রবিবার, ১ জুন, ২০১৪

ক্ষণিকের অভিসার

|| ক্ষণিকের অভিসার ||


শিপ্রার সাথে আমার পরিচয় ছোটবেলা থেকে | প্রায় আমার সমবয়সী, হয়ত কয়েক মাস, কি এক বছরের ছোট | ওর বাবা, বাপির শ্রীধর দা’, কলেজে বাপির থেকে ক’ বছরের সিনিয়র ছিলেন | আমি ওনাকে শ্রী জেঠু বলে ডাকতাম |

১৯৪২ এর ডিসেম্বরে কলকাতায় জাপানী বোমা পড়া শুরু হলে বাপি কলেজের পড়া শেষ করতে পারে না  | বাপি জামশেদপুরে এক দূর সম্পর্কের মামার কাছে পালিয়ে আসে | তিনি বাপিকে তখনকার বর্ধিষ্ণু টাটার লোহার কারখানায় কারিগরি শিক্ষানবিস করে ঢুকিয়ে দেন |

সেই বছরই শ্রী জেঠু কলেজের পড়া শেষ করে ভারতীয় রেলে কমার্শিয়াল ক্লার্ক এর পদে যোগ দিয়েছিলেন | ওনার পোস্টিং হয় জামশেদপুর এর দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ১০০ মাইল দূরে কেঁকুঢগঢে | জেঠুর কাছে শুনেছিলাম কেঁকুঢগঢ নাকি জায়গাটার আদি নাম কিঙ্কর গড়ের অপভ্রংশ, যা ওখানকার কুঁড়ে, জাবর কাটা আদি বাসিন্দারা চিবানো তামাক আর তার রসে ভরা মুখে উচ্চারণ করতে পারত না |

শিক্ষানবিশি শেষ করে বাপি টাটার লোহার কারখানাতেই কাজ পায় | ফি বছর গরমকালে গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে যাওয়ার পথে, কিম্বা ফিরত আসার সময়, শ্রী জেঠু জামশেদপুরে নামতেন সপরিবারে | আমাদের সাথে কটা দিন কাটিয়ে যেতেন | ওদের বেড়িয়ে যাওয়ার সবচেয়ে প্রখর স্মৃতি, আমার যখন স্কুলের পাট শেষ হচ্ছে |

আমাদের তুলনায় ছয় ছেলেমেয়ের ওই পরিবারটা ছিল অনেক বড় | প্রথমে দুই ছেলে, তারপর দুই মেয়ে ও শেষে যমজ ছেলে ও মেয়ে | কলেজে পড়া বড় দুই ভাই, সৃজন দা’ আর সুজন দা’ আমার থেকে দাক্ষিণ্যে ভরা সৌহার্দ্যের দূরত্ব বজায় রেখে চলত | ছোট দুই ভাই বোন নিজেদের নিয়ে এতো মেতে থাকত যে আমার হওয়া না হওয়ায় তাদের কিছু এসে যেত না | তাই বাকি থাকত, শুভ্রা দি’ আর শিপ্রা, মাঝের দুই মেয়ে, আমার উপর ভাগ বসাতে |

জেঠিমা ছিলেন রোগা, ঘন শ্যামল বর্ণ, মেদ হীন মুখে কোটরে ঢোকা বড় বড় চোখ, শীর্ণ সূক্ষ্ম নাক, আর সরু চাপা ঠোঁট | আমি মাঝে মাঝে অনুমান করার চেষ্টা করতাম কালো না হলে কি জেঠিমা দেখতে ভালো হতেন | কিন্তু না, উনি ভীষণ কালো ছিলেন | সব ছেলে মেয়েই কম বেশি কালো ছিল, শুধু শুভ্রা দি’ আর শিপ্রা বাদ দিয়ে | ওদের গায়ের রং ছিল অনেক হালকা, আমার মায়ের ভাষায় ‘পাকা গমের রং’ | আমার দৃষ্টিতে ওদের গায়ের রঙে ছিল তপ্ত কাঁসার বর্ণাঢ্য |

বড় মেয়ে শুভ্রা দি’ আমার থেকে দু’ বছরের বড় ছিল | ভারী মিষ্টি ছিল ওর অচপল হাসি | হাসলে দাঁত দেখা যেত না | শুধু ঠোঁট দুটো দুপাশে আরও ছড়িয়ে যেত, আর তাদের দুই কোন একটু উঠে শুভ্রা দি’র চাপা গালে দ্বিতীয়ার চাঁদের মত টোল ফেলত | উচ্চতায়  ছোটখাটো, শুভ্রা দি’র চৌকো মুখটায় চোয়াল আর গালের হাড় ছিল খুব প্রকট  | ঢেউ খেলান চুল সবসময় শক্ত হাতে টেনে বিনুনি করে বাঁধা থাকত | কাঁধে আর  শ্রোণীতে শুভ্রা দি’র শরীরের কাঠামো ছিল বড্ড চওড়া | অথচ, শুভ্রা দি’র শরীর ছিল বয়েসের অপেক্ষায় অনুচ্চারিত, যা নিয়ে ও খুব আত্মসচেতন ছিল | শরীরে ভাস্কর্যে উন্নতি অবনতির এই অভাব তাই শুভ্রা দি’ ঢেকে রাখত মাড় দেয়া শাড়ির খোলের প্রলেপে | তবুও, সব নিয়ে, প্রখর গরমেও ওর কাছ ঘেঁষলে একটা ঝরঝরে স্বর্গীয় সুগন্ধ পেতাম | আসা আর যাওয়ার সময় শুভ্রা দি’ যে আমাকে জড়িয়ে ধরত, বলতে দ্বিধা নেই, আমি তার প্রতীক্ষায় থাকতাম |

শিপ্রা ছিল লম্বা, উচ্চতায় প্রায় আমার সমান, শরীর না হালকা না ভারী | আমার সেই বয়েসে ওর মুখের চেয়ে বেশি পরিষ্কার ঘরোয়া সাদামাটা চেহারা আমি আর দেখিনি | ওর ছোট মাথা থাকত লম্বা নমনীয় গলার উপর | গলায় কণ্ঠমণির নিচে হালকা মেদের স্তরে তিনটে কালচে গভীর খাঁজ ছিল, যার তুলনায় আশেপাশের ত্বক ফ্যাকাসে মনে হত | খুব গরমে ওই ত্বক আর্দ্র হয়ে চিকচিক করত |

ওর মধ্যে আমার যেটা ভালো লাগত তা ছিল ওর নিরস্ত্র করা সারল্য | ওর কিশোরী শরীরে কোনও আগ্রাসী আকর্ষণ ছিল না | প্রবণতায় প্রায়োগিক, পড়াশোনায় ওর তেমন প্রচেষ্টা ছিল না, আর তার সাধারণ ফল নিয়েও ওর কোনও লুকোচুরিও ছিল না | অথচ, আমি কোনও বুদ্ধিমত্তার কথা বললে দেখতাম ওর মুখ উষ্ণ উজ্জ্বলতায় ভরে উঠত | অবশ্য, ওকে বলার মত তেমন কথা আমি সচরাচর খুঁজে পেতাম না | আমার মনে হত আমাদের দুজনের কৌতূহল আর আগ্রহের বিষয়ের মধ্যে দুই মেরুর ব্যবধান |

আমাদের এই ব্যবধানের একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বাইরের আকর্ষণ | ও ভালবাসত পায়ে পায়ে দূরে বেড়াতে যেতে | প্রায় দিনই, সূর্যাস্তের আগে, যখনও বাইরে গরমকালের আলো খুব উজ্জ্বল, ও শাড়ি পরে এসে আমায় জিজ্ঞাসা করত আমরা হাঁটতে যেতে পারি কি না | তখন আমি আমার সাইকেল নিয়ে বেরতাম | আমি ধীরে ধীরে সাইকেল চালাতাম, আর ও হাঁটত, কয়েক পা পিছনে পড়ে | ও নিজের মনে ডুবে থাকত, কথা হত খুব কম | কখনো আমি থেমে পিছনে ফিরে তাকালে ও আমায় দেখে একটু হাসত, ওর সমতল দাঁতের সারি দেখিয়ে | একই সাথে, মাথা ঝাঁকিয়ে ও আমায় অনুনয় করত না থামতে |

কোনও কোনও দিন খুব দূরে চলে গেলে, ফেরার পথে আমি জোর করতাম ওকে সাইকেলে নিয়ে নেয়ার  জন্য | তখন ও উঠে আমার সামনে বসত বাঁ পাশে দু’ পা ঝুলিয়ে | আমি খুব জোরে প্যাডেল চালাতাম তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য, আর তখন কখনো ওর টানটান পায়ে আমার বাঁ হাঁটুর ঠোকা লাগত | জোরালো হাওয়া উঠলে, ওর পাট-রেশমি চুলের গুছি হাওয়ায় উড়ে, পিয়ানোয় বুলান আঙ্গুলের মত, আমার চেহারায় বিলি কেটে আমায় সম্মোহিত করত | বাড়ি পৌঁছে দেখতাম হৃদপিণ্ডটা অদ্ভুত এক স্নায়বিক দুর্বলতায় ছটফট করছে | সেই সন্ধ্যাগুলো আমি আনমনা হয়ে থাকতাম, আর খাবার টেবিলে ওর চোখ এড়িয়ে যেতাম | ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখতাম যে ওকে আমি সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছি | সাইকেলের ঘণ্টির নাগাল পেতে আমার হাত ওর কোমরের কাছ ঘেঁসে যেতে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলছে | ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে নিজেকে নিয়ে ঘৃণা হত যে একজন, যাকে আমার রুচিতে এত সাদামাটা আর আকর্ষণ হীন মনে হয়, তাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখছি |

তাও আমি ওকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে পারতাম না | যখন ওর দিদি আমাকে জড়িয়ে ধরত, ওর দৃষ্টি দেখে মনে হত যেন কোন অচিন জন ওকে অবজ্ঞা করে ওরই জিনিস ধরে আদর করার স্পর্ধা করেছে | ওর সেই দৃষ্টির স্ফুলিঙ্গ আমার সর্বাঙ্গে এক গুপ্ত উত্তেজনার অগ্নি সঞ্চার করত | সত্যি বলতে কি, ও আমায় এক হেঁয়ালির মত দখল করে রেখেছিল, যার জট আমি খুলতে চাইতাম না |

আমি কলেজে যাওয়ার পর, শ্রী জেঠুদের গরমে গ্রামে যাওয়া বন্ধ হলে, ওদের সাথে আমাদের দেখা সাক্ষাত ছিন্ন হল | আমার কলেজের শেষ বছর তার এক সুযোগ পেলাম | কোনও গণ্ডগোলে লোহার কারখানায় আমার হওয়ার ট্রেনিং হয়ে উঠল না | সে’ বছরের প্রচণ্ড গরমটা ঘন ঘন কালবৈশাখী হয়ে অনেকটা প্রশমিত হয়েছিল | বাপি বলল আমি গিয়ে দেখে আসতে পারি শ্রী জেঠু কেমন আছে, কী করছে | বাপি জানত শ্রী জেঠু আমার এক রকম প্রিয় ছিল | আসলে, আমার ভালো লাগত যে অনেক বিষয়ে যেখানে বাপি কোনও উচ্চবাচ্যও করত না, সেখানে জেঠু আলোচনা, বিতর্ক করতে পারতেন | আমার মনে আছে, একবার বাপির সাথে আমার খুব তর্ক হলে, জেঠু আমায় বলেছিলেন বদ্ধমূল ধারণা না পুষতে | পরে উনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন ওই কথার মানে কী | এও  বুঝিয়েছিলেন যে বদ্ধমূল ধারণা পোষা আর বাস্তববাদী হওয়ার মধ্যে কী তফাত | অতএব (ওনার ছয় সন্তান হওয়া সত্যেও) আমার ধারণা হয়েছিল যে উনি নিজেকে বাস্তববাদী মনে করেন | প্রকৃতপক্ষে উনি ছিলেন উগ্র নাস্তিক, এবং তখনকার বাঙালি হিন্দু সমাজে বর্তমান সব রকমের কুসংস্কার কে প্রকাশ্যে ধিক্কার করতেন |

আমি বাপির কথা শুনে এক ঝরঝরে সকালে কেঁকুঢগঢ যাত্রা করলাম | ট্রেনে ঘণ্টা চারেক লাগল | নামলাম প্রায় শূন্য এক প্ল্যাটফর্মে | স্টেশন মাস্টারের অফিসে জিজ্ঞাসা করে জানলাম শ্রী জেঠু রেলের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন | এখন উনি রেলে স্লিপার সরবরাহের ঠিকাদার হয়েছেন | রেলের কোয়ার্টার ছেড়ে উঠে গেছেন | লোকটা আমাকে বলে দিল কী করে জেঠুর বাসায় পৌঁছাতে পারব – স্টেশনের বাইরে থেকে আমায় একটা জীপ ভাড়া করতে হবে |

জীপের যাত্রা সবুজ শালের জঙ্গলের ধূলিধূসর পথে এক ঘণ্টা সময় কাটিয়ে, শেষ হল আদি কিঙ্কর গড় শহর পার করে |

শহরের শেষ অনেক দূরে ছাড়িয়ে, পুরনো দুর্গের কাছে জেঠুর বাড়ি | প্রায় মহলের সমান বাড়িটা ছিল রাজার দেওয়ানের | তার দুরবস্থায় বিক্রি করা বাড়িটা জেঠু জলের দরে পেয়েছিলেন | আগাছায় ভরা বিস্তীর্ণ জমিতে দাঁড়ানো বেশ কিছু বড় কামরার বাড়িটার দেখলাম মেরামত আর রং করানোর বেশ দরকার | তাও, প্রথম দৃষ্টিতেই শহরের ভিড় থেকে দূরে ওই বাড়িটার মায়াবী নিঃসঙ্গতা আমার নিশ্বাস কেড়ে নিলো |

জেঠু বাড়িতে ছিলেন না | জেঠিমা আমায় দেখে ভীষণ খুশি হলেন | আমি আশা করেছিলাম শুভ্রা দি’ ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরবে | ওকে দেখতে পেলাম না, আর বাড়িটা খালি খালি মনে হল | আমার ব্যাগ রেখে জেঠিমা আমায় চা এনে দিলেন | ধীরে ধীরে, আমি খেই ধরলাম গত চার বছরের | সৃজন দা’ আর সুজন দা’ চাকরি পেয়ে চলে গেছে, একজন রাউরকেলায়, আর অন্যজন কটকে | শুভ্রা দি’ কলকাতার কাছে এক স্কুলে মাস্টারি করছে, আর এক সহপাঠীকে বিয়ে করেছে | শিপ্রা কলেজে গেছে, শিগগিরই ফিরবে | যমজ ভাই বোন স্কুলে, ওরাও শিগগিরই ফিরবে |

যমজ দুজন হইচই করতে করতে ফিরে শান্ত হলে, একটু পরে শুনলাম আবছা গেট খোলার কটকট আওয়াজ | হটাত কোন অজানা কারণে এক অস্বস্তিকর উদ্বেগ যেন তার মুঠিতে আমার পেটটা মুচড়ে ধরল | বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখলাম বাগানের পথ দিয়ে শিপ্রা আসছে | ওর স্পষ্টত গরম লেগেছে, গলার ঘাম শাড়ির আঁচলে মুছছে | বাগান থেকে বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির নিচে পৌঁছে, ও আমার উপস্থিতি অনুভব করে উপরে তাকাল | সাথে সাথে সর্বাঙ্গের সব আন্দোলন মুহূর্তে থামিয়ে ও স্থাণু হয়ে গেল |

আমি একটু হাসলাম | ও শুধু বলল, “তুমি !” তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল | ঘরের দরজায় পৌঁছে, থেমে, ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে চোখের পাতা নামিয়ে ইঙ্গিত করল যে আমি ওকে অনুসরণ করতে পারি |

প্রায় বন্দিত্বে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা আমার বিশেষ মনে নেই | শিপ্রা খুব ভোরে উঠত, আর আমি যতক্ষণে উঠতাম ও কলেজে চলে গিয়ে থাকত | যদি আমি উঠে দেখতাম ও তখনও বাড়িতে আছে তাহলে বিছানায় পড়ে থাকতাম ও চলে না যাওয়া অব্দি | ও বাড়ি ফিরত দুপুর দু’টোর সময় | ততক্ষণে আমি জেঠিমার চাপে পড়ে খেয়ে নিয়েছি | আমি ওকে দেখতাম বিকেলে, যখন ও আমার চা নিয়ে আসত | আমাদের বলার কথা খুবই কম ছিল, আর একের কলেজ নিয়ে অপরের যা কৌতূহল, তারও আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে শেষ হয়ে গেল | তাও, প্রত্যেক রাত্রে আমি যখন বিছানায় যেতাম, ও এসে আমায় জিজ্ঞাসা করত কিছু লাগবে কি না | ও তখন, আমার বিছানায় বসতে বলার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত | আমি ফিরে আসার আগের রাত্রে ও এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “এবার আর আমরা হাঁটতে গেলাম না |” আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আরও শোনার জন্য | ও জিজ্ঞাসা করল,  “কাল কি আমি তোমার সাথে স্টেশনে যেতে পারি তোমায় বিদায় জানাতে ?” আমি মাথা হেলাতেই ও ঘরের বাতি নিবিয়ে চলে গেল |

পরদিন সকাল সকাল আমরা জীপ নিলাম | আমি ধরব কলকাতা মেল, যেটা আসে ঠিক নটায়, আর থামে মাত্র এক মিনিট | ট্রেন থামতেই আমি ছুটে গিয়ে কাছের কামরার দরজায় পৌঁছে, ধরে ওঠার রডটা বাঁ হাতে ধরে ঘুরে তাকালাম ওকে বিদায় জানাতে | ও ততক্ষণে পিছনে এসে আমার বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে, আমার হাতে ওর বাঁ হাতের পাতা ফেলে চেপে ধরেছে, আর ডান হাতে খামচে ধরেছে আমার পিঠের জামা | শুনতে পেলাম, ও আমায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল  “যাও ...” | ইঞ্জিনের তীব্র কর্কশ বাঁশির শব্দে ওর বাকি কথা ডুবে গেল | আমি হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠে কাছের খোলা জানালার দিকে এগলাম | কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন জোর গতি নিয়ে ওকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে |

এরপর বহু বছর আর আমার ওকে দেখা হল না আবার ; ওদের পরিবারের কী হল, তাও জানতে পারলাম না |

আমি কলেজ পাশ করে ক’বছর এদেশে কাজ করলাম, তারপর আমেরিকা গিয়ে ডক্টরেট শেষ করলাম | থেকে থেকে খুব ইচ্ছে করত বাড়ি ফিরতে, কিন্তু ভেবে পেতাম না কী প্রত্যাশায় | ছবি তোলা আর বেড়ান, আমার এই দুই অবাধ্য নেশা আমাকে গ্রাস করল | কী ভাবে জানিনা আমার বিয়ের প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল আমায়, আর হয়ত আমার বাপি-মাদেরও | ওদের বয়েস হচ্ছিল, আর আমি ছিলাম দেরিতে হওয়া সন্তান |

হৃদরোগে বাপি মারা যাওয়ার ক’দিন পরে বাড়ি ফিরলাম – চিরকালের মত, যদিও সে কথা না জেনে | আসার পরিকল্পনা আমি আগেই করেছিলাম, তাই মা আমাকে বাপির মৃত্যুর কথা জানায়নি, শুধু বাপির মরদেহ হাসপাতালের মর্চ্যুয়ারীতে রেখে দিয়েছিল, যাতে আমি এসে পৌঁছে শেষ কৃত্য সম্পন্ন করতে পারি |

দাহ কার্যের কিছু দিন পর মায়ের সাথে বসেছিলাম | যেমনটা হয় কোন প্রিয়জনের মৃত্যুর পর, মা বসে বসে হিসাব করছিল মায়ের কালের আর কে কে দিন গুনছে | শ্রী জেঠুর কথা মনে পড়ায় মাকে তাঁর কথা জিজ্ঞাসা করলাম | “ও তো গত বছর মারা গেছে, তোর বাপির মতই, স্ট্রোক হয়ে”, মা জানাল | আমি ওনার পরিবারের কথা জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এক শিপ্রা ছাড়া সব ছেলে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে | ও এখনও কেঁকুঢগঢে আছে, জেঠিমার দেখা শোনা করতে | ওদের কথা শেষ করে মা বলল, “তোর উচিত একবার গিয়ে ওদের দেখে আসা |”

ক’দিনের মধ্যে মায়ের কাছে আরও কাহিনী শুনলাম | আমি পাশ করার পর, আর আমেরিকা যাওয়ার আগে জেঠু জেঠিমার কাছে শিপ্রা ঘোষণা করে যে ও নিজের পছন্দে বিয়ে করবে ; ওনাদের ওর জন্য ছেলে খুঁজতে হবে না | শিপ্রা কলেজ শেষ করে একটা সরকারী চাকরি পেয়েছিল | সেই টাকায় ও শাড়ি, গয়না কিনতে শুরু করল – আপাতদৃষ্টিতে বিয়ের জন্য, কিন্তু তার শিগগির হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না | ওর কাকে পছন্দ তাও কাউকে জানতে দিল না | শুধু বলল ও তার জন্য অপেক্ষা করতে চায় | জেঠু খুব বিরক্ত হলেন | উনি অনেক উপযুক্ত ছেলের প্রস্তাব আনলেন, কিন্তু শিপ্রা সব নাকচ করে দিল | জেঠিমা চাইছিলেন ওর বিয়ে হলে মঞ্জুর বিয়ে হয়, তাই মঞ্জুর বিয়ে স্থগিত রইল | শেষে একদিন এই নিয়ে খুব তর্কাতর্কি হল, আর জেঠু ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন | রাগের মাথায় শিপ্রাকে বলে বসলেন, ও যতদিনই অপেক্ষা করুক না কেন, ওর মত সাদামাটা মেয়ের প্রতি কোনও ছেলে আকর্ষিত হবে না | শিপ্রা কেঁদে ভেঙ্গে পড়ল, নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল | পরদিন সকালে দেখা গেল ও বাড়িতে নেই | ওর সমস্ত গয়না আর ভালো সিল্কের শাড়ি রেখে গেছে, একটা চিরকুটে লিখে, যে ও সব মঞ্জুকে দিয়ে যাচ্ছে | জেঠু ওর অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলেন যে শিপ্রা সম্বলপুরে বদলী নিয়ে চলে গেছে | তার পরিকল্পনা ও নিশ্চয় আগেই করেছিল | জেঠু যখন মঞ্জুর বিয়ে স্থির করলেন, জেঠিমা অনেক মিনতি করে শিপ্রাকে লিখলেন বিয়েতে আসতে | ও এলো বিয়ের দিন, আর পরদিন ফিরে গেল | এর পর জেঠু মারা গেলে শিপ্রা আবার কেঁকুঢগঢে বদলী নিয়ে ফেরত এলো, জেঠিমার দেখা শোনা করার জন্য |

মা আমায় এই সব কথা শুনিয়ে বলল, “তোর একবার গিয়ে ওদের দেখে আসা উচিত |” আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি যাবে আমার সাথে ?”  মা মাথা নেড়ে বলল, “আমি না ... তোর যাওয়া উচিত, দেখে আসতে |”

কয়েক সপ্তাহ আমি খুব ব্যস্ত থাকলাম | আপাতত আমার আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে একবছরের অধ্যয়নের ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলাম | খুঁজে এক বেসরকারি কলেজে শিক্ষকের চাকরি জোগাড় করলাম, সাথে অতিরিক্ত দায়িত্ব, ছাত্র সম্বন্ধিত ব্যাপারে দেখা শোনা করার জন্য ডেপুটি ডীন হিসাবে | আমি যোগ দেয়ার জন্য এক মাস সময় চেয়ে নিলাম |

মায়ের দেখাশোনা করার জন্য একজন নার্সের ব্যবস্থা করে, মাকে বললাম এবার আমি যাব জেঠিমা আর শিপ্রাকে দেখতে | মা তো ভারী খুশি, জেঠিমাকে চিঠি লিখে আমার হাতে দিল | আর আমায় বলল শিপ্রার জন্য একটা শাড়ি কিনে সেটা ওকে পরিয়ে তার একটা ছবি তুলে আনতে | আমার মনে হল না শিপ্রার কাছে অত দাবি করা যাবে | তাও আমি আমার ক্যামেরাটা নিয়ে নিলাম ; পরে, আরও কিছু চিন্তা করে, তার সমস্ত সরঞ্জাম | ভেবে দেখলাম, অনেক দিন আমি কোনও ছবি তুলি নি |

ট্রেন থেকে নামলাম, প্রায় সেই শেষবারের মতই সময়ে | মনে করার চেষ্টা করলাম সে’ বারের সব কথা | কিন্তু আমার এই ভাবুক খেয়াল স্মৃতির নিঃস্ব দেয়ালে মিথ্যে মাথা ঠুকল | যে টুকু কেবল স্পষ্ট মনে পড়ল তা হল আমার ফেরার দিনে কথা, যেন সেটা সেই সেদিনের ঘটনা |

জীপের ড্রাইভার ঠিকানাটা চট করে চিনে, খুব পরিচিতের মত বলতে শুরু করল ওই বাড়ির ম্যাডামকে ও প্রায়ই স্টেশনে নিয়ে আসে, আর ফিরিয়ে নিয়ে যায় | বুঝলাম না কার কথা ও বলছে, জেঠিমা না শিপ্রা | দুটোরই সম্ভাবনা কম মনে হওয়ায় ওকে বললাম খুলে বলতে | ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে শুধু বলল, “আরে,ম্যাডাম আসেন শুধু কলকাতা মেল দেখতে, আর তারপর ফিরে যান |” হতভম্ব হয়ে আমি আর ওকে ঘাঁটালাম না |

পৌঁছে দেখলাম কখনো, সম্ভবত শেষ বিয়ের (মঞ্জু’র) সময়, রং করা সত্যেও, বাড়িটা নিষ্প্রভ আর জনমানবশূন্য মনে হচ্ছে | বাগানটা আগাছা, ঝোপঝাড়, আর নানান বুনো গাছ গজিয়ে আরও বন্য হয়েছে | কাঠের গেটটা ভেঙ্গে অর্ধনমিত হয়ে একপাশে নেতিয়ে পড়ে আছে | আমি যেই সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠলাম, একটা জানালার পিছন থেকে কারো মুখ সরে গেল | আমি কড়া নাড়ার আগেই শিপ্রা দরজা খুলল | ও কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল | আমি ওর মুখের দিকে চাইলাম, ওর গলার দিকে | আমার তৃষিত চোখ অস্থির হয়ে ওর সমস্ত শরীর খুঁটিয়ে দেখল | দেখলাম আমার মনে ধরে রাখা ওর সেই  অটুট স্বাস্থ্য আর নমনীয়তা নিয়ে ওকে যেন আরও সাদামাটা দেখাচ্ছে | ওর কণ্ঠমণির নিচে সেই তিনখানা খাঁজ এখনও আছে, এই মুহূর্তে তাদের চারিদিকে কিছু স্বেদের শিশিরবিন্দু, সম্ভবত রান্নাঘরের গরমে কাজ করে |

চোখ ফেরাতে অপারগ হয়ে, নিজের উপর জোর খাটিয়ে বললাম, “আমি ! প্রিয়ব্রত ?|” ও কোন কথা না বলে এক পাশে সরে আমায় ঢুকতে দিয়ে জেঠিমা কে ডাক দিল, “মা ! এসো, দেখো কে এসেছে |”

জেঠিমা এলেন, পা টেনে টেনে, হলঘর পার হয়ে | কত বয়স্কা আর হারিয়ে যাওয়া চেহারা হয়েছে ওনার | কাছে এসে উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, যতক্ষণ না শিপ্রা পর্দা সরিয়ে আলো আসতে দিল | তখন উনি আমায় জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ আঁকড়ে ধরে থাকলেন | শেষে শিপ্রা ওনাকে ছাড়িয়ে শোয়ার ঘরে নিয়ে গেল | ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করল, “গত বারের ঘরটাই ?” আমি ব্যাগ তুলে বললাম, “একটা হলেই হল, আমি আগে স্নান করতে চাই |”

আমি জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে নেয়ার পর প্রায় দুপুর দু’টোর সময় শিপ্রা এসে বলল খেতে দিয়েছে | আমার খাটে পড়ে থাকা ক্যামেরাটা দেখল | খেতে খেতে খুব কম কথা বললেও, আমি যখন খাওয়া শেষ করে জেঠিমার খাওয়া শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি, জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি ছবি তোলার প্ল্যান করেছ ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, ... আসলে, মা তোমার জন্য একটা শাড়ি পাঠিয়েছে | মা চায় তোমার একটা ছবি, ওই শাড়ি পরে |” ও চট করে থালায় চোখ নামিয়ে নিলো, আর আমার মনে হল ওই এক ঝলক লজ্জার সাথে যেন একটু  বিব্রত ভাব জড়িয়ে ছিল |

সেদিন আমি সারাদিন নিজের ঘরে থাকলাম | দ্বিতীয় দিন, রবিবার, দেখতে গেলাম গড়, যার উঁচানো মাথা আমার জানালা থেকে সবুজ গাছের সমুদ্রের উপর দিয়ে দেখা যায় | আমি শিপ্রাকে জিজ্ঞাসা করলাম ও সাইকেল চালাতে পারে কিনা | ও বলল, শীতকালে কখন-সখন ও সালোয়ার কামিজ পরে জেঠুর সাইকেলটা চালিয়ে অফিস যায় | কিন্তু আফসোস, বাড়িতে ওই একটাই সাইকেল | আমি সাইকেলটা নিয়ে নিলাম | রাস্তায় বেরিয়ে শিপ্রা বলল ও হাঁটবে | তখন সেই ওর শেষবার জামশেদপুরে বেড়ানোর মত – আমি সাইকেলে এগলাম, কখনো চালিয়ে, কখনো থেমে,  আর, ও এলো পিছনে হেঁটে, আমার সাথে সাথে থাকার চেষ্টা করতে করতে | গড়ে পৌঁছে আমি অনেক ছবি তুললাম, কিন্তু শিপ্রা সব ছবির চৌহদ্দির বাইরে থাকল | যখন ফিরছি, সূর্য অস্ত যায় যায় | আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম সাইকেলে বসবে কি | ও মাথা নেড়ে সূর্যের দিকে আঙ্গুল দেখাল | আমি ভুরু কোঁচকালে, ও কৌতুকে হেসে বলল, “ওই দেখো ! এখনও সূর্য অস্ত যায়নি |”

দিনগুলো কাটল প্রতিদিন অন্য দিনের মত | শিপ্রা উঠে জলখাবার আর দুপুরের খাবার করে ন’টা নাগাদ বেরিয়ে যায় | আমি প্রস্তাব দিই কিছু সাহায্য করার, কিন্তু ও রাজি হয় না | ও অফিস থেকে ফেরে ছ’টার একটু পরে | ওর অফিস স্টেশনের পথে, মাঝামাঝি | কোন কোন সন্ধ্যায় আমরা হাঁটতে বেরই | ও আমার আমেরিকায় থাকা নিয়ে তুচ্ছ সব প্রশ্ন করে | ও কখনও জানতে চায় না, আমি কেন বিয়ে করিনি, যেন সে প্রশ্ন ওর মনেই জাগে না |

একদিন সকাল থেকে খুব ভ্যাপসা গরম ধরল | শিপ্রা যখন অফিস থেকে ফিরল, সমস্ত আকাশ জুড়ে ভয়ঙ্কর কালো মেঘের ছাউনি, গরম হাওয়ায় বিদ্যুতের গন্ধ, আর বৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী | মনে হল বেরোনো অসম্ভব | আমার বারান্দায় বসে চা খেলাম | আমার ইচ্ছা করছিল ছাদ থেকে দৃশ্যটা দেখি ; মেঘ আর বিদ্যুতের প্রেক্ষাপটে গড়ের ছবি তুলি | আমি শিপ্রাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “একটু কি ছাদে যাওয়া যাবে ?” যেন বিষ কামড় খেয়েছে, সেই রকম আহত দৃষ্টিতে ও আমার দিকে তাকাল | দেখলাম ওর মুখ, বিদ্যুতে মোচড়ানো আকাশের মত, যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠেছে | আমি কি কিছু ভুল বলে ফেলেছি জিজ্ঞাসা করার আগেই ও ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে নড়বড়ে পায়ে অন্ধকার হলের মধ্যে ঢুকে মিলিয়ে গেল | আমি নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম, যতক্ষণ না তুমুল ধারায় বৃষ্টি নামল, আর তারপর আমি আমার ঘরে ফিরে গেলাম |

সেই রাত্রে আমি যথারীতি মাকে ফোন করলাম | মাকে ঘটনাটা বলতেই, মা বলল, “ওহো ! তোকে আমার বলা উচিত ছিল | জানি না কী ভাবে ভুলে গেছিলাম ... মঞ্জুর বিয়ের সন্ধ্যায় শ্রীধর দা’ শিপ্রা কে বলেছিল ছাতে চলে যেতে, আর যতক্ষণ না অতিথিরা বিদায় নেয়, নিচে না নামতে  ...” | অবাক হয়ে, আমি মায়ের কথা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন ?”  মা বলল, “শ্রীধর দা’র মনে হয়েছিল আইবুড়ো মেয়ে অলক্ষুণে ; ওর উপস্থিতি দুর্ভাগ্য আনতে পারে, অতিথিরা অসন্তুষ্ট হতে পারে, অনুষ্ঠানে কোন বিঘ্নও ঘটতে পারে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “শিপ্রা কি সত্যি রাত্রে ছাতে থেকে গিয়েছিল ?” মা বলল, “হ্যাঁ, সারা রাত্রি ছাতে ছিল | পরদিনই ও বাড়ি থেকে চলে যায়, এই প্রতিজ্ঞা করে যে ওই বাড়িতে ও আর কোনও দিন পা ফেলবে না |” বোকা বোকা শোনালেও, প্রশ্ন করলাম, “তুমি কি জানো, মা, সেই রাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল কিনা ?” মা বলল, “হয়ে থাকতেই পারে, সময়টা তো বর্ষাকাল ছিল |” আমি ক্ষীণ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম, “এ তো আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না | জেঠু এত বাস্তববাদী ছিলেন ... উনি ... উনি তো কোনও রকমের কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না |” মা শুধু পুনরাবৃত্তি করল, “না, না | তোকে আমার সব কথা বলা উচিত ছিল | কী জানি কি করে ভুলে গেছিলাম |”

পরদিন শনিবার | আসার পর সাতদিন কেটে গেছে, আমি ফিরে যেতে উৎসুক হয়েছি | ঘুম ভাঙল দেরিতে | উঠেই মনে হল সারা বাড়িটা শিপ্রার অস্তিত্বে ভরে আছে | কী অদ্ভুত অনুভূতি | শুনতে পেলাম, বাথরুমে জল পড়ার শব্দ ; কেউ রান্নাঘরের বেসিনে বাসন নামাল ; এফএম রেডিওয় গান বাজছে ; আর চাপা গলায় কথার আদান প্রদান, দুজনের মাঝে – শিপ্রা আর সকালে আসা কাজের মেয়েমানুষটা |

একটু পরেই চা নিয়ে ঢুকে শিপ্রা জিজ্ঞাসা করল, “তুমি আমার সাথে স্টেশনে যাবে ?” জীপের ড্রাইভারটার কথা মনে পড়ল | আমি মাথা নাড়লাম | আর ভাবলাম, ‘আজ তাহলে ওর স্টেশনে যাওয়ার দিন !’

আমরা যখন স্টেশনে পৌঁছলাম , কলকাতা মেল চলে গেছে, তার প্ল্যাটফর্ম জনশূন্য | আমার ইচ্ছা করলো জানতে ও কেন স্টেশনে এসেছে | কিন্তু গত রাত্রের কথা ভেবে আমি নিজেকে নিরস্ত করলাম | আমি ছবি তুলতে নিজেকে ব্যস্ত করলাম | ও উপর নিচ পায়চারী করতে করতে বারবার ঘড়ি দেখল, যেন সেটা ভুল সময় দিচ্ছে |

আমরা ওভারব্রিজ দিয়ে উঠে উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে গেলাম, যেখানে একটা ফাঁকা ট্রেন দাঁড়িয়েছিল | তার ধড়টা ক্রমশ সরু হতে হতে দূরে এক বিন্দুতে মিলিয়ে গেছে, যেখানে গরম হাওয়ার হলকায় অনেকগুলো রেল লাইন ঝিলমিল করছে | আমি ট্রেনটার এক প্রান্তে গিয়ে আমার ক্যামেরাটা তার তেপায়ায় বসালাম পুরো ট্রেনটার ছবি তুলতে | আমি ক্যামেরাটা ফোকাস করছি, শিপ্রা এগিয়ে এসে বলল,  “তুমি কি আমাদের দুজনের একসাথে ছবি নিতে পারবে ?” আমি তাকালাম ওর দিকে | ও বলল, “যেন ... যেন তুমি চলে যাচ্ছ, আর আমি তোমায় বিদায় জানাচ্ছি |” দেখলাম ওর মুখ শান্ত, দৃষ্টি অপলক | আমার গত বারের কথা মনে পড়ল | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “সেই ... যেমন গত বার আমি যখন ফিরে গেলাম ?” ও মাথা নেড়ে কাছের একটা কামরার খোলা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল | আমি ওর কাছে গিয়ে ক্যামেরার দিকে মুখ করে, আমার বাঁ হাত রাখলাম দরজার ধারের রডটার উপর | ওকে বললাম আমার পিছনে এসে বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে ওর বাঁ হাতের তালু আমার রডে রাখা হাতের উপর রাখতে | তারপর, “এই ভাবে থেকো”, বলে আমি ক্যামেরার কাছে ফিরে গেলাম | ক্যামেরা ওর উপর ফোকাস করে একটা ছবি তুললাম | ক্যামেরাটা ওর কাছে নিয়ে গিয়ে ডিসপ্লে তে ছবিটা ওকে দেখালাম |

ততক্ষণে কিছু ভবঘুরে বাচ্চা এসে একটু দূরে দাঁড়িয়েছে | গোগ্রাসী কৌতূহল নিয়ে ওরা মাঝবয়েসী আমাদের দুজনকে দেখতে লাগলো – একজন ভিনদেশী খাকি শর্টস, ধুসর টি-শার্ট আর মুখ পিছনে ঘোরানো বেসবল-ক্যাপ পরে, আর অন্যজন গতানুগতিক সুতির ডুরে শাড়ি পরে | প্রায় ব্যতিক্রম হীন অসীম নিস্তব্ধতার মধ্যে শুনলাম ধীরে ধীরে ক্লিক্-টিক্-ক্লিক্ শব্দ করতে করতে একটা দূরের শান্টিং ইঞ্জিন এগিয়ে আসছে, থেকে থেকে টুট্ টুট্ করে তার হর্ন বাজিয়ে |

আমি ক্যামেরাটা তেপায়ার উপর রেখে, তার ভিউ-ফাইন্ডার এ শিপ্রাকে এক ঝলক দেখে নিলাম | টাইমার এ ছবি তোলার জন্য কুড়ি সেকেন্ড সময় দিয়ে ওর কাছে ছুটে এলাম | তারপর ভঙ্গী করে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম দুজনে |

ক্যামেরার ছবি তোলার আওয়াজ শুনেছি মনে হওয়ার পর, আমি সহজ হয়ে, ধীরে ধীরে দরজার রড থেকে আমার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম | শিপ্রার হাতের তালু তখনও মুঠো করে আমার হাত ধরে | আমি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে  বললাম, “হয়ে গেছে |”

ঘুরে দেখলাম ও হাতের আলতো মুঠোয় দরজার রড ধরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে | কোনও চিন্তা না করে প্রশ্ন করলাম, “তোমার কি মনে আছে, গত বার আমায় বিদায় জানাতে এসে তুমি কিছু বলেছিলে ?”

আমি ভাবি নি ও উত্তর দেবে | কিন্তু, “হ্যাঁ ... আমার মনে আছে” ও বলল, সম্মোহিতের মত ; বিভ্রান্ত চোখ মেলে তাকাল মুহূর্তের জন্য ; তারপর ওর চোখের পলক নামিয়ে নিতে নিতে ব্যথায় ভেঙে যাওয়া স্বরে বলল “আমি বলেছিলাম – যাও ! ... শুধু আমায় বলে যাও আমি ...”

ওর কথা ছাপিয়ে শুনলাম সেই শান্টিং ইঞ্জিনটা ট্রেনটার দূরের প্রান্তে জোড়া লাগার জন্য ধাক্কা দিল | এক অদ্ভুত জর্জর যান্ত্রিক শিহরণ কামরা থেকে কামরায় সঞ্চারিত হয়ে ক্রমশ কাছে এগিয়ে এলো, আর আমাদের কামরাটায় পৌঁছে তার শরীরটা ঝাঁকিয়ে দিল | কামরার দরজার রডটা শিপ্রার আলতো মুঠির ভিতর থরথর করে কেঁপে উঠে ওর মুঠি ছাড়িয়ে, ভেঙ্গে দিল এক ক্ষণিকের অভিসার ||



(ইংরেজি অনুবাদ : An Ephemeral Tryst )


--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

ইন্দ্রনীর / ০১ জুন ২০১৪

কোন মন্তব্য নেই: