বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৫

ফ্র্যাক্টাল

|| ফ্র্যাক্টাল ||


একটু আগে সন্ধ্যা হয়ে রাস্তায় বাতি জ্বলেছিল, শীত নেমে আসছিল | বাওয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে বেরিয়ে পার্কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম পৌষমেলার আলোয় আলো হয়ে আছে | গানের জলসা বসেছে | একটা উঁচু করে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে, উপরটা খোলা | তার উপর বসে কেউ খালি গলায় গান গাইছে | সামনে অনেক – প্রায় শ’ দুয়েক হবে – চেয়ার পাতা | ধবধবে সাদা রং করা বেতের চেয়ার | তাতে বসে মগ্ন  হয়ে গান শুনছে লোকে | সামনের সারি গুলোয় ভিড় এড়াতে, আমি পিছনের দিকে গিয়ে বসলাম | এই সারিটা প্রায় ফাঁকা | এই প্রান্তে কয়েকটা চেয়ার ছেড়ে এক পুরুষ আর মহিলার জুটি বসে | লোকটার পাশের দুটো জায়গা ছেড়ে বসলাম | বসতেই দু’জনে আমার দিকে তাকাল – পুরুষটা মাঝ বয়সী, কপালের উপর ব্যাক ব্রাশ করা চুল পাতলা হয়ে পিছিয়ে গেছে | মহিলাটা না সাদামাটা না সুশ্রী দেখতে যুবতী – চোখে চকিত হরিণের চোরা চাউনি | আমি মুখ সামনে ফিরিয়ে গান শোনায় মন দিলাম |

চুপচাপ দুজন হটাত মনে হল চাপা গলায় কিছু কথা কাটাকাটি করল | আমি কী কৌতূহলে ওদের দিকে তাকাতেই আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা উঠে দাঁড়ালো | সজোরে বলল, “চলো, তোমাকে বাসে তুলে দিই |” মেয়েটা উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার বসে পড়ল | কেন জানি না, আমার মনে হল আমার উপস্থিতি ওদের অন্তরঙ্গতায় কিছু ব্যাঘাত ঘটিয়েছে | ভাবলাম উঠে যাই, কিন্তু ততক্ষণে লোকটা সারিটার অন্য প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেছে | বসে থাকা লোকদের হাঁটুর সামনে জায়গা কম, তাই বেশি দূরে যেতে পারে নি | শুনলাম, বলতে বলতে এগোচ্ছে, “এক্সকিউস মি ! এক্সকিউস মি !”

তখনই মেয়েটা ডাকল, “শুনুন !” আমি অবাক হয়ে তাকালাম | মেয়েটার চোখে গভীর আবেদন | বলল, “যদি কিছু মনে না করেন, একটু আসবেন আমাদের পিছন পিছন |” এগিয়ে যাওয়া লোকটা এদিকে ফিরে ডাকল, “এসো ... এর পর আর বাস পাবে না |” মেয়েটা আমার দিকে থেকে মুখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে “আসছি” বলে গলা খাদে নামিয়ে বলল, “প্লিজ !” তারপর উঠে দাঁড়িয়ে অনিচ্ছুক দেহভঙ্গিতে লোকটার পিছু নিলো | কিছু দূর গিয়েই আমার দিকে ফিরে তাকাল, খুব আকুতি মাখানো দৃষ্টিতে – বুঝলাম কোনও বিপদের আভাস পেয়েই আমার সাহায্য চাইছে | ওরা দুজনে সারিটার ওপর প্রান্ত থেকে বেরিয়ে গেলে আমি আমার প্রান্ত থেকে বেরিয়ে ওদের উপর চোখ রেখে এগলাম | আমাকেও তো বাস ধরতে হবে |

পার্কের বাইরে রাস্তাটা শূন্য | বাতির তলায় কুয়াশা নেমে আসছে | এদিক ওদিক এক আধটা কুকুরকুণ্ডলী | রিকশার হুড নামিয়ে আলোয়ান মুড়ি দিয়ে রিকশাওয়ালারা ঘুমচ্ছে | পার্ক থেকে ভেসে আসা গান বাতাসে ভারী কুয়াশায় বেধে গুলিয়ে যাচ্ছে | সামনের মোড়ে বড় রাস্তায় ডানদিক ঘুরলেই বাস স্ট্যান্ড | লোকটা আর মেয়েটা মোড়ে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ল | লোকটা পিছন ফিরে তাকাল | তারপর মনে হয় আমাকে দেখে হনহন করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো |

আমার কাছাকাছি এসে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলল, “আপনি ? আবার ?”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, “আবার মানে ?”
- “মানে বুঝিয়ে বলতে হবে ? একটু আগে আপনি এসে আমাদের পাশে বসেছিলেন না ? এখন আবার পিছু নিয়েছেন | কেন ?”
-    “কোথায় পিছু নিলাম ?”
-    “এই যে আমাদের পাশে এসে বসলেন ... এখন আমাদের পিছন পিছন আসছেন | ভাবছেন আমি বুঝি না ? বারবার একই ব্যাপার হচ্ছে |”
-    “দেখুন, আপনি ভুল বুঝছেন | আমি বাস ধরতে যাচ্ছি | সামনেই আমার বাস স্ট্যান্ড |”

ঠিক তখনই গর্জন করে একটা বাস বেরিয়ে গেল | দেখলাম মেয়েটা সামনের রাস্তায় আর নেই | লোকটা চমকে পিছন ফিরে সেদিকে তাকিয়ে বলল, “যাহ ! আবার ... আবার সেই একই ব্যাপার হল |”

না জিজ্ঞাসা করে পারলাম না, “কী ব্যাপার ? মাফ করবেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি বারবার ‘আবার’ বলছেন কেন ?”
লোকটা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, অনেকটা স্বগতোক্তির গলায়, “দেখলেন না, আপনার জন্য ও আবার চলে গেল |”
- “আমার জন্য ? কে ? আপনার সাথের ওই ভদ্রমহিলা ?”
- “হ্যাঁ |”
- “উনি কে ? যদি কিছু মনে না করেন |”
- “সেটাই তো জানি না |”
- “জানেন না ? তবে যে আপনারা একসাথে ...”

লোকটা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল | তারপর বোধহয় আশ্বস্ত হয়ে যে আমাকে বিশ্বাস করা যায়, জিজ্ঞাসা করল, “আপনি সত্যিই কিছু জানেন না ?” যেন কোন অলীকের সন্ধান পেতে চলেছি, বললাম, “কী জানব ? কী করেই বা জানব ? আমি তো আপনাকে বা ওনাকে আগে কখনও দেখি নি | ব্যাপারটা কী বলুন তো |”

লোকটা একটা সিগারেট বের করে জ্বালাল | দেশলাইয়ের আলোয় মুখটা দেখে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল | কোথাও দেখেছি | কবে ? কোথায় ? লোকটা একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে হাত তুলে পার্কের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “ক’বছর ধরে পৌষমেলার এই গানের জলসার দিন এই একই কাণ্ড ঘটছে |  এই দিন সকাল বেলায় মেয়েটা ফোন করে | চিনি না জানি না, অথচ নাম ধরে চেনা মানুষের মত বলে, ‘তাহলে, পৌষমেলায় গান শুনতে আসছেন তো ? আমিও আসছি, আটটা নাগাদ | শেষের সারিতে থাকব |’ আমি জানতে চাই, ‘তুমি কে ?’ ও বলে, ‘দেখবেন, পরনে অমুক রঙের শাড়ি, গায়ে তসুক রঙের শাল থাকবে | সন্ধ্যাবেলায় আসুন, পরিচয় দেব | বেশি দেরী করবেন না | আমি কিন্তু নটার বাস ধরে ফিরব | আপনি তুলে দেবেন |’ অগত্যা আমি আসি ; কয়েক বছর ধরে এই ভাবে আসছি | প্রত্যেক বারই কোন না কোন কারণে আমার আসতে দেরী হয়, প্রায় নটা বেজে যায় | ও আগেই এসে বসে থাকে | আজকাল মুখ চিনতে কষ্ট হয় না | আমি ওর পাশে বসে  যেই জানতে চাই, ‘কে তুমি ?’ ও বলে, ‘বলব, বলব | যখন বাসে তুলে দিতে যাবেন, বলব ... দেরী করে এসেছেন, এখন চুপ করে গান শুনুন |” একটু পরেই কোন এক অচেনা লোক এসে আমাদের কাছে বসে, যেমন আজ আপনি এসে বসলেন | লোকটা এলেই ও যেন একটু অস্বস্তি বোধ করে | আমিও তখন ঘড়িতে দেখি প্রায় নটা বাজে, আর বলি, ‘চলো, এবার তোমাকে বাসে তুলে দেব | যেতে যেতে বোলো তুমি কে |’ আমরা উঠি, আর অচেনা লোকটাও উঠে আমাদের পিছু নেয় | তাই দেখে আমার রাগ হয়, মুখোমুখি হয়ে লোকটাকে চেপে ধরি, জানতে চাই লোকটা কী চায় | আমাদের কথা কাটাকাটির মধ্যে মেয়েটার বাস এসে পড়ে, আর ও উঠে চলে যায় | ওকে আর দেখি না | আবার এক বছর ধরে অপেক্ষা করি, কিন্তু প্রতি বছর একই ব্যাপার হয় !”

আমি কিছুটা অবিশ্বাস্য ভাবে বললাম, “কিন্তু আমি তো এই প্রথম আপনাদের দেখলাম |” লোকটা বলল, “হ্যাঁ, প্রত্যেক বছরই আলাদা লোক দেখি | কিন্তু অচেনা লোক পাশে এসে বসলেই ও বলে, যেমন এবার আপনি এলে বলল, “এই রে ! আবার সেই লোকটা ! শিগগির উঠুন | আমাকে বাসে তুলে দিন, আমি পালাই | নইলে বিপদ |”
- “কিসের বিপদ ?”
- “ঠিক জানি না | সেটাই তো জানবার কোন সুযোগ পাই নি আজ অব্দি |”

আমি একটু ভেবে বললাম, “আপনি কি গত বছর আমাকে দেখেছিলেন ?”
লোকটা বলল, “না, না | গত বছর যিনি এসে আমার পাশে বসেছিলেন, তিনি তো আলাপ করে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন | গুজরাটি সম্ভবত, নামটা মনে নেই | বিদেশ থেকে কদিনের জন্য এসেছিলেন, কোনও সেমিনারে অংশ নিতে | সামনেই বাওয়ারিং ইন্সটিটিউটে উঠেছিলেন |”

লোকটার কথায় গত বছরের কথা মনে পড়ে চমকে উঠলাম | সে’ বছর ঠিক এই সময় কলেজের বন্ধু আহমেদাবাদের নাগা (নাগামুনেন্দ্র) এসেছিল | বাওয়ারিং ইন্সটিটিউটে উঠে আমায় ফোন করেছিল | এসেছিল ফ্র্যাক্টালের উপর কী একটা সেমিনার এ যোগ দিতে | আমাকে বোঝাতে পারে নি ফ্র্যাক্টাল ব্যাপারটা কী | বলেছিল, ‘পঞ্চতন্ত্রে মনে আছে, গল্পের ভিতর গল্প, তার ভিতরে গল্প ?’ কিছুটা সেই রকম ব্যাপার | তবে ফ্র্যাক্টালের যত ভিতরেই যাবি, দেখবি ভিতর ভিতর গল্পটা একই |’

ওর সাথে গল্প করতে করতে দেখছিলাম ওর টেবিলে রাখা একটা খুব চকচকে রঙচঙে গোল ফিতে | আমার দৃষ্টি লক্ষ্য করে নাগা বলেছিল ‘এই রকম মবিয়াস স্ট্রিপ দেখেছিস ? এক পার্টি সেমিনারে এই মবিয়াস স্ট্রিপ বিলি করছে |’ কলেজে সাদা কাগজের ফালিতে এক পিঠে সাইড-এ, অন্য পিঠে সাইড-বি লিখে প্রান্ত দুটো জোড়া দিয়ে জিনিসটা বানিয়েছি | কিন্তু এত রঙচঙে কখনও দেখিনি | হাতে নিয়ে দেখলাম ওটা প্লাস্টিকের | রংটা ক্রমাগত সবুজ থেকে হলুদ হয়ে আবার সবুজ হয়ে গেছে | তাতে চৌকো ছোপ কাটা বিপরীত রঙের – সবুজে হলুদ আর হলুদে সবুজ | কোথাও জোড়া দেখা যাচ্ছে না | ওটা হাতে নিয়ে হরিনামের মালার মত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে পড়লাম | সেটা লক্ষ্য করে নাগা বলল, “এই, বেশি ঘাঁটিস না – দেখবি এক পিঠ থেকে অন্য পিঠে যেতে যেতে আসল থেকে অলীক জগতে পৌঁছে যাবি |”

সন্ধ্যা নামলে উঠে পড়ে নাগাকে বলেছিলাম, “শোন, সামনে পার্কে পৌষমেলা হচ্ছে | এখন গানের জলসা আছে | যাবি ? তারপর কোথাও একসাথে ডিনার করা যাবে |”

ও আশ্চর্য ভাবে তাকিয়ে, মাথা নেড়ে বলেছিল, “আমি হয়ত যাব, তবে তোর সাথে নয় |”
- “মানে ?”
- “রহস্যময় ব্যাপার ! আমি সিঙ্গাপুর থেকে কদিনের জন্য এসেছি ; এখানে কেউ আমায় চেনে না | আর, এক মহিলা আজ সকালে আমাকে ফোন করে জলসাটার কথা বলছে, যেন আমাকে চেনে | ওই ভাবেই জিজ্ঞাসা করেছে,  ‘যাবে ? আমি যাব আটটা নাগাদ |’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কে ? চিনব কী করে ?’ বলল, ‘এসো না, আবার না হয় পরিচয় দেব | শেষের দিকের সারিতে থাকব | দেখবে লাল সিল্কের শাড়ি আর গায়ে ক্রিম রঙের শাল, চুলে পনীটেইল বাঁধা মবিয়াস স্ট্রিপে |’ তখন বুঝলাম মহিলাটি সেমিনারে এসেছে | হয়ত কাল বুফ্যে লাঞ্চ করার সময় ছিল, কেউ আলাপ করিয়েছিল |”
- “তুই যাবি তাহলে ?”
- “এখনও জানি না | ভাবছি, কে না কে অচেনা মহিলা !”


-------------
ফুটনোট :
ফ্র্যাক্টাল: এক বিশেষ জ্যামিতিক রেখা বা আকার যার প্রতি অংশে ও সমগ্রতায় একই পরিসংখ্যাত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, ও যার প্রতি ক্রমাগত ক্ষুদ্রতর অংশে নিম্নতর মানে সদৃশ আকার দেখা যায় |
(Fractal (Mathematics) noun: A curve or geometrical figure, each part of which has the same statistical character as the whole, in which similar patterns recur at progressively smaller scales.)

------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ০৪ নভেম্বর ২০১৫


কোন মন্তব্য নেই: