শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৩

এক অম্লান সত্য

সবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এ দাখিল হইয়াছি |  পিতা মাতার শাসন হইতে মুক্তি এবং সদ্য-প্রাপ্ত স্বাধীনতার আনন্দে চিত্ত সদাই উৎফুল্ল. আমোদ আহ্লাদ এর অন্ত নাই | নিত্য নতুন বন্ধু সংগ্রহ হইতেছে |  কথায় কথায় হাসি মস্করা, গান, বাজনা | কিছু নাই তো সদ্যজাত বাছুরের ন্যায় হাত, পা ও কল্পিত লেজ নাড়াইয়া লম্ফ ঝম্প - কে কাহাকে দেখে সে প্রশ্ন অবান্তর |

এমন সময় একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে  - ঘটনা অথবা নাটক | তাহার কথাই এখনকার বক্তব্য | তবে, সেই প্রসঙ্গের চর্চা করিবার পূর্বে সেই নাটকের চরিত্রগুলির পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করি |

প্রথম চরিত্র – প্রথম বর্ষের ছাত্র বর্ধন – নাম হইতে অনুমান করা যায় তাহার কলেবর | জন্মাবধি পিতামাতার স্নেহ যেন তাহার শরীরে পুঞ্জিভূত মেদ রূপে ব্যাপ্ত | কিন্তু দেহ অনুযায়ী চিত্ত তাহার বড়ই সরল ও শান্ত | ভদ্র ব্যবহারে সে সকলের চিত্ত অল্প সময়েই জয় করিয়াছিল | তাহার আর এক বৈশিষ্ট্য ছিল উদার-হৃদয় | কখনো কেহ কিছু ধার লইলে সে তাহা ফেরত লইবার কোনও প্রচেষ্টার ধারে কাছেও যাইত না |

দ্বিতীয় চরিত্র – সেও প্রথম বর্ষের ছাত্র, কিন্তু প্রকৃতিতে সম্পূর্ণ বিপরীত | নাম তাহার অম্লান, এবং বৈশিষ্ট্য তাহার, অম্লানবদনে দুষ্টামি করা | তাহার দুষ্টামি হইতে কেহ ছাড় পাইত না | আর তাহার সুদীর্ঘ কদ ছিল সম্পূর্ণ কলেবর-হীন – অর্থাৎ ভগবান তাহাকে লম্বা অস্থির কাঠামো দিয়া, তাহার উপর মাংসের আচ্ছাদন প্রদান করিতে প্রচুর কার্পণ্য করিয়াছিলেন, কোনও অজ্ঞাত কারণে | কাজেই তাহার দুষ্টামির ভুক্তভোগী তাহাকে প্রহার করিতে চাহিলেও তাহার রুগ্ন শরীরে লক্ষ্যভেদ ব্যর্থ হইত | তদুপরি অম্লান অল্প বয়েসেই পুনঃপুন পিতৃ-হস্তে প্রহৃত হইয়া শেখে যে, “য পলায়তি স জীবতি” |

তৃতীয় চরিত্র – রসায়নের শিক্ষক জটায়ু বাবু | তাঁহার আয়ুতে জট লাগায় তাঁহার বয়েস বোঝা কিঞ্চিত দুষ্কর হইলেও, হাবভাবে ও চাল চলনে তিনি ছিলেন চির-ক্ষুব্ধ তরুণ | ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, খড়গনাসা, উন্নত ললাট এবং সদা উজ্জ্বল লাল চক্ষু | এক কালে ব্যায়াম করিতেন, ফলে শরীরের ঊর্ধ্বদেশ ও অধোদেশ ঋজু, কিন্তু ব্যায়াম ছাড়িয়া দেয়ার ফলে মধ্যদেশ ছিল বর্ধনের মতো প্রকাণ্ড | তাঁহার প্রিয় পরিধান ছিল শ্বেতশুভ্র জামা ও পাতলুন – কিবা গ্রীষ্ম কিবা শীত | কেহ তাহাকে সোয়েটার বা কোট পারিতে দেখে নাই | তিনি রসায়নে প্রকৃতই অনুরক্ত ছিলেন এবং তাহার প্রমাণ দিতে প্রায়শ ক্লাসে ল্যাব বয় দ্বারা বীকারে জল আনাইয়া পান করিতেন | কখনো বয় চা লইয়া আসিলে পিছন-পকেট হইতে স্প্যাটুলা (নাকি চিরুনি) বাহির করিয়া চা টি নাড়িয়া পান করিতেন | শোনা কথা, সেই চা তাঁহার কক্ষে বুণ্সেন বার্নরে তৈরি করা হইত |

এই ঘটনাটির বর্ণন করার পূর্বে ইহা বলিয়া রাখা প্রয়োজন যে সময়ের সাথে স্মৃতি দুর্বল হইয়াছে, কাজেই পাঠক হয়ত বিস্তারিত বিবরণের অভাব বোধ করিবেন |

...

সেদিন শীতের সকল | দ্বিতীয় ক্লাস জটায়ু বাবুর | তিনি আসিলে ল্যাব বয় যথাক্রমে জল ও চা আনিয়া রাখিয়া গেল |  জটায়ু বাবু পাতলুনের কটিবন্ধ ঘনঘন আঁটিতে আঁটিতে, কিছু অন্যমনস্ক ভাবে পিছন-পকেট হইতে স্প্যাটুলা / চিরুনি টানিলেন, কিন্তু না পাইয়া চা এমনিই পান করিলেন |

এদিকে ক্লাসের বাহিরে উজ্জ্বল রৌদ্রের চাঞ্চল্য | জানালা হইতে আসা শীতল হাওয়ার স্পর্শে মন উড়ুউড়ু | কিন্তু ক্লাসের ভিতরের আবহাওয়া রসায়ন মাস্টার জটায়ু বাবুর জমকাল কণ্ঠের এক্সথার্মিক প্রক্রিয়ায় একেবারেই নাতিশীতোষ্ণ | এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে ছাত্রদের ধ্যান বিক্ষিপ্ত | এইরূপ অবস্থায় জটায়ু বাবু ক্বচিৎ কদাচিৎ পরীক্ষা দিয়া গ্যালারি তে উঠিয়া আসিয়া ছাত্রদের উত্তর লইয়া তর্ক বিতর্ক করিতেন | সে দিন তাহাই হইল | তিনি ছাত্রদের মধ্যে আসিলে কিছু ভালো ছাত্র তাঁহাকে ঘিরিয়া তাঁহার ধ্যান আকর্ষণে করিতে বড়ই ব্যস্ত হইল | কিন্তু যেখানে একাধিক ভালো ছাত্র, সেখানে মন্দ কিছু ঘটা অবশ্যম্ভাবী | আর যাহার আশংকা হয় তাহা ঘটেও | আমরা মধ্যবর্গের ছাত্ররা শেষ পঙক্তিতে বসিয়া যে যার ঘড়ি কখনো দেখিতেছি, কখনো বা থামিয়া গিয়াছে ভাবিয়া তাহা ঝাঁকাইতেছি কিম্বা ডেস্কে ঠুকিতেছি | হটাত দেখি মাস্টারমশাই এর চারিপাশ হইতে ছাত্ররা ছত্রখান | এবং মাস্টারমশাই অম্লানের কান ধরিয়া চিৎকার ও চড়চাপড় করিতেছেন |  তবে আওয়াজ বেশি, আঘাত কম – কারণ পূর্বেই বলিয়াছি অম্লান কে মারধোর করা দুষ্কর ছিল | সে এই পাশ ওই পাশ করিয়া মাস্টারমশাই এর উদ্ধত হাত পা এড়াইবার প্রয়াস করিতেছে, ও মাস্টারমশাই কে কিছু বলিতেছে, বুঝাইতেছে | হটাত জমিতে পড়িয়া সে মাস্টারমশাইয়ের পাতলুন ধরিল, ও মাস্টারমশাই হুঙ্কার দিয়া পাতলুনের নিম্নগামী স্খলন থামাইতে ব্যস্ত হইলেন | সেই সুযোগে অম্লান মাস্টারমশাই হইতে গ্যালারির এক ধাপ উপরে উঠিয়া দাঁড়াইল | তাহার কান মাস্টার মশাইয়ের নাগালের বাহির হইল বটে, তবে তিনি তৎক্ষণাৎ অম্লানের ক্ষীণ কটি জড়াইয়া তাহাকে হ্যাঁচকা টানে নামাইলেন, এবং তাহাকে পাঁজাকোলা করিয়া ক্লাস হইতে বাহির হইয়া হনহন করিয়া প্রস্থান করিলেন | অম্লানের হাত পা মুক্ত হাওয়াতে নিষ্ফল আস্ফালন করিতে করিতে নেপথ্যে অদৃশ্য হইল |

এই রূপে যবনিকাপাত হইলে মুহূর্তেই নির্বাক দর্শক ছাত্র সব একেবারে সবাক | সমস্বরে শত প্রশ্ন - সহস্র উত্তর | গণ্ডগোল কমিলে, এবং উত্তেজনার কিঞ্চিত উপশম হইলে, জানিলাম যে অম্লান নাকি জটায়ু বাবুর পশ্চাৎ দেশে কলম দিয়া খোঁচা দেয় | কী কারণে, কাহার কলম দিয়া, তাহা কোথায় গেল, ইত্যাদি প্রশ্নের নির্ভরযোগ্য উত্তর পাওয়া যাইল না | দিনের বাকি ক্লাস পরম অস্বস্তিতে কাটিল |

সে দিন সন্ধ্যা নাগাদ জানা গেল যে জটায়ু বাবু অম্লান কে লইয়া প্রিন্সিপালের নিকট যান, এবং অম্লান কে সোপরদ্দ করিয়া সুবিচার দাবি করেন | অম্লান নাকি দোষ কবুল করে | স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দিতে সে জানায় যে, পূর্বদিন সে বর্ধনের কলম ধার নেয়, এবং ফিরত দিতে ভুলিয়া যায় | সকালবেলায় মেসে বর্ধন তাহার কলম দেখিয়া ফেলে, কিন্তু ভদ্রতা-বশত ফিরত চায়না | তখন অম্লান ঠিক করে যে, সে বর্ধনের অজান্তে তাহার পকেটে কলমটি রাখিয়া দিবে | উপযুক্ত সুযোগ সে পায় যখন জটায়ু বাবু ছাত্রদের একজোট করিয়া কিছু বুঝাইতে লাগেন | তখন সে ভিড়ের মধ্যে বর্ধনের সাদা পাতলুন দেখিয়া তাহার পিছন-পকেটে সন্তর্পণে কলম টি রাখিতে যায় | কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হোঁচট লাগিয়া সে হুমড়ি খাইয়া পড়ে, ও তাহার হাতের কলম পাতলুনের পশ্চাৎ দেশে আঘাত করে | জটায়ু বাবুর হাতে আচমকা গ্রেপ্তার হইয়া, তাঁহার প্রহারে সে বুঝিতে পারে, যে সাদা পাতলুনটিতে সে লক্ষ্যভেদের প্রয়াস করিয়াছিল তাহার ভিতর বর্ধন নহে, জটায়ু বাবু বর্তমান ছিলেন | একথা বলা বাহুল্য যে, জটায়ু বাবু তাহাকে হাতে-কলমে ধরিয়া ফেলেন |

কিন্তু, এই ব্যাখ্যা জটায়ু বাবু মানিতে অস্বীকার করিয়া প্রিন্সিপাল কে প্রকৃত কারণ তদন্ত করিতে অনুরোধ করেন | তদন্ত-কালীন জটায়ু বাবু ক্লাস লইতে অসম্মত হন | প্রিন্সিপাল পড়েন মহা ফাঁপরে | ছাত্রদের ব্যাপারে অন্যরা কী অনুসন্ধান করিবে ? অতএব তিনি ছাত্র জিমখানা’র শরণাপন্ন হন |

এইখানে এই নাটকের দ্বিতীয় অংশ -  প্রবেশ এই লেখকের, জিমখানা’র সদস্য ভূমিকায় | অবশ্য, তদন্তে আমি একমাত্র সদস্য নহি | তবে আমার উপর বিশাল চাপের সৃষ্টি হয়, কারণটি নিম্নে দেয়া |

তদন্তের প্রথম অধিবেশনে এই তথ্য সামনে আসে যে বর্ধন ঘটনার সময় অকুস্থলে উপস্থিত ছিল না | জটায়ু বাবুর হাজিরা-খাতা অনুযায়ী বর্ধন ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল | কিন্তু, বারম্বার জেরায় অম্লান  অবিচল থাকে যে সে পিছন হইতে বর্ধনের সাদা পাতলুন স্পষ্ট দেখিয়াছিল | কমিটির পরবর্তী অধিবেশনে স্থির হয় – প্রশ্ন একই – অম্লান কি সত্যই ভ্রমবশত: সাদা পাতলুনে জটায়ু বাবু কে বর্ধন মনে করে ?

সব কমিটিতেই কিছু পরোপকারী লোক হয়, যাহারা কার্যভার অপরের ঘাড়ে চাপাইয়া পরস্মৈপদী অবসর উপভোগ করে | তাহারা রায় দেয় যে মিলন নাকি জামা কাপড়ের সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান রাখে, অতএব এই ব্যাপারে আলোকপাত করিতে মিলনই সর্বাপেক্ষা সক্ষম সদস্য | বিচক্ষণ পাঠক নিশ্চয় অনুধাবন করিতে সক্ষম যে এই অধমেরই নাম মিলন |

অগত্যা আমি সাক্ষ্য প্রমাণ জুটাইতে ব্যস্ত হই, ও জটায়ু বাবু এবং বর্ধন দুইজনেরই পাতলুন আনাই | ততদিনে উভয় পাতলুনের এক দুই ধোলাই বোধহয় হইয়াছে | পাতলুন আসিলে দেখা গেল দুই পাতলুনের মাপ প্রায় সমান | তখন স্বাভাবিক রূপে সন্দেহ জাগে কোন পাতলুনের উপর আক্রমণ হইয়াছিল | অম্লান কে জিজ্ঞাসা করিলে সে নির্দ্বিধায় বর্ধনের পাতলুন সনাক্ত করে | তাহার সনাক্তকরণের ভিত্তি কী ? সে দেখায় যে পাতলুনের পিছনে সেলাই খুলিয়া মাপ বাড়াইবার স্পষ্ট চিহ্ন আছে | মাপ কবে, কী কারণে বাড়ানো হইয়াছিল এই সব তথ্যের অনুসন্ধানে কিছু অতিরিক্ত তথ্য জানা যায় | বর্ধনের দর্জি নাকি তাহাকে উবু হইয়া বসাইয়া মাপ লইত – পাছে দাঁড়ান অবস্থার মাপে বানান পাতলুনের পিছনের সেলাই, বসিলে ছিঁড়িয়া যায় | কিন্তু, এই পাতলুনের মাপ বর্ধন যেদিন দেয়, সেদিন সে – তখনো তাহার প্রাতঃকৃত্য হয় নাই বলিয়া – দাঁড়াইয়া মাপ দায় | কিছুদিন পূর্বে, ব্যবহার-কালে পাতলুন পশ্চাৎ দেশে ছিঁড়িয়া গেলে, সে দর্জিকে পাতলুনটি দিয়া সেখানের বাড়তি কাপড়ে কিছুটা মাপ বাড়াইয়া দ্বিতীয় সেলাই করিতে বলে | ‘মে-ফেয়ার’ দোকানের দর্জি সাক্ষ্য দেয় যে সে এই সেলাই করে ঘটনার কিছুদিন পূর্বে | তাহার বকবকানি তে জানিতে পারি যে সে একই সাথে বর্ধনের সেই পাতলুনের কোমর বড়, ও অম্লানের কোনও এক পাতলুনের কোমর খাটো করে |

এদিকে স্পষ্ট দেখিলাম বর্ধনের পাতলুনের দ্বিতীয় সেলাই এক জায়গায় ছেঁড়া | সেখানে একটি ছিদ্র – যে পথে, সম্ভবত, অম্লানের হাতের কলম অন্দরে (এবং বলা যায়, জটায়ু বাবুর অন্তরে) প্রবেশ করিয়াছিল |

আশ্চর্যজনক কথা, দেখা গেল জটায়ু বাবুর পাতলুনের পশ্চাৎ সম্পূর্ণ নিশ্ছিদ্র, এমন কি কলঙ্কহীন – কোনই কলম প্রসূত দাগ নাই |

ইতিমধ্যে আমার লক্ষ্যে আরও কিছু ধরা পড়ে | সেই মতো বর্ধনকে জিজ্ঞাসা করিয়া নিশ্চিন্ত হই যে আমার এক অনুমান সত্য | সে কথা পরে |

এতদ্বারা স্পষ্ট হইল যে, অপরাধের দিন জটায়ু বাবুর পরিধানে বর্ধনের পাতলুন ছিল | ছিল কি, সত্যই ? এই ভাবে বর্ধনের পাতলুনে জটায়ু বাবুর আবির্ভাব ভাবিতে বাধ্য করে কাহার বা কিসের মাধ্যমে বর্ধনের পাতলুন জটায়ু বাবুর পরিধানে আসে | দুর্ধর্ষ বুদ্ধিমান পাঠক অনুমান করিতে পারেন কি, কে বর্ধনের পাতলুন লইয়া তাহা জটায়ু বাবুকে দিতে পারে ? ঠিক কথা – ইহা একমাত্র ধোপার দ্বারাই সম্ভব |

ধোপাকে জিজ্ঞাসাবাদের পরে মূল সত্য প্রকাশ পায়, ও রহস্যের সম্পূর্ণ সমাধান হয় | অপরাধের দিন, ধোপা প্রথম জটায়ু বাবুর বাড়িতে যায় | সেখানে, সাইকেল হইতে চুরি হইবে সেই ভয়ে, সে সমস্ত ধৌত কাপড়ের গাঁট বাড়ির ভিতরে লইয়া যায়, যেখানে জটায়ু বাবুর ভৃত্য গাঁট  এর উপরে রক্ষিত সাদা পাতলুন লইয়া লয় | বর্ধনের কাছে আসিয়া  ধোপা লক্ষ্য করে যে তাহার পাতলুনের পরিবর্তে জটায়ু বাবুর পাতলুন তাহার গাঁটে | সে কিছু না বলিয়া চুপচাপ জটায়ু বাবুর পাতলুন বর্ধনকে দিয়া পয়সা লইয়া চলিয়া যায় | বর্ধন প্রাতরাশের পর এক অদ্ভুত হাঁসফাঁস অনুভব করে | তাহার কারণ যে তাহার পরিধানে জটায়ু বাবুর পাতলুনের চাপ, তাহা সে না বুঝিয়া শরীর খারাপ ভাবিয়া ক্লাসে যায় না |

এইভাবে অবশেষে প্রমাণিত হয় যে অম্লানের ভ্রান্তির কারণ পাতলুনের অদল বদল |

অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্ট পাইয়া প্রিন্সিপাল রায় মহাশয় রায় দেন যে, যেহেতু অম্লান বিচারের পূর্বেই সাজা পাইয়াছে, তাহাকে সাজা দিবার অবকাশ আর নাই |

এই কথা প্রকাশ পাইলে জটায়ু বাবু যারপরনাই লজ্জিত হন | তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করিলে অনুসন্ধান কমিটি তাহাকে অনুরোধ করে যে তিনি যেন অম্লান কে চা (ক্যান্টিনের চা, বুণ্সেন বার্নরের নহে) খাওয়াইয়া ভুল বুঝাবুঝি দূর করেন |

...

পরদিন জটায়ু বাবু অম্লানকে ক্লাসের পর সাথে লইয়া গেলেন চা খাওয়াইতে | অম্লান ফিরিল ম্লান মুখে, এবং জানাইল মাস্টারমশাই তাহাকে লইয়া ক্যান্টিনে যান | চা আসে ভাঁড়ে | তখন তিনি বুক-পকেট হইতে সন্তর্পণে দুইটি পিপেট বাহির করেন | একটি অম্লানকে দিয়া কহেন, “ভাঁড় এর কোনও ভরসা নেই | কার না কার এঁটো | পিপেটটা দিয়ে খাও বরঞ্চ |”  তারপরে কিঞ্চিত নিম্নস্বরে, “পিপেটের সুবিধা কী, চা কম দিল কিনা বোঝা যায় |”

চা খাওয়া হইলে তিনি পয়সা দিতে চাহেন, কিন্তু অম্লান তাহাতে বাধা দেয় | তখন তিনি বলেন, “ঠিক আছে | আমি আর এক দিন তোমাকে চা খাওয়াব | তবে ভেবে দেখ, কম চায়ের জন্য পুরো দাম দেয়া উচিত কি?”

ফিরিবার পথে তিনি অম্লানকে বর্ধনের কলম ফিরত দিয়া কহেন, “অদ্ভুত ব্যাপার | যেদিন তুমি আমার ব্যাক-পকেটে কলম রাখতে গেছিলে সেদিন বাড়িতে প্যান্টটা পরে চিরুনি রাখতে গিয়ে দেখি ব্যাক-পকেটটাই নেই | তুমি কি ঠিক দেখেছিলে আমার প্যান্টে ব্যাক-পকেটটা?”

আমরা সবাই সমস্বরে কহিলাম, “সে কী ? স্যারের পরনের প্যান্টে ব্যাক-পকেট ছিল না ? তাহলে, তুই কলম রাখতে গিয়েছিলি কোথায় ?”

বর্ধন আমার দিকে ইঙ্গিত-পূর্ণ চক্ষে তাকাইল, এবং কাহাকেও উদ্দেশ্য না করিয়া বলিল, “মিলন অম্লান কে খুব বাঁচিয়েছে | অম্লান এখন বলুক সেদিন ‘মে ফেয়ার’ এ আমার প্যান্টটা দেখে ও কী বলেছিল |”

অম্লান হাসিয়া বলিল, “আমি বলেছিলাম তোর এত ঢাউস পাছায় কোনও ব্যাক-পকেট নেই, আমি হলে তো প্রত্যেক পাছায় এক জোড়া করে পকেট রাখতাম |”

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৯ অগাস্ট ২০১৩



কোন মন্তব্য নেই: