মঙ্গলবার, ৩১ মে, ২০১৬

পরাণকালী

|| পরাণকালী ||

হটাতই দেখা হয়ে গেল ভবতোষের সাথে । মুচিপাড়ায় গিয়েছিলাম ইলেকট্রিকের বিল জমা দিতে । ফিরে আসছি, বড় রাস্তায় বাস ধরব বলে । সামনে দেখলাম একটা আদুড় গায়ে ছেলে, কোমরে ঘুনসিতে কড়ি বাঁধা, একটা বুড়ো মানুষের পিছন পিছন চলেছে, হাতে এলুমিনিয়ামের বাটি । যদিও মনে হল না ও কিছু চাইছে, তবুও বুড়ো মানুষটা থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বন্ধ ছাতাটা উঁচিয়ে ছেলেটাকে মারার ভয় দেখাচ্ছে । ছেলেটা থমকে দাঁড়িয়ে থেকে একটু পরে আবার বুড়ো মানুষটার পিছু নিচ্ছে । ওই ছাতা উঁচানো ভঙ্গি দেখে মজা লাগলে কিছু একটা কথা পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ল না । বাস স্ট্যান্ডে যখন পৌঁছলাম, বুড়োটা দেখি দুই হাঁটুর মাঝে ছাতাটা ধরে ধুতির কোঁচা তুলে মুখের ঘাম মুছছে । ব্যাস, মনে পড়ে গেল স্কুলের সহপাঠী ভবতোষের কথা । কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা, কি শীত – ভবতোষ স্কুলে ছাতা আনতো । পাছে আমরা ওটা লুকিয়ে ফেলি, ও ছাতাটা সব সময় আঁকড়ে থাকত । মাঝে মাঝে আমাদের ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে হাত তালি দিতে দুই হাঁটুর মাঝে ছাতাটা চেপে ধরত । আর বেশি বিরক্ত করলে, ঠিক এই ভাবে ছাতা উঁচিয়ে আমাদের মারবার ভয় দেখাতো ।

বুড়োটা ঘাম মুছে কোঁচা ছেড়ে আমার দিকে তাকাল | অবাক হয়ে, 'আরে ওই বাচ্চাটা হটাত করে বুড়ো হয়ে গেল কী করে ?' এইরকম মুখের ভাব করে ঘুরে ফিরে দেখল, না বাচ্চাটা ওর পিছনেই দাঁড়িয়ে । বিরক্ত হয়ে বাচ্চাটাকে বলল, “এই যা পালা । ওই দ্যাখ বাস আসছে । আমি উঠে গেলে তুই কী করবি ? হ্যাঁ ?” বাচ্চাটা বুড়োটার দিকে ছদ্ম অভিমানের চোখে দেখল | যেন ওকে বলল, ‘কেন ? তুমি আমার ভাড়াটা দিলেই তো হয় ! চল না, সাথে নিয়ে, দাদু !’

“ওফ, কী জ্বালাতন রে বাবা ... দেখছেন আপনি, কী আপদ জুটেছে ?” বলে ভবতোষ আমার মুখের দিকে তাকিয়েই, ভ্রু কুঁচকে, চালশে চোখ দুটো ছোট করে বলল, “মহাদেব না ? হটাত কোথা থেকে উদয় হলি ?” আমি হেসে বললাম, “আমি তোর পিছন পিছন আসছিলাম । তুই ছাতা দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছিলি, তাই লক্ষ্য করিস নি ।” “মাছি ?”, বলে ও অবাক হয়েই হেসে ফেলল | বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিকই বলেছিস । এক এক দিনে এক এক জ্বালা !” “কিসের জ্বালা ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম । কথাটা যেন শুনতে পায় নি সেই ভাবে ভবতোষ বলল, “তা, এদিকে কোথায় এসেছিলি ? থাকিসই বা কোথায় । বাস ধরবি মানে দূরে কোথাও থাকিস নিশ্চয় ?” আমি বললাম, “থাকি ঘোষপাড়ায় । এসেছিলাম ইলেকট্রিকের বিল দিতে । তুইও তো এখানে থাকিস না । কোনও কাজে এসেছিলি ?” ভবতোষ আমার প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে বলল, “ওই তো বাস । আমিও যাব ওই বাসে । স্টেশনে নেমে মদনগোলা প্যাসেঞ্জার ধরব । ওখানেই আছি গত দু’বছর ।”

স্কুল ছেড়ে আমি সায়েন্স কলেজে গেলাম, আর ভবতোষ গেল বি-কম পড়তে । একটু আধটু যা দেখা সাক্ষাত হত বিয়ের আগে, বিয়ের পর আমি কলকাতায় গেলে আর তাও বজায় থাকে নি । তবে মাঝে মাঝে একটু আধটু এর ওর কাছ থেকে খবর পেতাম । শুনেছিলাম ব্যাঙ্কে যোগ দিয়ে বিয়ে করেছিল । ছেলের শখ ছিল, কিন্তু পর তিন তিনটে মেয়ে হয় । বেচারার প্রথম মেয়ের বিয়ে দেয়ার পর নাকি প্রায়ই বাপের বাড়ি ফিরে আসত । বলত স্বামী পছন্দ হয় নি । তারপর একদিন কারো সাথে উধাও হয়ে যায় । দ্বিতীয় মেয়েটা বছর তিরিশ বয়সে বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মারা যায় । আর তৃতীয় মেয়েটা মাধ্যমিকে ফেল করে প্রেম ট্রেম করে | তাতেও ফেল করে বিষ খায় । প্রত্যেকবার খারাপ খবর শুনে মনে হয়েছে একবার গিয়ে দেখা করে আসি । হয়েই ওঠেনি । শেষ দেখা একবার কলকাতা থেকে ফেরার ট্রেনে – সেও তো বছর তিন চার হবে । সেই চেহারা আর এখন নেই | এখন ভবতোষ যেন একটা আধ পোড়া চেলা কাঠ |

বাসে উঠে ফাঁকা সিট পেয়ে একসাথে বসে দুজনের দুটো টিকিট কেটে ফেললাম । স্টেশনটা পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিট | কিন্তু রাস্তাটা রেললাইনের এপার ধরে লেভেল ক্রসিং পার করে স্টেশনে ফিরে এসেছে লাইনের ওপার ধরে । তাই বাসে পরের পরের স্টপ । আমাকেও স্টেশনে নামতে দেখে ভবতোষ অবাক হয়ে বলল, “তুই যে বললি ঘোষপাড়ায় থাকিস ।” বললাম, “চল, তোর সাথে কত বছর পরে দেখা । আমি তো তোর মুখ দেখে চিনতেই পারতাম না, যদি না তোর ওই ছাতা ধরা মুদ্রাটা দেখতাম ।“ ভবতোষ একগাল হাসল | বললাম, “মদনগোলার গাড়ি তো যা জানি, ঘণ্টা দু'ঘণ্টায় আসে | চল, তাহলে ততক্ষণ তোর সাথে গল্প করে নিই |” “ কিন্তু, তোর ফ্যামিলি, মানে মিসেস ?”, ভবতোষ জানতে চাইল, “তোর দেরী দেখে চিন্তা করবে না ?” বললাম, “না, সে পাট চুকে । বউ সগ্গে গেছে এক বছর আগে । ছেলে কলকাতায়, মাঝে মধ্যে আসে । সারা সময় একাই থাকি । তোর খবর বল । এখানে মুচিপাড়ায় কার কাছে এসেছিলি ?”

ভবতোষ ছাতাটা মাটিতে ঠেকিয়ে হাতলটা দু হাতে ধরে আকাশের দিকে মুখ তুলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তার মানে, আমাদের সেই স্কুল থেকে এক যাত্রায় এই একটা ফল অন্তত পৃথক হয় নি, তাই না ? আমারও গিন্নি গত বছর বিদায় নিয়েছে ।”

বুঝলাম, ভবতোষ বোধহয় বলতে চায় না কী কাজে এসেছিল । না বলবে, না বলুক । প্রসঙ্গ বদল করতে বললাম, “তোর এই ‘সম্বৎসর’ ছাতা বয়ে বেড়ানোর অভ্যাসটা কিন্তু রয়ে গেছে ।” ভবতোষ বলল, “আর বলিস না । এখন রোদ বিষ্টি তেমন গায়ে লাগে না | তার থেকে অনেক বেশি অন্য সব আপদ বিপদ, পদে পদে । কোথাও বিড়াল, কোথাও বাছুর, কোথাও কুকুর, এমন কি ভিখিরি বাচ্চা অব্দি আমাকে পথে ঘাটে নিস্তার দেয় না ।”

প্ল্যাটফর্মে ঢুকে আমাকে একটা বেঞ্চ দেখিয়ে বসতে বলে ভবতোষ টিকিট কাটতে চলে গেল । ফিরে এসে আমাকে দূরে একটা বাচ্চা দেখিয়ে বলল, “কাণ্ডটা দেখ । কী ভাবে পা ঝুলিয়ে বসে আছে । এইসব বাচ্চাদের মায়েরা কী করে যে ওদের ছেড়ে দেয় ।” দেখলাম একটু দূরে ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে একটা ছোট ছেলে একটা বাটি থেকে কিছু খাচ্ছে । আমি বললাম, “ওর মায়ের মত কাউকে তো দেখছি না ধারে কাছে ।” ভবতোষ বলল, “আরে, ওই সব মায়েদের কী – একটা বাচ্চা গেলে আরেকটা পেতে কোনও অসুবিধা তো হয় না । আমাদেরই যত ঝামেলা ... আমার গুলোর কথা তো শুনেছিস নিশ্চয় । তিন তিনটে চলে গেল, ধরে রাখতে পারলাম না । ঠাকুর কে যে কত ডেকেছি ।”

আমি বললাম, “ঠাকুর ! ঠাকুর কী করবে ? মরা মানুষ ফিরিয়ে দেবে ?”

ভবতোষ বলল, “প্রশ্নটা জানি | তুই হয়তো উত্তরটাও জানিস তাই ঠাকুর দেবতা মানিস না । কিন্তু আমি মানি । বৌটা মারা যাওয়ার পর থেকে একে তো চরম একা হয়ে পড়েছি, তার উপর হাতে অঢেল অচল সময় । আকছার বসে বসে ঠাকুরকে ডাকি - একটা কারো সঙ্গ দাও । এত একা কী থাকা যায় ?”

আমি প্রশ্রয় না দিলে ভবতোষ বলল, “তুই জানিস না, বৌটা মারা যাওয়ার পর বাড়িটা আমার কী ভাবে ফাঁকা হয়ে গেল । একটা দুধ-গরু ছিল । তার সদ্য বাছুরটা কোথায় কী খেয়ে পেট ফুলে মারা গেল । তার দুঃখেই কিনা জানি না, গরুটা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিল । সারাদিন অস্থির হয়ে চোখ পাকিয়ে পা দাপাত, আর চোখের জল বের হাম্বা হাম্বা করত । তারপর একদিন দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে গেল । বউয়ের পোষা বিড়ালটা বয়েস হয়ে খুব মোটা হয়ে গিয়েছিল । একদিন কার্নিশে পায়রা ধরতে গিয়ে পড়ে মারা গেল । চোখে কম দেখত হয়তো । শেষে বাড়ির কুকুরটা, ছোট ছানা ছিল যখন আমি মুঠোয় করে ঘরে এনেছিলাম, সেও মারা গেল ।”

ভবতোষ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম । মনে হল এখন আর পুরানো কথার কোন মানে হয় না । ভবতোষের পক্ষে অতীত দুঃসহ । ও এখন বর্তমানে থাকতে চায় ।

স্টেশনের ঘণ্টা বাজিয়ে জানালো গাড়ি আসছে । ভবতোষ উঠলো । দেখলাম দূরে বাচ্চাটা তখনও প্ল্যাটফর্মের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে । ট্রেন আসছে সে হুঁশ নেই, না তার, না তার মায়ের । “আশ্চর্য !” বলল ভবতোষ । তারপর আমার চোখে সোজা তাকিয়ে বলল, “তুই জিজ্ঞাসা করছিলি আমি মুচিপাড়ায় কোথায় গিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম তুই নাস্তিক, তোকে বলে কি হবে ? কিন্তু শোন । গিয়েছিলাম ওখানে পরাণকালী মায়ের মন্দিরে । মাঝে মধ্যেই যাই । তুই যাস কি ?” আমি মাথা ঝাঁকালাম । বললাম, “শুনেছি মা নাকি জাগ্রত । আমার বউ যেত ।”

ভবতোষ মাথা নাড়ল, অনেকক্ষণ, নিজের মনে, তালে বেতালে ।

তারপর বলল, “আমিও শুনেছি । তাই মায়ের কাছে মানত করেছি । বলেছি, মা আমার এই একা জীবন এবার শেষ করো । হয় আমাকে নাও, নইলে আমাকে কারো সঙ্গ দাও – যার সাথে থাকলে একটু কম একা লাগবে ।” আমি বললাম, “তোর আত্মীয় স্বজন ?” “ধ্যুত, যত্ত সব স্বার্থপরের দল ।” তিড়বিড় করে জ্বলে উঠল ভবতোষ । তারপর হাতের ছাতাটা একটু উঁচিয়ে ভাঁড়ের মত বলল, “যতদিন আমার হাতে এই অস্ত্র আছে, কাউকে ঘেঁষতে দেব না মোর ধারে কাছে ।” আমি থাকতে না পেরে হেসে ফেলে বললাম, “যেমন বাস স্ট্যান্ডের বাচ্চাটা ?” ভবতোষ বলল, “আর বলিস না ... জানি না আমার মধ্যে কী যে আকর্ষণ আছে । ওই মন্দির থেকে বেরিয়ে এক একদিন এক এক কাণ্ড হয় । একদিন একটা বাছুর আমার পিছু নিলো । নাছোড়বান্দা । ছাতা দেখিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টায় কোন কাজ হল না । এই রকমই আরেকদিন একটা বেওয়ারিশ ছাগল ছানা । ম্যাঁ, ম্যাঁ করে আমায় ডেকে অস্থির | একদিন একটা ছোট্ট বিড়ালছানা মিউ মিউ করে আমার পায়ে গা ঘষে একাকার করল । এমন কি একদিন একটা পায়রাও হেঁটেছে আমার পিছন পিছন, গুটি গুটি পায়ে । ওই ভয়ে আজ আমি বাস ধরলাম | নইলে আমি স্টেশন হেঁটেই আসি |”

হা হা করে হেসে উঠে ভবতোষ বলল, “জানিস, আজ আমি মন্দিরে মাকে প্রণাম করে বললাম, 'জানি না মা, তোমার মনে কী আছে । তুমি আমাকে এই সব কেন দিচ্ছ ? ভালো কিছু নেই কি তোমার কাছে ?' কথাগুলো মনে মনে ক’বার বলে মন্দির থেকে বেরোতেই ব্যাস, ওই বাচ্চা ছেলেটা পিছন পিছন আসতে শুরু করল ।” আমি বললাম, “দুটো পয়সা দিয়ে দিলেই চলে যেত ।” “বের করেছিলাম তো একটা টাকা, ওকে দিতে”, ভবতোষ বলল, “তা এমন বেয়াড়া ছেলে, টাকাটা দেখে পিছন ফিরে মা বলে চিৎকার করে ডাকল । দেখি দূরে একটা গরিব মেয়েমানুষ দাঁড়িয়ে । সে আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, 'এমনিই নিয়ে যাও বাবা, ছেলেটাকে । তোমার কাজে দেবে ।' বোঝ, আবদার !”

হুট করে ট্রেনটা 'পোওওওঙ .. পোওওওঙ' করে হল্লা করতে করতে এসে স্টেশনে ঢুকে পড়তেই দুজনে তাকালাম । প্ল্যাটফর্মটা এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা । ছেলেটা কখন সরে গিয়েছে ।

কই না তো ! ওই তো, বাচ্চাটা ভবতোষের দিকে এগিয়ে আসছে । অন্তত, আমার তাই মনে হল । ওর হাতে একটা বাটি । আর কোমরে সকালের বাস স্ট্যান্ডের বাচ্চাটার মতই ঘুনসিতে কড়ি বাঁধা । দূরে একটা গরিব বউ দাঁড়িয়ে দেখছে মুখে আশার হাসি ফুটিয়ে |

বৌয়ের কথা মনে পড়ল | বলত ভক্তদের নাকি মা নানান রূপে দেখা দেয় ।
 

------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩১ মে ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই: