|| শান্তির মুখ ||
শঙ্কর বাবু, শঙ্কর সমাদ্দার, নিজের মনেই হাসলেন | সকালে বেড়াতে বেরলেই নানান কথা মনে পড়ে | আজ একটা কথা ভেবেই মনে পড়ল তাঁর বাবা বলতেন, “দেখ খোকা, যতদিন নিজের উপর হাসতে পারবি, হাসির অভাব হবে না |” তাই, শঙ্কর হাসলেন, কেন না তিনি রোজকার মত ভাবছিলেন, “আমার আর শান্তির মুখ দেখা হবে না |”
মুখ দেখার ব্যাপারটা পুরানো | উনি মুখ না দেখে সাবিত্রীকে বিয়ে করেছিলেন | তারপর ঘুম থেকে উঠে প্রথম তার মুখ দেখে পরম শান্তিতে তিরিশ বছর কাটিয়ে, বছর পাঁচেক আগে সাবিত্রী কোমরের নিচে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে, সেই শান্তি হারিয়েছেন |
ওই একই পাঁচ বছর আগে শুরু করা অভ্যাসে শঙ্কর ভোর সকালে হাঁটতে বেরন | তার মেয়াদ বাড়তে বাড়তে, এখন প্রায় দু’ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে | সমস্ত পথটাই – বনবিথী, লাবনি স্ট্রিট, উডরো স্ট্রিট, হরিদাসী লেন – সব পাড়া-ঘরের রাস্তা, ভোরে নির্জন | শুধু হরিদাসী লেনের শেষে বড় রাস্তা যানবহুল অশোক এভিনিউ – সরু ফুটপাথ, প্রায়ই গাড়িঘোড়ার মধ্যে হাঁটতে হয় – কয়েক মিনিটই, তারপরই তিনি পার্কে ঢুকে পড়েন |
মাস খানেক আগে ঠিক ওই বড় রাস্তার মোড়ে তিনি প্রথম দেখেছিলেন মহিলাটিকে | পিছন থেকে - লম্বা, ঋজু, দোহারা শরীরটায় পিঠটা সামান্য সামনে বাঁকা | পরনে কমদামী সিনথেটিক শাড়ি | মাথার পিছনে সোজা করে আঁচড়ানো খোলা চুল টেনে একটা ছোট ক্লিপ দিয়ে গুছি করে ঝোলানো চামর | গায়ের রং ময়লাটে | কোমরে যেন সংসার খাটা মেয়েমানুষের গতরের কাজে বিরামের প্রথম আভাস, এক রতি মেদ | শরীর অনুযায়ী বয়েস মনে হয় তিরিশের মাঝামাঝি | মহিলাটি কাঁধে ব্যাগ, হাতে মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বাহনের অপেক্ষায় | শঙ্কর তার পিছন দিয়ে যেতে যেতে তার মুখটা দেখতে না পেয়ে অনুমান করার চেষ্টা করেছিলেন |
এটা তাঁর এক রকম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে | মেয়েমানুষের মুখ না দেখলে তাঁর মনে কী যেন একটা অশান্তি লেগে যায় | আসলে, সাবিত্রী শয্যাগত হওয়ার পর থেকে শঙ্কর বেড়িয়ে ফিরলেই খুঁটিনাটি জানতে চান | চেনা অচেনা কার সাথে দেখা হল ? এমন তো হয়না যে পথে ঘাটে শুধু পুরুষমানুষই ঘুরে বেড়ায় | মেয়েমানুষও ছিল নিশ্চয় ! তেমন কেউ চোখে পড়েছিল কি ? সকলের কথাই বলতে হয় | চেপে গেলে তাঁর মুখ দেখে সাবিত্রী বুঝতে পারেন | শুধু বলেন, “কিছু ভুলে যাও নি তো ?” তাই, তাকে বলে বলে এমন হয়েছে যে এখন কিছু না বললে শঙ্করের মনে একটা অশান্তি খটখট করে |
সেইদিন প্রথম দেখার পর থেকে অশান্তিটা প্রায় নিত্যকার হয়ে উঠেছে | রোজই দেখেন একই ভাবে বড় রাস্তার মোড়ে তাঁর শান্তির উৎস দাঁড়িয়ে আছে, হরিদাসী লেনের দিকেই তাকিয়ে | রোজই দূর থেকে মনে হয় কাছে এলে তার মুখটি দেখতে পাবেন | কিন্তু কাছে পৌঁছানোর একটু আগে সে তার মুখটা বড় রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে নেয় ... কখনও মুখের সামনে মোবাইলটা তুলে ধরে সেলফি তোলার ভঙ্গিতে | বেশ বড় সাইজের মোবাইল | তিনি মনে করেন সে যেন সব ইচ্ছে করেই করে | তাই শান্তির পিছন দিয়ে যেতে যেতে তার মুখটা দেখতে না পেয়ে শঙ্কর অনুমান করার চেষ্টা করেন |
একদিন একটু সুযোগও হয়েছিল, কিন্তু সুযোগটা নিতে পারেন নি শঙ্কর | সেদিন উনি কী ভাবে কয়েক মিনিট আগে বেরিয়ে পড়েছিলেন | হরিদাসী লেনে পা দিয়েই দেখলেন ক’ পা আগে শান্তি এগোচ্ছে বড় রাস্তার দিকে | মন্থর গতিতে সে চলেছে মাথা একটু নিচু করে | সেই ঋজু শরীরের শ্লথ গজগতির দিকে তাঁর দৃষ্টি আটকে গেলে শঙ্কর একটু অস্বস্তি বোধ করলেন | ওখান থেকে বড় রাস্তা প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ | ততক্ষণ ঠিক এই ভাবে নির্জন রাস্তায় একটি মহিলার পিছন পিছন যাওয়া ঠিক মনে হল না | তিনি একটু গতি বাড়ালেন | শান্তির পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে ফুটপাথ ছেড়ে পথে নেমে তিনি চাইলেন আড়চোখে একবার তার মুখটা দেখেন | কিন্তু অদ্ভুত এক আড়ষ্টতায় তাকানো হল না |
সেদিন বাড়ি ফিরে শঙ্কর হাতঘড়িটা সাত মিনিট এগিয়ে দিলেন | কিন্তু আড়ষ্টতা রয়েই গেল | ক’দিন পরে অপরাধ বোধে আবার ঘড়ির সময়টা ঠিক করে নিলেন | তাঁদের প্রহসন এই ভাবে চলল – তিনি দূর থেকে শান্তিকে তাঁর আসার পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন (সত্যিই কি তাই ?) | কিন্তু তার কাছে পৌঁছাতেই সে এক অস্থির ভঙ্গিতে তার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে রাস্তার দিকে তাকায় | প্রায়ই ওই সেলফি তোলার ভঙ্গিতে মোবাইলটা মুখের সামনে তুলে ধরে ; কানের পাশে চুল গুঁজে নেয় ; কপালের টিপ ঠিক করে | ক্রমে ক্রমে শঙ্করের মনে একটা কেমন সন্দেহ দানা বাঁধল | তাহলে কি শান্তি তাঁর অভিপ্রায় জেনে ফেলেছে ? তাহলে তো তার মুখটা কোনদিনই দেখা সম্ভব হবে না | ভারী মুশকিলের কথা ! এই ভাবে কতদিন সবিত্রীকে না বলে থাকা যায় ?
আরও একটা ব্যাপার জানার ছিল | ওই শান্তির চুলের ক্লিপটার রংটার নাম কী | খুব উজ্জ্বল সবুজের মধ্যে কালচে ছোপ, সকালের প্রথম রোদে কালো চুলের মাঝে জ্বলজ্বল করে | ক’দিন ধরেই ভাবছেন পাশের বাড়ির পিপিলী কে জিজ্ঞাসা করবেন | ছ’বছরের মেয়েটা একবার তাঁকে বুঝিয়েছিল হালকা রানী-কল্যর আর বেবি-পিঙ্কের মধ্যে তফাত কী | ওই ঠিক বলতে পারবে এই জ্বলজ্বলে সবুজ রংটার নাম |
সপ্তাহ খানেক পরে শঙ্কর নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে ঘড়িটা দু’মিনিট পিছিয়ে দিলেন | সেদিন সাক্ষাত না হওয়ায় বুঝলেন শান্তি হয়ত ওই মোড়ে মিনিট কয়েকের জন্যই দাঁড়ায় | শঙ্কর আবার ঘড়িটার সময়টা ঠিক করে নিলেন | এর পরই একদিন দূর থেকে দেখলেন একটা রেড ক্রস চিহ্নের গাড়ি এসে দাঁড়াল | শান্তি শাড়ি একটু তুলে গাড়িতে উঠে পড়ল, গাড়ি ছেড়ে দিল |
আজ শঙ্কর একটু আগে বেরিয়েছেন | খুব ভোরে উঠে পড়েছিলেন | আসলে, গত সন্ধ্যা থেকে শরীরটায় একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি | ঘুম উবে গেছে | পা দুটো ভারী, আর ঘাড়ের পিছনে একটা জমাট বাঁধা কষা চাপ | গাটা ঘামে ভিজে থাকছে | শুনে সাবিত্রী বলে দিয়েছেন আস্তে আস্তে হাঁটতে, আর বেশি দূরে না যেতে | তাই, ইচ্ছে পার্কের গেট অব্দি গিয়ে ফিরে আসবেন | শরীরের কথাই ভাবতে ভাবতে শুনতে পেলেন আগন্তুক এক মোটরসাইকেলের আওয়াজ | চোখ তুলে দেখে চমকে উঠলেন | তাঁর ফুটপাথের উপর হেডল্যাম্প জ্বেলে সবেগে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসছে একটা ছেলে | ভীষণ রাগ হল | ছেলেটা কাছে এসে একটু গতি কমালেও শঙ্কর ছিটকে এক পাশে সরলেন | ছেলেটাকে কড়া ধমক দেয়ার আগেই সে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে ফের গতি বাড়াল |
মোড়ের কাছে এসে শঙ্কর দেখলেন রেড ক্রস চিহ্নের গাড়িটা দাঁড়িয়ে | শান্তিকে দেখতে পেলেন না | মাথা পিছনে ঘুরিয়ে দেখলেন হরিদাসী লেন দিয়ে শান্তি আসছে, সেই একই মন্থর গতিতে, মাথা নামিয়ে | শঙ্কর একটু ইতস্তত করে এগোলেন পার্কের দিকে | ওদিকে মগজে ওই মোটরসাইকেল চালককে কিছু বলতে না পারার চাপা ক্ষোভ মাথা চাড়া দিচ্ছে | হটাত মাথাটা একটু টলে উঠল | কিছুদূর এগিয়ে আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন, যাক, শান্তি গাড়িতে উঠছে, তাঁর দিকে তাকিয়ে |
গাড়ির ড্রাইভার মদন বলল, “বাসন্তী, কী দেখছিস ? ওঠ তাড়াতাড়ি |”
বাসন্তী বলল, “ওই যে দেখছিস না, সামনে | নীল গেঞ্জি |”
মদন – “ও ... এই তোর রোজকার বুড়োটা ?”
মদন গিয়ার দিয়ে ক্লাচ ছাড়তে ছাড়তে বলল, “বাবা, ও যে টলছে রে | সকাল সকাল গিলেছে নাকি ? যদি বলিস তো একটু সাঁটিয়ে দিই |”
বাসন্তী – “কী সাঁটিয়ে দিবি ?”
গাড়িটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল | কয়েক বারের চেষ্টায় স্টার্ট করে গিয়ার দিতে দিতে মদন বলল, “সাঁটিয়ে মানে, গাড়িটা একটু বুড়োটার গা ঘেঁষে চালিয়ে দেব ... জাস্ট একটু ভয় দেখানোর জন্য | তুই খালি জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে তাকাস, যাতে তোকে দেখে বুড়োটা বুঝতে পারে |”
বাসন্তী আঁতকে বলল, “যাহ ! না, না | নিরীহ একটা লোক – একটু তাকানোর দোষ আছে হয়ত |”
শঙ্কর যেতে যেতে আবার ঘুরে তাকালেন – গাড়িটার এতো কেন দেরী হচ্ছে ? এতক্ষণে তো তাঁর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা | ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়িটা দেখতে গিয়েই তাঁর মাথা ঘুরে গেল | ভারসাম্য হারিয়ে ফুটপাথের ধার থেকে রাস্তায় পড়তে পড়তে দেখলেন, এক্কেবারে কাছে এসে যাওয়া গাড়িটা খুব জোরে ব্রেক কষে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল | তারপরই তাঁর দু’চোখে অন্ধকার নেমে এলো |
যখন জ্ঞান ফিরল, প্রথমে বুঝতে পারলেন না তিনি কোথায় | খাটে শুয়ে আছেন | হাতের আঙ্গুলে কিছু ছোট ছোট চিমটি লাগানো, যার থেকে এক গাদা তার গিয়ে একটা স্ট্যান্ডে ঝোলানো স্ক্রিনের নিচে ঢুকেছে | কালচে স্ক্রিনে সবুজ রেখা উঠে পড়ে আঁকিবুঁকি কাটছে | ছাতে পরপর অনেক পাখা ঘুরছে | মাথা কাত করে দেখলেন আসে পাশে অনেক লোক খাটে শুয়ে | তাহলে তিনি হাসপাতালে ! কটা বাজে ? কতক্ষণ তিনি বাড়ির বাইরে ? সাবিত্রী কি খবর পেয়েছে ? কিন্তু ... শঙ্কর আর চিন্তা করতে পারলেন না, একটা অসম্ভব অবসন্নতা শরীরে চেপে আছে | খুব তেষ্টাও পেয়েছে |
বোধহয় তাঁর নাড়াচাড়া দেখে একজন ডাক্তার এগিয়ে এলো | নাড়ি ধরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “কেমন বোধ করছেন এখন ?”
শঙ্কর একটু মাথা নেড়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “বাড়িতে কি খবর দেয়া হয়েছে | আমার স্ত্রী তো পক্ষাঘাতে পঙ্গু, একা আছে | আর কেউ নেই |”
ডাক্তার বলল, “দেখছি ... আগে বলুন এখন কেমন লাগছে |”
শঙ্কর বললেন, “খুব দুর্বল | বেজায় তেষ্টা পেয়েছে | একটু জল পাব ?”
ডাক্তার ডাক দিল, “বাসন্তী, এনাকে এক গেলাস খাওয়ার জল দিন |”
একটা নার্স পাশে এসে বলল, “উঠে বসে খেতে পারবেন. না আমি খাইয়ে দেব ?”
শঙ্কর দেখলেন একটা ময়লা কমনীয় চেহারা – কিন্তু তারই মধ্যে পুরু ঠোঁটে, উঁচু হনুতে আর গালে মাথা উঁচানো কিছু বিদ্রোহী ব্রণে ফুটে উঠেছে একটা তীব্র কামনার আভাস | বিব্রত হয়ে বললেন, “একটু উঠিয়ে বসিয়ে দাও মা | দেখি চেষ্টা করে |”
বাসন্তী বুকের সামনের চুলের গোছা এক ঝটকায় পিছনে ফেলে ঘুরে চলে গেল জল আনতে | শঙ্কর দেখলেন তার পিঠে সাদা গাউনের উপর সোজা করে আঁচড়ানো খোলা চুল টেনে একটা ছোট ক্লিপ দিয়ে গুছি করে ঝোলানো চামর | ক্লিপটা খুব চেনা – কালচে ছোপ ছোপ উজ্জ্বল সবুজ রঙের | শঙ্কর মনে মনে ভাবলেন বাড়ি ফিরে বলবেন, “সাবিত্রী, যে নার্সটা আমাকে দেখছিল তার নাম বাসন্তী | তাকে দেখতে মোটেও ভালো নয় |” সাথে সাথে পরম শান্তিতে তাঁর মন ভরে উঠল |
একটু পরে বাসন্তী এক গেলাস খাওয়ার জল এনে দেখল বুড়োটার মাথাটা নেতিয়ে বালিশ থেকে পড়ে গেছে |
--------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৮ মে ২০১৫
শঙ্কর বাবু, শঙ্কর সমাদ্দার, নিজের মনেই হাসলেন | সকালে বেড়াতে বেরলেই নানান কথা মনে পড়ে | আজ একটা কথা ভেবেই মনে পড়ল তাঁর বাবা বলতেন, “দেখ খোকা, যতদিন নিজের উপর হাসতে পারবি, হাসির অভাব হবে না |” তাই, শঙ্কর হাসলেন, কেন না তিনি রোজকার মত ভাবছিলেন, “আমার আর শান্তির মুখ দেখা হবে না |”
মুখ দেখার ব্যাপারটা পুরানো | উনি মুখ না দেখে সাবিত্রীকে বিয়ে করেছিলেন | তারপর ঘুম থেকে উঠে প্রথম তার মুখ দেখে পরম শান্তিতে তিরিশ বছর কাটিয়ে, বছর পাঁচেক আগে সাবিত্রী কোমরের নিচে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে, সেই শান্তি হারিয়েছেন |
ওই একই পাঁচ বছর আগে শুরু করা অভ্যাসে শঙ্কর ভোর সকালে হাঁটতে বেরন | তার মেয়াদ বাড়তে বাড়তে, এখন প্রায় দু’ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে | সমস্ত পথটাই – বনবিথী, লাবনি স্ট্রিট, উডরো স্ট্রিট, হরিদাসী লেন – সব পাড়া-ঘরের রাস্তা, ভোরে নির্জন | শুধু হরিদাসী লেনের শেষে বড় রাস্তা যানবহুল অশোক এভিনিউ – সরু ফুটপাথ, প্রায়ই গাড়িঘোড়ার মধ্যে হাঁটতে হয় – কয়েক মিনিটই, তারপরই তিনি পার্কে ঢুকে পড়েন |
মাস খানেক আগে ঠিক ওই বড় রাস্তার মোড়ে তিনি প্রথম দেখেছিলেন মহিলাটিকে | পিছন থেকে - লম্বা, ঋজু, দোহারা শরীরটায় পিঠটা সামান্য সামনে বাঁকা | পরনে কমদামী সিনথেটিক শাড়ি | মাথার পিছনে সোজা করে আঁচড়ানো খোলা চুল টেনে একটা ছোট ক্লিপ দিয়ে গুছি করে ঝোলানো চামর | গায়ের রং ময়লাটে | কোমরে যেন সংসার খাটা মেয়েমানুষের গতরের কাজে বিরামের প্রথম আভাস, এক রতি মেদ | শরীর অনুযায়ী বয়েস মনে হয় তিরিশের মাঝামাঝি | মহিলাটি কাঁধে ব্যাগ, হাতে মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বাহনের অপেক্ষায় | শঙ্কর তার পিছন দিয়ে যেতে যেতে তার মুখটা দেখতে না পেয়ে অনুমান করার চেষ্টা করেছিলেন |
এটা তাঁর এক রকম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে | মেয়েমানুষের মুখ না দেখলে তাঁর মনে কী যেন একটা অশান্তি লেগে যায় | আসলে, সাবিত্রী শয্যাগত হওয়ার পর থেকে শঙ্কর বেড়িয়ে ফিরলেই খুঁটিনাটি জানতে চান | চেনা অচেনা কার সাথে দেখা হল ? এমন তো হয়না যে পথে ঘাটে শুধু পুরুষমানুষই ঘুরে বেড়ায় | মেয়েমানুষও ছিল নিশ্চয় ! তেমন কেউ চোখে পড়েছিল কি ? সকলের কথাই বলতে হয় | চেপে গেলে তাঁর মুখ দেখে সাবিত্রী বুঝতে পারেন | শুধু বলেন, “কিছু ভুলে যাও নি তো ?” তাই, তাকে বলে বলে এমন হয়েছে যে এখন কিছু না বললে শঙ্করের মনে একটা অশান্তি খটখট করে |
সেইদিন প্রথম দেখার পর থেকে অশান্তিটা প্রায় নিত্যকার হয়ে উঠেছে | রোজই দেখেন একই ভাবে বড় রাস্তার মোড়ে তাঁর শান্তির উৎস দাঁড়িয়ে আছে, হরিদাসী লেনের দিকেই তাকিয়ে | রোজই দূর থেকে মনে হয় কাছে এলে তার মুখটি দেখতে পাবেন | কিন্তু কাছে পৌঁছানোর একটু আগে সে তার মুখটা বড় রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে নেয় ... কখনও মুখের সামনে মোবাইলটা তুলে ধরে সেলফি তোলার ভঙ্গিতে | বেশ বড় সাইজের মোবাইল | তিনি মনে করেন সে যেন সব ইচ্ছে করেই করে | তাই শান্তির পিছন দিয়ে যেতে যেতে তার মুখটা দেখতে না পেয়ে শঙ্কর অনুমান করার চেষ্টা করেন |
একদিন একটু সুযোগও হয়েছিল, কিন্তু সুযোগটা নিতে পারেন নি শঙ্কর | সেদিন উনি কী ভাবে কয়েক মিনিট আগে বেরিয়ে পড়েছিলেন | হরিদাসী লেনে পা দিয়েই দেখলেন ক’ পা আগে শান্তি এগোচ্ছে বড় রাস্তার দিকে | মন্থর গতিতে সে চলেছে মাথা একটু নিচু করে | সেই ঋজু শরীরের শ্লথ গজগতির দিকে তাঁর দৃষ্টি আটকে গেলে শঙ্কর একটু অস্বস্তি বোধ করলেন | ওখান থেকে বড় রাস্তা প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ | ততক্ষণ ঠিক এই ভাবে নির্জন রাস্তায় একটি মহিলার পিছন পিছন যাওয়া ঠিক মনে হল না | তিনি একটু গতি বাড়ালেন | শান্তির পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে ফুটপাথ ছেড়ে পথে নেমে তিনি চাইলেন আড়চোখে একবার তার মুখটা দেখেন | কিন্তু অদ্ভুত এক আড়ষ্টতায় তাকানো হল না |
সেদিন বাড়ি ফিরে শঙ্কর হাতঘড়িটা সাত মিনিট এগিয়ে দিলেন | কিন্তু আড়ষ্টতা রয়েই গেল | ক’দিন পরে অপরাধ বোধে আবার ঘড়ির সময়টা ঠিক করে নিলেন | তাঁদের প্রহসন এই ভাবে চলল – তিনি দূর থেকে শান্তিকে তাঁর আসার পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন (সত্যিই কি তাই ?) | কিন্তু তার কাছে পৌঁছাতেই সে এক অস্থির ভঙ্গিতে তার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে রাস্তার দিকে তাকায় | প্রায়ই ওই সেলফি তোলার ভঙ্গিতে মোবাইলটা মুখের সামনে তুলে ধরে ; কানের পাশে চুল গুঁজে নেয় ; কপালের টিপ ঠিক করে | ক্রমে ক্রমে শঙ্করের মনে একটা কেমন সন্দেহ দানা বাঁধল | তাহলে কি শান্তি তাঁর অভিপ্রায় জেনে ফেলেছে ? তাহলে তো তার মুখটা কোনদিনই দেখা সম্ভব হবে না | ভারী মুশকিলের কথা ! এই ভাবে কতদিন সবিত্রীকে না বলে থাকা যায় ?
আরও একটা ব্যাপার জানার ছিল | ওই শান্তির চুলের ক্লিপটার রংটার নাম কী | খুব উজ্জ্বল সবুজের মধ্যে কালচে ছোপ, সকালের প্রথম রোদে কালো চুলের মাঝে জ্বলজ্বল করে | ক’দিন ধরেই ভাবছেন পাশের বাড়ির পিপিলী কে জিজ্ঞাসা করবেন | ছ’বছরের মেয়েটা একবার তাঁকে বুঝিয়েছিল হালকা রানী-কল্যর আর বেবি-পিঙ্কের মধ্যে তফাত কী | ওই ঠিক বলতে পারবে এই জ্বলজ্বলে সবুজ রংটার নাম |
সপ্তাহ খানেক পরে শঙ্কর নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে ঘড়িটা দু’মিনিট পিছিয়ে দিলেন | সেদিন সাক্ষাত না হওয়ায় বুঝলেন শান্তি হয়ত ওই মোড়ে মিনিট কয়েকের জন্যই দাঁড়ায় | শঙ্কর আবার ঘড়িটার সময়টা ঠিক করে নিলেন | এর পরই একদিন দূর থেকে দেখলেন একটা রেড ক্রস চিহ্নের গাড়ি এসে দাঁড়াল | শান্তি শাড়ি একটু তুলে গাড়িতে উঠে পড়ল, গাড়ি ছেড়ে দিল |
আজ শঙ্কর একটু আগে বেরিয়েছেন | খুব ভোরে উঠে পড়েছিলেন | আসলে, গত সন্ধ্যা থেকে শরীরটায় একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি | ঘুম উবে গেছে | পা দুটো ভারী, আর ঘাড়ের পিছনে একটা জমাট বাঁধা কষা চাপ | গাটা ঘামে ভিজে থাকছে | শুনে সাবিত্রী বলে দিয়েছেন আস্তে আস্তে হাঁটতে, আর বেশি দূরে না যেতে | তাই, ইচ্ছে পার্কের গেট অব্দি গিয়ে ফিরে আসবেন | শরীরের কথাই ভাবতে ভাবতে শুনতে পেলেন আগন্তুক এক মোটরসাইকেলের আওয়াজ | চোখ তুলে দেখে চমকে উঠলেন | তাঁর ফুটপাথের উপর হেডল্যাম্প জ্বেলে সবেগে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসছে একটা ছেলে | ভীষণ রাগ হল | ছেলেটা কাছে এসে একটু গতি কমালেও শঙ্কর ছিটকে এক পাশে সরলেন | ছেলেটাকে কড়া ধমক দেয়ার আগেই সে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে ফের গতি বাড়াল |
মোড়ের কাছে এসে শঙ্কর দেখলেন রেড ক্রস চিহ্নের গাড়িটা দাঁড়িয়ে | শান্তিকে দেখতে পেলেন না | মাথা পিছনে ঘুরিয়ে দেখলেন হরিদাসী লেন দিয়ে শান্তি আসছে, সেই একই মন্থর গতিতে, মাথা নামিয়ে | শঙ্কর একটু ইতস্তত করে এগোলেন পার্কের দিকে | ওদিকে মগজে ওই মোটরসাইকেল চালককে কিছু বলতে না পারার চাপা ক্ষোভ মাথা চাড়া দিচ্ছে | হটাত মাথাটা একটু টলে উঠল | কিছুদূর এগিয়ে আবার পিছন ফিরে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন, যাক, শান্তি গাড়িতে উঠছে, তাঁর দিকে তাকিয়ে |
গাড়ির ড্রাইভার মদন বলল, “বাসন্তী, কী দেখছিস ? ওঠ তাড়াতাড়ি |”
বাসন্তী বলল, “ওই যে দেখছিস না, সামনে | নীল গেঞ্জি |”
মদন – “ও ... এই তোর রোজকার বুড়োটা ?”
মদন গিয়ার দিয়ে ক্লাচ ছাড়তে ছাড়তে বলল, “বাবা, ও যে টলছে রে | সকাল সকাল গিলেছে নাকি ? যদি বলিস তো একটু সাঁটিয়ে দিই |”
বাসন্তী – “কী সাঁটিয়ে দিবি ?”
গাড়িটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল | কয়েক বারের চেষ্টায় স্টার্ট করে গিয়ার দিতে দিতে মদন বলল, “সাঁটিয়ে মানে, গাড়িটা একটু বুড়োটার গা ঘেঁষে চালিয়ে দেব ... জাস্ট একটু ভয় দেখানোর জন্য | তুই খালি জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে তাকাস, যাতে তোকে দেখে বুড়োটা বুঝতে পারে |”
বাসন্তী আঁতকে বলল, “যাহ ! না, না | নিরীহ একটা লোক – একটু তাকানোর দোষ আছে হয়ত |”
শঙ্কর যেতে যেতে আবার ঘুরে তাকালেন – গাড়িটার এতো কেন দেরী হচ্ছে ? এতক্ষণে তো তাঁর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা | ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়িটা দেখতে গিয়েই তাঁর মাথা ঘুরে গেল | ভারসাম্য হারিয়ে ফুটপাথের ধার থেকে রাস্তায় পড়তে পড়তে দেখলেন, এক্কেবারে কাছে এসে যাওয়া গাড়িটা খুব জোরে ব্রেক কষে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল | তারপরই তাঁর দু’চোখে অন্ধকার নেমে এলো |
যখন জ্ঞান ফিরল, প্রথমে বুঝতে পারলেন না তিনি কোথায় | খাটে শুয়ে আছেন | হাতের আঙ্গুলে কিছু ছোট ছোট চিমটি লাগানো, যার থেকে এক গাদা তার গিয়ে একটা স্ট্যান্ডে ঝোলানো স্ক্রিনের নিচে ঢুকেছে | কালচে স্ক্রিনে সবুজ রেখা উঠে পড়ে আঁকিবুঁকি কাটছে | ছাতে পরপর অনেক পাখা ঘুরছে | মাথা কাত করে দেখলেন আসে পাশে অনেক লোক খাটে শুয়ে | তাহলে তিনি হাসপাতালে ! কটা বাজে ? কতক্ষণ তিনি বাড়ির বাইরে ? সাবিত্রী কি খবর পেয়েছে ? কিন্তু ... শঙ্কর আর চিন্তা করতে পারলেন না, একটা অসম্ভব অবসন্নতা শরীরে চেপে আছে | খুব তেষ্টাও পেয়েছে |
বোধহয় তাঁর নাড়াচাড়া দেখে একজন ডাক্তার এগিয়ে এলো | নাড়ি ধরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “কেমন বোধ করছেন এখন ?”
শঙ্কর একটু মাথা নেড়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “বাড়িতে কি খবর দেয়া হয়েছে | আমার স্ত্রী তো পক্ষাঘাতে পঙ্গু, একা আছে | আর কেউ নেই |”
ডাক্তার বলল, “দেখছি ... আগে বলুন এখন কেমন লাগছে |”
শঙ্কর বললেন, “খুব দুর্বল | বেজায় তেষ্টা পেয়েছে | একটু জল পাব ?”
ডাক্তার ডাক দিল, “বাসন্তী, এনাকে এক গেলাস খাওয়ার জল দিন |”
একটা নার্স পাশে এসে বলল, “উঠে বসে খেতে পারবেন. না আমি খাইয়ে দেব ?”
শঙ্কর দেখলেন একটা ময়লা কমনীয় চেহারা – কিন্তু তারই মধ্যে পুরু ঠোঁটে, উঁচু হনুতে আর গালে মাথা উঁচানো কিছু বিদ্রোহী ব্রণে ফুটে উঠেছে একটা তীব্র কামনার আভাস | বিব্রত হয়ে বললেন, “একটু উঠিয়ে বসিয়ে দাও মা | দেখি চেষ্টা করে |”
বাসন্তী বুকের সামনের চুলের গোছা এক ঝটকায় পিছনে ফেলে ঘুরে চলে গেল জল আনতে | শঙ্কর দেখলেন তার পিঠে সাদা গাউনের উপর সোজা করে আঁচড়ানো খোলা চুল টেনে একটা ছোট ক্লিপ দিয়ে গুছি করে ঝোলানো চামর | ক্লিপটা খুব চেনা – কালচে ছোপ ছোপ উজ্জ্বল সবুজ রঙের | শঙ্কর মনে মনে ভাবলেন বাড়ি ফিরে বলবেন, “সাবিত্রী, যে নার্সটা আমাকে দেখছিল তার নাম বাসন্তী | তাকে দেখতে মোটেও ভালো নয় |” সাথে সাথে পরম শান্তিতে তাঁর মন ভরে উঠল |
একটু পরে বাসন্তী এক গেলাস খাওয়ার জল এনে দেখল বুড়োটার মাথাটা নেতিয়ে বালিশ থেকে পড়ে গেছে |
--------------------------------
© ইন্দ্রনীর / ৮ মে ২০১৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন