সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৫

পাঁচ মিনিট

|| পাঁচ মিনিট ||


-    “তুই শুনবি না ?” বিরক্ত হয়ে সীমা জিজ্ঞাসা করল |
-    “হ্যাঁ, এইবার বল – শুনি তোর কথা |” খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে, চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে নামিয়ে রেখে তিন্নি বলল, “শুরু থেকে বল | কোথায় বললি তোর বর তোকে নিয়ে গেল ... আর, কেন ?”

সীমা - “সকাল সকাল – একটু আগেই শৈবাল ডেকে বলেছে প্রায় সাতটা বাজে – একটা ফোন এলো | ফোনে এক দুটো কথা বলেই গম্ভীর গলায় ও বলল, ‘ওঠো | চলো, বেরোতে হবে |’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হয়েছে ? কার ফোন ছিল ? কোথায় যেতে হবে ?’ ও বলল, ‘বড় মামার ফোন ছিল | বলল, এই মাত্র খবর পেয়েছি, তোতনদা মারা গেছে | হাসপাতাল থেকে ফোন করে খবর দিয়েছে |  আমার তো এখন লোকজন দরকার | তুই সীমা কে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারিস আয় |’ ”
তিন্নি - “তোতনদা বলতে ?”
সীমা - “শৈবালের বড় মামার সৎ-কাজিন |”
তিন্নি - “ইউ মীন ... শৈবালদা’র দাদুর দু’টো বউ ছিল ?”
সীমা - “আরে না | ওর দাদু একটাই বিয়ে করেছিলেন | তাঁর যে বাবা, তেনার দুটো বউ ছিল, সেই কোন এক কালে | সেই সুবাদে তোতন ... মামাই হবে তো ... বড় মামার একরকম সৎ-কাজিন হয় | মানে – বুঝছিস তো – আমি জানি না ওনাকে এক্চ্যুয়ালি কী বলা উচিত |”
তিন্নি - “ও ... তারপর ?”
সীমা - “আমি উঠে চটপট দু’একটা কাজ সেরে শাড়িটা পাল্টে তৈরি হয়ে নিলাম |”
তিন্নি - “কী শাড়ি পরলি ? তাঁত ?”
তিন্নি - “আহ, ছাড় তো | এত সিরিয়াস কথাবার্তার মধ্যে ... ‘কী শাড়ি পরলি ?’ ... তুই ও না !”
তিন্নি - “আচ্ছা বাবা, রাগিস না, বল |”
সীমা - “শৈবাল আমাকে নিয়ে একটু পরেই বেরিয়ে পড়ল | তাড়াহুড়োয় জলখাবারটা অব্দি মুখে দিতে পারলাম না | ও বলল পৌঁছে মুখে কিছু দেবার একটা ব্যবস্থা করবে | সবাই নাকি অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য |”
তিন্নি - “কোথায় যেতে হল ?”
সীমা - “সে অনেক দূরে | বাড়ি থেকে রিক্সা ধরে লেভেল-ক্রসিং মোড়ে গিয়ে সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ...  তোতন মামার বাড়ি সব মিলিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা | ওখানে, ও বলল কী নাম যেন পাড়াটার, হুগলীর মোহনার পাড়ে একটা ক্রিমেটোরিয়াম আছে – তারই সামনে একটা বাড়িতে | আমরা অনেক খুঁজে সেটা বের করলাম | দেখলাম, অনেকেই সেখানে আগে এসে অপেক্ষা করছিল |”
তিন্নি - “সেটা কি সেই ... তোতন মামার বাড়ি ?”
সীমা - “উহুঁ | ওটা কারো বাড়ি ছিল না – মানে, বাড়িটায় লোকজন বাস করে এমন কিছু দেখলাম না |”

সীমা একটু নড়েচড়ে বসে গুছিয়ে বলতে শুরু করল |

বাড়িটা একতলা, কিন্তু খুব বড় – যাকে বলে বিশাল, ছড়ানো | কিসের বাড়ি সামনে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই – ভিতরে গিয়ে বুঝলাম বাড়িটা সম্ভবত ভাড়া দেয়া হয় এই ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য | যেমন, যারা গঙ্গাপ্রাপ্তির জন্য মড়া পোড়াতে দূর দেশ থেকে লোকজন, দলবল নিয়ে আসে তারা ওখানে ওঠে | আমরা যখন পৌঁছলাম বাড়িটা প্রায় ফাঁকা | ভিতরে ঢুকেই দেখলাম একটা বেশ বড়সড় কামরায় মেঝেতে ফরাস পেতে অনেক লোক বসে | বেশির ভাগই পুরুষ মানুষ, আর দু’এক জন মেয়ে মানুষও বসে | কাউকেই চিনলাম না | মনে হয় না শৈবালও কাউকে চিনল | কিন্তু, ওদেরই মধ্যে থেকে কেউ এগিয়ে এসে ওকে বলল, “এসো, এসো |” মেয়ে বউদের একটা দল এক পাশে বসে আমাকে দেখছিল | তাদের একজন আমাকে হাত নেড়ে ডাকল ওদের কাছে বসে পড়ার জন্য | আমি কাছে গিয়ে বসতেই সে বলল, “চুপচাপ বসো এখন | অনেক সময় লাগবে |” কিসের সময় লাগবে ভাবছি, ততক্ষণে শৈবাল আমার কাছে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “শোনো, মনে হচ্ছে দেরী হবে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কিসের দেরী ?” ও বলল, “বলছে চুল্লীর ওখানে লাইন পড়ে গেছে | আমাদের পালা আসতে দেরী হবে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “বড় মামা কোথায় ? ওনাকে তো দেখছি না |” ও বলল, “আমিও দেখলাম না | কেউ বলতেও পারছে না |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আর তোতন মামার বডিটা ?” শৈবাল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “দাঁড়াও সীমা, আমি সব খবর নিয়ে এসে বলছি |” এই বলে ও চলে গেলে আমি বসে থাকলাম | অনেকক্ষণ বসে থাকলাম | ও আর ফিরেই এলো না |

বাকি সবাইও চুপ করে গ্রুপে গ্রুপে বসে | কিন্তু কেউই তেমন কথা বলছে না | বুঝতে পারছি না সবাই কি তোতন মামার সাইডের লোক, না আলাদা আলাদা ডেড বডির সাথে আসা দল | সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার - কাউকে কাঁদতে দেখলাম না | এও বুঝলাম না যে তোতন মামার পরিবার, ছেলে মেয়ে বলতে কিছু কি নেই ?

হলঘরটায় একটা ঘড়ি ছিল | তাতে যখন প্রায় দুটো বাজে, শৈবাল ফিরল | দূর থেকে আমাকে ডাকল | আমি উঠে গেলে বলল, “শোনো, মুশকিল হয়েছে | কিছু ছেলে, এখানকার মাস্তান-টাস্তান হবে, বড় মামার সাথে খুব ঝামেলা করছে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী নিয়ে ঝামেলা ?” ও বলল, “কাল তোতন মামার মারা যাওয়ার খবর পেয়ে বড় মামা হাসপাতালে গিয়ে বডিটা মর্গে রেখে, আজ ভোর ভোর এখানে এসেছিল | একা মানুষ, কী ভাবে সামলাবে ভেবে পায় নি | চিন্তা হয়েছিল যে কাঁধ দেবার লোকজন জোগাড় করে বডি নিয়ে আসতে আসতে এখানে পোড়ানোর লম্বা লাইন পড়ে যাবে | তাই আগে এখানে এসেছিল লাইনে জায়গা ধরতে | এসে দেখল মড়া বিনে কেউ কথাই বলতে চায় না | একদল বখাটে ছেলে খবরদারি করছিল | তারা বলল, ‘আগে মড়া নিয়ে আসুন | তারপর কথা বলবেন |’ মামা ওদেরকে বলল, ‘দেখো ভাই, আমি একা মানুষ | যে মারা গেছে, তারও তিন কুলে কেউ নেই | লোকজন জোগাড় করে বডি আনতে আনতে দেরী হয়ে যাবে | তাই বলছিলাম, আমার নম্বরটা যদি লিখে রাখতে |’ একজন বলল, ‘ঠিক আছে, নাম বলুন – আপনার না – যে মারা গেছে তার নাম বলুন |’ মামা নাম বললে ওরা নাকি একটা নোটবুকে লিখে রেখে বলল, ‘যান, গিয়ে মড়া নিয়ে আসুন | আপনার নম্বর থাকলো |’ তারপরই বড় মামা আমাকে ফোন করেছিল | আমি তখন বলেছিলাম, ‘হাসপাতালে নিশ্চয়ই ডেড বডি শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য হ্যর্স (শবযান) পাওয়া যাবে  | তুমি অপেক্ষা করো, আমি আসছি |’ এখন একটু আগে মামাকে নিয়ে হাসপাতালের হ্যর্স জোগাড় করে, তোতন মামার বডি নিয়ে ফিরেছি | এখানে এসে দেখছি আমাদের লাইন নেই – ইতিমধ্যে অন্য যারা এসেছে, ওই মাস্তানগুলো তাদের আমাদের আগে নম্বর দিয়ে বসে আছে | বড় মামা যে ভোরে এসেছিল সে কথা ওরা মানছেই না | বড় মামা যখন ওদের বলল ওদের একজন নোটবুকে নাম লিখেছিল, ওরা সবাই খুব খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিশ্রীভাবে হাসল | একজন বলল, ‘যা শ্যালা, সসান ঘাটে নোটবুক ! দাদু, এটা কি দেখে ইসকুল-টিস্কুল মনে হচ্ছে ?’ এই ধরনের কথা শুনে বড় মামার মাথা গরম হয়ে গেছে | আমি কোনমতে বড় মামাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ওই হাসপাতালের হ্যর্সে বসিয়ে রেখে এসেছি ... আমি এখন যাই – রগচটা মানুষ, সামলে না রাখলে আবার তেড়ে যাবে ওদের সাথে লাগতে |” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “খাওয়ার কী হবে ? সেই সকাল থেকে যে না খেয়ে আছি |” “দেখছি কী করা যায়”, বলে শৈবাল গেল |

সীমা কথা থামাল | তিন্নি বলল, “থামিস না | বেশ ইন্টারেস্টিং !”  সীমা চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে আবার বলতে লাগল |

যখন দেয়াল ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা বাজে, রোদ পড়ে আসছে, দেখলাম বাথরুম পেয়েছে – যদিও সকাল থেকে এক গেলাস জলও খাই নি | উঠলাম | বাড়িটার ভিতর দিকে ঘরটা থেকে বেরিয়ে একটা করিডোর – তার এক পাশে উঠোন, অন্য পাশে ঘর পর পর | কোনটার দরজা বন্ধ, কোনটার খোলা | কোথাও বাথরুম দেখতে পেলাম না | বেশ কিছু এগিয়ে গিয়ে পেলাম  এই করিডোরটার আড়াআড়ি আর একটা করিডোর | তার দু’পাশে ওইরকম খালি খালি ঘর | যতই এগোই কোনও বাথরুম দেখতে পাই না | এলোমেলো ঘুরে কখন কোন করিডোর থেকে কোন করিডোরে চলে গিয়েছি জানি না – হঠাত মনে হল আমি পথ গুলিয়ে ফেলেছি | ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে আন্দাজে হাঁটা দিলাম | একটু পরে লোকের কথা বলার আওয়াজ শুনে ভরসা পেলাম যে যাক নিজের ঘরটার কাছাকাছি এসেছি | তখন দেখি একটা ঘরের দরজা খোলা যার উল্টোদিকের দেয়ালে একটা আধখোলা দরজা – সেদিক থেকে অপরিষ্কার বাথরুমের মত একটা গন্ধ ভেসে আসছে | ঢুকে ভিতরের দরজাটার কাছে গিয়ে দেখি তার পিছনে একটা কুঠরি | তার মেঝেয় একটা কল থেকে জল পড়ে পড়ে শ্যাওলা হয়েছে, যার গন্ধ পেয়েছিলাম | ফিরে বেরিয়ে আসতে গিয়ে দেখি বাইরের ঘরটার একদিকে দেয়ালের লাগোয়া একটা টেবিলে সাদা কাপড় পেতে তার উপরে কিছু ফুল, সাথে কাগজের প্লেটে প্লেটে থরে থরে অনেক মিষ্টি রাখা | মনে হল  শ্মশান যাত্রীদের জন্য হয়ত জলযোগের ব্যবস্থা করা আছে | পাশে গেলাসে গেলাসে জলও রাখা ছিল | খুব তেষ্টা পেয়েছিল | একটা গেলাস তুলে জলটায় মুখ দিয়েছি কি, কী ভাবে ধাক্কা লেগে একটা মিষ্টির প্লেট থেকে কিছু মিষ্টি মাটিতে পড়ে গেল | তুলে দেখি শুকনো মিষ্টি | ওগুলো হাতে নিয়ে জল খেতে খেতে ভাবছি, মিষ্টিগুলো প্লেটে রেখে দেব না ফেলে দেব – এমন সময় কেউ বলল, “এ তুমি কী করলে ?” মেয়ে মানুষের গলা শুনে তাকিয়ে দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে একজন অল্প বয়সী বউ ভীষণভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে | আমি তাকাতেই সে বলল, “এখনও মড়ার মুখাগ্নি হল না, আর তুমি মিষ্টি খেয়ে মুখে জল দিলে ? ছি ছি ছি !” মনে করতে পারলাম না যাদের সাথে বসেছিলাম তাদের মধ্যে ওকে দেখেছি কিনা | আমি কিছু বলার আগেই সে মাথা পিছনে ঘুরিয়ে বলল, “এ কেমন  অলক্ষুণে কথা, দেখো দিদি ! কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার !” তার পিছন থেকে একজন বয়স্কা বউ উঁকি দিয়ে বলল, “কী সর্বনাশ ! চল চল, গিয়ে খবরটা ওদের বলি |” প্রথম বউটা মাথার কাপড় তুলে আঁচলের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে কাঁদো কাঁদো গলায়, “এর কী বিহিত হবে এখন ? হে ভগবান ! যে চলে গেল তার আত্মা এখন কী ভাবে শান্তি পাবে ?” বলে দরজা থেকে সরে গেল | আমি কী বলব, ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম | একটু সময় লাগল এই শক থেকে ধাতস্থ হতে | তারপর চট করে মিষ্টিগুলো কুঠরিতে ফেলে, ওখানে কলে হাত ধুয়ে করিডোরে বেরলাম | ওদের দু’জনকে কিন্তু কোথাও দেখতে পেলাম না |

লোকজনের গলা শুনতে শুনতে ঘরটায় পৌঁছলাম | ভিতরে ঢুকে কটা বাজে দেখার জন্য দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি কোনও ঘড়ি নেই | যারা বসে আছে তারা সব নতুন মুখ | স্পষ্ট বুঝলাম আমি যে ঘরে বসেছিলাম এটা সেই ঘর নয় | তাহলে আমি কি সত্যি হারিয়ে গিয়েছি ? দ্বিধা নিয়ে বেরিয়ে আসতে যাব, অমনি বসে থাকা বউদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠলো | দেখলাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে | একে একে সব বউরা নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করল | সেই বয়স্কা বউটা যে আমাকে মিষ্টির ঘরে উঁকি মেরে দেখেছিল, সে মাথা নাড়ল | অল্প বয়সী বউটা হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকল | আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, “কী ?” অমনি দু’তিন জন বউ সমস্বরে কথা বলতে লাগল | কেউ জিজ্ঞাসা করল, “এখনও মড়া পোড়ানো হয় নি, আর তুমি উপোষ ভাঙ্গলে ?” কেউ বলল, “এমন কাজ করলে ভাই !” আবার কেউ বলল, “আমরাও তো সবাই না খেয়ে আছি | ছি, ছি, ছি – কাজটা ভালো করলে না |” আমি ভাবলাম বলি, ‘আমি তো আপনাদের, বা যিনি মারা গেছেন তাঁর, কেউ নই | আর, আমি শুধু জল খেয়েছি, আর কিছু খাই নি |’ কিন্তু, ওদের আরও মতামত, মন্তব্য বলা শুরু হয়ে গেল – সবই আমার খেয়ে ফেলা নিয়ে কটু কথা | শুনে মনে হল না আমি ওদের অচেনা, ওদের পর | আমি ভীষণ হতাশ বোধ করলাম | একে না খেয়ে আছি সকাল থেকে, তারপর হারিয়ে গিয়েছি এই বাড়িটার গোলকধাঁধায়, আর জানি না শৈবাল কোথায়, কী করছে, আমি যে মিসিং আদৌ তা লক্ষ্য করেছে কিনা | আমি ছুটে করিডোরে বেরিয়ে এলাম |

জানি না কতক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মত যেদিকে পেরেছি হেঁটেছি | হয়ত এ্যাবসেন্ট মাইন্ডে বাইরে বেরোনোর পথ খুঁজছিলাম | কিছুক্ষণ পরে মনে হল সূর্য অস্ত গেছে | আলোটা আবছা হয়ে আস্তে আস্তে আঁধার ঘনিয়ে আসছে | অন্ধকার করিডোরে আমি সম্পূর্ণ একা |

আমি প্রায় কেঁদে ফেলব, হটাত কেউ পিছন থেকে এসে আলতো হাতে আমার ডান কব্জি ধরল – হাতের তালু খসখসে আর অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা – আর বলল, “এ কী ? তুমি এখানে ! সবাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা করছে |” গলা শুনে আন্দাজ করলাম বড় মামা | আমি ওনার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম | উনি বললেন, “তুমি কি ওদের কথায় রাগ করেছ ? ছেড়ে দাও মেয়েমানুষের কথা | ও সব গায়ে মাখতে নেই ... আমি এলাম তোমায় খুঁজতে, কেননা ওদিকে খুব ভয়ঙ্কর অবস্থা | শিগগির চলো | বাকি সবাই জড়ো হয়েছে, শুধু তুমি নেই |” আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল, তাই মুখ না ঘুরিয়ে, চলা না থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে ?”
-    “কতকগুলো ছেলে তোমার বড় মামার সাথে খুব মারপিট করেছে | ওকে বেদম মেরেছে |”
-    “কারা ? কেন মারল ? শৈবাল কই ? ও কেন এলো না আমাকে খুঁজতে ?”
আমি এক নিশ্বাসে প্রশ্নগুলো করে ফেলেই থমকে গেলাম | যে মানুষটা এই ভাবে বড় মামার কথা বলছে সে কী করে বড় মামা হবে ? মুখ তুলে পাশে তাকিয়ে দেখি বড় মামার মতই লম্বা চওড়া বেশ বয়স্ক একজন মানুষ | তার মুখের আদল বড় মামার মতই সৌম্য, কিন্তু চোখ দুটো কেমন অন্ধকার, নিষ্প্রভ | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কারা মেরেছে বড় মামাকে ? উনি এখন কোথায় ... আর, আপনি কে ?” লোকটা বলল, “তুমি আমাকে চিনবে না ... তোমার বড় মামা গিয়েছিল ওদের সাথে কথা বলতে, ওরা কেন আমাদের আগে অন্যদের চুল্লীর লাইনে ঢুকিয়েছে | সেই নিয়ে ... ওই দেখো, শৈবাল আসছে ! ওর কাছে শোনো কী হয়েছে ঘটনাটা |” লোকটা আমার হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল |

করিডোরের শেষে একটু আলোয় দেখলাম শৈবাল হন্ত দন্ত হয়ে আসছে | আমি ছুটে ওর কাছে যেতেই ও দাঁড়িয়ে পড়ে আমার হাত ধরল | তারপর আমায় টেনে ফিরে যেতে যেতে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি ? আমি কত খুঁজছি | শিগগির চলো ... বড় মামাকে ছেলেগুলো খুব মারধোর করেছে | বড় মামা কথা বলতে গিয়েছিল, ছেলেগুলো কেন আমাদের লাইন কেটে অন্যদের ঢুকিয়েছে | এই নিয়ে তর্কাতর্কি থেকে মারামারি |” আমি ওর সাথে সমান বেগে হাঁটার চেষ্টা করতে করতে বললাম, “এখন বড় মামা কোথায় ?” শৈবাল বলল, “ওখানেই |” “ওখানেই মানে ?” আমার প্রশ্ন শুনে শৈবাল আমার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, “সীমা, ওরা বড় মামাকে এমন মেরেছে যে বড় মামা চুল্লীগুলোর দরজার সামনে নেতিয়ে পড়ে আছে, উঠতে পারছে না | ছেলেগুলোর দলের সর্দারটা সবাইকে বলছে  ‘এখন লাইনে ইনি নেক্সট | জায়গা চাইছিলেন – জায়গা করে দিয়েছি |’ বড় মামাকে ওই অবস্থায় ফেলে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি | বাকি সবাই ওখানে |” আমি আঁতকে উঠে বললাম, “তার মানে ? কী হয়েছে খুলে বলছ না কেন ?’ শৈবাল বলল, “আমি হ্যর্সে তোতন মামার বডি নিয়ে বড় মামার সাথে বসে ছিলাম | কখন একটু চোখ বুজে এসেছিল | হঠাত শুনি খুব চেঁচামেচির আওয়াজ | চমকে উঠে চোখ খুলে দেখি বড় মামা নেই | চুল্লীগুলোর দিকে থেকে একটা হট্টগোলের শব্দ আসছিল | একজন ছুটে এসে আমাকে বলল, ‘শিগগির যান, ওনাকে বাঁচান |’ দৌড়ে গিয়ে দেখি ততক্ষণে ওরা বড় মামাকে মেরে প্রায় শেষ করে দিয়েছে | রক্তমাখা জখম দেহটা একটা চুল্লীর সামনে মাটিতে শুইয়ে রেখেছে | আমি গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতেই ওখানকার জটলা করে দাঁড়ানো একদল ছেলের মধ্যে একজন আমাকে বলল, ‘আর দেরী হবে না | লাইনে এখন ইনিই নেক্সট |’”

আমরা ততক্ষণে বাড়িটার সামনে বেরিয়ে এসেছি | আমি বললাম, “সে কী ? তোমরা কেউ কিছু প্রতিবাদ করলে না ? তোমরা এতগুলো মানুষ আর ওই কটা ছেলে ... ওরা ক’জন ? হাসপাতালে, পুলিশে কোথাও খবর দেবে না ?” শৈবাল বলল, “দেব, দেব | তক্ষুনি আমার প্রথম চিন্তা হল তোমাকে নিয়ে | তাই আমি আগে ছুটলাম তোমাকে খুঁজতে | এতগুলো ঘর, কোনটায় যে তুমি বসেছিল কিছুতেই চিনতে পারলাম না | তোমার সাথে ওই ঘরটায় যারা ছিল তাদেরকেও দেখতে পেলাম না ... এখন দেখি কী করতে পারি ... তুমি একটা কাজ করবে ?” আমি বললাম, “কী ?” শৈবাল বলল, “তুমি ওই হ্যর্সটার ভিতরে বসো | আমি যাই, অন্যদের ধরে বড় মামাকে তুলে নিয়ে আসি |” আমি আঁতকে উঠে বললাম, “না, না, ওতে ডেড বডি আছে ... আমি পারব না |” তাও শৈবাল প্রায় জোর করে আমাকে হ্যর্সটার কাছে দাঁড় করিয়ে সাইডের একটা দরজা একটু খুলে বলল, “ওঠো !” সারাদিনের ক্লান্তিতে তখন আমার চোখ জড়িয়ে ঘুম নামছে | বসতে পেলে শুয়ে পড়ি | জিজ্ঞাসা করলাম, “এত অন্ধকার যে, কটা বাজে এখন ?” “প্রায় সাতটা ... নাও, উঠে বসো” বলে শৈবাল আমার কাঁধে একটু চাপ দিয়ে চলে গেল | কিছুক্ষণ পরেই একজন দৌড়ে এসে হ্যর্সটার পিছনের দরজা দুটো সপাট খুলে দিল | দেখলাম শৈবাল আর কিছু লোক ধরাধরি করে নিয়ে আসছে বড় মামার বিরাট শরীর |

সীমার কথা থেমে গেল | তিন্নি বলল, “উফ ! কী বীভৎস ব্যাপার ! তুই ...”  সীমা উত্তর দিল না, কেননা মনে পড়ল ...

ওর দৃষ্টি কী ভাবে যে হ্যর্সটার ভিতরে চলে গিয়েছিল, হয়ত দেখতে যে বড় মামার দেহটা কোথায় রাখবে | তখনই চোখ পড়েছিল ভিতরে শোয়ানো তোতন মামার দেহটার দিকে | মুখের কাপড় সরানো | পিছনের খোলা দরজা দিয়ে আসা রাস্তার আবছা আলোয় বোজা চোখ দুটোর অন্ধকার গর্ত ঠিক দেখা না গেলেও, মুখটার আদল অবিকল বড় মামার মত – সৌম্য, বেশ অভিজাত – যেমন কিছু আগে ও দেখেছে করিডোরে | সীমার ডান হাতের কব্জি থেকে একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি শিরশির করে উঠে সারা শরীরে ছড়িয়ে গিয়েছিল | সীমা অবশ হয়ে পড়ে যেতে যেতে শুনেছিল, ক্ষীণ গলা থেকে ক্রমশ জোরালো হয়ে আসা শৈবালের ডাক, “সীমা ... সাতটা বাজছে ... আর না ... ওঠো এবার !”


----------------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ নভেম্বর ২০১৫

৩টি মন্তব্য:

Aloke Chatterjee বলেছেন...

ভয়ংকর ব্যাপার।

Aloke Chatterjee বলেছেন...

ভয়ংকর ব্যাপার।

Aloke Chatterjee বলেছেন...

ভয়ংকর ব্যাপার