শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৬

দেখা

|| দেখা ||


স্টাফ-রুমে  ঢুকে বুকে চেপে ধরা বইগুলো নামিয়ে চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে নীতা দেখল বড় টেবিলটার এক কোনে দীপা চুপ করে বসে আছে | সামনে একটা খোলা খাতা, হাতে ধরা কলম, কিন্তু শরীরের নিস্তেজ ভঙ্গি দেখে মনে হল ওর মন ওই দুটোর মধ্যে নেই | নীতা চেয়ার টানলে একটু আওয়াজ হল, কিন্তু দীপা ধ্যানস্থ হয়েই বসে রইল, নড়ল না, তাকাল না | নীতা বসে পড়ে বলল, “এই, কী হয়েছে তোর ?” একটু পরে মাথাটা খুব আস্তে ঘুরিয়ে দীপা বলল, “হরষে-বিষাদ কথাটার মানে কী জানিস ?” নীতা বলল, “হরষে-বিষাদ . . . আমি তো জানি হরিষে বিষাদ . . . যাকগে, হটাত এই কথাটার মানে কেন জিজ্ঞাসা করছিস ? কিছু হয়েছে ? তোর মেয়ে কেমন আছে ?”

উত্তর না দিয়ে দীপা মাথা নামিয়ে খোলা খাতায় একটা টিক দিল, তারপর পাতা ওলটাল | নীতা উঠে গিয়ে দীপার পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলল, “কিছু বলবি না ?” দীপা মুখটা তুলে একটু হাসল – ম্লান হাসি, যেমন মেঘলা দিনে চর জেগে ওঠা গাঙের বুকে দূরের জল চিকচিক করে ওঠে কোন অদৃশ্য সূর্যের ছটায় | তারপর পাশের চেয়ারটা টেনে বলল, “কাছে বোস, বলছি |” নীতা বসলে দীপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল -

কাল রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি | দেখেছি ওর সাথে কোথাও বেড়াতে গিয়েছি | আমরা একটা হোটেলে উঠেছি | তার চারিদিকে ঢালাও খোলামেলা প্রকৃতি, হাতছানি দিচ্ছে বেড়াতে যাওয়ার জন্য | কী সুন্দর সিন্যরী ! আমরা লবিতে বসে দেখছি, আর ভাবছি কখন বেরব | আমি ওয়াশরুমে গেলাম | ওয়াশরুমেও বড় বড় জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে | তখন দেখি ওয়াশরুমের পিছন দিকে একটা দরজা | কী কৌতূহলে দরজাটা খুললাম | পিছনে চারিদিক একেবারে গাছে গাছে ঢাকা, সবুজে সবুজ, মুগ্ধ করে দেয়ার মত | আর ওই দরজা থেকে একটা পায়ে হাঁটা পথ তার মধ্যে চলে গেছে | আমি ওর কথা ভুলে গেলাম, কোথায় আমি, কী করছিলাম সব ভুলে গেলাম | সব ভুলে গিয়ে ওই পথ ধরে রওনা দিলাম, যেন আমি জানি কোথায় যেতে হবে | কী সুন্দর, কী পরিষ্কার চারিদিক, কোথাও কোন আগাছা নেই, নিচে সবুজ ঘাসে একটা ময়লা, একটা খড়-কাঠি, একটা কুটো, কি একটা শুকনো পাতা নেই, চারিদিক শুধু সবুজ পাতা ছাওয়া বড় বড় গাছ | এইভাবে বাইরেটা আমাকে সব ভুলিয়ে দিয়ে টেনে নিয়ে চলল | কিসের টানে যে আমি কোন ভয় না করে এগিয়ে গেলাম তা আমি জানি না | কতদূর চলে গিয়েছি এই ভাবে হুঁশ হারিয়ে | তারপর দেখলাম গাছগুলো একটু ফাঁকা হচ্ছে, মাঝখানে বেশ খানিকটা পরিষ্কার জায়গা, যেন কেউ ওই ভাবে জায়গাটা তৈরি করেছে | গাছগুলো যত্ন করে সাজানো, নিচে কেয়ারি-করা ফুলবাগান  আর সমান করে ছাঁটা ঘাস, তার মধ্যে একটা বসার বেঞ্চ | বুঝলাম আমি কোন পার্কে পৌঁছেছি | সেই বেঞ্চে একটা বউ বসে, আর তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একজন হাবভাব ভঙ্গিতে বয়স্ক লোক, যে কোন কারণে বউটার থেকে সরে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে – যাকে সে সাথে করে নিয়ে এসেছে, কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না, অপেক্ষা করছে কখন সে ফিরে যেতে চাইবে | লোকটার মুখটা দেখতে না পেলেও বুঝলাম লোকটা মনের দৃষ্টিতে বউটার দিকে তাকিয়ে আছে, সেই দৃষ্টিতে একসাথে বিস্ময়, কৌতূহল, অপেক্ষা, আকাঙ্ক্ষা সব মিশে আছে | দুজনেই চুপ |

আমি কাছে যেতেই বউটা আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আর উঠে দাঁড়াল | অল্প বয়েস | লম্বা, সুঠাম, সুন্দর চেহারা | গায়ের রঙ ফর্সা নয় ময়লা, কিন্তু মুখের আদল অপূর্ব সুন্দর – যেন তার সব কটা বৈশিষ্ট্য কোন শিল্পীর খুব যত্ন করা হাতে ছেনি দিয়ে ছিলা-কাটা | মাথা ভরা কোঁকড়ানো চুল কাঁধ ছাপিয়ে উপচে পড়ছে | আর কী শান্ত চোখের দৃষ্টি, কত সৌম্য মুখের ভাব | আমি এমন সুন্দরী আর একজন দেখি নি | আমি ওকে দুচোখ ভরে দেখছি দেখে ও একটু হাসল | আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “সুখবরটা পেয়েছেন তো ?” ও মাথা নাড়ল, যেন খবরটা কেউ না বললেও
ওর জানা | আমি বললাম, “আপনি খুশি ?” ও বলল, “আমি খুউব খুশি |” আমি বললাম, “আপনার ছেলে আপনাকে মিষ্টিও পাঠাবে |” ও বলল, “পাঠাবে ? আমি মিষ্টি পাবো ?” আমি বললাম, “হ্যাঁ পাবেন, ও নিশ্চয় পাঠাবে |” ও বলল, “তবে তুমি ওকে বোলো দুটোর বেশি নয় |”

ওর কথা শুনতে শুনতে আমি চোখ ফেরাতেই পারছি না | এত সুন্দর মুখশ্রী, আর তাতে এত আনন্দ | কিন্তু এই শেষ কথাটা বলতে গিয়ে ওর মুখে একটা ছায়া পড়ল | ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি যাচ্ছেন তো ?” আমি বললাম, “আমি যাব, খুব শিগগিরই যাব | আপনি যাবেন না ?” ও বলল, “আমিও যাব |”

আমার হটাত মনে হল, এর টানেই কি আমি সব ভুলে ছুটে এসেছি | না হলে, আমি কেন ওর  মুখ থেকে আমার দৃষ্টি সরাতে পারছি না ? আমি কি ওকে আগে কখনও না দেখে থাকলেও সেই মুহূর্তে চিনেছিলাম ? এই সব প্রশ্নের চিন্তায় আমি একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম হয়ত, হয়ত আমার দৃষ্টিটা এক মুহূর্তের জন্য আবছা হয়েছিল | আবার দৃষ্টি স্পষ্ট হলে দেখলাম দুজনে নেই | আমি তখন ওই পথেই তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে এলাম |

দীপার বলা শেষ হলে নীতা জিজ্ঞাসা করল, “তুই কবে যাচ্ছিস মেয়ের কাছে ?”
দীপা, “এখনও দেরী আছে |”
নীতা, “ডেট কবে দিয়েছে ?”
দীপা, “বলছে তো এক্সপেক্টেড ডেলিভারি আশ্বিনের মাঝামাঝি, তবে এক আধ সপ্তাহ আগেও হতে পারে |”
নীতা, “তুই তোর মেয়েকে স্বপ্নটার কথা বলবি ?”
দীপা, “কী বলব ? যে ওর শাশুড়িকে স্বপ্নে দেখেছি | ওনাকে তো আমি দেখিই নি | শুনেছি, উনি আমার জামাইকে জন্ম দিয়ে মারা যান |”
নীতা, “তবে কী করে মনে করছিস যে ওটা তোর বেয়ান ছিল ?”
দীপা, “কে জানে, হয়ত ওই জামাইয়ের মত কোঁকড়া চুল, ওর হাসি, ওরই গায়ের রঙ . . . জানি না রে . . . বা, হয়ত ওর কাছে যে বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে ছিল সে আমার বেয়াই ছিল | সেই রকমই লাগছিল তার দেহভঙ্গি দেখে |”

এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে নীতা আবার দীপাকে স্টাফ-রুমে একা পেয়ে বলল, “কেমন আছে তোর মেয়ে ?”
দীপা, “ভালো আছে | এই তো স্কুলে আসার আগে ফোনে কথা হল |”
নীতা, “কিছু মনে করিস না . . . জিজ্ঞাসা করছি  . . . তোর সেই স্বপ্নের কথাটা তুই মেয়েকে বলেছিস ?”
দীপা, “হ্যাঁ বলেছি | আমার বরও আমাকে চাপ দিচ্ছিল | ক’দিন আগে মেয়েকে বললাম | বললাম, জামাইকে বলিস | ও বলল, ওকে ফোনটা দিচ্ছি, তুমি নিজের মুখে বল | জামাইকে বললাম | শুনে জামাই একটু চুপ করে থেকে বলল, মা, আপনি বাবাকে একটু বলবেন এই কথা ? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, উনি কিছু মনে করবেন না তো ? ও বলল, না | আমি বললাম, কিন্তু বলার দরকার আছে কি ? জামাই বলল, আপনি বলে দেখুন, বাবা হয়ত কিছু বলতে পারে |”
নীতা, “তুই বললি, তোর বেয়াই কে |”
দীপা বলল, “আমি বলি নি | আমার বর বলেছে | পরে বড় আমাকে বলল, স্বপ্নের কথা শুনে বেয়াই নাকি একদম চুপ করে গেলেন | তারপর ফোনটা ছেড়ে দিলেন আর কোনও কথা না বলে |”
নীতা, “আশ্চর্য তো !”
দীপা, “আশ্চর্য নয় | বা বলতেও পারিস . . . | কাল মেয়ের কাছে শুনলাম, জামাই ওকে বলেছে, প্রথম দুই মেয়ের জন্ম দেয়ার পর আমার বেয়ানের শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়, ডায়াবেটিসে ধরে | এইটুকু আমিও জানতাম | জানতাম না যে ওনার শ্বশুর চাইছিলেন নাতি | কিন্তু বেয়ান আর সন্তান চাইছিলেন না | শ্বশুরের শখ পূর্ণ করে দিয়ে আমার বেয়ান আর বেশি দিন বাঁচেন নি |”

দুজনেই চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ | তারপর দীপা বলল, “আর জানিস, আমি ভেবেছিলাম স্বপ্নে উনি মিষ্টির কথা বলছিলেন . . . যখন বললেন, ‘তবে তুমি ওকে বোলো দুটোর বেশি নয় |’ ”


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩০ এপ্রিল ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই: