শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

কাঁচা লাউয়ের সোওয়াদ



|| কাঁচা লাউয়ের সোওয়াদ ||


আমি খুব তক্কে তক্কে থাকি যে তেমন একটা ঘ্যাম স্বপ্ন দেখলে তাই নিয়ে লিখব | কিন্তু বহুদিন হল নিয়মিত স্বপ্নই দেখি না | যা ও বা দেখি, ঘুম থেকে উঠে মনেই পড়ে না | গত রাত্রে ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল | প্রেক্ষাপটটা এই – বহুদিন বাজারে যাওয়া হয় নি | কাল সন্ধ্যেয় রিলায়েন্স ফ্রেশে গিয়েছিলাম – কিন্তু তেমন মনঃপুত তরকারী পাই নি | একমাত্র তরকারী ছিল লাউ | লাউ আমার প্রিয় – খুব বলব না, তবে অন্য কিছু না পেলে খাই | কিন্তু যে লাউগুলো ছিল একটাও পছন্দসই নয় | হয় পেট-পিঠ সাদা গদাই-লস্কর, নয় যুদ্ধং দেহি লিকলিকে |

রাত্রে ঘুমে, এক মামা (নাকি দূর সম্পর্কের দাদা – বহুদিন আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাত নেই – যে এসে যা পরিচয় দেয় তাই মেনে নিই) দেখা দিয়ে বলল একটা ফাংশন করবে, তারই বাড়ির ছাদে | আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে | কী ফাংশন ঠিক বুঝলাম না, তবে খাওয়া দাওয়া থাকবে জেনে খুশি হয়ে রাজি হলাম | ফাংশনটা যদি তাদেরই বাড়ির ছাদে হয় তবে আমার সাহায্য দরকার কেন ? বুঝলাম, যখন মামা বলল বাড়িটা এক তত্ত্বাবধায়ক হাতে বহুদিন ধরে দেয়া আছে | এখন তার সহযোগিতা দরকার | কী সহযোগিতা ? মামা বলল, ফাংশনটার জন্য ছাতে একটা ছাউনি করতে হবে, তার জন্য টিনের চাল দরকার, কিন্তু কয়েকটাই মামার কাছে আছে, আর খান কয়েক ওই লোকটার কাছে চাইতে হবে | মামা কেন চাইবে না ? না, লোকটার নাকি অনেক বকেয়া বাকি | অতএব, আমিই লোকটাকে, নাম বীরু, ধরলাম | সে বলল, ঠিক আছে, আমি টিনের চাল দেব, তবে কিনে নিতে হবে | দাম কত ? বীরু বলল, আগে ফাংশনটা হোক | তারপর কেমন ফাংশন, কত লোক এলো গেল এই সব দেখে দামটা ধরা হবে – অর্থাৎ, কাজ অনুযায়ী দাম |

ফাংশন অবশ্য খুবই মামুলি হল, তাতে মামা বক্তা, আমি শ্রোতা এবং বীরু পর্যবেক্ষক – স্রেফ দেখতে যে ফাংশনটা কত জমকালো হল | মেনু ভাত আর লাউয়ের একটা ঝোলঝোল তরকারী | ফাংশন শেষ হলে বীরু কোন কথা না বলে, ভাত না খেয়ে, দু’ খানা কাঁচা লাউ তুলে চলে গেল |

পিছু পিছু মামা গেল বীরুর কাছে জানতে, যে টিনের চালের দরুন কত টাকা দিতে হবে | বীরু বেশ চড়া দাম হাঁকল | মামা অবাক হল দাম শুনে | বীরু বলল কারণ, এক – এত বাজে ফাংশন হয়েছে যে তার সব টিনের চালের এক রকম অবমাননা হয়েছে ; আর দুই, বাকি বকেয়াও তো দেখতে হবে ! মামা আমায় বলল, কী উপায় বল তো, আমার কাছে তো এতগুলো টাকা নেই | আমি বললাম, দাঁড়াও দেখছি | আমি গিয়ে বীরুকে বোঝালাম, যে টিনের চালগুলো বিক্রি না করে ভাঁড়া দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে | বছর বছর ও ভাঁড়া দেবে, আর মামা ফাংশন করবে | শেষে দশ হাজার টাকার দাম ছেড়ে দিয়ে ভাঁড়া হিসাবে হাজার খানেক টাকায়  বীরু রাজি হল | টাকা ট্যাঁকে গুজে নিজের টিনের চাল খুলে নিয়ে বীরু চলে গেল | মামাও নিজের টিনের চাল, আর কিছু বাকি লাউ, যা ওই ফাংশনের জন্য কেনা হয়েছিল, কিন্তু কোন গতি হয় নি, তুলে নিয়ে বলল, চল, এবার আমায় একটু এগিয়ে দে |

কিছুদূর এগিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়েই এক ভিয়েতনামের গেরিলা যুদ্ধের দৃশ্য | জল কাদায় ভরা ধানের ক্ষেতে একটা ভাঙ্গা টিনের চালের ঘর | সেদিকে তাকিয়েই মামা বলল, এই রে সর্বনাশ ! বলেই, মামা কাঁধ থেকে টিনের চাল মাটিতে ফেলে সামনে ঢালের মত ধরে বলল, শিগগির এর পিছনে লুকো | দুজনে টিনের চালের পিছনে দাঁড়াতেই, মামা আমাকে একটা সরু লিকলিকে লাউ হাতে ধরিয়ে বলল, এইটে উঁচিয়ে ধর বন্দুকের মত | আমি বললাম, কেন ? মামা বলল, দেখছিস না, সামনে ? ঐ ঘরটায় বীরু লুকিয়ে আছে, আমাদের অপেক্ষায় | আমি বললাম, কেন, কী করবে ও আমাদের ? মামা বলল, ঠিক করে দেখ | ঠাহর করে দেখলাম | বীরু দেখা না গেলেও, দেখলাম ঐ ঘরের বন্ধ জানালা থেকে দু দিকে দুটো লাউ উঁচিয়ে ধরে আমাদের দিকে তাক করা | ব্যাপারটা স্পষ্ট হল, বীরু ব্যাটা টিনের ভাঁড়া আদায় করে এখন বাকি বকেয়া আদায় করার জন্যে ফাঁদ পেতেছে |

বেশ খানিকক্ষণ আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে, আর ওদিকে বীরুর দিকেও কোন হাঁই-চাঁই নেই | কেউই গুলি চালাচ্ছে না | অথচ পরিষ্কার ভাবে পরিস্থিতি সঙ্গিন | কী করব ভাবছি, হঠাত ধাঁই করে মাথায় বুদ্ধি খেলল | মামার টিনের ঢাল থেকে বেরিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গেলাম বীরুর ঘরের দিকে | ও কিছু বোঝার আগেই ওর জানালা দিয়ে বের করা এক নলা লিকলিকে একটা লাউ আমি কপ কপ করে কামড়ে চিবিয়ে মুহূর্তের মধ্যে গিলে ফেলে, দ্বিতীয় লাউটারও একই গতি করলাম | সমস্ত ঘটনা চোখের নিমিষে ঘটে গেল | বীরুও একটু পরে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে মাথার উপর হাত তুলে ঘরটার পিছন দিক থেকে বেরিয়ে এলো |

এবার বলি, আমার মাথায় কী বুদ্ধি খেলেছিল | যখন আমি দেখলাম বীরু গুলি চালাচ্ছে না, আমি বুঝেছিলাম ওর কাছে গুলি নেই | আর, তক্ষুনি এও অনুভব করেছিলাম যে, যেহেতু আমাদের দিক থেকেও গুলি চলছে না, এই দেখে বীরুও শিগগির বুঝবে আমাদের কাছেও গুলি নেই | অতএব, ও সে’কথা বোঝার আগেই ওকে নিরস্ত্র করতে হবে | আর, নিরস্ত্র করার একমাত্র উপায় – বন্দুক লাউগুলোর সদ্গতি করা |

ঘুম থেকে উঠে খুব মনে পড়ল কেমন সুন্দর, একটু আঁকাবাঁকা, লিকলিকে সরু ছিল বীরুর লাউ দুটো | কিন্তু, কিছুতেই মনে পড়ল না ওগুলো খেতে কেমন লেগেছিল | বউকে বলতে, সে উল্টো অনুযোগ করল, কাল তুমি সিটকে দেখে লাউ নিলে না | একটা নিলে আজ চেখে দেখতে পারতে, কাঁচা লাউ কেমন লাগে খেতে |

একটা ব্যাপার বোধগম্য হয়েছে - র‍্যপিড আই মুভমেন্ট ঘুমে মুখে কোনও স্বাদ হয় না ||

------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫

কোন মন্তব্য নেই: