বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬

বুগেনভিলিয়া

|| বুগেনভিলিয়া ||


মোহন মাস্টার বিয়ে করে নি | চাপাচাপি করলেও কারণটা বলে না | বলে সময় হয় নি, বা পয়সা ছিল না, বা বয়স হয়ে গিয়েছিল প্রয়োজন বোধ করার আগে | আবার এও বলেছে, দরকারই পড়ে নি তেমন |

কিন্তু সেদিন আমাদের অন্য কথা বলল | অন্য প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল | মেয়েদের নিয়ে | এই বয়সে তো আর তেমন উত্তেজক কথা হয় না | তাও একজন কিছু বললে, অন্যজন তাতে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু মনে পড়ায় হটাত করে জেগে উঠে বলছিল, “জানেন, আমার একবার এমন হয়েছিল ... |”

শুনতে শুনতে কেমন উসখুস করে উঠে মোহন মাস্টার বলে বসল, “জানেন কি, মেয়েদের একটা মর্মস্থল হয় – kernel যাকে বলে ?”
“তাই ?” নিরুৎসাহে আমরা জানতে চাইলাম |
“হ্যাঁ !” বলল মোহন মাস্টার, “ফুলের মধ্যে ফুল | বুগেনভিলিয়ার ফুলে যেমন হয়, চারিদিকে বড় বড় পাপড়ি, আর তার মাঝে ছোট্ট একটা ফুল, অনেক সময় সাদা – একেবারে বিমল সাদা মাটা সাদা |”

একটু থেমে মোহন মাস্টার বলল, “আমি একবারই দেখেছিলাম ... অনুভব করেছিলাম একটা ফুলের মধ্যে অন্য আরেক ফুল ফুটছে | সেটাই মেয়েদের মর্মস্থল |”

আমাদের চেপে ধরা লম্বা নিঃশ্বাস মোহন মাস্টার কেড়ে নিয়ে বলল, “মেয়েরা যে প্রকৃতি নিয়ে জন্মায়, যা রূপ, গুণ আর পরিচয় নিয়ে, সেটা হল ওই বাইরের রঙিন পাপড়ি | সেটা নিয়েই বড় হয়, কারো মেয়ে থেকে কারো জীবনসঙ্গিনী হয়, পরে মা হয়, ঠাকুমা-দিদিমা | কুমারী থেকে যুবতী, একসময়ে পূর্ণযৌবনা, তারপর ভাঁটা পড়তে শুরু করে | কারো জন্মের রূপ, গুণ শেষদিন অব্দি থেকে যায় | কারো অল্পেই তার শেষ হয়, অনেক আগেই | এরই মধ্যে একসময় ওই ভিতরের ফুলটা ফোটে | সেটাই মেয়েদের মর্ম | তার নির্দোষ রূপ, গুণ, মায়া, মমতা, ভালবাসা দেখতে এক অন্য চোখ লাগে | আমি একসময় সেই চোখ পেয়েছিলাম, আর দেখেছিলাম ভিতরের ফুলটা একজনের মধ্যে |”

মোহন মাস্টার চুপ করে গেলেন | আমারও চুপ করে রইলাম | ‘কে সে ?’ সবাই ভাবছি, কিন্তু মুখে প্রশ্নটা আসছে না, যে যদি মোহন মাস্টারের ঘোরটা কেটে যায় |

কাটল না | মোহন মাস্টার আবার বলতে শুরু করল |

“দাদুর বাড়ির দোতলা থেকে পাশের একতলার বাড়িতে মেয়েটাকে দেখতাম | শুধু সকালে | সে স্নান করে এসে কাচা শাড়িটা পিছনের উঠোনে মেলত | আমি দেখতাম | আর তার চোখে ধরা পড়লে, সে মেলা শাড়িটার আড়ালে চলে যেত | চুপ করে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত | আমিও থাকতাম | শেষে আমাকে হার মানতে হত | দাদু ছিল খুব অবস্থাপন্ন | ওরা ছিল ভীষণ গরিব | তাই আমি ভাবতাম আমার জোর খাটানো উচিত নয়, সরে যাওয়াই ভালো | একদিন কী যে হল, মেয়েটা সরল না | শাড়ি মেলার ভঙ্গিতে তারের উপর হাত ধরে আমার দিকে তাকাল | আমি ওর ভিজে চুলে ঘেরা মুখটা দেখলাম | আর দেখলাম ওর চোখ, ওর চিবুক, গলা ... বাইরের ফুলটা পুরো দেখলাম সেদিন | আর দেখলাম একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি, কিছুটা আমাকে দোষারোপ করার আঁচ ছিল তাতে |

“তখন আমি সাইকেল চালান শিখছি | একদিন ওদের বাড়ির সামনে পড়ে গেলাম, বোকার মত চিতপটাং হয়ে | সেই সাথে শুনলাম কেউ খিলখিল করে হেসে উঠল | তাকিয়ে দেখি মেয়েটা জানালা দিয়ে আমার দুরবস্থা দেখে হাসছে, ভাবটা এই যে, এখন তো তুমি আমার চেয়েও অসহায়, দুর্বল | আর সেই মূহুর্তে ওর হাসির মধ্যে আমি ওর পরিমল মর্মস্থল দেখলাম | ক্ষণিকের জন্য ফোটা একটা ফুলের ভিতরের ছোট সাদা ফুল, কোন রেণু নেই, কুমারীর সিঁথির মত পরিষ্কার, নিষ্পাপ |

আমার যে কী মনে হল | মনে হল এই মর্ম একদিন মিটে যাবে, শেষ হয়ে যাবে, আর আমি কিছু করতে পারব না, একে ধরে রাখতে পারব না | বাইরের ফুল দেখে ভোমরা আসবে, আর মর্মের ফুলটা শেষ করে দিয়ে যাবে | আমি কিছু করতে পারব না |

“এরপর আমি চলে আসি | মনে কথাটা থেকে যায় | আর মন থেকে অন্য কোন ফুল দেখার, বা গ্রহণ করার বাসনাটা চলে যায় চিরকালের মত |”


-------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৯ মে ২০১৬

কোন মন্তব্য নেই: