শুক্রবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫

ইঁদুর


|| ইঁদুর ||


ভোর ভোর ঘুম ভেঙ্গে গেলেও, শৈলজার তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা একটু একটু করে কাটছে | হটাত মনটা তির তির করে সজাগ হয়ে উঠলো | আলতো গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “উঠে পড়েছ ?” পাশ থেকে শিবনাথ উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ | ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ... দেখি জানালায় একটা ইঁদুর এদিক ওদিক করছে |”
শৈলজা চমকে উঠলেন, “ইঁদুর ?”

বিস্মৃতিতে লুকিয়ে থাকা বর্জিত একটা শব্দ ...

তাঁদের বিয়ের পর দু’বছর কেটেছিল ২২/২ বনবিহারী মিস্ত্রী লেনে | পাড়াটা প্রায় বস্তি | বেশির ভাগ টালির কি টিনের ছাতের কুঁড়ে | তার মাঝে এক দু’টো পাকা বাড়ি | যেমন তাদের ভাড়া বাড়িটা | দোতলায় টালির ছাতের দু’খানা ঘর | সামনের উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি উঠে ঝুল বারান্দা হয়ে বসার ঘর, শোয়ার ঘর তারপর | তার নিচু জানালা দিয়ে পিছনের কুমোর বাড়ি দেখা যায় | নিধু কুমোর ভোরে উঠেই কাজে লেগে যায় | একটু বেলা হলে তার বউ মিনতি এসে ঘরের কাজ করে যায় | তার উপচানো সোমত্ত শরীর দেখে শৈলজার ভীষণ অস্বস্তি করে | তাই রবিবারে ডাকেন না | শিবনাথ এক দু’বার বলেছেন, “রোববারেও তো ডাকলে পারো | কেন মিছে ছুটির দিন খেটে মরো ?” তবুও, ওই অস্বস্তিটুকু বাদ দিলে নিটোল জীবন |

সেই জীবনে ইঁদুরের উৎপাত শুরু হয়েছিল | তার আগেই শৈলজার নিজস্ব অভিধানে ইঁদুর কথাটা জুড়ে বসেছে – কখনও নেংটি, কখনও ধেড়ে | তাই নিয়ে কৌতুক, অভিমান কি বিরক্তি - আবার বেশি উৎপাত হলে রাগ | কিন্তু, একদিন সত্যি ইঁদুর দেখা দিল | ভোরের আলো ফুটেছে কি গায়ে চাপায় হালকা টান পড়ায় শৈলজার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল | দেখলেন, শিবনাথ ঘাড় তুলে আধশোয়া হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন | শৈলজা জিজ্ঞাসা করলেন, “কী  দেখছ ?” শিবনাথ ধপ করে শুয়ে পড়ে বলেছিলেন, “ইঁদুর | জানালার চৌকাঠে এদিক ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে |” “ও,” বলে শৈলজা পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছিলেন | তারপর মাঝে মধ্যেই ভোরে গায়ে চাপায় টান পড়ত | শৈলজা বুঝতেন ইঁদুর এসেছে | শেষে ইঁদুরের ভয়ে শৈলজা মশারি খাটিয়ে শোয়া শুরু করলেন, যদিও পাড়াটায় মশা নেই বললেই হয় |

সেদিনের কথা আজও মনে দেগে আছে | ভোরে - বোধ হয় হাল্কা হাওয়ার চাপে - খুট করে জানালার পাল্লার ঠোকাঠুকির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল | উঠেই শুনলেন নিধু কুমোরের উঠোনে চাপা কলের শব্দ | তারপর বালতি থেকে জল ঢালার ক্রমাগত ছপছপ | একটু পরেই মিনতির গলায় আদুরে ডাক, “হ্যাঁ গা, গামছাটা একটু দেবে |” চুপিসারে শৈলজা উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন | তার দূর প্রান্ত থেকে নিধুর উঠোন একটু দেখা যায় | মিনতি এত ভোরে স্নান সেরে ভিজে শাড়ির প্রায় সবটাই তারে মেলে দাঁড়িয়ে | তার সিক্ত টানটান আবলুস শরীরে সূর্যের প্রথম রশ্মির আভা চিকচিক করে উঠে এক অদ্ভুত নম্রতার মায়াজাল বিছিয়েছে | শৈলজার শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠল | পা টিপে ঘরে ফিরে শোয়ার ঘরের দরজার চিলতে ফাঁক দিয়ে দেখলেন শিবনাথ আধশোয়া ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছেন | 

তারপর কী ভাবে বিরামহীন চল্লিশটা বছর কেটে গেছে | নিরলস, নিরুপদ্রুত, কিন্তু বৈচিত্র্যহীন নিঃসন্তান সংসার | তবে গায়ে চাপা আলাদা হয়েছে | আস্তে আস্তে সব রকমের ইঁদুরের সাথে আপোষ হয়েছে | ইঁদুর শব্দটাও দূর হয়ে আর কারো মুখে ফিরে আসে নি | শিবনাথ একটু একটু করে জীবনে উন্নতি করেছেন | শৈলজাকে আদরে রেখেছেন | ক’বছর আগে অবসর নিয়ে এই সাত তলার ফ্ল্যাটে উঠে এসেছেন | এখন উপর থেকে অনেক উঠোন দেখা গেলেও তাদের এত দূর থেকে দেখা ক্ষুদ্র ছবি সব তুচ্ছ, অর্থহীন | জীবন তাই এখন নিশ্চিন্ত |

এক লহমার স্মৃতিচারণ থেকে বেরিয়ে এসে শৈলজা ধরে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “ধেড়ে না নেংটি ?”
শিবনাথ বললেন, “বুঝলাম না | শুধু ওর পিঠটা একটু দেখতে পেলাম |”
শৈলজা নিজের গায়ে চাপা থেকে একটা হাত বের করে শিবনাথের গায়ে চাপার ভিতর ঢুকিয়ে তাঁর গায়ের উপর রাখলেন | বললেন, “না, না, এই সাত তলার স্বর্গে ইঁদুর আসবে কোথা থেকে ? অন্য কিছু হয়তো | তুমি ঘুমাও |”

--------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ জানুয়ারি ২০১৫

কোন মন্তব্য নেই: