রবিবার, ১৫ জুন, ২০১৪

দার্জিলিং স্টোন

বেণু বলেছিল, “ব্যাপারটা সে’রকম ?”

বেণুর এই “ব্যাপারটা সে’রকম ?” ব্যাপারটা আসলে একটু অন্য রকম | বেণু আর আমি একসাথে, মানে একে অপরকে, বিয়ে করে থাকলেও, আমরা একসাথে বড় হইনি | শুরুতে ঠোকাঠুকি লাগত | ক্রমে, সময়ের স্রোতে একসাথে গড়িয়ে গড়িয়ে, দুজনেই কিছুটা গোল নুড়ি পাথর হয়ে গেছি ; এখন আর ঠোকাঠুকি হলে কষ্ট হয় না | কিন্তু, ভিতরে ভিতরে আমরা আলাদা পাথর রয়েই গিয়েছি | যখন আমার কোনও ব্যাপার বেণুর গ্রাহ্য হয় না, ও বলে, “ব্যাপারটা সে’রকম ?” এটা কিন্তু কোনও প্রশ্ন নয়, এটা একটা আপোষে পৌঁছানোর ইঙ্গিত, যার অর্থ এই যে, ‘আমি তোমার সাথে একমত নই, কিন্তু বলছ যখন, তখন ...’

এখন শুরু করি শুরু থেকে |

সকালে পেট পুরে হোটেলের প্রাতরাশ গিলে ঠিক হল, ময়দানে যাই | হাঁটতে চাইলে
হাঁটো, বসতে চাইলে বসো | শীতের সকালে এমন রোদের ছড়াছড়ি, সবুজের ভিতরে ভিতরে | যেখানে রোদ পড়ছে, গাছের মাথা, ঘাসের ডগা, উজ্জ্বল সবুজ | আবার গাড় সবুজ, গাছের তলার পাতায় আর ছায়ার ঘাসে ঘাসে |

তাই আমরা বসছিলাম, আবার উঠছিলাম, আর হাঁটছিলাম | উদ্দেশ্য বিহীন | সাথে কন্যা বুবাই | তার বিশেষ হাঁইচাঁই নেই, স্কুলের ছুটি, কাজেই মাথারও ছুটি | ও দিব্যি সাথে সাথে থেকেও, আমাদের দুজনের কথাবার্তা এড়িয়ে এড়িয়ে, সাথে না থাকার চেষ্টাই করছিল | হটাত ও মায়ের গলার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “মাম্মা, তোমার হার ! হোটেলে রেখে এসেছ কি ?” বেণু থমকে গলায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আমায় বলল, “সে কী ? আমি তো
হারটা পরেই বেরিয়েছিলাম !”

আমারও মনে পড়ল জলখাবার খাওয়ার সময় ওয়েটারগুলো বেণুর গলার দিকে তাকাচ্ছিল, আর বেণু অপ্রতিভ হয়ে হারের লকেটটা আঙ্গুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল |

হারটা চোখে পড়ার মত | পেটানো গানমেটালের চাদরে অজস্র শঙ্খের আকারে দার্জিলিং স্টোন বসান একটা লকেট, যার আকারটা খানিকটা পুরানো হাতপাখার মত | তার দু’কানের ফুটো দিয়ে একটা সোনার চেন পরানো, পিছনে হুক দেয়া | আমার কাছে দার্জিলিং স্টোনের গল্প শুনে শুনে বেণু বায়না ধরেছিল যে ওকে তার একটা হার বানিয়ে দিতে হবে | সেটা হয়ে ওঠেনি | সেবার দিল্লিতে কনট প্লেসে এক ফুটপাথের ফেরিওয়ালার কাছে এই লকেটটা দেখে ওর খুব পছন্দ হয়েছিল | অথচ, আমার ভারী অপছন্দ – কেন না গানমেটালের পাঁশুটে রংটা পাথরগুলোর জেল্লা মাটি করছিল | আমি বেণুর হাত ধরে টানতেই বুবাই বলল, “বাপি ! উঁহুঁ ... পালাবার চেষ্টা কোরো না |” তারপর বেণুকে বলল, “মাম্মা এটা নিয়ে নাও, তোমার দার্জিলিং স্টোনের শখ পূর্ণ হবে |” আমি বললাম, “তাই বলে এতগুলো ছোট ছোট পাথর, কখন কোনটা খসে যাবে |” বুবাই আবার মাকে ঠেলা দিল, “নিয়ে নাও | বাকি ব্যবস্থা আমি করে দেব |” বুবাই আর কি করল, আমাকে দিয়ে ল্যাকার কিনিয়ে, তুলি দিয়ে বেশ কদিন লকেটটার সারা মুখে মাখাল আর শুকালো, মাখাল আর শুকালো | তারপর একদিন আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বাপি এবার বল, কেমন লাগছে ? বেশ জেল্লা দিয়েছে না ? আর, দেখ এখন পাথরগুলোর আর খসে যাওয়ার চান্স নেই |” আমি বললাম, “ভাল হয়েছে | এর পর ?” বুবাই বলল, “এবার তুমি মাম্মাকে একটা সোনার চেন গড়িয়ে দাও, যাতে লকেটটা মাম্মা পরতে পারে |” তাও হল |

কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল | কেনার সময় দেখা হয়নি যে লকেটটা বেশ ভারী ; আর, পরে ওই ল্যাকারের প্রলেপে তার ওজন আরও কত বাড়ল | ফল হল এই যে, বেণু ওটা পরে ঠিকই ; কিন্তু যেই ওর মনে হয় যাদের যা দেখার দেখে নিয়েছে, যা প্রশ্ন করার (‘বা বেশ তো ! এটা কোথায় কিনেছ ?’) করে নিয়েছে, আমায় একপাশে ডেকে বলে, “এবার আমার হারটা খুলে দাও |“ আমি হারটা খুলে দিলে ও ওটা হাতব্যাগে রেখে নেয় | লক্ষণীয় যে, বেণু কখনও বুবাইকে বলে না হারটা খুলে দিতে | কেন জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, “আমার যা ভালো লাগে তাতে তোমার কী !”

আজও তাই হয়েছে ভেবেও, আমি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কোথায় হারটা খুলেছি | বুবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায় হারটা খুলেছি মনে করতে পারিস |” বুবাই কল্পিত কোনও ডাঁসা পেয়ারায় কামড় দেয়ার অন্যমনস্কতায় বলল, “আমি কী করে বলব ? তোমরা কী করছ না করছ আমি কি তা দেখছিলাম ?”
আমি – “তাহলে তুই কী দেখছিলি ?”
বুবাই – “বা রে ! এত সুন্দর ময়দান | কত গাছপালা, কুকুর, গরু, ভেড়া, ফুচকাওয়ালা, বেলুনওয়ালা, হরি-মটর, ঝালমুড়ি | লোকে যাচ্ছে, আসছে ...”
বেণু – “আহ ! তোমাদের এই কথার পিঠে কথায় ... প্লিজ, তাড়াতাড়ি করে খোঁজো | ওটা কোথায় পড়ে গেছে দ্যাখো |”
বুবাই – “আমি বড় জোর বলে দিতে পারি কোন পথে আমরা এসেছি, কোথায় কোথায় বসেছি | বাকি তোমরা বুঝবে |”
আমি – “তাই বলে দে ... কত তো ভারী দামের লকেট, এখন পুরো সকালটাই মাটি করবে |”

বুবাই আমাদের গাইড করে নিয়ে চলল | প্রথমে অনেকটা হেঁটে এসে একটা রাস্তা পার হতে হল | আমি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে বুবাই বলল, “মনে আছে এখানে আমাদের আগে আগে একটা কুকুর পার হচ্ছিল ? গাড়ির খুব ভিড় আছে দেখে থমকে পাশের ওই গাছটার গায়ে গিয়ে ...”
বেণু বলল, “থাক, থাক !”
আমি আড় চোখে গাছটার নিচে গুঁড়িতে তাকালাম | কোনও আর্দ্রতা দেখতে না পেলেও, রাস্তাটা পার হওয়ার সময় মনে হল জায়গাটা বুবাই ঠিকই বলেছে | ওখানে নিরবচ্ছিন্ন ডিভাইডারটা কাটা ; সজ্জন লোকে কেটেছে, সহজে রাস্তা পার হওয়ার জন্য | রাস্তা পার হয়ে বুবাই রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে ডান হাতটা পিছনে দিকে একটু ঘুরিয়ে বলল, “বাপি, আমরা ওদিক থেকে এসে রাস্তাটা পার হয়েছিলাম |” ওদিকে - অর্থাৎ ‘স্লাইট টু দ্য লেফট’, যেমন গুগল ম্যাপস এ বলে - একটু এগিয়ে কতকগুলো গাছের জটলা দেখিয়ে বুবাই বলল, “এখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম, আমি বাদাম কিনতে চাইলাম, মাম্মা বলল, ‘এই তো লেস চিপস খেলি’ |” ঠিক কথা, একটু একটু মনে পড়ল | তার আগে আমরা আর একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলা দেখেছিলাম | কিন্তু এখন তারা নেট গুটিয়ে সরে গেছে, কোথায় খেলছিল বুঝবার উপায় নেই | তবু বুবাই টেনে নিয়ে গিয়ে দেখালো শুকনো ঘাসে একটা পিচ কাটা | আন্দাজে, যেখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে গিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে কিছু পাওয়া গেল না | আবার হাঁটা দিলাম | প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেছে খোঁজা শুরুর করার পর থেকে, আর আমি সন্দেহ করতে শুরুর করেছি হারটা এতক্ষণ পড়ে থাকবে কি না | আমি, ‘কটা বাজে রে, বাবা ?’, ভাবা মাত্র বেণু ঘড়ি দেখে বলল, “দেখ, প্রায় সোয়া এগারোটা হতে চলল |” তখনি বুবাই বলল, “বাপি, মনে পড়েছে | আমি যেখানে লেস চিপসটা খাওয়া শেষ করেছিলাম ওখানে চলো |” আমি বললাম, “চলো কী, তুই তো পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিস | আমার কাছে তো চারিদিক সেই একই ময়দান মনে হচ্ছে |”  “ঠিক আছে, এসো তো”, বলে বুবাই এগোল |

আরও কয়েকটা জায়গায় ঘুরঘুর করে আমরা সেই জায়গায় পৌঁছলাম | একটা বড় তেঁতুল জাতীয় গাছ | তার থেকে একটু দূরে একটা জল ছিটানো ছোট্ট সবুজ ঘাসের লন | সেই জল ছিটানোর ফোয়ারায় হাওয়া আরও ঠাণ্ডা হয়ে গাছের তলায় বয়ে আসছে | বুবাই ওখানে এসে বসে পড়ে ওর বিশেষ যত্নে, ধারটা একটুও না ছিঁড়ে, চিপসের প্যাকেটটা খুলেছিল | পরে ও যখন বলেছিল, “বাপি, মাম্মা, তোমরা খাবে তো খাও, আমার হয়ে গেছে”, আমি আর বেণু বসে পড়ে বাকি চিপস শেষ করতে যোগ দিয়েছিলাম | একটা পড়ে থাকা চিপসের খালি প্যাকেট দেখিয়ে বেণু বলল, “ওই তো, মনে হচ্ছে ওটা সেই প্যাকেটটা | এখানেই তো বসে পড়ে তোমাকে বলেছিলাম হারটা খুলে দিতে |”

তিনজন মাথা ঝুঁকিয়ে গাছতলার সমস্তটাই খুঁজলাম | কিছুই নেই | গাছটার তলায় ঘাস নেই বললেই হয় | লোকজনের ফেলা কাগজের টুকরো, বাদামের ঠোঙ্গা, শালপাতা, যা ময়দানের সর্বত্র বিরাজ করছে বা উড়ে বেড়াচ্ছে, সেসব কিছুই নেই, এক ওই একটা চিপসের খালি প্যাকেট ছাড়া | বুবাই একবার ওটার কাছে গিয়ে ঝুঁকে কিছু দেখল, তারপরে ফিরে এসে বলল, “বাপি, ওটা আমার প্যাকেটটাই |”
আমি – “কি করে বুঝলি ?”
বুবাই – “দেখেই চিনেছি, আমি যেভাবে প্যাকেট খুলি, ধারটা না ছিঁড়ে ...”

একটু পরে বুবাই বলল, “আচ্ছা বাপি, শুধু ওই প্যাকেটটা কি করে রয়ে গেছে, হওয়ায় উড়ে যায়নি কেন ?”
সত্যিই তো | হাওয়াটা প্যাকেটটাকে নড়াচ্ছে, কিন্তু সরাতে পারছে না | আমি এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটার কাছে মুখ নামিয়ে দেখলাম | একটু ফোলা | খোলা মুখে হাওয়া ঢুকে ওটাকে ফোলাচ্ছে, কিন্তু যেন কোনও ভারের চাপে প্যাকেটটা মাটি আঁকড়ে রয়েছে | একটু অস্বস্তি নিয়ে (‘কে জানে, কার না কার খাওয়া এঁটো প্যাকেট’) ওটার মুখটা এক আঙ্গুলে খুলে ভিতরে উঁকি দিলাম | কিছু দেখতে পেয়ে একটু প্যাকেটটা তুলে কাত করলাম | চেন সমেত লকেটটা পিছলে বেরিয়ে মাটিতে পড়ল | বেণু অধীর আগ্রহে বলল, “পেয়েছ ?” বুবাই বলল, “বাপি দেখলে, আমি ঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছিলাম ?” লকেটটা তুলতে তুলতে আমি বললাম, “কিন্তু এটা প্যাকেটের মধ্যে এলো কী করে ?”

যে ভাবে সুদক্ষ গোয়েন্দা কোনও সন্দেহজনক প্রমাণ সংগ্রহ করে, সেই ভাবে বেণু লকেটটা সযত্নে একটা টিস্যু পেপারে মুছে হাতব্যাগে চালান করল | তারপর টিস্যু পেপারটা প্যাকেটটার মধ্যে ঢুকিয়ে সেটা মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, “শুধু কাগজটা মাটিতে ফেললে বিচ্ছিরি দেখাত |"

আমি হাত তুলে জামার হাতা সরিয়ে মণিবন্ধে তাকালাম, সময় দেখতে | হাতে ঘড়ি নেই ! ‘হাতের ঘড়ি কই ?’

“এ কী ? কেউ আমার হাতঘড়িটা দেখেছ ?” আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম | বুবাই শান্ত গলায় বলল, “বাপি, তুমি তখন মাম্মার হারটা খোলার সময়, তোমার ঘড়িতে
মাম্মার চুল ওতে আটকাচ্ছিল বলে, ঘড়িটা খুলেছিলে | মনে নেই ? তোমার প্যান্টের পকেটগুলো চেক করো |”

‘তাই তো’, আমার মনে পড়ল | ‘তাহলে কি ওটা পকেটে রেখে আর বের করিনি ? কিন্তু, তার পরেও তো সময় দেখেছি মনে হচ্ছে |’ ট্রাউজারের পকেট দুটো ঘাঁটলাম ভালো করে, বেশ ক’বার | তারপর পকেট থেকে টাকার ব্যাগ, রুমাল, চিরুনি, হোটেলের চাবি সব বের করে পকেটের কাপড়গুলো উল্টিয়ে বার করলাম | না, ঘড়িটা পকেটে নেই | ততক্ষণে বেণুও নিজের হাতব্যাগ খুঁজছে | মাথা নেড়ে বলল, “আশ্চর্য ! আমার কাছেও তো ঘড়িটা তুমি রাখনি | তাহলে ওটা গেল কোথায় ?”

আবার সবাই মিলে আবার গাছতলায় ঘুরে ঘুরে খুঁজতে লাগলাম, যদি ওটাও পাওয়া যায় |

ইতিমধ্যে এক সৌম্য বয়স্ক ভদ্রলোক এসে আমাদের এই গোরুখোঁজা ব্যাপারটা দেখতে লেগেছেন | তার হাতে দড়িতে বাঁধা একটা কুকুর | সে নিঃশব্দে উসখুস করছে আমাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য | একটু পরে উনি বললেন, “বেঙ্গলী ?” আমি মুখ তুলে তাকিয়ে বললাম, “হ্যাঁ |”
উনি – “কী খুঁজছেন ? কিছু হারিয়েছে কি ?”
আমি – “হ্যাঁ | একটা ঘড়ি |”
উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, “দামী, না সেন্টিমেন্টাল ?”
বেণু – “বিয়েতে বাবা ওকে দিয়েছিলেন ...”
বুবাই – “রোলেক্স, পার্পেচ্যুয়াল |”
উনি – “কী করে হারাল ?”
আমি – “মনে করতে পারছি না | একটু আগে এখানে বসে গল্প করতে করতে ওটা হাত থেকে খুলেছিলাম | তারপর ...”
উনি – “ও | কতক্ষণ আগে ?”
আমি – “কত ? ঘণ্টা খানেক হবে, কি সোয়া এক ঘণ্টা |”
উনি – “এত আগে ? তাহলে কি আর এতক্ষণ ওটা কারো চোখে না পড়ে থাকে ? তাও দেখুন ভাল করে ...”
আমি – “সেই ... আর একটু দেখি, তারপর ...”
উনি – “তারপর, না পেলে অবশ্য থানায় একটা খবর দেবেন | বলা যায় না, কেউ যদি পেয়ে জমা দিয়ে থাকে |”
আমি – “কিন্তু আমরা তো এখানে থাকি না, বেড়াতে এসেছি |”
উনি – “ও ! আচ্ছা ... তাও ...”
একটু পরে, “চলি ... গুড লাক !” বলে ভদ্রলোক কুকুরটাকে টানতে টানতে এগিয়ে গেলেন |

বুবাই আমার হাত ধরে টেনে বলল, “চল বাপি, তাহলে তাই করি |”
আমি – “তাহলে তো ...”
বেণু – “তাহলে কী ?”
আমি – “তাহলে তো, পুলিশকে হারের কথাও বলতে হয় |”
বেণু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, “হারের কথা আবার কাউকে বলার কী আছে ?”
আমি – “না মানে ‘কেস অফ লস্ট এন্ড ফাউন্ড’ তো |”
বেণু – “ব্যাপারটা সে’রকম ?”
(ওই, সেই কথা, যা দিয়ে ঘটনাটার বৃত্তান্ত শুরু করেছিলাম)

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বেণু বলল, “বুঝি না বাপু, নিজের জিনিস হারিয়ে আবার নিজেই ফিরে পেয়েছি, এতে কাউকে বলার কী থাকতে পারে |”
আমি – “তুমি কিছু চিন্তা কোরো না |”
বেণু – “আমি চিন্তা করব না তো কে করবে ?”
আমি – “কেন, আমি কি বাজে কথা বলছি ?”
বেণু – “বাজে কথা ? আমি দেখছি তুমি সেই কাল রাত থেকে ...”
বুবাই – “আহ ! মাম্মা, তুমি আবার শুরু
কোরো না | বাপি, চলো তো | যা করবে করো ... কিচ্ছু বেড়ানো হচ্ছে না |”

কিন্তু থানা কোথায়, মানে সঠিক থানা ? যে সে থানায় গেলে তো বলবে, “এ তো আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে |”

রাস্তায় ফিরে এসে বাস ধরার চেষ্টা করে লাভ হল না | বাস থামে তো কন্ডাক্টর ‘থানা’ কথাটা শুনেই উত্তর না দিয়ে দুমদুম করে বাসটাকে পিটিয়ে উঠে পড়ে | বাসটা ছেড়ে দেয় | দুপুরের কাছাকাছি সময়ে ট্যাক্সিও বিরল | শেষে একটা রিক্সা ধরে বললাম, “কাছে কোথায় থানা আছে, নিয়ে চল |” রিকশাওয়ালা একটু থমকে ভেবে বলল, “বাবু, তিরিশটা টাকা দেবেন ?”
আমি – “কেন ? খুব দূরে কি ?”
লোকটা গাছগাছালির নীচ দিয়ে ময়দানের ওপারের বাড়িগুলোর দিকে দেখিয়ে বলল, “ওইখানে, তবে সারা ময়দানটা ঘুরে যেতে হবে |”
রাজি হয়ে উঠে পড়লাম |

সময় লাগল প্রায় কুড়ি মিনিট | একটা মস্ত কয়েক তলা বাড়ির সামনে লোকটা আমাদের নামিয়ে দিয়ে দেখালো বাড়িটার নীচে চলে যাওয়ার একটা সিঁড়িতে ঢোকার মুখে লেখা রয়েছে – “আদিপুর থানা” | ভাড়া চুকিয়ে ওকে ছেড়ে দিলাম | সিঁড়ির মুখে বেণু জিজ্ঞাসা করল, “আমরাও যাব ?” আমি বললাম, “এস না | এসব ব্যাপারে কতক্ষণ লাগে তা তো জানি না | তুমি কি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে ? আর, কোথায় কী বলতে, কী বলে বসব | তুমি থাকলে ...” বুবাই বেণুর হাত ধরে বল, “চলো, চলো মাম্মা | গিয়ে দেখি না, থানায় কী হয় |”

নীচে নেমে দেখি থানা বলতে মস্ত একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং এর মত জায়গা | চারিদিকে দেয়াল, আর মাথায় ছাত নিয়ে মস্ত খোলা জায়গাটা শুধু থামে আর থামে ভর্তি | তারই মধ্যে, থামের লাইন বরাবর বেঞ্চ কি চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা, কোথাও এক দু’টো টেবিল আর আলমারি | এখানে সেখানে উর্দি পরা লোকেরা বসে কাজ করছে | এ ছাড়াও প্রচুর সাধারণ বেশে লোকজন | কোথাও কাউকে দেখে অপরাধী গোছের মনে হল না | কোনও গারদও দেখতে পেলাম না | ঠিক উল্টো দিকে দূরে এক কোনে আর একটা উপরে ওঠার সিঁড়ি | তার পাশে একটা ঘর – একমাত্র ঘর সমস্ত জায়গাটার মধ্যে | মনে হল তার দরজায় একটা ফলক লাগানো, কারো নামের, যা এত দূর থেকে পড়া গেল না |

আমাদের দেখে একটা উর্দি পরা লোক আঙ্গুলের ইশারা করে একটা চেয়ারে বসা বাবুকে দেখিয়ে দিল | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “উনিই এখানকার দারোগা ? আমি দারোগার সাথে কথা বলতে চাই |” লোকটা মাথা নেড়ে আবার সেই একই ইশারা করল | আমি ইতস্তত করে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম | লোকটা মুখ তুলে চাইলে দেখলাম ওর বুকে নাম ফলকে নাম লেখা, ‘রবি বোস’ | আমি বললাম, “বোস বাবু, আমার একটা ঘড়ি হারিয়ে ফেলেছি ... দামী ঘড়ি, আমার বিয়ের | যদি কেউ ...”
রবি বেণু আর বুবাইকে অগ্রাহ্য করে, তার একমাত্র অন্য চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, “বসুন | বসে কথা বলুন |” তারপর মুখ ঘুরিয়ে কাউকে বলল, “এই, এখানে দুটো চেয়ার দিয়ে যা তো ... হ্যাঁ, বলুন, কী বলছিলেন |”
আমি সংক্ষেপে ঘটনাটা বললাম | রবি সব কথা চুপ করে শুনে বলল, “তার মানে তিনটে ঘটনা ?”
আমি – “তিনটে ?”
রবি – “ওই যে বললেন, আপনার স্ত্রীয়ের হার হারানো, একটা হার খুঁজে পাওয়া, আর আপনার ঘড়ি হারানো | হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ এক সাথে, নয় কি ?”
আমি – “একটা হার নয়, আমার স্ত্রীয়ের হারানো হারটাই খুঁজে পেয়েছি |”
রবি – “একবার দেখতে পারি হারটা |”
বেণু হাতব্যাগ থেকে হারটা বের করে রবিকে দিল | রবি সেটা উল্টে পাল্টে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “এই হার, আর ওনার হারানো হার এক জিনিস ?”
আমি – “নিশ্চয়ই | না হলে আমরা এটা তুলে আনব কেন ? কত জিনিসই তো রাস্তা ঘাটে পড়ে থাকে ...”
রবি – “ঠিক ... কিন্তু আপনাদের কাছে কোনও প্রমাণ আছে যে এই হারটাই আপনার স্ত্রীয়ের ?”
আমি – “দেখুন, আপনি হারটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না | ওটার ব্যাপারে আসিনি | এসেছি আমার হারানো ঘড়ির জন্য |”
রবি – “বেশ ... ঠিক আছে ... তাও আমি আপনার সমস্ত বিবৃতিই নিয়ে নেব | ইয়ে ... আপনি বলবেন আমি লিখব, না আপনি নিজে লিখতে চান ?”
আমি – “আমি লিখে দিতে পারি | কিসে লিখব ?”
রবি একটা ড্রয়ার খুলে গুনে গুনে ছটা কাগজ বের করল | প্রথম দুটোর মাঝে একটা কার্বন পেপার রেখে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নিন তাহলে, লিখুন | উপরে আজকের তারিখ আর সময় লিখবেন, আর আমি লেখাটা চেক করে ঠিক হয়েছে কিনা বলার পর, নীচে সই করবেন |”

তারপর ও হারটা তুলে, “এটা এখন আমাদের কাছে থাক” বলে ড্রয়ারে রেখে সেটা বন্ধ করে দিল |
বেণু আঁতকে উঠে বলল, “আরে, আপনি হারটা কেন নিয়ে নিলেন ? ওটার জন্য তো আসিনি আমরা !” রবির উত্তর না পেয়ে বেণু আমাকে ঠেলা দিয়ে বলল, “এই, তুমি কিছু বলছ না কেন ?”
বুবাই – “মাম্মা, তুমি একটু চুপ করো না | আগে বাপিকে লিখতে দাও | নইলে সব গুলিয়ে যাবে |”

আমি ঠিক কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে রবি বোসকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই তিন জোড়া কাগজ কেন ?”
রবি – “ওই যে তিনটে ঘটনা | প্রত্যেকটার জন্য আলাদা বিবৃতি | আর হ্যাঁ, সময়গুলো ক্রনলজিক্যালি লিখবেন, মানে প্রথমে হবে ওনার হার হারানোর সময়, তারপরে ঘড়ি হারানোর সময়, এবং সব শেষে এই হারটা খুঁজে পাওয়ার সময় | একটা বিবৃতিতে শুধু একটাই জিনিসের কথা লিখবেন, এক জিনিসের সাথে অন্য জিনিস মিলিয়ে মিশিয়ে তালগোল পাকাবেন না কিন্তু | তাহলে তার জট ছাড়াতে আমাদের মুশকিল হবে |”

বেণু আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রবি বোসের নিরস দৃষ্টি দেখে চুপ করে গেল | আমি চোখের ইশারায় বুবাইকে মিনতি জানালাম যে ও বেণুকে একটু সামলে রাখুক | তারপর তিনটে বিবৃতি লিখলাম, এক এক করে | প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল | রবি বোস তারমধ্যে বার কয়েক উঠে কোথাও গিয়ে আবার ফিরে এসে বসল | আমার লেখা শেষ হলে তিনটে পড়ে দেখে বলল নীচে সই করতে | আমার সই করা হলে ও কাগজগুলো ড্রয়ারে পাচার করল | আমি ত্রস্ত হয়ে বললাম, “আমি বিবৃতিগুলোর একটা নকল পাব না |” রবি বোস চেয়ারটা ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “নকল নিয়ে কী করবেন ?” আমি বললাম, “তা হলে কী ভাবে ... ?”
রবি – “আপনারা এখন আসতে পারেন | দিন কয়েক পরে খোঁজ নেবেন |”
আমি – “কিন্তু আমরা তো এখানে থাকি না | বেড়াতে এসেছি, কাল ফিরে যাচ্ছি |”
রবি – “ও ! তা হলে আপনি কাগজ গুলোয় স্থানীয় ঠিকানা আর স্থায়ী ঠিকানা লিখেছেন ?”
আমি – “হ্যাঁ, দুটোই লিখেছি ... আপনি বোধহয় লক্ষ্য করেননি |”
রবি – “না, না আমি দেখেছি | তাও জিজ্ঞাসা করে রাখলাম | যাক, তাহলে চিন্তা কিসের ? আপনারা আসুন | কাল ফিরে যাওয়ার আগে একবার খবর নেবেন | ততক্ষণে কেসটার সুরাহা না হলে আমরা আপনার সাথে স্থায়ী ঠিকানায় যোগাযোগ করব | হয়ত আরও কোনও তথ্য লাগবে | এমন কিছু আছে কি যা আপনি বলেননি ?”
আমি – “যা বলার সবই বলেছি |”

আমরা বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসেছি কি বেণু ক্ষোভে ফেটে পড়ল, “এ তুমি কী করলে ? আমার হারটা কেন দিয়ে দিলে ?”
বুবাই বলল, “মাম্মা, বড্ড খিদে পেয়েছে | কোথাও বসে খেতে খেতে কথা বললে হয় না ?”
আমি – “সেই ভালো | চল, বেরিয়ে দেখি কাছে পিঠে কোনও রেস্টুরেন্ট আছে কি না | তারপর না হয় ফিরে এসে একবার চেষ্টা করা যাবে হারটা ফেরৎ নেয়ার |”

একটু হেঁটেই কাছে একটা খাওয়ার জায়গা পাওয়া গেল | খুব ভিড়, নিরিবিলি টেবিল নেই কোনও |
অন্য লোকদের সাথে শেয়ার করে একটা টেবিলে আমি একা বসলাম, আর একটায় বেণু আর বুবাই | অর্ডার দিতে, খাবার পেতে খুব দেরী হল | তাও ওয়েটার অর্ধেক খাবার দিয়ে কোথায় যে চলে গেল, শেষে উঠে কাউন্টারে বলে এসে বাকি খাবার পেলাম | খেয়ে দেয়ে যখন বেরলাম প্রায় চারটে বাজে | শীতের সন্ধ্যা নামব নামব করছে | রাস্তায় দু’ধরনের ভিড় – যারা বাড়ি ফিরছে কাজ সেরে, ক্লান্ত, আর যারা বেড়াতে বেরিয়েছে, অদম্য | আমরা কোনও দলেই নই | বেরিয়েই বেণু বলল, “থানায় ফিরে চল | আমি ওই হার ফেরত নিয়েই হোটেলে ফিরব |”
আমি – “প্রমাণ ? দারোগাটা বলল না প্রমাণ চাই |”
বেণু – “ও তো গায়ের জোরের কথা | কেমন জোর করে হারটা নিয়ে রেখে নিলো | আর তুমি চুপ করে দেখলে, কিছু বললে না | এক এক সময় তোমার কী যে হয় | আপদ যত ... হারটা ফিরে পেলাম তো ঘড়িটা হারিয়ে গেল |”
আমি – “তা না হলেও তো থানায় গিয়ে ‘হারানো-প্রাপ্তি’র’ খবরটা জানাতে হত |”
বেণু – “আহ ! কী হয়েছে তোমার বলত ? সেই কাল থেকে উল্টোপাল্টা বকছ ... তখনই বলেছিলাম ছাইপাঁশ ...”
বাবুই – “তোমরা না থামলে কিন্তু আমি ... চলো বাপি, থানায় চলো | মাম্মা মনে হচ্ছে কিছু একটা  হেস্তনেস্ত করবে |”

অগত্যা ...

থানায় এসে দেখা গেল, রবি বোস স্থানে নেই | চেয়ারগুলোও নেই | ওর টেবিলের সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দুটো লোক একটা লম্বা লিকলিকে বেঞ্চ বয়ে এনে রেখে বলল, “আপনারা এইটেতে বসুন | সাহেবের ঘরে মিটিং চলছে, সব লোকজন, আর চেয়ার ওনার ঘরে |”

বসে বসে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না, হটাত কেউ কাঁধে টোকা দিল | চোখ খুলে দেখি আরও দু’জন আমার দেখাদেখি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে | টোকা দাতা রবি বোস বলল, “কই, প্রমাণ এনেছেন ?” কথাবার্তা শুনে বেণু আর বুবাই ধড়মড় করে উঠে বসল | বেণু বিরক্ত গলায় বলল, “প্রমাণ কিসের ? আমার জিনিস আমায় ফেরত দিন |”
রবি – “তা কী করে সম্ভব ?”
বেণু – “সে আপনি বুঝবেন | আমি আমার হারটা না নিয়ে যাচ্ছি না |”
রবি – “আপনি থাকুন, কোনও অসুবিধা নেই | থানা তো চব্বিশ ঘণ্টা খোলা | তবে, আমি দশটা নাগাদ চলে যাব | যিনি রাত্রে ডিউটিতে থাকবেন তাকে সব বুঝিয়ে বলবেন ... কেসটা কী, কেন আপনি বসে আছেন, ইত্যাদি |”
বেণু – “না, অত সহজে আমি ছাড়ছি না | আপনার বড় সাহেব কে ? আমি তার সাথে কথা বলব | নিয়ে চলুন |”
রবি বোস সেই দূরের কামরাটা দেখিয়ে বলল, “ওই তো ওনার রুম | যান |”
বেণু – “না আপনাকেও আসতে হবে |”
রবি আশ্বস্ত করার হাসি হেসে বলল, “ভয় নেই, আপনি যান | আমি কাগজপত্র একটু গুছিয়ে আসছি |”

কামরাটার দরজায় নাম ফলকে লেখা ‘অর্জুন ভড়’ | দরজায় টোকা দিতেই ভারী গলায় কেউ বলল, “ইয়েস, কাম ইন |”
ঢুকে দেখি ভিতরে উর্দি পরে এক ভদ্রলোক বসে | মাঝবয়েসী শক্তপোক্ত অবাঙালি চেহারায় চাপা বাঙালিয়ানা | মাথার কোঁকড়ানো চুলে বেশ ভালো রকম তেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা, জুলপিতে তার ধারা চুইয়ে নেমে আসছে | আশ্চর্য যে তাতে পিঁপড়ে ধরেনি | ঘন দাড়ি নিখুঁত করে কামানো | টুথব্রাশ গোঁপ | চাউনি সন্দিগ্ধ, সাক্ষী কপালে তিনখানা গভীর ভাঁজ |

কড়া সিগারেট খাওয়া ধরনের গাড় গলায় অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন, “কী চাই ?”
আমি – “ওই ...”
বেণু আমায় থামিয়ে বলল, “আমাদের রবি বোস পাঠিয়েছেন |”
“ও” বলে অর্জুন নিরাসক্ত ভাবে নিজের কাজে মন দিলেন | বেণু একটা চেয়ার দখল করে বুবাইকে বলল, “এই ! বসে পড়, আর তোর বাবাকে বসতে বল |”
অর্জুন একবার চোখ তুলে চাইলেন, ভাবটা ‘বুঝলাম, কথাবার্তা কে চালাবে |’ আমিও বুঝলাম বেণু ‘ব্যাপারটা সেই রকম’ মেনে চুপ করতে থাকতে আর রাজি নয় | আমাকেই চুপ করে থাকতে হবে |

একটু পরে অর্জুন টেবিলের ঘণ্টিটা বাজালেন | আর্দালি ঢুকলে বিরক্তির স্বরে বললেন, “যা, রবি বোসকে আসতে বল |”
রবি বোস এসে আমাদের অগ্রাহ্য করে অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার, ডেকেছিলেন ?”
অর্জুন মুখ থেকে কলমটা বের করে সেটার লেজ দিয়ে দিয়ে আমাদের দিকে হাওয়ায় একটা খোঁচা দিলেন, “কেসটা কী ?”
রবি – “স্যার, এনারা একটা হার ময়দানে কুড়িয়ে পান | এনে জমা দিয়ে বলছেন, হারটা এনাদের, ফেরৎ দিতে হবে |”
বুবাই – “জাস্ট কুড়িয়ে নয় | ওটা আমার ফেলে দেয়া লেস চিপস এর প্যাকেটে রাখা ছিল ... মনে হয় কেউ হারটা পেয়ে ওই প্যাকেটটার ভিতরে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল, যে পরে এসে নিয়ে যাবে |”
অর্জুন – “ও ! হারটা এখন কোথায় ?”
রবি – “আমার কাছে স্যার |”
অর্জুন – “যাও, ওটা নিয়ে এস |”
রবি – “নিয়েই এসেছি স্যার | এই দেখুন |”
রবি পকেট থেকে হারটা বের করে টেবিলে রাখতেই টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় পাথরগুলো সমস্বরে ঝলমল করে উঠল | রবি এবার হাত থেকে তিনটে কাগজ হারটার পাশে সাজিয়ে রেখে বলল, “আর স্যার, এই তিনটে ওনাদের বয়ান |”
অর্জুন কুঞ্চিত ভুরু আরও কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলেন, “তিনটে বয়ান ? তিনটে কেন ?”
রবি – “হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ, এক সাথে তিনটে কেস, স্যার ! ভাবা যায় না |”
আমি বুঝিয়ে বলতে যাওয়ার আগেই বেণু বলল, “দেখুন, ওর, মানে আমার স্বামীর, মাথা ঠিক নেই | হারটা খুঁজে পেয়েই ও দেখল যে ওর হাতঘড়িটা নেই, মানে হারিয়ে গেছে | একটু আগে ময়দানে বসে ও আমার হারটা খুলেছিল | তখন হাতের ঘড়িটা খুলে কোথায় যে রাখল ... | সেই ঘড়ি হারানোর কথাটা রিপোর্ট করতে এলে, এই এত ঝামেলার সৃষ্টি করলেন আপনার দারোগা | তিন তিনটে বয়ান লেখালেন |”
অর্জুন – “হারটা ফেলে দেয়া খালি চিপসের প্যাকেটে রাখা ছিল বললেন না ? ঘড়িটা ছিল না ওর মধ্যে ?”
বেণু – “না | ছোট্ট প্যাকেট তো, ওই যেটার কুড়ি টাকা দাম | আমরা ভালো করে ওটা ঝেড়ে দেখেছি | তারপর তো, যে টিস্যু পেপারটা দিয়ে হারটা মুছে আমার হাতব্যাগে রেখেছিলাম, সেটা ওর মধ্যে ঢুকিয়েই ফেলে দিলাম | না, ঘড়িটা ওই প্যাকেটের ভিতরে ছিল না |”
অর্জুন – “আশ্চর্য ! যে হারটা চিপসের প্যাকেটে ঢুকিয়ে রেখে গেল, সে কি তাহলে ঘড়িটা পরে চলে গেল ? অবভীয়াসলি, কোন পুরুষের কাজ ... মেয়ে হলে ঘড়িটা রেখে, হারটা পরে চলে যেত | কিন্তু হারটা যখন রেখে গেল তখন নিশ্চয় কোনও মেয়ে সাথী আছে, যে সুযোগ দেখে পরে এসে হারটা পরে চলে যেত ? ... বুঝলে রবি, আমি কি ভাবে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা দেখছি সেটা ধরতে পারছ ?”
রবি – “একদম ঠিক স্যার | তাই তো আমি হারটা রেখে নিলাম | একে তো এনাদের কাছে কোনও প্রমাণ নেই ... কে জানে এঁরাই হয়ত এইভাবে থানায় জমা দিয়ে হারটা ক্লেম করতে চান, যাতে আমরা পুরো ব্যাপারটা ধরতে না পারি | আপনি কিন্তু একদম হান্ড্রেড টেন পার্সেন্ট ঠিক ধরেছেন স্যার | ওই পুরুষ আর স্ত্রী’র অ্যাঙ্গলটা, বিশেষ করে | এনাদের সাথে একদম মিলে যাচ্ছে |”
বেণু – “কী যা তা বলছেন, হ্যাঁ ? আমরা যখন খোঁজাখুঁজি করছি, ওই ময়দানের এক ভদ্রলোক দেখেছেন | তিনিই বললেন থানায় এসে খবর দিতে | ওনার কথা শুনেই  তো এ আমাকে বলল যে থানায় খবর দিলে সব কথা জানাতে হবে | কাল রাত থেকে এ এই রকম উল্টোপাল্টা সব কথা বলছে | নইলে কেউ হারানো জিনিস ফিরে পেয়ে থানায় ডায়েরি লেখায় ? ... এখন ঘড়িটা গেলে যাক | আপনি বলুন এই হারটা ফেরত পাওয়ার জন্যে আমাদের কী করতে হবে |”
অর্জুন – “কী বললেন ? আপনার স্বামী কাল রাত থেকে এইরকম উল্টোপাল্টা কথা বলছেন | কী হয়েছিল কাল রাত্রে ?”
বেণু – “ওই হারটার দার্জিলিং স্টোন নিয়ে তর্ক | ও বলছিল দার্জিলিং স্টোন দার্জিলিং থেকে আসে না, আসে কাশ্মীর থেকে | তাই নিয়ে দুজনের মধ্যে খুব তর্ক বাধল |”
অর্জুন – “কেন ?”
আমি – “বেণু, আমায় বলতে দাও ... আসলে, আমরা যখন ছোট তখনকার কথা | আমার এক মেসো রেলে চাকরি করতেন আর মাসিকে নিয়ে প্রত্যেক বার রেলের পাস নিয়ে বেড়াতে যেতেন, হয় দার্জিলিং, নয় কাশ্মীর, নয় মুসৌরী – মানে হিমালয়ে কোথাও না কোথাও | বেশির ভাগ দার্জিলিং | ফিরে এলে মা মাসিকে বলত, ‘হ্যাঁ রে, ওখানে দার্জিলিং স্টোন পাওয়া যায় না ?’ মাসি বলত, ‘কই দেখিনি তো | দেখলে তোমায় এনে দেব |’ তারপর একবার মাসি শ্রীনগর থেকে ফিরল অনেক অনেক দার্জিলিং স্টোন নিয়ে, সবাই কে দিল | বলল কাশ্মীরে নাকি অঢেল পাওয়া যায় | তাই আমি জানি দার্জিলিং স্টোন দার্জিলিং থেকে আসে না, আসে কাশ্মীর থেকে | সেই কথাই কাল সন্ধ্যায় আমি ওকে বলছিলাম, তো ও তর্ক করতে লাগল যে,  ‘তাহলে নামটা কাশ্মীর স্টোন কেন হল না ?’ আমায় বলল, আমি নাকি ছোটবেলার কথা ভুলে গেছি |”
অর্জুন – “আমি কিছুই বুঝছি না | আপনি ... আপনি কাল রাত থেকে উল্টোপাল্টা কথা বলছেন বুঝলাম | কিন্তু, কেন ?”
বেণু – “আমি বলছি | ও কাল রাত্রে ওই তর্ক হওয়ার পর রেগে গিয়ে ড্রিংক করল | তারপর উল্টোপাল্টা যত কথা |”
অর্জুন অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি ড্রিংক করেন ?”
আমি – “না ... মানে ক্বচিৎ কদাচিৎ | এই যেমন, আমি এখন কোম্পানির হলিডে-প্ল্যানে বেড়াতে এসেছি | ওতে হোটেল থেকে কিছু কমপ্লিমেন্টরী ড্রিংক দেয় | তবে আমি এতদিন আছি, একদিনও খাইনি | কাল খেলাম, কেন না আমার সন্দেহ হল, সত্যি কি আমি ছোটবেলার কথা মনে করতে পারছি না | আসলে বুঝলেন, ড্রিংক করলে না আমার মাথাটা খোলে, খুব পুরানো কথাও পরিষ্কার মনে পড়ে যায় |”
অর্জুন – “তাই বলে আপনি কি এত ড্রিংক করেছিলেন যে আজ সকাল অব্দি তার ইয়ে ছিল ?”
আমি – “না, না, মোটেই নয় |”
অর্জুন – “মাফ করবেন | এ ভাবে আমাদের পক্ষে কিছু নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয় ... না, না রবি, এনাদের এখন যেতে বল | মনে হচ্ছে এনার এখনও ড্রিংকের ঘোর কাটেনি | পরে কখনো দেখা যাবে ... এখন আপনার আসুন | হারটার প্রমাণ নিয়ে এসে দেখা করুন রবির সাথে |”

আমি উঠে দাঁড়ালাম, বুবাই ও | কিন্তু বেণু অনড় হয়ে বসে রইল |

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে অভ্যাস বসত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ভাবছি কী করব, তখনই ওটায়
অ্যালার্ম বাজল | বেণু বলল, “এই ওঠো | আর কত ঘুমবে ? মনে নেই বারোটায় হোটেল ছাড়তে হবে ? ভাবছি তার আগে একটু বেরব, টুকিটাকি কিনতে ... জানো, আমার হারটা খুঁজে পাচ্ছি না | তুমি কি দেখেছ ?”

আমি চোখ খুলে বালিশের তলায় হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজলাম, সময় দেখতে | হাতে হারটা ঠেকল, আর হাতঘড়িটাও | মনে পড়ল, গতকাল রাত্রে শুয়ে পড়ে বেণু বলেছিল ওর হারটা খুলে দিতে | একটু বেশি পান করে ফেলেছিলাম বলে কিনা জানিনা, হারটা খুলতে গিয়ে বারবার ঘড়ির স্ট্র্যাপে বেণুর চুল জড়িয়ে যাচ্ছিল | তখন ঘড়িটা খুলে, তারপর বেণুর হারটা খুলেছিলাম, আর দুটোই বালিশের তলায় রেখেছিলাম | বেণু জিজ্ঞাসা করেছিল, “নেশার ঘোরে হারটা কোথায় রাখলে ? ঘুম থেকে উঠে মনে করতে পারবে ?” আমি বেণুর কথা শুনতে শুনতে অতল ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম - ওর চুল, ওর কাশ্মীরি গলা, ওর দার্জিলিং স্টোনের লকেট, এই সবের কথা গুলিয়ে নিয়ে |


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ১৫ জুন ২০১৪

কোন মন্তব্য নেই: