রবিবার, ২৯ মে, ২০১৬

ওথেলোর একালাপ

|| ওথেলোর একালাপ ||

সকালে ঘুম ভাঙ্গার মুখে তোর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম | স্নান সেরে শাড়ি কাপড় পরে এলো চুলে রোদে দাঁড়িয়ে চুল শুকচ্ছিস | রোদ দেখে মনে হল শীতের রোদ – যদিও ছবিটা সাদায় কালোয় | বয়েস তোর আন্দাজ আটাশ – কি তিরিশ | কোমর, কাপড়ের কুঁচি বাদ দিলেও, “ঈষৎ স্ফীত” | ছবিটা কী তোর জন্মের পর, না কী তুই জন্ম দেয়ার পর ? ভাবতে ভাবতে বুঝলাম গুলিয়ে ফেলেছি – তোর কথা ভাবছি তোকে মাতৃত্বের রূপে স্বপ্নে দেখে | তুই, তোর মা, সব আজকাল গুলিয়ে যায় |

মাঝে মাঝে তোর ছবিগুলো বার করে দেখি | কোথায় রেখেছি ছবিগুলো, কবে শেষ দেখেছি মনে নেই | তবে চোখ বুজলেই একটা বড় বাক্স হাতে পাই | তার ভিতরে থরে থরে ছবি সাজানো – তোর, আমার, আমাদের মায়েদের, আমাদের বাবাদের, আরও কত কার কার ছবি আছে | তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে তোর ছোটবেলার ছবি – পুতুলের মত ; তোর একটু বড় হয়ে ছবি – ডাগর চোখ, ফ্রকের তলায় লম্বা পা, আর ঠোঁটে একটা – তখনই ফুটছে – সেই হৃদয়সমুদ্র মন্থন করার ঠোঁট টেপা মৃদু, মিষ্টি, আলগোছ হাসি, “দূরে থাক ! খবরদার, কাছে আসবি না |” ওই হাসিটা এখনও তেমনি আমার বুকে হাতুড়ি পেটায় – অথচ তুই জানতিস না | তুই তো পালিয়ে বেড়াতিস – “চল খেলবি”, বলে কোথায় যে উধাও হতিস, ভালো করে জেনে যে তোকে আমি খুঁজে বেড়াব | আজও খুঁজি | খুঁজতে খুঁজতে ওই বাক্সয় হাতড়াই | কখনও তোর বড় হয়ে ওঠার ছবি পাই না – সেখানে পাই তোর মায়ের ছবি – কিন্তু হাসিটা গুলিয়ে দেয়, ভুল করিয়ে দেয়, যে ওটা তুই |

কী গান্ধারী ওই চেহারা | টিকালো নাক, উঁচু গালের উপর লম্বা পলকের ছায়ার শিরোনাম, পলকের নিচে কটা কটা চোখের মণি | আর ঠোঁটের কথা নাই বললাম | তুইও হয়তো তোর ঠোঁটের কথা জানতিস না | নইলে কী আমায় এগোতে দেখলেই ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে চুপ করতে ইশারা করতে গিয়ে উল্টে আমার টানটা আরও অদম্য করতিস ?

আমি আর তুই – যেন ওথেলো আর দেসদিমোনা | আচ্ছা বলতো, একই সম্পর্কের জালে কী ভাবে দু’রঙা সুতো থাকতে পারে, কালো আর লাল | কী করে সবাই হতে পারে হয় সুন্দর, নয় কুৎসিত ? আর কেন, তুই প্রথম দলে, তো আমি দ্বিতীয় দলে ? কোথায় আমাদের ধারা আলাদা হল ? কেন হল, এমন ? কেন হল এমন যে কাকা, পিসি, মামা, মাসি আর আরও সবাই – হয় রূপের পক্ষে, নয় বিপক্ষে ?

তুই কী লক্ষ্য করেছিস এই জালে সব সহোদর এক সুতোর নয় ? কেউ কালো, অপুষ্ট, শ্রীহীন, ক্ষীনপ্রাণ তো কেউ রূপের জেল্লায় লাল, ফেটে পড়ছে |

এই কথাতে  এসে আমার ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে যায় | রান্নার মাসি উনুন ধরিয়েছে পাট কাঠির মাথায় পাট জড়িয়ে কেরোসিন ঢেলে | তারপর চেলা কাঠ চাপিয়ে চলে গেছে | তোকে আর আমাকে বলে গেছে দেখতে যেন আগুনটা ধরে | আমি সামনে বসে পাটকাঠি দিয়ে ফুঁ দিচ্ছি গাল ফুলিয়ে – পরনে হাফ প্যান্ট, গা উদোম | তুই পাশে উবু হয়ে বসে দেখছিস – পরনে তোর লেস দেয়া হাতকাটা শেমিজ | কী কুক্ষণে যে তোর পায়ের দিকে আমার নজর গিয়েছিল, আর তুই লেসের হেম ধরে শেমিজ টেনে নামিয়ে হাঁটু গেড়েছিলি, পাছে আমার দৃষ্টি দুই ধারা কে কাছে টানে | তখন দেখছিলাম ওই আগুনে উজ্জ্বল হয়ে চেলা কাঠের বুক ফাটলো, তার স্ফুলিঙ্গ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ল, আর তোর গালে তার আগুন লাগলো | গালে ফুটে উঠল অজস্র লাল বিন্দুর স্ফুলিঙ্গ | তোর চোখও যেন জ্বলে উঠল | আমায় বললি, “মুখপোড়া হনুমান !” তারপর ছুটে পালিয়ে গেলি | তখনই তুই বলে গেলি – তুই শুভ্র, আমি কৃষ্ণ – আমরা জাতে, পঙক্তিতে আলাদা | আমরা ভিন্ন পথের পথিক |

অথচ আমি জানি, একদিন দুই ভিন্ন পথের পথিক – এক রূপসী আর এক দানো – এক হয়ে রক্তের ধারা এক করতে চেয়েছিল | তবুও কালো রক্তে লাল রক্ত মিশ খায় নি | দুটো ধারা আলাদা রয়ে গেছে | তাই তাদের প্রজন্মে দুই ধারা আলাদাই রয়ে গেছে |

তবুও তো আমার রক্তে রয়ে গেছে ওই অন্য রক্তের ডাক | আমার রক্ত ডাকে, আর এক রক্তের সাথে এক হতে – যাতে ওথেলো আর দেসদিমোনা আর আলাদা না থাকে |

ওই ডাক শুনে বিছানায় যাই | ওই ডাক শুনে ঘুম আসে | ঘুমে ছবির বাক্সটার ডালা খুলে ছবি দেখি | কিন্তু ওখানে তো তোর আর কোন ছবি নেই | তাই জানি না তুই কবে মায়ের রূপ ধরলি – আর কার সাথে এক হয়ে মা হলি | স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে আমি বুঝি – দুই রক্ত কোনদিন এক হবে না | ওথেলোরা চিরকুমার থেকে যাবে, আর দেসদিমোনারা চিরকুমারী |

তবুও বুকের চরে ভাঁটা পড়া রক্তের স্রোত বয়েই যায় – হয়ত এগোতে এগোতে তোর স্রোতের সাথে দেখা হবে, দুই স্রোত এক হবে |

যেখানেই থাক, বইতে থাক, থামিস না |


----------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৯ মে ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই: