সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৪

টগরের ছবি

৷৷ টগরের ছবি ৷৷

ভৈরব বাবু ইদানীং ছবি তুলছেন ৷ ডিসেম্বরে বড় নাতি রথীন তার পুরানো হয়ে যাওয়া ক্যামেরা ফেলে গিয়ে ফোন করে বলেছে, “দাদু, আমি ওটা তোমার জন্য রেখে এসেছি ৷” তাই, শীত কমার মুখে, উনি রোজ সকাল দশটার পর বেরিয়ে দুটো ব্লক পার করে প্রত্যন্তভিহার উদ্যানে ঢুকে পড়েন ৷ তারপর ঝোলা-ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা সাবধানে বের করে ছবি তুলতে শুরু করেন ৷ পুরানো বড় বড় গাছে ভর্তি পার্কটায় এই সময় স্বাস্থ্যসচেতনদের ভিড় শেষ ৷ শুধু ত্যানা কুড়ানি, আর, কোনও কোনও বেঞ্চে স্কুল কলেজ পালানো জোড়া কিশোর কিশোরী বসে ৷ দেখলে এড়িয়ে যেতে হয় ৷

একদিন, দূরে একটা ঝোপের উপর অনেক হলুদ কিছু উড়ছে, কাছে গিয়ে দেখলেন ওগুলো প্রজাপতি ৷ ছবি নিতে শুরু করেছেন, এক দুটো শট ঝাপসা উঠেছে, হটাত তাঁর মনে হল কেউ যেন হালকা হাততালি দিল ৷ ক্যামেরা থেকে মুখ সরিয়ে দেখলেন এক পাশে রথীনের বয়েসের একটা ছেলে দুহাত আঁজলা করে প্রজাপতি ধরার চেষ্টা করছে ৷ বেশভূষা দেখে মনে হল ভিখিরি, কি ভবঘুরে ৷  একটু বিরক্ত হয়ে তিনি ক্যামেরা নামালেন ৷ ছেলেটা ঝুঁকে হাত দুটো প্রসারিত করে এক ঝাপটায় প্রজাপতির কাছে এনে হাতের পাতা আঁজলা করে ঘিরতে চাইছে ৷ কিন্তু তার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে প্রজাপতি উড়ে পালাচ্ছে ৷ হাস্যকর কাণ্ডটার মুভি করে রাখতে তিনি ক্যামেরা তাক করলেন ৷ ছেলেটা যেন টের পেয়ে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, “কী করছ ?” ভৈরব বাবু নেতিবাচক ভাবে মাথা নেড়ে ক্যামেরা নামিয়ে নিলেন ৷ ছেলেটা এবার বলল, “ওই, ওটা দিয়ে ?”
ভৈরব বাবু মুখ খুললেন, “ছবি তুলছিলাম ৷”
ছেলেটা – “ফটো ?”
ভৈরব – “হ্যাঁ | তুমি কী করছ, ওই ভাবে হাততালি দিয়ে দিয়ে ?”
ছেলেটা – “প্রজাপতি ধরছি ৷”
ভৈরব – “ও ! ... ধরে কী করবে ?”
ছেলেটা – “কাউকে দেব ৷”
ভৈরব বাবু একটু কৌতূহলী হলেন, “কাকে দেবে ?”
ছেলেটা টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিক দেখে নিলো ৷
ভৈরব বাবু পরিস্থিতি লঘু করার জন্য জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কী ?”
ছেলেটা – “বাবলু”
ভৈরব – “বাহ ! বেশ ... তা বাবলু, প্রজাপতি ধরে কাকে দেবে ?”
বাবলু সন্দিগ্ধ হয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে একটা পড়ে থাকা বস্তা তুলে হাঁটা দিল ৷ তাড়াহুড়োর ঝটকায় কিছু ছেঁড়া প্লাস্টিকের প্যাকেট আর কাগজের ঠোঙ্গা তার থেকে উপচে পড়ল | ভৈরব বাবু বুঝলেন ছেলেটা ত্যানা কুড়ানি ৷

কিছু দিনেই তিনি বাবলুর পরিচয় পেলেন ৷ মা কে নিয়ে পার্কের পিছনে বস্তিতে থাকে ৷ ওর মদ্যপ বাবা লিলুয়ার দিকে এক কুয়াশা রাতে লেভেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে কাটা পড়ে ৷ ছেলেটা এখন তাঁকে দেখলে বস্তা নামিয়ে কাছে আসে ৷ সাথে সাথে ঘুরে এমন জায়গা দেখিয়ে দেয় যেখানে অচেনা সব পাখি আসে যায় ; উনি ছবি তোলেন ৷ বাবলু মাঝে মাঝে বলে, “কেমন ফটো তুললে আমায় দেখাও ৷” ভৈরব বাবু কখনও দেখান, আবার কখনও বলেন, “দেখাব ... আগে বল কার জন্য সেদিন তুই প্রজাপতি ধরছিলি ৷” তখন বাবলু নিরাশ হয়ে বলে, “তাহলে থাক ৷” তারপর ওর উৎসাহ কমে যায়, ইতস্তত করে বস্তাটা তুলে চলে যায় ৷ আবার এক দু দিন পরে দেখা দেয় ৷ এই রকম প্রস্থান হলে ভৈরব বাবু বিরক্ত হন | আবার যে দিন বাবলুর পুনরাবির্ভাব হয় সেদিন তিনি ভুরু না কুঁচকে বাড়ি ফেরেন ৷
 

আজ সকালে তিনি মন দিয়ে একটা গাছের নিচু ডালে বসা পাখির দিকে ক্যামেরা তাক করে জুম করেছেন কি পিছনে শুকনো পাতায় হালকা পা ফেলার শব্দ হল, আর পাখিটা উড়ে গেল ৷ মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন দু’হাত আঁজলা করে বাবলু দাঁড়িয়ে ৷ মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “আজ একটা ফটো তুলে দেবে ?”
ভৈরব – “কিসের ছবি ? তোর হাতে কী ?”
বাবলু – “প্রজাপতি ধরেছি | দেখবে ?”
ভৈরব – “প্রজাপতির ছবি নিতে বলছিস ?”
বাবলু – “না, না | আমি প্রজাপতিটা টগর কে দেব | তুমি ওর একটা ছবি তুলে দেবে ?”
নামটা প্রথম শুনলেও, ভৈরব বাবু কৌতূহল চেপে নিরস গলায় বললেন, “টগর ... বেশ তো ৷ যা ডেকে নিয়ে আয় ৷”
বাবলু ঘুরে জোর গলায় ডাকল, “রানী ...” ৷
দূরে ঘেউ ঘেউ করে উঠে একটা কুকুর দৌড়ে আসতে শুরু করল ৷ ওটা কাছে এলে দেখলেন একটা দো-আঁশলা ময়লা মাঝ-বয়সী মাদী কুকুর, যার ঘাড়ে, দাপনায় আর পিঠের কোথাও কোথাও চুল উঠে গেছে ৷ বাবলু ওকে বলল, “যা রানী, টগরকে নিয়ে আয় ৷”
কুকুরটা ছুটে চলে গেল ৷ পুনর্ধ্যানস্থ হয়ে ছবি তুলতে তুলতে ভৈরব বাবুর হটাত মনে হল, আরে এ তো ডিজিটাল ক্যামেরা – এর ছবি বাবলুকে কী করে দেবেন ? সমস্যাটা এড়াতে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁ রে, তুই ছবি নিয়ে কী করবি ?”
বাবলু – “মা দেখতে চায় ৷”
ভৈরব – “টগরের ছবি ?”
বাবলু – “হ্যাঁ ... না, মানে ... টগর কে |”
ভৈরব – “তাহলে ছবি নিয়ে কী হবে ?”
বাবলু – “কিন্তু, টগর চায় ... ওহ ! সে তুমি বুঝবে না ... এখন চলো আমার সাথে ৷”
ভৈরব – “কেন, কোথায় নিয়ে যাবি ?”
বাবলু – “চলো, দেখি টগর আসছে না কেন, আর রানী কোথায় পালাল ৷”

বাবলু ভৈরব বাবু কে নিয়ে চলল ৷ পার্কটা এত বড় যে বেশ অনেকটা দূরে এসে ভৈরব বাবুর সন্দেহ হল ছেলেটার কোন মন্দ মতলব নেই তো ৷ কিন্তু এতদিন ছেলেটার মার্জিত, অকপট কথাবার্তা শুনে তাঁর কেমন যেন মনে হয়েছে একটু ছিটিয়াল হলেও ছেলেটা বোকাসোকা, সরল ৷ জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রে, কোথায় গেল তোর টগর ?” একটু দূরে একটা, যেন কোনও জলাশয়ের চারিপাশে জমায়েত, ঝাঁকড়া গাছের জটলা দেখিয়ে বাবলু বলল, “ওই ওখানে, হয়ত ৷” গাছগুলোর কাছে পৌঁছে একটা সরু পথে বাবলুর পিছন পিছন এগিয়ে দেখলেন, জমিটা একটু উঁচু হয়ে উঠে নেমেছে একটা পুকুরে ৷ পথটার শেষে তালগাছের গুঁড়ি ফেলা তিন ধাপের সিঁড়ি ৷ পাশে একটা গাছের গুঁড়ি জলে আগা ডুবিয়ে শুয়ে ৷ তার উপরে ছেঁড়া কাপড় পরা একটা মেয়ে, পাশে কুকুরটা – দুজনে নিশ্চল হয়ে বসে পানকৌড়ি দেখছে ৷  যেন এদের অস্তিত্ব টের পেয়েও ওরা দুজনে চুপ করে বসে রইল ৷ বাবলু ডাকল, “রানী, টগর কে নিয়ে আয় ৷” কুকুরটা উঠে মেয়েটার কাপড় মুখে ধরে টানল ৷ মেয়েটা তাও বসে রইল ৷ অধীর হয়ে বাবলু হড়বড় করে নিচে নেমে মেয়েটার পাশে ঝুঁকে তার কানে কানে কিছু বলল
মেয়েটা এক অদ্ভুত জড়তার সাথে আস্তে করে বাবলুর মুখ থেকে কান সরিয়ে, আঁজলা করে ধরা বাবলুর দুই হাতের পাতার কাছে কানটা নুইয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল | বাবলু ভৈরব বাবুর দিকে মুখ তুলে বলল, “এই হল টগর ... টগর, মুখ তোল ৷ বাবুকে এনেছি, তোর ফটো তুলিয়ে মাকে দেখাব বলে ৷”

মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে  “আর আমাকে ... ?” বলে কথার খেই হারিয়ে বিব্রত মুখ তুলে হাসল ৷


ভৈরব বাবু
দেখে চমকে উঠলেন, গড়নে কিশোরী টগরের পোড়া মুখে পলকহীন ঘোলাটে চোখ দুটোয় কোনও দৃষ্টি নেই ৷
----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪


কোন মন্তব্য নেই: