রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫

কার্পেট-ব্যাগার

|| কার্পেট-ব্যাগার ||


শৈবাল ঘটনাটা বলেছিল, খানিকটা এই বয়ানে –

বুঝলি, আমার তখন প্রথম চাকরির প্রথম পদোন্নতি হয়েছে | একটু সচ্ছল অবস্থা – একনাগাড়ে ছ’মাস কেনাকাটা করে সংসারের খুঁটিনাটি মোটামুটি কুক্ষিগত করে একটু হাঁফ ছেড়েছি, কি, সীমা বলল ও জন্মদিনে একটা গালিচা নেবে | নতুন সোফার সামনে মেঝে নাকি ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে | অনেক বুঝিয়েও বোঝাতে পারলাম না যে জায়গাটা তত বড় নয়, গালিচা পাতলে আর খালি জায়গা থাকবে না | সব সময় গালিচায় মাড়িয়ে হাঁটতে হবে; আর আমদের দেশে জুতো চটিতে সবসময় ধুলো বালি থাকে | কিন্তু সীমা কিছুতেই শুনল না | তখন বললাম, 'আচ্ছা এই মাসটা যাক |' সীমা জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্রেডিট কার্ডে কেনা যায় কিনা ?’ সত্যিই, সদ্য সদ্য ক্রেডিট কার্ড নিয়েছি, বেশির ভাগ ভারী দামের জিনিস তাতেই কেনা হয়েছে |

অগত্যা, একদিন ওকে দোকানে, দোকানে নিয়ে গিয়ে, অনেক দেখে রেখে একটা গালিচা কিনে দিলাম | সাগর-সবুজ রঙের জমিতে পার্সি কারুকাজ করা সুন্দর গালিচাটা বেলজিয়াম এ তৈরি | সাইজ চার ফুট বাই ছ’ ফুট – কিন্তু দাম প্রচণ্ড | তারপর বিভ্রাট – কার্ড মেশিনের কী গণ্ডগোলে দোকানদার দামটা দু’বার চার্জ করে ফেললো | তাই নিয়ে কথা কাটাকাটি, ক্ষমা প্রার্থনা | শেষে. দোকানদার আবার আমাকে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য একটা চেক লিখে দিল | দোকান থেকে যখন বেরলাম রাত সাড়ে ন’টা | অতি কষ্টে একটা রিক্সা ধরে গালিচা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম |

প্রথমে ক’দিন ওই সুন্দর গালিচা পেতে ঘর আলো | সোফা দেয়ালের সাথে ঠেসে গালিচার চারপাশে একটু খোলা মেঝেয় পায়ে হাঁটার জায়গাও হল | সীমা গালিচায় বসে স্কুলের খাতা দেখে, বাতাবি ওতেই বসে খেলে, নয় পড়ে | আমিও মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফিরে ওতে বসে চা খাই | কিন্তু সে ক’দিন ? সীমা নিজেই একদিন বলে, পুঁটি মাসি নাকি ওর উপরেও ঝাড় দিচ্ছে | সর্বনাশ ! তাহলে তো গালিচা ধুলোয় ভরে যাবে | তখন ঠিক হল, অফিস যাওয়ার আগে আমি গালিচাটা ভাঁজ করে একপাশে করে যাব | পুঁটি মাসি দুপুরে এসে ঘর ঝাড় দিয়ে, মুছে দেবে | বিকেলে অফিস থেকে ফিরে আমি আবার গালিচাটা পেতে দেব | এই ভাবে চলল ক’মাস | তারপর সীমা বলল, ভাঁজ করে করে গালিচাটা নাকি খারাপ হয়ে যাচ্ছে, ‘তার চেয়ে বরঞ্চ যদি গালিচাটা রোল করে রাখা যায়, তাহলে কেমন হয় ?’ আমি বললাম, ‘তোমার পাঁঠা, তুমি যেদিকে কাটবে ... থুড়ি, ওটাকে যে ভাবে রাখবে ...’

আরও ক’মাস এই ভাবে কেটে গেল | এখন প্রায়ই গালিচাটা রোল করে ফেলে রাখা হয় | পড়ে থাকতে থাকতে ওটা একটু একটু করে খুলে যায়, তখন আবার রোল করতে হয় | সীমা বলল, ‘এতসব ঝামেলায় কাজ নেই, ওটাকে রোল করে দাঁড় করিয়ে রেখে দাও |’ বেশ, ওটাকে গুটিয়ে বসার ঘরের কোনে দাঁড় করিয়ে রেখে দিলাম | এর পর বাড়িতে কাউকে চা-জলখাবারে ডাকলেই ওটা পাতা হত | নইলে, ওটা দাঁড়িয়ে থাকত | শুধু শীত পড়লে ওটাকে খুলে, ভ্যাকুয়াম করে রোদে দিয়ে, সীমার স্কুলের ছুটির দিন ক’টা পেতে রাখতাম | সে’ ক’দিন পুঁটি মাসি বসার ঘরের ঝাড়া-মোছা বাদ দিত | আবার, সীমার স্কুল খুললে গালিচাটা কে গুটিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দেয়া হত |

একবার গরম পড়ছে কি টিকটিকির খুব উৎপাত | সীমা আবার টিকটিকি একদম সহ্য করতে পারে না | আমাকে বলল, গোল করে দাঁড় করানো গালিচার ভিতর নাকি টিকটিকি বাসা বেঁধেছে | টিকটিকি যে বাসা বাঁধে জানতাম না | কিন্তু, সীমা বলল, ‘ওরাও নিশ্চয় বাসা বাঁধে | নইলে ডিম পাড়বে কোথায় ?’ অগত্যা, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমাকে কী করতে হবে ?’ সীমা বলল, ‘একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট দিচ্ছি, ওটা কার্পেটের রোলের মাথায় টুপির মত পরিয়ে বেঁধে দাও, তাহলে ওর ভিতরে আর টিকটিকি ঢুকতে পারবে না | আর ওর ভিতরে ধুলোও ঢুকবে না |’

তাই করলাম | এই করতে গিয়ে গালিচাটা পড়ে গেলে ভিতর থেকে কিছু ভাঙ্গা টিকটিকির ডিমের খোলা বেরল | সীমা বলল, ‘দেখলে, টিকটিকি বাসা বাঁধে কিনা ?’ তাই তো, ডিম পাড়তে নিশ্চয় বাসা বাঁধতে হয় !

কিছু দিন পরে দু’জনের স্কুলে গরমের ছুটি হলে আমরা দার্জিলিং চলে গেলাম বেড়াতে | ফিরে এসে বাড়ি খুলে দেখি বদ্ধ ঘরে সে কি চিমসে দুর্গন্ধ | বুঝলাম, নির্ঘাত টিকটিকি মরেছে কোথাও | কিন্তু বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও মরা টিকটিকি পাওয়া গেল না | পুঁটি মাসিও পরদিন এসে কোথাও কিছু তেমন পেল না | তখন ও বলল, ‘তাহলে নির্ঘাত ওই কার্পেটের ভিতরে কোনও টিকটিকি আটকা পড়ে মরেছে |’ ‘ও মা’, সীমা শিউরে উঠে বলল, ‘মাসি তুমি তাহলে ওটা বাইরে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে এস না |’ পুঁটি মাসি বলল, ‘আমি কি করে অত ভারীটা তুলব ? আর ওই মরা টিকটিকির রসে হয়ত ওটা মাখামাখি হয়ে আছে, সেটা কী করে পরিষ্কার হবে ? ও তো ফিনাইল দিয়ে ধুতে হবে |’ সীমা গা ঘিন ঘিন করে বলল, ‘তাহলে মাসি কাউকে ডেকে নিয়ে এসো, কার্পেটটা নিয়ে যাক |’ আমি বললাম, ‘নিয়ে যাক মানে ?’ সীমা বলল, ‘নিয়ে যাক মানে নিয়ে যাক ! আমি আর ওই কার্পেটে হাঁটতে বসতে পারব না |’ আমি সীমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম | সীমা বলল, ‘কার্পেটটা কার, তোমার না আমার ?’ আমি বললাম, ‘তাহলে কাউকে দিয়ে দাও |’ সীমা বলল ‘কে নেবে মরা টিকটিকির রস মাখা কার্পেট ?’ পুঁটি মাসি সায় দিয়ে বলল, ‘যে নেবে সে কি আর গন্ধে টিকতে পারবে ? দিদি ঠিকই বলছে, ওটা ফেলে দেয়াই ভালো |’ শেষে রাজি হতেই হল | পুঁটি মাসি পাড়ার জমাদার বিশুকে ডেকে নিয়ে এলে | বিশু পনের টাকায় রাজি হল গালিচাটা নিয়ে ফেলে দিয়ে আসতে |

ক’দিন পরে বিশু বাথরুম, পায়খানা পরিষ্কার করতে এলে সীমা জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁ রে বিশু, সেদিন কার্পেটটা কত দূরে নিয়ে গিয়ে ফেললি ?’

বিশু বলল, ‘ফেলব কেন, দিদি ? একটু দূর যেতেই দেখলাম পুঁটির ছেলে দাঁড়িয়ে | ওকে দেখতেই  পুঁটি বলল, ‘দে, কার্পেটটা এখানেই নামিয়ে দে |’


----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৮ এপ্রিল ২০১৫

কোন মন্তব্য নেই: