর, তাই করো । আমরা তোমার সাথে আছি, থাকবও ।”

সেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিবার পথে রঘুনাথ নিলোর কুটিরে গিয়া বাহিরে আঙ্গিনা হইতে তাহাকে ডাকিয়া কিঞ্চিত ইতস্তত কথার মধ্যে জানিলেন যে নিলোর মাসি বর্ষার পূর্বে পুত্রের কাছে ফিরিয়া যাইবে । নিলো কহিল, “আমি ভাবছি, আমি ও মাসির সাথে চলে যাই । এই বাড়ির যা অবস্থা, হয়তো বর্ষায় পড়ে যাবে ।”
রঘুনাথ – “তাহলে তোমার পড়ার কী হবে ?”
নিলো – “কিন্তু, একা আমি এই পোড়ো বাড়িতে ...”
তাহার অসমাপ্ত কথা অগ্রাহ্য করিয়া রঘুনাথ দ্রুতবেগে কহিলেন, “তুমি কী আমার বাড়িতে থাকতে পারবে ?”
নিলো – “আপনার বাড়িতে ? কী ভাবে ?”
রঘুনাথ – “কেন, আমার সাথে ?”

সহস্র অজ্ঞাত উদ্বেগ সম্বরণ করিয়া বিব্রত মুখে হাসি ফুটাইবার চেষ্টা করিয়া নিলো কহিল, “আপনি বসুন ... আমি আপনার জন্য পানি নিয়ে আসি ।” কিন্তু ভিতরে গিয়া সে ভয়ঙ্কর আবেগে অভিভূত হইয়া পড়িল । খানিকক্ষণ পরে অস্ফুট ক্রন্দনের জোয়ার স্তিমিত হইলে বাহিরে আসিয়া দেখিল অন্ধকার আঙ্গিনা ফাঁকা, রঘুনাথ চলিয়া গিয়াছেন ।

সেই রাত্রে নৈশভোজ সমাপ্ত হইলে রঘুনাথ শম্ভুনাথ কে কহিলেন, “বাবা, একটা কথা আছে ...”
শম্ভুনাথ – “নিলোর ব্যাপারে ? তোমার বিয়ের আগে তুমি ওর একটা ব্যবস্থা করতে চাও, তাই তো ?”
রঘুনাথ স্তম্ভিত হইয়া কোন কথা বলিতে পারিলেন না ।
শম্ভুনাথ কহিলেন, “সুবল একটা মেয়ের খোঁজ এনেছে । বলরামপুরের নবীন সেনের মেয়ে । মনে হয় ভালো পাত্রী ।”
রঘুনাথ – “কিন্তু ...”
শম্ভুনাথ – “দেখ, এই আমার শেষ কাজ । এরপর তুমি যা ভালো বোঝ তাই কোর । তবে, এটা ভেবে দেখো, বংশরক্ষা তো আর তাকে নিয়ে হবে না । দেশ আছে, সমাজ আছে ...”

পরের দিন খেলার মাঠে রঘুনাথ সর্বসমক্ষে জ্ঞাপন করিলেন যে তাঁহার পাত্রী স্থির হইয়াছে । প্রবাসী পক্ষের সকলে প্রবল উল্লাসে এই ঘোষণার সম্বর্ধনা করিল । কেহ কহিল, “তাহলে আমরা ছুটি থেকে ফেরার আগে তোমার বিয়েটা হয়ে যাক ।”
কেহ বা কহিল, “হ্যাঁ, সবাই মিলে কাজটা চুকিয়ে দিয়ে যাই ।”
এবং বাকিরা যোগ দিল, “আর চেটেপুটে খেয়েও যাই । প্রবাসে তো আর এমন ভোজ জোটে না ।”
কেবল অরিন্দম এক ফাঁকে রঘুনাথকে আলাদা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “নিলো সম্বন্ধে কী ঠিক করলে ?” রঘুনাথ উত্তর করিলেন, “আমি ভেবেছিলাম ওর পড়াটা শেষ হলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত ... প্রাথমিক স্কুলে পড়ানোর কাজও যদি পেত । কিন্তু কাল জানলাম, নিলোর মাসি বর্ষা নামার আগে ছেলের কাছে ফিরে যাবে, সেই সাথে ও চলে যাবে ।”
অরিন্দম – “কিন্তু, তুমি যে বলেছিলে ওই মাসির ছেলের চরিত্র ভালো নয় ।”
রঘুনাথ – “তা এখন কী করা যাবে ?”

এই কাহিনীর এইখানেই শেষ হাওয়া উচিত ছিল । কিন্তু বিধির বিধান অন্যরূপ ছিল ।

প্রবাসীদিগের কর্মক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই বৈশাখের শেষে রঘুনাথের বিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেল । সেই বৎসর গ্রীষ্মের প্রকোপ কিছু অধিক হইয়াছিল । কালবৈশাখী হয় নাই । তাপমাত্রা ক্রমে ক্রমে বাড়িয়া অসহনীয় হইয়াছিল । বিবাহের কয় দিন পর শম্ভুনাথ রায় মহাশয় নদীতে স্নান করিতে করিতে জ্ঞান হারাইলেন । তাঁহার সলিল সমাধিই হইত, কিন্তু নিকটে সন্তরণরত কিছু বালক অন্যদের সচেতন করিলে তাহারা আসিয়া তাঁহাকে জল হইতে তুলিয়া বাটীতে লইয়া গেল । অনুকূল ডাক্তার আসিয়া দেখিয়া বিশেষ কিছু করিতে পারিলেন না । অজ্ঞান অবস্থায় শম্ভুনাথকে গরুর গাড়িতে করিয়া দশ কোষ দূরে নিমতলায় হাসপাতালে লইয়া যাওয়া হইল । সেখানে চিকিৎসার পর তাঁহার জ্ঞান ফিরিলেও, দেখা গেল তাঁহার শরীরের দক্ষিণ দিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হইয়াছে । কিছুদিন পরে তাঁহাকে হাসপাতাল হইতে গ্রামে ফেরত আনা হইলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার উপদেশ দিলেন যে রায় মহাশয়ের জন্য এক নার্সের প্রয়োজন হইবে ।

গ্রাম-দেশে ধাই ব্যতীত নার্স কোথায় পাওয়া যাইবে । পরদিন প্রত্যুষে চিন্তিত মুখে রঘুনাথ পিতার নিকট গিয়া দেখিলেন তাঁহার ঘুম ভাঙ্গিয়াছে ও তাঁহাকে বিছানায় উঠাইয়া বসান হইয়াছে । রঘুনাথের স্ত্রী বিমলার তদারকিতে তিনি দুগ্ধ পান করিতেছেন । রঘুনাথকে দেখিয়াই তিনি প্রশ্ন করিলেন, “কি, কাউকে পেলে আমার দেখাশোনা করার জন্য ? বৌমা তো আমার সেবা করে সারারাত ঘুময় নি মনে হয় ।”

রঘুনাথ ইশারায় বিমলাকে কক্ষের বাহিরে যাইতে ইঙ্গিত করিলে সে দুধের গেলাসটি লইয়া ঘোমটা সামলাইয়া চলিয়া গেল । রঘুনাথ দরজার দিকে চাহিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া কহিলেন, “বাবা, আমি বলছিলাম যে ... আপনি বলেছিলেন যে ...” তাঁহার মুখের কথা কণ্ঠে আটকাইয়া রহিল । কিছু পরে কিঞ্চিত ধাতস্থ হইয়া তিনি কহিলেন, “বাবা, নিলোকে কী আপনার সেবায় লাগানো যায় না ? ... অবশ্য, আমি জানি না সে এই কাজে রাজী হবে কিনা, আর ...”
শম্ভুনাথ – “আর কী ?”
রঘুনাথ – “আর, আপনি ওর হাতে জল স্পর্শ করবেন কিনা ।”
শম্ভুনাথ কিছুক্ষণ রঘুনাথের নত দৃষ্টির দিকে চাহিয়া দেয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া অবরুদ্ধ কণ্ঠে কহিলেন, “আমি মনে হয়, না জেনে তোমাকে ... তোমাদেরকে ... অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি ।”
রঘুনাথ ইহার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করিলেন না । অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করিলেন শম্ভুনাথ ইহার পর কী বলেন ।
শম্ভুনাথ কিছুক্ষণ পরে কহিলেন, “যাও, আমি এখন একটু বিশ্রাম করব ।”
রঘুনাথ কক্ষ হইতে যাইতে যাইতে শুনিলেন, শম্ভুনাথ স্বগতোক্তি করিতেছেন, “আমি তো বলেই ছিলাম বিয়ের তুমি যা ভালো বোঝ তাই কোর ।”

পরদিন শম্ভুনাথ প্রভাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় বোধ করিলেন কেহ তাঁহার গায়ের চাদর টানিয়া দিতেছে । তাঁহার মনে হইল নতুন কেহ কক্ষে আসিয়াছে । চক্ষু উন্মীলিত করিয়া দেখিলেন নিলো দাঁড়াইয়া আছে । সে গলায় আঁচল জড়াইয়া শম্ভুনাথের পায়ে মাথা ছোঁয়াইল । শম্ভুনাথ চাহিয়াও পক্ষাঘাতগ্রস্ত পা সরাইতে পারিলেন না । শুধু অস্পষ্ট স্বরে কহিলেন, “থাক মা, থাক ।”

কিন্তু রঘুনাথের সংসার-সুখ লাভ হইল না । একদিকে, আসিতে যাইতে নববধূর সহিত চক্ষের মিলনে তাহার চাহনিতে দেখিতে পান তাহার সাধ আহ্লাদের অব্যক্ত বার্তা । অপরদিকে, নিলোকে দেখিয়া তাঁহার বক্ষে সেই পুরাতন হতাশা বোধ । তাঁহার মনে হইল তাঁহার উচিত নিলোর বিবাহের ব্যবস্থা করা । তাহাতে গ্রাম-সমাজে কোনরূপ দুর্নাম রটানোর মুখ বন্ধ করা যায় । কিন্তু কাহার সহিত, কত দূরে ?

শম্ভুনাথ রায় মহাশয় প্রায় এক বৎসর শয্যাশায়ী রহিয়া ক্ষীণ হইয়া এক বসন্তের দিন প্রাণত্যাগ করিলেন । তাঁহার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন হইবার একদিন পর রঘুনাথ দাওয়ায় বসিয়া কিছু কাজের ফর্দ প্রস্তুত করিতেছেন, নিলো আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া অধোমুখে কহিল, “এবার আপনি আমাকে মাসির কাছে পাঠিয়ে দিন ।”
রঘুনাথ কিঞ্চিত আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কেন ? কেন চলে যাবে ? এখানেই থাক, বিমলা তো আছেই ।”
নিলো মুখ তুলিয়া চাহিল । সহসা তাহার দুই চক্ষে মুহূর্তের জন্য বিদ্যুতের ঝিলিক দেখা দিল, এমত বোধ হইল । সে উষ্ণ স্বরে কহিল, “না, তা সম্ভব নয় !”
অতঃপর স্বর কিঞ্চিত নম্র করিয়া কহিল, “আমি আর এখানে থাকলে হয়তো কোনদিন বৌদি গলায় দড়ি দেবেন ।”
রঘুনাথ তাহার দর্পে  থতমত হইয়া আমতা আমতা করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, দেখছি ।”
নিলো আর কিছু না বলিয়া, না কোন কথা শোনার অপেক্ষা করিয়া, দ্রুতপদে প্রস্থান করিল ।

কিছু পরে রঘুনাথ বিদ্যালয়ে যাইয়া মহাধ্যক্ষ হইতে সেই দিনের ছুটি লইলেন । কিশোরীতলার ঘাটে গিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া আরও অস্থির বোধ করিলেন । ঘাট হইতে একটি নৌকা ছাড়িতেছিল । জানা গেল নৌকা দশমীঘাট অব্দি যাইবে । তিনি মাঝিকে অনুরোধ করিলে সে তাঁহাকে লইতে রাজী হইল । দশমীঘাটে নামিয়া মানবাজারে ঘুরিয়া তিনি সারাদিন কাটাইলেন । দ্বিপ্রহর পার হইলে তাঁহার মনে পড়িল তিনি বাড়িতে বলিয়া আসেন নাই । কিন্তু দশমীঘাটে পৌঁছাইয়া নৌকা পাইতে বেশ দেরী হইল । সন্ধ্যায় তিনি যখন নৌকা হইতে কিশোরীতলায় নামিলেন এক অপেক্ষারত বালক দৌড়াইয়া আসিয়া কহিল, “মাস্টারমশাই, শিগগির বাড়ি চলুন, কাণ্ড হয়েছে ।” রঘুনাথ দ্রুত ধাবনে বাড়ি আসিয়া দেখিলেন লোকে লোকারণ্য । একটি খোলা গরুর গাড়িতে শয্যা সাজানো হইয়াছে । ভিড়ের মধ্যে হইতে কেহ আসিয়া নিম্ন কণ্ঠে কহিল, “রঘুনাথ, কোথায় ছিলে ?” রঘুনাথ ব্যস্ত কণ্ঠে কহিলেন, “কী হয়েছে ? এত ভিড় কেন ? আর এই গাড়িতে বিছানা কিসের ?” সে কহিল, “বিমলা গায়ে আগুন দিয়েছে । ওকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ।”

বিমলা হাসপাতাল হইতে প্রায় চার মাস পরে ছাড়া পাইলেও শয্যাশায়ী হইয়া ফিরিল । তাহার দৃষ্টি ও শ্রুতি আগুনে নষ্ট হইয়া গিয়াছিল । তাহার কণ্ঠ হইতে স্বরও বিদায় লইল । নিলোর আর ফিরিয়া যাওয়া হইল না । বিমলার সেবা শুশ্রূষার জন্য সে রহিয়া গেল । বোবা, কালা, অন্ধ বিমলা বৎসর তিনেক তাহার সেবা লইয়া মারা গেল । সে আর জানিল না যাহার ঈর্ষায় সে আত্মহত্যার চেষ্টা করিয়াছিল সেই তাহার আমরণ সেবা করিল ।

***

আমার কাহিনী শেষ হইলে দেখিলাম পথ আরও কিছু বাকি । ততক্ষণে অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে । আমাদের দুইজনের মনেও অপরিসীম বেদনার আঁধার ।

বুনু প্রশ্ন করিল, “আচ্ছা, ওই রঘুকাকার বাড়ির সামনে তেঁতুলতলার মোড়ে যে এক কামরার বাড়ি ছিল, সেটার কথা তো বললে না ?”
আমি – “দীনুদা বলল ওটা রঘুকাকার ছিল । পরে উনি ওটা গ্রামের ফুটবল ক্লাবকে দান করে দেন । এখনও ক্লাবেরই নামে আছে – তবে তাতে খেলাধুলার আলোচনা বাদ দিয়ে রাজনীতি বেশি হয় ।”
বুনু – “ওটা রঘুকাকার ছিল ? তুমি তো বলেছিলে ওতে গ্রামের কোন স্বৈরিণী থাকত, রাত্রে তার ঘরে বাতি জ্বলত ... সে সব কি মিথ্যে ?”
আমি – “দীনুদা বলল, ধুর ! ও’সব বাজে কথা, গ্রামের লোকের মুখে তো কিছু বাদ যেত না । ওই ঘরটা ছিল রঘুকাকার ছোটবেলার পড়ার ঘর । পরে, মানে নিলোকে বাড়িতে আনার পর, রঘুকাকা আর ভিটেতে রাত্রিবাস করতেন না । পড়ার ঘরটায় রাত কাটাতেন । অনিদ্রায় ভুগতেন - ঘুম না এলে রাত জেগে বই পড়তেন । তাই রাত্রে বাতি জ্বলতে দেখা যেত । কেউ কেউ বলত ওই বাড়িতে তাঁর রাত্রিবাসও একটা কারণ ছিল কাকিমার আত্মহত্যার ।”

বুনু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিল । তারপর সে কহিল, “কী অদ্ভুত !”
আমি – “কী অদ্ভুত ? কিসের কথা বলছ ?”
বুনু – “তুমি কি ঠিক শুনেছিলে ?”
আমি – “কী ঠিক শুনেছিলাম ?”
বুনু – “যে ওই বাড়িতে থাকত যে সে স্বৈরিণী ।”
আমি – “হ্যাঁ, তাইতো মনে পড়ে ।”
বুনু – “সে কি স্বৈরিণী ... না কি, যেমন আমি ভাবছি ... সই-ঋণী ?”


-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৪ অক্টোবর ২০১৪