বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৪

প্রণাম

|| প্রণাম ||


আশ্বিনের শেষ | দিন ক্রমে ক্রমে হ্রস্বতর হইতেছে | পূজা শেষ হইয়াছে | তাহারই অবসাদ যেন অস্তগামী সূর্যের দিনশেষ রশ্মিতে ঝরিতেছে | সুকোমল শয়নকক্ষে বসিয়া জানালা দিয়া আম্র কুঞ্জের পিছনে সূর্য বিলীন হইতে দেখিল  | দিন কয়েক যাবত তাহার যেন কিছুই ভালো লাগে না | অন্যান্য বারের মত এইবার সে গ্রামে আসিয়া বিশেষ আনন্দ উপভোগ করে নাই | কোন কিছুর সদ্য নূতন প্রয়োজন বোধ যেন তাহার বক্ষে একটি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার আকার লইয়াছে |

ঘরের ভিতর আসিয়া সৌদামিনী কহিল, “ঠাকুরপো, বাতি দিয়ে যাই |” সুকোমল কহিল, “না, থাক | এমনিই দিব্যি আছি |”
সৌদামিনী – “কেন ? কী হয়েছে ? মন খারাপ বুঝি, ফিরে যেতে হবে বলে ?”
সুকোমল – “না, তা হবে কেন | গেলেই তো স্কুল খুলে যাবে, আর সব বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে যাবে |”
সৌদামিনী নিকটে আসিয়া তাহার কপালে হাত রাখিয়া কহিল, “শরীর খারাপ নয় তো ?” সুকোমল মাথা নাড়িল, কিন্তু, বৌদির হাত সরাইল না | | বৌদির করস্পর্শ তাহার ভালো লাগে | কিছুক্ষণ এইভাবে সময় কাটিলে, কী ভাবিয়া সুকোমল কহিল, “আচ্ছা, ঠিক আছে বৌদি, যাও একটা বাতি নিয়ে এসো, আর, তেল আর নারকেল কুচো দিয়ে মাখা একটু মুড়ি |”

সৌদামিনী চলিয়া গেলে সুকোমল বসিয়া ভাবিবার চেষ্টা করিল তাহার কিসের অভাব বোধ হইতেছে | চিন্তায় মগ্ন রহিয়া সহসা তাহার জ্ঞান হইল যে কক্ষে কেহ আসিয়াছে | ভালো করিয়া ঠাহর করিয়া দেখিল প্রবেশ দ্বারের ভিতরে আসিয়া একটি বালিকা এক হাত বাড়াইয়া দাঁড়াইয়া আছে | সেই হাতে একটি কাঁসার বাটি | আশ্চর্য হইয়া সুকোমল শুধাইল, “তুমি কে ? কী করছ এখানে ?” বালিকাটি নিকটে আসিয়া কোন কথা না বলিয়া বাটিখানি তাহার দিকে বাড়াইয়া দিল | সুকোমল দেখিল তাহাতে কিছু মুড়ি ও দুইখানি বড় মোয়া | সে বাটিটি লইয়াছে কি, বালিকাটি কহিল, “আমি বকুল | ওই মোয়াগুলো আমার |” সুকোমলের বোধ হইল বালিকাটির বয়েস আট নয় বৎসর হইবে | সুকোমল হাসিয়া কহিল, “ঠিক আছে | তুমি তোমার মোয়াগুলো নিয়ে নাও, আর খাটে উঠে বসে খেয়ে নাও |”
উচ্চ পালঙ্কের দিকে চাহিয়া বকুল কহিল, “আমি অত উঁচুতে উঠতে পারব না ... আর, একটু পরেই তো চলে যাব |”
এমন সময় আলো দেখা গেল | একটি হ্যারিকেন লইয়া সৌদামিনী আসিয়া, হাসিয়া কহিল, “কি, আলাপ হল ?” বকুল সাথে সাথে উত্তর দিল, “আমার নাম তো আমি বলেছি | ও কে ?”
সৌদামিনী – “ও তোর দাদা হয় |”
বকুল – “দাদা ? কেমন দাদা ? নাম কী ?”
সৌদামিনী – “ওহ ! বড্ড প্রশ্ন করিস | তোর দূর সম্পর্কের দাদা হয় | ওর নাম সুকোমল, তুই কমলদা বলতে পারিস |” বকুল দ্বিধাভরে চাহিয়া সুকোমলের দিকে অগ্রসর হইয়া ঝুঁকিতেই, সে শশব্যস্ত হইয়া কেদারা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “থাক, থাক |” আজ অবধি কেহ তাহাকে প্রণাম করে নাই | সে সম্ভাবনার কথাও সে কখনও চিন্তা করে নাই | সৌদামিনী কহিল, “বকুলের মা হল তোমার দাদার দূর সম্পর্কের পিসিমা | পিসিমা বিকেলে মন্দিরে যাবে বলে গঙ্গায় গা ধুতে গিয়ে ফেরে নি দেখে পিসেমশায় খুঁজতে যাচ্ছিল | বকুল জেদ করল সাথে যাবে | কিন্তু অন্ধকার দেখে আমাদের বাড়ির কাছে এসে বলল, ‘আচ্ছা, আমাকে দিদির কাছে রেখে যাও’ |”
সৌদামিনী হ্যারিকেন খানি পালঙ্কের ছতরি হইতে ঝুলাইয়া, বকুলের হাতে দুইটি মোয়া দিয়া তাহাকে তুলিয়া পালঙ্কে বসাইয়া কহিল, “তুই বসে এগুলো খা, আর দাদার সাথে কথা বল | আমি একটু সন্ধ্যা দিয়ে আসি |”

কথা কিছুই হইল না | সুকোমল  মুড়ি খাইতে খাইতে পুতুলের মুখশ্রী নিরীক্ষণ করিল  | হ্যারিকেন খানি পুতুলের মাথার পিছনে হওয়ার জন্য তাহার মুখ ঠিক ভাবে দেখা না গেলেও, বুঝিতে পারিল যে তাহাকে দেখিতে মন্দ নহে | তবে মাথায় উচ্ছৃঙ্খল চুল | কী দেখিতে চাহিল, আর কী দেখিতে পাইল, সুকোমল তাহা তৎক্ষণাৎ জানিতে পারিল না | বকুল মন দিয়া মোয়া ভক্ষণ করিয়া সুকোমলকে প্রশ্ন করিল, “তুমি পড়াশুনা করো ?” সুকোমল হাসিয়া কহিল, “হ্যাঁ, আমি ক্লাস টেন এ পড়ি | তুমি ও বুঝি পড়াশুনা করো ?” বকুল কহিল, “হ্যাঁ ... না, আগে বলো, মোয়াগুলো খাচ্ছ না কেন ?” সুকোমল কহিল, “খাব না কেন ? তবে, তুমি খাবে তো নাও ?” সে দেখিল, বকুলকে ইহার বেশি বলার প্রয়োজন হইল না |

তুলসী তলা হইতে শঙ্খধ্বনি শোনা গেল | বকুল কপালে হাত তুলিয়া প্রণাম করিল | তখনই বাহির হইতে কেহ ডাকিল, “সৌদামিনী, ও সৌদামিনী, কই পারু কই ?” সৌদামিনীর সাড়া দিল, “আসি পিসেমশায় |” সদর দরজার অর্গল খোলার আওয়াজ হইল | কিঞ্চিত পরেই, “আয় বকুল, তোর বাবা এসেছে তোকে নিতে”, কহিয়া সৌদামিনী কক্ষে প্রবেশ করিল | বকুল পালঙ্ক হইতে লাফ দিয়া নামিয়া, হাতের মোয়া সুকোমলের বাটিতে ফেলিয়া, দৌড়াইয়া বাহিরে যাইতে যাইতে থামিয়া, পিছনে ফিরিয়া কহিল, “ওই যাহ্‌ ! প্রণাম ?” সুকোমল হাসিয়া কহিল, “এখন থাক | পরে কখনও কোরো |”
বকুল কহিল, “ঠিক আছে তাহলে, প্রণামটা বাকি রইল | তুমি কিন্তু ভুলবে না |”

কিছু পরে সৌদামিনী ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “কী কমল, কেমন দেখলে ? মিষ্টি না, মেয়েটা ?”
সুকোমল – “তেমন তো কিছু দেখলাম না | ওই তো ছোট্ট একটু মেয়ে – তার আবার সুন্দরী অসুন্দরী কী ?”
সৌদামিনী – “কই, আমি তো বলি নি ও সুন্দর দেখতে | সবাই অবশ্য বলে বড় হলে সুন্দরী হবে | ওর মা, সম্পর্কে যিনি তোমার মাসি হবেন, তিনি খুব সুন্দরী |”

সৌদামিনী সুকোমলের মামাতুত দাদার স্ত্রী | বয়েসে সুকোমল হইতে মাত্র ছয় বৎসরের বড় হইলেও মাতৃহীন বালকটিকে সে মাতৃস্নেহে আবৃত করিয়া রাখে | একই মাতৃস্নেহের দাবীতে সে প্রায়ই গ্রামের সুন্দরী বালিকাদিগের প্রতি সুকোমলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার চেষ্টা করে | কিন্তু সুকোমলের সদ্য শ্মশ্রু-গুম্ফের আভাস দেখা দিয়াছে – সে এই ব্যাপারে কপট গাম্ভীর্যে চরম উদাসীনতা প্রকাশ করিবার চেষ্টা করে | সৌদামিনী অন্তরে আমোদিত হইয়া নিশ্চিন্ত হয় |

সেই রাত্রে নৈশভোজ শেষ হইলে, পালঙ্কে শয়ন করিয়া হ্যারিকেনের শিখা স্তিমিত করিয়া সুকোমল চিন্তা করিল স্কুলে ফিরিয়া সে বন্ধুদের কাছে এই অদ্ভুত বালিকাটির কথা কহিবে কিনা | সহসা কিছু মনে পড়ায় সে সৌদামিনীকে ডাকিল, “বৌদি, শিগগির এসো |” সৌদামিনী আসিয়া কহিল, “কী হয়েছে ?”
সুকোমল – “আচ্ছা, ওই মেয়েটা কেন মুড়ির বাটি এনে বলল ওই মোয়াগুলো ওর ?”
সৌদামিনী – “আহা রে ! কী চিন্তায় ঘুম আসছে না, দেখো | ঠাকুরপো মশাই, ওই মোয়াগুলো পিসিমা দিন কয়েক আগে পাঠিয়ে দিয়েছিল | আমি যখন পারুকে বললাম, ‘যা, দাদার জন্য এই মুড়ির বাটিটা নিয়ে যা’, তখন ও বলল, ‘দাদাকে দুটো আমার মোয়াও দাও |’ জানো, ও সব কিছু নিয়ে ঐরকম করে | সবাই কে, সব জিনিস কে, নিজের মনে করে | কাল দেখব তোমায় দখল করতে ও সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, ‘আমার একটা নতুন দাদা হয়েছে’ |”
সুকোমল – “পারু ?”
সৌদামিনী – “হ্যাঁ, ওর নাম পারুল, বকুল ওর দিদির নাম | কিন্তু, ওই নাম নিয়েও ছোট থেকে পারু ঝগড়া করে, ‘আমার নাম বকুল | আমি বড়’ |”
সুকোমল – “আসল বকুল কত বড় ?”
সৌদামিনী – “সে তোমার থেকে ক’বছরের বড়ই হবে | কেন ?”
সুকোমল – “না, এমনি ... আমি কি তাকে দেখেছি ?”
সৌদামিনী সহসা সুকোমলের গাল টিপিয়া রহস্যের গলায় কহিল, “দেখে থাকলে ভুলতে না | ... নাও, এখন শুয়ে পড় তো |” সৌদামিনী বাতিটি লইয়া চলিয়া গেলেও অনেকক্ষণ তাহার ঘুম আসিল না | তাহার মানসে ওই চপলা বালিকার বিশৃঙ্খল কেশপুঞ্জ হ্যারিকেনের আলোক বিচ্ছুরিত করিয়া ভাসিতে থাকিল |

কিছুদিন পরে সৌদামিনী সুকোমলকে ডাকিয়া কহিল, “আসল বকুল এসেছে | তোমায় আলাপ করতে ডাকছে |” সুকোমল দাদার শয়ন কক্ষে যাইয়া দেখিল এক অপরূপ সুন্দরী বসিয়া | তাহার পরিধানের কাপড় সাদামাটা হইলেও, রূপসী মুখখানি দেখিলে বারম্বার দেখিতে ইচ্ছা করে | সলজ্জে সে যাইয়া প্রণাম করিলে,  বকুল কহিল, “সেদিন পারু এসে তোমার কথা বলছিল খুব |”
সৌদামিনী – “কী বলছিল ?”
বকুল – “বলছিল, নতুন দাদা না কিছুতেই আমার মোয়া খাচ্ছিল না | শুধু ড্যাবড্যাব করে আমাকে দেখছিল, আর ভাবছিল আমি কখন ওকে প্রণাম করব |”
সুকোমল সংকুচিত হইয়া কহিল, “বকুল দিদি, আমি একটু বেরুবো |”
বকুল – “আচ্ছা, তুমি এসো এখন | পারলে, বাড়িতে এসো |”

বাহিরে আসিয়া তাহার মাথায় এক অদ্ভুত ভাবনা দেখা দিল | যদি সে দুই ভগিনীকে একত্রে দেখিতে পাইত, তাহা হইলে কি জানিতে পারিত যে পারুল বড় হইয়া প্রকৃত সুন্দরী হইবে কিনা ?

দুই জন কে একত্রে দেখিবার সুযোগ এক দিন হইল, যখন সে ভবাই এর সহিত বাতাবী লেবু দিয়া ফুটবল খেলিয়া পায়ে চোট লাগাইয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে বাড়ি ফিরিতেছে | সহসা কেহ পিছন হইতে কহিল, “কী হয়েছে ? পায়ে লেগেছে বুঝি ?” সে পিছনে ফিরিয়া দেখিল, বকুল দিদি ও পারুল | ঠিক তখনই পারুল আমুদে গলায় কহিল, “আজ তো তাহলে তোমাকে আর প্রণাম করা যাবে না |”

ইহার পর প্রায় আট বৎসর সুকোমলের আর মাতুলালয়ে আসা হইল না | একেবারে কলেজ হইতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সম্পন্ন করিয়া সে আবার গ্রামে আসিল | যথারীতি তাহার পিতা আসেন নাই, কারণ শ্যালকের সহিত তাঁহার বিশেষ বনিবনা নাই | তবে তিনি মাতৃহীন পুত্রের উপর মামার অধিকার স্বীকার করেন | সুতরাং মামার পত্র অনুযায়ী, যে সুকোমল যেন চাকুরীরত হইবার পূর্বে একবার দেশ গ্রাম ঘুরিয়া যায়, তিনি সুকোমলকে গ্রামে পাঠাইয়া দিলেন |

সুকোমলের মামা, প্রতুল চন্দ্র মহাশয়, অবশ্য ভাগিনার মুখ দেখিয়া ভগিনীর মুখ স্মরণ করিয়াই খুশি থাকেন – আসিতে যাইতে স্নেহের অভিবাদন ব্যতীত আর বিশেষ কথাবার্তা করেন না | সুকোমলের দাদা, নবীন চন্দ্র, স্থানীয় বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার – নিজের কাজ কর্ম লইয়া ব্যস্ত থাকেন | সৌভাগ্যবশত, ইতিমধ্যে সৌদামিনীর এক কন্যা হইয়াছে | তাহার নাম সুরভি | পাঁচ বৎসরের সুরভি সহজেই কাকুর উপর আধিপত্য স্থাপন করিল | সুকোমল শৈশবের বন্ধুদের সন্ধান না পাইয়া অগত্যা সুরভির সহিত দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনে মন দিল | সে তাহাকে প্রত্যুষে গঙ্গার তীরে বেড়াইতে লইয়া যায় | বেলা হইলে বারান্দায় বসিয়া তাহাকে নিজের শৈশবের গল্প শোনায় | দ্বিপ্রহরে তাহার সহিত কথা কহিতে কহিতে সুরভি ঘুমায়, ও বৈকালে জাগিয়া তাহার সহিত মন্দিরে যায় | আবার নৈশভোজের পর সুরভি ঢুলু ঢুলু চক্ষে কাকুর কাছে শুইয়া রূপকথা শুনিতে শুনিতে ঘুমায় |

একদিন সুকোমল মন্দির হইতে ফিরিয়া দেখে বাড়ির খিড়কি দরজায়, পথের দিকে মুখ করিয়া সৌদামিনী দাঁড়াইয়া | তাহার সম্মুখে দুই তরুণী পথের দিকে পিঠ করিয়া কথাবার্তা করিতেছে | সুকোমল নিকটে আসিলে সৌদামিনী তাহাকে দেখিয়াই কিঞ্চিত উত্তেজিত কণ্ঠে কহিল, “ঠাকুরপো, দেখো তো, চিনতে পারো কিনা ?” সেই সাথে সে একটি তরুণীর চিবুকে হাত দিয়া তাহার মুখ ঘুরাইয়া দিল | তাহার পরিধান সবুজ পাড়ের গেরুয়া রঙের শাড়ি, যাহার অর্ধনমিত অবগুণ্ঠনের নিচে লহরিত কেশ বেষ্টিত, সিঁদুর মণ্ডিত, সিঁথি ও কপাল | তাহার গ্রীবায় স্বর্ণচম্পক দ্যুতি, কপোলে লালিমা,ও কমলা বর্ণের সুপক্ব ওষ্ঠাধরে সহসা লজ্জার অপ্রস্তুত মৃদু হাসি | এ হেন বর্ণাঢ্য সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য এত সন্নিকট হইতে সুকোমল পূর্বে দেখে নাই | তাহার অন্তরে যেন কোন সংযমের বন্ধন টুটিল | তাহার দৃষ্টি অপলক হইল | অবশ হাত হইতে সুরভির হাত স্খলিত হইল |

ঠিক এক মুহূর্তের অন্তরে অন্য তরুণীটি মুখ ঘুরাইলে সুকোমল তাহাকে দেখিয়া স্তম্ভিত হইল | দুই তরুণীর চেহারায় কিছু মিল হইলেও দ্বিতীয় জন লালিত্য হীন, বয়েসে মলিন | সুকোমল তাহাকে চিনিতে পারিয়া, অগ্রসর হইয়া, প্রণাম করিতে উদ্যত হইয়া কহিল, “কেমন আছ বকুল দিদি ?”

বকুল তড়িৎ বেগে পিছনে সরিয়া কহিল, “থাক, থাক !” তারপর সে কিঞ্চিত রুষ্ট কণ্ঠে প্রথম তরুণীটি কে কহিল, “তোর উচিত, সুকোমল কে প্রণাম করা |”

সে তাহার চপল মুখখানি সুকোমলের দিকে ঝুঁকাইয়া কৌতুকের সহিত কহিল,  “হ্যাঁ, ওনার একটা প্রণাম অনেক দিন ধরে তোলা আছে | তাই না, সুকোমলদা ?” সুকোমল অপ্রস্তুত হইয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আমি ... আমি তো ঠিক চিনতে পারলাম না |” সে কহিল, “ইস | বললেই হল ?” সৌদামিনী হাসিতে গদগদ হইয়া তাহাকে কহিল, “দেখলি, আমি জানতাম, ও তোকে চিনতে পারবে না |” তারপর সৌদামিনী সুরভি কে কহিল, “যা, তুই কাকু কে নিয়ে ভিতরে যা | আমি আসছি |”

কিছু পরে সৌদামিনী চা লইয়া আসিলে, সুকোমল কহিল, “ও কে ছিল, বৌদি | আমি তো চিনতে পারলাম না |”
সৌদামিনী – “তা তো হবেই | সেই কবে আট বছর আগে দেখেছিলে, তখন ওর বয়েস ছিল নয় |”
সুকোমল পালঙ্কে অর্ধ শায়িত অবস্থা হইতে সটান উঠিয়া কহিল, “বল কী বৌদি ? ও বকুলদি’র ছোট বোন পারু ?”
সৌদামিনী – “আজ্ঞে হ্যাঁ, মশাই | ও পারু | এক বছরের উপর হয়ে গেল, বিয়ে হয়ে গেছে |”
সুকোমল – “ও ! ... এই গ্রামেই ?”
সৌদামিনী – “হ্যাঁ, গ্রামেরই ছেলে |”
সুকোমল – “আর বকুল দিদি ?”
সৌদামিনী – “ওর বর শহরে থাকে | অবস্থা খুব একটা ভালো নয় | মাসে দুমাসে একবার আসে | ছেলেপুলে নেই | পিসিমা তো আগেই মারা গেছে | পিসেমশায়ও আজ যায়, তো কাল যায় | বকুলই পারুকে রেখেছে |”
সুকোমল – “রেখেছে মানে ? পারু কী শ্বশুরবাড়িতে থাকে না |”
সৌদামিনী – “না | বরটা জাহাজে কাজ করে | পারুলকে গ্রামে ফেলে রেখে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ায় | আগে ছুটিতে বাড়ি এলে ওকে নিয়ে যেত | বর চলে গেলেই পারু বকুলের কাছে চলে আসত | এখন তো ছ’মাসের উপর বরটা বাড়ি আসে নি | শুনেছি পারুকে কোনও টাকা কড়িও পাঠায় না | তাই, শ্বশুর-শাশুড়ি মুখে কিছু বলে না, কিন্তু ছেলের বউকে রাখতেও চায় না |”
সুকোমল – “আর পারু ?”
সৌদামিনী – “পারুও ... মুখে কিছু বলে না | দেখলে তো, কেমন মুখে হাসি মাখিয়ে থাকে | যাকগে, তুমি এই সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী করবে ? যার ভাগ্যে যা জোটে ... এখন তো তুমিও কিছু করতে পারবে না |”
সুকোমল, “আমি ?” কহিতে গিয়া বৌদির কথার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত অনুমান করিয়া নিরস্ত হইল |

সেই রাত্রে সুকোমলের মনে একটি চিন্তা দেখা দিয়া তাহাকে বিমর্ষ করিল | সে যে এক মুহূর্ত পারুলকে অপলক দৃষ্টিতে দেখিয়াছিল, তাহাতে কি কোনও অবাঞ্ছিত আকর্ষণ কিম্বা কামনা ছিল ? নতুবা, বকুল দিদি কেন এত দূরত্ব বজায় রাখিয়া কথা কহিল ? সে তো গতবারের মত তাহাকে বাড়িতে আসিতে আমন্ত্রণ জানাইল না |

গ্রামে আরও দিন কয়েক কাটাইয়া সুকোমল এক প্রভাতে সুরভি ঘুম হইতে উঠিবার পূর্বে বাড়ি ফিরিয়া গেল | বড় রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষা করিতে করিতে সহসা তাহার মনে হইল বিগত আট বৎসরে তাহার মাঝে মধ্যে গ্রামে আসা উচিত ছিল | কত কী বেদনাদায়ক পরিবর্তন হইয়াছে, যাহার যাতনা গ্রামের সহিত সম্পর্ক রাখিলে এতটা দুঃসহ হয়ত হইত না |

পঁয়ত্রিশ বৎসর জামালপুরে রেলের ওয়ার্কশপে কাজ করিয়া, একদিন সুকোমল কর্মজীবন হইতে অবসর লইল | বিবাহের কয় বৎসরের মধ্যেই তাহার পত্নী বিয়োগ হইয়াছিল | একমাত্র পুত্র বোর্ডিং স্কুল হইতে পড়াশুনা করিয়া কলেজের পাঠ শেষ করিয়া কর্মে যোগ দিয়াছে | সে কিঞ্চিত বাউণ্ডুলে প্রকৃতির | ছুটিতে বাড়িতে না আসিয়া এদিক ওদিক ঘুরিয়া বেড়ায় | পত্র লিখিবার অভ্যাস সে কখনই করে নাই | মাঝে মধ্যে টেলিফোনের মাধ্যমে পিতার খবর নেয় | চাকুরীরত অবস্থায় সুকোমল স্টেশনের নিকটে একটি বাড়ি নির্মাণ করাইয়াছিল | কাজেই ঠাঁইয়ের অভাব তাহার হইল না | বাকি রহিল জন সম্পর্ক | তাহার জন্য সে রোজ ‘মর্নিং-ওয়াক’ এ যাইয়া স্টেশনে পৌঁছায় | সেখানে চা ও কাগজ লইয়া একটি বেঞ্চিতে বসিয়া কাগজ পড়ে, রেলগাড়ি ও যাত্রীর গমনাগমন দেখে | অপেক্ষা করে যে, কোনও পরিচিত অধস্তন কর্মচারীর সহিত দেখা হইলে, যদি কিছু পুরানো কথাবার্তা হয় | কিন্তু সে বোঝে যে তাহার কর্মব্যস্ত জীবনের নেপথ্যে তাহার অজান্তে সমাজে বহু পরিবর্তন হইয়াছে | মানুষ আর আগের মত নাই | দু’টি কথা হইতে না হইতেই যেন লোকে পলায়িত সময়ের পিছনে ছুটিবার জন্য উদ্যত হয় | অবশ্য, প্রতি বৎসর এক বার সুরভি স্বামী, পুত্র, কন্যা লইয়া আসে কয় দিনের জন্য | সেই কয় দিন আর সুকোমল স্টেশনে যায় না |

একদিন তাহার এক প্রাক্তন অধস্তনের সহিত এক হ্রস্ব বার্তালাপের পর সুকোমল তাহার দ্রুত প্রস্থানের দিকে তাকাইয়া অন্যমনস্ক হইলে, সহসা কেহ তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, “আরে, সুকোমল না |” সুকোমল চাহিয়া দেখিল তাহারই মত বয়েসের এক ভদ্রলোক,  পরিধানে ধুতি, জামা ও কোট | সুকোমল উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আমি তো ঠিক চিনতে পারলাম না |” ভদ্রলোক সহাস্যে কহিল, “আরে বসো, বসো | আমিও বসি | ক’দিন ধরে তোমাকে দেখছি, আজ ঠিক চিনতে পারলাম | আমি জযপুরের ভবতোষ |” ‘ভবতোষ, ভবতোষ ...’, চিন্তা করিয়াও সুকোমল মনে করিতে পারিল না | “আরে, সেই বাতাবি লেবু নিয়ে ফুটবল খেলা, ভুলে গেছ ?”, ভদ্রলোক মনে করাইবার চেষ্টা করিলেন | সাথে, সাথে সুকোমলের মনে পড়িল, গ্রামের ভবাইয়ের কথা – যাহাদের বাড়িতে একটি খর্ব ঝাঁকড়া বাতাবী লেবুর গাছ ছিল | তাহাতে অবিশ্বাস্য রকম বৃহৎ ও বিস্বাদ অজস্র ফল হইত | পাকিলে তাহার বাহিরে হালকা হলুদ রং ধরিত, কাটিলে দেখা যাইত ভিতরের রং  হালকা গোলাপি | ভবাই ফুটবল খেলায় জেদাজেদি করিত বলিয়া তাহাকে কেহ খেলায় লইত না | সে একাই একটি বাতাবী লেবু লইয়া সামনের মাঠে খেলিত | 

সুকোমল কহিল, “ভবতোষ মানে, তুমি ভবাই ? হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে |” তৎক্ষণাৎ তাহার মনে পড়িল সেই স্কুলের কালে শেষ বার যখন সে গ্রামে যায়, একদিন ভবাইয়ের সহিত খেলিয়া পায়ে লাগিয়াছে, খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে বাড়ি ফিরিতেছে, সহসা কেহ পিছন হইতে তাহাকে ডাকিলে সে পিছনে ফিরিয়া দেখিয়াছিল বকুল দিদি ও পারুল কে | সেই তাহার শেষ দেখা বালিকা পারুলের সহিত, যাহার মুখচ্ছবি তাহার আর মনে পড়ে না |

তাহার চিন্তা স্রোত থামাইয়া ভবতোষ কহিল, “তা, তোমার খবর কী ? মনে হয়, অবসর নিয়ে জামালপুরেই বাস করছ | বাড়িতে কে কে আছে ?” সুকোমল সংক্ষেপে তাহার পারিবারিক ইতিহাস অবগত করাইয়া কহিল, “তোমার কথা বলো |”
ভবতোষ জানাইল যে সেও বিপত্নীক | পুত্র জামালপুরে রেলের কন্ট্রাক্টর | এখনও বিবাহ হয় নাই | কথাবার্তা চলিতেছে | পিতা ও পুত্র স্টেশন হইতে কিছু দূরে রামপুর কলোনিতে থাকে | কোন কোন দিন কাজে আসিবার পথে পুত্র তাহাকে মোটরসাইকেলে স্টেশনে ছাড়িয়া দেয় | সে স্টেশনে প্রাতরাশ করিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে বাড়ি ফেরে | পথে দৈনিক বাজার  সারিয়া লয় |

কিছু পরে ভবতোষ উঠিয়া কহিল, “আজ তাহলে আসি | আশা করি মাঝে মধ্যে এই ভাবে দেখা হবে, গল্প করা যাবে |”

কয় মাসের ভিতর সুকোমল ভবতোষের সহিত গল্প-গুজবে গ্রামের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানিতে পারিল না | কিম্বা, যাহা জানিল তাহা বিশেষ কিছু নহে | সে জানিত যে গত দুই পুরুষে গ্রামের প্রায় সকল চেনা জানা লোকই গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিল | সুরভির বিবাহ হইলে তাহার দাদা ও বৌদি বেশি দিন বাঁচে নাই | তখন সুরভি গ্রামের বাড়িটি বিক্রি করিয়া দেয় |
ভবতোষ বাকি যাহাদের কথা কহিল তাহাদের কাহাকেও সুকোমল চিনিতে পারিল না | কিছুদিন তাহার ইচ্ছা করিল বকুল ও পারুলের কথা জিজ্ঞাসা করে | কিন্তু দ্বিধা বোধ করিয়া সে প্রশ্ন করা হইল না |

প্রায় এক বৎসর কাটিলে, একদিন ভবতোষ জানাইল তাহার পুত্রের বিবাহ স্থির হইয়াছে | কন্যার পিতা গ্রামেরই ছেলে, অধুনা মিহিজামে রেলে ‘সার্ভিস’ করে | ভবতোষ আগ্রহ প্রকাশ করিল যে সুকোমলকে বর যাত্রীতে যাইতে হইবে | সুকোমল কহিল, “না না | আমাকে আর ওই কচি কাঁচাদের দলে নিও না | রবি (ভবতোষের পুত্রের নাম) যাক না ওর বন্ধু বান্ধব নিয়ে |” ভবতোষ অনেক অনুরোধ করিয়াও তাহাকে রাজী করাইতে পারিল না | শেষে ভবতোষ কহিল, “এত যে গ্রামের এর ওর খোঁজ খবর নাও, বিয়েতে গেলে গ্রামের কিছু না কিছু চেনা মুখ দেখতে পেতে | এক রাতের তো ব্যাপার | মেয়ের বাবা স্টেশনে থাকার ব্যবস্থা করছে | কী ভাবে জানি না | তবে যা শুনছি, যোগাড় যন্তর করে একটা রিটায়ারিং রুম আর একটা ডরমিটরি পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে | চলো চলো, আর আপত্তি কোরো না |” সুকোমল কহিল, “দেখি, ভেবে দেখি |” সে কহিতে পারিল না যে তাহার পত্নী বিয়োগের পর সচরাচর সে বিবাহের নিমন্ত্রণে যাইতে পছন্দ করে না |

সেইদিন সুকোমল স্টেশনে বসিয়া ভাবিয়া কুল পাইল না যে সে কাহাকে দেখিতে চায় | ভবতোষের কথা হইতে সে জানিয়াছিল যে তাহার সমসাময়িক গ্রামের চেনা জানা প্রায় সকলেই প্রবাসী হইয়াছে, কেহ কেহ পরলোকেও গমন করিয়াছে | কেবল বকুল দিদি ও পারুলের কথা সে জানে না | বকুল দিদির বয়েস নিশ্চয় চৌষট্টি পঁয়ষট্টি হইবে | সে কি আর বাঁচিয়া আছে ? আর পারুল – সে নিশ্চয় এতদিনে স্বামীর সহিত অন্য কোথাও সুখে ঘর করিতেছে |

বিবাহের দুই দিনে পূর্বে এই অসহ্য অধীরতা হইতে মুক্তি পাইতে সে ভবতোষ কে জানাইল যে সে বিবাহে যাইবে না, তবে বৌভাতে অবশ্যই যাইবে |

বৌভাতের দিন এই কার্যে ওই কার্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখিয়া সে যখন ভবতোষের বাড়ির নিকট ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব’ এ পৌঁছাইল তখন রাত প্রায় সাড়ে নয়টা | রাস্তার ধরে উচ্ছিষ্টের ঢিপি দেখিয়া বোধ হইল বেশ কিছু অতিথি আসিয়া চলিয়া গিয়াছে | তথাপি লোক প্রচুর, যাহাদের পোশাক ও ইতস্তত হাবভাব হইতে আন্দাজ করা যায় যে তাহারা গ্রাম্য | সে ভবতোষ কে খুঁজিয়া পাইয়া কহিল, “কই, কোথায় ছেলে, আর ছেলের বউ |” ক্লাবের হলঘরে খাওয়ার আয়োজন ছিল | তাহার পার্শ্বে একটি ছোট কামরায় এক মঞ্চে বসানোর ব্যবস্থায় বর-বধূ আসীন | সুকোমল মঞ্চে যাইয়া বর-বধূ কে আশীর্বাদ করিয়া নববধূর হাতে উপহার দিয়া রবির সহিত কিছু কথা কহিয়া নামিয়া আসিল | তারপর সে কোনদিকে যাইবে, কী করিবে, ভাবিতেছে, এমন সময় ভবতোষ তাহাকে পিছন হইতে কহিল, “দেখ তো, সুকোমল, একে চিনতে পার কিনা ?” কে ঘুরিয়া দেখিবার পূর্বেই পিছন হইতে তাহার সামনে আসিয়া দাঁড়াইল এক প্রৌঢ়া, পরিধানে সরু নীল পাড়ের সাদা সুতি শাড়ি, ও সাদা ব্লাউজ | ফেস পাউডারের আতিশয্যে রুক্ষ তাহার চেহারায় যায়-যায় সৌন্দর্যের যে ছটা এখনও অবশিষ্ট তাহাতে এক নজরে বেশিক্ষণ তাকানো সম্ভব নহে |

চেহারাটি চেনা চেনা মনে হইলে সুকোমল প্রণাম করিতে যেই নত হইল, মহিলাটি কহিল, “ছি ছি, এ কী করছেন | আমি যে আপনার চেয়ে ছোট |” সুকোমল বিস্মিত হইয়া কহিল, “পারুল ?” সে ম্লান হাসিয়া কহিল, “যাক ! আপনি ভেবেছিলেন বকুল দিদি, তাই না ?” সুকোমল বিব্রত মুখে কহিল, “না মানে, ... তা, বকুলদি কই ?” |
পারুল – “দিদি তো আর নেই ?”
সুকোমল – “সে কী ?”
পারুল  – “হ্যাঁ, দিদি, জামাইবাবু অনেক বছর হল মারা গেছে | আপনি জানতেন না ?”
সুকোমল – “ও, ... না, আমি জানতাম না, ... আর তুমি, তুমি কেমন আছ ? কোথায় আছ তোমরা ?”
পারুল  – “বর্দ্ধমানে থাকি | একটা স্কুলে পড়াই |”
সুকোমল – “তোমার বর ? সে কই ? ডাকো তাকে, আলাপ করি |”

পারুল তাহার দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে চাহিয়া কহিল, “আমার বর ? দাঁড়ান, আগে আমি আপনাকে প্রণাম তো করি |” সুকোমল দেখিল পারুলের কপালে সেই বড় সিঁদুরের ফোঁটা জ্বলজ্বল করিতেছে | সিঁথিতেও দু’কুল ছাপাইয়া চওড়া সিঁদুরের রেখা | সে দ্রুত পিছনে সরিয়া কহিল, “থাক, থাক | পায়ে হাত দিতে হবে না | তুমি খেয়েছ ?”

তৎক্ষণাৎ পিছন হইতে ভবতোষ কহিল, “সুকোমল, চলো খেয়ে নেবে | অনেক রাত হয়েছে | আমি বলি কী,  আজ রাতটা এখানে থেকে যাও | এইরকমই চেনা জানা লোকের সাথে গল্প স্বল্প করে সকালে চলে যেও, না হয় | শোয়ারও ঢালাও ব্যবস্থা আছে | চাইলে চোখ বুজে একটু গড়িয়ে নেবে |”

সত্যই, খাইতে খাইতে রাত বারোটা হইয়া গেল | এত রাত্রে গাড়ি-ঘোড়া কম, আর নির্জন মধ্যরাত্রে যাতায়াত ও সমীচীন নহে | তদুপরি, সুকোমলের মনে হইল, পারুলের বরের সহিতও আলাপ করা হয় নাই | সে পান খাইতে খাইতে বাহিরে রাস্তায় পায়চারী করিতেছে, এমন সময় ভিতরের মৃদু গুঞ্জন ছাপাইয়া হারমোনিয়ামের আওয়াজ শোনা গেল, কেহ গাহিতে লাগিল, “ভাঙা দেউলে মোর কে আইলে আলো হাতে / বলে দিল কে পথ, এ কালো রাতে” | সহসা কিসের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হইয়া সুকোমল দ্রুত পায়ে ভিতরে আসিল | দেখিল, সেই মঞ্চে বসিয়া পারুল গান গাহিতেছে | সাথে একজন অলস ভাবে হারমোনিয়াম বাজাইতেছে | তবলচি যে সে চুপ করিয়া বসিয়া আছে | সম্মুখে মেঝেতে শতরঞ্জি পাতিয়া শ্রোতারা বসিয়া শুনিতেছে | সে ও পিছনের সারিতে দেয়ালে হেলান দিয়া বসিয়া পড়িল |

আরও এক দুইটি গান গাহিয়া পারুল উঠিয়া চলিয়া গেল | তাহাকে আর দেখা গেল না | গান বাজনা চলিতে থাকিল | রাত্রির সাথে সাথে শ্রোতারা ক্রমে ক্রমে নিঝুম হইল | কেহ কেহ শুইতে চলিয়া গেল | কখন তাহারও চক্ষু নিমীলিত হইল, নিদ্রা তাহাকে গ্রাস করিল, সুকোমল টের পাইল না | ঘুমে কাতর হইয়া সে ঢলিয়া পড়িল, সেই ভাবেই রহিল, যতক্ষণ না কেহ আসিয়া তাহাকে ডাকিল | সে দেখিল মঞ্চ খালি, মেঝেতে এক আধ জন তাহারই মত নিদ্রামগ্ন | যে চাকর ধরনের ব্যক্তিটি তাহাকে ডাকিয়াছিল সে কহিল, “বাবু, এক দিদি আপনাকে ডেকে দিতে বললেন |” সুকোমল কহিল, “কে ?” চাকরটি কহিল, “তা তো জানি না | দিদিমণি খালি বললেন আপনাকে ডেকে খবর দিতে যে উনি চলে যাচ্ছেন |”

সুকোমল দ্রুত হাতে মুখে চোখে জল দিয়া বাহিরে আসিয়া দেখিল ভোরের আলো সবে ফুটিতেছে | প্রকৃতি তখনও নিস্তব্ধ, কাক পক্ষীর কোলাহল শুরু হয় নাই | রাস্তায় একটি রিক্সা ডাকিয়া তাহার উপর একটি স্যুটকেস রাখিয়া সেই চাকরটিই পাশে দাঁড়াইয়া আছে | ক্লাবের গেটের নুড়ি ঢাকা পথে অবগুণ্ঠিতা এক মহিলা, পরিধানে সেই সরু নীল পাড় সাদা তাঁতের শাড়ি | সুকোমলের ক্ষিপ্র পদক্ষেপে নুড়ির কর্কশ শব্দ শুনিয়া পারুল তাহার দিকে মুখ ফিরাইল | ভোরের মৃদু হওয়ায় হিল্লোলিত তাহার চূর্ণকুন্তল  দেখিলেও, সুকোমল লক্ষ্য করিল তাহার দুই চক্ষু নিদ্রার অভাবে ফোলা, ও লাল | তাহার নিকট পৌঁছাইলে, পারুল নিম্ন স্বরে কহিল, “সুকোমলদা, আমি আসি | কত দিন পরে আপনার দেখা পেলাম, আর, আবার কবে দেখা হবে জানি না | তাই ডেকে পাঠালাম | এই হয়ত শেষ দেখা |”
সুকোমল – “না, না | তা হবে কেন ?”
পারুল – “কে জানে, ... তাই, একটা শেষ কথা ... ”
সুকোমল – “কী ? ... কী শেষ কথা ?”
পারুল – “সেই  ... সেই অনেক দিনের তুলে রাখা প্রণামটা যদি আজ আপনি গ্রহণ করেন |” তাহার কণ্ঠে দ্বিধা | তবুও, সে সুকোমলের উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া চট করিয়া নত হইয়া তাহার পা স্পর্শ করিয়া অবগুণ্ঠন সরাইয়া মাথায় হাতখানি  ঠেকাইল | সুকোমল দেখিল সেই হাতের মণিবন্ধ আভরণ হীন | সে হেঁট মাথা উঠাইলে সুকোমল তাহার মাথায় হাত রাখিতে গিয়া যে শূন্যতা দেখিল, তাহাতে স্তম্ভিত হইয়া কহিল, “এ কী করেছ, তুমি ?”

পারুলের সিঁথি শূন্য, কপালে সিঁদুরের টিপটি ও নাই | সে অবগুণ্ঠনের কাপড়  গলবস্ত্রের মত টান করিয়া গলায় জড়াইয়া আঁচলের প্রান্ত দিয়া যেন বুকের ওঠাপড়া ঢাকিল | কহিল, “কাল রাত্রে আমার মনে হয়েছিল, কি জানি হয়তো সেটা ভুল চিন্তা, যে সধবার চিহ্ন নিয়ে আপনাকে প্রণাম করার যোগ্য আমি নই | তাই ... আচ্ছা, এবার আমি আসি ?”

তারপর ধীর পায়ে রাস্তা পার হইয়া রিক্সায় উঠিয়া সে কহিল, “আপনি ভালোয় ভালোয় থাকবেন |”
রিক্সা রওয়ানা দিল |


------------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৩০ অক্টোবর ২০১৪




কোন মন্তব্য নেই: