সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

অপেক্ষা

|| অপেক্ষা ||


হঠাত করে মলিনাদির সাথে দেখা হয়েছিল |

কিছু কাগজের কাজ নিয়ে কোর্টে গিয়েছিলাম | উকিলের সাথে কথা বলে বেরিয়ে বড় রাস্তার কাছে এসে মনে হল পেনটা ফেলে এসেছি, তাই ফেরত যাচ্ছিলাম পকেট হাতড়াতে, হাতড়াতে | উল্টোদিক থেকে মলিনাদি আসছিল | বয়েসের ছাপ তেমন না পড়লেও বেখেয়ালে আমি ঠিক লক্ষ্য করি নি |  মলিনাদি পাশ দিয়ে গিয়ে পিছন থেকে ডাকল, “ধ্রুব না ? এই ! তুই ধ্রুব না ?” যেই আমার হাতে পেনটা ঠেকল, শুনতে পেয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম । দেখে চিনতে একটুও অসুবিধা হল না |

তবে, সেই রকমই আছে তা বলবো না | শেষ দেখা হয়ে মনে হয় চল্লিশ – বিয়াল্লিশ বছর কেটে গেছে | এখন যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্মিত মুখে, তার রং সেই সময়ের তুলনায় বেশ কালো | মাজা, ঋজু চেহারাটা না হলেও পঁয়ষট্টি বছরের | মণিবন্ধের হাড় শক্ত, ব্লাউজের হাতার শেষে কনুইটা চওড়া | গাল একটু বসে গিয়ে মুখের চোয়াল আরও প্রশস্ত হয়েছে, আর তাকে দৃঢ় সমর্থন যোগাচ্ছে চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা | মাথার মসৃণ চুলে একটু পাক ধরলেও বেশিরভাগ কালো | এত গরমেও শাড়ির আঁচলটা গলায় পাকিয়ে বুকের উপর ছড়িয়ে ফেলা । শুধু এই আব্রুটুকু এই বয়সের তুলনায় বেমানান |

আমার চিনতে অসুবিধা হচ্ছে ভেবে মলিনাদি চোখ থেকে চশমাটা খুলে বলল, “এবার চিনতে পারছিস ?” সেই মমতা ভরা কালো গভীর চোখ ... যার চোখের লম্বা লম্বা পলক যে কোন মুহূর্তে ধীরে ধীরে নেমে এসে সেই মমতার হদিস হারিয়ে দিতে পারে | আমার কৈশোরের মলিনাদি – মলিনা মুখি – পাড়ার মুখি বাবুর বড় মেয়ে, আমার খেলার মাঠের সাথী বাবুয়ার দিদি |

আমি বললাম, “চিনব না কেন ? আসলে আমি পেনটা হারিয়ে ফেলেছি ভেবে একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই তোমাকে লক্ষ্য করি নি | কোথায় এসেছিলে ?”
মলিনাদি বলল, “একটু এফিডেভিটের কাজ ছিল | হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরছি | তুই ?”
আমি বললাম, “আমিও বাড়ি ফিরছি |”
-  “কতদিন পরে দেখা বল তো !"
-  "চল্লিশ বছর ?"
-  "বাড়ি ফেরার তাড়া আছে তোর ?”
-  “না, তেমন না | ইলাকে বলে এসেছি কোর্টের কাজ, সময় লাগতে পারে | কেন বলো তো ?”
কব্জির ঘড়িটায় চোখ রেখে মলিনাদি বলল, “কেমন আছিস ? চা খাবি ? খেতে খেতে বলবি ?”
আমি বললাম, “চা, এখানে ?”
-  “না, না ... কাছেই আমার বাড়ি, গেরুয়া রোডে | যাবি ?”
-  “কেন, তোমার আর কাজ নেই বুঝি বাড়িতে ?”
-  “কাজ ? একা মানুষের আর কাজ কী রে ? চল না, চল !”
-  “ঠিক আছে | তবে একটা কথা, পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দেবে তো ?”
-  “হ্যাঁ, হ্যাঁ ... এই রিক্সা !”

মলিনাদির বাড়ি কোর্টের রাস্তাটার উল্টোদিকে একটা বড় মাঠের ওপারে | রিক্সা থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করলাম, “এইটুকু পথের জন্য রিক্সা নিলে কেন ?” মলিনাদি বলল, “আসলে আমার ওই গাড়ি ঘোড়ার রাস্তাটা পার হতে ভয় করে | বয়স হয়েছে, একা মানুষ, কে কোথায় ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে |”

“আয় |” বলে মলিনাদি বাগানের গেটটা খুলল | ছোট্ট কোয়ার্টার, সামনে একটু বাগান, তাতে কিছু ফুলের গাছ | দু ধাপ সিঁড়ি উঠে ছোট বারান্দা | দরজা খুলে সামনের ঘরে ঢুকলাম | এক সেট সোফা, একটা ডিভান, দু একটা ঘর সাজানোর জিনিস আর একটা ছোট পড়ার টেবিল চেয়ার – ছিমছাম সাজ-সজ্জাহীন | সিলিং ফ্যান চালিয়ে দিয়ে মলিনাদি বলল, “দাঁড়া, চায়ের জলটা বসিয়ে দিয়ে আসছি |” এই বলে, ভিতরে যাওয়ার দরজা দিয়ে চলে গেল | আমি একবার চারিদিকে চোখ বুললাম | দেয়ালে একটা বিনে-ছবি বাংলা ক্যালেন্ডার | একটা ফ্রেমে বাঁধানো মুখি পরিবারের সাদা কালো ছবি, তাতে মলিনাদি শাড়ি পরা – দেখে মনে হল শেষ দেখা হওয়ার সময়ের | আর কারো কোন ছবি নেই | তাহলে কি ...
...

এক নিমিষেই আবছা স্মৃতির অনেক কথা দুর্বার বেগে ঝড়ের মতো উঠে আসতে পারে | ছোটবেলায় আমরা এক পাড়ায় থাকতাম | মুখি বাবুর বাড়ি ছিল আমাদের তিনটে বাড়ি পরে | অনেকটা এইরকম কোয়ার্টার | সামনে বারান্দা, তারপর পরপর বাইরের ঘর, ভিতরের ঘর, রান্নাঘর - পাশে এক ফালি সরু উঠোন, স্নানঘর, পায়খানা, আর পিছনের খিড়কি দরজা – সামনের থেকে খিড়কির, সব দরজা এক সারিতে |

যুধিষ্ঠির মুখি, মুখি বাবুর ছিল বড় পরিবার – পাঁচ মেয়ে আর এক ছেলে | প্রথমে মলিনাদি, তারপর বাবুয়া – আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট – তারপর আরও চার মেয়ে, নীলিমা, প্রতিমা, সরমা, আর সবশেষের জনের নাম বোধ হয় পুতুল | মাসীমা, মুখি বাবুর বউ, ছিল ক্ষীণকায়, ফর্সা, দুর্বল, টিকালো নাক আর সুন্দর চোখ-মুখের | তার ধারাটা অন্য মেয়েরা পেলেও, মলিনাদি নিয়েছিল বাবার ধারা – লম্বা, ময়লা, শান্ত, গভীর | খেলার জন্য বাবুয়াকে ডাকতে গেলে মলিনাদি ভিতরে ডাকত, “বাইরে কেন ? বাবুয়া খাচ্ছে - ভিতরে আয়, বোস ততক্ষণ |” আমি গিয়ে বসতাম বাইরের ঘরের একমাত্র চেয়ারে | ঘরটার বাকি অংশ জুড়ে ছিল একটা মস্ত খাট | ভিতরের ঘরে ছিল দুটো মাদুর পাতা চৌকি, একটা আলনা, আর অনেক জিনিস, এক কোনে মাসিমার ঠাকুরঘর – একটা ছোট কাঠের ঠাকুরবাড়ি | ঘরটায় সারাদিন ধূপ ধুনোর গন্ধ থাকত, আর থাকত ফুলের গন্ধ | বাইরের ঘর থেকে ভিতরের ঘরে যাওয়ার দরজাটার পরেই ছিল দেয়ালে ঝুলানো একটা বড় আয়না, তারপর আলনা | এই দরজাটায় একটা পর্দা থাকলেও তার অপর্যাপ্ত প্রস্থের পাশ দিয়ে আয়নাটা, আর তার প্রতিফলনে ভিতরের ঘরের কিছু অংশ দেখা যেত | তাই, আমি বসে থাকলে আয়নাটা একটু অস্বস্তির সৃষ্টি করত | বাবুয়া বেরোলেই এক লাফে উঠে বাইরে আসতাম |

কী ভাবে জানি না একটু একটু করে বুঝলাম মলিনাদির আমাকে নিয়ে একটা আগ্রহ হয়েছে | সেটা কোনদিন বাড়তে বা কমতে দেখলাম না | ব্যাপারটা কোনদিন খারাপও লাগে নি |

সেবার আমি ছুটির আগে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠে দূরের উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে যোগ দিয়েছি | বাবুয়া যাবে আরও দু বছর পরে | গরমের ছুটি হয়েছে | মলিনাদি আমাকে মাঝে মাঝে স্কুলের কথা জিজ্ঞাসা করে, মাস্টাররা কেমন, ছেলেরা কত বদমাইশ, আমি স্কুল পালিয়ে কোথাও যাই কিনা | প্রায় দুপুরেই মুখি মাসিমা নীলিমা, প্রতিমা আর সরমাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসে, মায়ের সাথে গল্প করতে | তিন বোন ইলার সাথে লুডো খেলে | একদিন মাসীমা বলল, “শোন ধ্রুব, মলিনা বলল তোকে পাঠিয়ে দিতে | বাবুয়া টিউশনে গেছে, ও একা আছে | যা, গল্প করবি তো |”

যেতেই মলিনাদি ভিতরের ঘরে নিয়ে গেল | একটা চৌকিতে পুতুল অঘোরে ঘুমোচ্ছে । মলিনাদি অন্য চৌকিতে উঠে কোলে একটা বালিশ টেনে আয়েস ঢালা গলায় বলল, “আয়, তোর কথা শুনি |”

কী গল্প করলাম মনে নেই | কিন্তু, সেবার প্রায় পুরো গরমের ছুটি কেটে গেল, দুপুরে আধো অন্ধকার ঘরে চৌকিতে বসে মলিনাদির সাথে গল্প করে | আমার কিছু তেমন বলার থাকত না, বিশেষ করে স্কুল বন্ধ বলে | তাও মলিনাদি যে কত প্রশ্ন করত | তখন আমার বয়স হয়ত তেরো, মলিনাদি বছর দুয়েক আগে স্কুল পাশ করেছে, তাই হয়ত ওর আঠেরো | মা বলত মলিনাদি আমার থেকে পাঁচ বছরের মত বড় |
...

এই সব চিন্তার স্রোতে ব্যাঘাত করে মলিনাদি ডাকল, “তুই চায়ে চিনি খাস তো ?” বললাম, “হ্যাঁ, তবে একটু কম দিও, চায়ের চামচের এক হলেই হবে |”
...

আমি জানি না মলিনাদি কেন কলেজে যায় নি | শুনতাম ওর জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে | মলিনাদি অবশ্য সেই নিয়ে কোন কথা বলত না | আমার একটুও মনে নেই আমরা কী নিয়ে গল্প করতাম | কিন্তু, এটাও ঠিক কোন মেয়েলি বা ঘরোয়া ব্যাপার নিয়ে কোন গল্প ছিল না | এইটুকু বুঝতাম মলিনাদি আমাকে একটু অদ্ভুত ভাবে স্নেহ করত – বা, শুধু স্নেহ হয়ত নয়, সাথে একটু সমীহ করত, কেন না আমি লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম | খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমি কী বই পড়ছি জানতে চাইত, আমাকে বলত, “তোর পড়া হয়ে গেলে আমাকে একটু দিস তো |” তাও আমি মলিনাদিকে বই পড়তে দেখি নি কোনদিন, যদিও মাসিমা বাড়িতে উল্টোরথ, আর নবকল্লোল রাখত |

ক্লাস এইটে উঠে আমার কবিতা লেখার শখ হল, ক্লাসের আর পাঁচটা ছেলের মত | শীতের ছুটিতে এক দুটো লিখেও ফেললাম, দুপুর বেলায় সামনের বারান্দায় রোদে বসে | একদিন মলিনাদি মায়ের কাছে উল বোনা শিখতে এসে দেখে ফেলল | “দেখি, কী লিখছিস | কবিতা ?” বলে আমার হাতের খাতাটা নিতে চাইল | আমি কিছুতেই দেব না | টানাটানিতে আমার খাতা ধরা হাতের মুঠো মলিনাদির বুকের মাঝে দুম করে লেগে গেল জোরে | “উঃ” বলে ব্যথায় ককিয়ে উঠে মলিনাদি আমার খাতাটা ছেড়ে দিল | মা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে মলিনা ? জোরে লেগেছে ? দেখি দেখি |” দেখলাম যন্ত্রণায় মলিনাদির চোখে জল এসে গেছে | তাও, “কিছু না |” বলে মলিনাদি উঠে পড়ল | বলল, “আসি মাসিমা |”

মা আমাকে কিছু না বললেও কদিন আমি খুব মন খারাপ করে পড়ে থাকলাম | বুঝলাম না, মলিনাদির কোথায় ব্যথা দিয়ে ফেলেছি | নাকি গায়ে হাত লেগেছে বলে | কিন্তু, যখন দুপুরে আধো আঁধার ঘরে মলিনাদির সাথে গল্প করেছি কতদিন মলিনাদি আমার কথায় বিশ্বাস না করে আমার হাতের পাতা জামার বুকে চেপে ধরে বলেছে, “গা ছুঁয়ে বল, সত্যি বলছিস !” আমি ওর গা ছুঁয়ে “সত্যি !” বলেছি | কতদিন, যখন উঠে পড়েছি, মলিনাদি আমার গাল বুকে চেপে বলেছে, “আয় এবার | কাল আসবি তো ?”

তা হলে ? তাহলে কী ? সেই যে একদিন এমনি মলিনাদি আমার মাথা গাল নিজের বুকে চেপে ধরলে আমি বলেছিলাম, “মলিনাদি তোমার বুকের ধুকপুক শুনতে পাচ্ছি |” মলিনাদি বলেছিল, “আর কিছু ?” আমি মাথা নেড়েছিলাম | মলিনাদি বলেছিল, “খুব কান পেতে শুনলেও না ?” আমি মাথাটা তুলে বলেছিলাম, “কিসের শব্দ ?” মলিনাদি একটু চাপা হাসি হেসে বলেছিল, “একটা ছোট্ট গুটি পোকার বুকের ধুকপুক |” আমি অবাক হয়ে বললাম, “গুটি পোকা ?” মলিনাদি বলল, “গুটি পোকা ... শতপদ ... থাক, তুই বুঝবি না |”

এক নিমিষেই এই সব অনেক কথা মনের মধ্যে বৈশাখের দুপুরের অশরীরী তপ্ত হাওয়ার ঘূর্ণিপাকের মত পাক খেয়ে গেল, জমে থাকা ধুলো পাতা উড়িয়ে ওলটপালট করে দিয়ে | আমি বসে রইলাম এক অন্য কোয়ার্টারে, অনেক সময় পিছিয়ে গিয়ে |
...

মলিনাদি একটা ট্রেতে দু’কাপ চা আর একটা প্লেটে কটা নিমকি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, “এবার কেমন গরম পড়েছে রে | সারাদিন ঘর বন্ধ করে অন্ধকারে বসে থাকি, আর দিন গুনি কবে একটু বৃষ্টি নামবে |”

আমি দেয়ালে চোখ বুলিয়ে বললাম, “শুধু তোমাদের মা-বাবা, ভাই-বোনের ছবি, আর কারো নেই কেন ?” মলিনাদি আঁচলে ঘাম মুছে বলল, “আর কার হবে বল | বিয়ে তো করি নি, মানে করা হয়ে ওঠে নি |”
-  “তাহলে এই কোয়ার্টার ? কার নামে ?”
-  “আমারই নামে | ও, তুই তো জানবি না । বাবা মারা গেলে আমি করেসপন্ডেন্স কোর্সে বিএ, বিএড করলাম । তারপর স্কুলে মাস্টারি । এখন আমি পাশেই  কস্তুরবা গার্লস স্কুলে পড়াই | ছ’বছর এক্সটেনশনে আছি | যতদিন রাখে, চিন্তা নেই | যাক, তোর খবর বল – বউ, ছেলেমেয়ে – কে কোথায় আছে, কী করে | তুই ইলার কথা বললি, ও কী তোর সাথেই আছে |
-  “হ্যাঁ | আমার তো এক ছেলে, দুর্গাপুরে কাজ করে | বউ মারা গিয়ে সাত বছর হয়ে গেল | তারপর ইলার বর মারা গেলে ওকে এনে রেখেছি সাথে | তোমার বোনেরা ? বাবুয়া ? ওরা সব কেমন আছে ?”

এইভাবে কথায় কথায় একটা বেজে গেল | বললাম, “তোমার খাওয়ার সময় হয়ে গেল | উঠি |” মলিনাদি বলল, “হ্যাঁ, আয় | আবার কবে আসবি বল | বাড়িটা তো চিনে গেলি | একদিন দুপুরে আয়, খুব গল্প করা যাবে | ইলাকেও আনিস |” আমি বললাম, “আসব | ইলা হয়ত আসতে চাইবে না – বাতের ব্যথায় ও আর বেরোতে চায় না | তোমার কি সুবিধা হবে দুপুরে এলে ?” মলিনাদি হেসে বলল, “আয় না দুপুরে, সেই ছোটবেলার গরমকালের মত |”

বাসে উঠে ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরলাম | সেকালে শুকনো গরম পড়ত | আমার মোটেও কষ্ট হত না | খালি গায়, কি গেঞ্জি গায়, থাকতাম | মলিনাদি তখন শাড়ি পরত না | প্রায় গোড়ালি অব্দি লম্বা ফ্রক পরত | আজকাল তাকেই গাউন বলে, বোধহয় । পাড়ার আর সব সমবয়সী মেয়েরাও ওইরকম ফ্রক পরত | মলিনাদি খুব উঁচু গলার ফ্রক পরত | মা মাঝে মাঝে বলত, “কী রে মলিনা, এত গরমে গলা উঁচু ফ্রক পরে তোর গরম লাগে না ?” মলিনাদি কথায় উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ত  | খালি সরস্বতী পুজোর দিন পাড়ার মেয়েদের সাথে মলিনাদি শাড়ি পরত | কেন জানি না, সেদিন আমি মলিনাদির থেকে নিজেকে আলাদা মনে করতাম । মনে করতাম এক সাথে গল্প করলে কী হবে, মলিনাদি আমার থেকে অনেক অনেক বড় | তবুও সেবার পুজোর দিন সকালে মলিনাদি বাবুয়াকে দিয়ে আমাকে বলে পাঠালো যে আমি যেন ওকে প্যান্ডেলে নিয়ে যাই অঞ্জলি দেয়ার জন্য | আমি বাবুয়াকে বললাম, “তুই থাকতে আমি কেন ?” বাবুয়া একটা কাঁধের ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “দিদিকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিস |”

আমি স্নান করে পাঞ্জাবি পায়জামা পরে মুখি বাবুর বাড়ির দরজার গায়ে কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে মলিনাদি বলল, “চলে আয় | দরজা ভেজানো আছে |” আমি ঢুকে চেয়ারে বসে বললাম, “দরজাটা ভেজিয়ে দেব কি |” মলিনাদি বলল, “না থাক | তুই আছিস তো | বোস তুই,  লিপি আমায় শাড়ি পরাচ্ছে | পরা হলেই বেরব |” লিপি, মানে লিপিকাদি, থাকত মলিনাদির পাশের বাড়িতে, মাঝখানে একটা গলি ছেড়ে | ওর ভাই ছিল পাড়ার একমাত্র গুণ্ডা ।

মনে হল বাড়িতে শুধু মাসিমা আছে, রান্নাঘরে ব্যস্ত | ভিতরের ঘরটা অন্ধকার দেখে বুঝলাম উঠোনে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ । দেখলাম ভিতরের ঘরের গলির দিকে জানালাটাও বন্ধ | বন্ধ জানালাটা চোখে পড়তেই চমকে উঠে বুঝলাম যে দুই ঘরের মাঝের পর্দাটা সরানো, তাই ভিতরের ঘরের দেয়ালে টাঙানো আয়নাটা পুরো দেখা যাচ্ছে চেয়ারে বসে | যদিও আয়নায় কাউকে দেখতে পেলাম না, ভিতর থেকে লিপিকাদি চেঁচিয়ে উঠল, “এই, খবরদার ! আয়না দিয়ে দেখবি না |” তারপরেই শুনলাম ভিতরে দুজনের চাপা গলায় হিসহিস করে কথাবার্তা |

সেদিন খুব অস্বস্তি সামলে দুই দিদিকে নিয়ে পাড়ার পুজোয় অঞ্জলি দিয়ে ফিরলাম | লিপিকাদি বাড়ি চলে গেল | মলিনাদি বলল, “ভিতরে আসবি না ?” আমি বিব্রত মুখে বললাম, “না |” মলিনাদি “বেশ” বলে বাগানের গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকে  আমায় বলল, “শোন, কাছে আয় তো |” আমি কাছে গেলে চাপা স্বরে বলল, “কিছু দেখিস নি তো আয়না দিয়ে ?” তারপর গম্ভীর চোখে আমার গালে আলতো করে তালি মেরে বলল, “যা, বাড়ি যা |”

এই ছোট ঘটনাটার পর আমি মলিনাদিকে একটু এড়িয়ে চললাম, যদিও ওর দিকে থেকে আন্তরিকতায় কোন পরিবর্তন দেখলাম না | আমায় দেখলেই বলত, “আর আসিস না কেন ?”, কিম্বা, “খুব পড়াশুনা করছিস বুঝি ?”

আমি ক্লাস টেনে উঠলে মুখি বাবু একটু বড় কোয়ার্টার পেয়ে অন্য পাড়ায় চলে গেল | তার কয়েক বছর পরে আমারও সেই পাড়ায় গেলাম | তখন আমি কলেজে তৃতীয়-বর্ষে পড়ি | গরমের ছুটিতে বাড়ি এলে সকাল-বিকেল বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে যাওয়া আসার পথে মুখি বাবুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাই | কাউকে দেখি না | কোনদিন মুখি মাসিমা আসে মায়ের কাছে দুপুরে গল্প করতে | কিন্তু, আমাকে আর বলে না, “যা, মলিনা বাড়িতে একা আছে | গল্প করবি তো যা |” তাও একদিন মলিনাদির সাথে দেখা হয়ে গেল | বিকেলে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল | মাথায় বেলি ফুলের মালা দেখে অবাক হলাম | মলিনাদিকে কোনদিন লোকদেখানো সাজতে দেখি নি | চেহারাটা দেখলাম শুকিয়ে গেছে | মুখটা ভর্তি ব্রণ | তবুও তারই মধ্যে চোখ দুটো আগেকার মত করুণাময় হয়ে আছে | আমায় দেখে একটু হাসল | তারপর হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, “শুনেছি তুই এসেছিস | কই একদিনও তো এলি না দেখা করতে | এখন কোথায় যাচ্ছিস ?” বললাম, “এই ... স্কুলের বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দেব | তুমি কার জন্য দাঁড়িয়ে আছ ?”

-  "কার জন্য আর ? আমায় দেখতে আসবে ... তাই হত্যে দিয়ে পড়ে আছি ।"
-  "তাহলে আমি যাই । পরে তোমার সাথে কথা বলব ।"
-  “কী বলবি ? কী গল্প করিস তোরা আড্ডায় ? শুধু গল্প করিস, না চা, সিগারেটও খাস |”
-  “তাও খাই ... পয়সা থাকলে |”
-  “হ্যাঁ, মায়ের মুখে শুনলাম, মাসিমা দুঃখ করেছে যে তুই খুব সিগারেট খাস | শোন, খেলে খাবি, কিন্তু কম সম |”
-  “কমই তো খাই | আজ দেখো না, পকেটে পয়সা নেই | বন্ধুদেরও একই অবস্থা হলে আজ আর ...”
-  “তাই ? দাঁড়া |” বলে মলিনাদি ভিতরে চলে গেল | টুক করে ফিরে এসে হাতের মুঠো এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নে | কিন্তু, প্রমিস কর, কম খাবি |”
-  “তুমি কেন পয়সা দেবে ?” আমি বিব্রত হয়ে বললাম |
-  “যা না, মাত্র আট আনা তো | আবার লাগলে চাইবি |”

আট আনায় সেদিন পুরো এক প্যাকেট সিগারেট কিনলে পরে বন্ধুরা জেনে গেল | যেদিনই কারও  কাছে পয়সা থাকে না সবাই আমাকে বল, “ধ্রুব, যা না | একটা টাকা চেয়ে নিয়ে আয় |” বলতে হয় না | মাঝে মধ্যেই মাথায় বেলি ফুলের মালায় সেজে মলিনাদি গেটে দাঁড়িয়ে থাকে, আমাকে দেখে ডাকে, জিজ্ঞাসা করে, “ভালো আছিস ?” তারপর আমার ইতস্তত ভাব দেখলে, “আজ হাত খালি বুঝি ?” বলে ব্লাউজের গলায় হাত ঢুকিয়ে টুক করে একটা টাকা বের করে দিয়ে বলে, “যা, পালা |” একদিন এই ভাবেই টাকাটা বের করতে গিয়ে মলিনাদি হটাত ব্যথায় মুচড়ে উঠল | হাতটা ব্লাউজের গলায় আটকে রইল এক মুহূর্তের জন্য | আমি ভয় পেয়ে বললাম, “কী হয়েছে, মলিনাদি ?” মলিনাদি বলল, “কিছু না | টাকাটা ভাঁজ করে রেখেছিলাম, তার কোনায় একটু খোঁচা লেগে গেল পুরানো ব্যথার জায়গাটায় |”

সেদিন বাড়ি ফিরে ইলাকে বললাম সব কথা, আগে প্রমিস করিয়ে নিয়ে যে ও মাকে কিছু বলবে না | সব বলে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই কিছু জানিস ? মলিনাদি কিসের পুরানো ব্যথার কথা বলল ?” ইলা মাথা নাড়ল | না, ও কিছুই জানে না | বলল, “তুই বললে আমি মাসীমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি |” আমি বললাম, “থাক, দরকার নেই |”
...

বাড়ি ফেরার বাসে বসে সেই সব কথা ভাবতে ভাবতে মনটা খুব টানটান হয়ে  উঠল পুরানো দিনগুলোর জন্য | যদি আবার একবার সেই গরমকালের দুপুরের আধো অন্ধকার দিনে মলিনাদির চৌকির উপর বসে গল্প করার সময়ে ফিরে যেতে পারতাম | তাহলে মন দিয়ে ওর সব কথা শুনে মুখস্থ করে নিতাম, পরে জাবর কাটার জন্য | তাহলে হয়ত সেদিন না বুঝলেও আজ নিশ্চয় বুঝতে পারতাম মলিনাদির বুকে কোথায় ব্যথা ছিল | বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঠিক করে নিলাম, ‘না, এরপর দেখা হলেই মলিনাদিকে জিজ্ঞাসা করব |’

কিন্তু অনেক দিন কেটে গেল | কতবার মলিনাদির কাছে গিয়ে এটা সেটা গল্প করে ফিরে এসেছি |
...

সদ্য বৃষ্টি শুরু হয়েছে | দুপুরে আর ঘুম আসে না | ভাবছি কাল মলিনাদির বাড়ি যাব দুপুরে | আমায় দেখে খুব খুশি হবে, “তুই এসেছিস | আমি তো ভাবছিলাম তুই আর দুপুরে আসবি না | আয়, ভিতরে আয় |” আমাকে বসিয়ে রেখে মলিনাদি ভিতরে চলে যাবে | ফিরে এসে বলবে, “এখনই চা খাবি, না একটু পরে ?” আমি বলব, “চা খাব ? এই ভর দুপুরে ?” মলিনাদি বলবে, “তাহলে থাক | তবে তুই খেলে আমিও খেতাম | এই বৃষ্টির জোলো হওয়ায় ... যদি বলিস কফি করতে পারি |”
আমি বলব, সুযোগ পেয়ে, “আচ্ছা, অবেলায় যা দেবে খাব, যদি একটা প্রশ্নের জবাব দাও |”
“ও, বাবা !” মলিনাদি বলবে, “এত বছর পরে এই সবে দেখা | এতদিনের সব কথা এখনও জানা বাকি | তার আগেই প্রশ্ন ? কী নিয়ে রে ?”
আমি বলব, “তোমার কি পুরানো কথা সব মনে আছে ? আমি যখন কলেজে, তুমি আমাকে মাঝে মধ্যেই বিকেলে আট আনা কি এক টাকা দিতে, আমার সিগারেট খাওয়ার জন্য ? ব্লাউজে ভাঁজ করে টাকা গুঁজে রেখে তুমি বাগানের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে |”
মলিনাদি মাথা হেলাবে, “মনে আছে |”
আমি বলব, “একদিন টাকাটা বের করতে গিয়ে তার ভাঁজের কোনে খোঁচা লেগে তুমি খুব ব্যথা পেয়েছিলে | বলেছিলে পুরানো ব্যথার জায়গায় খোঁচাটা লেগেছিল |”
মলিনাদি হাসবে, "হবে হয়তো |"
আমি বলব, “আর তার অনেক আগে - সেই পুরানো পাড়ারও টুকিটাকি কথা তোমার সাথে সেদিন দেখা হয়ে মনে পড়ে গেল - একবার আমার কবিতার খাতা নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে তোমার গলার নিচে আমার হাতের ধাক্কা লেগেও তুমি খুব ব্যথা পেয়েছিলে |”
মলিনাদি বলবে, “হ্যাঁ, ওটা মনে আছে ... কিন্তু, তার কথা এখন জেনে কী করবি ? ব্যথা তো একটা ছিল ... কিন্তু সে তো পুরানো হয়ে সয়ে গেছে | থাক না, অন্য কথা বল |”
আমি বলব, “না মলিনাদি | কথাটা ব্যথার শুধু নয় | তুমি সেই সময় আমাকে একটা গুটি পোকার কথা বলেছিলে একদিন | কিসের গুটি পোকা ?”
মলিনাদির দৃষ্টি কোমল করে বলবে, “ও ! ... সেই গুটি পোকাটা ? দেখবি ? দেখবি তুই গুটি পোকাটা ?”
আমি মাথা হেলাব |
...

মলিনাদি উঠে গিয়ে পাশের জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে এল | তারপর গলার পাক খুলে বুকের আঁচলটা একটু আলগা করে টেনে নামিয়ে দিয়ে বলল, “এই দেখ |” দেখলাম ব্লাউজের গলা খুব নিচু | তার উপরে বুকে একটা জড়ুল | না, গুটি পোকা নয়, শতপদও নয় | জোঁকের মত তেল চুকচুকে, কালো, কোঁচকানো গা একটা মস্ত জড়ুল | গাটা শিরশির করে উঠল | হয়ত শিউরে উঠেছিলাম | চট করে আঁচলটা তুলে গলায় জড়িয়ে নিয়ে মলিনাদি বলল, “তোকে ডেকে যে গল্প করতাম তা ছিল এই আশায় যে একদিন তুই ওটা টের পাবি | তখন তোকে ওটা দেখাবো | কেন জানি না, একটা বিশ্বাস হয়েছিল যে তুই দেখলেই ওটা সেরে যাবে | আমি ভালো হয়ে গিয়ে দিব্যি বিয়ে করতে পারব |”

আমি এক্কেবারে অবাক হয়ে বললাম, "তোমার মনে এই কুসংস্কারের ধারণাটা এসেছিল কী ভাবে ? আমি তখন জানলে কথাটা একদম উড়িয়ে দিতাম ।" মলিনাদি বলল, "আরে, ওই লিপিকা - ওই আমার মাথায় এইসব বুদ্ধি ঢোকাত । তোর কি মনে আছে একবার সরস্বতী পুজোর দিন – লিপিকা আমাকে শাড়ি পরাচ্ছিল, বাইরের ঘরের দরজা খোলা রেখে । আর তুই বাইরের ঘরে বসেছিলি | " আমি বললাম, "হ্যাঁ, লিপিকাদি তো আমাকে বলেছিল আমি যেন আয়না দিয়ে না তাকাই ভিতর ঘরের দিকে ।" মলিনাদি বলল, "সব ছল । ও বলেছিল, তোকে মানা করলে তুই ঠিক লুকিয়ে দেখবি । তুই দেখেছিলি কি, তাও ?" আমি বললাম, "কী যে বলো, মলিনাদি ! সেদিন আমি এত অস্বস্তিতে কাটিয়েছিলাম । সারাদিন ভেবেছিলাম তুমি আমাকে কতো খারাপ ভাবলে ।"
মলিনাদি বলল, "ওরে বোকা । তা কেন ভাববো ?"
আমি আশ্চর্য হলাম, "মানে ? তুমি কিছু মনে করো নি ?"

মলিনাদি মাথা নাড়ল, কথা বলল না । তারপর কোলে হাত জড় করে নিচু গলায় বলল, "আমিও তো ভাবতাম ... আমার এই জড়ুলের জন্য কোন ছেলে আমাকে শেষ পর্যন্ত পছন্দ করবে না, কেন না আমার সত্যবাদী পিতৃদেব পাকা দেখা হওয়ার আগেই পাত্রপক্ষকে বলে দিত আমার বুকে মস্ত একটা জড়ুল আছে । তাতেই সব ছেলে পালিয়ে যেত । তাই ভাবতাম – তুইও তো ছেলে । তুই যদি ওটাকে দেখে খারাপ মনে না করিস, দুরে না সরে যাস, তাও আমার কাছে আসিস, তাহলে জানতাম  ..."
...

আমি আর জিজ্ঞাসা করব না, "কী জানতে ?"
মলিনাদিও আর বলবে না, "জানতাম – যে সব ছেলের দৃষ্টি এক নয় । আর জানতে পারলে তোর মত একটা ভালো ছেলের আশায় অপেক্ষা করতাম ।"


------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২৩ মে ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই: