বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০১৪

সিল্ভ্যর লাইন

|| সিল্ভ্যর লাইন ||


জানার কোনও উপায় ছিল না সে কোন স্টেশনে নামবে | একটা অস্থিরতার অনুভূতি চেপে ছিলাম | যদি হটাত নেমে যায় | আর কিছুতেই মন ভরছিল না, কেন না তার মুখটা মনে রাখার মত করে দেখা হয়নি |

ট্রেন ছাড়ার শেষ মুহূর্তে আমি এই টু-টায়ারে উঠে ছোটার হাঁপটা একটু ছাড়িয়ে নিয়ে উপরের বার্থে ব্যাগটা রাখতে গিয়ে দেখেছিলাম মহিলা বসে আছে, পা ছড়িয়ে | অবাক হয়েছিলাম, কেউ গাড়িতে চেপেই উপরের বার্থে উঠে বসে না | ব্যাগটা আধ-তোলা অবস্থায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম যে চিন্তা মাথায় এসেছিলো, “কী করি ?” একটা দ্বন্দ্ব, হাতটা নামিয়ে ব্যাগটা নীচে রাখি, আর যোগাযোগ এড়িয়ে যাই, না, ব্যাগটা রাখতে গিয়ে যোগাযোগ হয়, আর মুখটা দেখতে পাই | মহিলা দুহাতে মাথার খোঁপা ঠিক করতে করতে পা দুটো টেনে নিয়ে জড়ো করে বলেছিল, “রেখে দিন ... শোয়ার সময় সরিয়ে নেবেন |” আমি, “না, থাক”, বলে হাতটা নামিয়ে নিয়েছিলাম | আর কথা হয়নি | মুখটা কিছুটা অদেখা রয়ে গিয়েছিল |

যে টুকু দেখছিলাম, খুব কোঁকড়ানো তামাটে চুলগুলো নিপুণ হাতে বিনুনি করা | রং ফ্যাকাসে, আর পরিপূর্ণ প্রসাধন হীন ঠোঁট দুটো স্বাভাবিক গোলাপি | হাতের মেদে মনে হয়েছিল মাঝবয়সী |

শোয়ার সময় হলে মহিলা খুব সাবলীল ভাবে বার্থ থেকে নেমে, ঘুরে এসে, আবার উঠে পড়ল | উঠে আলো নিভিয়ে বসে আমার দৃষ্টি দেখে একটু মিষ্টি হাসল, প্রশ্রয় দেয়ার ভঙ্গীতে, যাতে এ’টুকুই বুঝলাম যে আমি তাকালে আপত্তি নেই | তবে অনুজ্জ্বল আলোয় ওই মুখ দেখতে যে অনেক অনেক সময় লাগবে ; ততোটা সময় সে দেবে কি ?

রাত্রে ঘুমের মধ্যে অনেক বার জেগে, মাথা একটু উঁচু করে দেখার চেষ্টা করেছি, সে আছে তো | একবার এমনই, পাশ ফিরে দেখি মহিলা আমার দিকে পাশ ফিরে বার্থের ধারে মাথা টেনে এনে নীচের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে, চোখ দুটো খোলা, অদ্ভুত ঘন তাল তমালের বেষ্টনী ঘেরা মরূদ্যান | আমি কি সত্যি দেখলাম, না কি অনুমান করলাম ? নিজের চোখ বন্ধ করে ঘুমতে চাইলাম | ঘুম এলো ভাবতে ভাবতে. ‘খোঁপায় যদি ঠোঁটের সাথে রঙ মিলিয়ে দুটো গোলাপ গোঁজা হত !’

সকালে উঠে মুখ ধুয়ে জানালা দিয়ে আসা হুহু হাওয়ায় বসে রাত্রের কথা মনে পড়ল | একজন মাঝবয়সী মহিলা, যার খুব সম্ভবত স্বামী আছে, পরিবার আছে – সেই মহিলা কেন ওভাবে তাকিয়ে ছিল এক ঘুমন্ত পরপুরুষের দিকে ?

সারাদিনে মহিলা এক দু’ বার নামল আর উঠল | খাবার এলে উপরেই বসে খেল | একবারও নীচে নেমে সিটে বসল না | সন্ধ্যা হয়ে এলে বুঝলাম একটু পরে আমার নামার সময় এসে যাবে, আর মুখটা ঠিক করে দেখা হবে না | একবার উপরে তাকাতেই দেখলাম মহিলা উঠে বসে আছে | আমার দৃষ্টি দেখে অস্ফুট স্বরে বলল, “কিছু বলছেন ?” আমি তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে চোখ সরালাম |

একটু আগে শুনলাম, মহিলা বলছে, “শুনুন !”
উপরে তাকাতে সে বলল, “এর পর আমার স্টেশন আসছে | আমার ব্যাগটা স্টেশন এলে একটু নামিয়ে দেবেন ?”
আমি বলতে গেলাম, “আমিও নামব”, কিন্তু একটা ব্রিজের গমগম শব্দে  কথাটা চাপা পড়ে গেল | মহিলা বিব্রত হাসি হেসে বলল, “কী ?” তারপর আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সে বলল, “আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না |”
কথায় একটা অদ্ভুত টান |
ব্রিজটা শেষ হলে আমি বললাম, “আপনি চক্রধরপুরে নামবেন ?”
“হ্যাঁ | আপনি ?”
“আমি তারপর, জামশেদপুরে |”

চক্রধরপুর এলে মহিলা নেমে সিটের তলায় ব্যাগটা দেখিয়ে দিল | তুলতে গিয়ে দেখি বেশ ভারী | তার পিছন পিছন ব্যাগটা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামলাম | মহিলা হাতব্যাগ খুলল | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কুলি ডেকে দেব ?”
“না থাক | আমার স্বামী এসে পড়বে | অনেক ধন্যবাদ |”
আমি মুখ তুলে তাকালাম, পরিষ্কার দৃষ্টিতে | আর আমার দ্বিধা নেই, সহযাত্রা শেষ | আর দেখা হবে না – তাই চক্ষুলজ্জার প্রশ্ন নেই আর |

দেখলাম, বার্তালাপে নিকট হয়েও এই মহিলার অসম্ভব রূপ আমার কল্পনার আওতার বাইরে | অথচ বুঝবার উপায় নেই |

হাতব্যাগ থেকে মুখ তুলে, একটু শুকনো গলায় সে বলল, “টিকিটটা পাচ্ছি না কেন ?”
আমি কিছু বলার আগেই শুনলাম কেউ ডাকল, “রেখা !”
তার মুখে হাসি ফুটল | ঘুরে তাকাতে তাকাতে বলল, “ওই তো, আমার স্বামী এসে গেছে | যাকগে টিকিটটা !”

আমি হেসে ফিরে গাড়িতে উঠে পড়লাম | গাড়ি ছেড়ে দিল | দরজায় দাঁড়িয়ে দেখার ইচ্ছে দমন করে সিটের কাছে এসে দেখলাম মাটিতে কী একটা খাম পড়ে আছে | তুলে দেখি নাম ঠিকানা ছাপান খাম, যাতে রেলের টিকিট আসে | উল্টো পিঠে অমার্জিত হাতে লেখা একটা মোবাইল নম্বর | কেন ?

কিছুক্ষণ ভেবে, নম্বরটা ডায়াল করলাম | উত্তর শুনলাম, “হেলো !”
“রুপালী রেখা ?”
“হ্যাঁ ! আপনি কে ?”
“আমি ... আপনার টিকিটটা পেয়েছি | গাড়ির মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল |”
“ও, আপনি ! না, থাক চিন্তা করবেন না | আমার স্টেশন থেকে বেরোতে কোনও অসুবিধা হয়নি ... ফোন করার জন্য ধন্যবাদ |”
আমি চুপ করে থাকলাম |
“হেলো”
সম্বিত ফিরে বললাম, “হ্যাঁ, বলুন |”
“রাখতে পারি ?”
“হ্যাঁ |”

জিজ্ঞাসা করা হল না, “আমি কি টিকিটটা রাখতে পারি ?”
না, টিকিটটা রাখিনি | ঠিকানা তো ছিল মুম্বাইয়ের |
মোবাইল নাম্বারটা বাঁচিয়ে রেখেছি -
নাম দিয়ে, সিল্ভ্যর লাইন ||


-----------------------------------------------------------------------------
ইন্দ্রনীর / ১৬ জুলাই ২০১৪


কোন মন্তব্য নেই: