রবিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৪

প্রথম চিঠি


“...

ইতি, স্বাতী বোস |”

একি ! স্বাতীর চিঠি ! আমাকে লেখা ! আশ্চর্য তো ! কবে, কি ভাবে, কি ব্যাপার ...

“ ... আমার চিঠি পেয়ে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই | আমি আপনাকে অবাক করে দিতে চাই না | আমি 

এই চিঠি লিখতেও চাইনি | কিন্তু, বিশ্বাস করুন, আর কোন উপায় ছিল না | ...”

আমার হাত কাঁপতে শুরু করেছে | কিসের উপায় ? আমি কি ভাবেই বা বিশ্বাস করব এই দুর্বোধ্য জিনিষটাকে ?

“ ... আমার এই চিঠি লেখার উদ্দেশ্য, কি বলব, আমি চাই না এই বিয়ে, আমাদের বিয়ে হোক | 

আপনি আমার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না | আমি আপনার সর্বনাশ চাই না | ভগবানের দোহাই, আপনি
এই বিয়ে থামান | কারণ এই -

আমি বাড়ি পালানো মেয়ে | এক কালে কৈশোরের দুঃসাহসিকতায় আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম |
সুদীর্ঘ দু’বছর পরে বাড়ি ফিরি নিজের বিফলতায় হতাশ হয়ে | আমি যাকে চেয়েছিলাম তিনি তখন
যৌবনের মায়া কাটিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের এক আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত সন্ন্যাসী | তিনি আমাকে গ্রহণ করেননি |

যাক এই যথেষ্ট | আমার মনে হয় না কারণটার আর কোন বিস্তৃতির প্রয়োজন আছে | হটাত একটা
মনের আবেগে আপনাকে চিঠিটা লিখলাম | মনের আবেগটা একান্ত নিজস্ব | ওটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা
করবেন না | এর আগে আমার দুটো বিয়ের সম্বন্ধ হয় ও ভেঙ্গে যায় | এবার আশা করে আশাহত
হতে চাই না | হয়ত এই আবেগ কেটে গেলে নিজেকে বোকা মনে করব | আপনি তার আগেই আশা
করি একটা কিছু করবেন | আর একটা কথা – হয়তো মনে করছেন আমি আপনার মুখোমুখি হলাম
না কেন | আমার সে সাহস নেই | সমস্ত ঘটনাটার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি |
 
ইতি, স্বাতী বোস |”

ডাকঘরের ছাপটা পনের দিন আগেকার | গতকাল আমার বিয়ে হয়ে গেছে এই স্বাতীর সাথে | সেই সাথে ঠিক হয়ে আছে আমরা আগামীকাল হানিমুনে যাবো | যাবো কাঠগুড়ি | নাম-না-জানা ছোট্ট একটা হিল স্টেশনে হেমন্তের রোদে স্নান করে সদ্য-পরিচয়ের শীতলতা ভাঙ্গতে |

কাঠগুড়ি | কাঠগুড়ি | যেখান থেকে সহ্যাদ্রির চূড়া দেখা যায় | আমার বুকের মধ্যে সব একাকার হয়ে যাচ্ছে যেন | এই চিঠিটার অর্থ কি ? এখনই বা এলো কেন ? এর কি কোন প্রয়োজন ছিল ? এতো দেরী হয়ে গেছে |

আমার হাতটা চিঠিটা ধরে আছে, কিন্তু কোন অনুভূতি নেই | শুধু মনে হচ্ছে আমার বাস্তবতার পৃথিবীটা দ্রুত বেগে সরে যাচ্ছে | আর আমার ভাবনা চিন্তায় স্পর্শবোধহীনতার একটা গ্রহণ লাগছে |

*    *    *

ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করল | সেই কখন থেকে এই ভাবে চলে আসছে – একটু থেমে আবার গড়িয়ে | আকাশে বিকেল গড়িয়ে আসছে সেই সাথে | ট্রেনটা যখন থেমেছিল, দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম | ঘাসে হাওয়া লেগে শিরশির করে একটা আওয়াজ উঠছিল | মনের অস্থিরতার কথা ভেবে হটাত ইচ্ছে হচ্ছিল নেমে আস্তে আস্তে মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই | মাঠের শিরিষ গাছগুলোর ছায়া আহ্বান জানাচ্ছিল গিয়ে বসার জন্য, একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য, এলোমেলো ভাবনা চিন্তাগুলো গুছিয়ে নেয়ার জন্য | ট্রেনটা চলতে শুরু করেই মনের নিরুপায় ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে দিল | মাথা নিচু হয়ে আছে | ঘুমের মত একটা বিভ্রান্তি লাগছে | বুকের ভিতর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস না উঠে আসা বুদবুদের মত আটকে রয়েছে |

একটা সিগারেট ধরানো যাক | দেশলাইটা কোথায় রাখলাম আবার ? ওই তো ! স্বাতীর পায়ের কাছে | স্বাতী বেশ পা মুড়িয়ে বসেছে – হাঁটুর উপর কনুই রেখেছে | হাতের তালুতে চিবুক রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে | মাঝে মাঝে কপালের চুলগুলো সরানোর চেষ্টা করছে | ওর জানালাটা খোলা, বাইরের হাওয়া এসে চুলগুলো আবার কপালে ফিরিয়ে দিচ্ছে | ওর অন্যমনস্ক ভাবটা ঠিক বুঝতে পারছি না | কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকালেই বুকের উপর রাখা পাথরটা আরও ভারী হয়ে যাচ্ছে | আমার ঈষৎ ব্যস্ততায় মুখ ঘোরাল |

[
“ও কি ? পার্থ, ও রকম জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছ কেন ?”
“কই না তো |”
ও কি ধরে ফেলছে সব কিছু | এমন কি আমার চিন্তাটা যে সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছা থেকে ওর কাছে ফিরে গেছে | অনেকক্ষণ থেকেই এই রকম ভাবে আমি মনে মনে লুকিয়ে ওর চিন্তাগুলো দেখবার চেষ্টা করছি |
]

দুজনে দুজনের দিকে তাকালাম | স্বাতী আমার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল বোধহয় | বলল, “তোমার জানালাটা খুলে দাও না | রোদ পড়ে এসেছে |”
“না থাক | বড্ড ঘুম পাছে | চোখ বুজে এলে, ভাবছি, বসে বসে জানালাটায় মাথা রেখে ঘুমবো একটু |”
“এই ভরা সন্ধ্যাবেলায় ?”
“তাতে কি?”
“তা হোক | দেখি সরো তো, জানালাটা খুলি |”

আমার মুখটা ওর ঠাণ্ডা চুলে ডুবে গেল মুহূর্তের জন্য | তারপর ওর গলাটা আমার কপালে লাগল | আমরা প্রথম, এই প্রথম, একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই প্রথম, একজন আরেকজন কে ছুঁলাম | জানালাটা খুলতে এত সময় লাগছে কেন ?

স্বাতী জানালাটা খুলে নিজের সীটে গিয়ে বসল | পাশের দিক থেকে এখন হাওয়াটা আসছে | ওর পায়ের কাছে শাড়িটা হটাত হাওয়াটায় কাঁপতে শুরু করল |
“আর কতক্ষণ লাগবে ?”
“ঘণ্টা দুয়েক বোধহয় |”

আমার চোখের দৃষ্টিটাকে স্বাতীর মুখ থেকে ফিরিয়ে নিলাম | একটা শুকনো নদী | ব্রিজের গুমগুম আওয়াজ | ট্রেনের স্পীড বাড়ছে | সূর্যের শেষ আলোটা নদীর চিরচিরে জলটাতে একবার ঝিকমিক করে উঠে মিলিয়ে গেল | স্বাতী হাত জোড় করে পশ্চিম দিকে প্রণাম করল | আমার মনে পড়ে গেল চিঠিটার লাইনটা – “ভগবানের দোহাই আপনি ...” | ভগবান ওর দোহাই শুনতে পায় নি | ও কিসের আশায় প্রণাম করল ?

*    *    *

ঘুম আসছে না | সিগারেটও ফুরিয়ে গেছে | স্বাতী ঘুমচ্ছে | শোয়ার আগে ও বলেছিল – “শোবে না ? আমার চোখ ঘুমে ভেঙ্গে আসছে |”

ম্যানেজারটা প্রথমে যে ঘরটা দেখিয়েছিল সেটাতে ডাবল বেড ছিল | পায়ের দিকের দেওয়ালে বিরাট একটা আয়না | আয়নার সাথে বিছানার সম্পর্ক ভেবে বুকটা গুলিয়ে উঠেছিল | জিজ্ঞাসা করেছিলাম – “আর কোন রুম নেই ?”
“আছে |”
তারপরে অস্বস্তি ভরা গলায় বলেছিল – “এটা নিলে পারতেন | সবাই নেয় | অন্য ঘরগুলো তে সিঙ্গল বেড, আলাদা আলাদা | আর, তাছাড়া এটা কে আমরা হানিমুন রুম বলি |”

লোকটা কি নির্লজ্জ |  স্বাতী ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল – “অন্য রুমগুলি দেখান | যেটা থেকে পাহাড় দেখা যাবে সে রকম কোন রুম |”

[
আমরা তাহলে হানিমুনে আসিনি | আমরা পাহাড় দেখে ফিরে যাবো |
]

স্বাতীর নিঃস্পৃহতা আমি বুঝতে পারি না | ও কি বুঝতে পেরেছিল আমি হাজার, শত সহস্র চেষ্টা করেও ওর সাথে শুতে পারবো না |

[
রাত্রে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় ঠাণ্ডা পাহাড় দেখব | মুখটা বিস্বাদ লাগবে বেশি সিগারেট খাওয়ার জন্য, তবু শুতে পারবো না এক সাথে, খাটে, আয়নায়, ম্যানেজারের মনে |
]

“এ কি ! তুমি এখনো শুয়ে পড়নি?”
“তুমি জেগে আছো ?”
“হটাত ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল | শুয়ে পড় |”
আমি বুঝতে পারছি না কি বলব |
“স্বাতী !”
“কি ?”
“ভালো লাগছে না | তোমাকে একটা কথা বলব বলব ভাবছি ...”
“এখানে এসো তো |”

[
“ আমি তোমাকে এখনো নিজের ইচ্ছায় ছুঁয়ে দেখিনি, জানো ? তোমার ইচ্ছা করছে না ?”
“ কি ?”
]

“সিগারেটগুলোও ফুরিয়ে গেল |”
“অত সিগারেট খেতে নেই | বাবার আজকাল বুকে ব্যথা হয় মাঝে মাঝে, জানো |”
স্বাতী উঠে এসে আমার হাত ধরে টানল | বিছানায়, ওর নয় আমার, এসে বসলাম |
“শুয়ে পড় |”

[
নারী ও মাতৃত্ববোধ আমাকে চিরকাল স্পর্শ করেছে | স্ত্রী পুরুষের অন্য সম্পর্কগুলো যেন অস্পষ্ট |
]

স্বাতী কম্বলটা টেনে দিল গলা অব্দি | আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একবার হাই তুলল | আতপ চালের মতো দাঁতগুলো – ছোট ছোট, পরিষ্কার | আমার এলোমেলো চিন্তার জট এক সহস্রাংশ খোলেনি | চোখ বুজলাম শান্তির আশায় | সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা হাত, স্বাতীর, কম্বলটা টেনে দিল পায়ের কাছে | চুপচাপ নিথর নিস্তব্ধতা | তারপর স্বাতীর চটির আওয়াজ, দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে চলে গেল |

*    *    *

আজ সকালে যখন উঠলাম, এখানে আসার পর তিনদিন কেটেছে | স্বাতী একটা শাল গায়ে দিয়ে জানালার ধারে বসেছিল | আমি গত তিন ভোরের মতই বেরোতে যাচ্ছিলাম | হটাত কি মনে হতে দরজার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকালাম | ফোলা ফোলা চোখে স্বাতী তাকিয়ে | চোখের নির্নিমেষ দৃষ্টি যেন নির্জন দ্বীপ থেকে পরিত্যাগ করে যাওয়া জাহাজের চলে যাওয়া দেখছে | বুকের ভিতর একটা মোচড় অনুভব করলাম | ওর এই দৃষ্টি আমি আগে দেখিনি | গলাতে একটা রুক্ষতা উঠছিল নিজের বিবশতার উপর রাগ হয়ে | তবু যথাসম্ভব চেষ্টায় গলাটা হালকা করে বললাম – “স্বাতী বেড়াতে বেরুবে আমার সাথে ?”

স্বাতী ঘাড় নাড়ল | তারপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল – “একটু দাঁড়াও | চটিটা বদলে নিই |”

বাইরে কুয়াশা সরে যাচ্ছিল | ঘাস ভিজে ছিল | আর সকালের স্নিগ্ধতায় ঘুমের আড়ষ্টভাবটা কেটে যাচ্ছিল | স্বাতী পাশে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে শালটা ঠিক করে নিচ্ছিল | আমার শাল ও পায়জামা ভেদ করে একটা গা মাখা ঠাণ্ডাভাব লাগছিল | আর তাই বুঝতে পারছিলাম না স্বাতীর শীত করছে কি না |

হাঁটতে হাঁটতে আমরা উপরের দিকে উঠছিলাম | একটা জায়গায় রাস্তাটা হটাত গোল হয়ে ঘুরে নিজের কাছেই ফিরে এসে শেষ হয়ে গেল | মাঝখানের গোল জায়গাটায় কটা কাঠের বেঞ্চ আর কিছু ছড়ানো ছিটানো গুলমোহর ধরনের গাছ | ভিজে ঘাসে লাল টকটকে ফুল পড়েছিল, অজস্র | ফুলগুলো দেখতে দেখতে স্বাতীর পায়ের লাল চটি দেখতে পেলাম | হুবহু এক রং |

আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেটা পাহাড়টার মাথার শেষ | চারিদিকে গাছে ঢাকা ঢালু জমি নেমে গেছে | একটা হাওয়া গাছগুলোর মাথায় চিরুনি বুলিয়ে দিচ্ছিল | একটা মচমচ শব্দ শুনে দেখলাম পাহাড়ি পথ বেয়ে একটা লোক আর তার বউ কাঁধে জিনিস নিয়ে চলেছে | ওরা জঙ্গলে মিলিয়ে গেল আস্তে আস্তে | জঙ্গলের নিস্তব্ধতা আবার প্রকট হয়ে উঠতেই হটাত নিজের নিঃসঙ্গতার কথা মনে হল | তাকিয়ে দেখলাম স্বাতী নিচু হয়ে ভিজে ঘাসে শালের আঁচল লুটিয়ে ফুল কুড়চ্ছে | খানিকক্ষণ পরে মুখ ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একটু ইতস্তত করে বলল – “তোমার রুমালটা একটু দেবে ? হাতে ফুলগুলো আঁটছে না |”
“কি করবে জংলা ফুল কুড়িয়ে ?”
“দুপুরে তো কিছু করি না | ভাবছিলাম একটা মালা তৈরি করব |”
“পরবে ?”
“না | এমনি সময় কাটানোর জন্য |”

বুঝলাম কি অসম্ভব নিঃসঙ্গতা, সময়বোধহীনতা আরোপ করেছি আমি স্বাতীর মনে | রুমালটা দিলাম | স্বাতী নিচু হয়ে ফুল কুড়ানোতে মন দিল | আমি বেঞ্চে বসলাম ওকে সাহায্য করার হটাত ইচ্ছাটা চেপে | নিস্তব্ধতা আবার ঘন কুয়াশার মত নেমে এলো |

*    *    *

চারটে দিন কেটে গেছে | মানে চারটে সকাল, চারটে দুপুর, চারটে বিকেল আর চারটে রাত | সূর্য উঠেছে চারবার আর ডুবেছেও চারবার | অথচ আমি এখনও এর মানে খুঁজে পাইনি | যে, কোন অপরিচিত একটি লোক একটি অপরিচিতা মেয়ের সাথে বিয়ের দু’দিন পরে নাম-না-জানা একটা হিল স্টেশনে হানিমুন করতে আসবে, ও এসে এতগুলো পর্ব যাপন করবে অসহ্য অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে, প্রাকৃতিক সমস্ত নিয়ম উপেক্ষা করে |

অথচ দিন ছয়েক আগে, বিয়ের সময় আমি স্বাতীর বা স্বাতী আমার এতোটা অচেনা ছিল না | কিন্তু, কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল |

এ সবই  কি শুধু একটা চিঠির জন্য ? স্বাতীর মুখ দেখলে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় একটা কথা | আমার মনে হয় ও বুঝতে পেরেছে যে আমি চিঠিটা পেয়েছিলাম | বিয়ের আগে | ও কি কিছুতেই বুঝতে পারছে না যে আমি চিঠিটা পেয়েছি বিয়ের পরে | যখন আর কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না |

*    *    *

আজ পঞ্চম দিন | সকালে উঠে স্বাতী স্নান করে গেরুয়া একটা শাড়ি পড়েছিল | তার উপর সাদা একটা উলের চাদর জড়িয়ে যথারীতি জানালার ধারে বসল গিয়ে | আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে পেপারটা নিয়ে বসলাম | ক’দিন ধরে পেপারটা আমার সঙ্গী হয়ে আছে | পেপারটা লোকাল | রোজ ভোরে দরজার বাইরে পড়ে থাকতে দেখি | উঠিয়ে নিয়ে খুঁটিনাটি পড়ি | তারপর স্বাতী স্নান করে বেরোলে নিচে নেমে ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট করতে যাই |

এই হোটেলের অলিখিত নিয়মে সদ্যবিবাহিতের দল একটু  বেলায় ব্রেকফাস্ট করতে নামে | তারপর কাঁচা রোদে বেড়াতে বেরোয় | অথচ আমরা এসে থেকেই সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করছি | আজ স্বাতী এসে ডাকল না | চুপচাপ জানালার ধারে গিয়ে মেঝেতে কার্পেটের উপর বসল | কার্পেটের উপর বসলে জানালা দিয়ে সমতলের কিছুই দেখা যায় না | শুধু সহ্যাদ্রির চূড়াটা দেখা যায় | বেশির ভাগ দিনই আবহাওয়া পরিষ্কার থাকছে এবং নীল আকাশে অসম্ভব কাটা কাটা চূড়াটা চোখে পড়ছে | রাত্রে চাঁদের আলোয় মনে হয় কালো ভেলভেটে মোড়া একটা রুপোর তৈরি বর্শার শলা | কিন্তু দিনের বেলায় সাদা, শুধু সাদা | প্রথম দিন তন্ময় হয়ে তাকিয়েছিলাম | দ্বিতীয় দিন থেকে লক্ষ্যে পড়ে না | তবে বুঝে উঠতে পারিনি স্বাতী ওটার মধ্যে অত কি দেখে | আজ জিজ্ঞাসা করলাম – “স্বাতী ! কি দেখছ ?”
“উঁ | কিছু না |”

[
“কিছু না ? আমি লক্ষ্য করেছি তুম পাহাড়টাকে তন্ময় হয়ে দেখ | কিছু দেখতে পাও না ওর মধ্যে ? নাকি ওটা তোমার ভাবনা চিন্তার আঁকিবুঁকি কাটার সাদা পাতা ?”
]

স্বাতী উঠে দাঁড়ালো | তারপর বলল – “চলো, নিচে যাই |”
“চলো |”
পেপারটা গুটিয়ে উঠে পড়লাম |

ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে একটা কথা মনে পড়ল | ঘুরে স্বাতীকে বললাম – “স্বাতী, হাট দেখতে যাবে ?”
“কাপড় বদলে না এমনি ভাবেই ?”
“এমনিই চলো |”

আমরা এসে অব্দি বিশেষভাবে জামাকাপড় পরিনি একবারও | যখনি বেরিয়েছি আমার পরনে থেকেছে পায়জামা, পাঞ্জাবি আর শাল | স্বাতীর পরনে শাড়ি আর শাল কিম্বা উলের চাদরটা |

বাইরে বেরোতেই সোনা গলা রোদে চোখটা জুড়িয়ে গেল | বাইরে সবুজ ঘাসের ডগায় নীলচে শিশিরের আস্তরণ রোদে চিকমিক করছে | রাস্তায় লোকজন কম এখন | পাহাড়ি লোকগুলোর আধবোজা চোখে আর বিস্তৃত মুখে হাসির আভাস | নিজের অজান্তেই মুখের ভাঁজে একটা হাসি ফুটে উঠল | তাকিয়ে দেখলাম স্বাতীর মুখে রোদের ছটায় আর হাসির বিচ্ছুরণে একটা কাটাকাটি চলছে | মনে হল ইচ্ছে করলে আমি একটা ন্যায়সঙ্গত ভাবে ওই লোভনীয় গালে হাত দিতে পারি | মনটা আচমকা একটা অধিকার বোধের খুশিতে ভরে গেল |

হাটটা দেখে মনে হল এক কথায় জনসমুদ্র | মাসে নাকি একবার এত জোয়ার আসে যখন হাট বসে | হটাত স্বাতী মেঘ কেটে ঝিকমিকয়ে ওঠা রোদের মত খুশি খুশি গলায় চেঁচিয়ে উঠল – “ও মা ! কত লোক !”

আমরা ভিড় ঠেলে এগোতে লাগলাম | চুড়ি, মনিহারী, খাবারদাবারের দোকানে চারিদিক ঘেরা – মাঝখানে মাটির উপর জিনিস রেখে শাক সবজি, মাছ মাংস বিক্রি হচ্ছে |

অনেকক্ষণ থেকে ঘুরছি | ঘুরছি আর ঘুরছি | পা ব্যথা করছে একটু | তার উপর লোকের ধাক্কাধাক্কি | একবার স্বাতীর দিকে একটা গরু তেড়ে আসছিল | স্বাতী ভয়ে হটাত আমার বুকের মধ্যে এসে টুক করে পাখির মত ছোট্ট হয়ে মিশে গেল | গরুটা এগিয়ে আসতে আসতে থেমে আমার দিকে তাকাল | তারপর ঈর্ষা কাতর একটা দৃষ্টি হেনে ঘুরে চলে গেল | আমি গর্বের মধ্যে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেললাম |

*    *    *

কাল রাত্রে একটা স্বপ্ন দেখেছি | আমি সেই বেঞ্চটায় বসে | স্বাতী আপনমনে ফুল কুড়চ্ছে | নিচু হওয়ার প্রচেষ্টায় মুখটা ঈষৎ রক্তিম আর কপালে স্বেদ বিন্দু | কুড়চ্ছে, কুড়চ্ছে, শেষ নেই | হটাত কোথা থেকে একটা মাদলের আওয়াজ পেলাম | আস্তে আস্তে খুব আস্তে আস্তে জঙ্গল ঠেলে এগিয়ে আসছে | মৃদু তালের একটা আওয়াজ | জঙ্গলের মর্মর ছাপিয়ে ভাসছে | স্বাতী মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল | তারপর ফুলগুলো এনে আমার পায়ের কাছে রেখে বলল – কি বলল শুনতে পেলাম না | বোধহয় ফুলগুলো পাড়াতে মানা করল | তারপর আবার ফুল কুড়তে লাগল | আমার পায়ের কাছে রাখা ফুলগুলো থেকে একটা তুলে নাকের কাছে ধরলাম | মৃদু একটা সৌরভ | স্বাতী আবার এসে আরও কিছু ফুল রেখে গেল | স্বাতীর হাঁটা চলা যেন বদলে গেছে | স্বাতী নাচছে | মৃদু মৃদু মাদলের তালে তালে ঘাসের ডগার উপর ফুলগুলো এড়িয়ে স্বাতী ভেসে বেড়াচ্ছে শরতের হালকা মেঘের মত | নাচতে নাচতে ঘুরছে, দেখছে, খুঁজছে, কুড়চ্ছে, তুলে রাখছে ফুল আঁচলে | তারপর এসে আমার পায়ের কাছে ঢেলে দিচ্ছে | লাল লাল ফুল, অজস্র, টকটকে |

স্বাতীর নাচের তাল আস্তে আস্তে বাড়ছিল | মাদলের আওয়াজটা ভেসে আসছিল এতক্ষণ | এবার বয়ে আসছে | অনেক বেশি জোরালো এখন | স্বাতী লাল ফুল তুলছে গাছ কোমর শাড়ি পরে | ঘামে চুল কপালে আটকে গেছে | মাঝে মাঝে আমাকে একটা হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে | আমি সেই হাসির মধ্যে একটা আহ্বান পেলাম যেন | উঠে দাঁড়ালাম | কিন্তু স্বাতীর কাছে যেতে গিয়ে দেখলাম আমাকে ঘিরে চারিদিকে ফুল | আমার হাঁটু অব্দি | পাড়াতে মানা | স্বাতীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম এতক্ষণে হাসি, ফুল, শাড়ি সব এক হয়ে গেছে | সেখানে একটা ঘূর্ণি | উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে | মাদলের আওয়াজটা ঢেউয়ের মতো কানে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো | আমার চারিদিকে ফুলের স্তূপ উঁচু হতে হতে আমাকে ঢেকে ফেলছিল | ভেজা ভেজা ঠাণ্ডা ফুল | সৌরভটা পবিত্রতার মত শরীরটাকে ঘিরে ধরছিল | আমি আকণ্ঠ ফুলে ডোবা | মাদলের আওয়াজ আস্তে আসতে মিলিয়ে যেতে লাগল | শুধু রইল সৌরভটা | মুখে ফুলের স্পর্শে শিউরে উঠছিলাম | হটাত সব ঝড়, সব কোলাহল থেমে গেল | স্বাতীকে দেখতে পেলাম না |
স্বাতী কই ? স্বাতী কোথায় গেল ?

ঘুমটা ভেঙ্গে গেল | দেখলাম স্বাতী আমার বুকের একান্ত কাছে মুখ রেখে কাঁদছে | কান্নার শব্দে নয়, আর্দ্রতায় বুঝলাম | চুলগুলো আমার গালে মুখে ছড়ানো | তার থেকে সেই মৃদু সৌরভটা উঠছে |

*    *    *

[
“স্বাতী !”
“কি ?”
“আমি তোমার চিঠিটা পেয়েছিলাম |”
“কবে ?”
“বিয়ের পরদিন |”
“বলনি তো |” স্বাতীর গলায় কান্নার আভাস |
“সাহস হয়নি |”
“সাহসের কি দরকার ছিল ?”
“বিয়ের রাতে তোমাকে দেখে যে আশা পেয়েছিলাম তা ভাঙ্গতে সাহস হয়নি | ... তুমি আমাকে ভালোবাসো ?”
“এখন ? হ্যাঁ | তখন বাসতাম না |”
“তোমার কি দুঃখ হচ্ছে তখন বলিনি বলে ?”
“কখন ?”
“যখন চিঠিটা পেলাম |”
“একটুও  না |”
]

কাল আমরা চলে যাবো | আজ আমি আর স্বাতী বাজারে গিয়েছিলাম কটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে | ফেরার পথে উপর থেকে আমাদের হোটেলটা দেখতে পেলাম | স্বাতীকে বললাম – “এই ! রাস্তা ছেড়ে পাহাড় দিয়ে নেমে যাবে ? অনেক তাড়াতাড়ি হবে |”
“পড়ে যাব না তো ?”
“আমি ধরে রাখবো |”

পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে শুরু করলাম | এখানে পাহাড়টা একেবারেই খাড়া না | চারিদিকে খালি গাছ, গাছালি আর আকাশ বেঁধা গাছের গুঁড়ি | বড় বড় নুড়ি এখানে ওখানে ছড়ানো | কতকগুলো শেওলায় সবুজ হয়ে আছে | সমস্ত জঙ্গলটা ঠাণ্ডা আর গা ছমছমে | স্বাতী খানিকটা নেমে বলল – “একটু বসবে এখানে ?”
“কেন, পা ব্যথা করছে ?”
“না, এমনি | ... এখানে আবার কবে আসা হবে |”
“বেশ তো | চলো ওখানে |”
যে জায়গাটায় বসলাম সেখানে একটু রোদ এসে পড়ছে একটুখানি ঘাসের উপর | হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে রাখলাম | স্বাতী বসে হাঁটু দুটো জড়ো করে হাত দিয়ে ঘিরে ধরল | অন্যমনস্কতায়, ফিরে যাওয়ার হতাশায় কিছুক্ষণ কাটল | তারপর স্বাতী ফিসফিস করে বলল – “ আশ্চর্য |”
“কি আশ্চর্য ?”
“আমাদের এই প্রেমে পড়াটা | তাই না ?”
“হুঁ |”

আবার নিস্তব্ধতা | আমার গা সওয়া গরম রোদটায় একটা মদালস ভাব লাগছিল | শিরা উপশিরায় একটা আমেজ জড়িয়ে উপরে উঠছিল | স্বাতীকে কোলের কাছে টেনে নিলাম | স্বাতীর শরীরটা ফুলে মত নুইয়ে পড়ল | স্বাতী একটা ফুল, একটা পাখি, এক টুকরো মেঘ | আকাশের অসীম নির্লিপ্ততা আর প্রকৃতির পরিব্যাপ্তির মধ্যে আমি আর স্বাতী সোনালী সুখের সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখলাম | শরীরে স্পর্শের যে সুখানুভূতিটা মজ্জায় মজ্জায় মিশে যাচ্ছিল ঠোঁট দিয়ে তার এক চুমুক পান করলাম | স্বাতীর গালে গাল রেখে অনুভব করলাম প্রেমের প্রথম স্পর্শে শিরায় উপশিরায় উষ্ণ রক্ত ছুটে এসে ওর মুখে লজ্জার আবীর ছড়িয়ে দিল |

*    *    *

আমরা ফিরে চলেছি | ট্রেনটা জোরে ছুটছে | আশেপাশের গাছপালা, ঘর বাড়ি সব দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পাশ দিয়ে সমান্তরাল রেখায় ছুট যাচ্ছে | আমায় হাতের মুঠোয় যেন এরা এসেছিল, এখন মুঠোর ফাঁক দিয়ে গলে যাচ্ছে |

একটা ছোট্ট স্টেশন | মোরাম ঢাকা প্ল্যাটফর্ম | কাঠ-চাঁপা গাছ | কাঠবিড়ালি | স্টেশন মাস্টার | সবুজ ফ্ল্যাগ | জানালায় এসে বসা কৌতূহলী চড়ুইটা ট্রেনের নড়ে ওঠায় ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল | স্বাতী ফিক করে হেসে ফেললো |

স্বাতী জানালার ধারে বসে আছে | হেমন্তের ধান-হলুদ রোদ এসে গালে কপালে পড়েছে | গায়ের শাড়িটাও হলুদ | মাঝে মাঝে ঠোঁটের মাঝখানে একটু চাপা হাসি খুশির আভাস দিয়ে যাচ্ছে | আমি মাঝে মাঝে ওর চুলটাতে হাত দিচ্ছি, ধরে টানছি | স্বাতী ডুবে যাওয়া আরামের সুরে বলছে – “এই, ছাড় না |”

ট্রেনের স্পীড আর একটু বাড়লে উঠে স্যুটকেসটা  খুললাম | হাতড়ে হাতড়ে চিঠিটা বের করে পকেটে লুকিয়ে রাখলাম | তারপর কুপে থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে গিয়ে চিঠিটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়লাম | দরজাটা খুলে হাওয়াতে টুকরোগুলোকে ছেড়ে দিলাম | হটাত নিরালম্ব হয়ে টুকরোগুলো গতিহীন একটা অদ্ভুতভাবে ভাসতে লাগল | দূরত্বের জন্য টুকরোগুলো ছোট হয়ে আসছিল | তারপর মিলিয়ে গেল দৃষ্টি থেকে | দরজাটা বন্ধ করে কুপেতে ফিরে আসতে আসতে হটাত মনে হল স্বাতীর আমাকে লেখা প্রথম চিঠি ছিল এটা |

মনে হল না ছিঁড়লেও হত |
--


কোন মন্তব্য নেই: