শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০১৪

মেনকার বিড়াল

|| মেনকার  বিড়াল ||


মেনকার যখন বিবাহ হয়, তাহার বয়স নয়, যামিনীরঞ্জনের বিয়াল্লিশ | প্রথম স্ত্রী বিগত হইলে যামিনীরঞ্জন দ্বিতীয় দারগ্রহণের বাসনা ব্যক্ত করিলেন - এক স্বাস্থ্যবতী কন্যা চাই, যে বর্তমানে, ও ভবিষ্যতে তাঁহার অবর্তমানে, তাঁহার প্রথম পক্ষের পুত্র নলিনের দেখা শোনা করিবে ; এবং সেই কারণে নব বধূ ও পুত্রের বয়সের মধ্যে অন্তত দুই বৎসরের ব্যবধান হওয়া চাই | বস্তুত, বিবাহের সময় দেখা গেল বিমাতার বয়স নলিন হইতে তিন বৎসর কম | কিন্তু ততক্ষণে আপত্তির লগ্ন উত্তীর্ণ হইয়াছে |

ফুলশয্যার রাত্রে মেনকা বিছানায় বিকীর্ণ পুষ্প রাশি দেখিয়া বিচলিত হইল যে তাহাদের উপর শয়ন করিলে তাহারা নষ্ট  হইবে | অতএব সে বিছানার উপর হামাগুড়ি দিয়া পুষ্প চয়নে রত হইল | অচেনা সব পুষ্পের সুগন্ধ মেনকাকে এতই বিহ্বল করিল যে সে হামাগুড়ির ভঙ্গিতেই বিছানায় মুখ নামাইয়া তাহাদের ঘ্রাণ লইতে লাগিল | এমত অবস্থায় যামিনীরঞ্জন নব বধূর জন্য এক বাটি পরমান্ন হস্তে লইয়া কক্ষে প্রবেশ করিয়া এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখিতে পাইলেন | তাঁহার বোধ হইল যেন কোন হৃষ্টপুষ্ট মার্জার পুষ্পের ঘ্রাণ লইতে বিছানায় উঠিয়াছে | আশ্চর্য আদরে তাঁহার গদগদ কণ্ঠস্বর হইতে এই কথা বাহির হইল, “তুমি কি একটা মেনী নাকি ?” চকিতে মেনকা উঠিয়া সলজ্জে ঘোমটা টানিয়া কহিল, “আমায় বলছ, বুঝি ?”

ইহার পর মেনকা হইল যামিনীরঞ্জনের আদরের ‘মেনী’, ও বাটিকার দাস-দাসীদিগের, ‘মেনী-মাঠান’, কেন না যামিনীরঞ্জন মাঝে মধ্যে অনুসন্ধান করেন, “দ্যাখ গে গিয়ে তোদের মেনী-মাঠান কোথায় আছে, কি করছে |”

নলিনের সহিত মেনকার অবিলম্বে আলাপ হইলেও, সহজে ভাব হইবার সম্ভাবনা তেমন দেখা গেল না | মেনকার মধ্যে সেই মাতৃ রূপ কোথায় যাহা নলিনের স্মরণে সদাজাগ্রত ? বরঞ্চ, একদিন দ্বিপ্রহরে বিছানায় অর্ধ আসীন – অর্ধ শায়িত পিতৃদেবের ক্রোড়ে মেনকাকে ক্রীড়ারত দেখিয়া নলিনের মনে ক্ষোভ ও ঈর্ষার সঞ্চার হইল | সেই মুহূর্তে যামিনীরঞ্জন কী আদরে উদ্যত ছিলেন তাহা না দেখিয়াই, নলিন উদ্গত অশ্রু সম্বরণ করিয়া তৎক্ষণাৎ সেথা হইতে দ্রুত অপসরণ করিল |

ক্রমে ক্রমে, নলিন ও মেনকার মধ্যে একপ্রকার সন্ধির সম্পর্ক স্থাপিত হইল | নলিন যখন তাহার খেলনা লইয়া খেলে, মেনকা তাহার কাছে আসিয়া নিত্য নূতন কৌতূহল প্রকাশ করে | নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও নলিন তাহাকে কোন খেলনার আদ্যোপান্ত বিবরণ যোগায় – যথা খেলনাটি কত পুরাতন, কবে কে তাহাকে দিয়াছিল, কবে হারাইয়াছিল ও কবে আবার তাহার পুনর্প্রাপ্তি ঘটে | বলা বাহুল্য, সেই সকল খেলনা মেনকাকে তাহার পিতৃগৃহে ফেলিয়া আসা পুতুল ও ঘটি-বাটির কথা মনে করায় | তখন সে আপন কক্ষে গিয়া গোপনে অশ্রু বিসর্জন করে |

একদিন এই রূপে সে শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া নীরবে অশ্রু ঝরাইতেছে, এমন সময় কোথা হইতে এক মিহি আওয়াজ শোনা গেল, যেন কোন বিড়ালছানা সেই শব্দ করিয়াছে | মেনকা কখনও বিড়ালের সহিত একই কক্ষে অবস্থান করে নাই, সম্মুখীন হওয়া তো দূরের কথা | সাথে সাথে তাহার ক্রন্দন থামিল, ও অনতিবিলম্বে সে কাজল-মিশ্রিত অশ্রুধারা মুছিল | অধীর আগ্রহে একবার এদিক, একবার ওদিকে চাহিল | তারপর, কী ভাবিয়া উবু হইয়া শুইয়া সে পালঙ্কের নিম্নে তাকাইল | সঙ্গে সঙ্গে, সেথা হইতে নলিনের খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল | অতঃপর সে নিমেষে বাহির হইয়া দরজা খুলিয়া দ্রুত বাহিরে পলায়ন করিল | মেনকা শাড়ির আঁচল কোমরে বাঁধিয়া তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিল | কিছু পরে হলঘরে তাহাদের হুটোপুটির শব্দ, ও উত্তেজিত চিৎকার শুনিয়া কমলা দাসী গিয়া দেখিল নলিন ও মেনকা একে অপরকে ধরিয়া ধস্তাধস্তি করিতেছে | পাশেই এক বিড়ালছানা ভয়ভীতিতে  ইতস্তত করিতেছে, যে এ ক্ষেত্রে পলায়ন করা উচিত কি না | দাসী দুই জনের মধ্যে বচসার কারণ অনুমান করিয়া তাহাদের নিরস্ত করিবার পূর্বেই দেখিল নলিন দুই বাহুতে মেনকাকে বেষ্টিত করিয়া ফেলিয়াছে |

বাহুর নিষ্পেষণে মেনকা তাহার সমস্ত শক্তি হারাইয়া, হার মানিয়া, স্থির হইয়া আছে | মুখে কথা নাই | তাহার কাজলে কলঙ্কিত দুই কপোল আরক্তিম | তাহার অধরোষ্ঠ অজ্ঞাত এক উত্তেজনায় কি ত্রাসে কম্পিত |

দাসীর প্রতিবেদন শুনিয়া যামিনীরঞ্জন পরদিনই পশুহাটির বাজার হইতে একটি বিড়াল ছানা আনাইয়া মেনকার হস্তে সমর্পণ করিয়া কহিলেন, “কি ? আর ঝগড়া হবে না তো, নলিনের সাথে ?”
মেনকা মিশমিশে কালো বিড়ালছানাটি হাতে লইয়া কহিল, “এটা, মেনী, না হুলো ?”
বিস্ময়ে যামিনী প্রশ্ন করিলেন, “কেন ?”
মেনকা কিঞ্চিত তাচ্ছিল্যের সহিত কহিল, “এমনি ... আমার হুলো বিড়াল চাই | কী করে বুঝব, এটা হুলো বিড়াল কি না ?”
যামিনী কহিলেন, “ও ... তা, বড় হও | বুঝতে পারবে |”

কালক্রমে মেনকা বড় হইল, এবং রূপে, গুণে ও বিভিন্ন হস্ত কলার পারদর্শিতায় সে সম্পন্ন হইল | নলিনও ধীরে ধীরে তাহার অনুগত হইল, এই অর্থে যে মেনকার সহিত সে আর রেষারেষি করে না | তাহার আকর্ষণ বিড়াল ছানা, খেলনা ও খেলা ধুলা হইতে পড়াশোনায় স্থানান্তরিত হইয়াছে | বয়েসের পরিপক্বতার সহিত তাহার ভিতর মেনকার প্রতি এক প্রকার সম্ভ্রম বোধ জাগ্রত হইল | শৈশবে যে মেনকাকে ‘মা’ বলিয়া সম্বোধন করে নাই, সে এখনও করে না | কিন্তু, প্রায়ই সে  দিনে একবার মেনকার নিকট আসে,  জিজ্ঞাসা করে, “মেনী, তুমি কি করছ ?” উত্তরে মেনকা কী বলে তাহাতে নলিন বিশেষ কর্ণপাত করে না | বেশির ভাগই, সে চুপ করিয়া মেনকার পার্শ্বে বসিয়া তাহার আঁচলের খুঁট কিম্বা বিনুনির অন্ত লইয়া ব্যস্ত থাকে | কখনও বা সে মেনকার পায়ের অঙ্গুলির দিকে তর্জনী দেখাইয়া গম্ভীরতা পূর্ণ কপট ছলে, “একি, তোমার পায়ের একটা আঙ্গুল কোথায় গেল ?” বলিয়া তাহাদের সংখ্যা গণনা করিতে উদ্যত হয় | মেনকা, “আবার !” বলিয়া তাহাকে নিরস্ত করে | দুই জনের ক্বচিৎ কদাচিতের অন্য কথোপকথন মেনকার বিড়াল সম্বন্ধিত হয়, যেমন –

– “ বিড়ালটাকে সবসময় এত ঘাঁট কেন ?”
– “ভালো লাগে তাই” ...

কিম্বা,
– “বিড়ালটা কে যদি আমি তিনতলা থেকে ফেলে দিই ?”
– “কিচ্ছু হবে না | বিড়ালের ন’টা প্রাণ হয়, জানো না ?” ...

নতুবা,
– “এই বিড়ালটা মরে গেলে তুমি কি করবে ?”
– “গলায় দড়ি দেব ?”
– “কেন, মেনী ?”
– “আর, আমার কে আছে ?” ...
...
ইত্যাদি

ইত্যবসরে যামিনীরঞ্জন নিজস্ব সম্পদ, ব্যবসা ও আসন্ন স্থবিরতার নানান চিন্তায় ব্যস্ত থাকিয়া সংসারের সব সম্পর্কে ফাঁকি দেন | একেই তাঁহার একই শয্যায় স্ত্রী ও বিড়ালের সাহচর্য মনঃ পূত নহে, উপরন্তু তাঁহার রক্তচাপের রোগ ধরা পড়িয়াছে | অতএব তিনি একতলার বৈঠকখানায় একটি ক্যাম্প-খাটে শয়নের ব্যবস্থা করিয়াছেন | 
 

সময়ের সাথে সাথে মেনকার নিকট হুলো বিড়ালের গুরুত্ব হ্রাস পাইয়াছে | সে দোতলার শয়নকক্ষে নিজের মেনী বিড়ালটি লইয়াই ব্যস্ত থাকে | বিড়ালটি পাড়ার হুলো বিড়ালের সান্নিধ্যে প্রতি শীতে অন্তঃসত্ত্বা হয়, ও কয়েকটি শাবক প্রসব করে | ছানা গুলি মেনকার যত্নে, আদরে বড় হইয়াও, যথা সময়ে অকৃতজ্ঞের ন্যায় বহির্জগতে পাড়ি দেয় | বৎসরের বাকি সময় দেখা যায় মেনকা সদা নিত্যই বিড়ালটিকে লইয়া ব্যস্ত - সে বই পড়িতে পড়িতে, কি গান করিতে করিতে, বিড়ালটিকে বিছানায় চিত করিয়া রাখিয়া তাহার পেটে আদর করিতেছে, ও বিড়ালটি অর্ধ নিমীলিত চক্ষে সেই আদর উপভোগ করিতেছে | কয় বৎসর হইল বিড়ালটি আর প্রসব করে নাই | তাহাতে মেনকার বাৎসল্য রসে ভাঁটা পড়িয়া, মেনকার আর এক উপসর্গ দেখা দিয়াছে | বিবাহবার্ষিকীতে সে নিজ হস্তে যামিনীরঞ্জনের তরে পরমান্ন প্রস্তুত করিত | কিন্তু দেখা গেল যে বিড়ালটি তাঁহার মতোই সেই অন্নে বিমুখ | আজকাল মেনকা প্রায়শই মা ষষ্ঠীর পূজা দিয়া পরমান্ন প্রস্তুত করিয়া নলিনকে কহে, “মেনীর জন্য পায়েস রেঁধেছিলাম | খেলো না | এখন কী করি ? অতটা পায়েস |” নলিন কহে, “এঁটো না করে থাকলে আমায় দাও | আমার তো পায়েস ভালোই লাগে |” নলিন তাহা খাইয়া চলিয়া গেলে, মেনকার মনে এক অদ্ভুত বিজয়ের অনুভূতি হয় | সে দরজা বন্ধ করিয়া নলিনের আনা পূজার পুষ্প সমগ্রের পাপড়ি ছিঁড়িয়া বিছানায় ছড়ায় | তারপর, মেনীকে বিছানায় লইয়া সেই সব পাপড়ির ঘ্রাণ সমুদ্রে উভয়ে নিদ্রায় বিলীন হয় |

বিড়ালটির প্রতি যামিনীরঞ্জনের প্রকৃত মনোভাব প্রকাশ পাইল যখন মেনকার বয়স একুশ. নলিনের চব্বিশ ও বিড়ালটির বৃদ্ধাবস্থা | যামিনীরঞ্জন হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া পরলোক গমন করিলেন |

তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইলে জানা গেল, তিনি ইষ্টিপত্রে প্রায় সমস্ত ধন সম্পত্তি নলিনের নামে লিখিয়া দিয়াছেন, পরিবর্তে তাহাকে মেনকার রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইবে | মেনকার নামে শুধু বসতবাটিখানি রাখিয়াছেন, এই সর্ততে যে যতদিন তাহার বিড়ালটি জীবিত থাকিবে, মেনকার বসতবাটির উপর অধিকার থাকিবে | তাহার পর বাটিকাটি পরিবারের পুরোহিতের তত্ত্বাবধানে, সন্তানের রক্ষাকারিণী ষষ্ঠীদেবীর, ও তাঁহার বাহন বিড়ালের পূজার জন্য দেবোত্তর করা হইবে |

উকিলের কণ্ঠে যামিনীরঞ্জনের ইস্টপত্র পাঠ শুনিতে শুনিতে মেনকার মনে হইল, তবে কি সে বিড়ালটির সুবাদে মাত্র নলিনের রক্ষাকারিণী ষষ্ঠীদেবী ? পাঠ সম্পন্ন হইলে, মেনকা ম্লান দৃষ্টিতে নলিনের দিকে চাহিয়া, উঠিয়া কক্ষ হইতে প্রস্থান করিল | নলিন কিছু কহিতে উদ্যত হইয়া নিজেকে নিরস্ত করিল | পরে সে মেনকার কক্ষে যাইয়া তাহার সাক্ষাত পাইল না | সে রাত্রে মেনকা শয়নকক্ষে দ্বার রুদ্ধ করিয়া রহিল, রাত্রির আহারের জন্য নীচে নামিল না | নলিন আসিয়া, “মেনী, দরজা খোল ! চল, খেয়ে নেবে |” কহিয়া কত ডাকিল | রুদ্ধ দ্বারের পিছন হইতে মেনকা কোনও উত্তর দিল না |

পরদিন অতি প্রত্যুষে বৃদ্ধা কমলা দাসী আসিয়া উত্তেজিত ভাবে নলিনের দরজায় ঘন ঘন করাঘাত করিল | নলিন দরজা খুলিলে, দাসী রুদ্ধশ্বাসে কহিল, “দাদা বাবু, দাদা বাবু, শিগগির চল | মেনী উপর থেকে পড়ে দালানে মরে পড়ে আছে |”

নলিন হতভম্বের মত তাহার দিকে তাকাইয়া অস্ফুট স্বরে কহিল, “আর, মা ?”
কমলা দাসী বিস্মিত হইয়া, তাহার দিকে নির্বোধের দৃষ্টিতে তাকাইয়া, প্রশ্ন করিল, “মা আবার কে ?”


----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৭ জুলাই ২০১৪



কোন মন্তব্য নেই: