শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৬

বুকা

|| বুকা ||


ভেবেছিলাম কথাগুলো কী ভাবে গুছিয়ে লিখব | কতদিন আগেকার কথা | আমার কী না কী মনে আছে | তোমাকে বললে তুমিই কি মনে করতে পারবে ? আর, কী ভাবেই বা বলব ? কেটে গেল সাতাশ থেকে সাতান্ন – তোমার খোঁজ নিতে আজ অব্দি কাছে যেতে পারি নি | কেন, সে কথা এখন থাক ... বা, একটু পরে না হয় !

আমি শুধু একটা প্রশ্ন করতে তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম – ওই কোকিলটা কোথা থেকে এলো ? আর এলো তো এলো, আমাকে ছাড়ে না কেন ? জানো, বছরের বড় জোর এক দু’ মাস – শ্রাবণে তুমুল বর্ষা নামার পর থেকে হেমন্তের শেষ অব্দি শুধু – কোকিলটা থাকে না | তারপর একদিন হঠাত এক ছিমছাম অমল সকালে শুনি তার হালকা গলায় প্রথম সংশয়ী কূ ডাক | ওই ডাক এক মূহুর্তে আমার মাস দুয়েকের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ভাঙিয়ে দিয়ে আমাকে সচকিত করে দেয় | ডেকেই একটু পরে ও আবার ডাকে, যেন আস্কারা চেয়ে ; আবার ডাকে একটু পরে | ক্রমশ ওর ডাক জোরালো হয়, ওর যে কী জেদই চাপে, আর ওর ডাকের লয় কত যে দ্রুততর হয় | শেষে গলাটা সপ্তমে তুলে চমকে উঠে ও ডাক থামিয়ে দেয় | কিছুক্ষণ পরে, যেন বুকে দম ভরে নিয়ে, ও আবার ফিরে ডাকে | ওর ওই ডাকের ওঠা নামা, ওর আসা যাওয়ার টানা পোড়েন আমাকে টেনে নিয়ে যায় এক অপার সময় সমুদ্রের কিনারে |

মনে পড়ে যায় পিয়ারুল, প্রত্যেক বার নতুন করে | নামটা কী মিষ্টি | বাবা সেবার বলেছিল আমরা গরম পড়লে পিয়ারুলে বেড়াতে যাব | সেখানে নাকি যে দিকেই তাকাও শুধু শাল গাছ | তখন কেন জানি আমার বুক ঢিপঢিপ করে উঠেছিল হটাত | সেই বয়সটায় আমার ওইরকমই হত হয়ত | ক’দিন আমার সবকিছু কেমন টানটান হয়ে উঠেছিল এক উৎসুক কাতরতায় | আর, বেশ কয়েক রাত আমি স্বপ্ন দেখছিলাম যে আমার মাথার উপর শালের মঞ্জরী, তার মাঝে কেউ লুকিয়ে আছে | আমি যেন জানি যে সে গাছের ডালে, পাতার ফাঁকে কোথাও লুকিয়ে আছে | কিন্তু মাথা তুলে দেখতে সাহস পাচ্ছি না, যদি সে পালিয়ে যায়, মাথায় মঞ্জরী খসিয়ে |

প্রথম দিন তুমি এলে, আর ছোট পিসি তোমার পরিচয় দিয়ে আমায় আভাস দিল যে তুমি আমার চেয়ে বড় | হয়ত ছিলে | মাথায় তো ছিলে, কিন্তু চোখ দেখে মনে হল না | তোমার চোখে দেখলাম একটা লুকানো কিছুর রহস্যময় বিহ্বলতা, যেমন লক্ষ্মী ট্যারার দৃষ্টিতে হয়, যেন তুমি এমন কিছু দেখে নিয়েছ যা চাও না আর কেউ দেখুক | আমার প্রথমেই ভয় হল তুমি আমাকে সরল মনে নেবে না | আমাকে নেয়ার কথা কেন ভেবেছিলাম তা মনে নেই | তবে ছোটবেলায় আমার একটা ভয় ছিল আমাকে ভালো কেউ নেবে না | আসলে মা আমাকে ছোটবেলা থেকে শাসন করার বদলে ভয় দেখিয়ে বলত, তোকে ভালো কেউ নেবে না | কিন্তু, তা তো হল না | দু’দিনেই – আমার ঠিক মত ভাবও হয় নি – তুমি এসে পিসিকে বললে, রবার্টসন সাহেবের বাড়িতে নাকি একটা সাদা ময়ূর এসেছে – সে ভারী সুন্দর, আর আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি সাদা ময়ূর দেখেছি কিনা | আমি দ্বিধায় মাথা নেড়েছিলাম | ভয় ছিল সত্যি বললে যদি কিছু হয়, যদি তুমি আমার কথা অবিশ্বাস করো | আমি যে চাইছিলাম তোমার সাথে যেতে | কোথাও |

পরদিন আমি পিসিকে বলে তোমার সাথে গেলাম সাদা ময়ূর দেখতে | মেম-ঝিলের পাশ দিয়ে সাতটা কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচ দিয়ে কত দূরে আমার চলে গেলাম | আমরা কোন কথা বলি নি | তুমি আমাকে মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছিলে | শুধু একবার আমাকে তুমি বললে, “হারিয়ে গেলে একা ফিরতে পারবি ?” আমি মাথা নেড়েছিলাম | শীলঘাটা হলে অন্য কথা ছিল | ওখানে অনেক রিকশাওয়ালা আমাদের বাড়ির সবাইকে চেনে | কিন্তু পিয়ারুলের রিকশাওয়ালারা তো সব অচেনা | ওদের সাঁওতাল হাসি আমি বুঝতাম না | সারাদিন অলস বসে থাকত, আধো স্বরে কথা বলত, আর ঝকঝকে
সাদা দাঁত বের করে হেসে থুতু ফেলে আবার হাসত | মনে হত না ওরা কোনও কাজের লোক | হয়ত রিক্সায় উঠলে আধপথ নিয়ে যাবে | পরদিন পিসির বাড়ি এসে তুমি দেখবে আমি নেই | আর রিকশাওয়ালাদের জিজ্ঞাসা করলে ওরা থুতু ফেলে হাসবে |

তো, সেই লাল ইটের দেয়ালে ঘেরা বাংলোর উঠোনে আমি দেখলাম সাদা ময়ূরটা, দিব্যি দর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে | আমার কেন জানি না ঠিক ভালো লাগেনি | আমার বেশি ভালো লেগেছিল, পিছু টানছিল মেম-ঝিল, লেক ঘিরে কৃষ্ণচূড়ার সাতনরী – তুমি বলেছিলে কথাটা, ভুল বলেছিলে | আর, ভালো লেগেছিল বুকা মাহাতোর শালের বাগানের ভিতর দিয়ে শর্টকাট | শর্টকাট কথাটা সেই প্রথম তোমার কাছে শুনেছিলাম |

আমি কি তখন জানি যে ওই বুকা মাহাতোর শালের বাগান আর থাকবে না | আর তার কোকিলটা – ওখানেই আমি প্রথম যার ডাক শুনেছিলাম – আমার চেতনায় ঠাঁই নেবে | একই কোকিল, না অন্য কোন ? কোকিল ক’বছরই বা বাঁচে ?

ন’বার যখন তুমি আমায় নিয়ে যাচ্ছিলে রবার্টসন সাহেবের বাড়ি, ওই বুকা মাহাতোর শালের বাগানে হঠাত শুনলাম সর্বাঙ্গ শিউরে দেয়া একটা মায়াডাক | আমি চমকে উঠে উপরে তাকালাম উৎসটা দেখার জন্য | সোজা সোজা উঠে যাওয়া ঋজু শালের গুঁড়ির মাথায় অনচ্ছ সবুজ ছাউনির আকাশ | আমি তাকিয়ে রইলাম বুকের ঢিপঢিপ চেপে | তুমি আমার হাত ধরে টেনে বললে, চল, কিছু দেখতে পাবি না | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ও কে ডাকল ? তুমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, সে কী, তুই জানিস না ওটা কোকিল ? আমি জানতাম না | তাই বললাম, আমি কোকিল দেখব | তুমি বললে, আচ্ছা, ফেরার পথে দেখিস |

ফেরার পথে তুমি আমাকে নিয়ে শাল বাগানে দাঁড়ালে, আর বললে চুপ করে থাকতে | চুপ করেই ছিলাম, হটাত পায়ের কাছে জমিতে পড়া শুকনো শালপাতার মধ্যে থেকে সরসর করে একটা শব্দ হল | আমি ভয় পেয়ে তোমার গা ঘেঁসে দাঁড়ালাম | তুমি আমাকে টেনে তোমার গায়ে এক করে চুপ করে থাকলে | সে কতক্ষণ ! তারপর তুমি আমাকে দেখালে দূরে একটা বাদামী হলুদ সাপ | তার সারা শরীরের উপর কালো কালো ছাপ | আর, পিঠের উপর দিয়ে দুটো হলুদ ডোরা চলে গেছে লেজ অব্দি | আমাকে বললে, ওই দেখ, সাপটা চলে যাচ্ছে | চল এবার বাড়ি যাই | আমি তখন তোমার স্পর্শে, শাল মঞ্জরীর গন্ধে, বৈশাখের উত্তাপে আড়ষ্ট |  তোমার মা হতে তৈরি বুকে আমার মাথাটা মিশে যেতে দেখে তুমি চাপা এক হাসিতে হিলহিল করে উঠে বললে, এই ঢোঁড়া সাপ ! তুইও কি ঢোঁড়া সাপ ? তুই এমন চুপ করে গেছিস কেন ?

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, তুমি কি কোকিল দেখাবে না ? তুমি বললে, সেই লুকানো কিছুর অদ্ভুত আলো আঁধার ভরা মায়াচোখ নাচিয়ে, বুকা, জানিস না, কোকিল এমনি দেখা দেয় না | কোকিলের ডাক শুনতে পাবি, দেখা পাবি না |

কথাটা ঠিক তাই হল | আমি কত বনে জঙ্গলে যে ঘুরেছি – আম কাঁঠালের গাছে ঠাসা বাগানে গিয়ে বসে থেকেছি, কখনও কখনও হাতে ক্যামেরা নিয়ে | না | ছবির বইয়ে কোকিলের ছবি দেখেছি | অথচ, আমার কোকিলটা আমার সাথে থেকেছে, দেখা দেয় নি | তাই সন্দেহ হয়, কোকিলটা কি সত্যি | নাকি এটা আমার একটা ভ্রম | আমি যে মাঝে মাঝে ওর ওই নিঃসঙ্গ ডাক সহ্য করতে পারি না |

কী করতে পারতাম ? আবার পিয়ারুল যেতাম ? তোমাকে বলতাম ? তোমাকে বললে কি তুমি দেখিয়ে দিতে ? আমার কোকিলটাকে আমার থেকে আলাদা করে দিতে পারতে ? কিন্তু তাই বা কী করে হত | কোকিলটা তো এলো আরও ষোল বছর পরে, আমার সাতাশ পার হতেই |

সে দিন থেকে জীবনের এই রোগ লক্ষণ শুরু, সে কবেকার কথা | আমার আঠাশতম জন্মদিন ছিল সেটা | বন্ধুদের সাথে পুরী বেড়াতে গিয়ে হোটেল থেকে মাকে ফোন করেছিলাম | ফোনটা তোলার ঠিক আগে শুনলাম জানালার বাইরে ভুলে যাওয়া পিয়ারুলের কোকিলের ডাক | মনে পড়ে না পিয়ারুলের পরে এর আগে কখনও আমি কোকিলের ডাক শুনেছি | তাই মনে হয় সেইদিনই ওই কোকিলটা আমার সঙ্গ নিলো | সেই ডাকটা ছিল তীক্ষ্ণ আর আর্ত – যে ভাবে ভূমিকম্পের সময় মায়ের শঙ্খধ্বনিতে বাজতে শুনেছি – যেন কোকিলটা বলতে চাইল আমার দুঃসময় আগত |

কিন্তু, ফোনে আমার মৌখিক প্রণাম নিয়েই মা বলল, ভালো খবর আছে, তোর জন্য একটা মেয়ে খুব পছন্দ হয়েছে | খুব স্মার্ট আর ফর্সা | তুই কবে দেখতে আসবি বল | আমি একদম ছুটি পাই নি সে বছর | তাই আভাকে দেখতে গেলাম প্রায় এক বছর পরে | আমার বিপরীত, অসম্ভব সপ্রতিভ | এর পর ওকে দেখলাম বিয়ের রাত্রে | আমাদের ফাল্গুন মাসে বিয়ে হয়েছিল | বিয়ের লগ্ন ছিল গভীর রাতে | বিয়ের মন্ত্র পড়ব কি, কাছেই কোথাও কোকিলটা এসে জুড়ে বসল, আর ক্রমাগত ককিয়ে ডেকে গেল | কী বুক ভাঙ্গা সেই ডাক |

বাসর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, আভাও আমার পাশে পিঠে বালিশ দিয়ে ওর খোঁপায় ভারী মাথা আমার কাঁধে রেখে চোখের পাতা নামাল | কোকিলটা আবার ভর করল, পাগল করল ডেকে ডেকে | একবার ভাবলাম উঠে গিয়ে দেখি | কিন্তু আমি তো ইতিমধ্যে আভার সাথে গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়ে গেছি |

ফুলশয্যার রাত্রে আভাকে প্রথম দেখলাম ঠিক করে | বা বলা যায়, প্রথম সবার থেকে আলাদা করে | আমি ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিতেই কোকিলটার ডাক শুনলাম | একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম কিনা জানি না | আভার চন্দনে সাজানো অসম্ভব ফর্সা মুখে মনে হল কিছুর একটা ছায়া পড়ল | বলল, কখন থেকে ওই কোকিলটা বড্ড বিরক্ত করছে ডেকে ডেকে | এই জানালার বাইরেই কোথাও আছে | বন্ধ করে দিই ? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ও উঠে জানালটা বন্ধ করে দিল | আমি ক্লান্ত ছিলাম | বিছানায় গা এলিয়ে বালিশে মাথা ফেললাম | আভা পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে শাড়ির খসখস, চুড়ি বালার রিনরিন আর পান খাওয়া মুখের গোলাপজলের গন্ধের জাল ফেলে আমাকে ঘিরে ফেলে জিজ্ঞাসা করল, ঘুম পেয়েছে ? আমি বললাম, একটু | ও খুব হালকা ঠাট্টার গলায় জিজ্ঞাসা করল, আর ফুলশয্যার আদর ? পাচ্ছে না ?

তার কথা আগে ভাবি নি, বা ভেবে থাকলেও সেই মূহুর্তে মাথায় আসে নি, হয়ত ক্লান্তিতে | কী উত্তর দেব ভাবার আগেই আভা মুখটা নামিয়ে নিয়ে এলো | নিশিবাতির স্নিগ্ধ আভায় উদ্ভাসিত বিছানাটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো বহ্নিশিখায় | আর সেই রাত, সারা রাত, একটা সাদা ময়ূর আমাকে ঠুকরে ঠুকরে খেল | নিজেকে মনে হল আমি এক নির্জীব সাপ হয়ে পড়ে আছি ওই সাদা ময়ূরের ধারালো চঞ্চু আর নখের নিচে |

আশ্চর্য হলাম না মোটেই, যখন খুব শিগগিরই আভা ধরে ফেলল যে আমি প্রায় সারা বছর, দিনরাত কোকিলের ডাক শুনি | ধরে ফেলল, কেন না ডাকটা শুনলেই আমি ব্যাকুল হয়ে আমার স্মৃতিতে বুকা মাহাতোর শালের বাগানে ফিরে যাই | তখন আমার চোখের মণিতে তাকালে দেখা যাবে আকাশভেদী শাল গাছের গুঁড়ি, আর তার উপরে ছাওয়া সবুজ শালের পাতা – যার মাঝে কোকিলটা লুকিয়ে | আভা মাকে কিছু জানালো না | আভা কাউকে কিছু বলার মত মানুষ নয় | ও চুপচাপ কাজ করার মানুষ | তাই ও সাদা ময়ূরটাকে বাগ মানাতে শুরু করল | বুনো ময়ূরটা কী ভাবে ওর যে বশ হয়ে গেল জানি না | কিন্তু তিন পক্ষের খেলা ঘোর হয়ে উঠল | কোকিলটা, একটা সাদা ময়ূর আর আমি, এক নির্জীব ঢোঁড়া সাপ | বশ মানানো ময়ূর বড় ভয়ঙ্কর হতে পারে, বড় হিংস্র হয়ে খেলাতে পারে তার শিকারকে | সেই খেলায় যেন সাপটাও আমার থেকে আলাদা হয়ে ক্রমে ক্রমে পাকা সেয়ানা হয়ে উঠল | রোজ রাতে যখন কোকিলটা ডাকে, আভা সংসারের কাজ গুছিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে জানালাটা বন্ধ করে | তারপর নীল নিশিবাতিটা জ্বেলে রূপ বদলে সাদা ময়ূর হয়ে ঘনিয়ে আসে পরিশ্রমের বিছানায় | সাপটা তার উপর চোখ বুজে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে আছে | জানে ময়ূরটা এসে নখর নখে তাকে ধরে, নামিয়ে আনবে তার শরীরের উপর দুই ধারালো চঞ্চু | তারপর সেই চঞ্চু একটু একটু করে সাপটার খোলস ছাড়াবে | চাপা শীৎকারের সাথে সাথে ছটফট করে সাপটার শরীর ছিঁড়ে ফালাফালা করবে | বাইরে কোকিলটাকে বোবা করে রাত গভীর হবে | তারপর ময়ূরটা, প্রোথিত বিমথিত ময়ূরটা, এক জৈবিক নির্যাস নিকষিত করে নেতিয়ে নিজের মসৃণ মসলিন আবরণে ঢুকে পড়বে | সাপটা তার ফালি ফালি শরীরটা জড়ো করে একটা জামায় পুরে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে, ধুঁকবে | তখন কোকিলটা আবার ডাকবে, জানাবে, ও জেগে থেকেছে, সব শেষ হতে দেয় নি | চাঁদের আলো মেঘের আড়াল থেকে সাবধানে উঁকি মেরে পরিস্থিতি সহজ দেখে লাফ দিয়ে বেরিয়ে স্বস্তির হাসি হেসে চারিদিক আলো করবে | গাছের পাতায় শিরশির করে হাওয়া বলবে, ভোর হতে চলল | সেই খুশিতে কোকিলটা চঞ্চল হয়ে আবার ডাকবে | সাপটা বুকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বুকা মাহাতোর শাল বাগানে ফিরে যাবে |

এই ভাবেই আমি রোজ ঘুমিয়ে পড়েছি বছরের পর বছর | আর চেয়েছি বার্ধক্য | কিন্তু, ফিরে যেতে পারি নি পিয়ারুলে | পিসির মেয়ে সুরুচির কাছে খবর চেয়ে পেয়েছি – তোমার সেবায় থেকে রবার্টসন সাহেব মারা যাওয়ার পর তোমার কোন খবর নেই | সাহেবের বাংলো ভেঙ্গে পড়েছে | বুকা মাহাতোর শাল বাগান গাছ কেটে কেটে শেষ |

কাল রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম | একটা শ্যামবর্ণ হাতের পাতা চিত করে ধরা, যার রেখাগুলো সুগভীর | তার উপর চন্দন রঙের একটা ভারী সুন্দর সাপ বুক পেতে শুয়ে | নির্মোক হীন সাপটার বাকি দেহ সেই হাতেরই কব্জি জড়িয়ে | যেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্লীওপাত্রার হাতের এক আভরণ | আর একটা তেমনই শ্যামবর্ণ হাত সাপটার মাথার উপর আলতো করে রেখে বুলিয়ে ওকে আদর করছে | আমি বললাম, কী করছ ? তুমি বললে, ওকে বলছি, আমার ভাগ্যরেখায় পড়ে থাকিস না, সরে যা |

সারাদিনে অনেকবার আভা এসে দেখে গেছে আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছি | ওর কোন কৌতূহল নেই কাগজ পত্রে | ও শুধু জানে আমি একটা চিঠি লিখছি কাউকে, যার ঠিকানাটা সুরুচিকে বলেছি দিতে | আভা একবার দু’বার জিজ্ঞাসা করেছে, কতদিন ধরে চিঠিটা লিখছ | শেষ করবে না ?

ঠিক কথা, কিন্তু, একটু আগে সুরুচি ফোন করেছিল | বলতে, তুমি আর কোনও ঠিকানায়ই নেই |

তবুও কলমটা তুলেছি | একটা কথা না লিখলেই নয়, যা কাল হটাত মনে পড়েছে, আর আমি ধরে ফেলেছি কোকিলটাকে |

সেবার শেষদিন যখন আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে দেখাবে না কোকিল ? তুমি বলেছিলে, চল তাহলে বুকা মাহাতোর বাগানে | কই, ওখানে গিয়ে তো তুমি আমাকে কোকিল দেখালে না | শুধু, চারিদিক দেখে, তোমার কাছে আমায় টেনে তোমার হাতের তালু আমার বুকে চেপে বললে, বুকা কোথাকার ! কোকিল এখানে থাকে | বুঝিস না, তুই ?

আমি বুঝেছি, এখন বুঝছি, সেদিন তুমি তোমার হাতের তালু দিয়ে ঠেলে আমার বুকের কপাট খুলে একটা কোকিল ঢুকিয়ে দিয়েছিলে | সে ডাকত, আর আমি বুকার মত তাকে বাইরে বাইরে খুঁজতাম | তাই না, আয়াদি ?


-----------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৬ এপ্রিল ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই: