মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৩

আলেয়া



দেয়ালি, ২০০৭
জিত,
         একটা পুরনো খাতা পেয়ে পড়ে দেখছিলাম | কবেকার খাতা ? বলছি শোনো -

         ২০০১ এর পুজোয় বাড়িতে আসতেই মামণি ধরেছিল, “এবার তোর সেকেন্ড ইয়ার হয়ে গেল | ওই সব আই আই টি তে ভর্তি হওয়ার পড়াশুনার খাতাগুলো এবার ফেলে দিলে হয় না ?”

         কালীপূজোর আগে একদিন সকালে একটু শীত শীত ভাব | খাবার টেবিলে কচি রোদ এসে পড়ছে সকাল থেকে | আমি বসলাম খাতাগুলো নিয়ে | কত পরিচিত সময় আটকে আছে ওদের পাতায়, পাতায় | কোথাও লিখে কাট-কুট করেছি কতবার, কোনও অঙ্ক মেলাতে | কোথাও অর্গানিকের জটিল সমীকরণ | কোথাও বাপি সুন্দর ছবি এঁকে অপটিক্সের কিছু বুঝিয়েছে | প্রথম, প্রথম খাতা কিনতাম | পরে যখন কুলিয়ে উঠল না, তখন বাপি অফিস থেকে ব্যবহার করা কম্প্যুটারের ফ্যানফোল্ড কাগজ নিয়ে আসত | মামণি সেগুলোর এক এক পাতা আলাদা করে এক পাশের ফুটোতে সুতো ঢুকিয়ে সেলাই করে দিত একসাথে অনেকগুলো পাতা | দিব্যি খাতা হত, পাতার মুখের দিকটা পিছনে রেখে পিঠের দিকে আমি লিখতাম | একটা খাতা দিন পনের চলত | তাও ভালো | কেনা খাতাগুলো তো চার-পাঁচ দিনেই শেষ হত |

         এইসবের মধ্যে থেকে বের হল একটা খাতা, যেটা যখন আমি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম, তুমি এসেছিলে, তখনকার | মনে পড়ল তার শেষের দিকের পাতায় সেই হাসপাতালের দিনগুলোর কথা লিখেছিলাম, যখন আমি কেবিনে একা থাকতাম | সেই খাতাটা সরিয়ে রেখে বাকিগুলো মামণিকে দিলাম, ফিরীওয়ালাকে দিয়ে দিতে |

         আজ খাতাটা আমার পুরনো জামাকাপড়ের নিচ থেকে বেরল | সেটাই পড়ে মনে হল তোমায় একটা প্রশ্ন করি | নাকি দুটো ?

         তার আগে বলি – আমি নিচে সেই ডায়েরির পাতাগুলো নকল করে দিলাম | তখন লিখেছিলাম অবশ্য ইংরেজিতে | এখন সেটাই বাংলায় লিখে পাঠাচ্ছি |

         পড়ে এই দুটো প্রশ্নর উত্তর দিও |
- একটা কথা আমি তখন লিখিনি | ভাবতে পারো সেটা কি ?
- দেয়ালির রাতে তোমার মনে কি ঘটেছিল তা হয়ত এখন তোমার মনে পড়বে না | তাও জানতে চাই, নিচের লেখা পড়ে সেই রাতের কথা কি ভাবে তোমার মনে পড়ে ?

         তাড়াতাড়ি উত্তর পাঠাবে তো ?
মাম্মা আর বাপ্পি কে আমার কি জানাবো – প্রণাম, না শ্রদ্ধা ? তুমি ঠিক করে নিয়ে জানিয়ে দিও, প্লিজ !
তোমায় কিছুই জানাচ্ছি না, তোমার উত্তরের অপেক্ষায় |

- তোমার ইতি 


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

০৩ নভেম্বর
তিন দিন আগে বেনারসের বড় মাসির কাছ থেকে ফিরেছি জন্ডিস নিয়ে | যাওয়ার সময় খুব জ্বর ছিল | ওখানে ক’দিন ডাক্তার দেখানোর পর ইউরিনের রং দেখে ডাক্তার বলল যে জন্ডিস হতে পারে | ট্রেনে রিজার্ভেশন থাকলেও জ্বর আর গা ব্যথায় অনেক কষ্টে ফিরেছি | বাড়ি ফিরেই বাপি আমাকে হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে দেখাল | ওরা বলল তখনই ভর্তি করতে | ঘরে গিয়ে দরকারি জিনিস নিয়ে ফিরে এসে ভর্তি হলাম | প্রথমে ওরা আমাকে ওয়ার্ডে দিল | অনেক রাত অব্দি বাপি থেকে শেষে মামণিকে রেখে গেল আমার কাছে | খুব চিন্তা হল মামণি কি করে রাত কাটাবে, বসার জন্য তো খালি একটা স্টুল | ডাক্তার দেখে গেল, বেশি ওষুধ দিল না | শুধু নার্স রক্ত নিলো পরীক্ষা করার জন্য | ডাক্তার বলল পরদিন কেবিন দেবার চেষ্টা করবে |

বাড়ি থেকে আসার সময় মামণি বাপিকে জিজ্ঞাসা করেছিল জিত কে খবরটা দেবে কিনা | বাপি বলেছিল বাড়ি ফিরে জিত কে ফোন করবে | আমি ভাবলাম, ‘জিত কি করবে ? আমার সাথে হাসপাতালে তো কথা বলতে পারবে না | শুধু রাত জেগে ছটফট করবে হয়ত |’

পরশু জানলাম আমার বিলিরুবিন ১৬’র ওপরে | খুব বেশী | কেন হল এরকম ? বাপি আবার গেল কেবিনের কথা বলতে |

আজ সকালে আমি কেবিন পেয়েছি | আমি বলায় বাপি কিছু আই আই টির বই খাতা দিয়ে গেছে | সেগুলো রেখেছি মাথার কাছে ওষুধের ছোট টেবিলটা টেনে | তবে বেশি কিছু পড়তে পারছি না | ভারী ভারী বইগুলো পড়েই থাকছে | তার উপর বাতি আসছে আর যাচ্ছে | বাপি বলছিল ঋতু বদল হলেই লোড শেডিং হয় | যেমন এখন ঠাণ্ডা পড়ছে | কিন্তু কেন ? জিত থাকলে নিশ্চয় এই নিয়ে কথা বলা যেত | আমি কিছু প্রশ্ন করলে ও খুব খুশি হয় নিজের মতামত জানানোর সুযোগ পেয়ে |

৬ই রাত্রিতে কালীপূজো | পরদিন মামণি প্রদীপ জ্বালবে | বলছিল, “তুই নেই | কি করব ভেবে পাচ্ছিনা |” আমি তো দেয়ালি দেখতে পাব না বলেই মনে হচ্ছে |

০৪ নভেম্বর
কাল জিত এসেছে | রাত সাড়ে দশটায় স্টেশনে নেমে বাপিকে ফোন করে জেনে নিয়ে আমি কোথায় আছি, প্রথমে সোজা হাসপাতালে এসেছে | রিসেপশনে ওকে আটকে রেখে খবর পাঠাল কেবিনে | মামণি গিয়ে ওকে নিয়ে এলো | কেবিনে ঢুকে আমায় দেখে ওর হাসি নিভে গেল | ও এইরকম চুপ করলেই আমি বুঝি ওর মনে কোনও আলোড়ন হচ্ছে যা মুখে প্রকাশ করতে পারছে না | মামণিকে বললাম গিয়ে নার্সদের কাছ থেকে জেনে আসতে শোয়ার আগে কোনও ওষুধ খেতে হবে কি না | মামণি চলে গেল জিজ্ঞাসা করলাম, “জিত কি হয়েছে ? তুমি এমন চুপ করে আছ কেন ? ক্লান্ত ?”
জিত আমার কাছে এসে আটকানো গলায় বলল, “খুব কষ্ট পেয়েছ, না ? ... ভাবিনি তুমি এত রোগা হয়ে গিয়ে থাকবে |”
আমি – “না, না | আসলে আমি হাসপাতালের ঢিলে গাউনে রোগা লাগছি হয়ত | আর, কতদিন পরে দেখছ | ”
জিত – “না | তোমার হাত, গলা সব কত রোগা হয়ে গেছে | শরীর দেখে মনে হচ্ছে বয়েস বার – তেরো যেন | কি খাচ্ছ ?”
আমি – “ডাক্তার ঝা, যে আমায় দেখছে, বেশ বয়স্ক, খুব হেসে কথা বলে | আমার ভারী বইগুলো দেখে বলে, এখন এগুলো তুলো না, দুর্বল শরীরে ক্লান্ত হতে নেই | আজ ও বলেছে এখন আমি বাড়ির খাবার খেতে পারি | সেই কথা শুনেই বাপি লাফিয়ে অফিস থেকে ফিরে আমার জন্য কুমড়ো, বেগুন, ঢেঁড়স দিয়ে সাম্বার আর ভাত রান্না করে এনেছিল | খুব খেয়েছি |”

মামণি নার্সদের ওখান থেকে ফিরে এলে জিত বলল, “মাসিমা, আজ রাত্রে আমি থাকি ? আপনার নিশ্চয় অনেক দিন রাত্রে বাড়িতে শোয়া হয়নি |” মামণি বলল, “না টুকু | তুমি আজ কতক্ষণ ট্রেনে কাটিয়েছ | তুমি যাও | মেসোমশাই নিশ্চয় বসে আছে খাবার নিয়ে | ওকে বলে দিও আমি খেয়ে নিয়েছি |”

জিত চলে গেল সকালে আসবে বলে |

০৫ নভেম্বর
জিত আসার পর আমি মনে মনে অনেক ভাল বোধ করছি | জ্বরটা কমেছে, তবে ডাক্তার ঝা বলছে বিলিরুবিন কমতে দেরী হবে | রোজ সকালে এসে আমায় দেখে যায় | গলায় কণ্ঠীর মালা, কপালে চন্দন আর সিঁদুরের টিপ | ইংরেজি একদম বলতে পারে না | একদিন জিত কে না দেখতে পেয়ে মন্তব্য করল, “ও যখন থাকে তখন তো তুমি খুব হাসিখুশি থাক দেখছি !”
ভেবেছিল আমি উত্তর দেব না | হেসে বললাম, “আপনাকে দেখেও তো আমি খুশি হই |” | “ভাল কথা”, বলে চলে গেল |

মুশকিল নার্সগুলো কে নিয়ে | জিতকে নিয়ে নানা পরোক্ষ প্রশ্ন | একদিন জিত আমার খাটে বসে আমার হাতে কিরুকিবু কাটছিল | এটা ওর একটা খেলা | হাতের ভিতরের দিকের চামড়া তিন আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চিমটি কেটে কেটে আঙ্গুল তিনটে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে কব্জি থেকে কাঁধ অব্দি, মনে হবে যেন কোন ডেঁয়ো পিঁপড়ে কামড় দিতে দিতে হেঁটে যাচ্ছে | হালকা চিমটির সাথে অদ্ভুত একটা সুড়সুড়ি লাগে, যেটা হাতের শিরা বেয়ে বেয়ে গলা হয়ে মাথায় ওঠে | আমার তো কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীরের টানটান ভাব ছাড়তে শুরু করে | একবার মার হাতে করাতে মা তো হাসতে হাসতে হাত ছাড়িয়ে বলল, “ও সব তুমি ঋহার হাতেই করো, বাবা |” তাই, সেদিন একটা নার্স ইনজেকশন দিতে এসে এই সব দেখে খুব গম্ভীর হয়ে জিত কে বলল খাটে না বসতে | পরে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “ও কি তোমার ভাই, যে খাটে বসেছিল ?”

০৬ নভেম্বর
আজ রাত্রে কালীপূজো | বাপি আজ একটা অভাবনীয় কাজ করেছে | আমার বিলিরুবিন কমছে না এই নিয়ে খুব চিন্তিত দেখে কাল, অফিসে নয় ক্লাবে, বাপিকে কেউ বলেছে, পীরডিহিতে এক মুসলমান বাবা আছে যে নাকি জন্ডিসের ওষুধ দেয় | মাকে নিয়ে গিয়েছিল | একটা সাদা কাঠের পুঁতির মালা এনে আমায় দিয়েছে | এটা পরে থাকলে ওই পুঁতিগুলো শরীর থেকে বিলিরুবিন টেনে নেবে | পুঁতিগুলো হলুদ হয়ে গিয়ে কমলা রং ধরলে বুঝতে হবে অসুখ শেষ হয়েছে | মামণি তো এত রেগে গিয়েছে | বাপিকে জানি নাস্তিক বলে | ভগবান, সাধু, সন্ত কিছুতেই বিশ্বাস নেই | কিন্তু খুব কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “ঋহা, একবার পরেই দেখ না |” শেষে মামণি ও আমাকে বলল, “বাপির যখন এতে এত আস্থা, তখন কদিন পরেই দেখ |” তাই মালাটা পরেছি, কিন্তু খুব অস্বস্তি করছে কেন না ঘাড়ে, গলায় খরখরে পুঁতিগুলো ফুটছে |
মা আজ রাত্রে কালীপূজো দেবে | জিত থাকবে আমার সাথে কেবিনে |

আমার কেবিনটা বেশ বড় | বাইরে একটা এক মুঠো চৌক ঘাসের উঠোন ঘিরে চারি পাশে করিডোর | তিন পাশের তিন করিডোরে মুখ করে কেবিন পর পর, চতুর্থ করিডোরটা হাসপাতালের যাতায়াতের মেরুদণ্ড | আমার কেবিনে ঢুকে বাঁ দিকের দেয়ালে লাগান আমার খাট | তার এই পাশে ঢোকার দরজার পর একটা বড় সোফা, যাতে শোয়াও যায় | এই দরজার মুখোমুখি উল্টো দেয়ালে আর একটা দরজা | ওটা দিয়ে বেরলে একটা ছোট ব্যালকনি | ওই দরজার পাশে একটা বড় জানলা, যেটা দিয়ে হাসপাতালের রিসেপশন দেখা যায় | দেখা যায় এদিক ওদিক কত ঢাকা করিডোর গেছে, পাশ দিয়ে দিয়ে সবুজ বেড়া আর ছায়া ছায়া গাছ | কেউ না থাকলে আমি বাইরে বসি, বা খাটে শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দেখি | জিত এলে বাইরেই বসি | অনেক সময় কোনও কথা হয়না | কি ভাবছে জিজ্ঞাসা করলে বলে, “কারো সাথে কথা বলার একটা সুযোগ পেয়েছি | মনে মনে দুটো কথা বলে নিই |” মাঝে মাঝেই আমায় হাতে কিরুকিবু করে দেয় | কে যে শিখিয়েছে ওকে | আগে একবার বলেছিল অর্জুন নাকি | অত ছোটবেলায় ?

আর, ওদের কি হল, অর্জুন আর এর্মের, কে জানে ? জিত কে জিজ্ঞাসা করলে বলে জানে না |

০৭ নভেম্বর
কাল রাত্রে জিত ছিল | অনেক রাত অব্দি গল্প করে শুয়েছি | সকালে উঠে দেখি আমায় না বলে চলে গেছে | এই খাতার একটা পাতা ছিঁড়ে লিখে রেখে গেছে -

তুমি ঘুমচ্ছিলে, ভোরের নার্স ওষুধ রাখতে এসে আমায় দেখে চমকে গেল | আসলে, আমি তোমার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে তোমায় দেখছিলাম | ঘুমের মধ্যে তোমার বুক একটুও উঠছে পড়ছে না দেখে হটাত খুব ভয় পেলাম ! তারপর যখন তুমি নড়ে পাশ ফিরলে, তখন আশ্বস্ত হলাম | তখন দেখি তোমার গালে ঘামে আর লালায় অনেক চুল জড়িয়ে গেছে | গালটা মুছে চুলগুলো ছাড়াচ্ছিলাম, এমন সময় নার্সটা ঢুকল, আর থমকে দাঁড়াল |
আমি বাড়ি যাচ্ছি | স্নান করে জলখাবার নিয়ে আসব | তুমি ঘুমাও ততক্ষণ |

ঘুমবো কি, ফ্যান চলছে না, বাতি নেই সকাল থেকে | বাইরে শীত শীত আবহাওয়া হলেও সারা রাত বন্ধ ঘর সকালে গরম | জিত এলে ব্যালকনিতে বসে দুজনে মামণির বানিয়ে দেয়া স্যান্ডউয়িচ খেলাম চায়ের সাথে | তারপর জিত আমায় অনেক পার্ম্যুটেশনের অঙ্ক দেখিয়ে দিল | ও শুধু মুখে বলে দেয় | খাতায় কিছুতেই লিখবে না | একদিন ঠাট্টা করে বলল (সাধারণত এরকম কথা বলে না), “কে জানে একদিন যদি কেউ তোমার খাতায় আমার হাতের লেখা দেখে | কি বলবে তুমি তাকে ?”

আমার খাতায় আর কেউ লিখবে ? জিত, তুমি আমার যে খাতায় লেখ, সেটা কেউ কোনোদিন দেখবে না | আমি নিজেই দেখতে পাইনা | খালি লেখ যখন, যেমন এখন এই কথাগুলো বলে লিখলে, তখন মনের ভিতরে আঁচর টেনে কিরুকিবু করে তোমার লেখা পড়ে | কি লেখা তা বুঝি না | শুধু এটুকু বুঝি যে যা বলছ তা নয়, কি বলতে চাইছ তাই লেখা হচ্ছে | হয়ত অনেক দিন পরে একদিন আমি মনটা খুলে দেখাব তোমাকে, আর তুমি পড়ে শোনাবে কি বলতে চেয়েছিলে |

দুপুর অব্দি থেকে জিত চলে গেল | খেয়ে ঘুমিয়ে সন্ধ্যা বেলায় আসবে | ততক্ষণ মামণি থাকবে | ভাইফোঁটা পার হলে জিতের ছুটি শেষ, মায়ের স্কুল খুলবে, আমার ও | সামনে পরীক্ষা | কি লিখব ? ওদিকে আমার বিলিরুবিন কমতে লেগেছে, এখন দশের কাছাকাছি | বাপি একটু আশ্বস্ত হয়ে আমার গলার কাঠের পুঁতির মালাটা দেখল | মামণি কে বলল, “বুনু দেখ পুঁতিগুলো কেমন হলুদ হয়েছে |” মা জিতের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল | জিত বাপিকে বলল, “হ্যাঁ মেসোমশাই | আমি আগেই বলেছি ঝিলিক কে, যে এবার ও ঠিক হয়ে যাবে, আর আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি পালাতে পারব |”

আমি এটা বুঝি না, বাপি জিত কে জিত বলে ডাকে, কিন্তু মামণি ওকে এখনো মাঝে মাঝে টুকু বলে ডাকে | আর বাপির সাথে কথা বললে জিত আমাকে ঝিলিক বলে ডাকে | মনে হয় যেন মামণি জিতকে এখনো সেই ছোট মনে করে, আর বাপি ভাবে ও বড় হয়ে গেছে | আর বাপির মনে আমি এখনো ছোট, তাই বাপির কাছে জিত আমাকে ঝিলিক বলে ডাকে | আমি বাপির ঝিলিক, না টুকুর ? জিত আমার, না বাপির ? টুকু আর ঝিলিক কি ভাই বোন ? আর, জিত আর ইতি ...

০৮ নভেম্বর
কাল দেয়ালি ছিল | বিকেলেই পুরো পাওয়ার চলে গিয়েছিল | নেমে আসা অন্ধকারে আমি ব্যালকনিতে বসেছিলাম | সূর্য ডুবলে ওরা জেনারেটর চালিয়ে চেষ্টা করল অনেকক্ষণ ধরে | কিন্তু তাতে কখনো এখানে, কখনো ওখানে, এক দুটো বাতি শুধু জ্বলে উঠবার চেষ্টা করেই নিভে যাচ্ছিল | মনে হচ্ছিল যেন করিডোরে করিডোরে আলেয়ার আলো পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে | ভাবছিলাম করিডোরে অন্ধকার ঘনালে জিত আসবে কি করে | তখন বাইরের দরজায় দুটো টোকার শব্দ হল, শুনলাম জিত ডাকছে, “ইতি, তুমি কোথায় ?” আমি ব্যালকনির দরজা ফাঁক করে সাড়া দিলাম, “ব্যালকনিতে | চলে এস |”

দুজনে বসে থাকতে থাকতে দেখলাম, হাসপাতালের বাইরে নার্সদের হোস্টেলে বাতি এলো | ওরা অনেক ছোট চুমকি বাতি লাগিয়েছে - সাদা, হলুদ, লাল, নীল, সবুজ আর বেগুনী বিজলীর বাতি ঝালরের মত ঝুলছে চারতলা বাড়িটাতে | কি মায়াবী লাগছে বিশেষ করে ওই সবুজ, নীল আর বেগুনী আলো | তারপরে দেখলাম নার্সরা ব্যালকনির রেলিঙে প্রদীপ দিচ্ছে | জিত বলল মামণিকে প্রদীপের সলতে, তেল সব ঠিক করে দিয়ে এসেছে | মামণি বাপির অপেক্ষায় বসে আছে |

কিন্তু হাসপাতালে বাতি আর এলো না | জেনারেটর অনেক চেষ্টা করে শেষে কিছু কিছু জায়গায়, যেমন নার্সদের স্টেশনে স্টেশনে বাতি দিল | একটা নার্স এসে আমার ঘরে একটা ইমার্জেন্সি বাতি দিয়ে গেল | জিত গিয়ে সেটা নিভিয়ে এসে বলল, “চলো আজ অন্ধকারে বসি, দিনটা মনে রাখার জন্য |” দেখলাম একটু একটু করে ঠাণ্ডা নামছে | জিত আমার হাত দুটো নিয়ে নিজের হাতের তালুর মধ্যে ধরে রাখল | পরে ভিতর থেকে একটা চাদর এনে আমার হাঁটুর উপর ফেলে দিল |

একটু পরে আবার দরজায় টোকা | একটা নার্স ঢুকল, বলল রক্ত নেবে | নার্সটা নতুন মনে হল | কিছুতেই আমার নাড়ি খুঁজে পায় না আর থেকে থেকে জিতের মুখের দিকে তাকায় | জিত ওর চোখ এড়িয়ে ওকে একবার বলল অন্য নার্স ডাকতে | সে কথা না শুনে ও হটাত খুব জোরে ছুঁচ ফুটিয়ে রক্ত নিতে শুরু করল | তারপর ছুঁচটা বের করতেই ফোয়ারার মত রক্ত বেরোতে লাগল ফোটানো জায়গাটা থেকে | আমি দেখি জিত অদ্ভুত ভাবে সেদিকে তাকিয়ে, মুখে কথা নেই | আমি চিৎকার করে উঠতে নার্সটা ছুটে বেরিয়ে গিয়ে ফিরে এলো অন্য নার্স নিয়ে | জিত সেইভাবেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে | যেন স্থাণু হয়ে গিয়েছে | কিছুক্ষণ পরে নার্সরা রক্ত বন্ধ করে চলে গেলে আমি বিছানা থেকে উঠলাম | ততক্ষণে ও সোফায় গিয়ে বসে পড়েছে | আমি ওর হাতে হাত রেখে বললাম, “জিত, কি হয়েছে ? এরকম রক্ত দেখনি কোনও দিন ?” জিত সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, “না, আমি তোমার রক্ত তো আগে দেখিনি | কোথায় থেকে এলো এত কালচে রক্ত ? তোমার আর আমার রক্তের রং আলাদা কেন ? “
আমি – “জিত, ইমার্জেন্সি আলোয় রক্তটা হয়ত কালচে লাগছিল | তুমি তাই দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলে ?”
জিত = “না, আমি ঘাবড়ে যাইনি | কিন্তু কি সব এলোমেলো চিন্তার ঝোঁকে পড়ে গিয়েছিলাম, যেন ওই রক্ত আমাকে সম্মোহিত করেছিল |”

আমি জিত কে জড়িয়ে অনেকক্ষণ সোফায় ওর পাশে বসে থাকলাম | ওর পিঠে আমার বুক হেলিয়ে ওকে শোনালাম যে আমার বুকের ভিতরটা শান্ত হয়েই আছে; যাতে ও আর চিন্তা না করে | জিত কাঠের গুঁড়ির মত শক্ত হয়ে বসে থাকল |

রিসেপশনটা সন্ধ্যা থেকে অন্ধকার ছিল | অনেক দেরীতে ওখানে ওরা প্রথমে একটা ইমার্জেন্সি বাতি দিল | তারপর কেউ এসে অনেকগুলো মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে গেলে | জানলা দিয়ে আসা সেই আলোয় জিত হুঁশ ফিরে পেয়ে বলল, “চল, ঝিলিক, ওখানে গিয়ে দেখি ওরা কি করছে |” জিত আমাকে ঝিলিক বলে ডাকার মানেই হচ্ছে একটা কিছু খেলার কথা মনে হয়েছে ওর | উঠে বললাম, “আচ্ছা তুমি বস, আমি এই গাউনের নিচে একটা আমার শেমিজ পরে নিই |” তার ওপর চাদর গায়ে জড়িয়ে আমি বেরলাম | অন্ধকার করিডোরে ইমার্জেন্সি বাতিটা ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে রিসেপশন পৌঁছলাম | ওখানে একটা সোফায় আমায় বসিয়ে জিত গেল ক্যান্টিন থেকে চা আনতে | চা বলে দিয়ে ফিরে এলো কয়েকটা কাপ-কেক নিয়ে | একটু পরে একটা ছেলে চা দিয়ে গেল | খেতে খেতে দেখলাম কিছু স্টাফ অনেক রঙিন মশাল আর তুবড়ি নিয়ে এসে জ্বালাতে লাগলো পোর্টিকতে | তার ধুঁয়ায় ভরে গেল রিসেপশন | তখন একটা সিনিয়র ডাক্তার এসে খুব বকাবকি করল | তারপর সবাই এক এক করে চলে গেল | জায়গাটা শান্ত হয়ে গেল | শুধু মোমবাতিগুলো জ্বলল ঠাণ্ডা হওয়ায় শিখা হেলিয়ে দুলিয়ে | ওগুলো বোধ হয় সেন্ট দেয়া ছিল | পোড়া মশালের গন্ধ কাটিয়ে খুব সুন্দর হালকা একটা গন্ধ ছড়িয়ে গেল | আমি আর জিত বসেই থাকলাম | নটা বাজলে রিসেপশনিস্ট ও চলে গেল | তারপরে দেখলাম নার্স হোস্টেলে ওরা চুমকি বাতিগুলো নিভিয়ে দিল | দেখতে, দেখতে ওদের প্রদীপও প্রায় সব নিভে গেল | পটকা ফাটার শব্দ দূর হতে দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল | বাইরের অন্ধকার নিঃশব্দে বাড়তে থাকল | এক সময় ঠাণ্ডা হাওয়াটায় গাটা শির শির করে উঠলো | তখন আমি মনের মধ্যে ভেসে আসা একটা কথা শুনে অস্পষ্ট স্বরে তার প্রতিধ্বনি করলাম, “টুকু, এবার আমায় ঘরে নিয়ে চল |”

ঘরে ফিরে এসে প্রথমে খাটে শুলাম, ক্লান্ত লাগছিল এত | তারপর উঠে বসলাম জানালার দিকে মুখ করে | জিত জানালার কাছে গিয়ে বাইরে দেখল | তারপর আমার কাছে এসে, অন্ধকারে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল | আমি বললাম, “কি দেখছ ?”
জিত – “তোমার চোখ |”
আমি – “কি আছে ওতে ?”
জিত – “ওর কালো অন্ধকার মনিতে বাইরের আলোর প্রতিফলন দেখছি | স্পষ্ট |”
আমি – “তাই ?”
জিত – “ভাবছি, যদি ওই ভাবে চোখে আলো ভরে নিতে পারতাম |”
আমি – “কেন ?”
জিত – “পথ দেখার জন্য |”
আমি – “কোন পথ ?”
জিত – “জানিনা | পথটাই তো খুঁজছি |“
আমি এই হেঁয়ালি না বুঝে চুপ করে থাকলে জিত বলল, “খিদে পায়নি ? ... রাত হয়েছে | চলো তোমাকে খেতে দিই |”
আমি – “দাঁড়াও, আগে এতগুলো জামা ছাড়ি | তুমি এখানেই থাক, শুধু ইমার্জেন্সি বাতিটা নিভিয়ে দাও |”

আমি নিচে পরা বাড়ির শেমিজটা ছাড়তে ওপরের হাসপাতালের গাউনটা খুলতে চাইলাম | মাথার উপর কাপড়ে কাপড় জড়িয়ে গেল | জানালার আবছা আলোয় দেখলাম জিত এগিয়ে এলো আমায় সাহায্য করতে | আমার কাছে এসে ইতস্তত করছে কি, বাতি জ্বলে উঠল | জিত বিব্রত মুখে, “চলো, বাতি এসে গেছে | আমি বাইরে বসছি | তুমি কাপড় বদলে নাও”, বলে দরজা খুলে ব্যালকনিতে চলে গেল |

কিছুক্ষণ পরে আবার বাতি চলে গেল | জিত অন্ধকার ঘরে ফিরে এসে ইমার্জেন্সি বাতিটা না জ্বেলেই আমার খাবারটা বের করে বেড-টেবিলে দিয়ে বলল, “ইতি, প্রায় দশটা বাজে | আমি এবার গিয়ে মাসিমা কে পাঠিয়ে দিচ্ছি | তুমি খাবার সময় বাতিটা জ্বেলে নিও |”
আমি – “মা তো এখনো এলো না | তুমি এত তাড়াতাড়ি কেন যাবে ?”
জিত – “জানিনা | দেরী হয়ে গেছে | হয়ত কোনও বাস বা অটো পাব না | হেঁটে যেতে হবে | ভয় হচ্ছে যদি অন্ধকারে আমি পথ গুলিয়ে ফেলি | তাই আর দেরী করব না |”

জিত চলে গেলে অন্ধকারে আমি এক সম্পূর্ণ শূন্যতা নিয়ে বসে থাকলাম | জিত যখনই এইরকম অদ্ভুত কথা বলে আমি বুঝি ও কোনও অন্তর্দ্বন্দ্ব জয় করার চেষ্টা করছে | কিন্তু আমায় বলতে পারছে না, কেননা সেটা খেলা, না খেলার দ্বন্দ্ব নয় | কি নিয়ে দ্বন্দ্ব তাও হয়ত ও নিজে জানে না |

বাপি মামণিকে যখন দিয়ে গেল, তখন প্রায় এগারোটা বাজে | জিত তখনও বাড়ি পৌঁছায়নি |

০৯ নভেম্বর
জিত কাল সকালে চলে গেছে | যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করেনি | মামণি বলল ওকে বলেছিল ভাইফোঁটা কাটিয়ে যেতে | তাও থাকল না |

মামণি আরও বলল, “টুকু আসছে না দেখে বাপি ফেরার পর ওকে খুঁজতে গেল | কোথাও পেল না | টুকু অনেক রাতে এসে শুধু বলল ও পথ হারিয়ে গিয়েছিল | তারপর কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়ল | বাপি বলছিল, ছেলেটা খুব ইমোশনাল | কখন কি কথা নিয়ে ভাবে, কিছু বোঝার উপায় নেই | তোর কি মনে হয় ?” আমি মাকে কাল রাত্রের নার্সের রক্ত নেয়া, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরনোর কথা সব বললাম | বললাম, ওই রক্ত দেখে জিত কিভাবে স্থাণু হয়ে গিয়েছিল | মা বলল, “এতো আমারই ভুল | টুকু কি তাই পারে এই সব হাসপাতালের ঝক্কি সামলাতে ?”

ডাক্তার ঝা বাপিকে সন্ধ্যায় দেখা করতে বলেছে | আমার বিলিরুবিন অনেক কম | মনে হয় কাল ছেড়ে দেবে | বাড়ি গিয়ে আগেই জিতকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করব, সেদিন ও কেন বাতি জ্বললে অত বিব্রত হয়েছিল, যেন কোনও অচেনা মেয়ের কাছে এসে পড়েছে | হটাত আসা আলোয় আমি কি অচেনা হয়ে গিয়েছিলাম সেই এক মুহূর্তের জন্য ?
 





দেয়ালি, ২০০৭
ইতি,
         তখনকার অনেক কিছু কথাই আমার মনে নেই, এখন তোমার ডায়েরির লেখা পড়ে তার কিছু কিছু মনে পড়ছে | তবে, জানি না কোন অলিখিত কথার তুমি উল্লেখ করেছ |

         আমার একটা কথা তুমি লিখনি, কেননা তোমার জানার কথা নয় |

         প্রথম দিন তোমার রুগ্ন চেহারা হাসপাতালে দেখে আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম | আমার মনে তুমি সব সময় ছোটবেলার ঝিলিক – টুকটুকে চেহারার | আর হাসপাতালের গাউনে তোমায় দেখলাম যেন একটা ডুবন্ত জাহাজের ভেঙ্গে পড়া মাস্তুলে একটা প্রাণহীন পাল ঝুলছে | কি ভাবে কাটল পরের দিনগুলো | খালি মনে হত বিধ্বস্ত তোমাকে জড়িয়ে ধরে কোথাও নিয়ে যাই, কোনও এমন জায়গায় যেখানে গেলে সব অসুখ সেরে যাবে, তোমার হাসি ফিরে আসবে, আবার আমরা ছোটবেলার খেলায় ফিরে যাব | কত অছিলা করলাম তোমাকে ধরার, কিরুকিবু করে, গাল থেকে তোমার চুল সরিয়ে, তোমার হাত আমার হাতে নিয়ে গরম করে | তোমার হাঁটুতে গরম চাদর রাখতে গিয়ে মনে হল ওটাতে তোমাকে জড়িয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিই |

         কিন্তু কি ছিল এই ভাবে চাওয়ার মধ্যে, সাথে সাথে মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জাগল – এভাবে তোমাকে পাওয়া কি ঠিক ? কে বলে দেবে, আমি কোন পথে চলেছি ? নাকি পথে চলতে চলতে পথ হারাচ্ছি ?

         তখন শুধু তোমার চোখ দেখে মনে হয়েছে ওই আমার কম্পাস, আমায় এই অন্তর্দ্বন্দ্ব অন্ধকারে পথ দেখাবে |

         দেয়ালির দিন সন্ধ্যায় যখন তোমার কাছে যাব বলে বেরচ্ছি, মাসিমা জানতে চাইল, “টুকু, তুমি ভাইফোঁটা অব্দি থাকবে ?” মেসোমশাই বলল, “কিন্তু, ঋহা তো হাসপাতালে, কি ভাবে ফোঁটা দেবে ?” আমি বললাম, “দেখি |”

         আমার মনে কথাটা ঘুরতে থাকল | হাসপাতালে এসে তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে চাইলাম, কিন্তু কি ভাবে প্রশ্নটা সাজাব, কি শব্দে, কি কথায় ? একদিকে মন ছুটে যাচ্ছে তোমাকে ছুঁতে, অন্যদিকে তোমাকে হারানোর বিভ্রান্তি | রোজকার অন্ধকারে মনে হত পথ হারাচ্ছি তোমার কাছে যেতে যেতে | চাইতাম, যদি তোমার চোখের আলোয় একটু কোনও পথের ইঙ্গিত দেখতে পাই |

         আমার মনে হয় আমার সেদিনের দৃষ্টিতে কিছু ছিল যা ওই নার্সটাকে বিচলিত করেছিল | না হলে তোমার রক্ত নিতে গিয়ে ওর হাত এত কাঁপল কেন ? যখন ফিনকি দিয়ে তোমার রক্ত বেরল, আমি মরমে মরমে মরলাম | মনে হল আমার জন্য তোমার সব রক্ত কালো হয়ে গেছে | তাও তোমাকে ধরা-ছোঁয়ার ইচ্ছায় আমি লাগাম লাগাতে পারলাম না | তুমি যখন রিসেপশন থেকে কেবিনে ফিরে জামা খুলতে গিয়ে পারলে না আমি এগিয়ে গেলাম তোমাকে সেই সুযোগে ছুঁতে | তখনই বাতি এলো, আর দেখলাম তোমার শুকিয়ে যাওয়া শরীর, যার স্নেহ দরকার, স্পর্শ নয় |

         আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ভাবলাম কোথায় যাব ? কাকে শোনাব আমার পাগল করা সব প্রশ্নের কলরোল ? মনে পড়ল একবার ঠাকুমা বাবাকে বলছিল, আমি শুনেছিলাম, যে পাপবোধ হল কামনাকে গ্রাহ্য করার স্পর্ধার অভাব | এই সবই ভাবতে ভাবতে অনেক, অনেক সময় ধরে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে, আকাশের তারা দেখে পথ খুঁজে পেতে পেতে, বাড়ি ফিরলাম, তোমার মনের কাছে যাওয়ার পথ হারিয়ে |

         জানো, সেই রাত্রে আমি শপথ নিয়েছিলাম আমি আর তোমাকে ছোঁব না, আর তোমার স্পর্শও আমার অকাম্য হবে |

         এখন ভাবি কত শিশুসুলভ কথা ভেবেছিলাম তখনকার অপরিণত বুদ্ধিতে | কিন্তু, তাই পরদিন আমি সকালে উঠে রওনা দিলাম বাড়ি ফিরতে | এই ভেবে নয় যে থাকলে তুমি আমায় ফোঁটা দেবে | এই ভয়ে যে ফোঁটা দিতে গিয়ে তুমি আমায় ছোঁবে | আর আবার তোমাকে ছোঁয়ার লোভ আমাকে পেয়ে বসবে |

         এতদিন পরে তোমাকে এইসব কথা বলে জানিনা আমার মন হালকা হবে কিনা, আর তোমারই বা কি মনে হবে | কিন্তু, যত দিন গিয়েছে, জেনেছি আর বুঝেছি, সেই কদিন তোমাকে যতই ছোঁয়ার কামনা করে থাকি, কোথাও তারই মধ্যে সেই ছোটবেলার নির্দোষ খেলার সম্পর্কের একটা আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে ছিল – তোমার সংস্পর্শ পাওয়ার, তোমার শরীরটা ছোঁয়ার নয় |

         অনেক ভেবেছি, তোমাকে কি তোমার শরীর থেকে আলাদা করে চাওয়া যায় ? আর সেভাবে পেলে, কিভাবে তোমাকে ছোঁব ? আসলে আমরা ভালবাসার একটাই ভাষা জানি বোধহয়, যার সব কথা শারীরিক |

         তাও সেদিনের মনোভাব তোমাকে জানাচ্ছি এই নিচের লাইন গুলোয়, সেদিন বাড়ি ফিরে সারা রাত জেগে লেখা,


                         আদিগন্ত, অফুরন্ত এই আঁধার, কি করাল ধাঁধা
                         তৃষার্ত চাতক আমি, আলোর মরীচিকায় বাঁধা
                         হাতড়ে তোমায় খুঁজি, না পেয়ে আমার সমীপ
                         আঁধারে দৃষ্টিহীন হয়ে করি তোমার দূরত্ব জরিপ

                         জ্বালাও না কেন তুমি হাজার দীপের দিয়াড়ি ?
                         যোগাও আমায় সামর্থ্য, দিতে এই ব্যবধান পাড়ি
                         আলোর বলয়ে তোমার কালো দু’আঁখির প্রভা
                         আমার হৃদয়ে ভরাবে তার নম্র কবোষ্ণ আভা
                         চোখের তারার আলো তার কটাক্ষে, ইঙ্গিতে
                         দেখাবে পথ যা হারিয়েছে আকাশের তারাতে

                         কোথায় সেই পথ, যা খুঁজেছি আমি এতকাল ?
                         আঁধার বিছিয়ে ছিল সে তার অলীক মায়াজাল
                         উপরে মহাকাশে দেখে তা তারার নীহারিকায়
                         হয়েছি পথভ্রান্ত আমি পৃথিবীতে, অন্ধ, একাই

                         এখন জ্বললে প্রদীপে প্রদীপে আলোর আলেয়া
                         লেলিহান শিখায় লুকিয়ে শ্যামার আমরণ-মায়া
                         আসবো আমি ছুটে, তখন তুমি দেখিও আমায়
                         পথ বিছিয়ে আছ বসে, তোমার চোখের তারায়

                         এই পথ কি সেই পথ যা ফেলে এসেছি পিছে ?
                         এই পথ কেন তবে ভুলে ঘুরেছি মিছে মিছে ?
                         এখন দেখি যে দুই কালো চোখের দৃষ্টি ধরে
                         পথ চলে যেতে গেছে হারিয়ে শরীরে গভীরে
                         তার যে ধমনীতে বহে যায় শোণিতাক্ত ধারা
                         আমার পথ সেই নাড়িতে শুরু, তাতেই সারা

                         দুয়ার-কপাট অকপট চোখের মনিতে খোলা
                         আলেয়া আলোর শিখারা তাতে করে খেলা
                         আলোর চাতক আমি, নিয়ে পিপাসা শিখার
                         করি আকণ্ঠ পান সব আগুন, বুকে দীপিকার

                         আমি ভেবেছিলাম আলেয়া শিখায় নেই উত্তাপ
                         শুধু লাগে পোড়াতে প্রেমে সুপ্ত কামনার পাপ
                         তা যদি হবে তবে কি ভাবে এই আকণ্ঠ পিপাসা
                         কামনার বুকে লুকানো এক ভীরু ভাবুক আশা
                         খুঁজে পাবে পথ দেয়ালির আলোর আলেয়ায় ?
                         শরীরে না খুঁজে, আমি পাব কোথায় তোমায় ?

         আশা করি এতে তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর পাবে |
         ভালো থেক |
- জিত






দেয়ালি, ২০০৭ 
জিত,
         যে কথা তোমায় লিখিনি, আমার ডায়েরিতেও লেখা নেই |

         কালীপূজোর আগের দিন শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম আমার অসুখটার একটা ভালো দিক আছে | যতদিন অসুখ থাকবে তুমি আমার কাছে থাকবে, ছুটি ফুরিয়ে গেলেও হয়ত | মামণি জিজ্ঞাসা করেছিল, “জিত কে কি ভাইফোঁটা অব্দি থাকতে বলব ? ও অবশ্য কবে বাড়ি ফিরবে তা কিছু বলছেনা | কিন্তু আমি ভাবছি আগে জানা থাকলে সময়ে ব্যবস্থা করতাম | তুই কি বলিস ?”

         আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, “মামণি, আমি জানিনা |”

         মামণি তখন একটা কথা বলেছিল, যা আমার এখন মনে পড়লে মনে হয় তখন কেন বুঝিনি | বলেছিল, “দেখ, যাত্রা যবেই কর না কেন, যাত্রার প্রস্তুতি অনেক আগেই করতে হয় | নাহলে যাত্রার সময় এসে চলে যায়, মানুষ পা ফেলে এগোতে পারে না |”

         তুমি কি যাত্রায় প্রস্তুতি সেই সময়েই করেছিলে ? তা না হলে পথ কেন খুঁজছিলে আমার মধ্যে ?

- তোমার ইতি



                                                                                                                    দেয়ালি, ২০০৭

 
ইতি,


        হয়ত, আমি খুঁজছিলাম পথ – গন্তব্য ঠিক না করে, আর তুমি খুঁজছিলে গন্তব্য – পৌঁছানোর পথ আছে কি নেই না জেনে |        জীবনযাত্রাটা বোধহয় একটা গন্তব্য হীন, পথ হীন আলেয়া |

- জিত 





--->X<---

কোন মন্তব্য নেই: