মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৪

স্বৈরিনী

|| স্বৈরিনী ||

পিতার গ্রামবাসী বাল্যবন্ধু রঘুনাথের সহিত বৎসরে একবার, অধিকতর গ্রীষ্মকালে, গ্রাম-দেশে ছুটি কাটাইতে গেলে সাক্ষাত হইত । পিতা গ্রামের স্কুলে বেশিদিন পড়াশুনা করেন নাই । নিম্ন শ্রেণীতেই পিতামহ তাঁহাকে সদরে এক ধর্মীয় মহারাজের আবাসিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়াছিলেন । সেথা হইতে ম্যাট্রিকে উত্তীর্ণ হইয়া পিতা কলিকাতার এক কলেজে যোগ দেন । পরবর্তী কালে তিনি বিহার প্রদেশে চাকুরীরত হন । এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার আন্দাজ যে, রঘুকাকা পিতার অতি শৈশবের বন্ধু  ছিলেন ।

প্রায়শই আমাদের যাত্রা এইরূপ হইত যে আমরা গ্রামে রাত্রিকালে পৌঁছাইতাম । পরবর্তী এক দুই দিনে পিতামহের সহিত যত প্রয়োজনীয় (ও কিছু অপ্রয়োজনীয়) কথাবার্তা সম্পন্ন হইলে, এক সকালে প্রাতরাশ সমাধা করিয়া, পিতা রঘুকাকার সহিত সাক্ষাতের জন্য রওয়ানা হইতেন । পিতার নিষ্ক্রমণের পর আমি ইচ্ছামত আচরণ-বিচরণের স্বাধীনতা পাইতাম । পিতামহের বাটীতেই বড় জেঠা বাস করিতেন । তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র জগবন্ধু, ডাকনাম জগা, বয়েসে আমার অপেক্ষা কয়েক বৎসরের বড় হইলেও আমার বন্ধু ন্যায় ছিল । আমার মেজ জ্যাঠা, যিনি কৈশোরেই পিতামহের সহিত নিত্য বাদ-বিতণ্ডার ফলে এই বাটী ত্যাগ করেন, নিকটেই নিজস্ব বাটীতে বাস করিতেন । আমার প্রায় সমবয়সী তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র মহারাজ, ডাকনাম মহা, সে ও আমার বন্ধু ছিল । এই দুইজনের সহিত আমার খেলাধুলা চলিত, যতক্ষণ না পিতা বাটীতে প্রত্যাবর্তন করিতেন । অতঃপর তিনি আমাকে গ্রামের নদীতে স্নান করিতে লইয়া যাইতেন । কদাচ, অত্যধিক রৌদ্র, অথবা সময়ের অভাব হইলে বাটীতেই কূপের জলে স্নান হইত । তাহা আমার বিশেষ পছন্দ ছিল না ।

রঘুকাকা ছিলেন কৃশকায়, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ । তাঁহার সর্বদা সংকুচিত আননে লক্ষ্য করিবার মত ছিল ক্ষুদ্র তীক্ষ্ণ নাসিকা, ও তাহার নিচে চার্লি চ্যাপলিন ঢঙে ছাঁটা গুম্ফ, যাহা দেখিয়া বোধ হইত নাসিকা হইতে কিছু নির্গত হইয়া জমিয়া গিয়াছে । তাঁহার কুঞ্চিত ললাটের উপর অত্যন্ত তৈলাক্ত কোঁকড়ান কিছু কেশদাম সর্বদাই অবিন্যস্ত ভাবে পড়িয়া থাকিত । গভীর কোটরে অবস্থিত তাঁহার চক্ষু দুইটি ছিল লম্বা কৃষ্ণ পলকে আচ্ছাদিত । তাঁহার চোখ পিটপিট করার মুদ্রাদোষে পলকগুলি অসহায় ভাবে অনবরত উঠানামা করিত । এই সব কারণে তাঁহার চেহারা, অন্তত আমার মনে, এক অদ্ভুত করুণার উদ্রেক করিত । তিনি গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করিতেন । শুনিয়াছি, তাঁহার প্রচুর চাষের জমিজমাও ছিল । কিন্তু এই দুইয়ের উপার্জন সত্যেও কোন কালেই তাঁহার অবস্থায় সচ্ছলতা আমি দেখি নাই । তিনি সর্বদা পরিধান করিতেন ফিতা বাঁধা সাদা ফতুয়া, ও আজানু ধুতি, যাহারা কখনই সাবানের মুখ দেখে নাই । তাঁহার পায়ে খয়েরি রঙের ক্যাম্বিসের জুতা, ও বগলে একটি অতি পুরাতন ছাতা থাকিত । এই বিবর্ণ, প্রায় ক্যাম্বিসের জুতার রঙের ছাতাটি তাঁহাকে প্রখর রৌদ্রেও কখনও ব্যবহার করিতে দেখি নাই ।

রঘুকাকার ভিটা পিতামহের বাটীর অতি সন্নিকটে ছিল । সেই ভিটাতে একটি স্খলিত-প্লাস্টার ইটের বিকশিত-দন্ত শোভিত কয় কামরার বড় গৃহ, তাহার পার্শ্বে একটি মাটির বড় কুটির, ও কয়েকটি ধানের গোলা ছিল । আমি অত্যন্ত শৈশবে হয়তো পিতার সহিত রঘুকাকার ভিটাতে এক-আধ বার পদার্পণ করিয়াছি । কিন্তু, ক্ষীণ স্মৃতি হইতে মনে পড়ে না যা তাঁহার বাটীতে কখনও প্রবেশ করিয়াছি । পিতামহের বাটীর সদরের রাস্তা দিয়া বাম দিকে কিছু দূর যাইলে, রঘুকাকার বাটী ও তৎসংলগ্ন আম বাগানের পরেই আসিত ‘তেঁতুলতলা’ নামক এক চৌমাথা, যেখানে এক বিশাল তেঁতুল বৃক্ষ তলে এক উচ্চ মাচান ছিল । চৌমাথা হইতে কিঞ্চিত অগ্রসর হইলে কিছু আনাজ, মুদি ও কাপড়ের দোকানের বাজার ছিল, এবং তাহার পর আমার দুই পিসা-মহাশয়ের বাটী, একের পর এক । পিতা বাটীর বাহিরে গেলে কোন কারণে তাঁহাকে ডাকিতে আমাকে ওই চৌমাথা কি বাজার অব্দি যাইতে হইত । তেঁতুলতলার মাচানে উপবিষ্ট এক বা একাধিক গ্রামের প্রবীণ ও অশীতিপর বৃদ্ধ তামাকু সেবন ও পরচর্চায় রত থাকিতেন । সর্বদাই তাঁহাদের কাছে পিতার গতিবিধির খবর পাওয়া যাইত । ইহা মনে পড়ে না যে তাঁহাকে পাইতে কোনদিনই রঘুকাকার বাটী গিয়াছিলাম ।

পিতা কোন কালেই রঘুকাকা সম্বন্ধে বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন নাই । উভয়েই সর্বদা অত্যন্ত মৃদু স্বরে কথাবার্তা করিতেন,  রঘুকাকা কেবল পিতার প্রশ্নের উত্তরে । সর্বপ্রকারে অত্যন্ত শহুরে আমার পিতা ও নিতান্ত গ্রাম্য রঘুকাকা, উভয়েই মিতভাষী – এই দুইজনের মধ্যে কী ভাবে এত অন্তরঙ্গতা সম্ভব হইয়াছিল তাহা কোনদিন জানিতে পারি নাই । কদাচিৎ রঘুকাকা পিতার সহিত দেখা করিতে পিতামহের বাটীতে আসিলে মাতাকে ‘বৌদি’ সম্বোধন করিতেন । বোধ হয় সেই কারণেই আমি তাঁহাকে কাকা ডাকিতাম । রঘুকাকাকে অভ্যর্থনা করিলেও, রঘুকাকার পরিবার সম্বন্ধে মাতাকে কোনও প্রশ্ন করিতে শুনি নাই । এক কথায় বলা যায় যে রঘুকাকা সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানিতাম না । অতএব, জানিবার আগ্রহ দিনে দিনে প্রবলতর হওয়াই স্বাভাবিক ছিল ।

জগা ও মহার দৌলতে রঘুকাকা সম্বন্ধে যে টুকু জানিতে পারিয়াছিলাম তাহা বিশেষ কিছু নহে । ক্রমে ক্রমে আমার ধারণা হয় যে রঘুকাকা দৃশ্যত লাজুক প্রকৃতির হইলেও, আসলে তিনি নিতান্ত অসামাজিক ছিলেন । কী কারণে অসামাজিক তাহা না জানিতে পারিলেও, এক সময় কোন সূত্র হইতে অবগত হই যে রঘুকাকার স্ত্রী বহু বৎসর পূর্বে অগ্নিদগ্ধ হইয়া মারা যান । অতঃপর রঘুকাকা আর বিবাহ করেন নাই, ও তাঁহার পরিবার বলিতে কিছুই ছিল না । আসা যাওয়ার পথে তাঁহার বাড়িতে সচরাচর অন্যজন কাহাকে না দেখিলেও, একাধিক বার এক সুঠাম দেহের মহিলাকে দেখিয়াছি, যে সর্বদা এক লাল-পেড়ে সাদা শাড়ি পরিয়া গেরস্থালীর কার্য করিত । ঘোমটা সত্যেও তাহার সাবলীল সুনিপুণ অঙ্গ সঞ্চালনে ঢেঁকিতে ধান কোটা কি প্রাঙ্গণের নানাবিধ কাজ দেখিয়া বোধ হইত যে সে দৃঢ় অথচ কুশলী হস্তে রঘুকাকার সংসারের রক্ষণাবেক্ষণ করে । শিক্ষক হিসাবেও রঘুকাকার বিশেষ জনপ্রিয়তা ছিল বলিয়া জানা নাই । নিঃসন্দেহে ছাত্রদের মধ্যেও তিনি বিশেষ প্রিয় ছিলেন না । পথে ঘাটে, কখনও দেখা হইলে দেখিতাম তিনি মাটিতে চক্ষু রাখিয়া পথ চলিতেছেন । বোঝা যাইত যে অন্য জনের সহিত, সে ছাত্রই হউক না কেন, কোন প্রকার অভিনন্দনের কিম্বা দৃষ্টির আদান প্রদান তাঁহার পছন্দ ছিল না ।

রঘুকাকার সহিত পিতার কথোপকথনের দুইটি বিশেষ বিষয়বস্তু ছিল । প্রথমটি ফুটবল সম্বন্ধিত – গ্রীষ্মকালে যথেষ্ট সংখ্যক প্রবাসী বন্ধুর গ্রামে সমাগম হইলে একটি প্রবাসী বনাম স্বদেশী (অর্থাৎ গ্রামবাসী) ফুটবল প্রতিযোগিতা হইত – রঘুকাকা ইহার জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও আয়োজন করিতেন । দ্বিতীয়টি চাষবাস সংক্রান্ত – পিতা চাকুরীর আয় হইতে সঞ্চিত অর্থে গ্রামের আশেপাশে কিছু চাষের জমি খরিদ করিয়াছিলেন – যাহার তদারকির ভার তিনি রঘুকাকার উপর সঁপিয়াছিলেন । এই দুই কারণে, পিতার সহিত রঘুকাকার কথোপকথন হইতে প্রায়শই ‘ফুটবল’, ‘ম্যাচ’, ‘ভাগচাষী’, ‘ফসল’ ইত্যাদি শব্দ কানে আসিত । বলা-বাহুল্য, ইহাতে আমার তীব্র কৌতূহল প্রশমিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না ।

‘তেঁতুলতলা’ যাইবার পথে, ঠিক চৌমাথার পূর্বে, বাম দিকে রঘুকাকার বাটী ও তৎসংলগ্ন আম বাগানটি ছিল । চৌমাথা পৌঁছাইলে, দক্ষিণ দিকে ঘাটে যাইবার পথের কোনে ওই বাগানের ঠিক বিপরীতে একটি টিনের চালার পাকা বাটী ছিল । উভয় রাস্তা হইতে দৃশ্য তাহার একটি মাত্র জানালা সর্বদা বন্ধ দেখা যাইত । তাহার প্রবেশ-দ্বার পিছন দিকে চক্ষুর আড়ালে ছিল । ওই বাটীতে সচরাচর কোনও প্রাণের লক্ষণ দেখিতে না পাইলেও, তাহার বেড়া হীন, কিছু পুষ্পিত মাধবীলতা ব্যতীত রিক্ত, পরিষ্কার আঙ্গিনা দেখিয়া বোধ হইত যে অবশ্যই কেহ বাস করে । ওই জনহীন বাটীর পরিবেশে এক অদ্ভুত পয়মন্ত আবহাওয়া ছিল যাহা আমাকে চরম ভাবে আকর্ষিত করিত । যেন স্বয়ং লক্ষ্মী দেবী আসিয়া সংসারের কাজ গুছাইয়া ফিরিয়া গিয়েছেন । কে সেই বাটীতে বাস করিত জানিতে চাহিলে জগা ও মহা উভয়েই একে অপরের মুখে চাহিয়া, মৃদু হাসিয়া, সে প্রশ্ন এড়াইয়া যাইত । পরবর্তী কালে, জগার নিকট জানিতে পারি যে ওই বাটীতে গ্রামের এক ‘সঈর্নি’ (গ্রাম্য ভাষায় কুশীলা স্ত্রী, সম্ভবত স্বৈরিণী শব্দের অপভ্রংশ) বাস করিত, যাহাকে দিনের আলোকে কেহ কখনও দেখে নাই । কোনও স্ত্রীলোক এই ভাবে অসূর্যস্পশ্যা হইয়া কী প্রকারে একাকী বাস করিতে পারে তাহা আর জানা হয় নাই, কেন না এই জ্ঞান আহরণের কিছু পরেই কলেজে যোগদান করিলে, গ্রীষ্মের অবকাশে আমি বাড়ি আসিয়া আর কোথাও যাইতাম না । পিতা মাতা বৎসরের অন্য অনুকূল সময়ে গ্রামে যাইতে শুরু করেন । ইহার পর আমি দূর দেশে চাকুরীরত হইলে চিরকালের মত আমার গ্রামে যাওয়া ঘুচিয়া গেল ।

আমার বিদ্যালয়ে পাঠকালীন পিতামহ প্রয়াত হইয়াছিলেন । ক্রমে ক্রমে পিতামহী, বড় জেঠা ও জেঠিমা পরলোক গমন করিলেন । জেঠতুত ভাইয়েরাও একে একে গ্রাম ত্যাগ করিল । জমির ফসল বিক্রয়ের পয়সা সংগ্রহ করিতে পিতা অবশ্য মাঝে মাঝে গ্রামে যাইতেন, এবং বহুকাল যাবত রঘুকাকার সহিত তাঁহার পত্রালাপ চালু ছিল । সেই পত্র গুলিতে – সবই সংক্ষিপ্ত পোস্টকার্ড – দেখিতাম রঘুকাকা জমির ফসল বিক্রয়ের হিসাব ব্যতীত বিশেষ কোন কথা লিখিতেন না । শেষে, পিতা তাঁহার মৃত্যুর কয় বৎসর পূর্বে তাঁহার গ্রামের সকল জমি ও পিতামহের বাটীর অংশ মুসলমান ভাগচাষীদের কাছে বিক্রয় করিয়া দেন ।

গত বৎসর আমি চাকুরী হইতে অবসৃত হইলে, প্রাপ্ত পর্যাপ্ত অবসর লইয়া যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া পড়িলাম, যে কী এমন কাজ আছে যাহা চাকুরীরত হইয়া করি নাই । তখন মনে হইল একবার গ্রাম দেশ হইতে ঘুরিয়া আসিলে কেমন হয় । আমার শেষ গ্রাম যাত্রা হইয়াছিল প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর পূর্বে । কিন্তু, প্রশ্ন – কয় দিনের জন্য যাইব, ও কোথায় থাকিব ? সৌভাগ্যক্রমে জানিতে পারিলাম যে পিতামহের বাটীর বড় জেঠার অংশ এখনও বর্তমান, এবং তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র দীনবন্ধু তাহা বিক্রয় করিবার জন্য সেই বাটীতেই বসবাস করিতেছেন । আমার এই ‘দীনুদা’ আমার অপেক্ষা প্রায় দশ বৎসরের বড় ছিলেন । যে কালে আমি গ্রামে যাইতাম তিনি সদরে থাকিয়া কলেজে পড়াশুনা করিতেন । কাজেই তাঁহার সহিত কোন কালেই বিশেষ সাক্ষাত হয় নাই । তথাপি, অতি সুশীল, সুভাষ ও স্নেহময় এই দাদা আমাকে সর্বদা বড় স্নেহে স্বাগত করিতেন ।

শীত পড়িলে আমি সস্ত্রীক মোহারামপুর যাইয়া হোটেলে ঠাঁই লইয়া, পরদিন সকালে একটি গাড়িভাড়া করিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম । যে যাত্রা শৈশবে বাসে মেঠো পথে কয় ঘণ্টা, ও পরে নৌকায় নদীপথে আরও দুই ঘণ্টায় সম্পন্ন হইত, তাহা ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সমাধা হইল । গ্রামে পৌঁছাইয়া দেখি আমূল পরিবর্তন হইয়াছে । পথঘাট পাকা, বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা হইয়াছে । বেশির ভাগ বাটীই পাকা ও তাহাদের উপর টিভির ডিশ দেখা যাইতেছে । পিতামহের বাটী খুঁজিতে বেগ পাইতে হইল, কেননা তাহা একতল হইতে দ্বিতল হইয়াছে, এবং তাহার গাত্রে রং ও প্রবেশ পথে লোহার জালের ভারি দরজা লাগিয়াছে । সেই দরজা ঠেলিয়া প্রবেশ করিয়া দেখি দীনুদা সান বাঁধানো জমিতে বসিয়া রৌদ্রতাপ উপভোগ করিতেছেন । আমাকে দেখিয়া মুহূর্তের জন্য চমকিত হইয়াই, সত্বর পরম আহ্লাদে আটখানা হইলেন, ও বৌদিকে ডাকিতে চেঁচামেচি করিতে লাগিলেন । বৌদি দ্বিতল হইতে সবেগে অবতরণ করিয়া এই দম্পতির যুগল চেহারা দেখিয়াই চমকিয়া একেবারে থ । তাঁহাদের সহিত, মনে হয়, শেষ দেখা হইয়াছিল প্রায় পঁচিশ বৎসর পূর্বে । সমাদরে আমাদের দোতলায় লইয়া গিয়া বসান হইলে, বেশ কিছুক্ষণ চারি জন একই সাথে সমস্বরে নানান প্রশ্নোত্তরে জরাজীর্ণ হইয়া ক্রমে ক্রমে ক্লান্ত হইয়া ক্ষান্ত হইলাম । এতদিন পরে মিলনের উদ্দীপনা শান্তিতে সমাহিত হইলে বৌদি চায়ের আয়োজন করিতে চাহিলেন । আমি আপত্তি করিলাম, কেননা দ্বিপ্রহরের ভোজনের সময় প্রায় হইয়াছিল । আর, শীতের বেলা পড়িতে বিশেষ সময় লাগে না, তাহার পূর্বে আমরা মোহারামপুর ফিরিতে চাহিলাম । তখন দীনুদা কহিলেন, “সে কী ? এতদিন পরে গ্রামে এলি । একটু ঘুরে ফিরে দেখবি না ?”
আমি কহিলাম, “কী আর দেখব ? সবই তো দেখছি বদলে গিয়েছে ।”
দাদা – “না না, সে কী করে হয় । তোর গাড়ি আছে, গ্রামের সব রাস্তা প্রায় পাকা ... চল না, ফিরে যাওয়ার আগে না হয় গাড়িতে করেই একটু ঘুরে দেখে নে । আবার কবে আসবি, না আসবি ...”

স্ত্রী দেখিলাম এই প্রস্তাবে রাজী । অগত্যা তাহাই হইল ।

প্রথমে আমরা নদীতীরে গিয়া তাহার পাড় বরাবর রাস্তায় গ্রামের অপর প্রান্তে গেলাম, যেথা শৈশবে নদীপথে নৌকায় আসিয়া ঘাটে নামিতাম । এই ঘাটের নাম বড় মনোহারী – ‘কিশোরীতলা’ । তাহার নিকটেই স্থিত গ্রামের স্কুল, যাহা শৈশবে একতল দেখিয়াছিলাম । এখন তাহা দ্বিতল হইয়াছে, ও রাস্তার বিপরীত দিকেও তাহার বিস্তার হইয়াছে । স্কুল দেখিয়া রঘুকাকার কথা মনে পড়ায় প্রশ্ন করিলাম, “দীনুদা, রঘুকাকা কি এখনও বেঁচে আছেন ?”
দাদা – “না রে । সে তো কবেই মারা গেছে ... কাকাবাবুর, মানে তোর বাবার, আগেই ।”

স্কুল হইতে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া গ্রাম শীঘ্রই সমাপ্ত হইল, পরিচিত বিশেষ কিছু দেখিতে পাইলাম না । সর্বত্র অতীতের বিস্তৃত খোলা জায়গা, বাঁশঝাড়, পুষ্করিণী ও আম বাগান লোপ পাইয়া পাকা বাড়ি হইয়াছে । ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া নানান বিকট রঙের সেই সব বাড়ি নির্বিবাদ সহবাসে লিপ্ত । দ্বিপ্রহর হেতু পথে ঘাটে বিশেষ লোকজন দেখা গেল না । গ্রামের পর্যবেক্ষণ শেষ হইলে দীনুদার আজ্ঞায় ড্রাইভার গাড়ি লইয়া গ্রামের বাহিরে ছুটিল । কোথায় ? সেই মাঠ, যেথা শৈশবে পিতার সহিত প্রবাসী বনাম স্বদেশী ফুটবল খেলা দেখিতে আসিতাম । তাহার পার্শ্ববর্তী স্বাস্থ্য-কেন্দ্রটি  দেখিলাম সেইরূপই আছে, যদিও মেরামতের প্রয়োজন সুস্পষ্ট । আমি শৈশবের সেই ময়দানটি চিনিতে পারিয়া উৎফুল্ল হইলেও দেখিলাম দীনুদা কিঞ্চিত অধীর । বুঝিলাম তাঁহার অভিপ্রেত গন্তব্য অন্য । তাঁহার কথা মত গাড়ি আরও কিছুদূর অগ্রসর হইলে রাস্তার এক বাঁকে এক বিশাল প্রাচীন অশ্বত্থ বৃক্ষ দেখাইয়া দীনুদা জানাইলেন যে তাঁহার একমাত্র কন্যার বিবাহে এই বৃক্ষতলে পূজা দিয়া তিনি বিশেষ ভোজের আয়োজন করিয়াছিলেন, ও গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা তাহাতে নিমন্ত্রিত ছিল । বুঝিলাম এই অশ্বত্থ-তলা দাদার বিশেষ প্রিয় । আজ গাড়ির সৌভাগ্যে তাঁহার এই স্মৃতি-তীর্থ দর্শন লাভ হইল ।

ফিরিবার পথে বাটীর নিকট পৌঁছাইয়া স্মরণে আসিলে দীনুদাকে প্রশ্ন করিলাম, “কই, সেই তেঁতুলতলা তো দেখলাম না ।” দীনুদা তৎক্ষণাৎ পশ্চাতে মাথা ঘুরাইয়া কহিলেন, “ওই তো ! এইমাত্র পিছনে রেখে এলাম । অবশ্য মোড়টাই আছে, আর নামটা । সে’ তেঁতুলগাছ কবেই কেটে ফেলে বাড়ি হয়েছে । সে’ মাচানটাও নেই । দেখলি না সেখানে একটা ছোট মন্দির হয়েছে ।” ইহা সত্য, যাহা দেখিলাম, গ্রামে মন্দিরের প্রচুর প্রাদুর্ভাব হইয়াছে ।

বাটীতে ফিরিয়া বৌদি কহিলেন, “বেলা হয়েছে । তোমরা না খেয়ে এতটা পথ ফিরবে, আর আমরা বুড়ো বুড়ি নিশ্চিন্তে খেয়ে দেয়ে ঘুমব । সে কি হয় ?”
অগত্যা কহিলাম, “ঠিক আছে । তাহলে শুধু ভাতে ভাত খাব । বিশেষ আয়োজন কিছু কোর না ।”
“না, না । দাদা-ভাইয়ে গল্প করো । আমি চট করে ভাত চড়িয়ে দিই”, কহিয়া বৌদি স্ত্রীকে লইয়া রান্নাঘরে গেলেন ।

উদ্দ্যেশ্যহীন কিছু কথাবার্তার পর দীনুদা সহসা কহিলেন, “আশ্চর্য ! তোর কী ভাবে রঘু মাস্টারের কথা মনে পড়ল ?”
আমি – “রঘুকাকা তো বাবার বিশেষ বন্ধু ছিল ... বাবার জমিজমা দেখত । আমি ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামে এলে বাবা রঘুকাকার সাথে প্রায় রোজই দেখা করত ।”
দাদা – “হুম !”
কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভঙ্গ করিয়া কহিলাম, “জানো দীনুদা, ছোটবেলায় রঘুকাকাকে আমার খুব রহস্যময় লাগত ।”
দাদা – “তাই ? কী রকম ? অপরাধী, অপরাধী ...”
আমি – “না ... মানে, ওনার সম্বন্ধে তো কিছুই জানতাম না ... শুধু এই যে ওনার স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা যায় ।”
দাদা – “ওহ ! ... সে কথা কী করে জেনেছিলি ?”
জগন্নাথ ও মহারাজের নাম জিহ্বাগ্রে আসিলেও নিজেকে নিরস্ত করিয়া কহিলাম, “ঠিক মনে নেই ।”
দাদা পুনরায় নীরব হইলেন । আমি পুনরুদ্দীপিত কৌতূহলে দগ্ধ হইলেও, কী প্রকারে তাহা নির্বাপিত করা যায় ভাবিয়া পাইলাম না । কিছু পরে দেখিলাম দাদা দুই চক্ষু নিমীলিত করিয়াছেন । মনে হইল, বয়েস হইয়াছে, ক্ষণে ক্ষণে ক্লান্তি ও নিদ্রা অনিবার্য । এই সময় কী কাজে বৌদি আসিয়া কহিলেন, “সে কী ? তুমি কি ভাই কে বসিয়ে রেখে ঘুমচ্ছ ?” দাদা দুই নয়ন অর্ধনিমীলিত করিয়া কহিলেন, “না, কিছু পুরানো কথা ভাবছিলাম চোখ বুজে ।”
বৌদি প্রস্থান করিলে কিছু আশ্বস্ত বোধ করিয়া প্রশ্ন করিলাম, “দাদা, কিছু বলছ না যে ।”
দাদা – “কী বলব ? কী জানতে চাস তুই ? রঘুকাকার কথা ?”
আমি – “হ্যাঁ ।”
দাদা – “ও ... আর কিছু ?”
আমি – “আর ... জানি না, আরও একটা কৌতূহল ছোটবেলা থেকে রয়ে গেছে । কিছুতেই কাটাতে পারি নি । ওই রঘু কাকার বাড়ির উল্টোদিকে চৌমাথার কোনে একটা বাড়ি ছিল ... সব সময় বন্ধ থাকত । শুনতাম কোন কোন রাত্রে তার আঙ্গিনার দিকে দরজা খোলা থাকত । দরজা জানালা দিয়ে গভীর রাতেও বাতির আলো দেখা যেত । কে থাকত ওই বাড়িতে ?”
দাদা উঠিয়া বসিয়া দুই চক্ষু সম্পূর্ণ উন্মীলিত করিয়া হাসিয়া কহিলেন, “বাব্বা ! সে তো অনেক কথা । দাঁড়া ...”

ধীরে ধীরে দীনুদা আমাকে যাহা শুনাইলেন তাহা প্রায় এক কাহিনীর মত । কাহিনীটি শেষ হইলে দেখিলাম বৌদি ও বুনুও কখন নিঃশব্দে দরজায় আসিয়া শ্রোতা হইয়াছে । বুনু প্রশ্ন করিল, “আমি তো শুনতে পেলাম না সব কথা । নিলোর কী হল শেষমেশ ?”
দীনুদা – “নিলো আর ফিরে যায় নি । সে রঘুকাকার কাছেই থেকে গিয়েছিল ।”
বৌদি – “চলো বুনু, এই বেলা আমরা ভাত বেড়ে নিই । নইলে তোমাদের ফিরতে দেরী হবে । তুমি বরঞ্চ ফেরার সময় গাড়িতে সব শুনে নিও ।”

খাওয়া দাওয়া শেষ হইতে হইতে সূর্য অস্তাচলগামী । ত্বরায় দাদা বৌদিকে প্রণাম করিয়া গাড়িতে বসিলাম । গাড়ি চলিতে লাগিলে কিছু দূর যাইয়া বুনু পিছনে ফিরিয়া হাত নাড়িয়া, নড়িয়া চড়িয়া বসিয়া কহিল, “হ্যাঁ, এবার বল ।” আমি সামনে ঝুঁকিয়া ড্রাইভারকে কহিলাম, “গাড়ি ঘুরিয়ে তেঁতুলতলা হয়ে ঘুরে চল ।” তেঁতুলতলায় আসিয়া গাড়ি হইতে নামিয়া কিছুই চিনিতে পারিলাম না । শুধু দক্ষিণ দিকে কিশোরীতলা ঘাটে যাইবার পথের কোনে দেখিলাম একটি পাকা বাড়ি, যাহার একদা টিনের ছাত আর নাই । তাহাতে একটি ফলকে লেখা “প্রবাসী-স্বদেশী সংঘ” । শৈশবের এক দৃশ্য মানসে উঁকি দিলে এক মুহূর্তের জন্য আমি চক্ষু মুদিলাম । আমার প্রথম গ্রীষ্মের ছুটি । এক বৈকালে পিতার খোঁজ লইতে গিয়া না পাইয়া আমি একা একা ফিরিতেছি । এই বাটী হইতে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরিধানে এক স্ত্রীলোক বাহির হইল । তাহাকে পূর্বে কখনও দেখি নাই । কাছে আসিলে দেখিলাম তাহার মাথায় ঘোমটা হইলেও সিঁথিতে সিঁদুর নাই । সে আমার কাছে আসিয়া হাসিয়া কহিল, “তুই অরুদার ছেলে নীরেন না ?” আমি মাথা হেলাইয়া হ্যাঁ কহিলাম । সে কহিল, “তুই একা কেন ? অরুদা কই ?” আমি নেতিসূচক মাথা নাড়িলাম । সে কহিল, “চল, তোকে বাড়ি দিয়ে আসি ।” আমি পলায়ন করিতে উদ্যত হইতেই সে আমার হাত ধরিয়া কহিল, “আচ্ছা, থাক, তুই আয় আমার সাথে, নারকেলের নাড়ু খাবি । অরুদার প্রিয়, তোরও ভালো লাগবে । ক’টা খাবি, ক’টা নিয়ে যাবি ।” আমি সহসা প্রমাদ গণিয়া তাহার কোমল হাত ছাড়াইয়া পিছনে হটিয়া পিতামহের বাটীর দিকে ধাবিত হইয়া শুনিলাম সে ডাকিতেছে,  “কেন দৌড়চ্ছিস ? পড়ে যাবি যে ।” আজ সহসা বড়ই বিমর্ষ বোধ করিলাম সেই দৃশ্য মনে পড়িয়া, ও সেই ডাক মনে গুঞ্জিত হইয়া, “কেন দৌড়চ্ছিস ? পড়ে যাবি যে ।”

গাড়ি হইতে স্ত্রী ডাকিল, “এসো, দেরী হচ্ছে ।” গাড়িতে উঠিয়া কিশোরীতলার ঘাট পার হইলে আমি তাহাকে এই কাহিনী শুনাইলাম, কিছু কিছু আমার অনুমান যুক্ত করিয়া । ইহাতে অরিন্দম আর কেহ নহেন, আমার পিতা ।

***

রঘুনাথ রায়ের পরিবার অত্যন্ত সংরক্ষণশীল, এক প্রকার গোঁড়া, ছিল । রঘুনাথের পিতা শম্ভুনাথ রায় মহাশয় পত্নী বিয়োগের পর তাঁহার বিস্তর জমিজমা ভাগচাষীদিগের হাতে সম্পূর্ণ সঁপিয়া দিয়া শাস্ত্রচর্চা করিয়া দিনপাত করিতেন । ক্রমে ক্রমে সুযোগসন্ধানী চাষীদের হাতে ফসল হইতে প্রাপ্ত আয় হ্রাস পাইতে লাগিলে, তখন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র রঘুনাথ, জমিজমা দেখাশুনার কাজ শুরু করেন । এই সূত্রে তাঁহার দয়ালু এবং সহানুভূতিশীল চরিত্র হেতু তিনি লক্ষ্য করেন যে গরিব মুসলমান চাষীদের মধ্যে পড়াশুনার বিশেষ চল নাই, বিশেষত তাহাদের পর্দানশীন মহিলা মহলে । তাঁহার বাটীর সন্নিকটে চাষীপাড়া বাসী তাঁহার এক ভাগীদার চাষী সুলেমানের কন্যা নিলুফার, ডাক নাম নিলো, তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । যখনই রঘুনাথ সুলেমানের সহিত আবহাওয়া, বীজ, সার ইত্যাদি লইয়া আলোচনা, কিম্বা ফসলের পরিমাণ, মূল্য ইত্যাদির হিসাবনিকাশ করিতেন, মেয়েটি জল ও রঘুনাথের প্রিয় নারিকেলের নাড়ু লইয়া আসিবার ছলে নিকটবর্তী হইয়া মনোযোগ সহকারে সেই সব কথা শুনিত । ক্রমে নিলোর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখিয়া উৎসাহিত হইয়া রঘুনাথ বালিকাটির প্রাথমিক শিক্ষাদান শুরু করেন । কিছু আরও উৎসুক মুসলমান চাষীর শিশু যোগ দেয় । প্রায় এক দুই দিন বাদ রঘুনাথ সেই সকল শিশুদের বাটীতে ডাকিয়া তাহাদের প্রথমপাঠ, সহজ গণিত ইত্যাদির সহিত পরিচয় শুরু করেন । ইহা দেখিয়া শম্ভুনাথ রায় মহাশয় খুব খুশি হইয়া তাহাদের কিছু জলখাবারে ব্যবস্থা করেন । কিন্তু, ক্রমে ক্রমে এক এক করিয়া নিলো বাদে বাকি শিশুরা এই পাঠশালা হইতে পাততাড়ি গুটায় । নিলোর বয়েস বারো তের হইলে তাহার আসা যাওয়া লইয়া গ্রামে কুৎসা রটনা শুরু হইল । রঘুনাথ জেদি চরিত্রের মানুষ ছিলেন । তিনি সুলেমানের বাড়িতে কার্যে যাইয়া তাহারি মাঝে বালিকাটির শিক্ষা বজায় রাখিলেন । তিনি মোহারামপুর কলেজে যোগদান করিলে এই শিক্ষাদানে ব্যাঘাত ঘটিল । ছুটিতে বাটীতে আসিলে তিনি অবশ্যই সুলেমানের বাড়ি গিয়া খোঁজখবর লইতেন । কখনও কোন পছন্দসই বই নিলোকে পড়িবার জন্য ধার দিতেন । এক গ্রীষ্মে রঘুনাথ বিএ পাস করিয়া গ্রামে ফিরিলেন, ও স্থানীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করিলেন । তাঁহার আর্থিক সাহায্যে ষোড়শী নিলো পরীক্ষা দিয়া গ্রামের বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হইল । ইতিমধ্যে তাঁহার বাল্যবন্ধু অরিন্দম বিহার প্রদেশে কর্মে যোগ দিয়াছেন । দুই বন্ধুর সম্পর্ক পত্রালাপে সুরক্ষিত থাকিল ।

শরতে, দেবীর বিসর্জনের কিছুদিন পর,  এক প্রভাতে হটাত খবর আসিল গত রাত্রে সুলেমান ও তাহার স্ত্রী এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর রূপে আহত হইয়াছে । অবিলম্বে রঘুনাথ তাহার কুটিরে যাইয়া জানিতে পারিলেন, পূর্ব দিন সাইকেলে অসুস্থ স্ত্রীকে লইয়া সুলেমান সদরে গিয়াছিল । অধিক রাত্রে ফিরিবার সময় পশ্চাৎ হইতে আসা এক লরি ধাক্কা দেয় । দুইজন গুরুতর রূপে আহত হয় । সহায়তার অভাবে দুইজন দুর্ঘটনা স্থলে সারা রাত্রি পড়িয়া থাকে । প্রত্যুষে খবর পাইয়া গ্রামের অনুকূল ডাক্তার পৌঁছাইয়া দেখেন দুইজনেরই মৃত্যু হইয়াছে । বেলায় চাষীরা মরদেহ লইয়া আসিলে রঘুনাথ অন্তিম সৎকারের ব্যবস্থা করিলেন । কবরস্থান হইতে ফিরিয়া দেখিলেন কিছু পরিচিত ভাগচাষী কুটিরের সম্মুখে জড়ো হইয়াছে । তাঁহাকে দেখিয়া তাহাদের একজন কহিল, “কত্তা, এবার বাপ-মা মরা মেয়েটাকে কে দেখবে ?” দাওয়ায় উপবিষ্ট নিলোর ক্ষীণ ক্রন্দনের হৃদয়বিদারক শব্দে মরমে বিঁধিল । তিনি নিলোর নিকটে গিয়া কহিলেন, “তোমার কি আর কেউ নেই ?” নিলো উঠিয়া দাঁড়াইয়া আঁচলের খুঁট ধরিয়া মস্তক নত করিয়া রহিল । তাহার এই অসহায় ভঙ্গি দেখিয়া রঘুনাথের মনে কী করুণার উদ্রেক হইল, তিনি নিলোকে কহিলেন, “তুমি মুখ তোল, আমার দিকে তাকাও ।” নিলো মুখ তুলিয়া চাহিয়া তাঁহার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখিয়া রুদ্ধশ্বাসে কহিল, “আমার তো তেমন আর কেউ নেই । আমি কোথায় যাব ?” দেখিতে দেখিতে তাহার অশ্রুসিক্ত রক্তিম চেহারায় এক ফ্যাকাসে ছায়া ছাহিয়া গেল । রঘুনাথ কিঞ্চিত বিচলিত হইয়া কহিলেন, “ও ... আচ্ছা, দেখি কী করতে পারি ।”

বাড়ি ফিরিয়া অনেক চিন্তা করিয়াও রঘুনাথ কুল কিনারা পাইলেন না । নিলোর অসহায় অশ্রুসিক্ত নয়ন, ও ক্রন্দনের আবেগে  কম্পিত নত পৃষ্ঠ বারম্বার তাঁহার মানসে ফুটিয়া উঠিল । তাঁহার দয়ার এই পাত্রীর হৃদয়ে তাঁহার প্রতি একদা অস্ফুট কৃতজ্ঞতা যে অচিরে ক্রমে ক্রমে এক অপরূপ অনুরাগে প্রস্ফুটিত হইয়াছিল তাহা তিনি আজও অনুমান করিতে পারিলেন না । কেবল, আজ যেন তাঁহার বক্ষে এই অসহায় ক্রন্দসী ভাগচাষীর কন্যা করাঘাত করিয়া শুধাইল, “আমার ঠাঁই কই ?”

কিছু খোঁজ খবর করিয়া জানা গেল এক বিধবা, সুবাদে নিলোর মাসি, নিকটবর্তী এক গ্রামে পুত্রের সহিত থাকে । রঘুনাথ তাহাকে পথ খরচ দিয়া আনাইয়া নিলোর সাথে থাকিবার ব্যবস্থা করিলেন, যতদিন না নিলোর বিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন হয় ।

হেমন্ত ও শীত পার হইল । বসন্ত আসিলে শম্ভুনাথ রায় মহাশয় ঘটক ডাকিয়া রঘুনাথের বিবাহের জন্য পাত্রীর অনুসন্ধান করিতে আগ্রহ প্রকট করিয়া কহিলেন, “সুবল, আমার আর বেশি দিন নেই । রঘুর শেষ কাজটা করে আমি এই জীবন থেকে নিস্তার পেতে চাই ।” সুবল কিছু অগ্রিম লইয়া যাইতে যাইতে কহিল, “ঠিক সময় কাজটা শুরু করছেন কর্তা । এমনিতেও তো গ্রামে রঘু আর ওই মেয়েটাকে নিয়ে কেচ্ছার অন্ত নেই । যত্তো সব ... এইবার সব ব্যাটাদের মুখ বন্ধ করিয়ে ছাড়ব ।”

শম্ভুনাথ হতভম্ব হইয়া বসিয়া থাকিয়া রঘুনাথকে ডাক দিলেন । সে আসিলে প্রশ্ন করিলেন, “তুমি কি ওই মুসলমান ভাগচাষী সুলেমানের মেয়েটার সাথে ... মানে, আমি কি জানতে পারি, কী তোমাদের সম্পর্ক ?”
রঘুনাথ – “দুস্থ একটা মেয়েকে নিয়ে গ্রামের লোক কুৎসা রটাচ্ছে । আপনি তাতে কান দেবেন না ।”
শম্ভুনাথ – “কিন্তু যা রটে, তার কিছুটা তো বটে ?”
রঘুনাথ নিরুত্তর থাকিলে শম্ভুনাথ কহিলেন, “যাক গে । আজ আমি ঘটক ডেকে তোমার জন্য মেয়ে খুঁজতে বলেছি । তুমি বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত হও ।”

বৈশাখ মাসে গ্রামে প্রবাসী যুবাদিগের সমাগম হইলে যথারীতি ফুটবল খেলার আয়োজন করা হইল । স্বদেশী পক্ষে রঘুনাথ গোল রক্ষক । দেখা গেল খেলায় তাঁহার বিশেষ আগ্রহ নাই । তাঁহার অমনোযোগের ফলে স্বদেশী পক্ষ দুই গোল খাইয়া প্রথম খেলাটি হারিল । খেলার পর দুই পক্ষ একত্রে হুল্লোড়ে মত্ত হইলে কেহ কেহ লক্ষ্য করিল যে রঘুনাথ উদাসীন হইয়া আছেন । একজন কহিল, “কী রে ? দু’ দুটো গোল ছেড়ে দিলি যে ! কী হয়েছে তোর ? কী রকম মরা মরা লাগছিস ।”
অরিন্দম প্রশ্ন করিলেন, “বাড়িতে কিছু হয়েছে নাকি ? তোমার বাবা কেমন আছেন ?”
রঘুনাথ কিঞ্চিত ইতস্তত করিয়া কহিলেন, “বাবা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন । আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না ।”
চিঠি পত্রের মাধ্যমে অরিন্দম সমস্ত ব্যাপারে অবগত ছিলেন । তিনি চুপ করিয়া রহিলেও, অন্যেরা নানা প্রশ্নে রঘুনাথকে জর্জরিত করিল । শেষে অরিন্দম প্রস্তাব করিলেন, “রঘু, আমি বলি ?”
রঘুনাথ মাথা নাড়িয়া অনুমতি দিলে অরিন্দম জানাইলেন যে রঘুনাথের ধারণা, অসহায় নিলো সম্পূর্ণ ভাবে তাঁহার উপর নির্ভর করিয়া বসিয়া আছে । এই পরিস্থিতিতে রঘুনাথের কী করা উচিত ? নিলোরই বা কী ব্যবস্থা করা যায় ?
বিস্তর আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে কোনও সমীচীন পথের খোঁজ পাওয়া গেল না । পরিশেষে অরিন্দম কহিলেন, “রঘু, তুমি তো শিক্ষক । রোজ ছাত্রদের নানান নৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ করো । আজ এই ক্ষেত্রে তোমার কী উচিত মনে হয় ?”
রঘুনাথ – “আমি তো কোনই সিদ্ধান্ত করে উঠতে পারছি না “
অরিন্দম – “যা ঠিক মনে হয় তাই করো ... আমার সমর্থন পাবে ।”
প্রবাসী সকলে সমস্বরে কহিল, “হ্যাঁ, রঘু, তুমি যা ঠিক মনে কর, তাই করো । আমরা তোমার সাথে আছি, থাকবও ।”

সেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরিবার পথে রঘুনাথ নিলোর কুটিরে গিয়া বাহিরে আঙ্গিনা হইতে তাহাকে ডাকিয়া কিঞ্চিত ইতস্তত কথার মধ্যে জানিলেন যে নিলোর মাসি বর্ষার পূর্বে পুত্রের কাছে ফিরিয়া যাইবে । নিলো কহিল, “আমি ভাবছি, আমি ও মাসির সাথে চলে যাই । এই বাড়ির যা অবস্থা, হয়তো বর্ষায় পড়ে যাবে ।”
রঘুনাথ – “তাহলে তোমার পড়ার কী হবে ?”
নিলো – “কিন্তু, একা আমি এই পোড়ো বাড়িতে ...”
তাহার অসমাপ্ত কথা অগ্রাহ্য করিয়া রঘুনাথ দ্রুতবেগে কহিলেন, “তুমি কী আমার বাড়িতে থাকতে পারবে ?”
নিলো – “আপনার বাড়িতে ? কী ভাবে ?”
রঘুনাথ – “কেন, আমার সাথে ?”

সহস্র অজ্ঞাত উদ্বেগ সম্বরণ করিয়া বিব্রত মুখে হাসি ফুটাইবার চেষ্টা করিয়া নিলো কহিল, “আপনি বসুন ... আমি আপনার জন্য পানি নিয়ে আসি ।” কিন্তু ভিতরে গিয়া সে ভয়ঙ্কর আবেগে অভিভূত হইয়া পড়িল । খানিকক্ষণ পরে অস্ফুট ক্রন্দনের জোয়ার স্তিমিত হইলে বাহিরে আসিয়া দেখিল অন্ধকার আঙ্গিনা ফাঁকা, রঘুনাথ চলিয়া গিয়াছেন ।

সেই রাত্রে নৈশভোজ সমাপ্ত হইলে রঘুনাথ শম্ভুনাথ কে কহিলেন, “বাবা, একটা কথা আছে ...”
শম্ভুনাথ – “নিলোর ব্যাপারে ? তোমার বিয়ের আগে তুমি ওর একটা ব্যবস্থা করতে চাও, তাই তো ?”
রঘুনাথ স্তম্ভিত হইয়া কোন কথা বলিতে পারিলেন না ।
শম্ভুনাথ কহিলেন, “সুবল একটা মেয়ের খোঁজ এনেছে । বলরামপুরের নবীন সেনের মেয়ে । মনে হয় ভালো পাত্রী ।”
রঘুনাথ – “কিন্তু ...”
শম্ভুনাথ – “দেখ, এই আমার শেষ কাজ । এরপর তুমি যা ভালো বোঝ তাই কোর । তবে, এটা ভেবে দেখো, বংশরক্ষা তো আর তাকে নিয়ে হবে না । দেশ আছে, সমাজ আছে ...”

পরের দিন খেলার মাঠে রঘুনাথ সর্বসমক্ষে জ্ঞাপন করিলেন যে তাঁহার পাত্রী স্থির হইয়াছে । প্রবাসী পক্ষের সকলে প্রবল উল্লাসে এই ঘোষণার সম্বর্ধনা করিল । কেহ কহিল, “তাহলে আমরা ছুটি থেকে ফেরার আগে তোমার বিয়েটা হয়ে যাক ।”
কেহ বা কহিল, “হ্যাঁ, সবাই মিলে কাজটা চুকিয়ে দিয়ে যাই ।”
এবং বাকিরা যোগ দিল, “আর চেটেপুটে খেয়েও যাই । প্রবাসে তো আর এমন ভোজ জোটে না ।”
কেবল অরিন্দম এক ফাঁকে রঘুনাথকে আলাদা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “নিলো সম্বন্ধে কী ঠিক করলে ?” রঘুনাথ উত্তর করিলেন, “আমি ভেবেছিলাম ওর পড়াটা শেষ হলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত ... প্রাথমিক স্কুলে পড়ানোর কাজও যদি পেত । কিন্তু কাল জানলাম, নিলোর মাসি বর্ষা নামার আগে ছেলের কাছে ফিরে যাবে, সেই সাথে ও চলে যাবে ।”
অরিন্দম – “কিন্তু, তুমি যে বলেছিলে ওই মাসির ছেলের চরিত্র ভালো নয় ।”
রঘুনাথ – “তা এখন কী করা যাবে ?”

এই কাহিনীর এইখানেই শেষ হাওয়া উচিত ছিল । কিন্তু বিধির বিধান অন্যরূপ ছিল ।

প্রবাসীদিগের কর্মক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই বৈশাখের শেষে রঘুনাথের বিবাহ সম্পন্ন হইয়া গেল । সেই বৎসর গ্রীষ্মের প্রকোপ কিছু অধিক হইয়াছিল । কালবৈশাখী হয় নাই । তাপমাত্রা ক্রমে ক্রমে বাড়িয়া অসহনীয় হইয়াছিল । বিবাহের কয় দিন পর শম্ভুনাথ রায় মহাশয় নদীতে স্নান করিতে করিতে জ্ঞান হারাইলেন । তাঁহার সলিল সমাধিই হইত, কিন্তু নিকটে সন্তরণরত কিছু বালক অন্যদের সচেতন করিলে তাহারা আসিয়া তাঁহাকে জল হইতে তুলিয়া বাটীতে লইয়া গেল । অনুকূল ডাক্তার আসিয়া দেখিয়া বিশেষ কিছু করিতে পারিলেন না । অজ্ঞান অবস্থায় শম্ভুনাথকে গরুর গাড়িতে করিয়া দশ কোষ দূরে নিমতলায় হাসপাতালে লইয়া যাওয়া হইল । সেখানে চিকিৎসার পর তাঁহার জ্ঞান ফিরিলেও, দেখা গেল তাঁহার শরীরের দক্ষিণ দিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হইয়াছে । কিছুদিন পরে তাঁহাকে হাসপাতাল হইতে গ্রামে ফেরত আনা হইলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার উপদেশ দিলেন যে রায় মহাশয়ের জন্য এক নার্সের প্রয়োজন হইবে ।

গ্রাম-দেশে ধাই ব্যতীত নার্স কোথায় পাওয়া যাইবে । পরদিন প্রত্যুষে চিন্তিত মুখে রঘুনাথ পিতার নিকট গিয়া দেখিলেন তাঁহার ঘুম ভাঙ্গিয়াছে ও তাঁহাকে বিছানায় উঠাইয়া বসান হইয়াছে । রঘুনাথের স্ত্রী বিমলার তদারকিতে তিনি দুগ্ধ পান করিতেছেন । রঘুনাথকে দেখিয়াই তিনি প্রশ্ন করিলেন, “কি, কাউকে পেলে আমার দেখাশোনা করার জন্য ? বৌমা তো আমার সেবা করে সারারাত ঘুময় নি মনে হয় ।”

রঘুনাথ ইশারায় বিমলাকে কক্ষের বাহিরে যাইতে ইঙ্গিত করিলে সে দুধের গেলাসটি লইয়া ঘোমটা সামলাইয়া চলিয়া গেল । রঘুনাথ দরজার দিকে চাহিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া কহিলেন, “বাবা, আমি বলছিলাম যে ... আপনি বলেছিলেন যে ...” তাঁহার মুখের কথা কণ্ঠে আটকাইয়া রহিল । কিছু পরে কিঞ্চিত ধাতস্থ হইয়া তিনি কহিলেন, “বাবা, নিলোকে কী আপনার সেবায় লাগানো যায় না ? ... অবশ্য, আমি জানি না সে এই কাজে রাজী হবে কিনা, আর ...”
শম্ভুনাথ – “আর কী ?”
রঘুনাথ – “আর, আপনি ওর হাতে জল স্পর্শ করবেন কিনা ।”
শম্ভুনাথ কিছুক্ষণ রঘুনাথের নত দৃষ্টির দিকে চাহিয়া দেয়ালের দিকে মুখ ফিরাইয়া অবরুদ্ধ কণ্ঠে কহিলেন, “আমি মনে হয়, না জেনে তোমাকে ... তোমাদেরকে ... অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি ।”
রঘুনাথ ইহার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করিলেন না । অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করিলেন শম্ভুনাথ ইহার পর কী বলেন ।
শম্ভুনাথ কিছুক্ষণ পরে কহিলেন, “যাও, আমি এখন একটু বিশ্রাম করব ।”
রঘুনাথ কক্ষ হইতে যাইতে যাইতে শুনিলেন, শম্ভুনাথ স্বগতোক্তি করিতেছেন, “আমি তো বলেই ছিলাম বিয়ের তুমি যা ভালো বোঝ তাই কোর ।”

পরদিন শম্ভুনাথ প্রভাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় বোধ করিলেন কেহ তাঁহার গায়ের চাদর টানিয়া দিতেছে । তাঁহার মনে হইল নতুন কেহ কক্ষে আসিয়াছে । চক্ষু উন্মীলিত করিয়া দেখিলেন নিলো দাঁড়াইয়া আছে । সে গলায় আঁচল জড়াইয়া শম্ভুনাথের পায়ে মাথা ছোঁয়াইল । শম্ভুনাথ চাহিয়াও পক্ষাঘাতগ্রস্ত পা সরাইতে পারিলেন না । শুধু অস্পষ্ট স্বরে কহিলেন, “থাক মা, থাক ।”

কিন্তু রঘুনাথের সংসার-সুখ লাভ হইল না । একদিকে, আসিতে যাইতে নববধূর সহিত চক্ষের মিলনে তাহার চাহনিতে দেখিতে পান তাহার সাধ আহ্লাদের অব্যক্ত বার্তা । অপরদিকে, নিলোকে দেখিয়া তাঁহার বক্ষে সেই পুরাতন হতাশা বোধ । তাঁহার মনে হইল তাঁহার উচিত নিলোর বিবাহের ব্যবস্থা করা । তাহাতে গ্রাম-সমাজে কোনরূপ দুর্নাম রটানোর মুখ বন্ধ করা যায় । কিন্তু কাহার সহিত, কত দূরে ?

শম্ভুনাথ রায় মহাশয় প্রায় এক বৎসর শয্যাশায়ী রহিয়া ক্ষীণ হইয়া এক বসন্তের দিন প্রাণত্যাগ করিলেন । তাঁহার শ্রাদ্ধ সম্পন্ন হইবার একদিন পর রঘুনাথ দাওয়ায় বসিয়া কিছু কাজের ফর্দ প্রস্তুত করিতেছেন, নিলো আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া অধোমুখে কহিল, “এবার আপনি আমাকে মাসির কাছে পাঠিয়ে দিন ।”
রঘুনাথ কিঞ্চিত আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কেন ? কেন চলে যাবে ? এখানেই থাক, বিমলা তো আছেই ।”
নিলো মুখ তুলিয়া চাহিল । সহসা তাহার দুই চক্ষে মুহূর্তের জন্য বিদ্যুতের ঝিলিক দেখা দিল, এমত বোধ হইল । সে উষ্ণ স্বরে কহিল, “না, তা সম্ভব নয় !”
অতঃপর স্বর কিঞ্চিত নম্র করিয়া কহিল, “আমি আর এখানে থাকলে হয়তো কোনদিন বৌদি গলায় দড়ি দেবেন ।”
রঘুনাথ তাহার দর্পে  থতমত হইয়া আমতা আমতা করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, দেখছি ।”
নিলো আর কিছু না বলিয়া, না কোন কথা শোনার অপেক্ষা করিয়া, দ্রুতপদে প্রস্থান করিল ।

কিছু পরে রঘুনাথ বিদ্যালয়ে যাইয়া মহাধ্যক্ষ হইতে সেই দিনের ছুটি লইলেন । কিশোরীতলার ঘাটে গিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া আরও অস্থির বোধ করিলেন । ঘাট হইতে একটি নৌকা ছাড়িতেছিল । জানা গেল নৌকা দশমীঘাট অব্দি যাইবে । তিনি মাঝিকে অনুরোধ করিলে সে তাঁহাকে লইতে রাজী হইল । দশমীঘাটে নামিয়া মানবাজারে ঘুরিয়া তিনি সারাদিন কাটাইলেন । দ্বিপ্রহর পার হইলে তাঁহার মনে পড়িল তিনি বাড়িতে বলিয়া আসেন নাই । কিন্তু দশমীঘাটে পৌঁছাইয়া নৌকা পাইতে বেশ দেরী হইল । সন্ধ্যায় তিনি যখন নৌকা হইতে কিশোরীতলায় নামিলেন এক অপেক্ষারত বালক দৌড়াইয়া আসিয়া কহিল, “মাস্টারমশাই, শিগগির বাড়ি চলুন, কাণ্ড হয়েছে ।” রঘুনাথ দ্রুত ধাবনে বাড়ি আসিয়া দেখিলেন লোকে লোকারণ্য । একটি খোলা গরুর গাড়িতে শয্যা সাজানো হইয়াছে । ভিড়ের মধ্যে হইতে কেহ আসিয়া নিম্ন কণ্ঠে কহিল, “রঘুনাথ, কোথায় ছিলে ?” রঘুনাথ ব্যস্ত কণ্ঠে কহিলেন, “কী হয়েছে ? এত ভিড় কেন ? আর এই গাড়িতে বিছানা কিসের ?” সে কহিল, “বিমলা গায়ে আগুন দিয়েছে । ওকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ।”

বিমলা হাসপাতাল হইতে প্রায় চার মাস পরে ছাড়া পাইলেও শয্যাশায়ী হইয়া ফিরিল । তাহার দৃষ্টি ও শ্রুতি আগুনে নষ্ট হইয়া গিয়াছিল । তাহার কণ্ঠ হইতে স্বরও বিদায় লইল । নিলোর আর ফিরিয়া যাওয়া হইল না । বিমলার সেবা শুশ্রূষার জন্য সে রহিয়া গেল । বোবা, কালা, অন্ধ বিমলা বৎসর তিনেক তাহার সেবা লইয়া মারা গেল । সে আর জানিল না যাহার ঈর্ষায় সে আত্মহত্যার চেষ্টা করিয়াছিল সেই তাহার আমরণ সেবা করিল ।

***

আমার কাহিনী শেষ হইলে দেখিলাম পথ আরও কিছু বাকি । ততক্ষণে অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে । আমাদের দুইজনের মনেও অপরিসীম বেদনার আঁধার ।

বুনু প্রশ্ন করিল, “আচ্ছা, ওই রঘুকাকার বাড়ির সামনে তেঁতুলতলার মোড়ে যে এক কামরার বাড়ি ছিল, সেটার কথা তো বললে না ?”
আমি – “দীনুদা বলল ওটা রঘুকাকার ছিল । পরে উনি ওটা গ্রামের ফুটবল ক্লাবকে দান করে দেন । এখনও ক্লাবেরই নামে আছে – তবে তাতে খেলাধুলার আলোচনা বাদ দিয়ে রাজনীতি বেশি হয় ।”
বুনু – “ওটা রঘুকাকার ছিল ? তুমি তো বলেছিলে ওতে গ্রামের কোন স্বৈরিণী থাকত, রাত্রে তার ঘরে বাতি জ্বলত ... সে সব কি মিথ্যে ?”
আমি – “দীনুদা বলল, ধুর ! ও’সব বাজে কথা, গ্রামের লোকের মুখে তো কিছু বাদ যেত না । ওই ঘরটা ছিল রঘুকাকার ছোটবেলার পড়ার ঘর । পরে, মানে নিলোকে বাড়িতে আনার পর, রঘুকাকা আর ভিটেতে রাত্রিবাস করতেন না । পড়ার ঘরটায় রাত কাটাতেন । অনিদ্রায় ভুগতেন - ঘুম না এলে রাত জেগে বই পড়তেন । তাই রাত্রে বাতি জ্বলতে দেখা যেত । কেউ কেউ বলত ওই বাড়িতে তাঁর রাত্রিবাসও একটা কারণ ছিল কাকিমার আত্মহত্যার ।”

বুনু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিল । তারপর সে কহিল, “কী অদ্ভুত !”
আমি – “কী অদ্ভুত ? কিসের কথা বলছ ?”
বুনু – “তুমি কি ঠিক শুনেছিলে ?”
আমি – “কী ঠিক শুনেছিলাম ?”
বুনু – “যে ওই বাড়িতে থাকত যে সে স্বৈরিণী ।”
আমি – “হ্যাঁ, তাইতো মনে পড়ে ।”
বুনু – “সে কি স্বৈরিণী ... না কি, যেমন আমি ভাবছি ... সই-ঋণী ?”


-----------------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ১৪ অক্টোবর ২০১৪

কোন মন্তব্য নেই: