শনিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৬

সাপ

|| সাপ ||

উষ্ণ, উত্তপ্ত একদিন, যখন খরতাপে আমি ছিলাম পায়জামায়,
আমার জলাধারে এসেছিল সাপ এক
জল খেতে

বিশাল, নিরালোক তেঁতুল গাছের সুনিবিড় অচিন-গন্ধী ছায়ায়
আমি নেমেছিলাম সিঁড়ি বেয়ে, জলের পাত্র সমেত
কিন্তু যেহেতু ও ছিল জলাধারে আমার আগে, আমাকে দাঁড়াতে, অপেক্ষা করতে হয়

মেটে-দেয়ালের এক ফাটল থেকে ও নেমে এসেছিল আবছায়ায়
আর পাথরের জলাধারটার কানার উপর ও লতিয়ে নিয়ে গিয়েছিল
ওর পীতাভ-পিঙ্গল শিথিলতা, ওর নমনীয় পেট উপুড় করে
আর, রেখেছিল ওর গলা  নিচের পাথরের উপরে
এবং, যেখানে নল থেকে জল চুয়ে পড়েছিল, সেখানে এক সংকীর্ণ স্বচ্ছতায়
ও চুমুক দিয়েছিল ওর সরল মুখে
মৃদু ভঙ্গিতে সরল মাড়ির ভিতর দিয়ে,
ও শুষে নিয়েছিল ওর লম্বা ঢিলে শরীরের অন্তরে
নিঃশব্দে

কেউ তো ছিল আমার জলাধারে আমার পূর্বগামী
আর, দ্বিতীয় এক আগতের মত, প্রতীক্ষায় আমি

ওর জল পান থেকে ও উঁচিয়েছিল ওর মাথা, যেমন করে গবাদি পশু
আর দেখেছিল আমার দিকে ভাসাভাসা দৃষ্টিতে, পানরত গবাদির মত
ওর ঠোঁট থেকে লকলক করে উঠেছিল ওর দ্বিশৃঙ্গ জিভ
এবং মুহূর্তের জন্য  ও তন্ময় হয়েছিল
আর, ঝুঁকে আরও একটু জল খেয়েছিল
সেই সিসিলিয় জুলাইয়ের দিনে, যখন এতনা ধূমায়িত
জ্বলন্ত ভূগর্ভ হতে নিঃসৃত ওর মেটে-পিঙ্গল, মেটে-স্বর্ণাভ আভা দেখে
আমার শিক্ষাদীক্ষা সরবে আমায় বলেছিল
ওকে বধ করতে হবে
কেননা সিসিলিতে কৃষ্ণ-কালো সাপেরা নির্দোষ, আর সোনালীরা বিষধর

আর আমার অন্তরের স্বরেরা বলেছিল আমায়, তুমি যদি প্রকৃত পুরুষ হতে
তুমি হাতে লাঠি নিতে, ওকে ভেঙ্গে ফেলতে, ওকে শেষ করতে

কিন্তু, আমাকে কি স্বীকার করতেই হবে ওকে আমার কত ভালো লেগেছিল
কত খুশি হয়েছিলাম আমি, যে ও অতিথির মত নীরবে এসেছিল
আমার জলাধারে জল খেতে
আর শান্ত, প্রশমিত হয়ে অকৃতজ্ঞের মত ফিরে যেতে
পৃথিবীর জ্বলন্ত গর্ভে?

সেটা কি ছিল আমার কাপুরুষতা, যে আমি ওকে মারতে সাহস পাই নি ?
নাকি বিকৃতি যে আমি ওর সাথে আলাপের আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম ?
নাকি বিনম্রতা, এত সম্মানিত বোধ করায় ?
আমি কত সমাদৃত যে বোধ করেছিলাম !

কিন্তু সেই সব কণ্ঠস্বরেরা:
তুমি যদি না ভয় পেয়ে থাকতে, তুমি ওকে মেরে ফেলতে !

আর, সত্যিই তো আমি ভয় পেয়েছিলাম, বড় বেশি ভয়
অথচ তা সত্ত্বেও, আরও বেশি হয়েছিলাম সম্মানিত
যে ও আমার আতিথেয়তা চাইবে
গোপন জগতের আঁধার দুয়ার থেকে আগত

ও যথেষ্ট পান করেছিল
আর মাতালের মত মাথা উঁচিয়েছিল, স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে
এবং, ঠোঁট চেটে নেয়ার ভঙ্গিতে
বাতাসে ওর জিভ লকলক করেছিল দ্বিশৃঙ্গ নিশার মত, সে কী কালো
আর, ও দেবতার মত দেখেছিল, দৃষ্টিহীন, চারিপাশে বাতাসে
আর, ধীরে ওর মাথা ঘুরিয়েছিল
ধীরে, অতি ধীরে, যেন ত্রিগুণ স্বপ্নমগ্ন
এগিয়েছিল ও সর্পিল ভঙ্গিতে ওর মন্থর দৈর্ঘ্য টেনে নিতে
আর, আবার আমার দেয়ালের গায়ের ভাঙ্গা পাড়ে উঠে পড়তে

এবং, যেই ও ওর মাথা গুঁজল সেই ভয়ঙ্কর কোটরে,
যেই ও ধীরে থামল, ওর কাঁধে সর্পিল আয়েস মাখিয়ে, আর আরও ভিতরে সেঁধিয়ে গেল
এক ধরনের ভয়, এক ধরনের প্রতিবাদ – ওই ভয়ঙ্কর অন্ধকার কোটরে ওর প্রস্থানের বিরুদ্ধে,
সুচিন্তিত ভাবে অন্ধকারে ঢুকে পড়ে তারপর নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে –
আমাকে অভিভূত করল, যেই ওর পিঠ আমার দিকে ফিরল

আমি নামিয়ে রাখলাম আমার হাতের পাত্র, আমি ঘুরে দেখলাম,
আমি তুলে নিলাম একটা বেকায়দা চ্যালাকাঠ
আর সেটা ছুঁড়লাম জলাধারের দিকে সশব্দে

আমার মনে হয় তাতে ওর আঘাত লাগেনি
কিন্তু হঠাত ওর পিছিয়ে পড়া অংশটা এক অশালীন ব্যস্ততায় আন্দোলিত হল
মোচড় খেল বিদ্যুতের মত, আর তারপর মিলিয়ে গেল
সেই অন্ধকার কোটরে, আমার দেয়ালের গায়ে মেটে-ঠোঁটের মত ফাটলে
যা দেখে, সেই প্রখর স্তব্ধ দুপুরে, আমি চেয়ে রইলাম এক বিমুগ্ধ আকর্ষণে

আর সেই মুহূর্তেই আমার অনুতাপ হল
মনে হল আচরণটা কী সামান্য, কী অশোভন, কী ইতরই না ছিল
আমি ঘৃণা করলাম নিজেকে, আর আমার অভিশপ্ত মানুষী শিক্ষাদীক্ষার স্বরকে

আর আমার মনে পড়ল সেই সমুদ্রের পাখির কথা
আর আমি চাইলাম যে ও – আমার সাপ – ফিরে আসুক

কারণ, আমার আবার মনে হল যে ও রাজসিক
নির্বাসিত রাজা সম, অধোভুবনে মুকুটহীন
যার এখন আবার অভিষিক্ত হওয়ার সময় হয়েছে

আর, তাই আমি সুযোগ হারালাম জীবের প্রভুদের একজনের সাহচর্যের
এবং, আমায় খেসারৎ দিতে হবে কিছুর;
এক ক্ষুদ্র মানসিকতার |


(অনুবাদ - D. H. Lawrence, "Snake")

-------------------------------------
© ইন্দ্রনীর – ০৯ এপ্রিল ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই: