মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৫

বেপরোয়া

৷৷ বেপরোয়া ৷৷

কিছুদিন ধরে কলেজের বিবেকের খোঁজ হচ্ছিল ৷ ফেসবুকেতে তো নেইই, কেউ ওর হদিশ, ই-মেল, কি মোবাইল নম্বরও জানে না ৷ কিন্তু, যেমন হয়, একদিন না একদিন সময়ের সমুদ্র টেনে নিয়ে যাওয়া সম্পর্ক হটাত ফিরিয়ে দেয় ৷

সেদিন শৈবাল ভবানীকে ফোন করল, “শোন, বিবেকের খবর আছে ৷ ব্যাটা গুরগাঁওয়ে আছে ৷”
- “কী করে যোগাযোগ করলি ?”
- “আরে, কোন এক লাফটার ক্লাবে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর সাথে আলাপ করে তার কাছ থেকে ও আমার ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিল ৷ এতদিন ফোন করে নি, নাকি সময় হয় নি ৷ কাল ফোন করেছিল জানাতে যে ও কলকাতায় আসছে ৷ আসার কারণ, মেয়ের বিয়ে ৷ অনেক কথা হল ৷ আমাকে বলল, ‘শৈবাল, একবার সবাইকে কন্টাক্ট কর ... সেই কলেজে শেষ দেখা ৷ জেনে নে কে কে আমার মেয়ের বিয়েতে আসতে পারবে, আর জানা আমাকে ৷ আমি তাদের নেমন্তন্ন পাঠিয়ে দেব ৷ সবাই এলে বেশ জম্পেশ করে আড্ডা দেয়া যাবে’ ... তুই আসবি তো ?”
ভবানী একটু ইতস্তত করে বলল, “আমার কথা তো জানিস ৷ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া যাবে না, আর গুষ্টি নিয়ে গেলে কতটা আড্ডা দিতে পারব জানি না ৷”
শৈবাল – “দেখ না চেষ্টা করে ৷ আমাদের গ্রুপের প্রায় সবাই আসছে – বিমল, রথীন, স্যাম, বিরাট, গুড্ডু ৷ নীতিনও বলছে, ও সেই সময় কলকাতার বাইরে না গেলে অবশ্যই আসবে ৷ আর, সব্বাই জানতে চায়, তুই আসছিস কিনা ৷”
ভবানী – “দেখি রে ... এই মুহূর্তে ঠিক বলতে পারছি না ৷”
শৈবাল – “উত্তরটা তৈরি রাখিস ৷ বিবেক ফোন করবে ৷”

কিছুদিন পরেই ভবানী বিবেকের ফোন পেল, “শৈবালের কাছে শুনেছিস তো, আমার মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি কলকাতায় ?”
ভবানী – “হ্যাঁ, সে খবর পেয়েছি ৷ তুই ছিলি কোথায় এতদিন ?”
বিবেক – “বলব ... আমি তোকে এখুনি এসএমএস করে বিয়ের দিনক্ষণ, আর যে গেস্ট হাউসটা ভাড়া নিয়েছি তার ঠিকানা, সব পাঠিয়ে দিছি ৷ তোকে কিন্তু আসতেই হবে ৷”
ভবানী – “দেখি .. তবে প্রমিস করতে পারছি না ৷ কিছু অসুবিধা আছে ৷”
বিবেক – “এখন ছাড়ছি ৷ এসে বলিস কী অসুবিধা ৷ ঠিক আছে ?”

কিছুক্ষণ পরেই বিবেকের এসএমএস পেয়ে ভবানী ভাবল, ‘না, একবার শৈবালকেই বলতে হবে, যে আমার পক্ষে হয়ত যাওয়া সম্ভব হবে না ৷’

তার আগেই – বিয়ের ঠিক দু’দিন আগে – শৈবাল ভবানীকে রাত্রি সাড়ে এগারটায় ফোন করল ৷
শৈবাল – “ভবানী ! কী করছিস ? কথা বলা যাবে ?”
ভবানী – “হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল ৷ কী খবর ? সব ভালো তো ?”
শৈবাল – “ভালই ৷ তুই কি আসছিস ?”
ভবানী – “না ৷ তোর মায়ের চোখ কেমন আছে ?”
শৈবাল – “ঠিকই আছে, কাল একবার দেখাতে যাব ... যদি, মা কথা শোনে ৷”
ভবানী – “আর সব খবর ?”
শৈবাল – “এই ... ছেলে শীতে আসছে, হপ্তা তিনেক থাকবে ৷আমি ভাবছি ওর ফেরার সময় ওর সাথে যাব ৷”
ভবানী – “বাহ ! বেশ ... আমরা ভেবেছিলাম এই গরমে যাব, কিন্তু ছেলে বাড়ি কেনা নিয়ে ব্যস্ত ৷”
শৈবাল – “সে তো ভালো খবর ! কোথায় কিনছে, বে এরিয়াতে ?”
ভবানী – “ওই, ওরা যেখানে থাকে, স্যান ব়্যমনে, অফিসের কাছাকাছি ৷”
শৈবাল – “দারুণ খবর ... জানিস, এই যে আমাদের ছেলেরা ইউএসএ তে থাকে ... আমি মাঝে মাঝে ভাবি, যদি বে এরিয়াতে আমাদের জন্য একটা বৃদ্ধাশ্রম হত, তাহলে কেমন হত ৷”
ভবানী – “ভালই হয়, তবে ভিসা কে দেবে ?”
শৈবাল – “ছেলের গ্রীন কার্ড কি সিটিজেনশিপ থাকলে, বাবা-মা পেয়েই যায় ৷ আমি অনেককেই দেখেছি – পাঞ্জাবি, গুজরাতি, এমন কি করাচীর এক ভদ্রলোক - কথাও বলেছি তাদের সাথে ৷ আমি বাড়ির কাছেই যে পার্কে হাঁটতে যাই, ওখানে আলাপ হয়েছিল এক ভদ্রলোকের সাথে ৷ উনি বললেন, একটা ইন্টার্ভিউ দিতে হয়, কোশ্চেন নাকি মোটামুটি একই ধাঁচের হয় ৷”
ভবানী – “তাহলে খোঁজ নিয়ে জানা ৷ তবে, জানি না বিদেশে কতদিন আমার ভালো লাগবে ৷ আমার যেন বয়েসের সাথে সাথে শিকড়ের টানটা বাড়ছে ৷”
শৈবাল – “দেখ, ওদেশে গিয়ে চিরকালের জন্য কেউ থাকে না ৷ আমার জানা এক পাঞ্জাবি স্বামী-স্ত্রী আছে ৷ ওরা বছরে একবার মাস দুয়েকের জন্য দেশে আসে ৷ বুড়ো-বুড়ি পেনসন পায়, তাই ...৷ আর এমনিতেও, আমি তো রিফিউজি হয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দিলাম ৷”
ভবানী – “রিফিউজি কেন?”
শৈবাল – “প্রথমত, বাবা-মা ইস্ট বেঙ্গল থেকে রায়টের ঠিক আগে চলে এসেছিল ৷”
ভবানী – “তাই বলে তুই কেন রিফিউজি হবি ?”
শৈবাল – “দ্বিতীয়ত, জন্ম ঘাটশিলায় ৷ পরে, নরেন্দ্রপুরে স্কুল করলাম ৷ বাবা-মা তারপরও সাত বছর ওখানেই ছিল ৷ বাবা কেন যে নরেন্দ্রপুরে একটা বাড়ি বানাল না জানি না ৷ তাই, যখন বাবার হার্ট-অ্যাটাক হল, দাদা বিদেশে, আমি বোকারোতে বাবা-মাকে নিয়ে এলাম আমার কাছে ৷ শেষে আমি না রইলাম ঘাটশিলার, না নরেন্দ্রপুরের, না বোকারোর ; আর কলকাতার তো নইই, কোনভাবেই ৷”
ভবানী –  “হ্যাঁ, তোর একটু যাযাবর অবস্থা হয়েছিল বটে ৷ তবে এখন তো কলকাতায় সেটল করেই গিয়েছিস ৷
শৈবাল – “না রে ৷ সেটল করতে আর পারলাম কই ?”
ভবানী – “তুই এই কথা বললি যখন ... জানিস, আজকাল আর আমার বেশিদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে না ৷ ভাবছি চলে যাই ৷”
শৈবাল – “এই ইচ্ছা-অনিচ্ছাটা তো আমার মধ্যেও প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে, কেন জানি না ৷ আমি কতদিন ধরে যে ভেবেছি কোন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাব – কী বলে, কী পরামর্শ দেয় দেখব ৷”
ভবানী – “সে কী রে !”
শৈবাল – “হ্যাঁ, একটুও বাড়িয়ে বলছি না ৷ আমার বউ অবশ্য এসব কিছু জানে না ৷”
ভবানী – “কেন ?”
শৈবাল – “দেখ, এইরকম কিছু কথা না সবার সঙ্গে শেয়ার করা যায় না – এই উপলব্ধিটা সম্প্রতি আমার মধ্যে এসেছে ৷”
ভবানী – “যা বলেছিস ... আমারও আজকাল কেমন যেন মনে হয় যে একদম খুউব আপনজন বলতে কেউ নেই ৷ এটা কোন অভিযোগ নয়, স্রেফ একটা চরম সত্য ৷”
শৈবাল – “আমার তো মনে হয় আমার প্রয়োজন মিটে গেছে ৷”
ভবানী – “আমারও ৷ তবে, আমি আজকাল একটু আধটু, মাঝে মধ্যে, পুনর্জন্ম কামনা করছি ৷”
শৈবাল – “পুনর্জন্ম ? পুনর্জন্মে তুই যে আবার তুই হয়েই আসবি কী করে জানলি ?”
ভবানী – “না, তা নয় – এটা জাস্ট একটা চান্স নেয়া মাত্র, যে যদি যাদের আমি জানতাম তাদের আমার পুনর্জন্মে পাই ৷ আমি শুধু জানতে চাই ওদের মধ্যে কে কে আমাকে কামনা করেছিল, কিন্তু মুখ ফুটে বলে নি ৷”
শৈবাল – “তার আগে, তুই কিন্তু তোর দ্বিতীয় প্রজন্ম দেখে যাস ৷ ওর টান খুব সাংঘাতিক ৷ আমার নাতি ওর ছোট মুঠি দিয়ে আমার হাত ধরে যখন হাটতে শিখত আমার কী অদ্ভুত আনন্দ যে হত ৷ অপার্থিবও বলতে পারিস ৷”
ভবানী – “আচ্ছা ?”
শৈবাল – “হ্যাঁ ... তোর ওই দ্বিতীয় কথাটা কিন্তু খুব ভয়ানক, খুব ছোঁয়াচে ৷ খুব বেপরোয়া চিন্তা ৷”
ভবানী – “কেন ?”
শৈবাল – “আমিও যে ভাবি, যাদের চেয়েছিলাম, এবং যারা আমাকেও চেয়েছিল, তারা কি এখনও আমার কথা ভাবে ?”
ভবানী – “এই শোন, আমি কিন্তু এই কথাগুলো মনে মনে নথিবদ্ধ করছি ৷ হয়ত কোথাও এই নিয়ে লিখব ৷”
শৈবাল – “লেখ না ৷ আমার কোনও আপত্তি নেই, সমস্যাও নেই ৷”
ভবানী – “ফাস-ক্লাস ! তা, যেমন তুই বললি, আমিও চিন্তা করি – বিশেষ করে, জীবনের কোন মুহূর্তের ভালো লাগাটা ক্ষণস্থায়ী, আর কোনটা দীর্ঘস্থায়ী সেটা কেন অজানা রয়ে গেল ৷”
শৈবাল – “তাই বলছি – তুই বিবেকের মেয়ের বিয়েতে এখানে আয় ৷ তুই এলে বেশ গুছিয়ে মনের কথা শেয়ার করে হালকা হওয়া যেত ৷”
ভবানী – “দেখা, এবার নয় তো, আরবার হবেই ৷ এই সুযোগটা অবশ্য আইডিয়াল ছিল, নিঃসন্দেহে ৷
শৈবাল – “আসলে কী জানিস, প্রথম প্রেম ভোলা যায় না – এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস ৷”
ভবানী – “কিন্তু প্রথম প্রেম চেনা যায় কী করে ? ইন ফ্যাক্ট, আমি ভাবি প্রথম প্রেমের পর, পরপর অন্য প্রেম - প্রতি পরবর্তীটা পূর্ববর্তী সব কটার চেয়ে বেশি মোহময়, আচ্ছন্ন করা, পাগল করা – এমন হল কেন ?”
শৈবাল – “প্রথম প্রেমের ব্যাপারটা কিন্তু অন্যরকম ৷ খুব ভালো বোঝাবুঝি হয় ৷ পরে, বড় হয়ে গেলে, আমরা স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রয়োজনের বেশি ব্যবহারিক হয়ে পড়ি ৷ আর সেটাই সুসংগতির পথটা গড়তে দেয় না ৷ পরের প্রেমগুলো ঠিক নিষ্পাপ, পরিচ্ছন্ন প্রেমও হয় না ৷ ওগুলোতে স্বার্থ মিশে থাকে ৷”
ভবানী – “সেটা ঠিক – কিন্তু, আমি শুধু জানতে চাই একটার পর একটা আকর্ষণ কেন হয়েছিল - স্রেফ ডারউইনিয়ান সিলেকশন ? তাই যদি হয়, তাহলে মানুষের আবেগ আছে কেন ?”
শৈবাল – “হতেই পারে ... ছাড় এখন এ’সব কথা ... তুই কিন্তু চেষ্টা কর বিবেকের ওখানে আসতে ৷ এইরকম সুযোগ আর আসবে না ৷”
ভবানী – “দেখি ... তবে সম্ভাবনা খুব কম ৷”
শৈবাল – “চল, আমি এবার শুতে যাই ৷ চোখ বুজে আসছে ৷ সারাদিন হাওড়া স্টেশনে কিছু কাজে একরকম টোটো কোম্পানি করেছি, এই ভ্যাপসা গরমে ৷”
ভবানী – “কেন ? কী হয়েছিল ৷ কাউকে সী-অফ না রিসিভ ? কাকে ? গাড়ি লেট ?”
শৈবাল – “বললাম তো ... আয় না, সব খুলে বলা যাবে ৷ তোর গল্পও শুনব ৷”
ভবানী – “ঠিক আছে, যা তাহলে শুতে ৷ গুড নাইট ৷”
শৈবাল – “গুড নাইট ৷”


---------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ২১ এপ্রিল ২০১৫

কোন মন্তব্য নেই: