রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৩

সম্মোহন

দশ বছর এক সাথে বাস করে পারুলের আর আমার বিচ্ছেদ হয়ে গেল | প্রেম করার সময় ধরলে, আমাদের সম্পর্ক বাইশ বছরের | আমার যখন বারো আর পারুলের দশ, তখন ভালো লাগা থেকে শুরু হয় এই যুগ্ম জীবন | কলেজে উঠে আবিষ্কার করলাম যে দুজনে যা করতে চাই, বা বলতে গেলে, জীবন থেকে যে যা যা পেতে চাই তার জন্য একে অপরের অপরিহার্য পরিপূরক | অতএব অদম্য প্রেম, আকাঙ্ক্ষা, উভয়ের যৌথ চাহিদা মেটান | এই সব করতে করতে চব্বিশে বিয়ে করলাম | প্রথম লক্ষ্য কর্মক্ষেত্রে নিজেদের স্থাপন করা, তারপর সংসার | পারুল এম এ করে কলেজে ঢুকল | আমি ম্যানেজমেন্ট পাশ করে একটা ভালো কাজ পেলাম | সাতাশে পড়ে, চাকরিতে সুস্থিত হয়ে, মন বসল সংসারের পাটে - সংসার গড়তে |

কিন্তু সংসার যে টুকু সেই টুকুই রয়ে গেল | আত্মীয় স্বজনের নানা রকমের মন্তব্য ও উপদেশ শুরু হল | ডাক্তার দেখিয়ে কিছুই ধরা পড়ল না | পারুলের কোনও দোষ নেই, আমারও স্বাস্থ্য অটুট, পারস্পরিক আকর্ষণ অক্ষুণ্ণ | অথচ কোনই ফল নেই | সেই নিয়ে শুরু দুজনেরই নানারকম অভাব বোধ এবং অভিযোগ – আর তার থেকে খিটখিট করা অশান্তি | শেষে পারুলের আত্মীয় স্বজনের আর আমার বন্ধুদের কথায় গত কার্তিকে, পুজোর পরে, আমরা আইনত বিবাহ বিচ্ছেদ নিলাম |

ছাড়াছাড়ি হলে প্রথম দিন পারুল চলে গেল দাদার কাছে, কিছুই জিনিস না নিয়ে | তারপর একদিন দাদা, বৌদিকে সাথে নিয়ে এসে তিনজনে তিন স্যুটকেস ভরে কাপড় জামা, প্রসাধন আর পড়ার বই খাতা নিয়ে গেল | বাকি জিনিস রয়ে গেল | ওরা বেরনোর সময় আমি খাবার টেবিলে বসে রইলাম | ওর দাদা কিছু বলতে এসে শুধু আমার হাত ঝাঁকিয়ে চলে গেল | একটু পরে পারুল এসে বলল, “আমার বাকি জিনিস গুলো কাউকে দিয়ে দিও বা ফেলে দিও | জমিয়ে রেখ না |” আমি উত্তর না দিলে বলল, “আর, যদি ... সত্যি কোন দরকারের কথা থাকে তো ফোন করতে পার |” ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা অনুভব করে একবার ইচ্ছে করল ওর মুখটা দেখি, কিন্তু এও মনে হল যে তার সময় চলে গেছে | বিদায় স্বীকার করে নিচে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ | এবার এসো |”

কিছুদিন পারুলের ছেড়ে যাওয়া জিনিস গুলো রেখে দিলাম, যাতে ঘরটা একেবারে ফাঁকা না হয়ে যায় | মনে হতে থাকল যে ওদের মধ্যে লুকানো যে পিছুটানের চুম্বক আছে সেটা হয়ত চলে যাওয়া সময়টাকে আবার গুটিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারবে | কিন্তু দিনকে দিন বেওয়ারিশ জিনিসগুলো নিঃস্বতর হতে থাকল | একদিন দেখলাম পারুলের পুরনো সেতার, যেটা বিয়ের পর কোনোদিন বাজিয়েছে বলে মনে করতে পারলাম না, ধুলোয় ভরে গেছে, কয়েকটা তার ছিঁড়ে গেছে | সেদিন ওটাকে একটা বাজনার দোকানে দিয়ে আসলাম | ভাবলাম এই ভাবে একে একে পারুলের সব জিনিস বিদায় করে দিলে বাড়িটা খালি হয়ে অতীতের খোলস খসিয়ে একটা নতুন অস্তিত্ব পাবে | আমি আবার পথে বেরিয়ে মাথা উঁচু করে চলার শক্তি পাব | কিন্তু জানি না কী দুর্বলতায়, না অন্য কোন কারণে, আর কিছুই জিনিস ফেলা হল না | ধুলোর কী এক দুর্বোধ্য আকর্ষণ বাড়িটাকে একটা চলে যাওয়া সময়ের মোচড়ে আটকে একটু একটু করে আমাকে সম্মোহিত করতে লাগল |

অফিসের কাজ একাকীত্ব থেকে কিছুটা রেহাই দিলেও, স্টেশন আর বাড়ির মধ্যে হেঁটে যাওয়া আসার নিঃসঙ্গতাটা কিন্তু কিছুতেই কাটল না | জীবনের অনেক অতিরিক্ত সময় ছাঁটলাম অফিস যাওয়ার সময় বা অফিস থেকে ফিরে স্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে নির্লিপ্ত হয়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোকজন আর লোকালের ব্যস্ততা দেখে | একদিন একজন ঝাড়ুদার অনেকক্ষণ আমার বসার জায়গাটা বাদ দিয়ে ঝাঁট দিতে দিতে আমায় শেষে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন ?” আমি বাধ্য হলাম উঠে পড়ে বলতে, “করছিলাম ... তবে মনে হচ্ছে সে আর আসবে না |”

সকালের হাওয়ায় ঠাণ্ডা ভাব শুরু হলে আমাকে একটা বেঞ্চ খুঁজতে হল যাতে ওই সময় রোদ পড়ে | আমার প্ল্যাটফর্মের এক প্রান্তে সেরকম একটা বেঞ্চ পেলাম, সব কিছু থেকে এত দুরে যে সকাল আটটা, সাড়ে আটটা অব্দি ওটা ফাঁকা পড়ে থাকে | রোজ বাড়ি থেকে আটটার আগেই বেরিয়ে গিয়ে ওটা দখল করতে শুরু করলাম | তারপর অন্তত ন’টা – সাড়ে ন’টা অব্দি বসে দেখা কী ভাবে আস্তে, আস্তে প্ল্যাটফর্ম ভরছে | শেষে খুব ভিড় হয়ে গেলে, আর অফিসে দেরী হওয়ার অস্বস্তিটা শুরু হলে উঠে আমার লোকাল ধরা | ঠিক যে ভাবে আগে পারুল আর আমি রোজ আটটার আগে স্টেশন গিয়েছি – ও সোয়া আটটায় লোকাল ধরেছে, আর আমি বসে বসে কাগজ পড়ে ন’টায় | পার্থক্য বলতে এই যে এখন প্রায়ই ন’টার লোকালটা ছেড়ে দিই, ভিড়ের ঘনিষ্ঠতা অসহ্য লাগে বলে | কাগজ আর পড়তে পারি না | শুধু বসে বসে ভাবি, কখনো কি কোনও ভাবে পারুলের সাথে দেখা হতে পারে ? তাই হলে ... ? আর, মাঝে মাঝে এই প্রশ্নটা আমাকে জ্বালায় – একদিকে সংসারের মোহ আর অন্য দিকে বাইশ বছরের অভ্যাস – কোনদিকের ভারটা বেশি ?

এই ভাবে না শান্ত, না অশান্ত এক মাস কেটে গেল | নভেম্বরের মাঝামাঝি – শীত মোটামুটি নেমেছে – একদিন আমার বেঞ্চের কাছে গিয়ে দেখি তাতে একজন মহিলা বসে আছে | পাশে বসা উচিত হবে কিনা ভাবছি, মহিলা উঠে দাঁড়াল | গায়ে মোটা গরম চাদর, যেটা মাথার পিছনে ঘোমটার মত করে একটু তোলা | তার নিচে মাথার চুল একেবারে অবিন্যস্ত, আর শাড়িটা সর্বাঙ্গে কুঁচকে আছে | আমার উপস্থিতি বোধ করে আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো | সেই এক দৃষ্টিতে মুখটা দেখে মনে হল বয়েস পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে হবে | রোগা শরীরটা মাঝখানে একটু ভারী | মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের স্যুটকেসটা তুলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েই ওটা নামিয়ে আবার আমার দিকে তাকাল | তারপর আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে বলল, “আপনার ট্রেন কি এখনই ?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না, দেরী আছে |”
মহিলা – “তাহলে আপনি আমার স্যুটকেসটা একটু দেখবেন ? আমি যাব আর আসব |”
আমি – “আপনি কতদূর যাবেন ? দেরী হবে ?”
মহিলা – “বেশি দেরী হবে না, বড় জোর মিনিট দশেক |”
আমি – “ঠিক আছে, যান |”

মহিলা স্যুটকেসটা বেঞ্চের উপর তুলে রেখে চলে গেল | আমি দেখলাম স্যুটকেসটায় তালা নেই | দুটো গা-তালার একটা ঠিক করে বন্ধ অব্দি করা নয় | আউটারে দাঁড়ান একটা লোকাল হর্ন  দিয়ে নড়ল ঢোকার জন্য | আমার প্ল্যাটফর্মে ওটার জন্য অপেক্ষারত যাত্রীরা চঞ্চল হল | আমি বেঞ্চে বসে পড়ে হাত বাড়িয়ে স্যুটকেসটা নিজের যথাসম্ভব কাছে টেনে এনে রাখলাম |  চোখে পড়ল হ্যান্ডলের নিচে লেখা নাম ঠিকানা, ‘শেফালী দত্ত, ২০/এ পাওয়ার সাপ্লাই লাইন, আরামবাটী - ৭’ | দৃষ্টি সরিয়ে অলস চোখে যাত্রীদের মধ্যে শুরু হওয়া ব্যস্ততা দেখতে মন দিলাম | লোকালটা এসে সামনে দাঁড়িয়ে একদল যাত্রী উগরে আর এক দল যাত্রী শুষে উল্টো মুখে রওনা হল | গাড়িটা, আর নেমে যাওয়া প্যাসেঞ্জারদের ভিড় সরে গেলে দপ করে একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার দমকা ধাক্কা লাগল | বুকের উপর হাত গুটাতে গিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে মনে হল মহিলা যাওয়ার পর প্রায় পনের মিনিট কেটে গেছে | এমন সময় দেখলাম মহিলা আসছে মন্থর গতিতে, হাতে কাগজ, কলম | কেন জানি না তার চলার ভঙ্গি আর হাবভাব দেখে মনে হল সে অনেকদিন ঘুমায় নি আর নিজের কোনরকম যত্ন নেয়নি |

মহিলা এসে স্যুটকেসের ওপাশে বসে, কাগজটা হাঁটুর উপর রাখল | খানিকক্ষণ তার উপর কলমটা ধরে থেকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার কাছে পেন আছে ? আমার পেনের রিফিলটা মনে হচ্ছে শেষ হয়ে গেছে |”
আমি কিছু না বলে আমার কলমটা বের করে এগিয়ে দিলাম | দিতে গিয়ে চোখ চলে গেল মহিলার পায়ের দিকে | দেখলাম পায়ের ফ্যাকাসে, শুকনো দুটো পাতা | আবার মনে হল মহিলা অনেক দিন নিজের কোনরকম যত্ন করেনি | নিজেই নিজের এই অনুসন্ধিৎসায় বিরক্ত হয়ে মহিলার দিক থেকে দৃষ্টি সরাতে গিয়ে দেখলাম সে কাগজটার উপর লিখছে | একটু পরে কলমটা ফেরত দিয়ে বলল, “ধন্যবাদ |” আমি কলমটা নিয়ে পকেটে রাখলাম | ততক্ষণে উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে একটা লোকাল এসেছে, ওদিকে ব্যস্ততা শুরু হয়েছে | আমি পারুলকে আবিষ্কার করার আশায় মন দিলাম |

খানিকক্ষণ পরে মনে হতে লাগলো এভাবে এই মহিলার সাথে কতক্ষণ বসা যায় | আমি উঠে চলে যাব ভাবছি কি ও বলল, “আপনি আর একবার স্যুটকেসটা রাখবেন, যদি আপনার তাড়া না থাকে ?” আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “না, তেমন কোনও তাড়া নেই | আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি | আপনি যান |” মহিলা উঠে এগোল | কুড়ি মিনিট মত পরে ফিরে এলো সেই একই ভাবে | বসে পড়ে আবার হাতের কাগজটা হাঁটুর উপর মেলে রাখল | কৌতূহল চাপতে না পেরে আড়চোখে দেখলাম সেটা একটা হাতে ভরা টেলিগ্রামের ফর্ম | মনে হল ওটাই পাঠানোর জন্য গিয়েছিল |

একটু পরে মহিলা আমাকে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা বলতে পারেন, এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের টেলিগ্রাম অফিসটায় কি সব সময় লোক থাকে না ?”
আমি – “তা তো জানি না |”
মহিলা – “এই নিয়ে দু’বার গেলাম | প্রথম বার টেলিগ্রাম ফর্মটা ভরতে গিয়ে পেনের কালি শেষ হয়ে গেল | তাই দেখে সেই যে লোকটা ‘আসছি’ বলে কোথায় চলে গেল, আর পাত্তা নেই | বুঝতে পারছি না আমার ট্রেন আসার আগে এটা পাঠাতে পারব কি না |”
আমি – “আপনার ট্রেন কটায় ?”
মহিলা – “আগে বলেছিল এক ঘণ্টা লেট আছে | কিন্তু এই বলল মৌরিপাড়া ছেড়েছে | তাহলে আর পনের মিনিটে এসে পড়বে | একবার ট্রেনে উঠলে তো আর না নামা অব্দি টেলিগ্রামটা পাঠাতে পারব না | তাহলে আজ আর হবে না | অথচ, আজই একটা খবর না পেলে বাড়ির লোক চিন্তা করবে | কী যে করি ?”

আমি চুপ করে থাকলাম | একটু পরে মহিলা বলল, “আপনি তো কারোর জন্য অপেক্ষা করছেন, তাই না ?”
আমি – “এক রকম তাই | কেন বলুন তো |”
মহিলা – “তার কত দেরী আছে ?”
আমি – “ঠিক জানিনা, গাড়ি তো বলছে লেট ...”
মহিলা – “যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি স্টেশন থেকে বেরোবার সময় টেলিগ্রামটা করে দিতে পারবেন, আমি যদি আপনাকে ফর্মটা আর টাকা দিয়ে দিই ?”
আমি – “কিন্তু আপনি তো বললেন এখন কাউন্টারে লোক নেই |”
মহিলা – “যদি দেখেন তখন লোক আছে, তাহলে ?”
আমি – “আপনি যাকে টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছেন, তাকে ফোন করা যায় না ?”
মহিলা – “সেখানেই মুশকিল | বাড়ির ফোন কতো দিন হল ডেড হয়ে আছে |”
আমি – “বাড়িতে কারো মোবাইল নেই ?”
মহিলা – “বাবার আছে, কিন্তু বয়েস হয়েছে | অজানা নম্বর দেখলে তোলে না |”
আমি – “ওহ ! আপনার মোবাইল ... ”
মহিলা ম্লান হেসে বলল, “দুর্ভাগ্য কি একা আসে ? আমার মোবাইলের চার্জার খুঁজে পাচ্ছি না |”
আমি – “আমার মোবাইলটা দেব ?”
মহিলা – “বললাম তো, বাবা মোবাইলে নামের বদলে নম্বর দেখলে তুলবে না | ... ভোর থেকে আমি এই নিয়ে চেষ্টা ... ”
আমি – “ওহো | ... তাহলে তো টেলিগ্রাম ছাড়া উপায় নেই | কিন্তু, কত লাগবে কে জানে ?”
মহিলা – “আমি তো একবার টেলিগ্রামটা দেখিয়েছি | দেখে কত টাকা লাগবে হিসেব করে কাউন্টারের লোকটা কাটাকুটি বাদ দিয়ে পরিষ্কার করে লিখতে বলে সরে গেল | ... আমি না হয় আপনাকে টাকা দশেক বেশি দিয়ে দেব |”
আমি – “না তার দরকার হবে না | হলে এক দু’ টাকা এদিক ওদিক হবে | সে আমি দেখে নেব | কিন্তু, আমি ...”

কথা শেষ হবার আগেই দেখলাম মহিলার মুখে হতাশার ছায়া পড়ল | ঘনিয়ে আসা কোনও অজ্ঞাত বিপাকে জড়িয়ে পড়ার আশংকাটা দূরে সরিয়ে বললাম, “আচ্ছা, দিন টেলিগ্রামটা |”

মহিলা আমাকে কাগজটা ভাঁজ করে দিল, আর কিছু টাকা দিল | তারপর মিনিট দশেক পরে একটা ঘোষণা শুনে উঠে  দাঁড়িয়ে বলল, “আমি এবার এগোই | আপনাকে অনেক ধন্যবাদ |”

তাকিয়ে দেখলাম মহিলার ক্লান্ত চেহারায় কালি পড়া দুটো কালো চোখ গভীর কৃতজ্ঞতায় ভরে গেছে, আর ঠোঁটে একটা বিব্রত হাসি | মহিলা চাদরটা খুলে ঠিক করে জড়াতে গেলে দেখে সন্দেহ হল ও কি অন্তঃসত্ত্বা ? তারপর মহিলা স্যুটকেসটা তুলে নিয়ে এগোতে লাগলো | আমার কী মনে হল, আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওকে নমস্কার করে, আবার বসে পড়ে, ভাবলাম আমার লোকালটা ধরে অফিসে পৌঁছে লোক পাঠিয়ে টেলিগ্রামটা করে দিলেই তো হয় |

ন’টা চল্লিশে ঘোষণা করল আমার সাড়ে নটার লোকালটা বাতিল হয়ে গেছে | জমে আসা ভিড় দেখে আমার আর ইচ্ছা করল না বসে থাকতে | বরঞ্চ টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে দেয়ার একটা তাগাদা অনুভব করলাম | উঠে গিয়ে দেখি টেলিগ্রাম কাউন্টারে একটা বুড়ো লোক বসে আছে | জানালা দিয়ে ফর্মটা দিলাম | লোকটা এক নজর দেখে নিয়ে ফর্মটা ফেরত দিয়ে বলল, “আরে মশাই, বাক্যগুলোর মাঝখানে দাঁড়ির বদলে স্টপ লিখতে হয় |”
আমি – “যে ভাবে লেখা আছে সে ভাবেই পাঠানো যায় না ?”
লোকটা – “যাবে না কেন ? কিন্তু বাবা, স্টপগুলোর জন্য তো আর পয়সা লাগে না | বরঞ্চ লিখলে, যে টেলিগ্রাম পাচ্ছে তার পড়তে সুবিধা হয় | লিখবেন তো লিখুন, না হলে দিন, আমি এমনি পাঠিয়ে দিচ্ছি |”
আমি – “না, না | আমি ঠিক করে লিখে দিচ্ছি |”

একটু আশ্চর্য লাগলো যে মহিলা বলেছিল এই ফর্মটা একবার দেখানোর পরে আবার করে ভরা | ও কি সত্যি টেলিগ্রামটা দেখিয়েছিল ?

টেলিগ্রামটা পড়ে দেখি ইংরেজি হরফে বাংলা শব্দে লেখা “আমার জন্য চিন্তা করবে না | আমি কোথাও পৌঁছেই যাব | যার জন্য আর যার সাথে বেরিয়েছি সেই জন আমার ভরসা | তোমরা ভাল থেক |” কথাগুলো এত ঘন করে লেখা যে ওর মাঝে স্টপ লেখা সম্ভব নয় | আমি একটা নতুন ফর্ম নিয়ে নকল করে দাঁড়িগুলোর বদলে স্টপ যোগ করে ফর্মটা দিলাম টাকার সাথে | অভ্যাস মতো রসিদটা নিয়ে পার্সে রেখে দিলাম, পুরনো ফর্মটা না ফেলে দিয়ে |

এর পর ঘটনাটা ভুলেই গেলাম প্রায় | মনে করার মত তো কিছু ছিল না | খালি কখনও, এক আধ বার, কোথাও ওইরকম কোন ক্লান্ত, অবিন্যস্ত মহিলা দেখলে ঘটনাটা মনে পড়েছে |

শীত শেষ হয়ে এলো | মাঘের শেষে কদিন খুব বৃষ্টি হল | হিমালয়ে আবার বরফ পড়ে তার শৈত্যপ্রবাহ উত্তর ভারত থেকে এসে শীতকালের মেয়াদ বাড়িয়ে দিল | ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি বহরমপুর যেতে হল কাজে | সারাদিন কাজ করে বিকেলে হোটেলে ফিরে চা আনিয়ে বেয়ারাটাকে বখশিশ দিতে গিয়ে দেখলাম সব পাঁচশ টাকার নোট | একটা বের করলাম ওকে দেব খুচরো আনতে | তখন নজরে পড়ল নোট গুলোর পিছনে টেলিগ্রামের ফর্ম আর রসিদটা | বের করে ঠিকানাটা দেখে বেয়ারাটাকে জিজ্ঞাসা করতে বলল পাড়াটা কাছেই | রিক্সা নিলে দশ-বার মিনিটে পৌঁছে যাব | চা খেয়ে জামাটা বদলে বেরিয়ে পড়লাম |

বাড়িটা খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হল না, রাস্তা আর বাড়ির নম্বর চট করে মিলে গেল | রিকশাওয়ালাকে দাঁড়াতে বলে, বাড়ির ঘণ্টার বোতাম টিপলাম | একজন বয়স্ক চাকর দরজা খুলল | আমি বললাম, “হারাধন বাবু আছেন ? একটু ডেকে দেবে ওনাকে ?” বোধহয় আমার আওয়াজ শুনে ভেতর থেকে কেউ জিজ্ঞাসা করল, “কে ?” তারপর ভিতর থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলো, চোখে খুব মোটা চশমা | আমাকে সন্দিগ্ধ ভাবে জিজ্ঞাসা করল, “কে আপনি ? কী চাই ?”
আমি – “আমার নাম প্রবাল রায় | আমি বর্দ্ধমান থেকে আসছি | আপনি কি হারাধন বাবু ?”
উনি – “বর্দ্ধমান থেকে ? কেন ? আমাদের তো বর্দ্ধমানে কেউ নেই |”
আমি – “না, না | আসলে কিছুদিন আগে আপনার মেয়ের একটা টেলিগ্রাম আমি পাঠিয়েছিলাম |”
উনি – “আমার মেয়ের টেলিগ্রাম ... আপনি পাঠিয়েছিলেন ?”
আমি – “হ্যাঁ | মানে একজন মহিলা বর্দ্ধমান স্টেশনে আমাকে একটা টেলিগ্রামটা দিয়ে বলেছিল আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে | আমার মনে হয়েছিল যে সে আপনার মেয়ে |”
উনি – “আমি তো কিছুই বুঝছি না | ... সরমা, একটু এস তো |”
একজন মহিলা বেরলে তার চেহারা দেখে আমার আর সন্দেহ থাকল না যে আমার অনুমান সঠিক | বয়েসের তফাত বাদ দিলে দুজনের চেহারা প্রায় এক রকমের |

আমার অসংযত স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সহস্র প্রহর সময়ের দূরত্বে বর্জিত এক বিষাদ প্রতিমা | তার মুখময় ছিল শুধু দুটো বিষণ্ণ চোখ, যার পিছনে সে নিজের অপরিসীম রূপ লুকিয়ে বেদনার্ত মনের বাইরের রঙ্গভূমিতে নিজেকে হারাতে পারে |

সম্বিত ফিরে পেয়ে আমি বললাম, “আপনারা নভেম্বরের মাঝামাঝি শেফালী, মানে আপনাদের মেয়ের কাছ থেকে কোনও টেলিগ্রাম পাননি ?”
মহিলা – “শেফালী ? আমাদের মেয়ের নাম তো শেফালী নয় |”
আমি – “কিন্তু আমি তো তারই একটা টেলিগ্রাম এই ঠিকানায় পাঠিয়েছি | দেখুন তো এই কাগজটা |”
আমি পকেট থেকে টেলিগ্রামের ফর্মটা বের করে দিলাম |
মহিলা কাগজটা না নিয়ে বলল, “বাবা, তুমি বস তো | বসে বল কী হয়েছিল |”
আমি বসে সব ঘটনা বললাম | দুজনে চুপ করে সব কথা শুনল | তারপর মহিলা বলল, “তুমি বলছ বর্দ্ধমান থেকে তুমি এই ঠিকানায় টেলিগ্রাম করেছিলে | তাই না ? কিন্তু, সেরকম কিছু তো আমরা পাইনি | না, না, আমাদের কাছে ওরকম কোনও টেলিগ্রাম আসেনি |”
আমি – “কিছু মনে করবেন না | আপনাদের কথা শুনে মনে হল আপনাদের মেয়ে আছে |”
মহিলা – “ছিল | কিন্তু তার নাম শেফালী নয় | তুমি কোথাও কিছু ভুল করেছ | যাকগে, সে সব কথা | ... তুমি এখন এস |”
আমি বলতে চাইলাম, “আমি ভুল করিনি | যে আমাকে টেলিগ্রাম করতে দিয়েছিল তার আর আপনার চেহারা এক রকম |” কিন্তু আর কথা না বাড়িয়ে উঠে নমস্কার করে বেরিয়ে এলাম |

বাড়ি ফিরে ক’দিন এই হেঁয়ালি খুব মনের মধ্যে তোলপাড় করল | এক রাত্রে কেন ঘুম আসছে না কিছুতেই | হটাত চমকে উঠলাম যে যদি এই ভাবে স্যুটকেসে লেখা নাম আর ঠিকানাও সেই মহিলার না হয় ? তাহলে তো আমার কাছে তার আর কোনও সূত্রই থাকল না | পরদিন অফিসে চা খেতে খেতে অজিতকে সব খুলে বললাম | সব শুনে অজিত একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তুই তো এত সব ঘটনার কথা আগে কোনোদিন বলিসনি |”
আমি – “না, তা বলিনি |”
অজিত – “তুই কি ভেবে চিন্তে কথাগুলো চেপে গিয়েছিলি ?”
আমি – “জানি না |”
অজিত – “জানিস না মানে ?”
আমি – “মানে ... পারুল চলে যাওয়ার পর আমার এই প্রথম কোনও অচেনা মহিলার সাথে সংযোগ | সেই জন্যে হয়ত অজান্তে ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিলাম |”
অজিত – “ও !”
আমি – “শুধু একটা ‘ও’ ! আর কিছু বলবি না ?”
অজিত – “তুই কী শুনতে চাস ?
আমি – “আমি কেন কিছু চাইব ?”
অজিত – “আচ্ছা ? ভেবে দেখ তো, কেন তুই আমার কাছে কথা তুললি | হয় তুই অজান্তে কিছু চাইছিস, আর অবচেতনে ভাবছিস কাউকে কথাগুলো বলতে গেলে সেটা কী, তা পরিষ্কার হবে | নয় তো, তুই ভাবছিস তোর কথা শুনে যদি কেউ কিছু প্রস্তাব করে | ... কোনটা ঠিক ?”

আমি চুপ করে থাকলে অজিত বলল, “তোর মাথায় কিছু একটা কথা ঘুরছে | কী সেটা ?”
আমি – “তোকে বললাম না মহিলা অন্তঃসত্ত্বা ছিল | কে জানে, যেখানে যাচ্ছিল সেখানে কী অবস্থায় পৌঁছল | কেন জানি না, ওর ক্লান্ত চেহারাটা মনের মধ্যে কোথাও আটকে আছে, গলায় কাঁটার মত |”
অজিত – “দেখতে কেমন ?”
আমি – “অজিত ! শুধু মহিলাটার চোখ দুটো মনে আছে, ভীষণ স্যাড্ | ওই দেখে আর কিছুই লক্ষ্য করিনি, বিশ্বাস কর |”
অজিত – “ও, করুণা-দৃষ্টি ! বুঝেছি |”
আমি – “হয়ত তাই ... হয়ত তাই |”
অজিত – “হুম ....
বিনিদ্র রজনীর মসী-লাঞ্ছিত আঁখি, তমাল সারি বেষ্টিত জোড়া পুষ্করিণী,
প্লাবিত | হেন অশ্রুতে ভাসে কৃষ্ণ অক্ষিতারকা, ব্যগ্র আবেদনের তরণী,
ত্রাসিত | ...”

আমি – “খুব হয়েছে | চল, এবার ওঠা যাক ...”

অজিত কয়েকটা জোর টান দিয়ে সিগারেটটা শেষ করল | তারপর বেয়ারাকে ডেকে বলল আরও দু’কাপ চা দিতে | চা এলে অজিত বলল, “তুই বলছিলি না ওর স্যুটকেসে নাম ঠিকানা লেখা ছিল ?”
আমি – “হ্যাঁ | শেফালী দত্ত, ২০/এ পাওয়ার সাপ্লাই লাইন, আরামবাটী – ৭ |”
দেখলাম অজিত হটাত একটা মুচকি হাসি হাসল | তারপর বলল, “অদ্ভুত তো !”
আমি – “কী ?”
অজিত – “ঠিকানাটা ! ওই যে বললি, ‘কুড়িয়ে পাওয়ার’ কী সব, কী সব |”
আমি – “ও, তা তো আমি লক্ষ্য করিনি | ... যাকগে, তুই ঠিকানাটা জানতে চাইলি কেন ?”
অজিত – “বন্ধু হে ! তুমি যদি বহরমপুর যাইতে পারিলে তো একবার আরামবাটী কেন যাইতেছ না ?”
আমি – “এ কী বলছিস তুই ?”
অজিত – “আমি নহি, বন্ধু, তুমি ! মুখে না প্রকাশ করিয়া মনে মনে যাহা চাহিতেছ, আমি তাহাই কহিয়াছি, মাত্র |”
তারপর চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “শোন ! এই শনি, রবিবার যা, অ্যাডভেঞ্চার করে আয় | আরামবাটী ঘুরে আয় |”

বাড়ি ফিরে দেখলাম অজিতের প্রস্তাবটা তখনো মনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আমাকে ক্রমাগত জাগরূক করার চেষ্টা করছে | ঘুম আসার আগে মনে পড়ল অজিতই আমার এক মাত্র বন্ধু যে পারুলের সাথে বিচ্ছেদ হওয়াটা সমর্থন করেনি | হয়ত ওরই কথা আমার শোনা উচিত ছিল | এখন কি ওর কথা আমার শোনা উচিত নয়, অন্তত এই একবার ?

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল, এলার্ম বাজার আগেই | উঠে দাঁত মেজে যান্ত্রিক ভাবে ব্যাগে টুথব্রাশ, পেস্ট, চিরুনি, পায়জামা এইরকম সব একদিনের জিনিস ভরে নিয়ে ছুটে গিয়ে ছ’টার আরামবাটী এক্সপ্রেস ধরলাম | আরামবাটীর এক সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করায় বলল ঠিকানাটার রাস্তার নাম ‘লাইন’ নয় ‘লেন’ হবে, অর্থাৎ ‘পাওয়ার সাপ্লাই লেন’ | ওই রাস্তায় পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ পর্ষদের একটা খুব বড় সাব-স্টেশন আর তার অফিস আছে | স্টেশন থেকে অটো নিলে কুড়ি মিনিট লাগবে | অটোকে বলতে হবে মৌলিপাড়া যেতে | ওখান থেকে হাইওয়ে দিয়ে মিনিট পাঁচেক | এও জানলাম, তার কাছে, যে আরামবাটীতে স্টেশনের কাছে মোটামুটি কাজ চলার মত হোটেল বলতে ‘দীনবন্ধু লজ’ |

লজে কামরা নিয়ে দেখলাম গরম জলের ব্যবস্থা নেই | ম্যানেজার রান্নাঘর থেকে গরম জল পাঠিয়ে দিলে স্নান করে, এক কাপ চা খেয়ে একটা অটো ধরলাম | ড্রাইভার বলল ফেরার অটো পাওয়া যাবে কিনা বলতে পারবে না, কেননা জায়গাটা শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে | ও বলল ও অপেক্ষা করতে পারে | তবে দুপুরের খাওয়ার সময়, বড় জোড় দু’টো অব্দি | যাওয়া আর ফেরার ভাড়ার উপর আরও পঞ্চাশ টাকা লাগবে | তাতেই রাজী হলাম | ঘড়িতে দেখলাম প্রায় দুপুর বারোটা |

যেতে যেতে একটু একটু করে বাড়ি ঘর কমে এসে মৌলিপাড়ার পর সবুজের দেখা দিল | তারপর ধানের ক্ষেতের মধ্যে হাইওয়ে দিয়ে কিছু দূর গিয়ে অটোটা ডান দিকে একটা বিরাট ঝিলের পাশ দিয়ে একটা সরু পথ ধরল | দেখলাম কিছু দূর গিয়ে প্রথমেই একটা সাব-স্টেশন আর তার লাগোয়া অফিস যার উপর লেখা ‘পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ পর্ষদ’ | তারপর ঝিল শেষ হলে দু’দিকে কিছু বাড়ি আর বাগান | একটা মাধবীলতায় ঢাকা গেটে ২০/এ নম্বর লেখা দেখে অটোটাকে বললাম থামতে | আমায় নামিয়ে ড্রাইভার বলল ও মোড়টায় ফিরে হাইওয়েতে একটা চায়ের দোকানে অপেক্ষা করবে |

গেটটা খুলতে গিয়ে দেখলাম হাতের তালু ঘেমে আছে | মনের ভিতরটা একদম ফাঁকা, যেমনটা হয় খুব বড় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতির শেষে |

ঘণ্টার বোতাম টিপে কোনও আওয়াজ শুনতে পেলাম না | বিদ্যুৎ নেই নাকি ? কড়া নাড়তেই একজন মহিলা দরজা খুলল | সেই মহিলা, সদ্য স্নান করে তোয়ালেতে চুল জড়িয়ে তার প্রান্ত দুহাতে নিংড়াতে, নিংড়াতে | শরীর যেন আরও রোগা হয়ে গেছে | আমাকে দেখে তার কালো গভীর চোখ এক মুহূর্তেই বিস্ময়ে ভরে উঠলো | তারপর, সেই প্রায় ভুলে যাওয়া স্মিত বিব্রত হাসি হেসে বলল, “আপনি !”
আমি বললাম, “যাক, চিনতে পেরেছেন |”

পিছনে বাড়ির ভিতর থেকে একজন মহিলা ডেকে বলল, “শিউলি, দেখ তো কে এসেছে ?”
ওর নিরুত্তর দ্বিধা দেখে আমি আস্তে করে বললাম, “ভিতরে আসতে বলবেন না ?”
পিছনের দরজার পর্দা সরিয়ে এক মহিলা ভিতর থেকে সামনের ঘরে বেরিয়ে এলো | আমাকে দেখে বলল, “ইনি কে, শিউলি ?”
শিউলি ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে আমায় চুপ থাকতে ইশারা করে ঘুরে বলল, “দিদি, ইনি সেই ভদ্রলোক |”
দিদি – “সেই বলতে ?”
শিউলি – “আরে, সেই টেলিগ্রামের |”
দিদি – “ওহো ... কী নাম যেন ?”
শিউলি – “প্রবাল |”
দিদি – “হ্যাঁ, হ্যাঁ | প্রবাল |” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তাই তো ?”
শিউলি ততক্ষণে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাকে ঘরে ঢুকতে ইশারা করছে | আমি ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমার নাম আপনারা জানলেন কী করে ?”
দিদি – “বলছি | আগে বসুন | ... আপনি যে টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছিলেন তার তলে লেখা ছিল ‘ফ্রম’ প্রবাল |”
সাথে সাথে আমার সেই টেলিগ্রামটা আবার লেখার কথা মনে পড়ে গেল | তাহলে কি অন্যমনস্কতায় ‘ফ্রম’ এর জায়গায়  নিজের নাম লিখেছিলাম ? আমি জোড় হাত করে বললাম, “হ্যাঁ, আমার নাম প্রবাল রায় |”
তারপর শিউলির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম, “আপনার নাম শিউলি ? কিন্তু, আপনার স্যুটকেসে তো লেখা ছিল শেফালী |”
দিদি হেসে বলল, “ও, সেই দেখে আপনি আমাদের ঠিকানা পেয়েছেন বুঝি ? ওটা আসলে আমার স্যুটকেস | শিউলির কাছে পড়ে ছিল |”
আমি – “কিন্তু ... ”
শিউলি – “কিন্তু কী ?”
আমি – “না, মানে, কিছু মনে করবেন না | আমি আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম | বহরমপুরে একটা কাজ ছিল | হটাত কী খেয়াল হল, টেলিগ্রামের ঠিকানাটা স্বচক্ষে দেখতে গেলাম | কিন্তু আপনার বাবা, মা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন যে কোনও টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন | আমি তো একদম ...  তারপর ওনারা বললেন ... ”
শিউলি – “কী ?”
আমি – “যাক | ওই সব কথা থাক !”
দিদি – “ঠিক ! শিউলি, ওদের কথা ছাড় |”
শিউলি – “বেশ ! তাহলে, আপনার নিজের কথা বলুন | হটাত এ ভাবে ... আরামবাটীতে কোনও কাজে এসেছিলেন বুঝি |”
আমি – “বলতে পারেন | তো, মনে হল দেখে যাই |”
দিদি – “কী ? কাকে ? শিউলিকে ?”
আমি সঠিক উত্তরের অভাবে চুপ করে থাকলাম |

শিউলি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দিদি, তুই কথা বল | আমি চা করে নিয়ে আসি | ... খাবেন তো ?”
দিদি – “না, না | তোরা কথা বল | আমি চা নিয়ে আসছি | ... আর আপনি কিন্তু খেয়ে যাবেন | ওর জামাইবাবু এই পাশেই বিদ্যুৎ পর্ষদের অফিসে কাজ করে | একটু পরেই এসে পড়বে দুপুরের খাবার খেতে | ওর সাথে দেখা করে, খেয়ে তবে আপনি যাবেন |”

দিদি চলে গেলে শিউলি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল, “কই বললেন না তো কী দেখতে এসেছেন |”
আমি – “না, মানে ... এমনি কী মনে হল | ... আপনি কিন্তু সেই বারের তুলনায় আরও রোগা লাগছেন |”
শিউলি – “ও, বুঝেছি | চলুন, উঠুন |”
আমি – “কোথায় ?”
শিউলি – “চলুন না | তবে, আগে সাবান দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিতে হবে |”
আমি – “হাত মুখ ধোব কেন ? এই তো স্নান করে এলাম |”
শিউলি – “আসুন তো | এত প্রশ্ন করলে হয় ?”

অগত্যা উঠে শিউলির পিছন পিছন গেলাম | ভিতরের ঘর পার হয়ে একটা বারান্দা, তারপর একটা উঠোন রোদে ভরে পড়ে আছে | বারান্দায় একটা বেসিন দেখিয়ে দিল শিউলি | আমি হাত মুখ ধুতে ধুতে ও একটা বেতের চেয়ার এনে উঠোনে রেখে বলল, “এখানে আরাম করে রোদে বসুন | আমি আসছি |”

আমি বসলাম | উঠোনের একটা নিম গাছ থেকে থেকে হাওয়ায় শিরশির করে উঠে অনেক শুকনো পাতা ঝরাচ্ছে | তারা বাতাসে উড়তে, উড়তে হেলতে, দুলতে মাটিতে নেমে আসছে, যেন মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্তি পেয়েও মাটির, ধুলোর মায়া কাটাতে পারছে না | ঢিলে ঢালা রোদ আর ঠাণ্ডা হাওয়ার ছোঁয়া-ছুঁয়ি মনটাকে আবছা আমেজে ভরে দিল | আর, একটা বড় পরীক্ষা শেষ হওয়ার আলসে ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলে যেন আমি ও মাধ্যাকর্ষণ থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি পেলাম |

একটু পরে কেউ পাশে দাঁড়িয়ে ছায়া ফেলে বলল, “এবার চোখ খুলুন |” তাকিয়ে দেখি শিউলি দাঁড়িয়ে আছে | চুল খোলা, তোয়ালেটা নেই | দু’হাতে ধরা ফল রাখার মত কিন্তু বড় একটা বেতের টুকরিতে উজ্জ্বল লাল গরম চাদরের একটা বান্ডিল | তাতে ঠিকরানো রোদের আভায় কি না জানিনা ওর মুখে একটা অদ্ভুত লাবণ্যময় উত্তাপ | গভীর চোখ ছাপিয়ে এক অর্থপূর্ণ কৌতুকের হাসি | টুকরিটা আমার কোলে নামিয়ে দিয়ে বলল, “এই নিন, দেখুন | আমার ছেলে !”

দেখলাম গরম চাদরটায় চোখ বুজে ঘুমে অচেতন একটা কয়েক দিনের শিশু | মাথা ভরা চুল, আর দুটো ফোলা গালের মাঝে টুসটুসে ঠোঁট | আমি ভয়ে ভয়ে আস্তে করে সাবান দিয়ে ধোয়া ডান হাতের তর্জনী দিয়ে একটা গাল ছুঁলাম, যেন দেখতে যে ওটা সত্যি একটা শিশু নাকি একটা ফুটফুটে পুতুল | ও একটু নড়ে ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করল | তারপর চোখ খুলে, রোদের ছটা দেখে না কি কে জানে, চোখ কুঁচকে, খোলা মুখটা একটু ভেংচিয়ে একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার ঘুমে তলিয়ে গেল |

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ওর নাম কী রেখেছেন ?”
শিউলি – “এখনো ঠিক করিনি |”
আমি – “তাহলে, যিশু ?”

তখনি শেফালী শিউলিকে ডেকে বলল চা নিয়ে যেতে | আমার কোলে বাচ্চাটাকে রেখে শিউলি চলে গেল | একটু পরে চা নিয়ে এসে আমায় দিয়ে বলল, “আপনি কী যেন বললেন ? দিদির ডাক শুনতে গিয়ে শুনতে পেলাম না |”
আমি – “না, তেমন কিছু নয় |”

শিউলি আমার কাছ থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে নিলে আমি  চাটা খেলাম | শিউলি সেই কৌতুক ভরা চোখে আমাকে দেখতে, দেখতে আমার চা খাওয়া হলে আমার কোলে বাচ্চাটাকে আবার রেখে কাপ ডিশ নিয়ে ভিতরে চলে গেল | একটু পরে এসে বাচ্চাটাকে তুলে আমাকে উঠোনে ছেড়ে ভিতরে চলে গেল | আমি চোখ বুজে পড়ে রইলাম একই ভাবে, কোলে বাচ্চাটার টুকরির ভার আর উত্তাপের রেশ উপভোগ করতে করতে |

শিউলি আর না এলেও আমি বুঝলাম ও বাড়িতেই রয়েছে কোথাও, হয় তো দিদির সাথে, আমার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে |

শিউলির জামাইবাবু এলে শিউলি আমাকে ডেকে খাবার ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “আপনার অটো ড্রাইভার এসেছিল বলতে যে ও খেয়ে নিয়েছে | ও রয়েছে আপনার জন্য | খেয়ে উঠেই যেন বেরিয়ে পড়েন | ... আর একটা কথা | দিদি, জামাইবাবু কিছু বললে কিছু মনে করবেন না তো ?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কিন্তু ও চোখ ঘুরিয়ে নিলো | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “উনি কি আপনার নিজের দিদি ?” শিউলি মাথা নাড়িয়ে বলল, “না | কলেজে দু’ বছরের সিনিয়র ছিল | কিন্তু একদম নিজের দিদির মতো | ... চলুন, খেয়ে নেবেন |”

আমি আর শিউলির জামাইবাবু, অরুণ, শুধু খেতে বসলাম | শেফালী পরিবেশন করল | শিউলি বাচ্চাটাকে নিয়ে সোফায় পা তুলে বসে থাকল | খেতে খেতে অসংলগ্ন কিছু কথা হল | কে কী করে, কার দেশ বাড়ি কোথায় এই সব | সেই টেলিগ্রামের কথা কিছু না উঠলেও আমার মনে হল আমার পরিচয় ওতেই সীমিত | তার বেশি কারো কিছু কৌতূহলও নেই  দেখলাম | আমিও শিউলির সম্বন্ধে কৌতূহল সম্বরণ করলাম | ও এক দু’বার বাচ্চাটার দিক থেকে মুখ তুলে তাকালে চোখাচোখি হল | একবার আমি কিছু বলতে গেলে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে সেই রকম হাসি হাসি চোখে ও আমাকে কিছু ইঙ্গিত করল, বোধহয় বোঝাতে যে বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়াচ্ছে |

খাওয়া শেষ হলে বিদায় নিয়ে আমি অরুণের সাথে বেরলাম | ওর অফিসের সামনে এসে নমস্কার করলাম | তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, “কিছু মনে করবেন না | আমি কি আবার আসতে পারি ?”
অরুণ বিস্মিত চোখে তাকালে আমি বললাম, “যিশু কে দেখতে ?”
অরুণ ইতস্তত করে বলল, “যিশু ? ... ও ! হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ... মানে, যদি শিউলির কোনও আপত্তি না থাকে |”
আমি বললাম, “আসি তাহলে |”
 
----------------------------------------------------------------------------------

© ইন্দ্রনীর / ২৪ নভেম্বর ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই: