বুধবার, ৮ জুন, ২০১৬

চুল জড়িয়ে

|| চুল জড়িয়ে ||


দুপুর দুটো নাগাদ প্রমথকে স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখে রথীন বলল, “বাবা, আপনি বিশ্রাম নেবেন না ?” প্রমথ বললেন, “না, আজ মনে হচ্ছে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছি | অনেকদিন পরে তোমাদের সাথে খেলাম তো | কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করি নি |” বিশাখা পাশে এসে বসে বললে, “কেন বাবা, কী কষ্ট হচ্ছে ? একটু জোয়ান দেব ?” প্রমথ ম্লান হেসে বললেন, “না রে, থাক | পেটটা একটু ভার হয়েছে | আবার ঠিক হয়ে যাবে |” রথীন বলল, “বাবা, আমার মনে হয় আপনি শুয়ে পড়লে ঠিক হয়ে যাবেন |”

বিশাখা বলল, “বাবা ভাত বেশি কেন খেলে ? তুমি খিদের আন্দাজ করতে পার না ?” প্রমথ বললেন “ভাতের আন্দাজ তো আছে | কিন্তু তুই এত সব রেঁধেছিলি, তাতেই বেশি হয়ে গেল |” রথীন অবাক হয়ে বলল, “বাবা আমি বুঝলাম না |” প্রমথ বললেন, “কত খিদেয় কত ভাত খেতে হয় তার অভ্যাস তো সেই ছোটবেলায় হয়েছে | তখন ভাত খাওয়া বলতে সাথে একটু ডাল, আর আলু পোস্ত কি কুমড়োর ছেঁচকি, গরমকালে ডালে সর্ষে ফোড়ন দিয়ে দুটো কাঁচা আমের টুকরো ছেড়ে দেয়া | সপ্তাহে হয়ত একদিন পোনা মাছ | তখন ভাত খেয়েই পেট ভরত | আর আজ ...” বিশাখার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “মেয়ে আমার কত পদই যে রেঁধেছিল | তাই ভাতের সাথে আনুষঙ্গিক সব খেয়েই খাওয়াটা বেশি হয়ে গেল | দোষটা ওই ছোটবেলার অভ্যাসের |” রথীন বলল, “আমরা যখন নেই, তখন কি আপনি বেশি খান না ?” প্রমথ বললেন, “তোমরা না থাকলে মিন্টুর মা ওই এক তরকারী, ডাল ভাত করে দিয়ে যায় | ও না এলে আমি আলু ডিম সেদ্ধ করে ফ্যানা ভাতের সাথে খেয়ে নিই |”

রথীন বলল, “আপনি যদি না ঘুমন তাহলে চলুন কোথাও থেকে ঘুরে আসি | এমন শীতের দুপুর ... |” বিশাখা আঁতকে উঠে বলল, “এখন কোথায় যাবে ? আমার যে ভাত ঘুম পাচ্ছে |” “আহ, চলো না | বাবার গাড়িটা কতদিন পড়ে আছে |” প্রমথ বললেন, “না, বিশু এসে মাঝে মধ্যে স্টার্ট দিয়ে যায়, জল, তেল, ব্যাটারিও দেখে নেয় | তবে সেই তোমরা পুজোয় এসেছিলে, তারপর আর গাড়িটা নড়ে নি |” চাঙ্গা হয়ে উঠে প্রমথ বলল, “চলো তাহলে | আমরা পুরুলিয়া ঘুরে আসি |” বিশাখা বলল, “আমি যদি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়ি ?” প্রমথ বলল, “কোন অসুবিধা নেই |”

কোকালিয়া পার হতেই পিছনের সিট থেকে প্রমথ রথীনের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ফিসফিস করে বললেন, “মেয়ে আমার ঘুমিয়ে পড়েছে |” রথীন গাড়ি চালাতে চালাতে ঠিক দেখে নি | খুব আস্তে করে গাড়িটা রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে নেমে বাঁ দিকের দরজা খুলে বিশাখার সিটটা পিছিয়ে দিয়ে তার পিঠটা পিছনে হেলিয়ে দিল | বিশাখা একবার উঁ করে উঠে শরীরটাকে হেলান সিটে মিশিয়ে নিল | তারপর মৃদু স্বরে বলল, “থেমো না | চালিয়ে যাও |”

রথীন গাড়িটা চালু করে একটু বেগ নিতেই প্রমথ বললেন, “সামনের লেভেল ক্রসিংটায় একটু থামবে ?” রথীন দেখতে না পেয়ে বলল, “কোথায় লেভেল ক্রসিং ?” প্রমথ বললেন, “চলো, আরও মাইল কয়েক পরে, রঘুনাথপুর ঢোকার আগে | ওখানে একটু থেমো |”

লেভেল ক্রসিং পৌঁছে রথীন ভুলে গিয়ে পার হয়ে যেতে যেতেই প্রমথ বললেন, “এই এখানে ... এখানে একটু থামো |”

জোরে থামানো গাড়ির ঝাঁকুনিতে বিশাখা চোখ খুলে বলল, “কোথায় এলাম আমরা ?” প্রমথ বললেন, “টুকু পিসির লেভেল ক্রসিংয়ে | তুই নামবি ?” বিশাখা বলল, “না, তুমি যাও | আমরা একটু গাড়িতেই বসছি |”

প্রমথ গাড়ি থেকে নেমে রেল লাইনের দিকে যেতে শুরু করলে ওনার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রথীন বলল, “টুকু পিসি কে ? আমি তো কোনদিন নাম শুনি নি |” বিশাখা বলল, “আসলে পিসি নয় | বাবার ছোটবেলার খেলার সাথী |”
-    “গার্লফ্রেন্ড, বান্ধবী ?”
-    “ঊঁহু ... বাবার ছোটবেলার খেলার সাথী |”
-    “ও |” না বুঝে রথীন চুপ করে থাকলো |

একটু পরে বিশাখা বলতে শুরু করল ...
“বাবা আর টুকু পিসি ছোটবেলায় একসাথে খেলত | খেলার মধ্যে ঝগড়াও ছিল | মাঝে মধ্যেই চুল জড়িয়ে ঝগড়া করত | দুজনের বাবা মা ওদের ছাড়াতে পারত না – এই ভাব, তো এই ঝগড়া, তো এই আড়ি |”

রথীন বিশাখা চুপ করে যাওয়ায় বলল, “তোমার গল্পটা এখানেই শেষ নয় বোধহয় ?”

বিশাখা আবার বলতে শুরু করল ...
“বড় হয়ে ওঠার আগেই দুজনে আলাদা | তারপর টুকু পিসির কী হল কে জানে | এদিকে, আমি ছোট থেকে দেখেছি বাবা মার সাথে ভীষণ ঝগড়া করত, কী প্রচণ্ড অনমনীয় মনোভাব নিয়ে, সে বলার নয় | কারণ জানতাম না, কিছু বুঝতামও না |

“তারপর, একদিন, তখন আমি স্কুলে এইটে উঠেছি | টুকু পিসি বাড়িতে এল | খুব বড় অসুখ থেকে উঠেছিল | পিসেমশায় আসতে পারে নি | পিসিকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল, বাবা স্টেশনে গিয়ে নিয়ে এসেছিল | একদিন বাবা, আমাকে, মাকে আর পিসিকে নিয়ে গাড়িতে করে এখানে এসেছিল | পিসি সারাটা পথ চুপ করে বসেছিল |

“এখানে নেমে, বাবার কী মনে হল, বলল, টুকু, চল ছোটবেলার মত চুল জড়িয়ে ঝগড়া করি | ও মা ! জানো, পিসি কী বলল ? বলল, ঝগড়া করার মত আর চুল কি আছে যে ঝগড়া করব তোমার সাথে | বাবা অবাক হয়ে বলল, কেন ? পিসি মাথায় পরা পরচুলা খুলে বলল, এই দ্যাখো |

“কেমোথেরাপি করে পিসির সব চুল পড়ে গিয়েছিল | এর কিছুদিন পরে পিসি ফিরে গেল | তারপর আর বেশিদিন বাঁচে নি |

“ পিসির মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পর মায়ের অদ্ভুত পরিবর্তন হল | কদিন খুব কাঁদলো | তারপর আমাকে একদিন ডেকে বলল, দেখিস, তোর বাবার সাথে আমি আর ঝগড়া করব না | আমি না বুঝে বললাম, ভালোই তো | কিন্তু বাপি যদি করে ?

“আমি তখন বাবাকে বাপি বলতাম ...
   
“মা বলল, করলে আমি মুখ বুজে থাকব | আমি বুঝেছি ... ও কি আর আমার সাথে ঝগড়া করে ? ও তো ওই টুকু পিসির সাথে ঝগড়া করে | বলে মা আবার কাঁদতে লাগল |

“তারপর আমরা আর এখানে আসি নি | আমি জায়গাটার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম |”


----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৮ জুন ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই: