বুধবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৫

নিছক গল্প

|| নিছক গল্প ||


ক্লাবের রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখি সব টেবিল ভর্তি | তার মাঝে জোড়া দেয়া দুটো টেবিলে পিকুদা বসে আছে বৌদির সাথে | বিপরীতে, আমার দিকে পিঠ করে, এক ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা, দুজনেরই চুল সাদা | টেবিল জোড়া করে ছ’জন বসার জায়গায় বাকি দু’খানা খালি | পিকুদা আমায় দেখে হেসে হাত নাড়ল | আমিও “কেমন আছো ?” বলে এগিয়ে গেলাম |

পিকুদা বহুকালের | আমি যখন কলেজ শেষ করলাম, বাবা-মা নতুন পাড়ায় বাড়ি নিয়েছে মাস কয়েক আগে | আমাদের কোনাকুনি উল্টো দিকে পিকুদা থাকত | কলকাতার ছেলে, বছর কয়েক আগে পাশ করে কোম্পানিতে কভেন্যান্টেড অফিস্যর হয়ে ঢুকেছে | বিকেলে কারখানা থেকে ফিরে বাগানে বসে চা খেত | একদিন আমায় দেখে ডাকল, বলল, “তুমি রুদ্র বাবুর ছেলে না ?” আমি মাথা নাড়লে বলল, “এসো, চা খাবে আমার সাথে |” সেই ভাবে আলাপ | আলাপের কিছুদিন পরে  আমায় কলকাতা যেতে হল একটা চাকরির জন্য নানান পরীক্ষা দিতে | আমাদের কলকাতায় কোনও আত্মীয় নেই শুনে পিকুদা একটুও আশ্চর্য না হয়ে বলেছিল, “চিন্তা কী ? আমাদের বাড়িতে উঠো | কোনও অসুবিধা হবে না |” আমি গিয়ে তিনদিন ছিলাম | ঠাকুরপুকুর লেনে লম্বাটে তেতালা বাড়ি, যার নিচতলাটা ফাঁকা পড়ে থাকত | পিকুদার বাবা, মা এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে দোতলায় থাকতেন | তিনতলায় ঠাকুর, চাকর আর ঝি | বোধহয়, শুধু প্রথম দিন মাসিমার সাথে কথা হয় | উনি চাকর পাঠিয়ে আমার জন্য নিচের একটা ঘর খুলিয়ে দিলেন | একটু পরে তিতুম, আমার সমবয়সী পিকুদার ভাই, এসে আলাপ করল | যে ক’দিন ছিলাম ওই আমার খোঁজ রাখল, বিকেলে আমায় নিয়ে গেল ওর সাথে আড্ডা দিতে | সকালে দোতলায় খাওয়ার টেবিলে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে যেতাম পরীক্ষা দিতে | বিকেলে ফিরে নিজের ঘরেই ঠাকুরের পাঠানো চায়ের সাথে কিছু খেয়ে তিতুমের জন্য অপেক্ষা করতাম | রাত্রে খাওয়ার সময়ের আগেই রাঁধুনি এসে ডেকে নিয়ে যেত তেতালায় রান্নাঘরে লাগোয়া একটা ঘরে | আমি একা, একাই খেতাম, কেন মনে নেই | শুধু একদিনের একটা ছোট্ট ঘটনা বাদ দিলে, খুব স্বচ্ছন্দে ক’টা দিন কাটিয়েছিলাম | বাড়ি ফিরে কৃতজ্ঞতা জানালে অকপট মানুষ পিকুদা ভারি বিব্রত হয়েছিল |

পিকুদা’র টেবিলের কাছ ঘেঁসতেই পিকুদা বলল, “এসো, এসো ... তিতুমকে তো চিনবেই ... কিন্তু, একে মনে আছে কিনা দেখো |” পিকুদার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম মালার চোখে পড়েছে একটা টেবিল থেকে লোক উঠছে | আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “পিকুদা একটু দাঁড়াও, একটা টেবিল খালি হয়েছে |” পিকুদা মাথা ঘুরিয়ে দেখে বলল, “এখানেই বসো না, দু’টো জায়গা তো খালিই পড়ে আছে |” আমি দেখলাম মালার মুখ বিব্রত | ও তাও হেসে বলল, “আপনাদের অসুবিধা হবে না ?” পিকুদা বলল, “না, না, অসুবিধার কী আছে | তাছাড়া, তোমাদের দেখা তো চট করে পাওয়াও যায় না |”

কথাটা সত্যি | ক্লাবে খুব কম আসি | কখনও দেখা হলেও দু’ পক্ষের এক পক্ষ ঢুকছে, তো অন্য পক্ষ বেরোচ্ছে | পিকুদা কয়েক বছর আগে অবসর নিয়েছে, আমি গত বছর | দু’জনেরই ছেলে মেয়ে বিদেশে | প্রথম আলাপের কালে পিকুদার সাথে আড্ডার একটা বিষয় ছিল আমার আকাশকুসুম গল্প | প্লট সাজিয়ে নিয়ে খুব আলোচনা করতাম, কিন্তু লেখা আর হয়ে উঠত না চাকরি খোঁজার ঝক্কির মাঝে | তারপর আমি চাকরি পেয়ে অন্য শহরে চলে গেলে আর যোগাযোগ থাকে নি | বছর দশেক পরে ফিরে এসে জেনেছিলাম পিকুদা বাড়ি পাল্টেছে |

অতএব, এই শেষ বয়েসে বলার কথা কম | তবুও ক্লাবে দেখা হলে দাঁড়াই, দুটো কথা বলি | এখন মালার মুখে মৌন সম্মতি দেখে টেবিলের মাথায় তিতুমের পাশে বসে পড়লাম | মালা বসল পায়ের দিকে | বেয়ারা ডেকে খাবার বলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “পিকুদা, এমন টেবিল জোড়া করে বসেছিলে কেন ?” পিকুদা বলল, “ভাবতে পারো তোমাদের জন্য ... হা, হা ... না, আসলে আমরা যখন ঢুকলাম শুধু এই জোড়া করা টেবিলটাই খালি ছিল |”

তিতুমের সাথে বোধহয় তিরিশ বছর পরে দেখা | পুরু চশমা ঢাকা কৌতুকমাখা মুখে গড়গড় করে অনেক কথা বলে গেল, আর কিছু ঠাট্টা করা প্রশ্ন করল আগের মত | দেখলাম ওর ওপাশে বসা ভদ্রমহিলা ওর অনুপাতে চুপচাপ | একবার শুধু মুখ তুলে আমায় দেখে একটু হাসলেন | দোহারা শরীরে চঞ্চল লক্ষ্মী ট্যারা চোখের নিচে বেমানান চাপা বিব্রত হাসি | আদলে তিতুমের সাথে কোথাও একটা মিল | তবু চিনলাম না ওনাকে | মালার সাথে কথা বলতে দেখে ভাবলাম পরে মালার কাছ থেকে জেনে নেয়া যাবে |

খাওয়া প্রায় একসাথেই শেষ হলে সবাই বসে রইল কফির জন্য | উঠে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে | কিন্তু কফি বোধহয় শেষ, তাই তার জন্য অপেক্ষমাণ লাইন লম্বা | হটাত মালা বলল, “কফি এসেছে !” আমি ছাড়া সবাই উঠে গেল | আমি কফি খাই না রাতের খাওয়ার পরে | ভদ্রমহিলা উঠেও বসে পড়লেন | আমি বললাম, “আপনি কফি নেবেন না ?”  উনি মাথা নেড়ে বললেন, “না, বেশি খাওয়া হয়ে গেছে  ... আপনি আমায় ‘আপনি’ বলছেন কেন ?”

আমি একটু অস্বস্তি বোধ করলাম | কী করে বলি, আমি আপনাকে চিনি না | ‘পিকুদা তো আলাপ করাতেই গিয়েছিল | আমিই টেবিল ধরার তাড়ায় ...’ | চিন্তা থামিয়ে হেসে বললাম, “আপনাকে ঠিক চিনতে পারি নি | কিছু মনে করবেন না |” উনি বললেন, “আমি শ্রীমতী | নামটা শুনেছেন নিশ্চয়ই |” এবার শরীরে, মুখে একটু সহজ হওয়ার ভঙ্গি |

মনে করার চেষ্টা করলাম | আবছা মনে পড়ল, তিতুম ওর বান্ধবীর কথা বলত | কোন এক শ্রীমতীর কথা | আমি ভাবতাম ওটা নাম নয়, বিশেষণের বিভূষণ | কিন্তু এনার তো সিঁথি খালি | বললাম, “আপনার, মানে তোমার, নাম শুনেছিলাম মনে হচ্ছে | কিন্তু সে তো অনেক দিনে কথা |”

কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি নয় | অনেক কথাই মনে আছে, আর কিছু জিজ্ঞাসা | বিশেষ করে সে দিনের কথা, যে দিন শেষ পরীক্ষা দিয়ে ফিরে চা খেয়ে অপেক্ষা করছিলাম তিতুমের জন্য, বাড়ির বাইরে রোয়াকে একা বসে | হেমন্তের বিকেলের রোদ কোন কোন বাড়ির দেয়ালে ঠিকরে নির্জন এঁদো গলিটা উদ্ভাসিত করেছিল | হটাত রিক্সার টুংটাং শুনে, দুটো মেয়েকে গলির মুখে ঢুকতে দেখে নিজের ঘরে ফিরে এলাম | বসলাম জানালার দিকে মুখ করে, শেষ আলোটুকু উপভোগ করার জন্য | একটু পরেই কেউ সিঁড়ি দিয়ে চটির শব্দ করে উঠে গেল, আর একই সাথে আমার ঘরের দিকে কেউ যেন পা টিপে টিপে এগিয়ে এলো | তিতুম কিনা ভেবে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম মুহূর্তের জন্য দরজার চৌকাঠ থেকে উঁকি মারা একটা চুলের গোছায় ঘেরা মেয়ের মুখ এক ঝলকের দেখা দিয়েই সরে গেল | তারপর তার ছুটে পালিয়ে যাওয়ার শব্দটা, যাতে বিন্দু মাত্র লুকোনোর চেষ্টা নেই, ক্রমে জোরালো হয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল | আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে শুধু শুনতে পেলাম উপর থেকে দুই চপল গলায় খিলখিল হাসি চাপার বিফল চেষ্টা | পরে তিতুমকে ঘটনাটা বলতে ও আমুদে হাসি হেসে বলেছিল, মেয়েটি ওর বোনের বন্ধু হবে হয়ত | কিন্তু তার এই কৌতূহলের কারণটা ? সেই কি ছিল তবে তিতুমের শ্রীমতী ?

কফির লাইনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মালা তাকিয়ে দেখছে | হতাশার মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে জানালো, শিগগির কফি পাওয়ার আশা নেই | দেখলাম যারা কফির অপেক্ষায় ছিল, এক সাথে কয়েক কাপ ঢেলে নিয়ে যাচ্ছে, টেবিলের সব সঙ্গীদের জন্য |

অবসর ও অবকাশ আছে দেখে বললাম, “আচ্ছা, সেদিন কি তুমিই উঁকি দিয়েছিলে ?”
শ্রীমতী বলল, “সেদিন ? কবেকার কথা বলছেন ?”
আমি বললাম, “ওহো ! ভূমিকা ছাড়া প্রশ্ন করে ফেললাম বুঝি | আসলে, আমি কলেজ পাশ করে একবার তিতুমদের বাড়িতে গিয়ে ক’দিন ছিলাম, একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে ...”
শ্রীমতী – “জানি সে কথা |”
আমি – “তখন একদিন একটা মেয়ে আমার ঘরে এসে উঁকি মেরে পালিয়ে যায় | আমি জানতে পারি নি সে কে ছিল | তুমি কি ...”
শ্রীমতী – “না, আমি না |”
আমি – “কিন্তু তুমি জানো, নয় কি ?”
শ্রীমতী ইতস্তত করে বলল, “ও ছিল আমার কলেজের এক বন্ধু | আমার কাছে আপনার কথা শুনে দেখতে গিয়েছিল |”
আমি – “কেন ?”
শ্রীমতী মাথা ঘুরিয়ে কফির লাইনের দিকে তাকাল | তারপর আড়ষ্ট গলায় বলল, “এতদিন পরে জেনে কী করবেন ?”
আমি – “কিছু না | নিছক একটা কৌতূহল বলতে পার |”
শ্রীমতী – “দাদার কাছে আপনার কথা শুনে আমার বন্ধু বলেছিল আপনি নাকি ওর দাদার কলেজের ছেলে | তাই ওর খুব কৌতূহল হয়েছিল আপনাকে দেখার |”
আমি – “দাদা মানে পিকুদা ?”
শ্রীমতী – “না, না, ছোড়দা | রোজ আপনার সাথে বেড়িয়ে ফিরে রাত্রে খাওয়ার টেবিলে আপনার কথা বলত | শুনে আমারও খুব কেমন একটা কৌতূহল হত |”
আমি – “তাহলে তো দু’জনে এসে আলাপ করলেই পারতে |”
শ্রীমতী উত্তর না দিয়ে তাকাল | ওর লক্ষ্মী ট্যারা চোখ দেখে দ্বিধার কারণটা অনুমান করে আমি আর কিছু বললাম না |

ফেরার পথে গাড়িতে উঠেই মালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা ওই মহিলাটি কে ? দেখে তো মনে হল না তিতুমের বউ |”
মালা বলল, “কী যে আজগুবি প্রশ্ন করো ! ও পিকুদার বোন |”
আমি – “কী করে বুঝলে ?”
মালা – “আমায় বলল |”
আমি – “কিন্তু আমি জানতাম শ্রীমতী তিতুমের বান্ধবীর নাম ছিল |”
মালা – “সে হতেই পারে, দুজনের এক নাম | কিম্বা, হয়ত বান্ধবীর নাম ছিল রাধিকা | ... এটা বলো, এত অল্প আলাপে উনি এত কী কথা বলছিলেন |”
আমি – “তেমন কিছু না | ভদ্রমহিলা খুব চাপা | আমিই বকবক করছিলাম ...”
মালা – “উনি যে চাপা সে কী করে বুঝলে ?”
আমি হেসে বললাম, “কেন, শুধু তোমরা মেয়েরাই সব কথা বুঝতে পার কি ?”


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৭ জানুয়ারি ২০১৫

কোন মন্তব্য নেই: